ভোলু যখন রাজা হল – ৪

দিনমানে গর্তটা আবিষ্কার করেছিল বাবুরাম। বাগানের উত্তর-পূর্ব কোণে একটা ঘাসে ঢালা পাথরের চাঙড়। এমনিতে বোঝার উপায় নেই। তবে বাবুরাম জানে, তার চোখ অনেক তলিয়ে দেখতে পায়। তা সেই তলিয়ে দেখেই বাবুরাম চাঙড়ের নীচে একটা ফাঁক আবিষ্কার করতে পেরেছে। এটা যে একটা সুড়ঙ্গের লুকানো মুখ, তাতে তার বিশেষ সন্দেহ নেই। দিনের বেলা খোঁড়াখুঁড়ির অসুবিধে। তাতে লোকের চোখে পড়তে পারে। তাই আজ সন্তর্পণে নিশুত রাতে রাজবাড়িতে ঢুকেছে বাবুরাম। হাতে টর্চ আর শাবল।

হাঁটু গেড়ে ফাঁকটাকে সে ভাল করে দেখল। একটু খুঁড়লেই সুড়ঙ্গের মুখটা দেখা যাবে বলে মনে হচ্ছে তার। চারদিকটা ফের ভাল করে দেখে নিয়ে শাবলটা তুলে চালাতে যাচ্ছিল বাবুরাম। ঠিক এই সময়ে পিছন থেকে কে যেন মোলায়েম গলায় বলল, “কাজটা কি ভাল হচ্ছে?”

বাবুরাম এমন চমকাল যে, শাবল আর টর্চ দুটোই পড়ে গেল হাত থেকে। দাঁতে-দাঁতে ঠকাঠক, হাতে পায়ে স্তম্ভন। কঁকিয়ে উঠে বলল, “আমার যে বড় লোকসান যাচ্ছে।”

টর্চটা নিভে গিয়েছে। পিছু ফিরে দেখল অন্ধকারটায় একজন লম্বা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। পরনে যেন ধুতি, পাঞ্জাবিই মনে হচ্ছে।

“কাজটা কি ভাল হচ্ছে বাবু?”

বাবুরাম হাতজোড় করে বলে, “আপনি কে?”

“আমি একজন প্রাচীন মানুষ। আমার নাম অমিতেশ। তোমার মতলবটা কী বলো তো?”

“আজ্ঞে, একটু খোঁড়াখুঁড়ি করে দেখছিলাম আর কী?”

“কিন্তু ওটা যে তেজেনবাবুর বাড়ি। এত রাতে কাঁচা ঘুম ভাঙলে সে যে বড্ড রেগে যাবে হে?”

বাবুরাম ফাঁপরে পড়ে মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলে, “তেজেনবাবু যে এই গর্তের মধ্যে থাকেন তা তো জানতাম না। তা এই তেজেনবাবু কে?”

“এ বাড়ির বাস্তু সাপ। জাত গোখরো।”

“ওরে বাবা!” বলে বাবুরাম চার হাত পিছিয়ে এল।

“তা এই নিশুতরাতে খোঁড়াখুঁড়ি করতে লেগেছ কেন বলো তো? গুপ্তধনের সন্ধানে নাকি?”

বাবুরাম কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, “যে আজ্ঞে। তা মশাই এ বাড়িতে কি গুপ্তধন নেই?”

“তা থাকবে না কেন? গুপ্তধন আছে বলেই তো জানি।”

“একটু সুলুকসন্ধান দিতে পারেন?”

“ওহে বাপু, গুপ্তধন যেমন আছে, তেমনই তার ওয়ারিশনরাও আছে। বেওয়ারিশ মাল তো নয় যে, যে কেউ এসে তুলে নিয়ে যাবে?”

“এঃ, তা হলে যে আমার বড্ড লোকসান হয়ে যাবে মশাই!”

“তোমার আবার লোকসান কিসের?”

“আজ্ঞে রাহাখরচ, খোরাকি, গুন্ডাদের তোলা দিতে আমার যে হাজারদেড়েক টাকা বেরিয়ে গিয়েছে।”

“মাত্র দেড় হাজার টাকা!”

“আজ্ঞে আমি গরিব মানুষ, দেড় হাজারই আমার কাছে অনেক।”

“ঠিক আছে, তোমার পিছন দিকে দশ হাত দূরে যে বেল গাছটা আছে, তার কাছাকাছি একটা উইঢিবি দেখতে পাচ্ছ?”

