ভীষ্ম – ৩

॥ ৩ ॥

শান্তনুর পুত্র যখন মায়ের বাড়িতে মানুষ হচ্ছিলেন, তখন তাঁর নাম ছিল দেবব্রত। হয়তো গঙ্গাই তাঁর এই নামকরণ করেছিলেন। কিন্তু পিতার সঙ্গে বালককাল থেকেই তাঁর কোনও সম্পর্ক না থাকায় লোকে এই গঙ্গাপুত্রকে মায়ের নামেই ডাকত। তারা বলত গাঙ্গেয়। গাঙ্গেয় দেবব্রত জন্মাবধি পিতৃপরিত্যক্ত এবং তিনি যে বেঁচে ছিলেন, অন্য পুত্রগুলির মতো গঙ্গা যে তাঁকে জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলেননি—এ শুধু তাঁর শুভাদৃষ্ট। তবে ইউরোপীয় পুরাতত্ত্ববিদেরা বলেন যে, সৌরকুলের যাঁরা জাতক (Solar gods, Solar heroes), তাঁদের জন্ম এবং শৈশব লালনটুকু ঘটে অতি কষ্টে এবং যন্ত্রণায়। পিতা বা মাতার কাছে তাঁদের থাকা হয় না অথবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা জনক-জননীর দ্বারা পরিত্যক্ত। যেমন কৃষ্ণ অথবা যেমন কর্ণ। কৃষ্ণের সঙ্গে দেবব্রত গাঙ্গেয়র মিল হল—তাঁরা উভয়েই জননীর অষ্টম গর্ভের সন্তান এবং যেকোনও কারণেই হোক, তাঁদের পূর্বজন্মা সাতজন মারা গেছেন।

শিশু বয়সে সৌরকুলজাতকের এই যে কষ্টগুলি, এ নাকি ভবিষ্যতে তাঁদের উজ্জ্বল সম্ভাবনার প্রতিতুলনায় কল্পিত হয়। অর্থাৎ ভবিষ্যতে তাঁরা যে এক একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন, সেই প্রতিষ্ঠাকে প্রতিতুলনায় প্রোজ্জ্বল করার জন্যই প্রাথমিক জীবনে তাঁদের প্রতি সমাজের বঞ্চনা এবং অগৌরবের কথা উচ্চারিত হয়। তবে প্রাথমিক জীবনে নানা দুর্ভাগ্যের ঘটনা অন্যান্য সৌরকুলজন্মাদের জীবন যতখানি কণ্টকিত করেছে, সে তুলনায় দেবব্রত গাঙ্গেয়র ভাগ্য অনেক ভাল। পিতা তাঁকে রাজধানীতে নিয়ে না গেলেও তিনি জননীর পরিত্যক্ত নন এবং জননী তাঁকে আপন চেষ্টায় ভালই মানুষ করেছেন। সেকালের দিনের শ্রেষ্ঠ গুরুদের কাছে রেখে তিনি তাঁর পুত্রের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন—এটাই শুধু নয়, দেবব্রত গাঙ্গেয় শেষপর্যন্ত পিতৃকুলের রাজ্যাধিকারে স্থাপিত হয়েছেন বিনা চেষ্টায়, বিনা বাধায়।

কিন্তু অন্যান্য সৌরকুলের জাতকদের প্রতিতুলনায় এ পর্যন্ত দেবব্রত গাঙ্গেয়র ভাগ্য কিছু ভাল হলেও এরপর তাঁর জীবনে যত কষ্ট আসবে, সে কষ্ট আবার তাঁর স্বগোত্রীয় সৌরকুলজন্মাদের ভাগ্যে জোটেনি। ভেবে দেখুন, গাঙ্গেয় দেবব্রত যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হবার পর তাঁর পিতৃরাজ্যের অমাত্য-মন্ত্রীদের সঙ্গে যথেষ্টই ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠল। দেবব্রত গাঙ্গেয় তাঁদের অনুরক্তি, আনুগত্য এবং সাহায্য সবই পেলেন একসঙ্গে। তা ছাড়া তিনি নিজে যেহেতু অস্ত্রবিদ্যায় অসামান্য নৈপুণ্য অর্জন করেছিলেন, তাই বহু রাজ্য জয় করে কুরু-ভরতবংশের শত্রুদের যেমন শান্তনুর বশে নিয়ে এসেছিলেন, তেমনই করদ রাজ্যগুলি থেকে বহু ধনরত্ন তিনি হস্তিনাপুরের রাজকোষে জমা করেছিলেন। এতদিন পরে হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে প্রবেশ করেও দেবব্রত গাঙ্গেয়র যে কোনও অসুবিধে হল না, তার কারণ তিনি নিজ গুণে এবং ব্যক্তিত্বে সমস্ত প্রজাদের আস্থা অর্জন করে নিয়েছিলেন খুব কম সময়ের মধ্যেই। ফলত রাজ্যের মন্ত্রী অমাত্যরাও তাঁর কোনও কাজে বাধা দেননি, কারণ তাঁরা একটি ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, শান্তনুর এই পুত্রটি বহিরাগত হলেও কুরুরাজ্যের হিতের জন্য সমস্ত দায়বদ্ধতার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন।

স্বাভাবিকভাবেই মহারাজ শান্তনুর দিক থেকেও পরম নিশ্চিন্ততার কারণ ঘটেছিল। আর নিশ্চিন্ততা থাকলেই রাজাদের যা হয়, তাঁদের মন আনচান করে ওঠে বিলাসের জন্য, ব্যসনের জন্য, ভ্রমণের জন্য। শান্তনু পাত্রমিত্র ছেড়ে যুবরাজ দেবব্রতকে রাজ্য পরিচালনার ভার দিয়ে নিশ্চিন্তে মৃগয়া করতে বেরুলেন একাকী। এবারে গঙ্গার দিকে নয়, যমুনাপুলিনে। সেবারে গঙ্গার তীরচারিণী এক মৃগবধূ পূর্বেই তাঁর ভালবাসার শরে বিদ্ধ হয়েছেন, এবারে যমুনাপুলিনে কোনও মৃগবধূ তাঁর শরবিদ্ধ হওয়ার অপেক্ষায় আছেন তা না বুঝেই শান্তনু চললেন মৃগয়ায়। ‘ধনুকবাণ ধরি দখিন করে।’

