ভোলু যখন রাজা হল – ২

ব্ৰহ্মগোপাল ইদানীং একটু মুশকিলে পড়েছেন। মুশকিলটা হল, তিনি আজকাল মাঝেমধ্যে দৈববাণী শুনতে পাচ্ছেন। ব্ৰহ্মগোপাল অবশ্য এসব মানেনটানেন না। তিনি আত্মারাম যুক্তিবাদীর শিষ্য। আত্মারাম ঘোর নাস্তিক মানুষ। তিনি ভগবান, ভূত, জ্যোতিষবিদ্যা, হোমিওপ্যাথি এসব একেবারেই বিশ্বাস করেন না। তিনি এতই যুক্তিবাদী যে, নিজের পৈতৃক পদবি ভট্টাচার্য ত্যাগ করে নতুন পদবি নিয়েছেন যুক্তিবাদী। এই অঞ্চলে তাঁর মেলা শিষ্য রয়েছে। ব্ৰহ্মগোপালও তাঁদের একজন।

তবে ব্ৰহ্মগোপালের মুশকিল হল এই যে, তিনি একটু দুর্বল প্রকৃতির লোক। নাস্তিক বটে, কিন্তু কালীর থান বা শনির মন্দিরের সামনে দিয়ে গেলে একটু আবডাল হয়ে নমো না ঠুকেও পারেন না।

ব্ৰহ্মগোপালের বাড়ির পিছন দিকেই একটা বেশ বড়সড় জঙ্গলমতো আছে। ভয়ের জঙ্গল নয়, সাপখোপ, ভাম, হনুমান, শেয়াল থাকলেও বাঘ-ভল্লুক নেই। আর ওই জঙ্গলের মধ্যেই পুরনো রাজবাড়িটার ভগ্নস্তুপ পড়ে আছে। সকালের দিকে ব্ৰহ্মগোপাল প্রায়ই দাঁতন করতে-করতে রাজবাড়িতে চলে আসেন। দিব্যি নিরিবিলি জায়গা। বাড়িটা ভেঙে পড়লেও আগাছায় ভর্তি বাগানটা এখনও আছে। ফোয়ারার বাঁধানো ধারটাতে বসে দাঁতন করতে-করতে বিচিত্র সব পাখির ডাক শুনতে তাঁর খুবই ভাল লাগে। হাওয়া আছে, গাছের ছায়া আছে, নিস্তব্ধতা আছে।

তা প্রায় মাসছয়েক আগে এরকমই এক সকালে রাজবাড়ির ফোয়ারার ধারে বসে দাঁতন করতে-করতে প্রথম দৈববাণীটা শুনতে পেলেন ব্ৰহ্মগোপাল। কে যেন উপর থেকে গম্ভীর গলায় বলল, “শিবমন্দিরের চূড়া থেকে ত্রিশুলটা নামিয়ে আন।”

ব্ৰহ্মগোপাল চমকে উঠে চারদিকে তাকালেন। কেউ কোথাও নেই। মাথার উপর মস্ত একটা বেল গাছ। না, সেখানেও কাউকে দেখা গেল না। ব্ৰহ্মগোপাল উঠে চারদিকটা ভাল করে ঘুরে দেখলেন। ঝোপঝাড়, আড়াল-আবডাল কিছুই বাকি রাখলেন না। তবে কিনা পাজি  লোকদের
 তো ছলের অভাব হয় না। কেউ হয়তো আড়াল থেকে কথাটা বলেই সরে পড়েছে।

বাঁদিকে বাগানের এক কোণে জঙ্গলে ঢাকা শিবমন্দিরটায় এখন পুজোপাঠ হয় না। ভারী জীর্ণ দশা, বুক সমান নানা আগাছায় অর্ধেকটা ঢাকা পড়ে গিয়েছে। তবে শিবমন্দিরের চূড়ায় একটা ত্রিশুল আছে বটে। ব্রহ্মগোপাল মন্দিরের মাথায় ত্রিশূলটা ভাল করে দেখলেন। ত্রিশূলটা নামিয়ে আনতে বলল কে? আর কেনই বা বলল? আর বললেই বা তিনি ত্রিশূলটা নামাতে যাবেন কেন? তা ছাড়া, কথাটা যে তাঁকেই বলা হয়েছে, এমন নাও হতে পারে। এখানে অবশ্য তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। তবু কথাটা তাঁর গায়ে মাখার কোনও কারণ নেই।

