৩
নগেনবাবু এলেই পটল বেশ খুশি হয়। হওয়ারই কথা। নগেনবাবু আসা মানেই মা লক্ষ্মীর আগমন। এমনকী লক্ষ্মী ঠাকরুনের নুপুরের বোলও যেন শুনতে পায় পটল। বলতে নেই নগেনবাবুর নজরও বড্ড উঁচু। নীচের দিকে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, তা যেন তার চোখেই পড়ে না।
এই তো মাসখানেক আগেকার কথা। রাত সাড়ে আটটা কী পৌনে নটা বাজে। গাঁ-গঞ্জের পক্ষে অনেক রাত। সন্ধের পরই পটল তার গদির দরজা আঁট করে বন্ধ করে বাঠাম তুলে দেয়, সঙ্গে ডবল ছিটকিনি আর ভারী তালা। তার পাহারাদার ঘ্যানার একে তো বয়স হয়েছে, তার উপর রাতকানা। তাই ঘ্যানা আর সন্ধের পর থাকতে চায় না। পটল তখন একা। তা তার যা কাজ-কারবার তাতে একাই সুবিধে। সাক্ষী থাকাটা কাজের কথা নয়। সন্ধের পর পটলের সব লেনদেন হয় জানালার একটা ঘুলঘুলি দিয়ে। গাঁয়ের গরিবগুঁড়বোরা ঘটিবাটি বাঁধা দিতে আসে দিনমানে। রাতের বেলা বেশির ভাগই ভারী খদ্দের। চোরাছ্যাঁচড়ারা তখন চোরাই মাল বেচতে আসে।
নগেনবাবু অবশ্য চোরছ্যাঁচড়াদের মধ্যে পড়েন না। তাঁকে কোন খাতে ধরা উচিত, তাও পটল জানে না। কারণ নগেনবাবুর শুধু বাঁহাতখানা ছাড়া আর কিছুই পটল দেখেনি। তবে বাঁ হাত যদি হতে হয় তবে, নগেনবাবুর মতো। ধপধপ করছে ফরসা হাত, লম্বা-লম্বা লতানে আঙুল, দু’আঙুলে দুটো আংটি। একটায় ইয়া বড় একটা পদ্মকাটা হিরে আর একটায় বিরাট সাইজের একখানা চুনি। কবজিতে সোনার ব্যান্ডের মতো সোনার ঘড়ি, গরদের পাঞ্জাবির হাতায় সুতোর কারুকাজ। এই পঞ্চান্ন বছর বয়স অবধি পটল এরকম বাঁ হাত আর দেখেনি। সেই বাঁ হাতেরই দু আঙুলে ধরা একটা গিনি খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পটলের সামনে ফেলে দিয়ে বললেন, “দেখুন তো, এর দাম কত হবে।“
পটল সোনাদানা, হিরে, মুক্তো যেমন চেনে, তেমনই মানুষও চেনে। তবে মানুষের পুরোটা তার চোখে দেখার উপায় নেই। রাতবিরেতে বাইরে থেকে যারা মালপত্র দস্ত করতে আসে, তারা মুখ দেখানো তেমন পছন্দও করে না। অনেকে আবার গামছায় মুখ ঢেকে রাখে। মুখ দেখার দরকার হয় না পটলের। অভ্যাসে কী না হয়। হাত দেখেই সে দিব্যি মানুষটাকে মেপে নিতে পারে। নগেনবাবুর বাঁহাতখানা দেখেই সে বুঝে গিয়েছিল, ইনি উঁচু নজরের মানুষ। নীচের দিকে কী হচ্ছে, তা গ্রাহ্যিই করেন না। পটল সুতরাং গিনির ওজন বেশ কমিয়েই ধরল। তারপর বলল, “আজ্ঞে, পানটান বাদ দিয়ে…””
নগেনবাবু অধৈর্য হয়ে বললেন, “হিসেবের দরকার নেই। কত দেবেন দিন।”
পটল ভয়ে-ভয়ে পাঁচ হাজার টাকা গুনে দিয়ে বলল, “আজ্ঞে এই পাঁচ হাজার। এর বেশি…”
