তিন
সে রাতে, ছেলেদের চোখে ঘুম আসতে দেরি হলো না। মাঝরাতের দিকে, নড়ে উঠল ডন। ওর মনে হলো কোন শব্দ শুনেছে-অনেকটা দ্রুত বয়ে চলা জলপ্রবাহের মত আওয়াজটা। সম্ভবত বাইরে থেকে এসেছে। শব্দটা কীসের?
‘কিশোরভাই?’ ফিসফিস করে ডাকল ও।
কিশোর সাড়া দিল না, ঘুমিয়ে কাদা।
ডন হড়কে নামল বিছানা থেকে। হেঁটে গেল জানালার কাছে। জানালার ধারিতে ঝুঁকে, স্ক্রিন ভেদ করে কালিগোলা আঁধারে চাইল।
অদ্ভুত শব্দটা যেমন শুরু হয়েছিল তেমনি আচমকাই থেমে গেল।
‘ডন?’ ঘুম জড়ানো গলায় ডাকল কিশোর। ‘কী হয়েছে?’
‘কী-কীসের যেন শব্দ পেলাম,’ তুতলে বলল ডন।
‘ঝিঁঝি পোকা হবে,’ হাই চেপে বলল কিশোর। ‘চিন্তার কিছু নেই।’
মাথা নাড়ল ডন।
‘না, ওটা অন্য কিছুর শব্দ, কিশোরভাই,’ দৃঢ়কণ্ঠে বলল। গলার স্বর নিচু রাখতে চেষ্টা করল। ‘অদ্ভুত কোন কিছু।’
‘তুমি স্বপ্ন দেখছিলে বোধহয়, তন্দ্রাচ্ছন্ন কিশোর বলল। ‘হবে হয়তো,’ বলল ডন, উঠে পড়ল বিছানায়। তবে জানে ও স্বপ্ন দেখেনি।
‘আমি বলছি, মেগের ব্রুচটা চুরি গিয়েছিল,’ পরদিন নাস্তার টেবিলে এমিলিকে বলছিল রুবি। ‘নিশ্চয়ই কোন মিস্ত্রি সরিয়েছিল ওটা।’
ভ্রূ কোঁচকাল ডন।
‘তারমানে আপনি বলছেন কোন গোপন জায়গায় ওটা লুকানো নেই?
‘অবশ্যই।’ টোস্ট থেকে সামান্য একটু ভেঙে মুখে দিল রুবি। ‘গবেষণা করে, জেনেশুনেই বলছি।’
ডন রীতিমত মুষড়ে পড়ল।
ওর হতাশা স্পর্শ করল মুসাকে।
‘খাইছে, তদন্ত না করে নিশ্চিতভাবে এখনই কিছু বলা যাবে না, ডন।’ বিফের বড় থালাটা ঠেলে দিল মনিকার দিকে।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
‘আমাদের অন্তত চেষ্টা তো করতে হবে।’
‘আপনি হয়তো কিছু মিস করেছেন, রুবি,’ বলল ডন।
কথাটা বলা ঠিক হয়নি। সঙ্গে-সঙ্গে ভ্রূ কুঁচকে ফেলল রুবি।
‘আমরা ভাগ্যবান, ভুল করলে ধরিয়ে দেয়ার জন্যে তোমরা আছ,’ বলল, তবে কণ্ঠস্বর শুনে মোটেই মনে হলো না নিজেকে ভাগ্যবতী ভাবছে ও।
তিন গোয়েন্দা দৃষ্টি বিনিময় করল। রুবি এত নাখোশ কেন ওদের ওপরে?
‘পুরনো কোন খবরের কাগজেই চুরির কথা লেখা হয়নি।’ টোস্টে কামড় দিয়ে চিবোতে লাগলেন চিন্তামগ্ন এমিলি। ‘আর মেগের সেই ছোট্ট ছড়াটা? ওটার ব্যাপারে তুমি কী বলবে, রুবি?’
‘ফালতু, খুব সম্ভব।’
একটা ভ্রূ উঠে গেল এমিলির।
‘ফালতু?’