মুশকিল হল, ব্ৰহ্মগোপাল দুর্বলচিত্ত মানুষ। দৈববাণীতে তিনি বিশ্বাস করেন না ঠিকই, তবে দুনিয়াতে কত কিছুই তো হয়। তাই তিনি একটা দোটানায় পড়ে গেলেন।

দোটানায় পড়লে ব্ৰহ্মগোপাল সর্বদাই গভীর ভাবে চিন্তা করেন। এখনও করলেন। করতে-করতে দাঁতনটা ছিবড়ে হয়ে গেল। মিনিটকুড়ি বাদে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যা থাকে কপালে, তিনি ত্রিশুলটা মন্দিরের মাথা থেকে নামিয়েই আনবেন।

তিনি ভগবান মানেন না বটে, কিন্তু তিনি মানেন না বলেই ভগবান থাকবে না, এ আবার কেমন কথা? সুতরাং বাই চান্স, ভগবান যদি কেউ একজন থেকেই থাকেন এবং দৈববাণীটা যদি তাঁরই প্রত্যাদেশ হয়ে থাকে, তা হলে প্রত্যাদেশটা মান্য করাই উচিত।

অনেকদিন দেওয়ালটেওয়াল বাওয়ার অভ্যাস নেই। বয়সও তত আর কম হল  না
। গত বোশেখে পঞ্চাশ পেরিয়েছেন। এই বয়সে এইসব হড়যুদ্ধ কি পোষায় না মানায়?

ব্ৰহ্মগোপাল শিবমন্দিরটার কাছে গিয়ে ভাল করে জরিপ করে বুঝলেন, মন্দিরের চূড়াটা উঁচু হলেও গম্বুজের ঢাল বেয়ে ওঠা শক্ত হবে না, কারণ বিস্তর লতানে গাছ মন্দিরটার গা বেয়ে উঠেছে।

দাঁতনটা ফেলে পরনের ধূতিটা টাইট করে মালকোঁচা মেরে নিলেন ব্ৰহ্মগোপাল। তারপর কোঁৎ ক্যোঁৎ করে গোটাকুড়ি ডন আর গোটাকুড়ি বৈঠক দিয়ে নিলেন। তারপর গিয়ে শিবমন্দিরের দেওয়ালের নানা কারুকাজের খাঁজে পা রেখে লতানে গাছপালা ধরে দিব্যি উঠতে লাগলেন উপরে। হাঁটু আর কনুইয়ের খানিকটা নূনছাল উঠে জ্বালা করছিল বটে, তবে তা গায়ে না মাখলেও চলে। শেষ দিকটায় একটু হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করতে হল। কিন্তু এক সময়ে ত্রিশূলের কাছে দিব্যি পোঁছেও গেলেন। ত্রিশূলটা ধরে দাঁড়িয়ে একটু হাঁফ ছাড়তে-ছাড়তে চারদিকটা অকিয়ে দেখছিলেন ব্রহ্মগোপাল।

শিবমন্দিরের চূড়াটা বেশ উঁচু। চারদিকটা অনেকখানি দেখা যায়। তবে দেখার বিশেষ কিছু নেই। সামনেই রাজবাড়ির ধ্বংসস্তুপ। দিনমানেও যেন অন্ধকার হয়ে আছে। নানা সময়ে লোকেরা এসে গুপ্তধনের আশায় রাজবাড়ির মেঝে, দেওয়াল সব খোঁড়াখুঁড়ি করে রাজবাড়ির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।