“ঠিক আছে-ঠিক আছে, ” বলে নগেনবাবু টাকাটা নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।
খুব ভক্তির সঙ্গে মা লক্ষ্মীকে একটা পেন্নাম করল পটল। গিনিটার দাম হেসেখেলে চোদ্দো-পনেরো হাজার তো হবেই। তার বুকটা আনন্দেই ধড়ফড় করছিল।
দিনদশেক বাদেই আবার মা লক্ষ্মীর আগমন। সেই ঘুলঘুলি। সেই বাঁহাত। এবার বাঁহাতে ধরা এক ছড়া সোনার বোতাম, মুক্তো বসান।
“দেখুন তো, এটার দাম কত হবে।”
পটল ঘেসের হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপছিল। সে কী এমন পুণ্যির কাজ করেছে যে, মা লক্ষ্মী একেবারে তেড়েফুঁড়ে দিতে লেগেছেন। না, একথাও ঠিক যে, সে লোক ভাল। লোকে তার সম্পর্কে যাই বলুক, পটলের নিজের চোখে নিজের তেমন কোনও দোষ ধরা পড়ে না। ব্যবসার খাতিরে লোককে দু-চার টাকা ঠকাতে হয় বটে, তা বলে সে তো আর চুরি-ডাকাতি বা খুনখারাপি করেনি। আর মা লক্ষ্মীকে সে মান্যিগণ্যিও করে খুব।
পটল বোতামের ছড়াটা ওজনটোজন করে ভারী গদগদ হয়ে বলল, “আপনি মান্যগণ্য মানুষ, আপনার মর্যাদা রক্ষা করাটাও আমার কর্তব্য। এই ছয় হাজার টাকা দিচ্ছি। একটু হয়তো লোকসানই হবে আমার, তা হোক।”
নগেনবাবু ঠিক আগের দিনের মতোই “ঠিক আছে, ঠিক আছে, ” বলে টাকাটা নিয়ে উধাও হয়ে গেলেন।
বুকটা এমন উথালপাথাল করছিল পটলের যে, ভয় হল হার্টফেল না হয়ে যায়।
দশ-বারোদিন যেতে না-যেতেই একদিন রাত প্রায় দশটা নাগাদ পটলের ঘুলঘুলিতে নগেনবাবুর বাঁহাতকে আবার দেখা গেল। হাতটার সঙ্গে পটলের রীতিমতো ভাবসাব। দেখেই বুকটা ছলাৎ করে উঠল। ভক্তি গদগদ গলায় পটল বলল, “বাবু নাকি?”
“হু।”
“কী সৌভাগ্য!”
“আচ্ছা পটলবাবু, আগের দিন আপনি বললেন, আমি নাকি একজন মান্যগণ্য লোক! আপনি কি আমাকে চেনেন?”
পটল হেঃ হেঃ করে বলে, “তা কী আর চিনি না! মান্যগণ্য লোক চিনতে কি আমার ভুল হয়?”
“আপনি কি আমাকে দেখেছেন?”
“তা এক রকম দেখছি বইকি! আপনি খুব ফরসা, লম্বা মানুষ, একটু শৌখিনও বটে। আপনাকে খেটে খেতে হয় না। আপনার নজর খুব উঁচু।”
“হু, আপনার ঘটে বুদ্ধি আছে দেখছি!”
“কী যে বলেন বাবু! আমাদের মতো মনিয্যির আবার বুদ্ধি।”
“আপনি কি চোরাই জিনিস কেনেন?”
পটল জিভ কেটে শশব্যস্ত বলে, “আজ্ঞে না বাৰু, আমি ধর্মভীরু মানুষ। চোরাই মাল কিনে কি শেষে নরকে পচব?”
“কিন্তু আমিই তো আপনাকে চোরাই জিনিস বিক্রি করেছি।”
পটল হেঃ হেঃ করে হেসে বলে, “কী যে বলেন বাবু। আমি কী আর লোক চিনি না? ওই সুন্দর হাতে কি আর চুরিডাকাতি হয়? ও তো কার্তিক ঠাকুরের হাত।”
“আপনি কি জানেন যে, কার্তিক ঠাকুরই হলেন চোরদের দেবতা?”
