ভোলু যখন রাজা হল – ১

সকালবেলাতেই কেউ এসে রঙ্গরসিকতা করলে কারই বা ভাল লাগে? ভোলুরও লাগল না। ভোলু বা ভোলার অবস্থা মোটেই সুবিধের নয়। বিধবা পিসি নবদ্বীপবাসিনী দেহরক্ষার আগে একদিন তাকে ডেকে বলল, “ওরে ভোলু, তোর তিন কূলে কেউ কিন্তু নেই। এই আমি তোর পিসি তোকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি বটে, কিন্তু আজ সত্যি কথাটা বলে যাই বাছা, আমিও তোর কেউ নই।

তোর বাবা আমার কাছে তোকে গচ্ছিত রেখে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল কে জানে! পরে শুনেছি সে ডাকাতি করতে গিয়ে কোন গেরস্তুবাড়িতে বেকায়দায় ধরা পড়ে, তারপর বাড়ির লোকজন তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তা বাছা, রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও বুকে করে মানুষ তো করেছি। কিন্তু আমার আর সম্বল কী বল? তোকে মানুষ করতে গিয়ে মহাদেব তেজপালের কাছে বাড়িটা বাঁধা রাখতে হয়েছে এই কড়ারে যে, আমি মলেই সে এ বাড়ির দখল নেবে। সুতরাং এ বাড়িটাও আর ভোগে লাগবে না। সব খুলে বলে দিলুম বাছা, যতদিন আমি বেঁচে আছি, তুইও থাক। আমি মলে নিজের আখের তোকে নিজেকেই গোছাতে হবে।”

এসব শুনে তো ভোলু হাঁ হয়ে গেল।

পিসি গত হয়েছে ছয় মাস হল। যথারীতি মহাদেব এসে চড়াও হল। একা নয়, সঙ্গে চার-পাঁচটা খুব ঠাণ্ডা মাথার গুন্ডা।

হাতে-পায়ে ধরে কটা দিন সময় চেয়ে নিয়েছিল ভোলু? তা সেই সময়ও শেষ হয়ে এল বলে। পিসির অস্থাবর যা ছিল, কিছু গয়নাগাটি আর বাসনকোসন, রুপোর ঠাকুরের থালা-গেলাস আর তক্তপোষ, আলনা, আলমারি সব বিক্রি করে কয়েকটা দিন প্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে হল। দু’দিন আগে সেই টাকাও ফুরিয়েছে। পিসি যে এমন পথে বসিয়ে যাবে, কে জানত?

ঘটনাটা ঘটল সকালের দিকেই। নিত্যিকার মতো খুব প্রাতঃকালেই তার ঘুম ভেঙেছে। উঠে দাঁতন করে, প্রাতঃকৃত সেরে কিছুক্ষণ দাওয়ায় বসেও থেকেছে। বসে থাকতে থাকতে তার মনে হল, দূর ছাই, আমার তো কাজকর্ম কিছুই নেই। শুধু-শুধু হাঁ করে বসে থেকে হবেটা কী? তাই সে ঘরে গিয়ে চাটাইয়ের শয্যায় শুয়ে ফের একটা ঘুম দিল।

ঘুম ভাঙল দরজায় ধাক্কাধাক্কির শব্দে। বাইরে একাধিক কণ্ঠ বেশ হেঁকে বলছে, “কেউ কি আছেন মশাই?”

ভোলু উঠে কপাট খুলে হাঁ। দাওয়ায় তিনটে বিটকেল লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। একজন বেঁটে বকেশ্বর, একজন লম্বা আর সুড়ুঙ্গে, তৃতীয়জন বেশ তাগড়াই চেহারার।

বেঁটেজনই বলল, “এটাই তো নবদ্বীপবাসিনী দেব্যার বাড়ি?”

“হ্যাঁ, তা কী চাই? তিনি কিন্তু গত হয়েছেন।”

“আহা, তিনি গত হলে হয়েছেন। তাতে আমাদের কী-ই বা এল আর গেল। তাকে নিয়ে তো কথা নয় মশাই! কথাটা হল, রাজামশাই আছেন কি? রাজা রূপেণ চৌধুরী?”

ভোলু বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনারা ভুল বাড়িতে এসেছেন। এখানে ও নামে কেউ থাকে না। এই প্রাতঃকালে খামোখা কাঁচা ঘুমটা ভাঙালেন?”

লাোকটা চোখ গোল করে বলল, “প্রাতঃকাল?”

“প্ৰাতঃকাল নয় তো কী?”

“প্রাতঃকালে কি আর অন্য বিষয়কর্ম নেই যে, সে এই নফরগঞ্জের মতো এঁদো পাড়াগাঁয়ে সারা দিনমান শিকড় গেড়ে বসে থাকবে? তার আরও বিস্তর গুরুতর কাজ আছে মশাই। এখন বেলা প্রায় দশটা বাজে।”

ভোলু বাইরের দিকে চেয়ে দেখল, কথাটা ন্যায্যই বটে। উঠোনে বেশ তেজালো রোদ। আমতা-আমতা করে সে বলল, “তা আজ একটু বেলা হয়ে গিয়েছে বটে, কিন্তু আপনারা যেন কোন রাজাগজাকে খুঁজছেন! এটা কি কোনও রাজপ্রাসাদ বলে মনে হচ্ছে আপনাদের?”