এক রমণীর সাহচর্য লাভ করে মহারাজ শান্তনু উপযুক্ত পুত্র লাভ করেছেন বটে, কিন্তু এখনও হস্তিনাপুরের রাজবধূ তাঁর ঘরে আসেননি। তাঁর হৃদয়ে আছে অদ্ভুত এক শূন্যতা। হৃদয় পেয়েও বিনা কারণে হৃদয় হারাবার শূন্যতা। অনুক্ষণ তাঁর মনে হয়—কী যেন বলিবার ছিল বলা হয় নাই, কী যেন শুনিবার ছিল শুনা হয় নাই। শান্তনু শূন্য মনে মৃগয়ায় চললেন। অন্তরে এক প্রেমিকের মন তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল।

ধীর সমীরে যমুনাতীরে যেতে যেতে শান্তনুর নাকে এক মধুর গন্ধ ভেসে এল। এ এমন এক সুগন্ধ, যা কোনও স্বভাব-প্রেমিকের হৃদয়ে জন্মান্তরের ভাবস্থির স্মৃতি এনে দেয়, তাকে উতলা করে, অশান্ত করে। সেই মধুর সুগন্ধের উৎস খুঁজতে খুঁজতে শান্তনু যেখানে এসে পৌঁছেলেন, সেখানে এক রমণী দাঁড়িয়ে আছেন। লোকে তাঁকে সত্যবতী বলে ডাকে। কেউ বা বলে গন্ধবতী, পদ্মগন্ধা, যোজনগন্ধা। এই রমণী যেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন, তার এক যোজন দূর থেকে নাকি তাঁর গায়ের সুগন্ধ ভেসে আসে। শান্তনু সেই সৌগন্ধে লুব্ধ হয়েই এত দূর এসেছেন এবং এখন যে অবস্থায় তিনি রমণীকে দেখতে পেলেন তাতে তাঁর লুব্ধতা চরম বিন্দুতে পৌঁছোল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—তুমি কে? কার মেয়ে? এখানেই বা তুমি কী করছ—কস্য ত্বমসি কা বাসি ভীরু কিঞ্চ চিকীর্ষসি?

শান্তনু যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেটা যমুনানদীর এক খেয়াঘাট। আজ তেমন লোকজনও নেই যারা খেয়া পার হয়ে যমুনার পরপারে যাবে। একেবারে হস্তিনাপুরের রাজা না হলেও বহু পুরুষমানুষকে গান গেয়ে তরী বেয়ে যমুনার ওপারে নিয়ে গেছেন এই রমণী। কাজেই পুরুষমানুষ দেখলেই তাঁর কোনও ভাববিকার ঘটে না। রমণী নিজেই জানেন যে, তিনি অসাধারণ রূপবতী। এই খেয়া পারাপারের সময়েই একদিন তাঁর ছোট্ট নৌকাটিতে পদধূলি দিয়েছিলেন মহামুনি পরাশর। তিনি মধ্যনদীতে এই রমণীর প্রণয়প্রার্থী হয়ে তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। মুনির অলৌকিক ক্ষমতায় সদ্যগর্ভ লাভ করে তৎক্ষণাৎ পুত্রলাভ করেছিলেন সত্যবতী, আর সেই থেকেই মুনির আশীর্বাদে তাঁর জন্মগন্ধ ধুয়ে গেছে। তিনি যোজনগন্ধা গন্ধবতী হয়েছেন।

বস্তুত, সত্যবতী কৈবর্তপল্লিতে দাসরাজার ঘরে মানুষ হয়েছেন। কিন্তু মুনিবর পরাশরের সংস্পর্শে এসে, অপিচ স্বয়ং মহাভারতের কবি দ্বীপজন্মা দ্বৈপায়ন ব্যাসকে গর্ভে ধারণ করে তিনি যে মাহাত্ম্য লাভ করেছেন, তাতেই হয়তো তাঁর সুনাম-সৌগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। হয়তো সেইজন্যই তাঁর নাম যোজনগন্ধা। নইলে এমনিতে তিনি কৃষ্ণবর্ণা এক রমণী, কৈবর্তপল্লির অন্ত্যজ সংস্কারে তাঁর জন্ম। কিন্তু যৌবনসন্ধিতেই মুনিবর পরাশরের সাহচর্যে এসে তাঁর জীবনে যেমন ব্রাহ্মণ্য সংস্কার এসেছে, তেমনই খেয়া পারাপারের কর্ম করতে করতে তাঁর ব্যক্তিত্বও দৃঢ়তর হয়েছে। শান্তনুর প্রশ্ন শুনে সত্যবতী বললেন—আমি দাসরাজার মেয়ে। তাঁরই নির্দেশে আমি এই যমুনানদীতে খেয়া পারাপার করি।

মহারাজ শান্তনু যেন এমন রূপময়ী এবং ব্যক্তিত্বময়ী রমণী জীবনে দেখেননি। অতএব দেখামাত্রই তাঁকে কামনা করলেন তিনি—সমীক্ষ্য রাজা দাসেয়ীং কাময়ামাস শান্তনুঃ। শান্তনু এতকাল স্ত্রীসঙ্গবর্জিত অবস্থায় দিন কাটিয়েছেন। গঙ্গার সঙ্গে তাঁর যৌবনসন্ধির প্রথম বৎসরগুলি ঘনিষ্ঠভাবেই কেটেছে বটে, কিন্তু একের পর এক সন্তান-বিপর্যয়ের পর গঙ্গার প্রতি তাঁর সেই মানসিকতা গড়ে ওঠেনি, যাতে পুরুষহৃদয়ের সরসতা টিকে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই সত্যবতীর রূপ এবং ব্যক্তিত্ব দেখে শান্তনু তাঁর হৃদয় যাচনা করলেন।

সত্যবতী কিন্তু রাজার সমস্ত আবেগ বুঝেও হস্তিনাপুরের মহারাজকে সোজাসুজি হৃদয় দিতে পারলেন না। স্মিতহাস্যে মধুর আবেশ জড়িয়ে তিনি বললেন—আমি আমার প্রভু নই, মহারাজ! অতএব আমি নিজেই নিজেকে আপনার হাতে তুলে দিতে পারি না। আপনার যদি সত্যিই আমাকে পাবার ইচ্ছে থাকে, তবে আমার পিতাকে রাজি করান। শান্তনু ভাবলেন—এ আর এমন কী বড় কথা। তিনি সঙ্গে সঙ্গে কৈবর্তপল্লিতে উপস্থিত হয়ে দাসরাজাকে বললেন—আমি হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু। তোমার কন্যাটিকে বিবাহ করতে চাই—স গত্বা পিতরং তস্যা বরয়ামাস শান্তনুঃ।

