ভোলু যখন রাজা হল – ৫

ভোরবেলায় কে যেন মিষ্টি আদরের গলায় ডাকছিল, “রাজকুমারী ওঠো! রাজকুমারী, ওঠো!” কাশীশ্বরী ডাকটা শুনে ঘুমচোখে হাসলেন। চোখ চেয়েই দেখতে পাবেন দাসীরা সব মুখ ধোওয়ার জলের ঝারি, ঝলমলে পোশাক পরে রূপটানের থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ মুখ ধোয়াবে, কেউ চুল আঁচড়ে দেবে, কেউ পোশাক পরিয়ে দেবে।

কাশীশ্বরী হাই তুলে ধোঁয়াটে লন্ঠনের আলোয় চেয়ে দেখলেন, হা হতোস্মি। কোথায় সেই মখমলের বিছানা, কোথায় দাসী আর কোথায় কে? নড়বড়ে চৌকিতে কাঁথাকানি বিছানায় শুয়ে আছেন। ময়লা মশারি, চারদিকে হতশ্রী ঘরদোর। কাশীশ্বরীর বয়স হয়েছে। হিসেব করলে একশো পেরিয়ে দু’বছর। আজকাল বড় ভুলভাল হয়ে যায়। তবু আবছা মনে পড়ে, তিনি এক রাজার মেয়ে, রাজার বোন, রাজার পিসি। আবার ভাবেন, তাই বা কী করে হয়? রাজার মেয়ে হলে, রাজার বোন হবেন কী করে? আর তা হলে রাজার পিসিই বা কেমন করে হওয়া যায়? কাজের মেয়ে মাস্তি বুঝিয়ে দেয়, “তা হবে না কেন দিদিমা? তুমি হলে এক রাজার মেয়ে আর-এক রাজার বোন। আবার আর-এক রাজার পিসি।”

আবার একটা হাই তুলে কাশীশ্বরী পাশ ফিরে শুতে গিয়ে লণ্ঠনের আবছা আলোয় দেখতে পেলেন, ঘরের মেঝেয় কে যেন হামাগুড়ি দিচ্ছে। না, বাচ্চা ছেলে তো নয়। রীতিমতো বড় একটা মানুষ। বুড়োমানুষ হামাগুড়ি দেয় এ তিনি জন্মে দেখেননি। কাশীশ্বরী বালিশ থেকে মাথাটা তুলে বললেন, “কে রে লক্ষ্মীছাড়া, ঘরের মধ্যে হামাগুড়ি দিচ্ছিস। তোর মতলবটা কী?”

লোকটা মুখ তুলে এক গাল হেসে বলল, “এই আমি দিদিমা।”

“আমি। তা আমির নাম কী বাছা? চারদিকের সবাই তো একজন-একজন আমি। তা তুই কোন আমি রে মুখপোড়া?”

“আজ্ঞে, আমি হলুম গে গদাই খটিক।”

“চোর নাকি রে তুই অ্যাঁ। চোর? কী খুঁজছিলি বল তো! নিশ্চয়ই আমার মন্ত্রমুখো বালাজোড়া?”

“আজ্ঞে না দিদিমা। আপনার যেবার জ্বরবিকার হয় সেবার ওই বালাজোড়া বেচে আপনার চিকিৎসা হয়েছিল। মনে নেই?”

“ও বাবা! তুই যে অনেক খবর রাখিস। তা না হয় মানলুম, তুই বালার লোভে ছোক-ছোক করছিস না, তবে কি আমার মটরদানা হারছড়া হাতাতে এসেছিস রে অলগেয়ে?”

“কী যে বলেন। মটরদানা হার বাঁধা দিয়ে যে সেবার আপনার দাত বাঁধানো হল।”

“তুই তো সব্বোনেশে লোক দেখছি। এত খতেন তোকে কে দিল বল তো। হার নয়, বালা নয়, তবে হামা দিয়ে খুঁজছিস কী?”

“আজ্ঞে, বঙ্গলে আপনি হয়তো দুঃখ পাবেন। আসলে আমি আপনার ঘরটাই খুঁজছি।”

“ঘর খুঁজছিস, ও আবার কী অলক্ষুণে কথা। ঘরের মধ্যে কেউ ঘর খোঁজে?”

“তা এই ঘরখানাই কি আপনার?”

আমার নয়তো কার?”

“সে কথা সত্যি! এ ঘরখানাও আপনার। তবে হ্যারিকেনটা একটু উস্কে দিচ্ছি, ভাল করে দেখুন তো এটা আপনার শোওয়ার ঘর কিনা?”

“শোওয়ার ঘর নয়? ই কি বলতে চাস, এটা আমার গোয়াল ঘর?”

“পায়ের ধুলো দিন দিদিমা, ঘুমচোখেও এটা যে গোয়ালঘর বলে চিনতে পেরেছেন সেটাও কম কথা নয়।”

“কী আবোল-তাবোল বকছিস রে হতভাগা? এটা আমার গোয়ালঘর হতে যাবে কোন দুঃখে?”

“শোওয়ার ঘর যদি গোয়ালঘর হয়ে যায় তা হলে তো সেটা দুঃখেরই দাঁড়ায় দিদিমা। এই হ্যারিকেনটা উস্কে দিলাম। এবার ভাল করে চেয়ে দেখুন তো, ঘরখানা চিনতে পারেন কিনা। উপরের দিকে চেয়ে ঠাহর করে দেখলে টিনের চালের ফাঁক দিয়ে আকাশের তারা আর একটু জ্যোছনাও দেখতে পাবেন।”

কাশীশ্বরী চারদিকটা ভাল করে চেয়ে দেখতে-দেখতে বললেন, “টিনের চাল। আমার পাকা বাড়ির দোতলার ঘরে টিনের চাল কোথা থেকে আসবে রে হনুমান? মস্করা করছিস নাকি?”

“আজ্ঞে মস্করা যদি কেউ করে থাকে, তবে সে আমি নয়।”

কাশীশ্বরী হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠলেন, “ওরে একী? আমার শোওয়ার ঘরখানা কোথায় গেল? এ তো দেখছি সত্যিই গোয়ালঘর। ভাঙা বেড়া, টিনের চালে বড়-বড় ফাঁক! পুরনো গোবরের গন্ধও পাচ্ছি যেন! ওরে ঘরখানা কি চুরি হয়ে গেল?”

“আজ্ঞে চুরি হলেও, আমি চুরি করিনি দিদিমা।”

“তবে কে করল?”