ব্ৰহ্মগোপাল একটু বিশ্রাম নিয়ে ত্রিশূলটা একটু নেড়েচেড়ে দেখলেন। পাকা গাঁথনিতে পোঁতা ত্রিশূলটা নড়াচড়ার কোনও লক্ষণই প্রকাশ করল না। ব্ৰহ্মগোপাল বলবান মানুষ নন, আবার খুব দুর্বল লোকও নন। দু’হাতে ত্রিশূলটা ধরে বারকয়েক রামঝাঁকুনি দিলেন। বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় অবশেষে ঢকঢক করে ত্রিশুলটা নড়তে লাগল। ব্ৰহ্মগোপাল “ওঠ বাবা, ওঠ। মৌরসী পাট্টা করে বসে থাকলে তো হবে না বাবা। দৈববাণী যখন হয়েছে, তখন তোর না উঠে উপায় নেই কিনা, ” বলে ত্রিশূলটাকে জপাতে লাগলেন। আর এই টানাহ্যাঁচড়ায় বিরক্ত হয়েই বোধ হয় ত্রিশলটা তার এতকালের বাসস্থান ছেড়ে ধীরে-ধীরে উপরে উঠতে লাগল। তুলতে গিয়ে ব্ৰহ্মগোপাল বুঝতে পারলেন, ত্রিশূলটা বেজায় ভারী। অন্তত মনখানেক তো হবেই।

অত ভারী ত্রিশূল নিয়ে চুড়ো থেকে নেমে আসা তো সোজা কথা নয়। তাই ত্রিশূলটা তুলে তিনি নীচে ফেলে দিলেন।

চূড়া থেকে সাফল্যের সঙ্গে নেমে ব্ৰহ্মগোপাল বিজয়গর্বে ত্রিশুলটা ঘাড়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। তাঁর ঘাড়ে অত বড় লোহার ত্রিশূল দেখে বাড়িতে একটু শোরগোল উঠল বটে, কিন্তু ব্ৰহ্মগোপাল তেমন কিছু ভেঙে বললেন না। বাড়ি যে ঘরখানায় পুরনো জিনিস ডাই করা থাকে, ত্রিশূশুলটা সেখানেই রেখে দিলেন।

ঘটনাটা আবার ঘটল মাসদুই বাদে। বর্ষা গিয়ে সবে শরৎ আসি-আসি করছে। চারদিকে ভারী মনোরম দৃশ্য। আকাশে ছেঁড়া মেঘের আনাগোনা, শিউলি ফুটছে, ছাতিমের গন্ধে চারদিক ম ম করে। যথারীতি এক সকালে রাজবাড়ির ফোয়ারার ধারে বসে ব্ৰহ্মগোপাল দাঁতন করছেন। ঠিক এই সময়ে উপর থেকে বজ্রগম্ভীর স্বরে দৈববাণীটা হল, “রাজবাড়ির পুকুরের ঠিক মাঝখানটায় ডুব দিয়ে এক খামচা মাটি তুলে আন।”

ব্ৰহ্মগোপাল যথারীতি চমকে উঠলেন। চারদিকে খোঁজাখুঁজি করলেন এবং নিয়মমতোই কাউকে দেখতে পেলেন না।

একবার দৈববাণীকে বিশ্বাস করে মেহনত কিছু কম হয়নি। মন্দিরের মাথায় উঠে ভারী ত্রিশূল নামাতে হয়েছে। পরীক্ষা করে দেখেছেন, ত্রিশূলটা সোনা-রুপোর নয়, নিকষ্যি লোহার পুরনো জংধরা জিনিস। মেহনতে পোযায়নি। এ আবার নতুন দৈবাদেশ নিয়ে কী করবেন ভেবে পেলেন না।

তবে ভাবলেন। অনেকক্ষণ বসে গভীর চিন্তা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আসলে তিনি খুব একটা শক্ত মনের মানুষ নন। দৈববাণীকে বিশ্বাস করার মানেই হয় না, অথচ অবিশ্বাসই বা করেন কী করে?

