সাত
‘খাইছে, আমাদেরকে আর সাসপেন্সে রেখো না,’ মিনতি করল মুসা। ‘ঝটপট বলে ফেলো!’
কিশোর স্প্রিঙ্কলে মনিকার নামের বানানটার দিকে আঙুল দেখাল।
‘দেখেছ?’
রবিন মাথা ঝাঁকাল।
‘মেগের ধাঁধার প্রথম দু’লাইন মনে আছে?’
‘আছে তো, ওকে বলল ডন। ‘আমরা তো ওটা পড়তে-পড়তে মুখস্থ করে ফেলেছি।’
কিশোর রবিনের নোটবই রাখা টেবিলটার কাছে গেল। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে, সাদা এক পাতায় লিখল-ETON’S LOOP. নোটবইয়ের ওপর পেন্সিল ধরা অবস্থায় আবৃত্তি করল, ‘শেষটা যখন শুরু, আর শুরু যখন শেষ।’
অন্যরা হতবিহ্বল চোখে চেয়ে ওর দিকে।
‘খাইছে, বুঝলাম না,’ বলল মুসা, সবাই বসে পড়ল ওরা।
‘আমিও না,’ বলল ডন।
রবিন বলল, ‘আমিও তোমাদের দলে।’
‘ডন যা করেছিল একই কাজ করব আমিও,’ কিশোর বলল ওদেরকে। ‘অক্ষরগুলো উল্টে দেব।’
একটু থেমে, সবার দিকে চাইল ও, আশা করছে ওরা বুঝতে পারবে কী ইঙ্গিত করছে।
‘দুটো শব্দের প্রথম অক্ষরটা শেষে নিয়ে যাচ্ছি, এবং শেষেরটা শুরুতে।’ রবিনের নোটবইটা অন্যদের দেখার জন্য তুলে ধরল কিশোর – ETON’S LOOP হয়ে গেছে STONE POOL!
‘খাইছে!’ অস্ফুটে বলে, উঠল মুসা।
‘বাহ! দারুণ তো,’ প্রশংসার সুরে বলল রবিন।
‘ভাগ্যিস ভুল করেছিলাম আমি,’ বলল ডন, পাত্র থেকে শেষ ফ্রস্টিংটুকু চেঁছে তুলতে ব্যস্ত।
‘হ্যাঁ, মনির নামটা তুমি উল্টো লেখাতেই মাথা খোলে আমার।’
‘একটা ব্যাপার বুঝলাম না,’ বলল মুসা, ‘স্টোন পুল গাঁয়ের কী সম্পর্ক এই রহস্যটার সাথে?’
‘সেটাই তো জানতে হবে আমাদের,’ বলল রবিন।
মুখের কোণে লেগে থাকা ফ্রস্টিংটুকু চেটে নিল ডন।
‘কীভাবে জানব?’ প্রশ্ন করল।
রবিন একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘জবাবটা হয়তো স্টোন পুলের সেই ছবিটার মধ্যে আছে। এমিলি যেটা আমাদেরকে দেখিয়েছিলেন।’
ভ্রূজোড়া উঠে গেল মুসার।
‘খাইছে, ওটার কথা তো ভাবিনি।’
‘আপাতত ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেয়া যাক,’ পরামর্শ দিল রবিন। ‘যদি দেখা যায় আমরা ভুল করেছি, তবে এমিলি হতাশ হবেন।’
এসময়, রুবির মাথা উঁকি দিল কিচেনে, কানের পেছনে পেন্সিল গোঁজা ওর।
‘কী খবর তোমাদের?’ মৃদু হেসে বলল, ভাবখানা এমন যেন মহাখুশি ওদেরকে দেখে। ‘আসব?’
ছেলেরা স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল রুবির দিকে, মেয়েটির এত হাসিখুশি, বন্ধুভাবাপন্ন আচরণে রীতিমত হতবাক। ঘটনাটা কী?!