পটল হাত কচলে বলে, “আর জানি না। তবে কিনা চোরদের হাত আমি খুব চিনি। যে সব বিচ্ছিরি-বিচ্ছিরি হাত বাবু! কড়া পড়া, কালো, নখের নীচে ময়লা, আঙুলেরও ছিরিছাঁদ নেই। হাত না থাবা বোঝা যায় না।”
“চোরদের হাত আপনি চিনলেন কী করে?”
“হেঃ হেঃ, বয়েস তো আর কম হল না বাবু। অভিজ্ঞতা বলেও তো একটা কথা আছে।”
“তার মানে আপনি চোরাই জিনিস কেনেন।”
পটল ভারী বিনয়ের সঙ্গে বল, “আজ্ঞে না বাবু। দেখেশুনে কখনও কিনি না। তবে মুশকিল কী জানেন, মালের গায়ে তো আর লেখা থাকে না যে, সেটা চুরির জিনিস কিনা।”
“তা তো ঠিকই।”
“না জেনে কিনলে আর দোষ হয় বাবু?”
“দোষ! না, দোষ হবে কেন? আসলে আমি একজন চোরকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।”
পটল ঘেস ভারী আহ্লাদের গলায় বলে, “তা বাবু চারদিকে চোরের অভাব কী? এ তল্লাটে চোর তো একেবারে গিজগিজ করছে। দরজার আড়ালে, জানলার আবডালে, দেয়ালের পিছনে, ঝোপেঝাড়ে আড়ে-আড়ে মেলা চোর।”
‘আমার তো চোরের পাইকারি ব্যবসা নেই মশাই। আমি একজন মার্কামারা চোরকেই খুজছি। তবে তার নাম জানি না, চেহারা কেমন তাও বলতে পারব না। তবে তার ডানহাতে কবজির একটু উপরে উল্কি দিয়ে লেখা আছে ‘কালী সহায়।”
পটল ঘেস হেঃ হেঃ করে হেসে বিগলিত মুখে বলল, “আজ্ঞে, এ তো খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো ব্যাপার।”
নগেনবাবুর বাঁহাতে হঠাৎ একটা সাত লহরীর সোনার সীতাহার দেখা দিল। হারটা পটল ঘেসের নাকের সামনে একটু বুলিয়ে নগেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “এটার দাম কত হবে, বলুন তো?”
পটলের চোখ দুটো চকচক করতে লাগল। হ্যারিকেনের নিস্তেজ আলোতেও হারখানার জেল্লা যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। গদগদ গলায় পটল বলে, “কত সরেস জিনিস বাবু। তা ধরুন, ফেলে ছড়িয়ে হাজারপঞ্চাশেক টাকা তো হবেই।”
“গঞ্জের মদন স্যাকরা দু’লাখ দিতে চেয়েছিল।”
শশব্যস্তে পটল বলে, “তা হলে বড় লোকসান হয়ে যাবে বাবু।”
“ঠিক আছে। পঞ্চাশ হাজারই দিন। তবে ওই সঙ্গে চোরের নামটাও।”
“যে আজ্ঞে।”
কাঁপা হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা গুনে নগেনবাবুর ফরসা হাতে ধরিয়ে দিয়ে পটল বলে, “বাবু, ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি, কথাটা পাঁচকান হলে আমার বড় বিপদ হবে।”
“কোনও ভয় নেই, রাখুন।”
“আজ্ঞে, ওই হাত হচ্ছে গোকুলের। অবিদ্যাঠাকুরের চেলা। কিন্তু আপনি কে আজ্ঞে? এ তল্লাটের মানুষ তো নন!”