‘অর্থহীন ছড়া,’ বলে ন্যাপকিনটা বারকয়েক মুখে চেপে ধরল রুবি। ‘আর কিছু নয়।’
কিন্তু এমিলি মোটেও আস্থা রাখলেন না ওর কথায়।
‘আমার ধারণা, মেগের ছড়ায় এমন কিছু রয়েছে যেটা চট করে চোখে পড়ে না,’ বললেন তিনি।
মিসেস ম্যাকলিন বিনা দ্বিধায় বান্ধবীর সঙ্গে একমত হলেন। ‘এর সমাধান করতে পারলে একমাত্র কিশোর, মুসা, রবিন আর ডনই পারবে।’
হতাশায় দু’হাত ছুঁড়ল রুবি।
‘যাই, আমার জরুরী কাজ আছে,’ বলে চেয়ার পেছনে ঠেলল ও। ‘আমাকে ডেন-এ পাবেন।’
‘এক মিনিট, রুবি,’ বললেন এমিলি, প্রসঙ্গ পাল্টালেন। ‘তুমি কি আমার টেপ রেকর্ডারটা দেখেছ? আমার ডেস্কে ছিল পাচ্ছি ‘না।’
রবিন খেয়াল করল মনিকা লাল হয়ে গেছে।
‘না তো,’ জানাল রুবি। এবার বাঁকা হাসল। ‘তবে আমি শিয়োর এই সোনার ছেলেগুলো ওটা ঠিক খুঁজে বের করতে পারবে-জাস্ট এভাবে!’ বলে, তুড়ি বাজাল। এবার হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।
‘রুবি আমাদের দেখতে পারেন না,’ ক্ষীণস্বরে বলল ডন। ওদেরকে নিয়ে কেউ তামাশা করলে ভাল লাগে না ওর।
‘অবশ্যই পারে, ডন,’ এমিলি আশ্বস্ত করলেন ওকে। ‘রুবিকে প্রচণ্ড খাটতে হয় তো, তাই ওর মেজাজটা অমন খিটখিটে হয়ে থাকে। তুমি ও নিয়ে একটুও মন খারাপ কোরো না।’ মুখ ভর্তি ডিম গেলার জন্য সামান্য বিরতি নিলেন তিনি। ‘এই গবেষণাটাকে কে জানে কেন অসম্ভব গুরুত্ব দিচ্ছে রুবি। ‘
মিসেস ম্যাকলিন টোস্টে মাখন মাখাচ্ছিলেন, চোখ তুলে চাইলেন।
‘তোমার সহকারী মনে হয় নিশ্চিত যে ফ্রঁচটা চুরি গিয়েছিল।’
হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকাল ডন।
‘রুবির ধারণা কোন মিস্ত্রি চুরি করে ওটা। এ কথা বলে উনি কী বোঝাতে চাইলেন জানি না।’
‘ও সেতুর শ্রমিকদের কথা বলছিল,’ ব্যাখ্যা করলেন এমিলি, প্যানকেকে সিরাপ ঢাললেন। ‘ক্রচটা যখন খোয়া যায় ওরা তখন এখানে কাজ করছিল।’
কিশোর জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি পেছনের ওই ব্রিজটার কথা বলছেন?’
‘হ্যাঁ, ওটাকে সেই স্টোন পুল থেকে নিয়ে আসা হয়, বললেন এমিলি।
‘খাইছে, স্টোন পুল?’ মুসা চমকে তাকাল এমিলির মুখের দিকে।
‘ওই সাঁকোটার ওপর দাঁড়িয়েই জন বিয়ের প্রস্তাব দেন মেগকে,’ জানালেন মিসেস ম্যাকলিন, পাতে আরও খানিকটা গরুর মাংস তুলে নিলেন। ‘ঠিক না, এমিলি?’