দাসরাজা তথাকথিত হীনজাতির মানুষ হলে কী হবে, তাঁর স্বভাবে কোনও হীনম্মন্যতা নেই এবং তাঁর বুদ্ধিটাও অত্যন্ত প্রখর। তিনি বুঝলেন—রাজা যখন তাঁর মেয়ের অঞ্চল ধরে এই কৈবর্তপল্লি পর্যন্ত উপস্থিত হতে পেরেছেন, তখন মেয়ের ভবিষ্যৎটি এখনই নিশ্চিত করে নেওয়া ভাল। বিশেষত শান্তনুর গঙ্গা-ঘটিত প্রণয়সম্বন্ধ এবং সেই সম্বন্ধে মহারাজ শান্তনুর পুত্রলাভের কথাও দাসরাজার অবিদিত ছিল না নিশ্চয়। আর ঠিক সেই কারণেই এতাবৎকাল স্ত্রীসঙ্গবর্জিত এক প্রায়-কামুক রাজাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে দাসরাজা তাঁর চাল চাললেন। বললেন—মেয়ে তো আমাকে সৎপাত্রে দিতেই হবে, মহারাজ! সে আর এমন বেশি কথা কী—জাতমাত্রৈব মে দেয়া বরায় বরবৰ্ণিনী। তবে হ্যাঁ, বিয়ের ব্যাপারে আমার একটা শর্ত আছে, মহারাজ! সেই শর্তটি পূরণ করলেই আমার আর কোনও কথা নেই। শত খুঁজলেও আপনার মতো জামাই আমি কোথায় পাব—ন হি মে ত্বৎসমো কশ্চিদ্‌ বরো জাতু ভবিষ্যতি।

শান্তনু বুঝলেন—দাসরাজা খুব সহজ লোক নন। সুযোগসন্ধানী তো বটেই। তিনি তাই আগেই কথা দিলেন না। বললেন—আগে তোমার শর্তটা কী শুনি। তারপর না হয় প্রতিজ্ঞা করব। দাসরাজা বললেন—এমন বেশি কিছু নয়, মহারাজ! শুধু মনে রাখবেন—আমার এই মেয়ের গর্ভে আপনার ঔরসে যে পুত্রটি জন্মাবে তাঁকেই দিতে হবে হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসন। অপিচ আপনি বেঁচে থাকতেই সেই পুত্রকে আপনি যুবরাজপদে অভিষিক্ত করবেন, মহারাজ! যাতে অন্য কোনও ভাগীদার হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসন দাবি না করতে পারে—নান্যঃ কশ্চন পার্থিবঃ।

বেশ বোঝা যায় দাসরাজা সব জেনেশুনেই তাঁর শর্ত পেশ করেছেন। সত্যবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে শান্তনু এই কৈবর্তপল্লি পর্যন্ত এসেছেন বটে, তবে এই মুহূর্তে সমস্ত মুগ্ধতা ছাপিয়ে তাঁর মনের মধ্যে ভেসে উঠল একটি সদা-বিনীত পুত্রমুখ। গাঙ্গেয় দেবব্রত। হস্তিনাপুরে সে পিতা ছাড়া আর কাউকে জানে না। আপন জন বলতেও আর কেউই নেই তার। তা ছাড়া এই কিছুদিন আগেই তো তাঁকে যৌবরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শান্তনু। রাজ্যবাসী প্রজারা তাঁকে যেমন ভালবাসে, তেমনই নিজের ব্যবহারে প্রজাদের মনও তিনি জয় করেছেন। সেই সদা-বিনীত একনিষ্ঠ পুত্রকে বঞ্চিত করে, তাঁর হাত থেকে যৌবরাজ্য ছিনিয়ে নিয়ে অন্য একট ভবিষ্যৎ-পুত্রকে যুবরাজপদে প্রতিষ্ঠা করা—যেকোনও ভদ্রলোক রাজার পক্ষে প্রায় অসম্ভব কাজ।

শান্তনু দাসরাজার শর্ত সোজাসুজি মেনে নিলেন না বটে, কিন্তু সত্যবতীর রূপ-ভাবনাও তাঁর মন থেকে গেল না। সাময়িকভাবে পুত্র দেবব্রতর জন্য তাঁর চক্ষুলজ্জা কাজ করল, বিশেষত মতলববাজ দাসরাজার সামনে, কিন্তু এতদিন স্ত্রীসঙ্গবর্জিত রাজা সত্যবতীর জন্য সমস্ত কামনা হৃদয়ে বহন করেই বাড়ি ফিরলেন—স চিন্তয়ন্নেব তু তাং…কামোপহতচেতনঃ।

হস্তিনাপুরের রাজার মন একেবারে উদাস বিবাগী হয়ে গেল। রাজকার্যে তাঁর মন বসে না, মন্ত্রী-অমাত্যদের সঙ্গে রাজ্যের প্রশাসন নিয়ে কোনও আলোচনায় বসেন না তিনি। সারাদিন আনমনে কী যেন তিনি ভাবেন আর ভাবেন। পিতার ব্যবহার দেখে গাঙ্গেয় দেবব্রত একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। তারপর একদিন ওই সত্যবতীর ধ্যানেই মগ্ন ছিলেন শান্তনু। আর ঠিক সেই সময়েই পুত্র দেবব্রত এসে দাঁড়ালেন তাঁর সামনে। বললেন—সব দিকেই তো আপনার রাজ্যের কুশল দেখতে পাচ্ছি, পিতা। সমস্ত সামন্ত রাজারা আপনার বশীভূত। রাজ্যের ভিতরেও কোনও অশান্তি নেই। তা হলে সব সময়ই আপনাকে এমন শোকগ্রস্ত উদাসী মানুষের মতো দেখতে লাগছে কেন। এত মৃগয়ার শখ আপনার, তা আপনি তো ঘোড়ায় চড়ে মৃগয়াতেও যান না, অন্য কোনও বিলাসেও আপনার মন নেই। আর শরীরটাই বা কী হয়েছে আপনার—বিবর্ণ, কৃশ, পাণ্ডুর—ন চাশ্বেন বিনির্যাসি বিবর্ণো হরিণঃ কৃশঃ। সবসময় ধ্যানী যোগীর মতো বসে আছেন। আপনি তো আমার সঙ্গেও ভাল করে কথা বলছেন না।

শান্তনু পুত্রের কথা শুনে অপ্রতিভ হলেন। সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাবও দিলেন না। যুবক দেবব্রতর ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, রাজ্য রাজনীতি বা প্রশাসন নয়, অন্য কিছু, অন্য কিছু তাঁর পিতার হৃদয় অধিকার করেছে। তিনি তাই একটু অধৈর্য হয়েই বললেন—আপনার রোগটা ঠিক কী—তা কি জানতে পারি আমি। যদি জানান, তবে সে রোগ সারানোর ব্যবস্থাও নিশ্চয় করা যাবে—ব্যাধিমিচ্ছামি তে জ্ঞাতুং প্রতিকুর্য্যাং হি তত্র বৈ।

