ছয়
‘একটা ব্যাপার মাথায় আসছে না,’ মুসা আর রবিনের কামরায় গভীর রাতে আলোচনায় বসেছে ছেলেরা, ‘কেউ একজন চাইছে সেতুটাকে আমরা যেন ভুতুড়ে ভাবি। সেজন্যে অনেক ঝামেলাও পোহাতে হচ্ছে তাকে।’ বলল রবিন।
ভ্রূ কুঁচকে গেল মুসার।
‘খাইছে, কে করবে অমন কাজ?’
‘আর কীভাবেই বা?’ ডন জবাব চাইল।
‘জানি না,’ বলল রবিন, বিছানায় ডনের পাশে বসে রয়েছে। ‘কিন্তু শব্দটা ঠিক সাঁকোর নিচ দিয়ে চলা ঝরনার মতন।’
‘অন্যরা কেউ কি শুনেছে শব্দটা?’ ডন প্রশ্ন করল।
‘মনে হয় না, বলল কিশোর। এমিলি আর মিসেস ম্যাকলিনের কামরা দুটো বাড়ির সামনের দিকে। রুবিরও।’
‘কিন্তু মনিকা?’ বলল ডন। ‘ওরটা তো পেছনমুখো।’ শ্রাগ করল রবিন।
‘ওর হয়তো কুম্ভকর্ণের ঘুম।’
‘কিংবা হয়তো শব্দটা পেয়েছে,’ বাতলে দিল মুসা। ওর তো ধারণা সাঁকোটা ভুতুড়ে।’
‘আরেকটা সম্ভাবনা আছে,’ বলল কিশোর। চিমটি কাটল নিচের ঠোঁটে।
অন্যরা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইল ওর দিকে।
‘পুরো ব্যাপারটার পেছনে হয়তো মনিকার হাত আছে।’
‘খাইছে, তুমি কি সত্যিই ওকে সন্দেহ কর, কিশোর?’ বলে উঠল মুসা। ও তো এমিলির আত্মীয়!’
‘কেউই সন্দেহের বাইরে নয়, বলল কিশোর
‘কিন্তু ও আমাদের সাথে চালাকি করতে যাবে কেন?’ ফের প্রশ্ন করল মুসা। বিশ্বাস করতে পারছে না মনিকা অমন কাজ করতে পারে।
‘মেয়েটাকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে,’ বলল রবিন। ‘ও বলেছিল জঙ্গলে যায় না। কেন মিথ্যে বলেছিল?’
‘খাইছে, ব্যাপারটা সত্যিই আজব,’ স্বীকার করল মুসা।
‘মিথ্যে বলে ওর কী লাভ সেটাই হলো প্রশ্ন,’ ভাবুক কণ্ঠে বলল কিশোর।
‘কিংবা আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে,’ যোগ করল ডন।
‘ও হয়তো মজা করছে আমাদের সাথে,’ বাতলে দিল নথি।
‘আমাদের তো মজা লাগছে না, বলল কিশোর।
‘আরেকজনকে আমাদের সন্দেহের তালিকায় রাখা উচিত,’ বলল মুসা।
‘গ্রাহাম ব্রাউন?’ অনুমান করল রবিন।
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
‘উনি হয়তো ভাবছেন এভাবে ভয় দেখিয়ে এমিলিকে সাঁকোটা বেচতে বাধ্য করবেন।
‘সেতুটা ভুতুড়ে এটা প্রমাণ করে?’ ডন বলল।
আবারও মাথা ওপর-নিচ করল মুসা।
‘উনি তো বলেছিলেন সাঁকোটা যেভাবেই হোক চাই তাঁর।’
রবিনকে চিন্তামগ্ন দেখাল।
‘কাল রাতে উনি ডরোথির সাথে বসে ছিলেন ব্যাপারটা কেমন না? আমি তো ভেবেছিলাম উনি এ শহরের কাউকেই চেনেন না। বলেছিলেন স্রেফ এখান দিয়ে নাকি যাচ্ছিলেন।’
‘দু’জনে হয়তো ঘোঁট পাকিয়েছেন, কে জানে,’ বলল কিশোর।
‘গ্রাহাম আর ডরোথি হাত মিলিয়ে এসব করছেন?’ প্রশ্ন করল রবিন।
‘হতেও তো পারে, জবাব দিল কিশোর।
অন্যরাও সম্ভাবনাটাকে উড়িয়ে দিতে পারল না। হাজার হলেও, ডরোথিই প্রথম ওদেরকে বলেছিলেন সাঁকোটা ভুতুড়ে।
‘আমি আরেকজনের কথাও ভাবছি,’ বলল ডন। ‘রুবি।’
চমকে গেল মুসা।
‘রুবিকেও সন্দেহ করছ?’