“আহা, রাজপ্রাসাদ খুঁজব কোন দুঃখে? আমরা রাজা রূপেশ চৌধুরীকে খুঁজছি।”

“ওই তো বললুম, আপনারা ভূল বাড়িতে এসেছেন, ভুল পাড়ায় এসেছেন, ভুল গাঁয়েও এসে পড়েছেন। এখানে কস্মিনকালেও কোনও রাজাগজার বাস ছিল না।”

বেঁটে, শুটকো আর হোঁৎকা তিনজন নিজেদের মধ্যে একটু তাকাতাকি করে নিল। তারপর বেঁটেজনই ফের বলল, “তা হলে কি মশাই এ গাঁয়ের নাম নফরগঞ্জ নয়? বিষ্ণুপুর থানা, জেলা বাঁকড়ো?”

“তা নফরগঞ্জ হবে না কেন? থানা বিষ্ণুপুরই বটে, আর জেলা তো বাঁকড়ো বলেই জানি। তবু কোথাও আপনাদের একটা ভুল হচ্ছে।”

“আচ্ছা, এটা নিৰ্যস নবদ্বীপবাসিনী দেব্যার বাড়িই তো?”

“তাও বটে।”

“তা হলে তো অঙ্ক একেবারে দুইয়ে-দুইয়ে চার। কী বলিস রে নিতাই?”

শুঁটকো লম্বা লোকটাই নিতাই, ঘাড় নেড়ে বলে, “অবিদ্যাঠাকুরের চিরকূটটা বের করে মিলিয়ে নে না। কী বলিস রে নবু?”

তাগড়াই লোকটা কটমট করে অনেকক্ষণ ধরে ভোলুকে দেখছিল। এবার বল, “আমার তো মনে হচ্ছে এ ব্যাটাই রাজামশাইকে লুকিয়ে রেখেছে। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে খুঁজে দেখলেই তো হয়।”

কথাটা শুনে গরম খেয়ে ভোলু বলল, “ইস, ধাক্কা দেবে! কেন, দেশে আইন নেই? পুলিশ নেই?”

তাগড়াই লোকটা বলল, “বিষ্ণুপুর থানা তিন মাইল দূর। আর আইনবাবাজি তো কেতাবে থাকেন। উকিল-মুহুরি ছাড়া তার নাগাল পাওয়া কঠিন। বুঝলে! এবার আসল কথাটা ভেঙে বলো তো বাপু! আমাদের রাজাবাহাদুরকে গুম করে রাখোনি তো! নাকি মেরে মাটিতে পুঁতে দিয়েছ। তোমাকে দেখে তো মোটেই ভাল লোক বলে মনে হচ্ছে না! ঠিক বলেছি রে গোকুল?”

বেঁটে জনেরই নাম গোকুল। এবার সে বলল, “ধানখেতে বেগুন খুঁজে কী করবে বল? কলিযুগে কি ভাল লোকদের থাকার কথা? আমরাই বা কোন ভাল লোক বল! ফৌজদারি মামলায় দু’চার বছরের মেয়াদ আমরা কে না খেটেছি?”

ভোলু এবার ভয় বেয়ে বলল, “দেখুন, এর পর কিন্তু আমি চেঁচিয়ে গাঁয়ের লোক জড়ো করব। এ গায়ের লোক কিন্তু খুব গুন্ডা!”

বেঁটে লোকটা অর্থাৎ গোকুল ভারী দুঃখের সঙ্গে বলল, “কেন হে বাপু, আমরা কি চুরি-ডাকাতি করতে এসেছি, না তোমাকে মেরেছি-ধরেছি যে, আমাদের গুন্ডা ডেকে পেটাই করাবে? গুরুতর কাজেই এসেছি বাপু, রাজকার্যও বলতে পার। আমাদের রাজামশাইকে নিয়ে গিয়ে অবিদ্যাঠাকুরের কাছে হাজির না করলেই নয়।”

ভোলু বলল, “তা মশাই যেখানে-সেখানে রাজাগজা খুঁজলেই তো, হল না, নবদ্বীপবাসিনীর বাড়িতে সেই ছোটটি থেকে এই এত বড়টি হলাম, এখানে রাজাগজা দূরে থাক, রাজার গায়ের আঁশটুকুও কখনও দেখিনি।”

তিনজনে ফের নিজেদের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে নিল। তারপর গোকুল বলল, “বাপু হে, আমাদের অবিদ্যা ঠাকুর হলেন বিদ্যের জাহাজ, অনেক গুনেগেঁথে, বংশলতিকা ঘেঁটে, খোঁজখবর নিয়ে তবেই তিনি আমাদের পাঠিয়েছেন। কী বলিস রে নবু?”

‘তা আর বলতে! আজ অবধি অবিদ্যাঠাকুরের মুখ থেকে একটা ভুল কথা বেরয়নি, ঠিক বলছি রে নিতাই?”

নিতাই বিমর্ষ মুখ করে বলল, “অবিদ্যাঠাকুর বলে রেখেছেন, ঠিকঠাক লোক হলে তার মেরুদণ্ডের নীচের দিকে একটা ছোট্ট ত্রিশূলের দাগ থাকবে।”

“ওই তো বললুম, যাকে খুঁজছেন সে এখানে মোটেই নেই। গাঁয়ের অন্য সব বাড়িতে খুঁজে দেখুন, অন্য গাঁ বা জেলাতেও খুঁজতে পারেন।”

নবু মানে হোঁৎকা লোকটা এবার বলল, “বাপু, না হয় মানলুম যে, আমাদের রাজামশাই এখানে নেই। কিন্তু এই আমরা তিনজন হা-হয়রান হয়ে এত দূর এসেছি। ফেরার পথটার পাল্লাও বড় কম নয়। তা একটু জল খাওয়াতে পার?”