জবাবের তোয়াক্কা না করে, কিচেনে ঢুকল রুবি, দরজাটা পেছনে লাগাল।
‘তো…প্রাচীন রহস্যটার কোন কূল-কিনারা পেলে?’ উজ্জ্বল হাসি ওর মুখে।
‘হ্যাঁ, আমরা…’ বলতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গেল ডন। হঠাৎই মনে পড়েছে রহস্যটা নিয়ে কথা বলা নিষেধ
মুহূর্তে কৌতূহলী হয়ে উঠল রুবি।
‘কী হলো, থামলে কেন?’ তাগাদা দিয়ে, একটা চেয়ার টেনে নিয়ে টেবিলের ওপর কাপটা রাখল ও।
ছেলেরা পরস্পর চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। ওরা মিথ্যে বলতে চায় না, তবে রহস্যটা নিয়ে কথা বলার সময় যে এখনও আসেনি এটাও তো ঠিক।
‘আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন,’ বলল রবিন, ‘কিন্তু বেশিরভাগেরই কোন উত্তর নেই।’
টেবিলে পেন্সিলটা ঠুকছে রুবি।
‘তোমরা এরমধ্যেই নিশ্চয়ই কোন সূত্র খুঁজে পেয়েছ!’
‘সূত্র?’ রবিনের প্রশ্ন।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে, রবিনের দিকে চাইল রুবি। এবার আরেকটি শব্দও উচ্চারণ না করে, সটান সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে, ছোঁ মেরে কফি কাপটা তুলে নিয়ে কামরা ছাড়ল গটগট করে।
ওর পেছনে দরজাটা লেগে যেতেই, স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল ছেলেরা।
‘কী আশ্চর্য!’ বলল রবিন। ‘ও এই আমাদের গোয়েন্দাগিরি নিয়ে তামাশা করছে তো এই আবার-
‘কোন সূত্র পেয়েছি কিনা জানতে চাইছে,’ বাক্যটা শেষ করল গোয়েন্দাপ্রধান। ‘অদ্ভুতই বটে!’
‘আপাতত ছাড়ো ওর কথা,’ বলল মুসা। রহস্যটা নিয়ে ভাবো।’
‘হুম,’ একমত হলো রবিন। ‘স্টোন পুলের ফটোগ্রাফটা পরীক্ষা করা দরকার। এমিলি থাকলে নিশ্চয়ই আপত্তি করতেন না।’
‘লিভিংরুমের এক ক্যাবিনেটে আছে অ্যালবামটা,’ মনে পড়ল ডনের। ‘মানে ওটা ওখানেই রাখার কথা মনির।’
ঝাপসা কাঁচের দরজা নিয়ে পাইন কাঠের পুরানো এক ক্যাবিনেট, ওটার নিচের তাকে অ্যালবামটা খুঁজে পেল ছেলেরা। এবার সোফায় আরাম করে বসে, পাতা উল্টাতে লাগল ওরা যতক্ষণ অবধি প্রাচীন ফটোটা না পেল। ফটোর তলায় লেখা শব্দগুলো আরেকবার সবাইকে পড়ে শোনাল রবিন। ‘১৮১০-এর গরমের এক বিকেলে স্টোন পুল গ্রাম।’
‘খাইছে,’ বলে উঠল মুসা, রবিনের কাঁধের ওপর দিয়ে চাইল। ‘সালটা তিনবার আণ্ডারলাইন করা।’ ও নিশ্চিত নয়, তবে মন বলছে এটা কোন ধরনের সূত্র হতে পারে।
কিন্তু রবিনের ধারণা এই ছবিটার মধ্যেই নির্ঘাত কোন সূত্র লুকিয়ে রয়েছে। হাত বাড়িয়ে ছবিটা দূরে ধরে থেকে, মাথা এপাশ-ওপাশ কাত করে খুঁটিয়ে দেখল।
‘নাহ,’ বলল শেষমেশ। ‘অস্বাভাবিক কোন কিছুই তো ধরতে পারছি না। তুমি দেখো তো, কিশোর। বন্ধুকে দিল ছবিটা।
কিশোর ঝুঁকল ওটা নিরীখ করতে।
‘এটা স্রেফ পুরনো আমলের এক গাঁয়ের ছবি। এর মধ্যে অস্বাভাবিক কোন কিছুই নেই।’ ও ছবিটা দিল ডনের হাতে।
দোকানগুলোতে অনেক লোক ঢুকছে-বেরোচ্ছে,’ মন্তব্য করল ডন। ‘ব্যস, এই তো। এর মধ্যে তো অন্যরকম কিছু পাচ্ছি না।’
ডনের কাছ থেকে ছবিটা নিয়ে গভীর মনোযোগে পরখ করল মুসা।
‘এখানে কিছু একটা ভুল আছে,’ বলল। ‘তবে ঠিক ধরতে পারছি না।’
‘কোন কিছু নিশ্চয়ই আমাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে, বলল নথি।
কিন্তু কিশোরের মাথায় তখন খেলা করছে অন্য চিন্তা ‘আমরা হয়তো ভুল পথে ভাবছি।’
ছবিটা থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই মুসা বলল, ‘খাইছে, আমরা ঠিক পথেই আছি, কিশোর। আমার মন বলছে।’
‘আপাতত আমাদের করার কিছু নেই, বলল কিশোর।
‘পেট ভরা থাকলে মাথা খেলে আমার,’ বলল মুসা।
হেসে ফেলল কিশোর।
‘বুঝেছি, মুসা। চলো তবে, লাঞ্চটা সেরে নিই।’
‘ছবিটা এখানেই থাক,’ বলল রবিন। ‘কিচেনে নিলে খাবার মেখে নষ্ট হতে পারে।
কফি টেবিলে রাখছে ফটোটা, রবিনের মনে হলো হল-এ মৃদু খসখস শব্দ হলো। এটা কি নিছকই ওর কল্পনা? নাকি সত্যিই কেউ আড়ি পেতে ওদের কথা শুনছিল?’