“আজ্ঞে, উইঢিবিটা আমি চিনি।”

“শাবল দিয়ে উইঢিবিটা ভেঙে গর্তের মধ্যে হাত ঢোকাও।”

বাবুরাম শাবলটা তুলে নিয়ে অন্ধকারেই উইঢিবিটা ভাঙল। গর্তে হাত দেওয়ার আগে ভয়ে-ভয়ে বলল, “এখানে আবার কোনও তেজেনদা নেই তো মশাই?”

“না, ভয় নেই, হাতটা একটু গভীরে ঢুকিয়ে দাও।”

বাবুরাম প্রাণপণে গর্তের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে হাতড়াতে লাগল। বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টার পর হঠাৎ একটা শক্ত জিনিসে হাত ঠেকল তার।

“কিছু পেলে?”

“যে আজ্ঞে, মনে হয় থালাটালা কিছু।”

“টেনে তোলো।”

টেনে তুলতে যথেষ্ট পরিশ্রম হল বাবুরামের। জিনিসটা একটা বেশ বড়সড় ভারী থালা বলেই মনে হল তার। তবে মাটিতে মাখামাখি।

“এটা কী জিনিস মশাই?”

“ওটা অনেক পুরনো একটা রুপোর থালা। বিক্রি করলে বেশ অনেক টাকাই পাবে।”

“আপনাকে একটা পেন্নাম করতে ইচ্ছে করছে মশাই।”

“তার আর দরকার নেই। তবে গুপ্তধন খুঁজে আর সময় নষ্ট কোরো না। লাভ নেই। গুপ্তধনের কাছে পৌঁছতে গেলে অনেক কলকাঠি নাড়তে হবে। অনেক হিসেব মেলাতে হবে। যার-তার কম্মো নয়। যত দূর শুনেছি, এই বংশের একজনই সেই জিনিসের নাগাল পাবে, যার শরীরে একটা ত্রিশূলের চিহ্ন আছে।”

“তা হলে আমাদের কি কোনও আশা নেই মশাই?”

“না।“

একটু জ্যোৎস্না ফুটেছে মধ্যরাতে। বাবুরাম দেখল, তার সামনে দাঁড়ানো লোকটা আস্তে-আস্তে যেন কুয়াশার মতো আবছা হয়ে যেতে লাগল, তারপর জ্যোৎস্নার আলোর সঙ্গে মিশে গিয়ে মিলিয়ে গেল। কোনও চিহ্নই আর রইল না।

বাবুরাম এত অবাক যে, ভয় পেতে অবধি ভুলে গেল। তারপর টর্চ আর শাবলটা তুলে নিল সে। রুপোর থালাটা বগলে করে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও একবার রাজবাড়িটার ভগ্নস্তুপের দিকে ফিরে তাকাল। থালাটা অ্যান্টিকের দরে বেচলে সে অনেক টাকা পাবে। কিন্তু কেন যেন তার আর তেমন লোভটোভ হচ্ছে না।

ব্ৰহ্মগোপাল সকালবেলায় যথারীতি রাজবাড়ির বাগানে এসে ফোয়ারার ধারে বসে দাঁতন করতে যাবেন, এমন সময়ে দেখেন ফোয়ারার অন্য ধারে খুব চিন্তাঙ্কিত মুখে বাবুরাম আদিত্য বসে আছে। আজ পায়ে গামবুট নেই। মাথাও টুপিহীন।

ব্ৰহ্মগোপাল ভদ্রতার খাতিরেই জিজ্ঞেস করলেন, “বাবুরাম বাবু যে, খোঁড়াখুড়ি করে কিছু পেলেন নাকি?”

বাবুরাম খুবই গম্ভীর মুখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ব্ৰহ্মবাবু, আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন?”

“ভূত!” বলে ব্ৰহ্মগোপালও গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর খুব গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগলেন এবং বেশ কিছুক্ষণ বাদে চিন্তিত মুখেই বললেন, “ব্যাপারটা কী জানেন? আমি একটা নাস্তিক ক্লাবের মেম্বার। আমাদের প্রেসিডেন্ট আত্মারাম যুক্তিবাদী খুব কড়া লোক। নাস্তিকরা ভূতপ্রেত, ভগবান, অলৌকিক এসব মোটেই বিশ্বাস করে না। তাই আমারও ওসবে বিশ্বাস করা বারণ। তবে কিনা…”

‘তবে কী?”