‘ও আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইছে,’ বলল ডন। ‘কেন জান? কারণ ও নিজেই ব্রুচ লুকানো গোপন জায়গাটা খুঁজে বের করতে চায়!’
এর পেছনে যুক্তি আছে, মনে হলো কিশোরের।
‘তোমার কথা ঠিকও হতে পারে, ডন,’ বলল। ‘এমিলি যেই বললেন আমরা রহস্যটা নিয়ে কাজ করব অমনি রুবির হাবভাব একদম পাল্টে গেল।’
‘এবং সেজন্যেই ও জোর দিয়ে বলছে ফ্রঁচটা চুরি গেছে,’ উপলব্ধি করল রবিন। ‘ও চায় না অন্য কেউ ওটা খুঁজুক।’
ভ্রূ উঁচাল মুসা।
‘তারমানে কি রুবি ব্রুচটা চুরি করতে চাইছে?’
‘অসম্ভব নয়,’ জবাব দিল কিশোর। ‘ভুলে যেয়ো না, দামি রত্ন দিয়ে তৈরি ব্রুচটা। আর ওটার অ্যান্টিকমূল্যও আছে। ওর হয়তো পড়াশোনার খরচ চালাতে টাকার দরকার।’
মুসার সন্দেহ এখনও কাটেনি।
‘রুবি মিশুক মেয়ে নয়, কিন্তু তাই বলে ওকে চোর ভাবতে পারছি না।‘
‘সন্দেহ করতে অসুবিধে কী?’ বলল কিশোর।
‘খাইছে, আমাদের এক লাফে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছনো ঠিক হবে না,’ বলল মুসা, ‘এজন্যে আরও প্রমাণ চাই।’
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
‘আপাতত আমাদের সন্দেহ আমাদের মধ্যেই থাকুক। কিছু ব্যাপার জেনে নিই আগে।’
একটি বিষয়ে ওদের কারও কোন দ্বিমত নেই-ইটন প্লেসে নিঃসন্দেহে অনেক আজব ঘটনা ঘটছে।
পরদিন সকালে, নাস্তার পর এমিলি আর মিসেস ম্যাকলিন শহরে গেলেন কিছু কেনাকাটা সারতে। তাঁদেরকে বিদায় দিয়ে, তিন গোয়েন্দা আর ডন পেছনের আঙিনায় গেল খানিক তদন্ত করতে। কাল রাতে সেতুতে যে ছিল সে হয়তো কোন সূত্র ফেলে গেছে।
‘এসো, আমরা ছড়িয়ে পড়ি, বলল নথি। ‘তাহলে বেশি জায়গায় তল্লাশী করা যাবে।’
‘ভাল বুদ্ধি, বলল কিশোর। কেউ কিছু দেখলেই চিৎকার করবে।’
‘চিন্তা কোরো না, কিশোরভাই,’ সোৎসাহে বলে উঠল ডন। ‘আমি গলা ফাটিয়ে চেঁচাব।’
সেতুটার ওপরে তন্নতন্ন করে খুঁজে, কিশোর হেঁটে গেল মুসা যেখানে ঝোপঝাড়ে সূত্র খুঁজছে।
‘পেলে কিছু?’ প্রশ্ন করল ও। ‘নাই,’ বলল মুসা।
‘সেতুর নিচের ফুলবাগিচাগুলোয় খুঁজে দেখেছি,’ রবিন বলল, ডনকে নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ‘কিন্তু’
‘কিছুই পাইনি,’ শেষ করল ডন।
‘কী খবর, ছেলেরা!’ আচমকা শোনা গেল গ্রাহাম ব্রাউনের কণ্ঠস্বর। বাড়িটার ওপাশ থেকে হেঁটে আসছেন। ‘এমিলি আছেন এখানে?’ উজ্জ্বল হেসে বললেন।