“তা কে জানে, তবে কানাঘুষো শুনছিলুম, আপনার পাকা বাড়িতে নাকি রাজামশাই থাকবেন। সেইজন্যই আপনাকে ধরাধরি কয়ে এই গোয়ালঘরে চালান দেওয়া হয়েছে।”

“রাজামশাই থাকবেন। রাজামশাইটা আবার কে? আর সেই মুখপোড়া রাজা আমার ঘরেই বা থাকবে কেন? আর আমার এই এত বড় পাকা বাড়ি থাকতে আমি গোয়ালঘরেই বা থাকব কেন? হ্যাঁ রে জাম্বুবান, এসব কী হচ্ছে বল তো? আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”

গদাই খটিক মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “না দিদিমা, এটা স্বপ্ন নয়। চন্দ্রঘোষপুরের একজন রাজামশাইয়ের নাকি খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। তিনি এলেন বলে। তা তিনি এসে এ গাঁয়ে থাকবেনই বা কোথায়! তাই এই বন্দোবস্ত।”

“চন্দ্রঘোষপুরের রাজা। ওরে আমি তো ওই রাজবাড়িরই মেয়ে, আমার বাবা রাজা, ভাই রাজা, ভাইপো রাজা, আমি কি ফ্যালনা মানুষ? এই বাড়ি যে বাবা আমার নামে লিখে দিয়ে গিয়েছেন। আর রাজা আসবে কোথেকে? আমিই তো রাজবাড়ির একমাত্র ওয়ারিশ!”

“আজ্ঞে এতকাল তাই ছিলেন বটে দিদিমা, কিন্তু এখন ফ্যাঁকড়া বেরিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, ভবেশের ছেলে রূপেশ এসে শিগগিরই সিংহাসনে গ্যাঁট হয়ে বসবে।”

“ভবেশের ছেলে বললি? সে কি আর বেঁচে আছে?”

“তাই তো শুনছি।”

“ওরে, ভবেশ যে সম্পর্কে আমার নাতি। তার ছেলে হল গে আমার পুতি। সম্পর্ক দাঁড়ায় পিসি আর ভাইপো, তার পিসি গোয়ালঘরে থাকলে কি লোকে তার সুখ্যাতি করবে? হ্যাঁ রে মর্কট, এসব ষড়যন্ত্রের পিছনে কি তুইও আছিস?”

“কী যে বলেন দিদিমা! আমি হলুম গো গদাই খটিক, ছিঁচকে চোরের বেশি কিছু নয়। গোয়ালঘরটায় আলো জ্বলছে দেখে ঢুকে পড়েছিলুম। ঢুকে দেখি আপনি! স্বয়ং দানেশ চৌধুরীর মেয়ে, সত্যেশ চৌধুরীর বোন। তেজেশ চৌধুরীর পিসি আর ভবেশ চৌধুরীর ঠাকুরমা!”

“তবেই বল বাছা, আমাকে কি গোয়ালঘরে মানায়? নাকি তাতে রাজবাড়ির সম্মান থাকে। এটা অবিচার কিনা তুই-ই বিচার করে দেখ তো ভাই। অত বড় দালানকোঠা আমার, সাত-আটখানা ঘর। ভবেশের ছেলে এসে দাঁড়ালে কি আমি ফেলে দেব? শত হলেও পুতি, তা সেও থাকুক, আমি থাকি। দে ভাই ব্যবস্থা করে। গোয়ালঘরে থাকলে যে আমি নিউমোনিয়া হয়ে মরে যাব।”

“তা কী করে হবে দিদিমা! রাজামশাইয়েরমেলা মন্ত্রীসান্ত্রী, মেলা খিদমগার, তারা থাকবে কোথায়? রাজা বলে কথা, তার কেতাই আলাদা।”

“বলিস কী? তা হলে কি রাজবাড়ির সুদিন আবার ফিরে এল? রাজাদের তো নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা। তা মন্ত্রী, সান্ত্রী, খেদমদগার এল কোথা থেকে?”

“কত কী হয় দিদিমা। আঙুল ফুলে তো কলা গাছও হয়। আর তখনই বিপদ। কিন্তু ভোর হয়ে এল দিদিমা। দিনমানে আমাদের তেমন সুবিধে নেই। অনুমতি দিলে এবার আসি।”

“যাচ্ছিস বাছা? তা যা। যাওয়ার আগে আমার গায়ে কাঁথাকানি টেনে ঢাকা দিয়ে যা তো বাবা। ভোররাতে আমার ব শীত শীত করে।”

গদাই খুব যত্ন করে কাঁথা দিয়ে কাশীশ্বরীকে ঢাকা দিল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এল।

সকালবেলাতে মান্তি এসে হুড়ো দিল, “ও দিদিমা, উঠে পড়ো, অনেক বেলা হয়েছে যে!”

কাশীশ্বরী চোখ চেয়ে বললেন, “হ্যাঁ রে মান্তি, আমি কি কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছি? একটা চোর এসে বলল, আমাকে নাকি দালানকোঠা থেকে গোয়ালঘরে চালান দেওয়া হয়েছে?”

“সে মিছে কথা কয়নি দিদিমা, তোমাকে সত্যিই গোয়ালে চালান দেওয়া হয়েছে।”

“এটা কত বড় অবিচার বল দিকি। গাঁয়ের পাঁচজনকে ডেকে বল না।“

“ও বাবা, ও কাজ করতে যেও না। বাড়িতে গিজগিজ করছে ষন্ডা-ষণ্ডা চেহারার সব লোক। তাদের ভাবভঙ্গি মোটেই ভাল নয়। আমি একটু ঝগড়া করতে গিয়েছিলাম, তা এমন রক্তচক্ষুতে তাকাল যে হাড় হিম হয়ে যাওয়ার দশা।”

সকালবেলাতেই ভোলুকে চান করতে হল। তারপর একটা পট্টবস্ত্র পরানো হল তাকে। পট্টবস্ত্রের উত্তরীয় আর মাথায় একটা পাগড়ি। তারপর পনেরো-বিশজন পাহাড়-পর্বতের মতো বড়সড় চেহারার মানুষ তাকে ধরে নিয়ে চলল জঙ্গলের মধ্যে রাজবাড়িতে।

রাজবাড়ির ভাঙা দরবার ঘরখানা আজ সাফসুতরো করা হয়েছে। লোহার সিংহাসনের উপর একখানা সাদা চাদর পাতা। তার সামনেই যজ্ঞের আয়োজন।