“আমি বিশ্বাস করি না বটে, কিন্তু ভূত-প্রেত ভগবান এসব সত্যিই আছে। এমনকী, দৈববাণীটানিও গাঁজাখুরি ব্যাপার নয়।”

“তা হলে আপনি মানেন না কেন?”

“আহা, আমার যে ওসব মানতে নেই মশাই। কিন্তু আমি মানি কিংবা না মানি ওসব আছে। কেন? আপনি ভূতটুঁত দেখলেন নাকি? তবে আমি আগেই বলে রাখছি, আমি কিন্তু ভূতে বিশ্বাস করি না।“

বাবুরাম খুব হতাশ গলায় বলে, “বিশ্বাসই যখন করেন না তখন আর বলে কী হবে?”

“আহা, কী মুশকিল। ওই যে বললুম, বিশ্বাস না করলেও ভূত যে আছে সেটা জানি। আমার সমস্যাটা হল, আমিও মাঝে-মাঝে দৈববাণী শুনতে পাই। একদিন সেই কথাটা বেফাঁস নাস্তিক ক্লাবের বৈঠকে বলে ফেলেছিলাম। তাতে আত্মারামবাবু এমন রেগে গেলেন যে, আমার অস্থির অবস্থা। দাঁত কড়মড় করে বললেন, ‘দৈববাণী। শুনেছেন? অ্যা! দৈববাণী। এর পর তো ভূত দেখবেন, ভগবান মানবেন, তাগা-তাবিজ-মাদুলি ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াবেন, জলপড়া খেয়ে পেটের ব্যথা কমাবেন, আরও কত কী!’ সেই থেকে ঠিক করেছি ভূত আছে থাক, ভগবান আছেন তো থাকুন। তবে আমি আর ওসব বিশ্বাস করতে যাচ্ছি না। তা মশাই, ভূত কি সত্যিই দেখলেন নাকি?”

“দেখলুম মানে। একদম জলজীয়ন্ত দেখলুম।”

“দুর মশাই। জীয়ন্ত হলে আর ভূত কিসের?”

“জীয়ন্ত না হলে ভূত বলে বুঝবেন কী করে?”

ব্ৰহ্মগোপাল ভারী ভাবিত হয়ে বললেন, “কিন্তু জীয়ন্ত হলে কি মানুষ আর ভূত থাকে? যুক্তিতে আসছে না যে?”

“আরে মশাই, মরা ভূত দিয়ে কি কোনও কাজ হয়? জ্যান্ত না হলে কি ভূতের কাজ কারবার চলে? জ্যান্ত ভূতে আপত্তি থাকলে সেটা বলে ফেলুন, আমি না হয় আর ঘটনাটা বলব না।”

“না মশাই না। ভূতেই যখন বিশ্বাসই করছি না, তখন জ্যান্তই কী আর মরাই কী! বলে ফেলুন।”

“শুধু দেখাই তো নয়, কথাটথা হল, গুপ্তধনের হদিশ দিলেন। শেষে আমার লোকসানের কথা শুনে উইঢিবির ভিতরে একটা রুপোর থালার সন্ধানও দিলেন।”

“বলেন কী?”

“যে আজ্ঞে। অদ্ভুত দেড়-দু’কেজি ওজনের রুপোর থালা, আমি তার নাম জিজ্ঞেস করায় জানালেন, তাঁর নাম অমিতেশ। নামটা কি চেনা ঠেকছে?”

ব্ৰহ্মগোপাল তাড়াতড়ি জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “চেনা ঠেকবে না? উনি যে রাজবংশের উর্ধতন পঞ্চম পুরুষ। শুনেছি তার আমলে এই রাজবাড়ির কেতাই ছিল আলাদা, তা গুপ্তধনের হদিশ দিলেন, নাকি?”

“না, বললেন, গুপ্তধন বেওয়ারিশ মাল নয়। তার উপযুক্ত ওয়ারিশান আছে। আর সেই ওয়ারিশানের গায়ে একটা ত্রিশূল চিহ্ন থাকার কথা। আপনি কি এই সব কিংবদন্তি মানেন?

“না, আমাদের কিংবদন্তিতে বিশ্বাস করায় নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে এটা আমি শুনেছি।”

বাবুরাম বলল, “কী শুনেছেন?”

