ভুতুড়ে সাঁকোর রহস্য – ৮

আট

এমিলি আর মিসেস ম্যাকলিন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই, হারানো ফটোগ্রাফটার কথা তাঁদেরকে জানাল নথি।

‘আমি দুঃখিত, এমিলি,’ বলল ও। ‘ছবিটা আপনার কাছে কতখানি তা জানি আমি। কিন্তু কী যে হলো কিছুই বুঝলাম না। এখানেই তো রেখেছিলাম!’

‘হায়, খোদা, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠলেন মিসেস ম্যাকলিন। ‘প্রথমে টেপ রেকর্ডার, এখন ফটো। এরপর কী?’

‘চিন্তা নেই, রবিন,’ কোমল স্বরে বলে, রবিনের বাহু চাপড়ে দিলেন এমিলি। ‘আত্মীয়-স্বজনদের দেয়ার জন্যে আমি ছবিটার বেশ কটা কপি করিয়েছি।’

‘ওহ, বাঁচলাম!’ হাঁফ ছাড়ল রবিন। সহজ হয়ে এল মুখের চেহারার অভিব্যক্তি।

‘তাছাড়া, মিসেস ম্যাকলিনের পিছু নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় বললেন এমিলি, ‘ওটা পাওয়া যাবেই। এই পরিবারেই তো শুধু দাম ওটার, আর সবার কাছে তো মূল্যহীন।

ছেলেরা পরস্পর চোখাচোখি করে নিল। এমিলি জানেন না ধাঁধাটার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ এই ছবি। ব্রুচটা হাত করতে চাইছে এমন যে কারও কাছেই ছবিটি অমূল্য।

‘ওটার অন্তত এক ডজন কপি আছে আমার ডেস্কের ড্রয়ারে,’ হেঁকে বললেন ছেলেদের উদ্দেশে। ‘হল-এর শেষমাথায় ডেন। ওখানে গেলেই ডেস্কটা পাবে।’

‘চলো,’ বলল রবিন। চিরাচরিত খোশমেজাজে ফিরেছে।

হল ধরে শশব্যস্তে পা বাড়াল ছেলেরা। ডেন-এর কাছাকাছি পৌছতেই দেখল দরজাটা অল্প খোলা। পরিচিত এক কণ্ঠস্বর কানে এল ওদের।

‘আমি তো বলছি আপনাকে, এটা একটা নিখুঁত পরিকল্পনা।’ রুবির গলা। ‘কেউ এক ফোঁটাও সন্দেহ করবে না।’

কথাগুলো শুনতে ভাল লাগল না ওদের। লুকিয়ে অন্যের কথা শুনতে নেই, কিন্তু এক্ষেত্রে, অনুভব করল ভাল উদ্দেশ্যেই কাজটা করছে ওরা।

‘না… ওরা আর কোন ঝামেলা পাকাবে না, ফোনে কথা বলছে রুবি। কী বললেন? … সবকটা পাথর তুলে দেখব আমরা?’ সশব্দে হাসছে এখন ও। ‘ভাল!’

‘শুনলে?’ হল ধরে ফেরার সময় অন্যদের উদ্দেশে বলল নথি।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

‘রুবি মনে হয় কোন ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে।’

‘আর আজকেই তো ও রহস্যটার কথা জানতে চাইছিল, বলল রবিন। ‘ব্যাপারটা কেমন সন্দেহজনক না?’

‘খাইছে, অবশ্যই!’ নির্দ্বিধায় বলল মুসা।

ডন বড়ভাইদের দিকে চাইল।

‘আমরা এমিলিকে সাবধান করব না?’

‘রুবিকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে আমাদের,’ স্বীকার করল মুসা।

‘কিন্তু ও ফোনে কী নিয়ে কথা বলছিল এখনও জানি না আমরা।’

কিশোর একমত হলো।

‘আর এমিলিও বিশ্বাস করবেন না রুবি কোন মতলব পাকাচ্ছে-শক্ত প্রমাণ ছাড়া।

‘ঠিক বলেছ, কিশোর,’ বলল রবিন। ‘কাউকে শুধু শুধু সন্দেহ করলেই তো হবে না, প্রমাণও লাগবে।’

.