“আমার নাম নগেন রায়, এর বেশি কিছু আপনার না জানলেও চলবে।”
“যে আজ্ঞে।”
মা লক্ষ্মী যে একেবারে ভাসাভাসি কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন, তাতে পটলের যে আনন্দ হচ্ছে না তা নয়। খুবই আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে একটা দুশ্চিন্তা ঢুকে গেল মাথায়। লোভে পড়ে নামটা ফাঁস করে দিতে হল। বিপদ হল গোকুল শুধু চোরই তো নয়। তার নানাবিধ দুষ্কর্ম আছে। খুনখারাপি তার কাছে জলভাত। বার দুই-তিন জেলও খেটেছে।
ঘুলঘুলির ঝাঁপ ফেলে দিয়ে পটল ঘেস টের পেল, তার বড় অসোয়াস্তি হচ্ছে। তার কারবারের মূলমন্ত্রই হচ্ছে, মক্কেলদের কথা ফাঁস না করা। বেইমানি করলে এ ব্যবসা টেকে না। গুন্ডা-বদমায়েশরা তো আর ছেড়ে কথা কওয়ার লোক নয়।
প্রায় বিশ ভরির সীতাহারখানা এক রকম মিনি মাগনাতেই পাওয়া গিয়েছে। ঠিক আনন্দটা ভিতরে ঠেলে উঠতে পারছে না। এখন চালে কাঁকড়, দুধে জল আর গুড়ে বালির মতোই ব্যাপার হল। রাতে ভাল করে খেতে পারল না পটল। ঘুমোতে গিয়ে দেখল শয্যাকন্টকী হচ্ছে। বুকে একটা ধড়ফড় ভাব। বারবার জল খেয়েও তেষ্টা মিটছে না।
নগেন রায় পটল ঘেসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে লম্বা-লম্বা পায়ে আমবাগানের দিকে হাঁটছিল। এদিকটা অন্ধকার। লোক চলাচল নেই বললেই হয়।
আমবাগানের ছায়ায় পা দিতেই একটা গাছের আড়াল থেকে একজন লোক বেড়িয়ে এল।
“কাজ হল কর্তা?”
নগেন রায় ডানহাতের দু’আঙুলে কপালের দু’ধারটা চেপে ধরে বলল, “হল, কিন্তু এখনও অনেক কিছু মনে পড়ছে না বুঝলি?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকটা বলল, “তা কী আর করবেন। সবটা তো আর আমাদের হাতে নয়। বেঁচে যে আছেন সেই ঢের।”
“এই বেঁচে থাকার তো অর্থই হয় না।”
“সবুর করুন, ধৈর্য ধরলে সব হয়।”
নগেন রায় গম্ভীর ভাবে বলল, “হু।”
তারপর আমবাগানের অন্ধকারে আনমনে হেঁটে যেতে লাগল। মুখে কথা নেই। কয়েক পা পিছনে মুশকো লোকটা, তার নাম দানু।
“জায়গাটি কি আপনার চেনা-চেনা লাগছে কর্তা?”
“না।“
“চন্দ্রঘোষপুর নামটা শুনেছেন আগা কোথাও?”
“তা হলে ঘুমের মধ্যে মাঝে-মাঝে চন্দ্রঘোষপুর নাম বলতেন কেন??”
“জানি না।”
“নফরগঞ্জ নামটাও বোধ হয় মনে নেই?”
“না।”
“গত এক মাসে তো তিন-চারবার এলেন, কেউ চিনতে পারল আপনাকে?”
“উহু।“
“নফরগঞ্জেও কেউ চিনতে পারেনি?”
“আর ওই উল্কি লেখা হাতটা। ওটা যেন কার হাত?”
“কে একজন গোকুল। সে আবার অবিদ্যাঠাকুর নামে কার চ্যালা।”
“তাকে ধরলে হয় না। সে হয়তো জানে।”
নগেন রায় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে বলল, “লাভ নেই।”
“লাভ নেই কেন? চেষ্টা করতে দোষ কী?”
“ওরকম অনেক কথা আমার হঠাৎ-হঠাৎ মনে পড়ে। কিন্তু আগুপিছু আর কিছু মনে না পড়লে শুধু একটা উল্কি আঁকা হাত দিয়ে কী হবে?”