শান্তনু পুত্রের কথার জবাব দিলেন বটে, তবে সে জবাবের মধ্যে এমন এক হাহাকার ছিল, যা তাঁর পুত্রবাৎসল্য অতিক্রম করে তাঁর জীবনের অন্য এক সত্য পরোক্ষভাবে প্রকট করে ফেলে। শান্তনু বললেন—পুত্র! আমার যেমন অবস্থার কথা তুমি বলছ, তা অসত্য নয়। তবে কী না আমার ভাবনা হয় যে, এই বিশাল কুরুবংশে তুমিই আমার একমাত্র সন্তান। সেই তুমি যেমন করে নানা যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়ে যেভাবে পুরুষকার প্রদর্শন করছ, তাতে আমার ভয় হয়—ত্বঞ্চ শূরঃ সদামর্ষী শস্ত্রনিত্যশ্চ ভারত। মানুষের জীবন বড় চঞ্চল। কখন কী হয়, কিছুই ঠিক নেই। তাই বলছিলাম, তোমার যদি কোনও বিপদ ঘটে, তবে আমার বংশটাই লুপ্ত হয়ে যাবে।

শান্তনু যা বলতে চাইলেন, তা পরিষ্কার করে বলতে পারছেন না। তিনি এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন একমাত্র পুত্রের জীবন যাতে সুরক্ষিত থাকে তার জন্য তিনি বড়ই চিন্তিত, যেন পুত্র ছাড়া আর ভাবনার কোনও বিষয়ও নেই তাঁর। কিন্তু এই পুত্র-ভাবনার সঙ্গে তিনি তাঁর কামনার বিষয়টিও যে নিপুণভাবে মিশিয়ে দিচ্ছেন, তা তাঁর বক্তব্য থেকেই বেশ বোঝা যায়। শান্তনু বললেন—তুমি আমার একশো ছেলের বাড়া এক ছেলে। আমি আর সন্তানবৃদ্ধির জন্য নতুন করে আবার বিয়েটিয়ে করে গোলমাল বাধাতে চাই না—ন চাপ্যহং বৃথা ভূয়ো দারান্‌ কর্তুমিহোৎসহে।

এ যেন এক অতিরিক্ত মদ্য-মাংসপ্রিয় ব্যক্তি আমন্ত্রণকারী গৃহকর্তাকে বলছে—না, না, আবার এসব ব্যবস্থা করেছেন! শাক-সুক্তুনিতেই তো বেশ চলত। ঠিক এইরকম একটা ভালমানুষি প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই শান্তনু বললেন—পিতার কাছে একটিমাত্র পুত্রও যা, নিঃসন্তান হওয়াও তাই—অনপত্যতৈকপুত্রত্বম্‌ ইত্যাহুর্ধৰ্মবাদিনঃ। যজ্ঞ বল, বেদ বল—এ সমস্ত কিছুই পুত্রপ্রাপ্তির সৌভাগ্য থেকে কম। যদি বল—আমি তো পুত্রহীন নই, তবে বলতে হবে—তা ঠিক। তোমাকে নিয়েই আমার অনপত্যতার দোষ খণ্ডন হয়ে গেছে। কিন্তু বাছা! তুমি তো যুদ্ধ ছাড়া থাকতেই পার না। অতএব সেই যুদ্ধে যদি কখনও কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যায়—নান্যত্র যুদ্ধাৎ তস্মাত্তে নিধনং বিদ্যতে ক্কচিৎ—তা হলে তো এই বিশাল বংশটাই নষ্ট হয়ে যাবে—কথঞ্চিৎ তব গাঙ্গেয় বিপত্তৌ নাস্তি নঃ কুলম্।

আকারে, ইঙ্গিতে, ভাষায় শান্তনু বোঝাতে চাইছেন তাঁর আর দু-একটি পুত্রলাভ বড়ই প্রয়োজনীয় এবং সে তাঁর নিজের জন্যও নয়, নেহাত এই বিখ্যাত কুলরক্ষার জন্যই তাঁর পুত্রলাভ প্রয়োজন। আর পুত্রলাভের জন্য তাঁর অন্যত্র বিবাহও প্রয়োজন, কিন্তু কুমার দেবব্রতর স্বার্থে তা যেন তিনি করতেও চান না।

গাঙ্গেয় দেবব্রত মুহূর্তের মধ্যে পিতার আশয় বুঝে নিয়েই হস্তিনাপুরের বৃদ্ধ মন্ত্রী-অমাত্যদের সঙ্গে দেখা করলেন। কারণ সেখানেই সমস্ত খবর সবিস্তারে পেয়ে যাবার কথা। মন্ত্রীরা মহারাজ শান্তনুর গতিবিধি, এমনকী কৈবর্তপল্লিতে দাসরাজার কন্যাপণের শর্তটিও জানিয়ে দিলেন। গাঙ্গেয় দেবব্রত পিতার রোগটি সম্পূর্ণ বুঝতে পারলেন এবার এবং সেই রোগশান্তির জন্য সেইদিনই তিনি কুরুসভার বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়দের নিয়ে কৈবর্তপল্লিতে উপস্থিত হলেন দাসরাজার বাড়িতে।

দাসরাজা যথোচিত সম্মান জানিয়ে কুমার দেবব্রতকে বসতে আসন দেবার আগেই কুমার দেবব্রত কোনও ভণিতা না করে পিতার বিবাহের জন্য তাঁর মেয়েকে যাচনা করলেন—অভিগম্য দাসরাজং কন্যাং বব্রে পিতুঃ স্বয়ম্‌। এমন ঘটনা পৃথিবীতে কখনও হয়নি, অথবা হওয়া উচিত নয়, আজ সেইরকম এক করুণ ঘটনার সাক্ষী হয়ে উঠলেন গাঙ্গেয় দেবব্রত। কুমার দেবব্রতর এখন যা বয়স, তাতে শান্তনুরই উচিত ছিল কোনও কন্যা-পিতার সঙ্গে যোগাযোগ করে পুত্রের জন্য কন্যা যাচনা করা। কিন্তু নিজেরই বিবাহযোগ্য বয়সে পিতার জন্য দাসরাজার কাছে কন্যা চাইতে এসেছেন কুমার দেবব্রত। এমন দুর্ভাগ্যও যে পুত্রের হয়, সেই পুত্রই একমাত্র জানে জগতে বাঁচা কত কষ্টকর।