“শুনেছি যে, রাজবংশে ত্রিশূল চিহ্ন নিয়ে এক বংশধর জন্মাবে। যে খুব ভাগ্যবান। আর এই কিংবদন্তির ঠেলাতেই তো বংশটা লোপাট হয়ে গেল মশাই।”

“কীরকম?”

ব্ৰহ্মগোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “এই সব কুসংস্কারের জন্যই তো আমরা একটা যুক্তিবাদী নাস্তিক ক্লাব তৈরি করেছি, তাতে বেশ কাজও হচ্ছে। ঘটনাটা হল, ভবেশ চৌধুরীর ছেলের পিঠে নাকি একটা ত্রিশূল চিহ্ন ছিল। সেই ছেলেই গুপ্তধন পাবে, এরকম একটা রটনা আছে। তার ফলটা হল কি জানেন? সেই ছেসের উপর গুডা-বদমায়েশদের নজর পড়ল। ছেলেকে বাঁচাতে ভবেশ চৌধুরী গা ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু প্রাণে বাঁচেনি। পালদিঘিতে তাকে গুন্ডারা পিটিয়ে মারে ডাকাত অপবাদ দিয়ে।”

“আর ছেলেটা?”

“তারও বেঁচে থাকার কথা নয়। বাপের সঙ্গে সেও মারা গিয়েছে বলে অনেকের ধারণা। আর যদি বেঁচে থেকেও থাকে, তবে এদেশে অনাথ শিশুদের যা হয় তারও সেই দশাই হয়েছে।”

“আপনার কথাটার মধ্যে যুক্তির অভাব আছে।”

“কীরকম?”

“গুন্ডারা ভবেশ চৌধুরীকে মারলেও তার ছেলেকে কিছুতেই মারবে না। তা হলে গুপ্তধনের সন্ধান দেবে কে?”

“তা অবিশ্যি ঠিক, তবে সেই ছেলের কোনও খোঁজখবর আজ অবধি পাওয়া যায়নি। পাঁচ-ছয় বছর আগেকার ঘটনা।”

“বেঁচে থাকলে সেই ছেলের এখন বয়স কত?”

“ভবেশ তার ছেলেকে নিয়ে পালায় অন্তত বারো-তেরো বছর আগে। তখন ছেলের বয়স হয় কী সাত, বেঁচে থাকলে তার এখন উনিশ-কুড়ি বছর বয়স।”

“আচ্ছা, একটা কথা বলবেন?”

“কী কথা?”

“ভূতেরা কি আমাদের চেয়ে বেশি জানে? তাদের জ্ঞানগম্যি কি মানুষের চেয়ে বেশি?”

“দেখুন মশাই, আপনাকে তো আগেই বলেছি যে, ভূতে বিশ্বাস করা আমাদের বারণ!”

“বিশ্বাস করতে বলছে কে? বিশ্বাস না করেই বলুন।”

“যদি পাঁচকান না করেন, সে বলতে পারি। পাঁচকান হলে নাস্তিক ক্লাবে আমার খুব অপমান হবে। চাই কী তাড়িয়েও দিতে পারে।”

“পাঁচকান করছেটা কে?”

“তা হলে শুনুন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভূতেরা এমন অনেক কিছু জানে এবং দেখতেও পায় যা মানুষের পক্ষে জানা বা দেখা সম্ভব নয়।”

“কী করে বুঝলেন?”

“আপনি কি জানেন যে, হরীতকী বানানে দুটো দীর্ঘ-ই আছে?”

“দুটো দীর্ঘ-ই? বলেন কী মশাই! দুটো দীর্ঘ-ই দিলে যে হরীতকী বড় ভারিক্কি হয়ে যাবে?”

“আপনি কি লেফটেনান্ট বানান জানেন?

“না তো?”

“রুট ওভ্যর অঙ্ক?”

“আজ্ঞে অঙ্ক বড় ভয়ঙ্কর জিনিস!”

“তার মানে, জানেন না। আমিও জানতুম না। কিন্তু খেঁদি জানে।”

“খেঁদি! খেঁদি কে?”

“গত ফাল্গুন মাসে আমার বাড়ির কাজের মেয়ে যমুনা তার বাবার অসুখের খবর পেয়ে দেশে গেল। পরদিন সকালেই খেঁদি এসে হাজির। বলল, কাজের লোক চাই কিনা। চাই শুনে, কাজে লেগে গেল। বলব কী মশাই, তাকে কাজের লোক বললে কিছুই বলা হয় না। চোখের পলকে বাড়িঘর সব পরিষ্কার ঝকঝকে করে ফেলল। তারপর রান্না!, আহা, কী বলব মশাই, সেই রান্নার স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। তবে কিনা অবাক কাণ্ডও হতে লাগল। কচুর শাক রান্না করেছে, বাড়িতে ইলিশ মাছের আঁশও নেই, অথচ খেঁদির রান্না করা করা শাকে দিব্যি ইলিশের মুড়ো!”