“এমনও তো হতে পারে, লোকটা আপনাকে দেখেই চিনতে পারল আর আপনার আসল নাম ধরে ডেকে উঠল।”
“সেখানেই তো আমার ভয়।”
“ভয়! কীসের ভয় কর্তা?”
“লোকটা অর্থাৎ ওই গোকুল একজন চোর। ভদ্রলোকরা কেউ আমাকে চিনতে পারছেন না, কিন্তু হঠাৎ একজন চোর যদি চিনতে পারে, তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায় বল তো! তার চেয়ে আমি আসলে কে বা কেমন লোক, তা না জানাই ভাল।”
“তা হলে কি চন্দ্রঘোষপুরের সঙ্গে আপনার পাট চুকে গেল।”
“হু।“
“তা হলে ওই সুদখোর মহাজনটার কাছে দামি জিনিসগুলো ফেলে রেখে যাই কেন? আপনি অনুমতি করলে…”
আমবাগানের প্রান্তে ঝোপঝাড়ের ভিতরে একটা মোটরবাইক দাঁড় করানো। নগেন রায় মোটরবাইকের সিটের উপর উঠে বসে খুব আনমনে বলল, “হু।”
দানু চকিতে হাওয়া হয়ে গেল। একটু পরেই দূর থেকে দশ বারোটা কুকুরের প্রবল ঝগড়ার আওয়াজ আসতে লাগল। সে এমন খেয়োখেয়ি ঝগড়া যে, লোকের মাথা গরম হয়ে যাওয়ার কথা।
একে মাথা গরম, বুকে ধড়ফড়, তার উপর কুকুরের ওই চিৎকারে পটল ঘেস আর থাকতে পারল না। প্রথমে জানলা খুলে কিছুক্ষণ হ্যাটহ্যাট করল, তাতে কুকুরগুলো দমল না দেখে বাধ্য হয়ে পটল একটা টর্চ আর ঠ্যাঙা নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল, তারপর তার আর কিছু মনে নেই।
আধঘণ্টা বাদে দানু এসে নিঃশব্দে মোটরবাইকের পিছনের সিটে উঠে পড়ল। নগেন রায় বাইকটা চালু করে হুশ করে হাওয়া হয়ে গেল।
“হ্যাঁ রে, ডালের কি ফ্যান গালতে হয়?”
“আজ্ঞে না।”
“খেজুরের আমসত্ব খেয়েছিস কখনও?”
“আজ্ঞে না।”
“গোরুর গর্জন শুনেছিস?”
“সে কী করে হয়?”
“মরুভূমিতে ধানচাষ, সমুদ্রে পদ্মফুল ফোটা, নারীদের দাড়ি হওয়া কি সম্ভব?”
“আজ্ঞে না বড়বাবু।”
“এরকমই সব হচ্ছে রে।”
“বোকালোকা মানুষদের সুবিধের জন্য একটু ভেঙে বললে হয় না।“
“বললে কি বিশ্বাস করবি?”
“কেন, আপনার কোন কথাটা বিশ্বাস না করেছি বলুন তো, সেই যে গত মাঘ মাসে একদিন বললেন, ‘ওরে হারুরাম আজ চান করেছে, বিশ্বাস করিনি সেকথা? যদিও জানি হারুরামের হল স্থায়ী জলাতঙ্ক, জীবনে জল ছোঁয় না। তারপর ধরুন, গত চোত মাসে একদিন বললেন, ‘ওরে আজ নিধে গয়লার দুধে সর পড়েছে’, বিশ্বাস করিনি সেকথা? এমনকী, হাড়কেপ্পন দিগিনবাবু নতুন জুতো কিনেছেন, শুনেও আমরা অবিশ্বাস করিনি। করেছি কি? যদিও জানি দিগিনবাবু জুতোর বদলে পায়ে ন্যাকড়া বেঁধে হাঁটেন।”
“কিন্তু এবার যা বলব, তা কি বিশ্বাস হবে রে?”
“বলেই দেখুন না।”
“তবে শোন, আমার মনস্তাপ হয়েছে।”
“কী স্তাপ হচ্ছে?”