ভোলুর রাতে ভাল ঘুম হয়নি, একটা লোক এসে তার ঘুম ভাঙিয়ে কিছুক্ষণ বকবক করে গেল। কথাগুলোর খুব একটা মাথামুন্ডু হয় না। তবে সেগুলোই বাকি রাতটুকু শুয়ে-শুয়ে  ভেবেছে
 ভোলু। ভেবে কুলকিনারা পায়নি। এখন তার ঝিমুনি আসছে, হাই উঠছে। খিদেও পাচ্ছে। তবে অভিষেকের আগে নাকি খাওয়া বারণ।

ঠিক তার ডানপাশেই যে লোকটা বসে আছে, তার যেমন মুগুরের মতো দু’খানা হাত, তেমনি মাঠের মতো চওড়া ছাতি, দু’খানা চোখে খুনিয়ার চাউনি। বারবার তার দিকে বাঘা চোখে তাকিয়ে দেখছে। যজ্ঞের ধোঁয়া আর পোড়া ঘিয়ের গন্ধে ভোলুর চোখ জ্বালা করছে। কিন্তু এ লোকটার কোনও হেলদোল নেই। লোকটার নাম বোধ হয় জগু। হঠাৎ ভোলুর পেটে আঙুলের একটা পেল্লায় খোঁচা দিয়ে দাঁত কড়মড়িয়ে বলল, “কত খরচা হয়েছে জান? তিনশো টাকা কেজির ঘি, পুরুতের দক্ষিণা, পট্টবস্ত্র, তারপর ভোজের খরচ। দুপুরে পোলাও আর কষা মুরগি, রাতে লুচি আর খাসির কালিয়া। যদি উসুল না হয় তা হলে ঠেলা বুঝবে। রাজা হওয়া বেরিয়ে যাবে এখন।”

ভোলু কথা শুনে হাঁ। কিসের উসুল তা সে বুঝতেই পারল না। এসব খরচাপাতি করা হচ্ছে কেন বা কে করছে তাও সে জানে না। রাজা সে নিজের থেকে হতেও চায়নি। তার বুকটা একটু ধুকপুক করতে লাগল, কোনও বিপদের গন্ধ কি পাচ্ছে সে?

বেশ কিছুক্ষণ যন্ত্র করে অবিদ্যাঠাকুর ক্ষ্যামা দিলেন। তারপর যজ্ঞের টীকা পরানো হল ভোলুকে। তারপর সবাই ধরাধরি করে তাকে নিয়ে গিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে দিল। অবিদ্যাঠাকুর অংবং মেলা মন্ত্র পড়ে কোষা থেকে জল তুলে তার মাথায়-ঘাড়ে ছিটিয়ে দিলেন। তারপর সমবেত ডাকাতে চেহারার লোকেরা নিতান্তই দায়সারা ভাবে জয়ধ্বনি দিল, “জয় মহারাজের জয়।”

নিজেকে ভোলুর মোটেই রাজাগজা বলে মনে হচ্ছে না। বরং বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে, ভয়-ভয় লাগছে। সে ঠিক বুঝতে পারছে না কাদের পাল্লায় পড়েছে। এরা ভাল লোক না খারাপ লোক, তা সে জানে না।

দুপুরে পোলাও আর কষা মুরগি মুখে দিয়ে সে কোনও স্বাদই পেল না। খিদেটা যেন মরে গিয়েছে। জোর করে খানিকটা খেয়ে পেট ভরে জল গিলল।

খাওয়ার পর আর-একজন ন্যাড়ামাথার ষণ্ডা এসে বেশ হাসি-হাসি মুখ করে বলল, “কী বাপু, দিব্যি তো ফাঁকতালে রাজা হয়ে গেলে! অ্যাঁ! তা রাজা হয়ে বেশ ভাল লাগছে তো! বেশ-বেশ! তা হলে বাপু, এবার তোমার কাজকর্ম শুরু করে দাও। আমাদের তো বসে থাকার সময় নেই। কাল থেকেই লেগে পড়ো।”

ভোলু ভারী অবাক হয়ে বলে, “কোন কাজের কথা বলছেন বলুন তো! আমাকে কী কাজ করতে হবে?”

“সে কী হে! এবারই তো তোমার আসল খেল দেখানোর পালা। চটপট কাজে লেগে পড়ো। আমরা তোমার পিছনেই আছি।”

অবিদ্যাঠাকুর তাড়াতাড়ি এসে দু’জনের মাঝখানে পড়ে বলেন, “ওরে, ওকে অত হুড়ো দিসনি। একটু ধাতস্থ হতে দে। ঠান্ডা মাথায় কাজ না করলে যে এত আয়োজন সব বৃথা যাবে! একটা-দুটো দিন সবুর কর বাপু, আগে জায়গাটা ঘুরেফিরে দেখুক।”

ভোলু কিছুই বুঝতে পারছে না। এরা তাকে দিয়ে একটা কাজ করাতে চাইছে বটে, কিন্তু কাজটা ঠিক কী তা ভোলুর মাথায় আসছে না।

সন্ধের পর অবিদ্যাঠাকুর তাকে আড়ালে ডেকে যা বললেন, তাতে তার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। তাকে নাকি রাজবাড়ির গুপ্তধন খুঁজে বের করতে হবে। আর গুপ্তধন নাকি সে ছাড়া আর কারও খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। আর গুপ্তধন বের করতে না পারলে এইসব ষণ্ডাগুন্ডারা নাকি খুবই অসন্তুষ্ট হবে। অবশ্য অবিদ্যাঠাকুর ভরসাও দিলেন, ওদের দেখে ভয় পেও না। ওরা সব কথা দিয়েছে যে, গুপ্তধন পাওয়া গেলে ওরা সব চুরি-ডাকাতি, ষন্ডামি, গুন্ডামি ছেড়ে দিয়ে রাজবাড়ির কাছে লেগে যাবে। গুপ্তধন পেলেই তো হবে না, তাকে রক্ষা করার জন্য ভাল রক্ষকও তো চাই।

শুনে ভোলুর শরীরে এমন কাঁপুনি উঠল যে, মনে হল তার নিশ্চয়ই ম্যালেরিয়া জ্বর হয়েছে। রাতে “জ্বর হয়েছে” বলে কিছুই খেল না সে। ছাদের ঘরে গিয়ে বিছানার চাদরটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল।

মাঝরাতে কে যেন গায়ে নাড়া দিতেই ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসল ভোলু, “কে?”

দেখল, পায়ের দিকটায় সেই ছায়ামূর্তিই বসে আছে। খুক করে একটু হেসে বা কেশে বলল, “রাজা হয়ে এখন কেমন বুঝছ হে?”