ভোলু বলল, “তা পারব না কেন? দাওয়ায় বসুন, জল এনে দিচ্ছি। গাছে শশা আছে, কয়েকটা পেড়ে দেব কি?”

তিনজন প্রায় সমস্বরে বলে উঠল, “হ্যাঁ-হ্যাঁ, শশা চলবে।

শুধু শশা নয়, ক’দিন আগে বড় ধামার এক ধামা মুড়িও দিয়ে গিয়েছিল পিসির গঙ্গাজল সই।

তিনজনে বেশ তৃপ্তি করে শশামুড়ি আর জল খেয়ে  ঢেঁকুর
 তুলে উঠে পড়ল। গোকুল বলল, “তা হলে আসি বাপু? খররটা যে ভুল ছিল, তা অবিদ্যা ঠাকুরকে বোঝানো বড় শক্ত হবে। কিন্তু কী আর করা!”

লোকগুলো চলে যেতেই দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিল ভোলু। আর সঙ্গে-সঙ্গে বিপদটা ঘটল। দরজার জোর নাড়া খেয়ে উপর থেকে একটা গোদা টিকটিকি থপ করে ভোলুর ব্রহ্মতালুতে এসে পড়ল।

মাথায় টিকটিকি পড়াটা এমন কিছু গুরুতর ঘটনা নয়। প্রায়ই টিকটিকিরা মানুষের মাথায়, গায়ে পড়েই থাকে। কিন্তু আজ কী হল কে জানে, ভোলুর মনে হল তার মাথায় যেন বাজ পড়েছে। “বাপ রে, ” বলে মাথা চেপে ধরে চোখে অন্ধকার দেখতে-দেখতে সে উবু হয়ে বসে পড়ল। কানে  ঝিঁঝিঁর
 ডাক। বড়সড় গোদা চেহারার টিকটিকিটা তার হাত বেয়ে নেমে পালিয়ে গেল। আর হঠাৎই ভোলুর মনে  পড়ে গেল
, অনেকদিন আগে তার পিসি তাকে বলেছিল, “এ বাবা ভোলু, তোর কিন্তু একটা বেশ পোশাকি নামও আছে। ভারী বাহারি নাম, রূপেশ চৌধুরী। আমার কি ছাই অত মনে থাকে! একটা কাগজের টুকরোয় লিখেও রেখেছিলুম, কিন্তু সেটাও কোথায় গেল কে জানে। তা এই গতকাল মহেশ গয়লা দুধের পয়সার জন্য তাগাদা দেওয়ায় হারানো রুপোর সিঁদুরের কৌটোটা বলাই স্যাকরার কাছে বিক্রি করতে যাচ্ছিলুম। তখনই কৌটোটার মধ্যে দুটো রুপোর টাকা আর ভাঁজ করা এই কাগজটা পাই। এই দ্যাখ, এতে লেখা আছে ভোলুর আসল নাম হল রূপেশ চৌধুরী। তা বাবা, চিরকুটটা রেখে দে।“

ভোলু তাড়াতাড়ি উঠে তার টিনের বাক্সটা হাতড়ে দেখল। ভাগ্য ভাল যে, তার বেশি জিনিসপত্র নেই। বাক্সের তলায় একটা পুরনো খবরের কাগজ পাতা রয়েছে। তারই নীচে চিরকুটটা।

ভোলু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে লোকগুলোকে খুঁজল। ভিখুরামের দোকানে জিজ্ঞেস করে জানল, তিনটে বিটকেল লোক হাটখোলার দিকে গিয়েছে বটে।

ভোলু পাইপাই করে ছুটল। হাটখোলা পেরিয়ে খানিক দূর যেতেই দেখতে পেল, অনেকটা দূরে তিন মূর্তিমান হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে।

সে হাত তুলে চেঁচাতে লাগল, “ও মশাইরা, ও গোকুলবাবু! ও নিতাইবাবু! ও নবুদাদা! যাবেন না, গুরুতর কথা আছে।”

শেষ অবধি ডাক শুনে লোক তিনটে থেমে তার দিকে ফিরে তাকাল। ভোলু হাঁফাতে-হাঁফাতে গিয়ে বলল, “একটা বড় ভুল হয়ে গিয়েছে মশাই। দয়া করে ফিরে চলুন। কথা আছে।”

গোকুল বলল, “তা বাপু, ব্যাপারটা কী? লোক ডেকে পেটাই করাবে নাকি?”

“না-না মশাই। ফিরে চলুন।”

তা তিনজন ফিরে এল। ভোলু তাদের ছেঁড়া মাদুর পেতে দাওয়ায় বসিয়ে ভারী অপরাধী মুখ করে বলল, “হঠাৎ করে একটা কথা মনে পড়ে যাওয়াতেই আপনাদের ডেকে আনা। অপরাধ নেবেন না।”

গোকুল বলল, “আর একটু ভেঙে বললে হয় না?”

“বলছি মশাই। আপনারা বিদায় হওয়ার পর দোর দিতেই হঠাৎ এই অ্যাত্তো বড় একটা গোদা টিকটিকি আমার মাথায় এসে পড়ল।”

তিনজন প্রায় সমস্বরে বলে উঠল, “অ্যাঁ! মাথায় টিকটিকি পড়েছে?”

“যে আজ্ঞে ।”

গোকুল ব্যাকুল হয়ে বলে, “বলো কী? মাথায় টিকটিকি পড়া যে রাজলক্ষণ!

কী বলিস রে নিতাই?”

