ভোলু যখন রাজা হল – ৬

একটা জাম গাছের ছায়ায় দু’জনে চুপ করে বসে আছে। অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলেনি। তার কারণ অবশ্য, দানু বসে-বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আর নগেন রায় গভীর ভাবে কিছু ভাবছে।

একটু আগে সামনের রাস্তা দিয়ে একটা গোবরকুড়ুনি মেয়ে যাচ্ছিল। তার বয়স অল্প আর তেজি চেহারা। নগেন রায় তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “হ্যাঁ গো মেয়ে, ওই দোতলা বাড়িটাই কি অবিদ্যাঠাকুরের বাড়ি?”

মেয়েটা খুব সন্ধিহান চোখে আপাদমস্তক নগেন রায়কে মেপে নিল। আজ নগেন রায়ের পরনে ঝাঁ চকচকে পোশাক নেই। পরনে একটা রংচটা পাতলুন আর গায়ে একটা আধময়লা মোটা কাপড়ের জামা। মেয়েটা বলল, “অবিদ্যাঠাকুরের বাড়ি খুঁজছ কেন? তোমরা কি তার দলের লোক?”

নগেন যায় মাথা নেড়ে বলল, “আমরা তার দলের লোক নই, একটা খবর দিতে আসা।”

মেয়েটা থমথমে মুখ করে বলল, “অবিদ্যাঠাকুর কোন চুলোর লোক তা জানি না বাপু, তবে ও বাড়ি মোটেই তার নয়। এটা কাশীশ্বরী ঠাকরুণের বাড়ি। অবিদ্যাঠাকুর এমন পাজি লোক যে, একশো বছর বয়সি বুড়িটাকে গোয়ালঘরে চালান দিয়ে অত বড় বাড়িটা দখল করে আছে। সঙ্গে তার দলবল।”

কাশীশ্বরী নামটা সেই থেকে মাথার মধ্যে ভনভন করে ঘুরছে নগেন রায়ের। নামটা যেন একটা দূরের প্রতিধ্বনির মতো। তার ভুলে যাওয়া স্মৃতির মধ্যে কোথাও কি কাশীশ্বরী বলে কেউ ছিল? কে জানে। আজ সকালেই ঘুম থেকে উঠতেই যেমন একটা শব্দ মনে পড়েছিল তার। সিংহাসন। সিংহাসন কথাটা কেন মনে পড়ল কে জানে! সিংহাসনের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?

দানু শুনে বলল, আপনার যত উদ্ভুটে কথা মনে পড়ে। আমরা হলুম এলেবেলে লোক। আর সিংহাসন হল গে রাজারাজড়াদের ব্যাপার।”

দানু একটা হাই তুলল। তারপর আড়মোড়া ভেঙে বলল, “আর কতক্ষণ বসে থাকবেন? বলি কী, চলুন গিয়ে গোকুলকে পাকড়াও করি।”

“অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা বলে একটা কথা আছে, জানিস?”

“খুব জানি। কিন্তু আগুপিছু করে লাভটা কী হচ্ছে? কাজ তো মোটেই এগোচ্ছে না! একটু কষে ভাবুন তো!  চেপে ভাবলে দেখবেন ঠিকই পুরনো কথা মনে পড়ে যাবে।”

“বেশি ভাবলে আমার মাথায় যন্ত্রণা হয়। চোখ অন্ধকার হয়ে আসে।”

“আমি শুনেছি মাথায় চোট পেয়ে স্মৃতিভ্রংশ হলে ফের মাথায় চোট লাগলে স্মৃতি ফিরে আসে।”

“সেটা আমিও শুনেছি। কিন্তু ডাক্তার বলেছে আমার মাথার যা অবস্থা তাতে ফের চোট লাগলে বাঁচার আশা নেই।”

“কী যে মুশকিলে ফেললেন?”