“মনস্তাপ।”
“সেটা কী রকম ব্যাপার বড়বাবু?”
“অনুশোচনা জানিস?”
“একটু-একটু।”
“এ সেই জিনিস।”
“সেটা হওয়া কি ভাল বড়বাবু? হলে চিকিৎসাও আছে নিশ্চয়ই।”
“আমার কী মনে হয় জানিস? মনে হয়, আমি বোধ হয় আর বেশিদিন নেই। লক্ষণ সুবিধের নয়।”
“কিন্তু বড়বাবু, গায়ে গতরে তো আপনি মোটেই টসকাননি। দিব্যি হাড়েমাসে চেহারা?”
“মনস্তাপ কি শরীর দেখে মাপা যায়? ও হল মনের ব্যাপার।”
“বিরজা কবিরাজকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে আসব কি?”
“বিরজা কবিরাজের কথা আর বলিসনি, তার এই নিরানব্বই বছর বয়স চলছে। সেদিন দুপুরে গিয়ে দেখি ভিতরের বারান্দায় ভাত খেতে বসেছে। বললুম, কবিরাজমশাই, একটা দরকার ছিল যে, ‘, তাতে বলল, রোসো বাপু, এই চানটা করেই আসছি।”
“সে অবিশ্যি ঠিক। সেদিন আমিও দেখলুম নিজের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ‘বাড়িতে কে আছেন? বাড়িতে কে আছেন?’ বলে হাঁকডাক করছেন।”
“মনস্তাপের কোনও ওষুধও নেই রে, যত দুষ্কর্ম করেছি, তার সবক’টার মনস্তাপ একসঙ্গে এসে চেপে ধরেছে।”
“দুষ্কর্ম। আপনি কি দুষ্কর্ম করেছেন নাকি বড়বাবু! এটা তো জানা ছিল না। শুনে ভারী অবাক লাগছে।”
“কী যে বলিস। সারাটা জীবন দুষ্কর্ম ছাড়া আর তো কিছুই করিনি। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, খুন, জখম, গুন্ডামি কোনটা বাদ আছে বল তো।”
“দুষ্কর্মের কথা বলছিলেন যে। তা দুষ্কর্মটা কোথায় সেটা বলুন।”
‘চুরি, ডাকাতি, খুনজখম কি দুষ্কর্ম বলে মনে হচ্ছে না তোর?”
দানু মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “তাই নাকি? এগুলোই দুষ্কর্ম বলছেন। আমি ভাবলুম না জানি আর কোনও গুরুতর কথা কইবেন।”
“তোকে নিয়ে আর পারা যায় না।”
“তা কী করব বলুন, চুরি, ডাকাতি বা খুন, জখম যে দুষ্কর্ম, তা তো জানা ছিল না আজ্ঞে।”
আজ সকালে কালীপ্রসাদ তার বউকেও মনস্তাপের কথাটা বলেছিল। বউ শুনে অনেকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, “কূলধর্ম বলে কি কিছু নেই? আমি হলুম কালো ডাকাতের মেয়ে। জন্ম থেকেই ডাকাতির পয়সায় খেয়ে এত বড়টি হলুম। আর তুমিও তো বাপু বিলু গুন্ডার ছেলে, তোলাবাজি আর ছিনতাইয়ের পয়সা খেয়ে পোস্টাই। মনস্তাপটা কিসের বলো তো?”