সেদিন সন্ধেয়, এমিলি, মিসেস ম্যাকলিন, মনিকা আর ছেলেরা বেসবল খেলা দেখতে গেল এবং সরবে সমর্থন জানাল স্থানীয় দলটিকে। এমনকী মনিকা পর্যন্ত মজে গেল খেলায়। অতিরিক্ত ইনিংসে গড়াল ম্যাচটি, ফলে ইটন প্লেসে ওদের ফিরতে-ফিরতে রাত হয়ে গেল।

শুতে যাওয়ার আগে, আরেকটি নৈশ বৈঠকে বসল তিন গোয়েন্দা আর ডন।

‘রুবি ফোনে কার সাথে কথা বলছিল কে জানে,’ বলল ডন। এখনও মাথায় রয়ে গেছে মেয়েটির রহস্যময় কথাবার্তাগুলো।

জবাবটা দিল কিশোর।

‘প্রথমেই গ্রাহাম ব্রাউনের কথা মনে আসে।’

‘রুবি আর গ্রাহাম দল বেঁধে কাজ করছে ভাবছ?’ রবিন বিস্মিত গলায় জানতে চাইল।

‘হতে পারে, বলল কিশোর।

‘রুবি আর গ্রাহাম?’ পুনরাবৃত্তি করল ডন, বোঝেনি, কিন্তু গ্রাহাম তো শহর ছেড়েছেন, মনে নেই?’

‘উনি হয়তো আমাদেরকে ওটাই বিশ্বাস করাতে চান,’ বলল কিশোর। ‘ধোঁকাবাজি আরকী।’

মুসা বিষয়টা উল্টেপাল্টে ভেবে দেখে মাথা ঝাঁকাল।

‘উনি হয়তো চেয়েছেন আমরা ভুল পথে চলি।’

‘হুম,’ বলল কিশোর। ‘যাতে কেউ ওঁকে সন্দেহ না করে।’

মুসা কোঁকড়া চুলে হাত বোলাল।

‘উনি আসলে হয়তো ব্রিজটা চান না

‘তারমানে?’ ডনের প্রশ্ন।

‘গ্রাহাম হয়তো মেগের ব্রুচটা হাতাতে চান।’

।‘ওহ, এটা তো ভাবিনি, মুসাভাই!’ বলল ডন।

এসময় কিছু একটা মনে পড়ল রবিনের। লিভিংরুমের ঠিক বাইরে, হল-এ কারও উপস্থিতি টের পেয়েছিল চটপট সে কথা জানাল ওদেরকে।

‘কেউ কি আমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করছিল?’ ডন জবাব চাইল।

‘ব্যাপারটা অসম্ভব নয় স্বীকার করল নথি।

‘সে কতখানি শুনেছে তা-ই ভাবছি,’ অস্বস্তির সঙ্গে বলল মুসা।

‘ফটোগ্রাফটা যে রহস্যটার গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেটুকু তো শুনেছে বটেই,’ জানাল রবিন।

অন্যরা মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল। ব্রুচ উদ্ধারে কাজে আসবে জানলে তবেই না কেউ ছবিটা চুরির ঝামেলায় যাবে।

কিশোরের কিছু যোগ করার ছিল।

‘রুবি ফোনে কী বলেছিল মনে নেই? ‘ওরা আর কোন ঝামেলা পাকাবে না?’

অন্যরা মাথা ওপর-নিচ করল।

‘খাইছে, রুবি কি আমাদের কথাই বলছিল নাকি?’ মুসা শুধাল।

‘হ্যাঁ,’ বলল কিশোর। ‘আমার তেমনটাই ধারণা।’

‘ওর সম্ভবত মনে হয়েছে ফটোটা ছাড়া আমরা এ রহস্যের কিনারা করতে পারব না,’ জুগিয়ে দিল রবিন।

মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল কিশোর।

‘ও হয়তো ছবিটা নেয়ার সময় ভাবেনি এটার আরও কপি আছে।’

‘একটা কথা বুঝলাম না,’ চিন্তামগ্ন ডন বলল। ‘চিলেকোঠায় ছবিটা প্রথমে তো রুবিই খুঁজে পায়, তাই না? ও যদি ওটা চুরিই করবে তাহলে তখনই গায়েব করল না কেন?’