“আমার কী মনে হয় জানিস? একটা কোনও গুরুতর কথা আমার স্মৃতিটাকে ছিপি দিয়ে আটকে রেখেছে। সেটা যদি মনে পড়ে তবে বাদবাকি সব কথা হুড়হুড় করে মনে পড়ে যাবে।”

“তা হলে আলু, মুলো, পটল, নিম গাছ, গয়া, কাশী এক-এক করে বলতে থাকেন।”

“দূর পাগল! ওতে আরও সব গুলিয়ে যাবে।”

এমন সময় রাস্তার দিক থেকে একটা হেড়ে গলা শোনা গেল, “ওরে ও গোকলো, পা চালিয়ে আয়।”

জবাবে কে যেন বলল, “যা না বাবা, আসছি। বিড়ি ধরাচ্ছি দেখছিস না।”

দানু আর নগেন রায় দেখল, একটা বেঁটে আর-একটা বড়সড় চেহারার জোয়ান লোক পাশাপাশি ধীরেসুস্থে হাঁটছে। বেঁটে লোকটা একটা বিড়ি ধরাচ্ছিল।

দানু চাপা স্বরে বলল, “কোনটা গোকুল বলুন তো?”

“মনে হচ্ছে বেঁটেটা হাতে ‘কালী সহায়’ লেখাটা থাকার কথা।”

দানু “দাড়ান দেখছি, ” বলে উঠে দাঁড়াল।

নগেন রায় বিরক্ত হয়ে বলল, “একা পারবি না। দু’জন আছে।”

“আগে আপনি একটাকে নিন, আমি অন্যটাকে। আপনি কাকে নেবেন?”

“বড়টাকে, তুই এগো।”

দানু চটপটে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দুজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পথ আটকে বলল, “ভাই ম্যাচিসটা একটু দেবে? বিড়ি ধরাব।”

গোকুল বিরক্ত হল বটে, কিন্তু জামার পকেট থেকে দেশলাইটা বের করেও দিল। হাতে পরিষ্কার ‘কালী সহায়’ লেখা উল্কি। দানু দেশলাইটা নিয়ে পট করে চারদিকটা দেখে হঠাৎ ঘ্যাক করে তার বাঘা হাতে গোকুলের ঘাড়টা চেপে ধরল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বড় চেহারার লোকটি কিছু বুঝবার আগেই নগেন রায় পিছন থেকে তার ঘাড়ে হাতের কানা দিয়ে একটা কোপ বসাল। লোকটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিল। নগেন রায় তাকে হিড়হিড় করে টেনে গাছপালার আড়ালে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যেতে লাগল। দানুর হাতে নেংটি ইঁদুরের মতো ছটফট করছিল গোকুল।

জঙ্গলের অনেকটা ভিতরে ছেঁচড়ে টেনে এনে নগেন জোয়ান লোকটাকে মাটিতে ফেলে দিল। দানু গোকুলকে দাঁড় করিয়ে বলল, “তুই কে।“

গোকুল ফুঁসে উঠে বলল, “তা দিয়ে তোমার কী দরকার? তোমরা কারা?”

তার গালে একটা ঠোকনা দিয়ে দানু বলে, “আমরা জবাব দিই না। জবাব নেই। বল।”

গোকুল গালে হাত বোলাতে-বোলাতে বলল, “মারধর করছেন কেন হে। এর ফল কিন্তু ভাল হবে না।”

“আমরা তো খারাপই চাইছি। বল।”

“আমি গোকুল, গোকুল মিস্তিরি।”

“কী কাজ করিস?”

“নানা রকম কাজ করতে হয়।”

নগেন লক্ষ করল, গোকুল তার দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না। চোখে চোখ পড়তেই সরিয়ে নিচ্ছে।

এবার নগেন জিজ্ঞেস করল, “আমাকে চিনতে পারছিস?”