“খুব খারাপ। আমাকে নাকি রাজবাড়ির গুপ্তধন খুঁজে বের করতে হবে। নইলে কপালে কষ্ট আছে।”

“তা কষ্ট তো আছেই। গুপ্তধন খুঁজে বের করার জন্যই তোমাকে এতদিন গোরুখোঁজা করা হচ্ছিল।”

ভোলু ভারী বিরক্ত হয়ে বলে, “গুপ্তধনের আমি কী জানি মশাই। এ রাজবাড়ির কিছুই আমি চিনি না। এখানে যখন ছিলুম, তখন বাবার সঙ্গে একটা ছোট্ট বাড়িতে থাকতুম।”

“হ্যাঁ, পালপাড়ার পুকুরধারে।”

“ঠিক তো! আপনি অনেক কিছু জানেন দেখছি! ছেলেবেলায় আমি রাজবাড়িতে এসেছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু এরা বলছে গুপ্তধন নাকি আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে। কী মুশকিল বলুন তো।

“গুপ্তধন না পেলে ওদেরই বা চলবে কী করে বলো। আখের গোছাতে হবে তো! চুরি-ডাকাতিতেও আজকাল খুব কম্পিটিশন।”

“এরা কি সব চোর-ডাকাত?”

“বটেই তো। আজই তো দল বেঁধে পালদিঘিতে ডাকাতি করতে গিয়েছে।”

“পালদিঘি। পালদিঘি নামটা খুব চেনা-চেনা ঠেকছে। কোথায় যেন শুনেছি।”

“শোনারই কথা। ভবেশ চৌধুরীকে ওখানেই একদল গুন্ডা পিটিয়ে মারে। কেন জান? ভবেশ তার ছেলের ঠিকানা ওদের বলেনি বলে।”

“আমি? আমার জন্য? কেন বলুন তো।”

“কপালে দুর্ভোগ থাকলে খন্ডাবে কে? ত্রিশূল চিহ্ন নিয়ে জম্মেছ বলেই এই দুর্ভোগ বাপ আর ছেলের।”

ত্রিশুল নিয়ে জন্মালে কী হয়?”

“সে অনেক কথা বাপু, তবে বলে রাখছি, গুপ্তধন না পেলে যেমন তোমার বিপদ, পেলেও তেমনি বিপদ।”

“আমার যে বড্ড কাঁপুনি হচ্ছে মশাই?”

“তা তো হবেই! যার আগুপিছু বিপদ, তার কাঁপুনি হবে না তো কার হবে বাপু?”

“তা হলে কি আমার এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত?

“উচিত তো বটেই। তবে কিনা নীচে শক্ত পাহারা আছে। গোকুল, নবু আর নিতাই যেমন আছে, তেমনি দামোদর, বৃন্দাবন আর হরিপদও মোতায়েন। চেষ্টা করে দেখতে পার।”

“তা হলে আপনি কী করে এলেন? আপনি কি ওদের দলের লোক?”

“না বাপু, আমার মতো নগণ্য মনিষ্যিকে দলে নেওয়ার মতো বোকা ওরা নয়। তবে এটা ঠিক যে, যেখানে মাছিও গলতে পারে না, সেখানেও আমি বেশ ঢুকে পড়তে পারি। অনেকদিনের অভ্যেস কিনা।”

ভোলু কিছু বলল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

লোকটা বলল, “হাল ছেড়ে দিলে নাকি ভায়া?”

“পালানোরও যখন পথ নেই, তখন এদের হাতেই প্রাণটা যাবে দেখছি।”

“বাপু হে, এ বাড়ি ছেড়ে পালাবেই বা কেন? এবাড়ি তো ধর্মতঃ ন্যায্যতঃ তোমারই বাড়ি! কাশীশ্বরীর তিন কুলে কেউ নেই। একমাত্র তুমি ছাড়া। তিনি গত হলে এ বাড়িখানা যে তোমার?”

“আমার বাড়ি? কী করে?”

“ব্যাপারটা একটু জটিল বটে, কিন্তু তলিয়ে বুঝলে জলবৎ।”

“কীরকম?”

“কাশীশ্বরী হলেন সম্পর্কে তোমায় পিসিমা, তোমার প্রপিতামহ সত্যেশ চৌধুরীর বোন, দানেশ চৌধুরীর মেয়ে। কাশীশ্বরী অল্প বয়সে বিধবা হওয়ায় তাঁর বাবা মেয়েকে এই বাড়িখানা করে দেন। সুতরাং এ বাড়ির ওয়ারিশান তুমিই। কিন্তু তোমাকে ধরে আনার দিনপনেরো আগে কাশীশ্বরীকে ঘুমন্ত অবস্থায় অবিদ্যাঠাকুর আর তার দলবল চৌকিসুদ্ধ গোয়ালঘরে চালান করে বাড়ির দখল নেয়। কাশীশ্বরীর বয়স এখন একশো দুই বছর। সহায়-সম্বল কিছু নেই। ছাদে গিয়ে পশ্চিমদিকে তাকালেই গোয়ালঘরটা দেখতে পাবে। ভাঙা বেড়ার ঘর, টিনের চালে ফুটো, শেষ রাতে কাশীশ্বরীর শীতে ভারী কষ্টও হয়। কিন্তু তাঁর তো কিছু করারও নেই। তিনি শুধু শুনেছেন তাঁর ভাইপো রাজা হয়ে এসে বাড়ির দখল নিয়েছে।

“ছিঃ ছিঃ, এ তো ভারী অন্যায়?”

“এই দুনিয়ায় তোমার আত্মীয় বলতে ওই পিসিটাই যা অবশিষ্ট আছে।”

“আমি কি পিসিকে গিয়ে একটু দেখে আসতে পারি?”

“প্রকাশ্যে গেলে বিপদ। তবে গোপনে যেতে পার। ছাদ ঘেঁষে একটা পেয়ারা গাছ আছে। গাছ বাইতে পার তো?”

“খুব-খুব।“

“তা হলে টুক করে নেমে যাও। নীচে মেলা ঝোপঝাড় আছে। গা ঢাকা দিতে অসুবিধে হবে না।”

পেয়ারা গাছ বেয়ে তিনতলা থেকে নামাটা ভোলুর কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। লেখাপড়া না শিখলেও এসব তার কাছে জলভাত। নীচে নেমে সে দেখল, বাস্তবিকই গাছপালার আড়াল আছে। কারও চোখে পড়ার সম্ভাবনা নেই।

গোয়ালঘরে একটা লম্ফ জ্বলছে। দরজা-জানলার বিশেষ বালাই নেই। যেখান-সেখান দিয়েই ঢুকে পড়া যায়। একজন বুড়োমানুষের পক্ষে এ ঘরে থাকা মোটেই উচিত নয়।

কঙ্কালসার যে মহিলাকে সে মৃদু আলোয় দেখতে পেল, তাকে দেখলেই মায়া হয়। ভোলুর তো আর কেউ নেই, যদি এই পিসিমা তার সত্যিই আত্মীয় হয়ে থাকে, তবে এ-ই তার একমাত্র আপনজন।

খুব মৃদু স্বরে আদরের গলাইে ভোলু ডাকল, “পিসিমা। ও পিসিমা।”

“কে রে?” বলে কাশীশ্বরী চোখ মেললেন। ভাঙাচোরা বুড়োটে মুখ দেখলে কিন্তু এখনও বোঝা যায় যে, একসময়ে খুব সুন্দরী ছিলেন।

“আমি ভোলু, পিসিমা।”

“ভোলু, ভোলু কে রে?”