ভোলু বলে, “রাজলক্ষণ কিনা জানি না মশাই। তবে গোদা টিকটিকিটা ব্ৰহ্মতালুর উপর পড়ায় যেন বজ্রাঘাত হয়ে গেল। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। আর তখনই মনে পড়ল, রূপেশ চৌধুরী নামটা তো আমারই। সেই কবে পিসি বলেছিল একদিন, তবে বাহারি নাম দিয়ে আমার আর কাজ কী বলুন! ভোলু নামেই আমার দিব্যি চলে যাচ্ছে! রূপেশ চৌধুরী নামটাও তাই ভুলেই মেরে দিয়েছিলুম।”

গোকুল চোখ গোল বল, “তবে তো বাপু, তুমিই আমাদের হারানিধি! রাজা রূপেশ!”

ভোলু মাথা নেড়ে বলে, “না মশাই, আমার রাজা হওয়ার কোনও উপায় নেই। পিসির কাছে শুনেছি আমার বাবা ভবেশ চৌধুরী ডাকাত ছিলেন। ডাকাতি করতে গিয়েই মারা পড়েন।”

তিনজনে ফের মুখ তাকাতাকি করে নিল। নবু গম্ভীর মুখ করে বলে, “এই সেই। সব সক্ষণ মিলে যাচ্ছে।”

সুড়ঙ্গে নিতাই একটা বড় করে শ্বাস ফেলে বলল, “আমি সেই কখন থেকে ছোকরার গায়ে একটা রাজা-রাজা গন্ধ পাচ্ছি!

গোকুল নিশ্চিন্তের শ্বাস ফেলে বলল, “যাক বাবা, দুইয়ে-দুইয়ে চার কেন, চারে-চারে আট, আটে-আটে ষোল অবধি মিলে গেল।”

ভোলু বলে, “দুর মশাই, আপনারা তলিয়ে বুঝছেন না। আমি রাজার ছেলে নই, ডাকাতের ছেলে।”

হোঁৎকা নবু দাওয়ায় তার বাঘা হাতের একটা থাবড়া বসিয়ে বলল, “বুঝলে হে ছোকরা, ডাকাতের ছেলে না হলেই বরং মনে করতুম যে তুমি আসল রাজাই নও।”

কাহিল গলায় ভোলু বলে, “তার মানে?”

গোকুল ঠান্ডা গলাতেই বলল, “ওরে বাপ, রাজা আর ডাকাতে তফাত কি বলতে পার? ডাকাত যখন খুব বড় ডাকাত হয়ে দাঁড়ায়, তখনই লোকে তাকে রাজা বলে মান্যিগণ্য করতে থাকে। ডাকাতের যা কাজ, রাজারও সেই একই কাজ। দলবল নিয়ে অন্যের উপর চড়াও হওয়া, মারকাট আর লুঠপাট করে পরদ্রব্য নিয়ে আসা। সুতরাং তোমার বাবা ভবেশ চৌধুরী তো কুলকার্য করে গিয়েছেন বাপু, যাকে বলে রাজধর্ম পালন করা।”

এসব কথা শুনে ভোলু কেমন ভ্যাবলা হয়ে গেল। কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, “এসব কী বলছেন, কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”

সুড়ুঙ্গে নিতাই বলে, “ওরে গোকুল, সময় নষ্ট না করে ছোকরার মেরুদণ্ডের নীচের দিকে ত্রিশূলের দাগটা আছে কিনা যাচাই করে নে। অবিদ্যা ঠাকুর পইপই করে বলে দিয়েছেন। অসুষ্ঠ পরিমাণ একটা ত্রিশুলের ছাপ তিনি নাকি দেখেই রেখেছিলেন।”

ভোলু কিছু বুঝবার আগেই হঠাৎ তিনজন তার হাত-পা পাকড়ে ধরল, তারপর জামা তুলে কোমরের কষি নামিয়ে কী একটা চিহ্ন দেখে নিয়ে সোল্লাসে বলে উঠল, “আছে! আছে! আছে! এই তো আমাদের রাজা।”

এরকম আচমকা হামলায় ভারী রেগে গিয়ে ভোলু বলে, “এটা কী হল মশাই?”

তিনটে বিটকেল লোক হঠাৎ তার সামনে উপুড় হয়ে পড়ে ঢিপঢিপ করে প্রণাম সেরে উঠে দাঁড়াল। তিনজনের চোখেই আনন্দাশ্রু। গোকুল গদগদ স্বরে বলল, “রাজামশাই, এবার যে গা তুলতে হচ্ছে!”

নিতাই বলল, “নন্দপুরচন্দ্র বিনা বৃন্দাবন যে অন্ধকার রাজামশাই।”

নবু চোখ কচলাতে-কচলাতে ধরা গলায় বলল, “আমাদের চন্দ্রঘোষপুরে এবার সূর্যোদয় হবে। রাজা ছাড়া গাঁ যেন দিনমানেও ঘুটঘুটি অন্ধকার। লম্ফ জ্বেলে বেরুলে যেন ভাল হয়। কী বলিস রে গোকুল?”

গোকুল বলল, “তা ছাড়া কী? রাজা ছাড়া গাঁ যেন বাপ ছাড়া মা। পুঁজ ছাড়া ঘা। জল ছাড়া না’।”

ভোলু কঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, “কিন্তু আমার যে রাজা হওয়ার মোটেই ইচ্ছে নেই মশাই।”

বলো কী? রাজা হতে চাও না? তোমার মাজায় ত্রিশূলের দাগ। তোমার বাপ ভবেশ ডাকাত! তোমার গায়ে রাজা-রাজা গন্ধ! রাজা না হয়ে তোমার কি কোনও উপায় আছে বাপু?”