“না।“

দানু পটাং করে একটা থাবড়া বসাল তার গালে।

“ভাল করে চেয়ে দেখ।”

গোকুল চোখ তুলল না। শুধু বলল, “না, চিনি না।”

“চিনিস। কারণ তোর হাতে উল্কিটা আছে। সত্যি কথা না বললে এইখানে মেরে মাটিতে পুঁতে দিয়ে যাব। আমরা ভাল লোক নই।”

“কী করে চিনব? কখনও দেখিনি।”

পরের রদ্দাটা এত জোরে কষাল দানু যে, গোকুল ঘোক করে একটা শব্দ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

নগেন রায় বিরক্ত হয়ে বলে, “তোর দোষ কী জানিস দানু? মাত্ৰাজ্ঞান নেই। মারধর করার সময়ে মেপে মারতে হয়। এখন যদি তোর রদ্দার চোটে এর স্মৃতিভ্রংশ হয় তখন কী হবে?”

“ভাববেন না কর্তা, এর হল পাকা হাড়। ফুলের গায়ে মূর্ছা যাওয়ার মানুষ নয়।”

ঝোলা থেকে জলের বোতল বের করে দানু গোকুলের মুখে ঝাপটা দিল।

গোকুল জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে বসল। তার পর ফুঁপিয়ে উঠে বলল, “আমি কী করেছি? ওই দলে তো আমি ছিলুম না৷”

“কোন দলে?”

গোকুল মাথা নেড়ে বলে, “জানি না।”

“এবার কী করব জানিস। হেঁটমুন্ডু করে গাছে ঝুলিয়ে দেব। মাথায় রক্ত উঠে আস্তে-আস্তে কষ্ট পেয়ে মরবি।”

“ওই দলে আমি ছিলাম না, বলছি তো।”

নগেন রায় বলল, “তবে কে ছিল?”

“রঘু, রাজু, ন্যাড়া, বটেশ্বর, কাতু এরা সব।”

দানু বলল, “এই বাবুকে চিনতে পারছিস?”

গোকুল মাথা নত করে মাটির দিকে চেয়ে রইল।

“বলবি? না আরও ওষুধ দিতে হবে?”

“চিনতে পেরেছি, চেহারাটা পালটে গিয়েছে।”

“কে বল তো?”

“ভবেশ চৌধুরী।”

দানু একবার চোরা চোখে নগেনের দিকে চাইল। নগেন রায় ভ্রু কুঁচকে চেয়ে ছিল গোকুলের দিকে।

দানু জিজ্ঞেস করল, “মেরেছিলি কেন?”

গোকুল চোখ মুছতে-মুছতে বলল, “আমি কোথায় মারলাম? মেরেছে তো ওরা!”

“কিন্তু কয়েন?”

“ওর ছেলের জন্য। উনি কিছুতেই ছেলে কোথায় আছে, তা বলতে রাজি হননি।”

“ছেলে! ভবেশ চৌধুরীর ছেলে?”

“হ্যাঁ, রূপেশ চৌধুরী।”

নগেন রায় হঠাৎ দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে একটা অস্ফুট শব্দ করে বসে পড়ল। চোখ বোজা। বিড়বিড় করে শুধু বলতে লাগল, “সিংহাসন। সিংহাসন।“

দানু তীক্ষ চোখে একবার নগেন রায়কে ভাল করে দেখে নিল।

তারপর গোকুলকে জিজ্ঞেস করল, “রূপেশ চৌধুরী এখন কোথায়?”

“আমি জানি না।”

“তোর বাঁচার ইচ্ছে নেই? যদি থাকে, তা হলে বলে ফ্যাল। না বসলে তোর উপায় নেই।”

“অবিদ্যাঠাকুরের হেফাজতে।”

“অবিদ্যাঠাকুরের কাছে কেন?”

“সেটা উনিই জানেন।”

“তুই যে ভবেশ চৌধুরীকে খুন করতে চেয়েছিল, তা আমি জানি। এমনিতেই তোর ফাঁসি হওয়া উচিত। ফাঁসিটা যদি এখনই হয়ে যায়, তা হলে কেমন হয়?”