‘তখন হয়তো বোঝেনি ছবিটা এত গুরুত্বপূর্ণ, বাতলাল মুসা।

‘কাল সকালে সবার আগে ছবিটার একটা কপি জোগাড় করতে হবে,’ আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলল কিশোর। এখন আর মাথা কাজ করছে না, শরীর ভেঙে আসছে ক্লান্তিতে।’ ওরা সিদ্ধান্ত নিল আজকের মত ক্ষান্ত দেবে।

বিছানায় যাওয়ার পর মুসার ভাবনা আবারও ফিরে গেল স্টোন পুলের ওই ফটোগ্রাফটায়। এখনও মনটা কেমন খচখচ করছে ওর। কী যেন একটা ভজকট আছে। কিন্তু কী সেটা? ধরতে পারছে না ও।

এবার ভাবনাটাকে চেতনার আড়ালে পাঠিয়ে ঘুমে তলিয়ে গেল।

মাঝরাতে, হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠল মুসা, ‘খাইছে, পেয়েছি!’ এক ঝটকায় বিছানায় উঠে বসল ও, জবাবটা যেই মাথায় খেলে গেল। ‘সেজন্যেই তিনবার দাগানো হয়েছে ওটার নিচে!’

‘উম…?’ নিদ্রামগ্ন রবিন চোখ পিটপিট করে চাইল মুসার দিকে।

‘ফটোটার গুমর ধরতে পেরেছি!’ গা থেকে চাদর ছুঁড়ে ফেলে এক লাফে বিছানা ছাড়ল মুসা। ‘এসো, রবিন, সকাল পর্যন্ত অপেক্ষার কোন মানে নেই।’

কিশোর আর ডনকে জাগিয়ে, রবিন আর মুসা ওদেরকে পেছনে নিয়ে, নিচে, ডেন-এর উদ্দেশে চলল। এমিলির ডেস্কের ড্রয়ারে স্টোন পুল গাঁয়ের সেই ছবিটার বেশ কিছু কপি পেল ওরা।

‘ব্যাপারটা আসলে কী, মুসা?’ কিশোরের জিজ্ঞাসা।

‘ভেবে দেখো,’ বলল মুসা, ছোট্ট সোফাটায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসল ওরা। ‘এটা ১৮১০ সালের ছবি, তাই না?’

প্রদীপের আলোর বলয়ের মাঝে বসা রবিন মান্ধাতা আমলের লেখাটায় চোখ রাখল।

‘তা-ই তো লেখা এখানে।’

‘সমস্যাটা হচ্ছে,’ মুসা বলল ওদেরকে, ‘১৮২০-এর দশকে ফটোগ্রাফি আবিষ্কৃত হয়।’

আঁতকে উঠল প্রায় রবিন।

‘বলো কী?! তাহলে এ ছবি ১৮১০ সালে কীভাবে তোলে!’

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

‘মেগ সালটা ভুল করেছিলেন।‘

‘আজব তো,’ কপাল কুঁচকে বলল ডন। ‘তারমানে কি আরেকটা সূত্র পেলাম আমরা?’

‘একশোবার!’ বলে মুসাকে হাই ফাইভ দিল কিশোর। রবিন আর ডনও হাই ফাইভ বিনিময় করল।

‘কিন্তু…এ থেকে কী বোঝা গেল? ডনের প্রশ্ন।

কারও মুখে কথা নেই কিছুক্ষণ। সবাই ওরা ভাবনায় মগ্ন। শেষমেশ মুখ খুলল কিশোর।

‘আর কোন ভুল আছে ছবিটায়?’

‘আমি নিশ্চিত নই,’ বলল মুসা। ‘এটাই শুধু আমার চোখে পড়েছে।

ফটোগ্রাফটার ওপরে ঝুঁকে পড়ে বার কয়েক ‘হুম’ বলল কিশোর।

‘কী দেখছ?’ ওর কাঁধের ওপর দিয়ে চাইল নথি।

জবাব দিল না গোয়েন্দাপ্রধান।

‘কিশোর?’ রবিন বলল আবারও।

‘রহস্যটা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে।’ সাদা কালিতে লেখা শব্দগুলোর নিচে আঙুল বোলাল কিশোর। চিমটি কাটল নিচের ঠোঁটে। ‘এখানে বলছে ছবিটা বিকেলে তোলা হয়েছে।’

‘খাইছে, তাতে সমস্যাটা কী, কিশোর?’ মুসার প্রশ্ন।

‘পেছনের ক্লকটাওয়ারটা বলছে দশটা বাজে। ছবিটা বিকেলে নয়, তোলা হয়েছে সকালে!’