ভোলু ফুঁপিয়ে উঠে বলে, “ও বাবা, রাজার কাজ বড় শক্ত। তার মন্ত্রীসান্ত্রীদের সামলাতে হয়, যুদ্ধ করতে হয়, হাতি-ঘোড়ায় চড়তে হয়, ও বাবা! ওসব আমার পোষাবে না।”

গোকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সে গুড়ে বালি। তবে হ্যাঁ এক সময়ে পিলখানা, আস্তাবল, গোশালা, মৃগদাব সব ছিল বটে। এখন সব ঢুঢু। আর মন্ত্রীসান্ত্রীর কথা আর বোলো না বাপু, চন্দ্রঘোষপুরে তাদের টিকির নাগালও কেউ পায়নি গত পঞ্চাশ বছর। আর চন্দ্রঘোষপুরে ঝগড়া কাজিয়া হয় বটে, কিন্তু যুদ্ধটুদ্ধ হয় না।”

নিতাই বলে, “গেলেই টের পাবে বাপু। রাজত্বটাজত্ব কিছুই নেই। শুধু একখানা ভাঙা বাড়ি আর মজা পুকুর।”

নবু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “কেন, লোহার সিংহাসনটা তো আছে! তবে মরচে ধরে সেটাকেও আর সিংহাসন বলে চেনা যায় না। সেদিন দেখলুম একটা নেড়ি কুকূর সিংহাসনে দিব্যি শুয়ে আছে।”

ভোলু বলল, “তা হলে আর সেখানে গিয়ে হবেটা কী?”

গোকুল বলে, “তা এখানেই বা তুমি কোন সুখে আছ? নবদ্বীপবাসিনী দেব্যা কি বাড়িখানা তোমাকে লিখে দিয়ে গিয়েছে?”

ভোলু মাথা নেড়ে বলে, “না মশাই। সে বড় দুঃখের কথা। এ বাড়ি মহাদেব তেজপালের কাছে বাঁধা দেওয়া আছে। তেজপাল রোজই লোক পাঠিয়ে আমাকে হুড়ো দিচ্ছে। মাথা গোঁজার আর জায়গাই নেই আমার।”

“তবে? চন্দ্রঘোষপুরে পুরনো হোক, ভাঙা হোক, বসবাসের অযোগ্য হোক, তবু তো নিজের একটা বাড়ি পাচ্ছ হে। আর রাজার একটা মানসম্মানও তো আছে! এ গাঁয়ে কেউ তোমাকে রাজা বলে চেনে? কিন্তু আমাদের গায়ে ছেঁড়া জামা গায়ে বেলেও লোকে তোমাকে দেখিয়ে বলবে, “ওই দেখো রাজা যাচ্ছে।”

প্রস্তাবটা মনে-মনে একটু ওজন করে দেখল ভোলু। দোনোমনো হচ্ছে বটে, কিন্তু নফরগঞ্জে তার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। নতুন গাঁয়ে গিয়ে যে কী লবডঙ্কা পাওয়া যাবে, তাও বুঝতে পারছে সে। তবে জীবনে একবার একটু রাজা হয়ে দেখাই যাক না।

ভোলু মুখখানা করুণ করে বলল, “হ্যাঁ মশাইরা, আপনারা আমাকে ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে গিয়ে শেষে কোথাও বেচে দেবেন না তো?”

গোকুল অবাক হয়ে বলে, “কিন্তু কিনবে কে? চারদিকে চেয়ে ভাল করে দেখো দিকি, পোকার চেয়েও লোকের সংখ্যা বেশি। কে কাকে চিনছে বলো তো? নফরগঞ্জের হাটবারে গিয়ে নিজেকে ফিরি করে দেখো দিকি ক’পয়সা দাম ওঠে তোমার।”

ভোলু লজ্জা পেয়ে বলে, “তা অবিশ্যি ঠিক। আমার আবার কী-ই বা দাম। পেটে বিদ্যে নেই, মাথায় বুদ্ধি নেই, পকেটে পয়সা নেই, দানাপানির জোগাড় নেই। না মশাইরা, চলুন আপনাদের সঙ্গেই বিবাগী হয়ে যাই।”

“তা হলে আর দেরি করে কাজ নেই। পোঁটলা বেঁধে নাও, তারপর রওনা হয়ে পড়ি।”

ভোলুর জাগতিক জিনিসপত্র বেশি কিছু নেই। গোটা দুই জামা, দুটো গেঞ্জি আর দুটো ধুতি। দু’চারটে থালাবাটি আর গেলাস। বিছানাপাত্রের বিশেষ বালাই নেই। পিসি চৌকির উপর শতরঞ্চি পেতে শুত। সে মেঝেয় মাদুর পেতে শোয়। শতরঞ্চি আর মাদুরটা অবশ্য কাজে লাগবে। তাই ও দুটোও নিল।

তিনবার বাস বদল করে ফকিরগঞ্জে নেমে ভ্যানগাড়িতে মাইলতিনেক পথ। তারপরও আল ধরে আরও তিন মাইল। চন্দ্রঘোষপুর যখন পৌঁছল, তখন সন্ধে পেরিয়ে গিয়েছে।

গাঁ মোটেই সুবিধের নয়। অজপাড়াগা বললেই হয়। বড় জঙ্গলে জায়গা। ঢুকতেই গা কেমন ছমছম করে উঠল।

গোকুল বলে, “আগে অবিদ্যাঠাকুরের কাছে চলো।”

ভোলু বলে, “আচ্ছা, এই অবিদ্যা ঠাকুরমশাই আসলে কে বলুন তো!”