“আমি কোথায় খুন করতে চাইলাম?”

“রূপেশ চৌধুরীর সঙ্গে অবিদ্যাঠাকুরের কী দরকার?”

“ভাল জানি না। উড়ো কথা শুনেছি, রূপেশ চৌধুরী রাজবাড়ির গুপ্তধনের খোঁজ জানে।”

“তার মানে তাকে অবিদ্যাঠাকুর আটকে রেখেছে?”

“ঠিক আটকে রাখেনি, রূপেশ চৌধুরী ওই রাজবাড়িতেই আছে।”

“ওটা কার বাড়ি?”

“কাশীশ্বরী ঠাকরুণের।”

দানু উঠে দাঁড়ায়। নগেন রায়ের হাত ধরে টেনে দাঁড় করাতে-করাতে বলল, “উঠুন কর্তা, এখন অত ভাববার সময় নেই। হাতে অনেক কাজ। সব কি মনে পড়েছে?”

নগেন রায় বিবশ চোখে খানিকক্ষণ দানুর দিকে চেয়ে থেকে বলল, “বোধ হয়। একটু উলটোপালটা হচ্ছে, কিন্তু মনে পড়ছে।”

“আপনি ভবেশ চৌধুরী, নগেন রায় নন কিন্তু।”

“হু।”

“আর আপনার একটা ছেলে আছে, রূপেশ চৌধুরী।”

“হু।“

মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার দিকে চেয়ে দানু বলল, “আপনি একে যে কানকিটা মেরেছেন তাতে তো এ আজ রাত অবধি ঘুমোবে মনে হচ্ছে। আর এটার কী ব্যবস্থা করবেন বলুন।”

নগেন রায় ওরফে ভবেশ চৌধুরী বলল, “ওকে আমাদের দরকার হবে। ভিতরের খবর ওর কাছ থেকেই আদায় কর।”

দানু গোকুলকে ঘাড়ে ধরে দাঁড় করাল। বলল, “লক্ষ রাখ, রাস্তা দিয়ে যারা যাতায়াত করছে তাদের মধ্যে তোদের লোক কে চিনিয়ে দে।”

গোকুল ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, “তা হলে আমার বিপদ হবে।”

“তার চেয়ে বেশি বিপদের মধ্যে তুই এখন আছিস।”

ব্যায়ামবীরের মতো চেহারার দু’জন লোক কথা কইতে-কইতে বাড়িটার দিকে যাচ্ছিল। গোকুল বলল, “ওরা রঘু আর নবু।”

চোখের পলকে ভবেশ আর দানু গিয়ে ওদের পথ আটকে দাঁড়াল। লোক দুটো বুঝতেই পারল না কী হল। ভবেশের দুটো হাত হাতুড়ি মতো রঘুর দুই চোয়ালে লাগাল। দানু, নবুর মাথায় মুগুরের মতো কিল বসাল।

দু’জনকে টেনে এনে যখন প্রথমজনের পাশে মাটিতে শোয়ানো হল, তখন গোকুল চোখ বিস্ফোরিত করে নিথর লোকতিনটেকে দেখে দানুর দিকে চেয়ে বলল, “আপনারা কারা?”

দানু খুব দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “আমরা মোটেই ভাল লোক নই রে বাপু। ওজন দেখলে বোধ হয় আমরা তোমাদের চেয়েও খারাপ লোক।”

গোকুল আতঙ্কিত চোখে চেয়ে রইল। আর রা কাড়ল না।

ভবেশ তার দিকে চেয়ে বল, “এরকম আর ক’জন ডাকাত তোমাদের সঙ্গে আছে বলো তো?”

গোকুল একটি হিসেব করে বলল, “আজ্ঞে, বারো-তেরোজন।”

শুনে দানু একটু মাখা চুলকে বলল, “কর্তা, তা হলে যে আরও বিস্তর ঘাম ঝরাতে হবে।”

ভবেশ চৌধুরী বলল, “দূর বোকা! একটা দলে রুস্তম থাকে মেরে কেটে চার-পাঁচজন। বাকিরা ভেড়ুয়া। চাকরবাকরের বেশি কিছু নয়। তারা ঝামেলা দেখলেই পালায়। ওরে ও গোকুল, তোদের রুস্তম ক’জন আছে, ঠিক করে বল তো?”