সবার হয়ে কিশোর জানাল, ‘না, নেই।’
ডন বাহুজোড়া ভাঁজ করল।
‘আপনাকে সাফ জানিয়ে দিচ্ছি, এই সেতুটা বিক্রির জন্যে নয়।’
গ্রাহাম এক হাত তুললেন।
‘জানি, আমি এমিলিকে জ্বালাতন করতে আসিনি। বরং ক্ষমা চাইতে এসেছি।
‘ক্ষমা?’ অবাক কণ্ঠে বলে উঠল রবিন।
‘আমি ব্রিজটা বেচার জন্যে ওঁকে অনেক পীড়াপীড়ি করেছি, ‘ ব্যাখ্যা করলেন গ্রাহাম। ‘কাজটা ঠিক হয়নি আমার।’
‘শুধু তা-ই না, আপনি সবাইকে ভয় দেখানোরও চেষ্টা করেছেন, ঠিক না?’ অভিযোগের সুর ডনের গলায়।
‘কী…?’ চোখ পিটপিট করছেন গ্রাহাম।
ডন বলল, ‘আপনি এমন ব্যবস্থা করেছেন মানুষ যাতে ভাবে এটা ভুতুড়ে সাঁকো।’
‘কী বলছ এসব! আমি আবার কখন একাজ করলাম!’ রীতিমত হকচকিয়ে গেলেন গ্রাহাম। ‘মানুষকে বিরক্ত করেছি ঠিক, কিন্তু কাউকে ধোঁকা তো দিতে যাইনি!’ একে-একে ছেলেদের সবার দিকে চাইলেন। আমার নিজের বাচ্চাকাচ্চা আছে, বাচ্চাদেরকে ভয় দেখানোর প্রশ্নই ওঠে না!’
ছেলেরা পরস্পর চোখাচোখি করল। ওদের মনে হলো গ্রাহাম ব্রাউন সত্যি কথাই বলছেন।
গ্রাহাম বলে চললেন, ‘কাল রাতে গ্যাস স্টেশনের ভদ্রমহিলার সাথে কথা হয় আমার। উনি বললেন জন ইটন এই সেতুটার ওপর দাঁড়িয়েই তাঁর হবু স্ত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এ-ও বলেছেন, সেই স্টোন পুল থেকে জাহাজে করে ব্রিজটা আমেরিকায় আনান তিনি, শুধুমাত্র স্ত্রীকে খুশি করতে।’
‘হ্যাঁ, তাই,’ বলল মুসা।
‘খবরের কাগজের ওই আর্টিকল্টায় এসবের কিছুই ছিল না,’ কথার খেই ধরলেন গ্রাহাম। এখন বুঝতে পারছি এজন্যেই এমিলি দর কষাকষিতে রাজি হননি। পারিবারিক ইতিহাস- ঐতিহ্যের কি টাকার অঙ্কে কোন মূল্য হয়?’ বিরতি নিয়ে প্রশংসার দৃষ্টিতে চাইলেন সাঁকোটার দিকে। ‘এমিলিকে প্লিজ আমার তরফ থেকে বিদায় বলে দিয়ো। আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, আর আসব না।’ খোশমেজাজে হাত নেড়ে, হাঁটা দিলেন ভদ্রলোক।
‘গ্রাহাম ব্রাউন সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ,’ বলল রবিন, বারান্দার সিঁড়ির ধাপ ভেঙে উঠছে
‘ডরোথিকেও বাদ দেয়া যায়, দল বেঁধে কিচেনে ঢোকার সময় বলল কিশোর।
বাতাসে নাক টানল মুসা।
‘কী দারুণ গন্ধ! জিভে পানি আসছে!’