দাসরাজা দেবব্রতকে বসতে দিয়েই বললেন—আপনি সত্যিকারের পুরুষ বটে। মহারাজ শান্তনুর আপনি প্রধান অবলম্বন। এই তিন ভুবনে অস্ত্রধারী আছেন যত, তাঁদের মধ্যেও আপনি শ্রেষ্ঠ। কাজেই আপনাকে আর কীই বা বলব! আপনি মহারাজ শান্তনুর জন্য আমার মেয়েকে চাইছেন, এ তো আমার সৌভাগ্য। এমন বৈবাহিক সম্বন্ধ স্বর্গের ইন্দ্ৰঠাকুর এলেও প্রত্যাখ্যান করবেন না, আমি তো কোন ছার। তবে জানবেন—আমার এই মেয়েটিও বড় সাধারণ নয়। সত্যবতী রাজার ঘরের মেয়ে, আমার ঘরে মানুষ হয়েছে এই যা। যে রাজা সত্যবতীর জন্ম দিয়েছেন, তিনিই আমাকে মহারাজ শান্তনুর কথা বলে গিয়েছেন। বলেছেন, এই শান্তনুই নাকি আমার মেয়ের স্বামী হবে।

দাসরাজা সত্যবতীর জন্মবৃত্তান্ত শুনিয়ে তাঁর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করলেন। সে বৃত্তান্ত অলৌকিক এবং এখানে তা শোনারও প্রয়োজন নেই আমাদের। আমাদের মতে সত্যবতী দাসরাজারই মেয়ে এবং তিনি শান্তনুর মুগ্ধতার সুযোগ নিয়ে নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে চাইছেন মাত্র। দাসরাজা বললেন—মহাত্মা অসিতঋষির নাম জানেন তো আপনি। তিনিও আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। আমি প্রত্যাখ্যান করেছি মহারাজ শান্তনুর কথা মনে রেখেই। কাজেই শান্তনুর সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে হোক, এতে একবিন্দু আপত্তি নেই আমার। শুধু মুশকিল হয়েছে একটাই এবং একজন মেয়ের বাবা হিসেবে সেটাই আমার একমাত্র চিন্তার বিষয়—কন্যাপিতৃত্বাৎ কিঞ্চিত্তু বক্ষ্যামি ত্বাং নরাধিপ।

দাসরাজা শান্তনুর সঙ্গে তাঁর কন্যার সম্বন্ধ পাকা করতে চান এবং সেইসঙ্গে তাঁর কন্যার ভবিষ্যৎটিও পাকা করতে চান। এ বিষয়ে একমাত্র বাধা হলেন কুমার দেবব্রত। অতএব সে বাধা দূর করার জন্য কুমার দেবব্রতকেই অবলম্বন করছেন দাসরাজা। তিনি বললেন—আমার মেয়ের ঘরের নাতিটি আপনার মতো একটি শত্রু লাভ করুক—এ আমি চাই না। আমি জানি—আপনার মতো মহাবীর যার শত্রু হয়ে দাঁড়াবেন, সে অসুর, গন্ধর্ব যেই হোক, তার রক্ষা নেই। আর সে যদি বেঁচেও থাকে তো সুখে তার জীবন কাটবে না—ন স জাতু সুখং জীবেৎ ত্বয়ি ক্রুদ্ধে পরন্তপ৷ অতএব আমার মেয়ের সঙ্গে আপনার পিতার বিবাহ সম্বন্ধে এইটুকুই যা অসুবিধে রয়েছে, আর কোনও বাধাই নেই—এতাবানত্র দোষো হি নান্যঃ কশ্চন পার্থিবঃ।

কুমার দেবব্রত তখন প্রায় পরিপূর্ণ যুবক। সে তাঁর ত্যাগের বয়স। তাঁর জন্য তাঁর পিতা বিবাহ করতে পারছেন না—এ তিনি সইবেন কী করে। রাজ্য বা রাজসিংহাসন তাঁর কাছে এমন কোনও বড় জিনিস নয়। দাসরাজার ইঙ্গিত বুঝে সঙ্গে সঙ্গে তিনি কুরুরাজ্যের বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়দের সামনে বলতে আরম্ভ করলেন—আপনি সত্যি কথাটা আমাকে পরিষ্কার জানিয়ে ভাল করেছেন, দাসরাজ! সমবেত ক্ষত্রিয় পুরুষরা শুনুন—এমন প্রতিজ্ঞা কেউ কোনওদিন করেনি। যে মায়ের গর্ভ থেকে জন্মেছে সেও এমন প্রতিজ্ঞা করেনি আর যে এখনও জন্মায়নি সেও ভবিষ্যতে এমন প্রতিজ্ঞা করবে না—নৈব জাতো ন চাজাত ঈদৃশং বক্তুমুৎসহেৎ। আপনি যা বলেছেন, দাসরাজ, তাই হবে। আপনার মেয়ের গর্ভে যে পুত্র জন্মাবে সেই আমাদের সকলের রাজা হবে—যো’স্যাং জনিষ্যতে পুত্রঃ স নো রাজা ভবিষ্যতি।

দাসরাজা যথেষ্ট পাটোয়ারি বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। দেবব্রতর এই প্রতিজ্ঞায় তিনি যে একেবারে বিগলিত হয়ে গেলেন, তা মোটেই নয়। ওপর ওপর খুব মুখমিষ্টি ভাব দেখিয়ে তিনি বললেন—এমন প্রতিজ্ঞা আপনি ছাড়া আর কেই বা করতে পারবে? আজ থেকে শুধু মহারাজ শান্তনুর ওপরেই আপনার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল না, এই সত্যবতীর ওপরেও আপনার অধিকার জন্মাল। আপনি নিজেই এখন এই কন্যা দান করতে পারেন। তবে হ্যাঁ, আরও একটা কথা ছিল। আমরা কন্যাপক্ষের মানুষ তো, সেইজন্যই আগ বাড়িয়ে কথাটা বলতে হচ্ছে—কৌমারিকানাং শীলেন বক্ষ্যাম্যহমরিন্দম। আমি জানি—সমস্ত রাজাদের সামনে যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, তা মিথ্যে হবার নয়। তবে একটাই কথা। কুমার! আপনি না হয় রাজা হলেন না। কিন্তু আপনারও তো বিয়ের বয়স হয়েছে। বিয়েও হয়তো হবে শিগগিরই। সেখানে আপনার যে ছেলে হবে, তারও তো একটা হক আসবে রাজ্য পাবার। কাজেই সন্দেহ কিন্তু একটা রয়েই গেল—তবাপত্যং ভবেৎ যত্তু তত্র মে সংশয়ো মহান্‌।