গোকুলের চোখে অকৃত্রিম একটা শ্রদ্ধার ভাব ফুটে উঠল। সে হাত জোড় করে বলল, “ঠিকই বলেছেন রাজাবাবু। অবিদ্যাঠাকুরের দলে বেশির ভাগই ভাড়াটে লোক। রুস্তম হিসেব করলে পাঁচজন। তার মধ্যে তিনজন তো ওই চোখ উলটে পড়ে আছে। বাকি শুধু প্রীতম আর ঝড়ুয়া।”

“তারা কোথায়?”

“বোধ হয় খেয়েদেয়ে ঘুমোচ্ছ। আজ রাতে একটা ডাকাতি করতে সবাই হরিহরপুর যাবে কিনা।”

“ওদের মোবাইল ফোন নেই?”

“প্রীতমের আছে, ঝড়ুয়ার নেই।”

“তা হলে প্রীতমের মোবাইলে ফোন করে বল, দেশ থেকে লোক এসেছে, বটতলায় দাঁড়িয়ে আছে।”

“যদি জিজ্ঞেস করে লোকটা কে?”

“বলবি একজন বুড়োমানুষ।”

জামার বুকপকেট থেকে একটা সস্তার মোবাইল বের করে ফোন করল গোকুল। চাপা স্বরে কী যেন বলল। তারপর ভবেশের দিকে চেয়ে বলল, “আসছে। ভেবেছে ওর বাবা এসেছে।”

ভবেশ দানুর দিকে চেয়ে বলল, “মানুষকে অকেজো করে রাখতে হলে শরীরের একটা না-একটা হাড় ভেঙে দিতে হয়, জানিস তো।”

“ও তো বাচ্চারাও জানে, তা এর কোন হাড় ভাঙতে হবে?”

“কলারবোন।”

“আর ঝড়ুয়ার?”

“চোয়াল আর মালাই চাকি।”

“ঠিক আছে।”

একটু বাদেই প্রীতম হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে।

বেশ লম্বা হাড়ে-মাসে চেহারা, লাল চোখ, ঝাঁকড়া চুল।

দানু তাকে যখন ক্যাঁক করে ধরল তখন এত অবাক যে, হাঁ আর বন্ধ হতে চায় না। একটু বাদেই সেই হাঁ থেকে একটা আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল। চুপচাপ ঘাসে নেতিয়ে পড়ে রইল তারপর।

গোকুল খুব করুণ দৃষ্টিতে প্রীতমের দিকে একটু চেয়ে রইল, তারপর বলল, “এবার?”

“আমাদের সঙ্গে এসো, ঝডুয়াকে ডেকে বলো, ঘরে সাপ ঢুকেছে।”

গোকুল বাড়ির সামনে এসে চেঁচিয়ে ডাকল, “ঝড়ুয়া, এই ঝড়ুয়া!”

নীচের তলার সামনের ঘরের জানলায় ঝডুয়ার বিরক্ত মুখটা দেখা গেল, “কেন ডাকছিস?”

“তোর ঘরে সাপ ঢুকেছে। এইমাত্র দেখলুম?”