রাজবাড়ির দক্ষিণ দিকে একটা পুরনো মস্ত পুকুর আছে বটে, তবে ব্যবহার হয় না বলে অনেকটাই মজে গিয়েছে। জলের চেয়ে কাদাই বেশি। ওই পুকুরে নামা বিপজ্জনকও বটে। কাদায় গেঁথে গেলে উঠে আসা মুশকিল হবে।

নামবেন? নাকি নামবেন না?

বেশ কিছুক্ষণ দোলাচলে থাকার পর তিনি দাঁতনটা ফেলে ধুতিটা আঁট করে মালকোঁচা মেরে পরলেন। তার মনে হল, ওই দৈববাণী তাঁকে নিশির ডাকের মতো ডাকছে।

পুকুরটা রাজবাড়ির পিছন দিকে। চারদিকে বিস্তর গাছপালা এবং নিবিড় ঝোপঝাড়। ঝোপঝাড় ভেঙে, রাজবাড়ির ধ্বংসস্তুপ এড়িয়ে বেশ কষ্ট করেই তাঁকে পুকুরের ধারে পৌঁছতে হল। বাঁধানো ঘাটের চাতাল আর পৈঠা কবেই লোপাট হয়েছে। জলে কচুরিপানা ভর্তি। তার উপর গাছের পাতাটাতা পড়ে জল দেখবার জো নেই।

পুকুরের মাঝখানটা একটু আঁচ করে নিলেন ব্রহ্মগোপাল। বেশি ভাবতে গেলে কাজ হয় না। যা থাকে কপালে বলে নেমে পড়লে বরং কাজ হয়। কঠোর নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি মা কালীকে একটা নমো ঠকে খপ করে কাদাজলে নেমে পড়লেন।

আগে এই পুকুরে বেশ বড়-বড় মাছ হত। কিন্তু গাঁয়ের ছেলেরা তা সব তুলে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে। এখন দু’-চারটে চাঙাব্যাঙা মাছ হয়তো আছে। আর আছে ব্যাঙ আর জলঢোঁড়া। কচুরিপানা সরিয়ে-সরিয়ে ব্রহ্মগোপাল ধীরে-ধীরে ডুবজলে গিয়ে পরলেন।

পুকুরের মাঝখানটায় গিয়ে যখন পৌঁছলেন, তখন তার বেশ হাঁফ ধরে গিয়েছে। তিনি যতদূর জানেন, রাজবাড়ির পুকুর বেশ গভীর। হেজে মজেও গাড় খুব কম হবে না। বুক ভরে দম নিয়ে ব্ৰহ্মগোপাল ডুব দিলেন। জলের নীচে কালিঢালা অন্ধকার। কিন্তু ব্ৰহ্মগোপাল জানেন, দৈববাণী লঙ্ঘন করাটা খুব বিপজ্জনক।

একবারের চেষ্টায় অবশ্য তলায় পৌঁছতে পারলেন না। উঠে একটু দম নিতে হল। দ্বিতীয়বার অনেকটা তলায় গিয়েও থই পেলেন না। আবার ভেসে উঠে একটু দম নিতে হল। তিনবারের বার গোঁ ধরে গোঁত্তা খেয়ে এমন ডুব মারলেন যে, তার ব্ৰহ্মতালু গিয়ে পুকুরের তলায় কাদার মধ্যে ঢুকে গেল। এক খামচা মাটি মুঠোয় নিয়ে তিনি প্রাণপণে উঠতে লাগলেন। দম যায়-যায় অবস্থায় ভুস করে জলের উপরে তার মাথাটা ভেসে উঠল। কিছুক্ষণ হ্যাঁহ্যাঁ করে বড় বড় শ্বাস নিলেন। মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। ধীরে-ধীরে পুকুরের ধারে এসে ডাঙায় উঠে হাতের মুঠো খুলে দেখলেন। এক খাবলা কাদামাটির মধ্যে কী একটা যেন চকচকে জিনিস। মাটির ভিতর থেকে সাবধানে বের করে দেখলেন, একটা পেতলের বেশ বড়সড় চাবি। অবাক হয়ে ফের ভাবতে বসলেন। দৈববাণীতে চাবির কথা বলা হয়নি। শুধু মাটির কথাই বলা হয়েছিল। তবে চাৰিটাও যখন উঠেছে তখন কে জানে, তার মধ্যেও দৈব ইচ্ছা কিছু থাকতেই পারে।