চামচ ভর্তি সুপ মুখে চালান করে বলল মুসা, খাইছে, কী অদ্ভুত!’
‘কীসের কথা বলছ?’ প্রশ্ন করে, গ্রিলড্ চিয স্যাণ্ডউইচে কামড় বসাল কিশোর।
‘ঠিক বোঝাতে পারব না, তবে স্টোন পুলের ছবিটার মধ্যে কী যেন একটা আছে,’ বলল মুসা, ‘আমাকে যেটা খোঁচাচ্ছে।’
‘ফটোটা কেমন ঝাপসা হয়ে গেছে,’ বলল ডন। ‘অনেক পুরনো তো।’
‘হ্যাঁ,’ বলে গ্লাসে আরও খানিকটা লেমোনেড ঢালল মুসা। ‘তবে ওটা না, অন্য কী যেন একটা মনে আসি আসি করেও আসছে না। কিছু একটা গড়বড় আছে ছবিটাতে।’
‘লাঞ্চের পর আবার দেখব আমরা ফটোটা,’ বলল রবিন। ‘তোমার মনে যখন এতটাই অস্বস্তি হচ্ছে।’
সুস্বাদু কুকিগুলো চেখে, ডিশগুলো সাবড়ে, ছেলেরা সোজা চলল লিভিংরুমের উদ্দেশে।
‘স্টোন পুলের ছবিটা কই?’ ডন জিজ্ঞেস করল।
‘নেই!’ বলে উঠল রবিন। এখানেই তো ছিল, কফি টেবিলের ওপরে।’
মাথা ওপর-নিচ করল মুসা।
‘তুমি তো ওখানেই রাখলে দেখলাম।’
‘তাহলে…গেল কোথায়?’ প্রশ্ন করে, কিশোর হতচকিত দৃষ্টি বোলাল চারধারে।
একটা ভাবনা খেলল মুসার মাথায়।
‘কেউ হয়তো অ্যালবামে রেখে দিয়েছে।’
‘দেখি তো, বলল নথি। কিন্তু খুঁজে পেল না ছবিটা।
‘খাইছে, কে নিতে পারে ওটা: মুসার জিজ্ঞাসা।
‘চোর-আর কে!’ ঘোষণা করল ডন। এবং কাজটা ভেতরের কেউই করেছে। একটা জানালাও তো ভাঙা নয়।’
শুনে মুখ টিপে হাসল কিশোর।
‘শার্লক সাহেব, হুট করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছনো ঠিক নয়।’
‘আমি বাজি ধরে বলতে পারি কাজটা রুবির,’ বলল ডন, স্থিরনিশ্চিত নিজের ধারণায়।
রবিন চাইল ডনের দিকে।
‘কাউকে সন্দেহ করার আগে, আমাদেরকে নিশ্চিত হতে হবে ফটোটা সত্যিই চুরি গেছে।’
এবার কামরাময় ধীর পায়ে হেঁটে বেড়াতে লাগল ছেলেরা, কুশন আর চেয়ারগুলোর পেছনে খুঁজল। কিন্তু স্টোন পুলের প্রাচীন ছবিটা লাপাত্তা।