“অ্যাঁ!” বলে আতঙ্কিত ঝড়ুয়া দরজা খুলে বেরোতেই দু’খানা সাঁড়াশির মতো হাতে ধরা পড়ে গেল। দানুর অভ্যস্ত হাতের একটা কোপ আর একটা হিসেব করে মারা লাথি খেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল সে।

প্যান্টের পকেট থেকে একটা ভারী পিস্তল টেনে বের করল ভবেশ চৌধুরী। দানুর পিস্তলটা বেরল কোমর থেকে। গোকুলকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল তারা। গোকুলকে বলল, “অবিদ্যাঠাকুরকে বেরিয়ে আসতে বল। বলবি, জরুরি কথা আছে।”

সিঁড়ির পাশের ঘরখানার বন্ধ দরজায় কড়া নেড়ে গোকুল বলল, “ঠাকুরমশাই, বেরিয়ে আসুন, জরুরি কথা আছে।”

অবিদ্যাঠাকুর দরজা খুলে মুখ বাড়াতেই তাকে হ্যাঁচকা টানে বের করে আনল দানু।

এ কী! এ কী। তোমরা কারা?”

ভবেশ চৌধুরী পিস্তলটা তুলে বলল, “তোমার লোকজনকে ডাকো।”

“কেন কী হয়েছে?”

“আগে ডাকো।”

হইচই শুনে কয়েকজন বেরিয়ে এল। একটু চোখা-চোখা ভাব। কিন্তু পিস্তল দেখে তাদের মুখ শুকিয়ে গেল।

ভবেশ চৌধুরী বলল, “ঠিক তিনমিনিট সময় দিচ্ছি। তার মধ্যেই তোমরা হাওয়া হয়ে যাও। নইলে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে।”

দানু পিস্তলটা তুলে সামনের দেয়ালে একটা গুলি চালিয়ে দিল। দেওয়াল থেকে একটা চাঙড় খসে পড়তেই লোকগুলোর মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। তিমিনিটের আগেই দশ-বারোটা লোক হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে সত্যিই হাওয়া হয়ে গেল।

অবিদ্যাঠাকুর কাঁপতে-কাঁপতে মেঝেতে বসে পড়েছিল।

দানু অবিদ্যাঠাকুরের দিকে চেয়ে দেখে ভ্রু কুঁচকে ভবেশকে জিজ্ঞেস করে, “কর্তা, এ লোকটা কি সর্দার?”

অবিদ্যাঠাকুর কাঁপতে-কাঁপতে হাতজোড় করে বলে, “আমাকে প্রাণে মেরো না বাবা।”

ভবেশ বলে, “আমাকে মনে পড়ে অবিদ্যাঠাকুর? তুমি যে আমাকে প্রাণে মারতে চেয়ে তোমার খুনে গুন্ডাদের পাঠিয়েছিলে!”

ভারী বিস্ময়ে আর ভয়ে কিছুক্ষণ হাঁ করে ভাবেশের মুখের দিকে চেয়ে থেকে অবিদ্যাঠাকুর ডুকরে ওঠে, “ভবেশবাবা! না বাবা, সে আমি নয়। তোমাদের নুন খেয়েছি, বেইমানি করতে পারি?”

“বামুন পচলে কি হয় জানেন? অস্পৃশ্য! কুলাঙ্গার। জাতিভ্রষ্ট! কোনও প্রায়শ্চিত্তই তোমার জন্য যথেষ্ট নয়।”

গায়ের উড়ুনিটার খুঁট তুলে চোখ-মুখ ঢেকে অবিদ্যাঠাকুর হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

দীর্ঘকায় লকলকে চেহারার একটা ছেলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিল। কয়েকটা সিঁড়ি উপরে থমকে গড়িয়ে সে নীচের দৃশ্যটা অবাক হয়ে দেখে।

দানু হাঁ করে তার দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর মুখ ফিরিয়ে ভবেশকে বলল, “এ যে একেবারে আপনার যমজ কর্তা! শুধু রংখানাই যা আপনার মতো ফটফটে নয়, একটু চাপা। এ কে, তা কি আর জিজ্ঞেস করার দরকার আছে কর্ত?”

ভবেশও একদৃষ্টে ছেলেটাকে দেখছিল। গম্ভীরমুখে বলল, “আছে। আমার অনেক কিছু হারিয়ে গিয়েছে। ফিরে পাব বলে ভরসা হয় না।”

ছেলেটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, “আমি ভোলু।”

মাথায় তীব্র একটা যন্ত্রণার ঢেউ উঠল ভবেশের। সে চোখ বুজে দেওয়াল ধরে টাল সামলাল। তারপর স্খলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কার ছেলে?”