এক মুঠো কাদা আর চাবিটা নিয়ে তিনি ভেজা গায়ে বাড়ি ফিরে এলেন।

এই মাসদুয়েক আগে ফের সেই ঘটনা। সেই রকমই সকাল, সেই রকমই ফোয়ারার ধারটিতে বসে ব্ৰহ্মগোপাল দাঁতন করছেন। পাখি ডাকছে, হাওয়া বইছে। ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ ফের মাথার উপর থেকে বজ্রনির্ঘোষের মতো দৈববাণী হল, আঠাশ পা, হেঁটে যা’।

ব্ৰহ্মগোপাল আগের মতো অতটা চমকালেন না। কারণ তাঁর দু’বারের অভিজ্ঞতা আছে। তবে এবারেও তিনি যথারীতি চারদিকটা দেখছিলেন। কেউ অবশ্য কোথাও নেই। এই দৈববাণীটা আগেকার দুটোর মতো কঠিন নয়। আঠাশ পা হাঁটা এমন কিছু শক্ত নয়। কাজের মধ্যেও পড়ে না। কিন্তু কোন দিকে আঠাশ পা হাঁটবেন, সে কথা দৈববাণী বলেনি। সোজা, না ডাইনে, না বাঁয়ে?

ব্ৰহ্মগোপাল ভাবতে বসলেন। অনেকক্ষণ ভেবে তাঁর মনে হল, নাক বরাবর সোজাই তাঁর হাঁটা উচিত। কিন্তু সমস্যা হল, সোজাসুজি হাঁটলে তাঁকে রাজবাড়ির ধ্বংসস্কুপের মধ্যে সেধোতে হয়। স্তুপাকার ইট, আবর্জনা, লোহালক্কড়ে জায়গাটা বেশ দুর্গম। কিন্তু দৈববাণী লঙ্ঘন করবার সাধ্য কী?

আবার মালকোঁচা আঁট করে নিয়ে, মাকালীকে স্মরণ করে বুক ঠুকে তিনি এক পা, দু’পা, তিন পা গুনে-গুনে এগোতে শুরু করলেন।

কিন্তু মুশকিল হল, কখনও উঠতে হচ্ছে, কখনও নামতে হচ্ছে বা ডিঙোতে হচ্ছে, সামনে দেওয়াল বা থাম পড়লে এঁকেবেঁকে যেতে হচ্ছে। পা গোনা কী সোজা কথা। বারতিনেক হোঁচটও খেয়ে উঠলেন। শুধু ইট, কাঠ, আবর্জনা তো নয়, বুকসমান আগাছা, বিছুটি পাতা, কাঁটা গাছ এসবও খেয়াল করতে হচ্ছে। না, আঠাশ পা হাঁটা যে এত শক্ত, তা আগে মোটেই অনুমান করতে পারেননি। তবে পা গুনতে ভুল হয় না তার। শেষ অবধি হাঁফসে পড়ে যেখানে আঠাশ পা শেষ হল, সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলেন, তিনি পুরনো ভাঙা দরবার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছেন। চারদিকে আবর্জনার ডাই। আর ঠিক তার সামনেই সেই নিরেট লোহার সিংহাসনখানা।