“আমার ভাল নাম রূপেশ চৌধুরী। আমি ভবেশ চৌধুরীর ছেলে।”

বুড়ির ফোকলা মুখে যে হাসিটা দেখা গেল, তেমন সুন্দর হাসি ভোলু জীবনে দেখেনি।

“ওম্মা গো, তুই ভবেশের সেই সুলক্ষণ ছেলে। তোর গায়েই তো ত্রিশূলের চিহ্ন আছে রে। অ্যাঁ, তা হ্যাঁ বাবা, পিসিকে দেখতে এলি বুঝি। ওম্মা, আনন্দে যে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। শুনছি তুই রাজা হয়েছিস, আর সেই জন্যই আমাকে ঘর থেকে সরিয়ে গোয়ালঘরে চালান দিয়েছে।”

“না পিসি, বাড়ি আমি দখল করিনি। যারা দখল করেছে, তারা আমার লোক নয়। তবে ভেবো না পিসি, আমি তোমাকে আবার তোমার দালানকোঠায় নিয়ে যাব।”

যাবি বাবা? সত্যিই যাবি? এখানে আমার বড় কষ্ট রে! শেষ রাতে হিম পড়ে তো, আমার বড় কষ্ট হয়। কুকুর-বিড়াল ঢোকে, পোকামাকড় ঘুরে বেড়ায়, পিপড়ে, মশা…।

রাগে শরীরটা যেন ফুলে-ফুলে দুনো হয়ে যাচ্ছিল ভোলুর। কান আর নাক দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরচ্ছে। রাগের চোটে তার ভয়ড়র উড়ে গেল।

কাশীশ্বরীর কঙ্কালসার হাত দু’খানা নিজের মুঠোয় নিয়ে ভোলু বলল, “তুমি দেখো পিসি, আমি এর বিহিত করবই।”

“হ্যাঁরে, তুই সত্যিই ভবেশের ছেলে তো! আমাকে ছল করছিস না তো বাবা?”

“না পিসিমা, আমার শরীরে ত্রিশুল চিহ্ন আছে বলে আমার বাবা আমাকে বাঁচাতে গাঁ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আমি রক্ষা পেলেও বাবা হার্মাদদের হাতে মারা যায়।”

“তা হলে একটু কাছে আয় তো বাবা ভোলু, তোর কানে-কানে দুটো কথা বলে রাখি।”

“কী কথা পিসি?”

“বাতাসেরও কান আছে রে বাবা, কাছে আয়।”

ভোলু নিচু হলে কাশীশ্বরী তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, “ত্রিশূলটা আছে শিবমন্দিরের মাথায়। আর চাবি পুকুরের ঠিক মাঝখানে, জলের তলায়। বুঝলি?”

“না পিসিমা, বুঝলাম না তো।”

“কিন্তু এর বেশি যে আমি আর কিছু জানি না বাবা। বাপ-দাদার মুখে এ দুটো কথা শোনা ছিল, তোকে বলে দিলাম। তুই সাচ্চা লোক হলে ঠিক সব খুঁজে পাবি।”

“ঠিক আছে পিসি, কথাগুলো আমার মনে থাকবে। তুমি এখন ঘুমোও, কিছু খুঁজে পাই বা না-পাই, তোমাকে তো পেয়েছি। আমার তো আপনজন বলতে আর কেউ নেই। একমাত্র তুমি।”

“বেঁচে থাক বাবা! যা বললি তাতেই আমার কান জুড়িয়ে গেল, বুকটা ভরে উঠল।”

কাশীশ্বরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভোলু আর নিজের ঘরে ফিরল না। সোজা হাঁটতে-হাঁটতে অন্ধকারেই রাজবাড়ির বাগানে ঢুকে ফোয়ারার ধারটিতে বসে রইল। বসে চুপ করে ভাবতে লাগল। তার এখন আর ভয়-ভয় ভাবটা নেই। বরং একটা রাগ আর উত্তাপ টের পাছে সে।

অন্ধকার কেটে গিয়ে কখন ভোরের আলো ফুটেছে তা ভোলু টেরই পায়নি। ভারী অন্যমনস্ক ছিল।

হঠাৎ কে যেন বলল, “নতুন মুখ দেখছি যেন।”

ভোলু চেয়ে দেখল, মাঝবয়সি একজন লোক দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দাঁতন করছেন।

ভোলু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তা নতুন লোকও বলতে পারেন।”

“তা এখানে কী মনে করে? গুপ্তধনের সন্ধানে নাকি?”

ভোলু হেসে ফেলল, তারপর বলল, “তাও বলতে পারেন।“

লোকটা একটু তফাত রেখে ফোয়ারার ধারে বসে দাঁতন চিবোতে-চিবোতে বলল, “কত লোকই যে গুপ্তধনের খোঁজে আসে, তার হিসেব নেই।”

ভোলু বলল, “হ্যাঁ, জানি। আপনি কি এখানকারই লোক?”

“তার মানে? এই চন্দ্রঘোষপুরে আমাদের সাত পুরুষের বাস।”

“বাঃ, তা হলে তো আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, রাজবাড়ির শিবমন্দিরের মাথায় একটা লোহার ত্রিশুল ছিল। ত্রিশুলটা এখন নেই। কেন?”

ব্ৰহ্মগোপাল দাঁতন চিবোতে-চিবোতে বললেন, “ত্রিশূল একটা ছিল বটে। ইদানীং দেখছি না। চুরিটুরি হয়ে গিয়েছে বোধ হয়।”

“ওই উঁচু শিবমন্দিরের মাথা থেকে একটা পুরনো জংধরা লোহার ত্রিশূল চুরি করে কার কী লাভ?”