বান্ধবীর উদ্দেশে চেয়ে স্মিত হাসলেন এমিলি।
‘হ্যাঁ, শার্লট! এবং জন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন সাঁকোটাকে মহাসাগর পার করে যেভাবেই হোক নববধূর জন্যে নিয়ে আসবেন।’
মুসা বুঝতে পেরে মাথা ঝাঁকাল। মেগের যাতে জন্মভূমির জন্য মন কেমন না করে তাই জন চেয়েছিলেন স্টোন পুলের একাংশকে এখানে নিয়ে আসতে।
‘শুনেছি তাঁর লোভনীয় প্রস্তাবটা ফেরাতে পারেনি স্টোন পুলের গ্রামবাসী। শীঘ্রি সাঁকোটাকে ভেঙে, প্রতিটা পাথর আলাদা করে, জাহাজে চাপিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।’ সামান্য হাসলেন এমিলি। ‘সমস্যা ছিল একটাই।’
‘কী সেটা, এমিলি?’ রবিন প্রশ্ন করল।
‘জন জঙ্গলের ঝরনাটার মাপ নেননি, ভেবেছিলেন ব্রিজটা ঠিকঠাক বসে যাবে ওটার ওপরে,’ বললেন তিনি। কিন্তু তাঁর হিসেবে ভুল হয়ে যায়। সাঁকোটা লম্বায় খাট ছিল।
‘সাঁকোটা তো অন্তত বাড়ির পেছনের ঝরনাটার মাপ মত ছিল,’ মুসা বলল।
‘বাড়ির পেছনে কোন ঝরনা নেই, মুসা,’ বললেন এমিলি। ‘সাঁকোটা পানির ওপর নয়- প্যানজি ফুলের বড়সড় এক বাগিচার ওপর বসানো হয়েছে।’
‘সেজন্যেই কেউ ওখানে কখনও মাছ ধরতে যায় না,’ এবার পরিষ্কার বুঝল কিশোর।
‘ওটার নিচে এক ফোঁটা পানিও নেই,’ মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন এমিলি। ‘কখনওই ছিল না।’ সিরাপ এগিয়ে দিলেন ডনকে। ‘তবে মেগ তাতে কিছু মনে করতেন না। পিছনের উঠনে পুরানো সেতুটা দেখেই খুশি থাকতেন তিনি।’
ডন কী যেন ভাবছিল।
‘এমিলি, ব্রিজটা কি ভুতুড়ে?’
‘আমার ধারণা এসবই ওই ডরোথির রটনা,’ বললেন মিসেস ম্যাকলিন।
চোখ ঘোরালেন এমিলি।
‘ডরোথি মুখের লাগাম টানতে জানে না।’
বিস্মিত ছেলেরা একে অন্যের মুখের দিকে চাইল। তাহলে কি ডরোথির কথাই ঠিক?
‘খাইছে, সাঁকোটায় কি জনের ভূত হানা দেয়?’ মুসা জানতে চাইল। ‘নাকি মেগের?
ডনের হঠাৎই মনে পড়ল মিসেস ম্যাকলিন কী বলেছিলেন। ‘ওটা নিশ্চয়ই চ্যাটারিং বোনসের ভূত!’
এমিলি হাসলেন ওর দিকে চেয়ে।
‘ঠিক বলেছ, ডন!’
রবিন কৌতূহলী হয়ে উঠল।
‘একটু খুলে বলবেন, এমিলি?’
এমিলি বললেন, ‘অনেক বছর ধরে মাঝরাতে ওখানে মাঝে-মাঝে অদ্ভুত সব শব্দ শোনা যায়।’
ডনের চোখ বিস্ফারিত।
‘কী ধরনের শব্দ?’
‘আমি নিজে কখনও শুনিনি,’ বলে মুখে ন্যাপকিন চাপলেন এমিলি। তবে লোকে বলে পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ঝরনার কলকল শব্দের মত নাকি শোনায় ওটা।’
ছেলেরা চেয়ে রইল অবাক বিস্ময়ে, মুখে কথা ফুটল না ওদের। ওরা কোন প্রশ্ন করার আগেই, আবারও কথা বললেন এমিলি।
‘চ্যাটারিং বোস্’ নামে স্টোন পুলের কাছে এক ঝরনা ছিল। শহরের সীমান্তে, প্রাচীন এক পাথুরে সাঁকোর নিচ দিয়ে বহু বছর ধরে বয়ে গেছে ওটা।’
মুসা শ্বাস চাপল।
‘এটা কি মেগের জন্যে কেনা জনের সেই সাঁকোটা?’