“বলেন কী?”

“তাই তো বলছি। গিন্নি অবাক হয়ে বললেন, ‘ও খেঁদি, ইলিশমাছ কোথায় পেলি?’ খেঁদি বলল, ওই তো বটতলার বাজার থেকে নিয়ে এলাম। বাজারে কখন গেল কখন এল তা কেউ-ই বুঝতে পারলাম না। বাড়িতে ঘি ফুরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু আমার ছেলের জন্মদিনে খেঁদি দিব্যি বিরিয়ানি রেঁধে খাওয়াল। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড হল, আমার মেয়ে সেদিন সকালে আমাকে হরীতকী বানান জিজ্ঞেস করেছিল। আমি আমতা-আমতা করছিলাম, খেঁদি ছুটে এসে বলল, “ও খুকি, হরীতকী বানানে কিন্তু দুটোই দীর্ঘ-ই। পরে অভিধান খুলে দেখি, তাই। তারপর আরও আছে। অনেকদিন আগে আমাদের একটা পেতলের ঘটি কুয়োয় পড়ে গিয়েছিল। সেটা বহু চেষ্টা করেও তোলা যায়নি। হঠাৎ দেখি, খেঁদি সেই ঘটি নিয়ে দিব্যি বালতি থেকে জল তুলে কাপড় ধুচ্ছে। ও খেঁদি, ও ঘটি কোথায় পেলি?’ খেঁদি ভালমানুষের মতো মুখ করে বলল, কেন, জল থেকে তুলেছি তো।’ “কী করে তুললি?’ তেমনই নির্বিকার মুখ করে বলল, ‘ঘটি তুলতে জানতে হয় গো।”

“আহা এতে প্রমাণ হয় যে, আপনার কাজের মেয়ে খেঁদি বেশ চৌকস এবং লেখাপড়াও জানে। কিন্তু তার সঙ্গে ভূতের সম্পর্ক কী তা তো বোঝা যাচ্ছে না।”

“বলেন কী? এখনও বুঝতে পারছেন না? আচ্ছা তেএঁটে লোক তো আপনি। এ তো জলের মতো সোজা ব্যাপার! তবে চান তো আরও বলতে পারি। সেদিন আমাদের বাড়িতে লাউ-চিংড়ি আর আলু পোস্ত রান্না। আমাদের নাস্তিক ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আত্মারাম যুক্তিবাদী লাউ-চিংড়ি বড় ভালোবাসেন বলে তাঁর বাড়িতে খানিকটা পাঠানো হয়েছিল খেঁদিকে দিয়ে। তা  খেঁদি
 গিয়ে দেখে, আত্মারামের বাড়িতে সেদিন মানকচু বাটা হবে। কিন্তু ঘরে নারকেল নেই। গাছে অবশ্য নারকেল আছে। কিন্তু পেড়ে দেয় কে? তখন খেঁদি বলল, ‘আমি পেড়ে দিচ্ছি।’ ঘটনাটা আত্মারামবাবু নিজের চোখে দেখেছেন বলেই বলছি। আত্মারামের জানলার পাশেই নারকেল গাছ। আত্মারাম তখন গেঁয়ো মানুষের কুসংস্কার নিয়ে একটা গুরুতর প্রবন্ধ লিখছিলেন। হঠাৎ দেখেন, খেঁদি শাড়ির আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে তরতর করে হেঁটে, লক্ষ করুন, বেয়ে নয় কিন্তু, স্রেফ হেঁটে নারকেল গাছে উঠে গেল এবং চার-পাঁচটা প্রায় ঝুনো নারকেল পটাপট পেড়ে হেঁটে নেমে এল।”

“তখন আত্মারামবাবু কী করলেন?”

“কিছুই করতে পারেননি, তিনি মূৰ্ছা গিয়েছিলেন। তবে পরদিন কাঁপতে-কাঁপতে এসে আমাকে বললেন, “খবরদার, এই মেয়েটিকে আর আমার বাড়িতে পাঠাবেন না। তা হলে আমি নাস্তিকতা হারিয়ে ফেলব। আর নাস্তিকতা চলে গেলে আমার বেঁচে থাকার কোনও মানেই থাকবে না। ওই নাস্তিকতাটুকু ছাড়া আমার আর আছেই বা কী বলুন।”

“তা তো বটেই, উনি উচিত কথাই বলেছেন!”