“তা জানি না বাপু, আজকাল চোরদের আক্কেল বলে কিছু নেই। এই তো সেদিন আমায় বাড়ি থেকে একগাছা পুরনো ঝাঁটা চুরি হয়েছে।”

ভোলু গম্ভীর মুখে বলল, “হু।”

“কেন বাপু, তুমি ত্রিশূলটা খুঁজছ কেন?”

ভোলু মাথা নেড়ে বলল, “কেন খুঁজছি তা আমিও জানি না।”

“তা তুমি তো এ গাঁয়ের লোক নও। কোথা থেকে আসা হচ্ছে শুনি।”

ভোলু লোকটার দিকে চেয়ে বলল, “আমার নাম রূপেশ চৌধুরী। আমি ভবেশ চৌধুরীর ছেলে। এই রাজবাড়ির সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক ছিল।”

ব্ৰহ্মগোপাল চমকে উঠে বলেন, “বলো কী! তুমিই ভবেশের ছেলে রূপেশ! সেই ত্রিশূল চিহ্নওয়ালা।”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

ব্ৰহ্মগোপালের স্খলিত হাত থেকে দাঁতনটা খসে পড়েছিল। তিনি সেটা আবার কুড়িয়ে নিয়ে ভোলুর দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “তোমার জামাকাপড় ভাল নয় বটে। কিন্তু তোমার চেহারায় রাজবংশের লম্বাইচওড়াই ব্যাপারটা আছে। তোমাকে দেখে ভবেশের ছেলে বলে মনে হয় বটে। তা তোমার বাবা…”

“বাবা বেঁচে নেই। শুনেছি, আমাকে গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে বছরদুয়েক আগে তাঁকে মরতে হয়েছিল।”

“সে কথা আমরাও শুনেছি বাবা! তা তুমি কি গাঁয়ে ফিরে এলে?”

মাথা নেড়ে ভোলু বলে, “তা ঠিক বুঝতে পারছি না। শুধু বুঝতে পারছি এখানে আমার কিছু কাজ আছে।”

“কী কাজ বাবা?” ভোলু হেসে বলল, “গুপ্তধন খোঁজা।”

ব্ৰহ্মগোপাল দাঁতনটা আর-একটু চিবিয়ে নিয়ে বললেন, “তুমি কি জান গুপ্তধন যদি থেকেই থাকে, তবে তা তোমারই পাওনা বলে একটা কিংবদন্তি আছে।”

“শুনেছি, কিন্তু সেই কিংবদপ্তির ফল ভাল হয়নি। আমার বাবাকে মরতে হয়েছে। আমাকেও হয়তো মরতে হবে।”

“ও কথা বোলো না বাবা। তবে ত্রিশূলের খবর তোমাকে আমি দিতে পারি। ওটা আমার হেফাজতে আছে।”

ভোলু অবাক হয়ে বলল, “আপনার কাছে আছে?”

“হ্যাঁ, বাবা। যদি চাও তো, সেটা তোমাকে এনে দিতে পারি।”

“ত্রিশূল দিয়ে কী হবে, তা তো জানি না। ওটা বরং আপনার কাছেই থাক।”

ব্ৰহ্মগোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বললে হয়তো তোমার বিশ্বাস হবে না, আমি একটা দৈবাদেশ পেয়ে ত্রিশুলটা নামিয়ে এনেছিলাম। ওর মহিমা আমার জানা নেই। আরও একটা জিনিস আমার হেফাজতে আছে। তবে সেটা তোমাকে বলা ঠিক হবে কিনা, তা বুঝতে পারছি না।”

ভোলু খুব আনমনে সামনের দিকে চেয়ে থেকে বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পরে বলল, “পুকুরের মাঝখানে জলের তলায় একটা চাবি আছে বলে শুনেছি।”

ব্ৰহ্মগোপাল কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন, তারপর বললেন, “এতক্ষণ একটু সন্দেহ ছিল বটে। এখন আর নেই। তুমি ভবেশের সেই ছেলেই বটে। হ্যাঁ বাবা, অনেক কষ্ট করে সেই চাবিও দৈবাদেশে আমি পুকুর থেকে তুলেছি।”

ভোলু একটু হেসে বলল, “চাবির রহস্যও আমার জানা নেই। চাবিও আপনার কাছেই থাক।”

“ভবেশ আমার ছোট ভাইয়ের মতো। তুমিও আমার সন্তানের সমান। কোনও সাহায্যের দরকার হলে বোলো। চৌধুরীদের সঙ্গে আমাদের তো আজকের সম্পর্ক নয়। সেই টানেই রোজ সকালে এসে এই বাগানে কিছুক্ষণ বসে থাকি। কী বলব বাবা, ভাঙাচোরা হলেও এ বাড়িতে এখনও যেন প্রাণ আছে।”

ভোলু চুপ করে বসে রইল। কথা বলল না।

ব্ৰহ্মগোপাল উঠে পড়লেন। বললেন, “আমি বাবা, আমার নাম ব্ৰহ্মগোপাল। দরকার হলে বোলো। পাঠকপাড়ার মুখেই আমার বাড়ি। সবাই চেনে।”

“ঠিক আছে জ্যাঠা।”

ব্ৰহ্মগোপাল চলে যাওয়ার পর ভোলু আস্তে-আস্তে উঠে দরবার ঘরে গিয়ে ঢুকল। আধখানা ছাদ নেই। বাকিটাও বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে। ভোলু চেয়ে-চেয়ে বাড়ির দুর্দশা অনেকক্ষণ ধরে দেখল। কেন যেন বাড়িটা দেখে তার একটা মায়া জন্মাচ্ছে। যতই ভেঙে পড়ুক পূর্বপুরুষের ভিটে।

সিংহাসনের উপরে চুপ করে চোখ বুজে অনেকক্ষণ বসে রইল ভোলু। পিসি ত্রিশূল আর চাবির কথা বলেছে। তা দিয়ে কী হবে, তা ভোলু জানে না। কিন্তু তার এখন ঘোর বিপদ জেনেও তার তেমন ভয় হচ্ছে না। কোনও দুশ্চিন্তা নেই, উদ্বেগ নেই।

অনেকক্ষণ ধ্যানস্থ হয়ে থাকার পর সে উঠল এবং ফের চারদিকটা দেখতে লাগল। দেখতে-দেখতেই হঠাৎ সিংহাসনের পিছনে হেলান দেওয়ার জায়গাটার উপরের দিকটা নজরে পড়ল তার। আর একটু নীচে একটা গোল চাকতির মতো জিনিস।

হঠাৎ কাছেই একটা হুঙ্কার শোনা গেল, “এই যে মহারাজ! পালানোর মতলব করছ নাকি! না আমাদের ফাঁকি দিয়ে একাই গুপ্তধন হাতিয়ে সরে পড়তে চাও?”