মাথা ঝাঁকালেন এমিলি।
‘হ্যাঁ, ওটাকেই ভেঙে টুকরো-টুকরো করে জাহাজে চাপিয়ে পাঠানো হয় এখানে।’
মনিকা এতক্ষণ এক কমলার খোসা ছাড়াচ্ছিল, ঝট করে মুখ তুলে চাইল।
‘এর ঠিক পরপরই চ্যাটারিং বোস্ হারিয়ে যায়।’
‘হারিয়ে যায় মানে?’ বলে উঠল কিশোর।
মনিকা চাইল ওর উদ্দেশে।
‘স্রেফ উবে যায়।’
কিশোর রীতিমত হতবুদ্ধি।
‘কিন্তু একটা ঝরনা… হঠাৎ উধাও হয়ে যায় কীভাবে?’
‘ব্যাপারটা আসলে তা-ই, কিশোর। জানা যায় সাঁকোটা ভাঙার পরপরই শুকিয়ে যায় ঝরনাটা। অনেকটা এমন যেন খাঁড়িটার সাঁকোটাকে ছাড়া চলবে না। দুটো যেন মানিকজোড়।’ এমিলি ধীরে-ধীরে বললেন, কী বলছেন সে বিষয়ে যেন নিজেও নিশ্চিত নন।
শিউরে উঠল মুসা। রহস্য ক্রমেই আরও ঘনিয়ে উঠছে। ডনের চোখ ছানাবড়া।
‘তারমানে রাতে যে শব্দটা হয় ওটা চ্যাটারিং বোনসের ভূতে করে?’
মনিকা জবাবটা দিল।
‘হ্যাঁ, রাতের আঁধারে ভুতুড়ে ঝরনাটা সাঁকোটার নিচ দিয়ে বয়ে যায়।’ শান্ত, ফিসফিসে শোনাল ওর কণ্ঠস্বর।
চোখজোড়া আরও গোল হয়ে গেল ডনের। তড়িঘড়ি জানালার কাছে গিয়ে বাইরে উঁকি দিল।
‘অদ্ভুতুড়ে এক ভূতের গল্প এটা,’ মন্তব্য করে, টেবিল পরিষ্কার করতে উঠে পড়ল রবিন।
‘ইটন প্লেস রহস্যের খনি,’ বললেন মিসেস ম্যাকলিন। ‘তাতে কোন সন্দেহ নেই।’
ডন হঠাৎই এমিলির দিকে চাইল।
‘সেই ভদ্রলোক আবার এসেছেন।’
‘কোন্ ভদ্রলোক?’ প্রশ্ন করে, ডনের পেছনে এসে দাঁড়াল কিশোর।
‘যিনি ব্রিজটা কিনতে চান।’
ঝটিতি উঠে দাঁড়ালেন এমিলি।
‘লোকটাকে দু’এক কথা না শোনালেই নয় দেখছি!’
তাঁর পিছু নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল সবাই। ওই তো, সেতুটার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন গ্রাহাম ব্রাউন। ওদেরকে দেখে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। ওরা শশব্যস্তে যখন পৌঁছল, তাঁর মুখে তখন খেলা করছে আনন্দের হাসি।
‘আমার সাঁকোটা একটু দেখতে এলাম আরকী,’ বললেন ওদেরকে।
‘মানে?’ ভ্রূ কুঁচকে গেছে এমিলির।
কিন্তু তাঁর কথা যেন কানেই যায়নি গ্রাহামের। স্রেফ পাথরগুলোর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে মৃদু হাসলেন।
‘এটা আমার সাঁকো, শাণিত কণ্ঠে বললেন এমিলি। ‘আমি কারও কাছেই এটা বেচব না!’
আচমকা হেসে উঠলেন গ্রাহাম, তবে হাসিটা কেমন যেন কানে লাগল সবার।
‘আমার ধারণা আপনার মত পাল্টাবে,’ বললেন। এবার উল্টো ঘুরে গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন।
ছেলেরা পরস্পর উদ্বিগ্ন দৃষ্টি বিনিময় করল। গ্রাহাম ব্রাউনের মতলবটা কী?