ব্ৰহ্মগোপাল খুব ভাবিত হলেন। দৈববাণীর মতলবটা ঠিক বুঝতে পারছেন না তিনি। যত দূর জানেন এই লোহার সিংহাসনখানা এই ঘরে বহু বছর ধরে পড়ে আছে। বড়সড় ঢালাই লোহার জিনিস। অন্তত বিশ, ত্ৰিশ মন ওজন তো হবেই। তার উপর মেঝের পাথরে পায়াগুলো গাঁথা। চোর-ডাকাতরা বেশ কয়েকবার এটা চুরি কর চেষ্টা করেছে, কিন্তু সুবিধে করতে পারেনি। দৈববাণী কি বলতে চাইছে যে, তিনি এই সিংহাসনখানা তুলে বাড়িতে নিয়ে যান? দৈববাণীর কি উচিত হচ্ছে তাঁকে এত কঠিন কাজের মধ্যে ফেলে দেওয়া।

ব্ৰহ্মগোপাল হাতজোড় করে ঊর্ধ্বপানে চেয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “বাবা দৈববাণী, তোমার আদেশ শিরোধার্য বাবা। কিন্তু এই লোহার সিংহাসন ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়ার মতো পালোয়ান যে আমি নই বাবা।”

সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর কথায় সায় দিয়ে টিকটিকি টিক টিক টিক করে ডেকে উঠল।

সিংহাসনটা নাড়াঘাঁটা করে লাভ নেই, তিনি জানেন। তবে এতোটা এগিয়ে এসে হাল ছেড়ে দেয়াটাও কাজের কথা নয়। তাই ব্রহ্মগোপাল সিংহাসনের উপর পড়ে থাকা ইট, বালি, আবর্জনাগুলো একটু সরিয়ে দিতে লাগলেন। তারপর ধূতির খুঁট দিয়ে ধুলো-ময়লা যত দূর সম্ভব সাফ করলেন। তারপর আশপাশটা বেশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। নেড়েচেড়েও দেখলেন, নট নড়নচড়ন। ঢালাই লোহার জিনিস, কারুকার্য বিশেষ নেই। সিংহাসনের পিছনে হেলান দেওয়ার জায়গায় একটু উপরের দিকে একটা গোল খোদাই করা চাকতি রয়েছে। তাতে অস্পষ্ট একটা সিংহের মুখ। সিংহাসনের পিঠের অংশটা অন্তত চার ইঞ্চি পুরু। তার একদম মাঝখানে একটা ফুটো রয়েছে। ব্রহ্মগোপাল অনেক ভেবে বুঝতে পারলেন, রাজাদের মাথায় ছাতা ধরার ব্যবস্থা করতেই ওই ফুটো। ছাতার ডাঁটি ঢুকিয়ে দিলেই দিব্যি ছাতা দাঁড়িয়ে থাকবে।

দৈববাণীর আদেশ তিনি পালন করছেন। কিন্তু তাঁর করণীয় কী, তা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তাই তিনি সিংহাসনের উপরেই গ্যাঁট হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন আর চোখ বুজে গভীর চিন্তা করতে লাগলেন। মনে নানা প্রশ্নও আসছে। প্রথম কথা, তিনি সত্যিই দৈববাণী শুনেছেন, না ভুল শুনছেন? দ্বিতীয় কথা, দৈববাণীর আদেশ পালন করে তিনি কি ঠিক কাজ করছেন, না ভুল? তৃতীয় কথা, দৈববাণী তাঁকে বিপদে ফেলতে চাইছে না তো? এত লোক থাকতে দৈববাণী তাঁকেই বা বেছে নিল কেন, সেটাও একটা প্রশ্ন। কিন্তু কোনও প্রশ্নেরই কোনও সদুত্তর না পেয়ে তিনি একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। তন্দ্রার মধ্যেই ফের যেন দৈবাণী হল, “কিছু পেলেনটেলেন নাকি মশাই?”