কালীপ্রসাদ জবাব দিতে পারেনি। তবে মনস্তাপ যে তার হচ্ছে এটাও সত্যি।
সন্ধের পর সে নগেনকে ডেকে বলল, “আজ তোমাকে একটা কথা বলব বাবা।”
“বলুন।”
“তুমি স্মৃতিভ্রংশ মানুষ। নিজের পরিচয় জান না। পালদীঘি হাটখোলার কাছে কয়েকজন খুনিয়া লোক তোমাকে যে-মার-মেরেছিল, তাতে তোমার বাঁচার কথা ছিল না।”
নগেন রায় বলে, “সে সব তো জানি।”
“তবু আর একবার ঘটনাগুলো স্মরণ করা ভাল। আমার কিছু ধন্দ হচ্ছে।”
“ঠিক আছে বলুন।”
“তোমার মাথায়, মুখে, পাঁজরে গুরুতর চোট হয়েছিল। তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর দুদিনের মাথায় তুমি মারা গিয়েছ বলে বেওয়ারিশ মড়ার গাড়িতে তোমাকে রেখে দেওয়া হয়। ভাগ্যিস একজন ডোম তোমাকে নড়াচাড়া করতে দেখতে পেয়েছিল। ডাক্তাররা কাটা-ছেঁড়া, সেলাই করে একটু খাড়া করেছিল তোমায়। বাকিটা করে বিরজা কবিরাজ। কিন্তু তোমার স্মৃতি ফিরে আসেনি। তুমি কে, নাম-পরিচয় কী, কোথায় বাস, কেউ জানে না। তারপর আমি তোমাকে নজর করি। তিনটে জিনিস দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। এক তোমার গায়ে প্রচণ্ড জোর, দুই হল, তোমার ক্ষুরধার বুদ্ধি আর তিন হল, তোমার বাঘের মতো সাহস। এই তিনটে একসঙ্গে একজনের মধ্যে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। যার গায়ে জোর আছে, তার বুদ্ধি থাকে না। যার বুদ্ধি আছে, তার হয়তো সাহস নেই। আর যার সাহস আছে, তার প্রায়ই বুদ্ধি বা শক্তি থাকে না। এই তিনটে একজনের মধ্যে থাকা এক অশৈলী ব্যাপার।”
“এসব কথা ফের মনে করানোর কী এমন দরকার হল?”
“দরকার আছে বাবা। এখন আমার মনে হচ্ছে, তোমার ভিতরে যে অসম্ভব গুণগুলো ছিল আমি তার সদ্ব্যবহার করতে পারিনি, তোমাকে দিয়ে আমি চুরি, ডাকাতি, গুন্ডামি করিয়েছি। আজ আমার মনে হচ্ছে, আমি ভুল করেছি। তোমার চেহারার মধ্যে একটা উঁচু বংশের ছাপ ছিল। সেটাকে আমি তেমন গায়ে মাখিনি।”
“সেইজন্যই কি আপনার মনস্তাপ হচ্ছে?”
“হ্যাঁ বাবা, হচ্ছে।”
“কিন্তু আপনি তো আমাকে কাজের জন্য যথেষ্ট মজুরিও দিয়েছেন। আমাকে তো কিছু না-কিছু করে পেট চালাতেই হত।”
মাথা নেড়ে কালীপ্রসাদ বলে, “না, বাবা, এসব তোমার কাজ ছিল না। আমি তোমাকে ভূল কাজে ব্যবহার করেছি।”
“অত ভাবছেন কেন? আমার স্মৃতি নেই, আমি কোন বংশের ছেলে, তাও জানি না। আপনিই আমাকে নগেন রায় নামটা দিয়েছেন। নইলে নিজের নামটাও তো আমার জানা নেই।”
“আমি অনেক ভেবে দেখেছি, তোমাকে তোমার জায়গায় না ফেরাতে পারলে আমার প্রায়শ্চিত্ত হবে না। তুমি ঘুমের মধ্যে দুটো জায়গার নাম বলতে। চন্দ্রঘোষপুর আর নফরগঞ্জ।”
“হ্যাঁ, কিন্তু দুটো জায়গাতেই তো অনেক ঘোরাঘুরি করলাম। কেউ আমাকে চিনতে পারল না।”
“আমার কি মনে হয় জান?”