“আমি ভবেশ চৌধুরীর ছেলে রূপেশ চৌধুরী। আমি বোধ হয় আপনাকে চিনতে পারছি। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনি কি বাবা? বেঁচে আছেন?”

ভবেশ মাথা নেড়ে বলে, “না বাবা আমি সবটুকু বেঁচে নেই। আমার অনেকখানি মরে গিয়েছে। মাত্র একটুখানি বেঁচে আছি। আমি তোমাকে ভুলে গিয়েছিলাম। আমাকেও ভুলে গিয়েছিলাম।”

“আপনি যখন আমাকে কাঁধে নিয়ে ওই গ্রাম থেকে পালিয়েছিলেন, আমার মনে পড়ে আপনি সারারাত হেঁটেছিলেন। আমি আপনার কাঁধের উপরেই ঘুমিয়ে পড়ি। আপনার কত কষ্ট হয়েছিল আমাকে কাঁধে নিয়ে অত দুর হাঁটতে। শুনেছি শুধু আমাকে বাঁচানোর জন্য আপনি তাদের হাতে মার খেয়ে প্রায় মরেই গিয়েছিলেন।”

“আমার কোনও কষ্ট হয়নি বাবা।”

“এরা আমাকে গুপ্তধনের জন্য ধরে এনেছে। আমি ভাবছি, আমাদের কি আর গুপ্তধন খোঁজার দরকার আছে?”

“আছে বাবা ভোলু। যতদিন গুপ্তধন তুমি খুঁজে বের না করবে, ততদিন লোভী লোকদের শ্যেনদৃষ্টি থাকবে তোমার উপর। তোমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। বারবার বিপদে পড়বে। তার চেয়ে গুপ্তধন মুক্ত হওয়াই ভাল।”

মধ্যরাতে গুটিকয়েক লোক অন্ধকার রাজবাড়ির দরবার ঘরে জমা হয়েছে। ভোলু, ভবেশ, দানু, বাবুরাম, ব্ৰহ্মগোপাল আর গদাই খটিক। তিন-চারটে টর্চের আলো চারদিকে ঘোরাফেরা করছে।

ব্ৰহ্মগোপাল বললেন, “কিছু বুঝতে পারছ বাবা?”

ভোলু মৃদুস্বরে বলল, “হ্যাঁ, গত পরশু আমি এই সিংহাসনে অনেকক্ষণ একা চুপচাপ বসেছিলাম। আমার মনে হয়, কোনও সংকেত যদি থেকে থাকে, তবে তা ওই লোহার সিংহাসনেই লুকিয়ে আছে। ত্রিশূলটা কি আমাকে একবার দেবেন জ্যাঠা?”

“নিশ্চয়ই! এ তো তোমারই জিনিস।”

সিংহাসনের পৃষ্ঠদেশের মাথায় যে ছিদ্রটা আছে, ত্রিশূলের গোড়াটা আস্তে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল ভোলু। প্রথমটায় কিছুই হল না। কিন্তু একটু চাপ দিতেই ঝনাৎ করে পিঠের চাকতিটা খসে পড়ে গেল। টর্চের আলোয় দেখা গেল সেখানে একটা চাবির খাঁজ।

ভোলু হাত ছাড়িয়ে বলল, “এবার চাবিটা জ্যাঠা।”

“এই যে,” বলে ব্ৰহ্মগোপাল চাবিটা এগিয়ে দিলেন।

ভোলু চাবিটা খাঁজে ঢোকাতেই সেটা দিব্যি ঢুকে গেল। চাবি ঘোরানোর সঙ্গে-সঙ্গেই আচমকা সিংহাসনটা খট করে খানিকটা মেঝের মধ্যে ঢুকে গেল। অন্তত ইঞ্চিচারেক।