“তা হলে কি ধরে নেব যে, এই ঘটনার সঙ্গে ভূতের সম্পর্ক আপনি ধরতে পেরেছেন?”

“একটু ভূত-ভূত গন্ধ যে পাচ্ছি না, তা নয়। তবে নারকেল গাছে উঠলেও লোকে তো হেঁটে এভারেস্টেও ওঠে! আর কে না জানে, নারকেল গাছে ওঠার চেয়ে এভারেস্টে ওঠা ঢের শক্ত।”

“না মশাই, আপনার সঙ্গে কথা বলাই ঝকমারি। সব ঘটনা শোনার পরও আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?”

“আহা, আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?”

“রাগ হচ্ছে বলেই রেগে যাচ্ছি।”

“তা হলে কি ধরে নেব, আপনি খেঁদিকেই ভূত বলে প্রমাণ করতে চাইছেন?”

“প্ৰমাণ। প্রমাণের কী আছে? আপনার কি তাই মনে হচ্ছে না? যদি না হয়, তা হলে বুঝব আপনি একজন একগুয়ে লোক!তাও তো বলিনি ওই  খেঁদিই আমার ছেলেকে লেফটেনান্ট বানান আর
মেয়েকে  রুট ওভারের অঙ্ক শিখিয়ে দেয়। আপনিই তো ভূতেদের জ্ঞানগম্যির কথা তুললেন
, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না? এত জ্ঞানগম্যি কি ভূত ছাড়া কারও হতে পারে?”

“হাসালেন মশাই, জ্ঞানগম্যি থাকলেই যদি ভূত হয়, তবে তো দেশের যত লেখাপড়া জানা পণ্ডিত মানুষকেও ভূতের খাতে ধরতে হয়। সেটা কি ঠিক হবে ব্রহ্মগোপালবাবু? ধরুন, একজন লোক নারকেল গাছে উঠতে পারে, লেফটেনান্ট আর হরীতকী বানান জানে, রুট ওভারের অঙ্ক পারে, তা হলেই কি তাকে ভূত বলা যাবে?”

“আপনার হচ্ছে এঁড়ে তর্ক, সকালবেলাতেই মেজাজটা খিঁচড়ে দিলেন। আপনার কি ধারণা খাঁটি ভূত শুধু আপনিই দেখেছেন? আর আমাদের ভূত কি ভেজাল মাল?”

“তা আপনি যাই বলুন, আপনার খেঁদিকে আমার যেন হান্ড্রেড পারফেক্ট ভূত বলে মনে হচ্ছে না। ঠিক ভূত-ভূত ব্যাপারটাই নেই, যেন বড্ড স্পষ্ট একটা মানুষ। রক্তমাংসের মানুষকে কি ভূত বলে চালানো যায়?”

“ঠিক আছে। আপনি যখন আমার ভূতকে ভূত বলে স্বীকার কতে চাইছেন না, তখন আমিও আপনার ভূত অমিতেশকে স্বীকার করছি না। অমিতেশও মোটেই ভূত নয়।”

“বলেন কী মশাই? আমিতেশ যে একেবারে জ্যান্ত ভূত! অমিতেশ যদি ভূত না হন, তা হলে দুনিয়ায় ভূত বলে কিছুই নেই।”

“নেই বললেই হল? আজ খেঁদি থাকলে আপনাকে দেখিয়ে দিতুম। ভূত আছে কী নেই।”

দেখুন মশাই, খেঁদি-পেঁচিকে ভূত বলে চালানো সোজা কাজ নয়।”

ঠিক এই সময়ে হঠাৎ মাটি খুঁড়ে একটা বছরকুড়ির কালো মতো মেয়ে দেখা দিয়ে বলে উঠল, “ইঃ, খেঁদি ভূত নয় তো কে ভূত রে মিনসে? তোর ওই অমিতেশ? ঝ্যাঁটা মারি অমন ভূতের মুখে।”

অমনি একজন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বুড়োলোক শূন্য থেকে নেমে এসে বাঘের মতো গর্জন ছাড়ল, “মুখ সামলে। মুখ সামলে! বড্ড বাড় বেড়েছিস যে!”