“ওবাবা! অবিদ্যাঠাকুরই আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আসল নাম হল অবিদ্যাবিনাশক কাঞ্জিলাল।”

অবিদ্যাবিনাশকের বয়স বছরপঞ্চাশেক হবে। বেঁটোখাটো মজবুত চেহারা। জম্পেশ চোমড়ানো একজোড়া কাচাপাকা গোঁফ আছে। মাখা ন্যাড়া। টিকিতে একটা গাঁদাফুল বাঁধা। পুরনো একখানা ইটরঙা দোতলা বাড়ির একতলায় একখানা ঘরে বসে হ্যারিকেনের আলোয় বিস্তর দলিল, দস্তাবেজ আর খেরোর খাতায় ডুবে আছেন।

তিনজনে পটাপট গড় হয়ে পেন্নাম করল। দেখাদেখি ভোলুও।

অমনি অবিদ্যাঠাকুর আঁতকে উঠে বললেন, “করো কী? করো কী? দেশের রাজা হুট করে কাউকে পেন্নাম করে না।”

ভোলু থতমত খেয়ে বলল, “কিসের রাজা? রাজা বলে তো কিছু বুঝতেই পারছি না ঠাকুরমশাই।”

অবিদ্যাবিনাশক তলচক্ষুতে তাকে একবার নিরীক্ষণ করে বলেন, “বাপু, বেশি বুঝে তোমার কাজ নেই। যত বুঝবে তত ফ্যাসাদ। ওরে, তোরা হ্যারিকেনটা তুলে ত্রিশূল চিহ্নটা আমাকে দেখা।”

ফের জামা তুলে, কষি নামিয়ে লণ্ঠনের আলোয় ত্রিশূল দেখে অবিদ্যাঠাকুর একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলে বললেন, “নাঃ, এ যে একেবারে খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে। তবে সন্দেহের আঁশটুকুও রাখা ঠিক হবে না।”

এই বলে একটা আতশকাচ দিয়ে কপাল দেখালেন, হাঁ করিয়ে দাঁত দেখলেন, হাত-পায়ের গড়ন দেখলেন। তারপরেও আবার হস্তরেখা বিচার এবং জাবদা খাতায় নানা রকম আঁকিবুকি আর হিসেব কষার পর তার মুখে হাসি ফুটল। বললেন, “হ্যাঁ, সত্যিই তুমি রাজা হে। শুভস্য শীঘ্রম, কাল প্রাতঃকালেই তোমার অভিষেক।”

ভোলু বিরক্ত হয়ে বলে, “সেঁকতাপের কথা পরে। চাট্টি মুড়িটুড়ি কি জুটবে মশাই? পেটে যে খোঁদল হয়ে গেল।”

কিন্তু কথাটা যেন কারও কানেই গেল না। অবিদ্যাঠাকুর একটা লম্বা সরু কাগজে কী যেন লিখছেন আর তিন মূর্তিমান উবু হয়ে বসে লণ্ঠনের আলোয় ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করছে। ভোলু মেঝেতে বসে দেওয়ালে পিঠ রেখে চোখ বুজতেই ঝিমুনি চলে এল।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে কে জানে। একজন পালোয়ান গোছের লোক এসে তার কাঁধ ধরে এমন ঝাঁকুনি দিল যে, সে কঁকিয়ে উঠল। লোকটা বলল, “উঠে পড়ুন রাজামশাই, হাত-মুখ ধুয়ে নিন। আপনার ভাত বাড়া হয়েছে।”

রাজামশাই সম্বোধন কিংবা আপনি-আজ্ঞেতে তার মোটেই অভ্যাস নেই। সে ভারী জড়সড় হয়ে তাড়াতাড়ি উঠে মুখে-চোখে জল থাবড়ে এসে দেখে, ভিতরবাড়িতে লম্বা টানা বারান্দা জুড়ে অন্তত পনেরো বিশজনের পাত পাড়া হয়েছে। আর যারা খেতে জড়ো হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই বেশ দশাসই গুলি পাকানো চেহারা। এবার অবিদ্যাঠাকুরের আত্মীয়স্বজন বলে মোটেই মনে হল না ভোলুর। শুধু চেহারাই নয়, চোখগুলোও কেমন যেন বাঘা-বাঘা। লম্ফের আলোতেও যেন ঝিলিক মারছে।

বাকিরা চাটাইয়ের আসনে বসলেও ভোলু আর অবিদ্যাঠাকুরের জন্য পাশাপাশি দু’টি পিঁড়ি। বাকিরা কলাপাতায় খাবে। তার আর অবিদ্যাঠাকুরের জন্য কাঁসার থালা।

আয়োজনও খারাপ নয়। মোটা চালের রাঙা গরম ভাত, সোনামুগের ঘন ডাল, আলু আর কুমড়োর ছক্কা, বড়-বড় মাছের টুকরো আর ঝোল, শেষ পাতে একটা করে দরবেশ। ওঃ একেবারে ভরপেট হয়ে হেউঢেউ হয়ে গেল ভোলুর।

খেতে-খেতেই অবিদ্যাঠাকুর বললেন, “এরাই সব তোমার সৈন্যসামন্ত বলতে পার।”

সৈন্যসামন্ত শুনে ভারী ভাবিত হল ভোলু। তা হলে কি তাকে যুদ্ধটুদ্ধও করতে হবে নাকি? সেসব তো পেরে উঠবে না সে।