ব্ৰহ্মগোপাল সচকিত হয়ে চোখ মেলে দেখলেন, দৈববাণী নয়। সামনেই একজন খেঁকুড়ে চেহারার লোক দাঁড়ানো। লোকটার সবই সরু। হাত, পা তো বটেই, মুখটাও যেন সরুর দিকে। তার পায়ে গামবুট, মাথায় একটা টুপি, প্যান্টে গোঁজা শার্ট। হাতে একটা লাঠি। ব্ৰহ্মগোপাল অবাক হয়ে বলেন, “আপনি কে?”

লোকটা ফিচ করে একটা ফিচেল হাসি হেসে বলল, “আমি হলুম গে বাবুরাম আদিত্য। এদিককার লোক নই। গন্ধে-গন্ধে এসে পড়েছি, আর কী।”

“গন্ধ? কীসের গন্ধ মশাই?”

“কেন? গন্ধটা আপনি পাচ্ছেন না? আমি তো বেশ পাচ্ছি।”

ব্ৰহ্মগোপাল বড় করে শ্বাস নিয়ে গন্ধটা শোঁকার চেষ্টা করলেন। বারকয়েক প্রক্রিয়াটা চালিয়ে বললেন, “ছুঁচোর গন্ধ আর ভামের গন্ধের কথা বলছেন নাকি মশাই?”

বাবুরাম আদিত্য ফের ফিচ করে হেসে বলে, “আরে না মশাই। আসল গন্ধ হল সোনা-দানা আর হিরে-জহরতের গন্ধ। তা আপনি কি কিছু পেলেনটেলেন? রাজবাড়ি বলে কথা। আনাচে-কানাচে খুঁজলে কি আর এক-আধটা মোহর বা হিরে-জহরত পাওয়া যাবে না?”

ব্ৰহ্মগোপাল মাথা নেড়ে বললেন, “না মশাই, বহুকাল ধরেই লোকে ওসব খুঁজে যাচ্ছে। কেউ কিছু পেয়েছে বলে শুনিনি!”

লোকটা মুখ শুকনো করে বলে, “এঃ, তা হলে যে আমার বড় লোকসান হয়ে যাবে মশাই! রোজ পঞ্চাশ টাকার টিকিট কেটে রাজবাড়িতে ঢুকতে হচ্ছে। গত চারদিন দু’শো টাকা বেরিয়ে গিয়েছে মশাই। এখন অবধি একটা মুন্ডুভাঙা চিনেমাটির পুতুল, তিনটে তামার পয়সা, একটা পুঁতির মালা আর একটা কৌটোয় কয়েকটা কড়ি খুঁজে পেয়েছি।”

ব্ৰহ্মগোপাল অবাক হয়ে বললেন, “টিকিট। রাজবাড়িতে ঢুকলে টিকিট লাগে নাকি?”

“কেন আপনার লাগেনি?”

“কই না তো। টিকিটের কথা জন্মে শুনিনি।”

বাবুরাম কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল ব্ৰহ্মগোপালের দিকে। তারপর একটা ঢোক গিলে বলল, “দিন চারেক আগে রাজবাড়িতে ঢুকে একটু উঁকিঝুঁকি মারছি, তখন তিনজন লোক রে রে করে তেড়ে এসে আমাকে একেবারে পেড়ে ফেলল, এই মারে কি সেই মারে। তারা নাকি রাজবাড়ির কেয়ারটেকার। গুপ্তধন খুঁজছি শুনে বলল, “গুপ্তধন কি মাগনা নাকি? পঞ্চাশটাকার টিকিট কেটে তবে পারমিশন পাওয়া যায়। তিনজনের নাম হল গোকুল, নবু আর নিতাই।”

ব্রহ্মগোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ও নামের কাউকে চিনি না। আর রাজবাড়ির কোনও কেয়ারটেকারও নেই। আপনি কোনও জোচ্চোরের পাল্লায় পড়েছেন।”

“অ্যাঁ!” বলে লোকটা কাঁদো-কাঁদো মুখ করে ধুলোবালির মধ্যেই ধপ করে বসে পড়ল। তারপর করুণ গলায় বলল, “আমার যে বড় লোকসান হয়ে গেল মশাই।”