আভ থেকে ট্রে ভর্তি কুকি বের করছিল মনিকা। ডনের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল।
‘তোমার না কুকিতে নকশা করার কথা ছিল, ডন?’ বলল। ‘আমার কাছে কী আছে জান? বাটারনাট ফ্রস্টিং আর স্প্রিঙ্কস্!’
ডনকে দু’বার বলতে হলো না। ও হাত ধুয়ে কাজে লেগে পড়ল, ওদিকে মনিকা ব্যস্ত হলো আরেক ধরনের কুকি নিয়ে।
তিন গোয়েন্দা টেবিলে বসে মেগের ধাঁধাটার মর্মোদ্ধারের চেষ্টা করতে লাগল।
রবিন ওর নোটবই খুলে আবৃত্তি করল।
শেষটা যখন শুরু,
আর শুরু যখন শেষ,
তুমি ইটন’স লুপের জট খুললে,
শুকরিয়া অশেষ।
একবার…দু’বার… তিনবার পড়ল ও ধাঁধাটা। বৃথা। ওদের এখনও ক্ষীণতম ধারণা নেই এটার অর্থ কী।
মনিকা কুকি ব্যাটারে ভ্যানিলার ফোঁটা ফেলছে সেদিকে চাইল মুসা।
‘মনি, তুমি কি বাসাতেও বেক কর?’ প্রশ্ন করল। ‘তোমার বাবা-মাকে খাওয়ানোর জন্যে আরকী। ওঁরা নিশ্চয়ই খুব ভালবাসেন তোমার কুকি?’
অদ্ভুত দৃষ্টিতে মুসার দিকে চাইল মেয়েটি।
‘আমার বাবা-মার কথা তুললে কেন?’ শীতল স্বরে বলল।
মুসা বুঝল ভুল করে ফেলেছে।
‘আমি শুধু বলতে চেয়েছিলাম…’ কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল ওর।
কিশোর আর রবিনের তাকাতাকি হলো। ওদের চোখের ভাষায় ফুটে উঠেছে ‘ব্যাপারটা কী হলো’ দৃষ্টি। এ পরিস্থিতিতে এরপর কী বলা উচিত কেউই নিশ্চিত নয়। একটু পরে, মনিকা দুপদাপ পা ফেলে কামরা ছাড়ল।
‘আজব না?’ নিচু গলায় বলল রবিন।
সায় জানাল কিশোর।
‘মনি বাবা-মার ব্যাপারে কোন কথাই বলতে চায় না।’
‘খাইছে, তা-ই তো মনে হলো,’ বলল মুসা।
কুকিগুলো দেখতে ওরা সবাই জড় হলে ডন বলল, ‘মনির জন্যে তারার নকশাওয়ালা এটা বানিয়েছি আমি। ওর নাম আছে এতে।’
ডনের তর্জনী লক্ষ্য করে তাকিয়ে কোনমতে হাসি চাপল রবিন।
‘অক্ষরগুলো উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে, ডন। ‘মনি’ লিখতে গিয়ে ‘ইনম’ লিখেছ তুমি। Moni না হয়ে Inom হয়ে গেছে ওটা।’
কপালে করাঘাত করল ডন।
‘ইস!’
‘I অক্ষরটা সবশেষে যাবে,’ খুলে বলল মুসা। ‘M আসবে শুরুতে, তারপর O, তারপর N।’
স্প্রিঙ্কস্ চেঁছে তুলে আবারও চেষ্টা করল ডন। এবার ঠিকঠাক বানানে লিখতে পারল মনিকার নাম। সবাই ওকে উৎসাহ দিতে হাততালি দিল শুধু কিশোর বাদে, এদিকে মন নেই ওর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল ও। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে ওর মনে হচ্ছে ধাঁধাটার সমাধান করে ফেলা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, কিন্তু ঠিক ধরতে পারছে না সেটা কীভাবে। এবং এবার বিদ্যুচ্চমকের মতন সব কিছু বসে গেল খাপে খাপে।
‘পেয়েছি!’ চেঁচিয়ে উঠল ও।