কিন্তু তারপর আর কোনও ঘটনা নেই। সবাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সিংহাসনটার দিকে চেয়েছিল। কিন্তু কিছুই ঘটল না দেখে হঠাৎ বাবুরাম বলে উঠল, “আমি জানি।”

ব্ৰহ্মগোপাল বাবুরামের উপর খুব একটা সন্তুষ্ট নন। ভূত নিয়ে তাঁদের বিতর্ক এখনও মেটেনি। তিনি খ্যাঁক করে বলে উঠলেন, “কী জানেন মশাই?”

বাবুরাম, বলল, “আমার সঙ্গে আসুন। গুপ্তধন এখানে নেই।”

ব্রহ্মগোপাল খিঁচিয়ে উঠলেন, “তবে কোথায় আছে?”

“তেজেনবাবুর বাড়িতে। আসুন, দেখিয়ে দিচ্ছি।”

বাগানের উত্তর-পশ্চিমের আগাছার জলে ঘাসে ঢাকা একটা জায়গায় সবাইকে নিয়ে এল বাবুরাম। বলল, “এখানে মাটিচাপা একটা বড় পাথর আছে। উপর থেকে বোঝবার উপায় নেই। টর্চটা ফেলুন তো?”

প্রথমটায় কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। তারপর হঠাৎ গদাই খটিক বলে উঠল, “এখানে একটা বড় চাপড়া উঠে এসেছে। একটা শাবল হলে হত।”

বাস্তবিকই দেখা গেল, মাটি ভেদ করে সদ্য একটা সাদা পাথরের চাঙর উঁচু হয়ে আছে। দু’-তিনটে শাবল আর বাঁশ এনে চাঙরের নীচে ঢুকিয়ে চাড় দিতেই পাথরটা সরে গিয়ে একটা চৌবাচ্চা মতো জায়গা দেখা গেল।

টর্চের আলোয় দেখা গেল, অন্তত ছয়-সাত ফুট গভীর চৌবাচ্চার মধ্যে চারটে বড়-বড় কাঠের বাক্স।

বাবুরাম আহ্লাদের গলায় বলল, “বলেছিলাম কিনা ব্ৰহ্মবাবু?”

ব্ৰহ্মগোপাল বললেন, “হু। কিন্তু ত্রিশূল আর চাবি কে দিল শুনি।”

বিস্তর কসরত করে বাক্সগুলো একে-একে তুলে নিয়ে দরবার ঘরে নিয়ে আসা হল। পুরনো বাক্স, তায় মাটির নীচে থাকায় কাঠ পচে গিয়েছে। শাবলের চাড়ে সহজেই খুলে গেল। টর্চের আলো ফেলে ভিতরে যা দেখা গেল, তাতে কেউ তেমন অবাক হল না। এরকমটাই তো হওয়ার কথা। চারটে বাক্সই পুরনো আমলের সোনার গয়না, সোনার টাকা, সোনার বাসনপত্রে ঠাসা।

ভোলু তার বাবার দিকে চেয়ে বলল, “এসব কি সরকারের ঘরে জমা করতে হবে বাবা?

ভবেশ মাথা নেড়ে বলল, “না। সরকারের ঘরে একবার ঢুকলে আর বেরবে না। নানা নিয়মকানুন আর আইনের ফাঁকে আটকে থাকবে। কারও কাছে আসবে না।”

“তা হলে?”

ভবেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “টাকাপয়সার নানা ব্যবহার আছে। ভোগেও লাগানো যায়। আবার কাজেও লাগানো যায়। ভোগ দু’-একজনের আনন্দ, কাজে লাগলে গাঁসুদ্ধ লোকের আনন্দ। এখন তুমিই ঠিক করা এই গুপ্তধন কিসে লাগাবে।”

ভোলু একটু থামল, তারপর বলল, “তা হলে কাজেই লাগানো যাক।”

(সমাপ্ত)