খাওয়ার পর অবিদ্যাঠাকুর বললেন, “আজ রাতটা ভাল করে ঘুমোও। কাল থেকে তোমার জীবন অন্য রকম হবে।”

যে লোকটা তাকে রাজামশাই ডেকে ঘুম থেকে তুলেছিল, সে-ই একটা হ্যারিকেন নিয়ে তাকে তিনতলার টুঙ্গি ঘরটায় পৌঁছে দিয়ে বলল, “আজ এখানেই ঘুমিয়ে নিন রাজামশাই। কাল থেকে রাজবাড়িতেই ব্যবস্থা।

লণ্ঠনখানা নিবু-নিবু করে রেখে লোকটা চলে গেল। ঘরের চারদিকটা দেখে ভোলুর কিছু খারাপ লাগল না। ন্যাড়া একটা তক্তপোষের উপর শতরঞ্চি আর চাদর পাতা। একখানা শক্ত বালিশও রয়েছে। তা ভোলুর কাছে এটাই রাজশয্যা। পিসির বাড়িতে তো মেঝেয় মাদুর পেতে শুতে হত। ঘরের জানালা-দরজার অবস্থা অবশ্য নড়বড়ে। তিনটে জানালার দুটোর পাল্লাই নেই। দরজায় একখানা হুড়কো আছে বটে, কিন্তু তা বিড়ালের লাথিও সইতে পারবে না। নাঃ, এদের বিবেচনা আছে। একটা বড় পিতলের ঘটিভরা খাওয়ার জ্লও চৌকির পাশে রাখা রয়েছে।

ভোলুর আজ বিস্তর হাঁটাহাঁটি গিয়েছে। তার উপর রাতের ভোজটাও হয়েছে বড় জব্বর। শুয়ে পড়তেই গাঢ় ঘুম ভল্লুকের মতো চেপে ধরল তাকে।

ভোলুর চিরকালই এক ঘুমে রাত কাবার। কস্মিনকালে মাঝরাতে ঘুম ভাঙে না তার। কিন্তু আজ ভাঙল। কে যেন তার বাঁ কাঁধে জোর ঝাঁকুনি দিতে দিতে চাপা গলায় বলছিল, “রাজামশাই, ও রাজামশাই! এ যে কুম্ভকর্ণের ঘুম রে বাবা।”

জেগে উঠে ভোলু ভোম্বল মাথায় অন্ধকারে চারদিক চাইতে সাগল, ঘরে কি চোর ঢুকেছে নাকি? কিন্তু চোর ঢুকে লাভ কি? পাবে কোন লবডঙ্কা? হঠাৎ একটু চমকে গিয়ে দেখল, পায়ের দিকটায় চৌকির কোনায় কে যেন বসা।

“কে?”

“কে তা জেনে হবেটা কী? যদি বলি আমি হলুম গে রসময় দাস, পিতা পীতম্বর দাস, বাড়ি মুকুন্দপুর, তা হলে কি চিনতে পারবে?”

“আজ্ঞে না।“

“তবেই বোঝো। নামধাম দিয়ে লোক চেনা অত সোজা নয়। আর বাপু, সত্যি কথা বলতে আমার নাম রসময়, পিতার নাম পীতাম্বর আর বাড়ি মুকুন্দপুর মোটেই নয়।”

একেই মাথার ভিতরে এখনও ভনভন কাছে ঘুম, তার উপর এইসব গোলমেলে কথা শুনে ভোলু আরও ভোম্বল হয়ে গেল। বলল, “কিন্তু মশাই, আপনি তো একজন কেউ হবেন! রসময় দাস ছাড়াও তো কত কী হওয়া যায়।”

“তা বটে। তা ধরে নাও না কেন, আমি তোমারই এক প্রজা, রাজদর্শনে এসে হাজির হয়েছি।”

ভোলু একটু হাঁ করে ছায়ামূর্তিটার দিকে চেয়ে রইল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, “দোষ নেবেন না যেন, এ কথাটাও আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।”

“বিশ্বাস করা উচিতও নয়। লোকে আজকাল মুড়িমুড়কির মতো মিছে কথা কয়। সব কথা বিশ্বাস কলে কি কাজ কারবার চলে? আমার কথাগুলোও তোমাকে বিশ্বাস করতে বলছি না।”

ভোলু একটা হাই তুলে বলে, “ত না হয় না করলুম। কিন্তু তা হলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে মশাই?”

“রোসো বাপু রোসো, দুনিয়াতে মিছে কথা আছে বলে কি সত্যি কথাও নেই? না থাকলে কি কাজকারবার চলে নাকি? তাই বলছিলুম, আমার মিছে কথাগুলোর মধ্যে এক-আধটা সত্যি কথাও আছে কিন্তু। এই ধরো, চালে যেমন কাঁকড়। ধরো, চাল হল মিথ্যে আর কাঁকড় হল সত্যি। এখন চালের ভিতজ্ঞ থেকে কাঁকড়গুলো তোমাকেই বেছে বের করতে হবে। পারবে না?”

ভোলু মাথা নাড়া দিয়ে বলল, “না মশাই, আমার মোটেই বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। নফরগঞ্জের লোকও আমাকে বোকা-হাঁদা বলেই জানত।”

বলো কী? তেজেশ চৌধুরীর মাথাটা যে ছিল বুদ্ধির কারখানা। দিনরাত সেই কারখানায় হাজার-হাজার মতলব তৈরি হত। কাকে তুলতে হবে, কাকে ফেলতে হবে, কার ডানা ছাঁটতে হবে, কার বাড় বেড়েছে আর কে মতলব আঁটছে, এসব যে লহমায় বুঝে যেতেন তেজেশ চৌধুরী! বললে হয়তো বিশ্বাস যাবে না, কাছে দাঁড়ালে তার মাথার ভিতরে যে ভুটভাট শব্দ হচ্ছে, তাও শোনা যেত। লোকে বলত, তেজেশ চৌধুরীর মাথায় সর্বদা বুদ্ধির খই ফুটছে, ও তারই আওয়াজ।”

ভোলু অবাক হয়ে বলে, “তেজেশ চৌধুরী কে আজ্ঞে?”