‘খাইছে, ঠিক বলেছ, কিশোর, মুসা চেঁচিয়ে উঠল।

‘আরেকটা ব্যাপার চোখে পড়ল এইমাত্র। ছবিটা থেকে চোখ তুলল রবিন। এই ছবি কিছুতেই গরমকালে তোলা হয়নি।’

‘খাইছে, একথা কেন বলছ, রবিন?’ মুসা জবাব চাইল।

‘গাছগুলো দেখো।

সবকটা মাথা এক হলো, অন্যরাও খুঁটিয়ে দেখছে ছবিটা।

একটা গাছেরও পাতা নেই! বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল ডন। ‘সবকটা ন্যাড়া।‘

‘আর চিমনিগুলো থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে,’ আরও বলল কিশোর। ‘খেয়াল করেছ?’

মুসা আরেকটু ঝুঁকল।

‘তুমি বলার পর তো…’

‘প্রথম থেকে শুরু করা যাক,’ বলল কিশোর। সূত্রগুলো মনের মধ্যে গুছিয়ে নিল। ‘এই ছবি বিকেলে তোলা হয়নি। সময়টা গ্রীষ্মকালও নয়। আর সালটা ১৮১০ হতে পারে না।

ছেলেরা পরস্পরের দিকে চাইল। মেগ এত সব ভুল করলেন কীভাবে?

‘দেখা যাচ্ছে ভুল শুধু জন ইটন একাই করেননি,’ মন্তব্য করল ডন।

‘জন ইটন?’ চোখে প্রশ্ন নিয়ে ওর দিকে চাইল কিশোর।

‘সাঁকোটার বেলায় উনি ভুল করেছিলেন,’ ব্যাখ্যা দিল ডন। ‘মনে নেই?’

ছেলেরা হঠাৎই একে অন্যের দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টে।

‘জন’স ব্লাণ্ডার!’ এবার কোরাসে চেঁচিয়ে উঠল

‘খাইছে, বিশ্বাস হচ্ছে না,’ বলল মুসা, ‘মেগ ইচ্ছে করেই এতগুলো ভুল করেছিলেন। তাঁর বড়-বড় ভুলগুলো সেতুটার দিকে ইঙ্গিত করছে!’

‘সব মিলে যাচ্ছে,’ বলল নথি। ‘এমিলি বলেছিলেন মিস্ত্রিরা যখন কাজ করছিল তখন ব্রুচটা খোয়া যায়। ডন ভাগ্যিস জনের ব্লাণ্ডারের কথাটা বলেছে!’

‘তাহলে কি…’ মুহূর্তের বিরতি নিয়ে ভাবনাগুলো সাজিয়ে নিল কিশোর। ‘মেগের ব্রুচটা সাঁকোর কোন একটা পাথরের তলায় লুকানো রয়েছে?’

ঠোঁট কামড়াল রবিন।

‘যদি তা-ই হয়, তবে মহা ঝামেলা অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে।’

‘তারমানে?’ কিশোর জানতে চাইল।

‘রুবি ফোনে কী বলেছিল মনে আছে?’ সবার ওপর নজর বোলাল নথি। বলেছিল, ‘সবকটা পাথর তুলে দেখব আমরা।’

মাথা ঝাঁকাল ডন।

‘কথাটা বলার পর হেসেছিল।’

আচমকা শ্বাস চাপল মুসা।

‘ও জানে!’

‘কী জানে?’ ডন বিভ্রান্ত।

‘রুবি হয়তো বলতে চেয়েছে সাঁকোটার মধ্যেই কোথাও লুকানো আছে ক্ৰচটা, ডনকে জানাল কিশোর।

চোয়াল ঝুলে পড়ল ডনের।

‘ও, তাই?’

‘খাইছে, সেজন্যেই সাঁকোটার ব্যাপারে এত আগ্রহ গ্রাহামের,’ উপলব্ধি করল মুসা।

রবিন বলল, ‘এখন একটা কাজই করার আছে।’

অন্যরা চাইল ওর উদ্দেশে।

‘কী সেটা, রবিনভাই?’ ডন শুধাল।

‘গুপ্তস্থানটা আগে খুঁজে বের করা!’

‘তবে আর দেরি কীসের?’ ইতোমধ্যেই দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে ডন।