“মনে হয় তোমার আগের চেহারাটা পালটে গিয়েছে। ডাক্তাররা কাটা-ছেঁড়া করলে হতেই পারে, তোমার মুখে অনেক সেলাই পড়েছিল। আর তোমার চুল আঁচড়ানোর জায়গাটাও হয়তো বদলে গিয়েছে। আর এমনও হতে পারে যে, আগে তোমার দাড়িগোঁফ ছিল। আমি দানুর কাছে শুনলাম, তুমি চন্দ্রঘোষপুরের পাট তুলে দিতে চাইছ। আর নাকি সেখানে যাবে না।”
‘গিয়েও তো লাভ হল না, কালীকাকা।”
“তোমার একটু ভুল হচ্ছে বাবা। আমার মনে হয়, তোমাকে যে লোকে চিনতে পারছে না, তার জন্য তোমার চেহারাই দায়ী। এখন তুমি বেশ ধোপদুরস্ত থাকো, তখন হয়তো তা থাকতে না। আরও একটা কথা, ওই গোকুল বলে হাতে উল্কি আঁকা যে লোকটার সন্ধান পেয়েছ, তাকেও একটু বাজিয়ে দেখা দরকার। আমার মন বলছে, তোমার শিকড় তুমি ঠিকই খুঁজে পাবে।”
নগেন রায় একটু ভ্রু কুঁচকে বলে, “তার মানে কি আপনি আমায় আর চাইছেন না?”
“না বাবা, চাইছি না। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, কোনও বড় ঘরের ছেলেকে দিয়ে অনেক কুকর্ম করিয়েছি। পাপের বোঝা আর আমি বাড়াতে চাই না।”
“আমার অতীতটা তো ভাল নাও হতে পারে।”
“তা পারে। তবে ভালমন্দ যাই হোক, তোমার আসল পরিচয়টা জানা দরকার। হয়তো তোমার আপনজনেরা তোমার পথ চেয়ে বসে আছে। বেশিদিনের কথা তো নয়, মাত্র ছয় বছর। এত তাড়াতাড়ি লোকের তোমাকে ভুলে যাওয়ার কথা নয়। জনে-জনে জিজ্ঞেস করে দেখো, তারা তোমাকে চিনতে পারছে কিনা। চেহারা যতই পালটে যাক, কেউ না-কেউ তোমাকে ঠিকই চিনতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।”
“আর যারা আমাকে মারতে চেয়েছিল, তারা যদি চিনতে পারে?”
কালীপ্রসাদ হঠাৎ থমকে গেল। তারপর বল, “হ্যাঁ, সেটাও বিপদের কথা। আমার খেয়াল ছিল না বাবা। তা হলে নিজেকে জাহির না করাই ভাল।”
“আপনি ভাববেন না কালীকাকা। স্মৃতিভ্রষ্ট হলেও আমি বোকা নই। নিজের মতো করে আমি একটা উপায় বের করার চেষ্টা করব।”
“কোরো বাবা। তুমি নিজেকে খুঁজে পেলে আমার অপরাধবোধের খানিকটা স্খালন হয়।”
দানু এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কাজটা কি ঠিক হচ্ছে বড়বাবু?”
“বেঠিকের কী দেখলি?”
“নগেনের মতো চার চৌকস লোক তো ভগবান গন্ডায়-গন্ডায় তৈরি করেননি। কালেভদ্রে দেখা মেলে। নগেন না থাকলে যে কাজকারবার লাটে উঠত।”
“তুই বুঝবি না, তোর মনস্তাপ নেই।”
“মনস্তাপ নেই কে বলল? খুব আছে বড়বাবু। বাড়িটা এখনও তিনতলা হল না। মেয়ের বিয়েতে মেহবুব ব্যান্ড আনতে পারলুম না। বউকে এরোপ্লেনে চাপাতে পারলুম না। মনস্তাপের কি শেষ আছে?”
“পাপে যে একেবারে ডুবে আছিস রে দানু। এবার একটু ভেসে উঠবার চেষ্টা কর।”
দানু ভারী আহ্লাদের গলায় বলে, “আজ্ঞে, সে ব্যবস্থাও কি করিনি বড়বাবু, এই যে দেখুন জটাধারীবাবার মাদুলি। হাতে দিয়ে বললেন, যা ব্যাটা যত খুশি পাপ কর। দিনান্তে একবার মাদুলি ডুবিয়ে এক ঘটি জল খাবি। সব পাপ কেটে যাবে।”