“সর্বনাশ! নিজের বংশপরিচয়টাও কি ভুলে মেরে দিয়েছ নাকি?”

ভোলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “বংশের সঙ্গে পরিচয়টাই বা হল কোথায় বলুন, যে, বংশপরিচয় জানব? আমি শুধু জানি, আমি ভবেশ চৌধুরীর ছেলে। তা বাবাকেও আমার ভাল মনে নেই। খুব আবছা মনে পড়ে, বাবা এক রাত্রিবেলা আমাকে কাঁধে নিয়ে একটা জায়গা ছেড়ে কোথায় যেন পালিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি বাবার কাঁধেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর থেকে ওই নবদ্বীপবাসিনী পিসির কাছেই বড় হওয়া। বাবাকে দু-চারবার দেখেছি বটে। তবে বেশি কাছে ঘেঁষা হয়ে ওঠেনি।”

“তোমার বাবা কি তোমাকে বংশ পরিচয়টাও দিয়ে যায়নি?”

“না মশাই। বাবার সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ খুব কমই হয়েছে। তারপর একদিন শুনলুম, ডাকাতি করতে গিয়ে ভবেশ চৌধুরী খুন হয়েছে। পিতৃপরিচয়টা তেমন গৌরবের হওয়ায় বংশ নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি।”

“তোমার প্রপিতামহ সত্যেশ চৌধুরী যে ফিজিক্সে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন, তা কি জান? তস্য পিতা দানেশ চৌধুরী গামা পালোয়ানকে পটকে দিয়েছিলেন, জানা আছে কি? পিতামহ তেজেশ চৌধুরীর বুদ্ধির কথা তো আগেই বলেছি, তা তেজেশ চৌধুরী তো দিল্লিতে মন্ত্রীও হয়েছিলেন? এসব খবর কি তোমাকে কেউ দেয়নি?”

ভোলু মহা ভাবনায় পড়ে মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “না আজ্ঞে। এসব খবর আমার জানা নেই। তবে কিনা, কিছু মনে করবেন না, এটা ঠিক বিশ্বাস করা যাচ্ছে না।”

“আহা, বিশ্বাস করার দরকারটাই বা কী? কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না কেন বলো তো? আটকাচ্ছে কোথায়?”

“আজ্ঞে, বড় বাড়াবাড়ি ঠেকছে।”

“তা বাড়াবাড়িটা কোথায় হচ্ছে বলো তো। ফিজিক্সে কি কেউ নোবেল প্রাইজ পায় না? নাকি গামাকে কেউ হারায়নি? নাকি দিল্লিতে কেউ কখনও মন্ত্রী হয়নি?”

ভোলু আমতা-আমতা করে বলে, “আজ্ঞে ঠিক তা নয়। তবে কিনা…”

‘বাপু হে, আমিও তো তোমাকে এইটেই বোঝনোর চেষ্টা করছি যে, সব শোনা কথাই বিশ্বাস করতে নেই। সত্যেশ চৌধুরীর নোবেল প্রাইজ পাওয়া, দানেশ চৌধুরীর গামাকে হারানো বা তেজেশ চৌধুরীর মন্ত্রী হওয়া তোমার বিশ্বাস হল না, কিন্তু তোমার বাবা যে ডাকাত ছিলেন, একথাটা লোকের মুখে শুনে বিশ্বাস হল কেমন করে?”

ভোলু মহা ফাঁপরে পড়ে বলল, “আজ্ঞে পিসিও যেন বলেছিল যে, বাবা কোথায় যেন ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, আর গাঁয়ের লোকেরা পিটিয়ে মেরে ফেলে।”

“তোমার পিসি কি তখন সেখানে ছিলেন?”

“তা নয় অবশ্য।”

“গাঁয়ের বিধবা অনাথা, বোকাসোকা মানুষ, লোকে যা বুঝিয়েছে। তাই বিশ্বাস করেছেন।”

“তা অবিশ্যি ঠিক।”

“আর একটা কথা। ধরো, যদি আমি তোমাকে ধরাধাম থেকে সরাতে চাই আর খুনের মামলায় ফেঁসে যেতেও যদি আপত্তি থাকে, তা হলে একটা সোজা উপায় হল তোমার নামে একটা বদনাম রটিয়ে দিয়ে পাঁচজনকে খেপিয়ে লেলিয়ে দেওয়া। তাতে সাপও মরে, লাঠিও ভাঙে না। নিশুত রাতে যদি একটা লোককে সাপটে ধরে ডাকাত-ডাকাত’ বলে চেঁচাও, তা হলে গাঁয়ের লোক আপসে আপ লাঠিসোঁটা নিয়ে রে রে করে তেড়ে আসবে। ওটাই দস্তুর।”

“তা বটে। নফরগঞ্জেও ওরকম কয়েকবার হয়েছে।”

“সব গাঁয়েই হয় বাপু। তবে তোমার বাপ ভবেশ চৌধুরীর বেলায় যা হয়েছিল, তা একেবারে ছক কষে খুন।”