দুটো ষন্ডামার্কা লোক দাঁড়িয়ে আছে দরবার ঘরের মুখটাতেই।

ভোলু চমকাল না, ভয়ও পেল না। চোখে চোখ রেখে বলল, “কেন হে, আমি কি তোমাদের কেনা গোলাম?”

ভিতু নরম-সরম ভোলুর কাছে এ জবাব তারা আশা করেনি। দুজনেই হাঁ করে চেয়ে রইল।

এক গুন্ডা আর-এক গুন্ডাকে বলল, “বাপ রে, এর যে ভোল পালটে গিয়েছে দেখছি! ওহে, রাজা হয়ে কি মাথায় চড়ে বসেছ নাকি? এখন ভালয়-ভালয় চলো তো বাপু, তোমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার হুকুম হয়েছে।”

বলেই দু’জন এসে দু’দিক থেকে বাঘা হাতে তার দু’খানা হাত চেপে ধরল।

ভোলু একটা ঝটকায় তার হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “চুপচাপ তফাতে থেকে হাঁটতে থাকে। গায়ে হাত দিলে হাত মুচড়ে দেব।”

লোক দুটো অবাক হল বটে, একটু রুখে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু কী ভেবে আর উচ্চবাচ্য করল না। সামনে ভোলু, পিছনে তারা বেশ একটু তফাতে হাঁটতে থাকল।

বাড়িতে ফিরে ভোলু দেখল, সামনের বারান্দায় শালখুঁটির মতো গুন্ডারা খুব উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সামনেই রঘু। ভ্রুকুটি করে বলল, “কী ব্যাপার হে, কার হুকুমে বাড়ির বাইরে গিয়েছিলে?”

ভোলুর কাল মনে হয়েছিল, লোকগুলোর পাহাড়-পর্বতের মতো বড় বড় চেহারা। আজ মনে হচ্ছিল, দূর, এরকম চেহারার লোক তো রাস্তায়, ঘাটে, হাটেবাজারে সদাসর্বদা দেখা যায়। আজ তো এদের একটুও ভয়ঙ্কর লাগছে না। আসলে কাল ভয়ের চোখে সবাইকে যত ভয়ঙ্কর দেখছিল, আজ ভয় কেটে যাওয়ায় লোকগুলো সাইজে যেন অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।

ভোলু রঘুর দিকে চেয়ে খুব ঠান্ডা গলাতেই বলল, “শোনো বাপু, আমি কারও হুকুমে চলি না। তুমি বেয়াদব, সহবত জান না, ফের ওরকম ভাবে কথা বলে তোমাকে সহবত শেখাব।”

রঘু এমন হাঁ হয়ে গেল যে, প্রথমটায় বাক্যস্ফূর্তি হল না। এমন সময় অবিদ্যাঠাকুর এগিয়ে আসায় রঘু বলে উঠল, “শুনলেন ঠাকুরমশাই! এ যে  পিঁপড়ের
 পাখা গজিয়েছে।”

অবিদ্যাঠাকুর বললেন, “তোরা বাড়াবাড়ি করছিস কেন? ও তো রাজবাড়িতেই গিয়েছিল। একে সব দেখতে দে, বুঝতে দে। তবে না মাল বেরোবে।”

“যদি মাল তুলে নিয়ে পালায়? না ঠাকুরমশাই, যেখানেই যায় যাক, কিন্তু সঙ্গে আমাদের লোক থাকবে।”

ভোলু ফুঁসে উঠে বলল, “কেউ আমার সঙ্গে থাকবে না। আমি যেখানে খুশি, যখন খুশি একাই যাব।”

রঘু বোধ হয় একটা গর্জন ছাড়তে যাচ্ছিল। ভোলুর চোখের দিকে চেয়ে সেটা আর ছাড়ল না। অবিদ্যাঠাকুরকে বলল, “ঠাকুরমশাই, এর দেখছি খোলনলচে পালটে গিয়েছে। চোখ দুটো দেখেছেন? যেন জ্বলছে।”

“ওরে শত হলেও গায়ে রাজার রক্তটা তো আছে! চোখ রাঙিয়ে কাজ হবে না। সব ব্যাপারে কি দাদাগিরি চলে?”

হঠাৎ ভোলু বলে উঠল, “ঠাকুরমশাই, আমার একটা কথা আছে।”

“কী কথা বাপু?”

“গোয়ালঘরে একজন বুড়ি রয়েছে। শুনেছি সেই বুড়িই এ বাড়ির মালিক। আপনার লোকেরা তাঁকে জোর করে সরিয়ে দিয়েছে। আমার ইচ্ছে, বুড়িমাকে দালানকোঠার একটা ঘরে এনে রাখা হোক।”

সঙ্গে-সঙ্গে রঘু আর তার স্যাঙাতরা প্রতিবাদ করে উঠল, “তা কী করে হয়? এখানে আমাদেরই জায়গা হচ্ছে না, গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে।“

ভোলু মাথা নেড়ে বলল, “তা আমি জানি না, তবে ওটাই আমার শেষ কথা। বুড়িমাকে কোঠাঘরে এনে রাখতে হবে, নইলে গুপ্তধনটনের কথা ভুলে যান। আমি ওসব খুঁজতে পারব না।”

একটা ন্যাড়ামাথা লোক ঘুসি বাগিয়ে তেড়ে এসে বলল, “এটা কি তোমার বাপের জমিদারি যে, যা খুশি হুকুম করবে? এখানে আমরা যা বলব, তাই হবে। তুমি ফোঁপরদালালি করার কে হে?”