গাঙ্গেয় দেবব্রতর ভিতরটা পুড়ে গেল নিশ্চয়। তবু মুখে তিনি কোনও বিকার প্রকাশ করলেন না। বললেন—ঠিক আছে, দাসরাজ! আমার পিতার সুখের জন্য আবারও প্রতিজ্ঞা করছি আমি। আমি যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত ছিলাম, সে রাজ্য তো আমি আগেই ত্যাগ করেছি। এখন যাতে আমার পুত্র হওয়ার কোনও সম্ভাবনা না থাকে, তার জন্যও আমি প্রতিজ্ঞা করছি—-অপত্যহেতোরপি চ করিষ্যে’দ্য বিনিশ্চয়ম্‌। আজ থেকে আমি ব্রহ্মচারীর ব্রত গ্রহণ করলাম, দাসরাজ! আশা করি আর কোনও সন্দেহ নেই তোমার—অদ্য প্রভৃতি মে দাস ব্রহ্মচর্যং ভবিষ্যতি।

নিজের অভীষ্ট স্বার্থ সম্পূর্ণ সিদ্ধ হয়েছে দেখে দাসরাজের শরীর রোমাঞ্চিত হল। তিনি বললেন—আর আমার কোনও বাধা নেই। সত্যবতীকে আমি শান্তনুর হাতে তুলে দিলাম।

মহাকাব্যের বিশাল পরিসরে যখন এমন অভাবনীয় বিরাট ঘটনা ঘটে, পুত্র হয়ে যখন পিতার সুখের জন্য আত্মবলিদানের কীর্তি স্থাপিত হয়, তখন আকাশ থেকে দেবতার আশীর্বাদ ঝরে পড়ে পুষ্পবৃষ্টি হয়ে, অপ্সরা গন্ধর্বরা এমন দৃষ্টান্তে নৃত্য করেন, কিন্নর-কিন্নরীরা তাঁর যশোগান করেন। দেবতারা আকাশবাণী করে বলেন—এমন ভীষণ প্রতিজ্ঞা যাঁর মুখে শোনা যায় তাঁর নাম হোক ভীষ্ম—অভ্যবৰ্ষত কুসুমৈ-ভীষ্মো’য়মিতিচাব্রুবন্‌। বস্তুত পিতার জন্য যে পুত্র এমনভাবে নিজেকে উৎসর্গ করে, মানুষের মুখেই যে উচ্চগ্রামের প্রশংসাধ্বনি উচ্চারিত হয়, সেই প্রশংসাই মহাকাব্যের পরিমণ্ডলে অপ্সরা গন্ধর্বের নৃত্যগীত আর দেবতার আশীর্বাদের প্রতিরূপে ধরা দেয়। বস্তুত, সেই প্রশংসাধ্বনিতেই গাঙ্গেয় দেবব্রতর নবতর নামকরণ—ভীষ্ম। আমরাও এখন থেকে তাঁকে এই নামেই ডাকব।

সমবেত রাজাদের সামনে দু-দুটি প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করে ভীষ্ম মহত্ত্বের বর্ম পরিধান করলেন। সেই মহত্ত্ব তাঁর মনুষ্য-হৃদয়কে কতটা ক্ষতবিক্ষত করেছিল, মহাভারতের কবি সে খবর দেননি। কেননা ভীষ্ম পিতার বিবাহের জন্য কৈবর্তপল্লিতে এসেছেন, আর মহাভারতের কবি তাঁর মায়ের বিবাহ বর্ণনা করছেন। মহাভারতের কবি তাঁর আপন মর্যাদার আরেকটি মানুষকে কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন করার সঙ্গে নিজেও এক কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন। একজনের জনক, আর একজনের জননী।

সত্যবতীর কন্যা-অবস্থায় জন্মলাভ করে যিনি মহাভারতের কবি হয়েছেন, তিনি তাঁর ভ্রাতৃকল্প ভীষ্মের অন্তর্দাহ বোঝেন। তিনি বোঝেন—জনক-জননীর বিবাহ-সরসতা সম্পন্ন করা যত কঠিন, তা বর্ণনা করাও ততটাই কঠিন। বিশেষত তাঁর ভ্রাতৃপ্রতিম ভীষ্ম যাঁকে পিতার ঘরণী করে নিয়ে যাবার জন্য কৈবর্তপল্লিতে উপস্থিত হয়েছেন, তাঁর অন্তর্দাহ বর্ণনা করতে গেলে তাঁর পূজনীয় জননীর সম্মান বাড়ে না। অতএব ভীষ্মের সম্বন্ধে আর একটি কথাও উচ্চারণ করলেন না মহাভারতের কবি। শুধু তাঁর ওপরে দেবতার পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করে, নবতর নামে তাঁকে চরম মহত্ত্ব দান করে তাঁকে উপস্থিত করেছেন আপন জননীর গৃহপ্রান্তে। পিতার মতো, বরকর্তার মতো তিনিই নববধূকে নিয়ে যাবেন কার্যত ছেলেমানুষ শান্তনুর কাছে।

শান্তনুর তখন যাই বয়স হোক, তিনি তখন যুবক নন নিশ্চয়ই। অন্তত প্রৌঢ় তো বটেই। আর গাঙ্গেয় ভীষ্মর তখন যা বয়স, তা কোনওমতেই সত্যবতীর চেয়ে খুব বেশি নয়। হয়তো তাঁরা প্রায় সমবয়সি৷ দাসরাজার অনুমতি নিয়ে একটি প্রায় সমবয়সি রমণীর কাছে এসে ভীষ্ম বললেন—রথে ওঠো, মা! আমাদের নিজের ঘরে যাব, চলো—অধিরোহ রথং মাতঃ গচ্ছাবঃ স্বগৃহানিতি।

এই যে এক মুহূর্তে একটি প্রায়-সমবয়সি রমণীকে মাতৃ সম্বোধন করেই—আমরা এখন নিজের ঘরে যাব—বলে নিজের সাজাত্যে গ্রহণ করলেন ভীষ্ম—এর মধ্যে মাতৃত্বের দূরত্ব রেখেও সমবয়সির বন্ধুত্বটুকুও ইঙ্গিত করলেন ভীষ্ম। ভবিষ্যতে আমরা দেখব—সত্যবতী এবং ভীষ্ম—দুজনে কেউ কাউকে কোনও দিন অতিক্রম করেননি। ভীষ্ম যে দাসরাজার চক্রান্তে রাজা হলেন না বা তিনি বিবাহ করলেন না—সে বিষয়েও মনস্বিনী সত্যবতীর সমব্যথা ছিল শান্তনুর চেয়ে অনেক বেশি।

ভীষ্ম যেদিন আপন রথে চড়িয়ে পিতার বধূকে পিতার ঘরে নিয়ে এসে তুললেন সেদিন তাঁর পিতার মুখখানি কেমন দেখতে হয়েছিল! যিনি একমাত্র পুত্র কুমার দেবব্রতর মৃত্যুভয়ে বড় চিন্তিত ভাব দেখিয়েছিলেন, তিনি সত্যবতীর মিলনরসে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁকে বর দিলেন—মৃত্যু তোমাকে কিছুই করতে পারবে না, পুত্র! যতদিন তুমি বাঁচতে চাও, ততদিন তোমার আয়ু। মরণ তোমার কাছে আসবে তোমার অনুমতি নিয়ে—ন তে মৃত্যুঃ প্রভবিতা যাবজ্জীবিতুমিচ্ছসি। আমাদের জিজ্ঞাসা হয়—যার মৃত্যুভয়ে এত চিন্তিত ছিলেন শান্তনু তাঁকে বিবাহের পূর্বেই এই আশীর্বাদ দিতে পারতেন। তবে তাতে আর কারও ক্ষতি হত না, ক্ষতি হত শুধু মহাভারতের কবির। তিনি তাঁর মায়ের সম্বন্ধে পাওয়া ভাইটিকে তা হলে মহাকাব্যিক মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন না। পিতার শুষ্ক আশীর্বাদে ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যু হননি, আপন উদার বৈরাগ্যের ফলেই তিনি ইচ্ছামৃত্যু।

লোকে আজকাল—বাপের বিয়ে দেখিয়ে দেব—বলে গালাগালি দেয়, কিন্তু ভীষ্ম আক্ষরিক অর্থে শান্তনুর বিবাহ দিলেন সত্যবতীর সঙ্গে—বিবাহং কারয়ামাস শাস্ত্ৰদৃষ্টেন কর্মণা। রূপবতী নববধূর সঙ্গে মিলিত হয়ে পিতা শান্তনু যেদিন আপন ভবনের দ্বার রুদ্ধ করলেন—তাং কন্যাং রূপসম্পন্নাং স্বগৃহে সন্ন্যবেশয়ৎ—সেদিন কেমন লেগেছিল ইচ্ছামৃত্যু ব্রহ্মচারী ভীষ্মের? জননীর সম্মানরক্ষার্থে মহাভারতের কবি সে কথা উচ্চারণ করেননি। শুধু পর পর দুটি বছর দীর্ঘ-দীর্ঘতর হয়ে চলে গেল। ভীষ্ম দেখলেন তাঁর দুটি ভাই হয়েছে—চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্য।

মহারাজ শান্তনু যে তাঁর এই নবতর দুই শিশুপুত্রকে খুব মানুষ করার কাজে মেতে উঠলেন, তা মনে হয় না। ভীষ্মের শিক্ষাদীক্ষার জন্য মনস্বিনী গঙ্গা যে চেষ্টা করেছিলেন এবং সে, বৈচিত্র্য সম্বন্ধে মহাভারতের কবিকে যে দু-চার কথা খরচা করতে হয়েছে, তার এক বর্ণও এখানে নেই। বেশ বোঝা যায়, মহারাজ শান্তনু তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের এই ছেলেদুটিকে যথেষ্ট পরিমাণ প্রশ্রয় দিয়ে তাঁদের যথাসাধ্য অমানুষ তৈরি করেই স্বর্গারোহণ করেছিলেন। আর কী, শান্তনুর বড় ছেলে চিত্রাঙ্গদ বিনা বাধায় পিতার সিংহাসনে বসলেন।

একজন রাজপুত্রের যতটুকু নীতিশিক্ষা, বিনয়শিক্ষার প্রয়োজন থাকে, তা কিছুই না থাকায় চিত্রাঙ্গদ নিজের বলদর্পিতায় বেশ কিছু সামন্ত রাজাকে পর্যুদস্ত করলেন বটে, তবে তিনি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে মানুষ বলে মনে করতেন না—মনুষ্যং ন হি মেনে স কঞ্চিৎ সদৃশম্‌ আত্মনঃ—কাউকে নিজের সমবুদ্ধিও ভাবতেন না। এই সামান্য কথাটি থেকেই বোঝা যায়—চিত্রাঙ্গদ রাজ্যশাসনের কোনও ক্ষেত্রে মহামতি ভীষ্মের পরামর্শ নিয়ে চলতেন না। ভীষ্মও তেমন মানুষ নন, যে তিনি আগ বাড়িয়ে কোনও উপদেশ দেবেন পুত্রপ্রতিম বৈমাত্রেয় ভাইকে। তিনি নিজের মর্যাদা রেখে সমস্ত ঘটনার ওপর দৃষ্টি রাখছিলেন। ইতিমধ্যে চিত্রাঙ্গদ এক গন্ধর্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা পড়লেন। ভীষ্ম তাঁর প্রেতকার্য সম্পন্ন করেই কিশোরবয়স্ক বিচিত্রবীর্যকে—বালম্‌ অপ্রাপ্তযৌবনম্‌— সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মহাভারতের কবি মন্তব্য করছেন যে, কুমার বিচিত্রবীর্য সব ব্যাপারে ভীষ্মের মত নিয়ে বাপ-ঠাকুরদার কাছ থেকে পাওয়া রাজ্যশাসন চালাতেন—ভীষ্মস্য বচনে স্থিতঃ। অম্বশাসন্‌-মহারাজ পিতৃপৈতামহং পদম্‌।

বেশ বোঝা যায়, কুমার বিচিত্রবীর্য তাঁর বড় দাদা চিত্রাঙ্গদের অহংকারী মানসিকতা থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন। অথবা যদি তাঁর সে শিক্ষা না থেকে থাকে তবে মনস্বিনী সত্যবতী তাঁকে সেই শিক্ষা দিয়েছিলেন যাতে বিচিত্রবীর্য তাঁর পিতৃকল্প বড় ভাই ভীষ্মকে মেনে চলেন। রাজ্যের আইনকানুন শৃঙ্খলা তথা পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে মহামতি ভীষ্মের মূল্যবান পরামর্শগুলি সর্বান্তঃকরণে মেনে নিতেন বিচিত্রবীর্য। আর এতটা তিনি মেনে নেওয়ার ফলে ভীষ্ম তাঁর সমস্ত শক্তি এবং হৃদয় দিয়ে বিচিত্রবীর্যকে সাহায্য করতে লাগলেন—