ভোলু একটুও ঘাবড়াল না। লোকটার দিকে গনগনে চোখে চেয়ে বলল, “শুনে রাখো, এটা আমার বাপেরই জমিদারি, আর আমি যা চাই তাই হবে।”

লোকটা চোখ পাকিয়ে বলল, “এঃ, খাঞ্জা খাঁর নাতি এলেন! রাজা না খাজা। বেশি কথা বললে মুখ ভেঙে দেব…”

অবিদ্যাঠাকুর পট করে লোকটার হাত টেনে ধরে বললেন, “ওরে কার সঙ্গে মাথা গরম করছিস? শুধু গাজোয়ারিতে কি সব কাজ হয় রে বাপু? দেখছিস না ও তোকে মোটই ভয় পাচ্ছে না? এখন যা তো বাপু , ওই দক্ষিণের ঘরখানা খালি করে দে। তারপর বুড়িটাকে চৌকিসমেত ধরাধরি করে নিয়ে এসে ওই ঘরখানায় বহাল কর।”

লোকটা রুখে উঠে বলে, “বললেই হল? আমরা তা হলে কোথায় থাকব।“

ভোলু খুব ঠান্ডা গলাতেই বলল, “কেন, তুমি ওই গোয়ালঘরে থাকবে।

লোকটা রাগে কাঁপতে-কাঁপতে বলল, “আমি গোয়ালঘরে থাকব? আমি গোয়ালঘরে থাকব? এত সাহস! আজ তোরই একদিন কী আমারই…”

ভোলু জীবনে কখনও মারপিট দূরের কথা, কারও সঙ্গে কোনও ঝঞ্ঝাটেই যায়নি। ঝগড়া-বিবাদ, মারদাঙ্গা দেখেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। কিন্তু আজ ভোরবেলা কাশীশ্বরীর দুরবস্থা দেখে তার ভিতরটা বড় গরম হয়ে আছে। গায়ে যেন সেই রাগেরই একটা জ্বলুনি হচ্ছে। লোকটা পাগলা হাতির মতো ধেয়ে আসতেই ভোলুর কী হল কে জানে। হঠাৎ ডান হাতটা তুলে পটাং করে একটি থাপ্পড় কষিয়ে দিল লোকটার গালে।

থাপ্পড়ে যে বজ্রপাতের মতো শব্দ হয়, এটা জানা ছিল না তার। কাজেই থাপ্পড় খেয়ে যখন লোকটা চোখ উলটে গদাম করে পড়ে গেল, তখন ভোলু নিজেই স্তম্ভিত। থাপ্পড়ের শব্দটাও এত জোরে হয়েছে যে, কানে তালা লাগার জোগাড়।

দেখা গেল, ভোলু একাই নয়, বাদবাকি ষণ্ডাগুন্ডারাও কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ ভোলুর দিকে তেড়েও এল না বা ঘটনার প্রতিবাদও করল না। ভূপতিত লোকটারও কোনও নড়াচড়া দেখা গেল না।

বেশ অনেকক্ষণ বাদে অবিদ্যাঠাকুর বললেন, “তোদের যে কবে আক্কেল হবে কে জানে। এখন যা, বুড়িটাকে ধরাধরি করে নিয়ে আয়।”

তিন-চারজন ষন্ডা সঙ্গে-সঙ্গে “যে আজ্ঞে, ” বলে ছুটে গেল।

পনেরো মিনিটের মধ্যেই কাশীশ্বরীকে একতলার সবচেয়ে ভাল ঘরখানায় চৌকি এবং কাঁথাকানি সমেত বহাল করা হল। এ নিয়ে আর কোনও উচ্চবাচ্য শোনা গেল না।

ভোলু ধীরে-ধীরে সিড়ি  ভেঙে
 তার ছাদের ঘরখানায় উঠে এসে চুপ করে বসে রইল। সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে যে, সে আর আগেকার ভোলু নেই। তার ভিতরে কী একটা বস্তু যেন টগবগ করছে। হাত-পা নিশপিশ করছে। মাথাটাও যেন বেশ তেতে রয়েছে। এই নতুন ভোলুর সঙ্গে তার বনিবনা হবে কিনা তাই বা কে জানে!

দিব্যকর্ণ বলে কী একটা কথা আছে না! সেটা হয়তো কথার কথাই হবে। কিন্তু বসে থেকে হঠাৎ ভোলু পরিষ্কার রঘু  গুন্ডার
 গলার স্বর শুনতে পেল। রঘু অবিদ্যাঠাকুরকে বলছে, “এটা কী হল ঠাকুরমশাই? ছেলেটা কি হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়েছে নাকি? চিন্তার কথা কী জানেন? যে ছেলেটাকে তুলে এনেছিলেন, সে তো একদম গোবরগণেশ ছিল। সাত চড়ে রা ছিল না। হঠাৎ তার হল কী বলুন তো? ওর চোখ দুটো দেখলেন? কোনও ভয়ডরের চিহ্নমাত্র নেই। আর সেটাই চিন্তার কথা। যে মানুষের ভয়ডর থাকে না, তাকে বাগ মানানো খুব মুশকিল।”

অবিদ্যাঠাকুর বললেন, “ওই তো বললুম, ভিতরে রাজার রক্ত তো ছিলই। অভিষেকের পরপরই সেটা ক্রিয়া করতে লেগেছে। ওকে ঘাঁটাতে যাসনি। যা বলবে, তাতেই সায় দিয়ে যা। গুপ্তধনটা আগে খুঁজে বের করুক, তারপর যা খুশি করিস।”

“তা বলে এত বড় অপমানটা হজম করতে হবে? আজ অবধি বধু সর্দারের চোখে চোখ রেখে কথা বলার হিম্মৎ কারও হয়নি। আর ওই পুঁচকে ছেলেটার এত বড় হেনস্থার একটা জবাব দেব না?”

“কুটনীতি বুঝিস? যদি বুঝসি, তা হলে পরামর্শের জন্য আমার মতো পাকা মাথার দরকার হত না। অপমানের শোধ তুলতে গিয়ে যদি রাগের মাথায় ছেলেটাকে খুন-জখম করে ফেলিস, তা হলে আমও গেল, ছালাও গেল। শোধ তুলতে চাস তো তার জন্য মেলা সময় বাকি। ছোকরাকে এখনই বিগড়ে দিলে কার্যোদ্ধারের আর কোনও আশাই থাকবে না।”

দিব্যকর্ণ পট করে বন্ধ হয়ে গেল। সারাক্ষণ দিব্যকর্ণ চালু থাকলে অবশ্য ভোলুর বিপদ ছিল। সারাক্ষণ ভ্যাজর-ভ্যাজর শুনতে কারই বা ভাল লাগে? যেটুকু শোনার দরকার ছিল, সেটুকু শুনে নিয়েছে সে। কতখানি বিপদের মধ্যে আছে, তা আর বুঝতে বাকি নেই। তবে তার ভয় কি বিশেষ হচ্ছে না? কেন যেন মনে হচ্ছে যে, আর একা নয়। গায়েও বেশ জোর পাচ্ছে ভোলু। মাথাটা এতকাল কেমন যেন নিরেট মতো ছিল, তেমন বুদ্ধিসুদ্ধি খেলত না। এখন মাথাটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। বুদ্ধিও খেলছে বলেই মনে হচ্ছে তার। ভয়ের চোটে কাল একদম খিদে ছিল না তার। খুব অরুচি হচ্ছিল। আজ যেন চনমনে খিদে হয়েছে। অরুচিটাও নেই।