স ধর্মশাস্ত্ৰকুশলং ভীষ্মং শান্তনবং নৃপঃ।

পূজয়ামাস ধর্মেণ স চৈনং প্রত্যপালয়ৎ॥

লক্ষণীয়, এই রাজ্যপালনের বিষয়ে ভীষ্ম তাঁর আপন অভিজ্ঞতায় এবং শক্তিমত্তায় কুরু রাজ্যের একনায়ক হয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু সে সুযোগ থাকলেও ভীষ্ম সে সুযোগের সদ্‌ব্যবহার করেননি। রাজ্যশাসন এবং প্রজাপালনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি মনস্বিনী সত্যবতীর মত নিয়ে চলতেন—পালয়ামাস তদ্ৰাজ্যং সত্যবত্যাঃ মতে স্থিতঃ—এবং ভীষ্মের কর্তব্যকর্মগুলি এতটাই নিষ্কাম ছিল যে দিনে দিনে ভীষ্মের ওপর সত্যবতীর আস্থা বাড়ছিল।

বিচিত্রবীর্য যখন রীতিমতো সাবালক হয়ে যৌবনে পদার্পণ করলেন, তখন সম্পূর্ণ এক অভিভাবকের মতোই ভীষ্ম দায়িত্ব বোধ করলেন বিচিত্রবীর্যের বিয়ে দেবার। লোকপরম্পরায় ভীষ্মের কানে এল কাশীরাজের অপূর্ব সুন্দরী তিন কন্যার কথা—অম্বা, অম্বিকা এবং অম্বালিকা। ভীষ্ম আর কাল নষ্ট না করে মেয়ে তিনটিকে কুমার বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিয়ে দেবার কথা ভাবলেন। সত্যবতীর সঙ্গে তাঁর যথোচিত পরামর্শ হল এবং ঠিক হয়ে গেল—ভীষ্ম নিজে গিয়ে কাশীরাজের তিন মেয়েকে হস্তিনাপুরে নিয়ে আসবেন। এই ব্যাপারে সত্যবতীর কোনও দ্বিধা ছিল না, কারণ তিনি নিজেও ভীষ্মের রথে চড়েই তাঁর ভাবী স্বামীর ঘরে এসেছিলেন। আর এখন তো কোনও সংকোচই নেই, কারণ এক বৃদ্ধপ্রায় প্রৌঢ় মানুষ তাঁর পুত্রকল্প কনিষ্ঠ ভাইয়ের জন্য বউদের রথে চড়িয়ে নিয়ে আসবে, তাতে অন্যায়টা কী? অন্তত সত্যবতী এ ব্যাপারে যথেষ্ট আধুনিকা ছিলেন।

আসলে কাশীরাজ্যে পৌঁছোতে ভীষ্মের একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। তিনি যখন রাজসভায় পৌঁছেছেন, তখন বরণডালা হাতে করে কাশীরাজের তিন কন্যা রাজসভায় এসে গেছেন। সমবেত রাজারা তখন স্বয়ংবরা রাজকুমারীদের সামনে নিজেদের সপ্রতিভ এবং সুন্দর দেখানোর জন্য বসন ভূষণের শেষ ছাঁদটুকু দেখে নিচ্ছেন। স্বয়ংবরসভার ঘোষক সমবেত রাজাদের নাম গুণ পরিচয় বলতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। ভীষ্ম এইসময় এসে রাজসভায় আসন গ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষের কোনও রাজা তখন তাঁর নাম জানেন না বা তাঁকে চেনেন না, এমন হবার কথা নয়। কিন্তু তাঁকে যথেষ্ট জানলেও এবং চিনলেও তিনি কী উদ্দেশ্য নিয়ে স্বয়ংবরসভায় এসেছেন, সে কথা ঘোষকমহাশয়কে তিনি জানাবার সময় পাননি বলেই মনে হয়। কারণ সত্যবতীর সঙ্গে ভীষ্মের আলোচনা শেষ হবার পরে মহাভারতের কবি কাশীরাজের বিবাহসভার এতটুকু বর্ণনাও দেননি। পরের শ্লোকেই তিনি মন্তব্য করেছেন—ভীষ্ম গিয়ে দেখলেন—রাজারা সব এসে গেছেন—সর্বতঃ সমুপাগতান্‌—স্বয়ংবরা কন্যারাও এসে গেছেন—দদর্শ কন্যাস্তাশ্চৈব—রাজাদের পরিচয় ঘোষণাও আরম্ভ হয়ে গেছে। কাজেই তাঁর উদ্দেশ্য জানাবার কোনও সময় পাননি।

যাই হোক, ভীষ্মের পরিচয় দেবার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী রাজকুমারীরা তাঁর দিকে তাকালেন, একটু কাছেও বা এগিয়ে এলেন হয়তো। কিন্তু তাঁকে প্রায় বুড়োমানুষ দেখে অপিচ কোনও বিবাহযোগ্য যুবাপুরুষ তাঁর সঙ্গেও নেই দেখে রাজকন্যারা প্রায় দৌড়ে তাঁর কাছ থেকে সরে গেলেন—অপাক্ৰামন্ত তাঃ সর্বা বৃদ্ধ ইত্যেব চিন্তয়া। যুবতী রমণীর ত্রস্ত ভীতচকিত অবস্থা দেখলে অনেক পুরুষমানুষই যেমন নিজের চলনেবলনে অক্ষম পুরুষকার প্রকট করে বসেন, রাজকুমারীদের ভীতচকিত অবস্থা দেখে সমবেত রাজা এবং রাজপুত্রেরা তেমনই ভীষ্মকে কটু ভাষায় গালাগালি দিতে আরম্ভ করলেন।

এক রাজা বললেন—লোকে আবার এই লোকটাকে ধার্মিক বলে। ব্যাটা বুড়ো হয়ে গেছে, গায়ের চামড়া ঝুলে পড়েছে, চুলে এমন পাক ধরেছে, তবু কীরকম নির্লজ্জ দেখো। এ বিয়ের আসরে তোর আসার দরকারটা কি—কিং কারণমিহায়াতো নির্লজ্জো ভরতৰ্ষভ। অন্য আর একজনে বললেন—এ নাকি আবার আজীবন ব্রহ্মচারী। যত সব মিথ্যা কথা। আজকে যেভাবে এই স্বয়ংবরসভায় এসে পৌঁছেছে, তাতে লোকে কী বলবে? ব্রহ্মচারী?—মিথ্যাপ্রতিজ্ঞে লোকেষু কিং বদিষ্যতি ভারত?

কটু কথাই শুধু নয়, সমবেত রাজারা ভীষ্মকে তাচ্ছিল্য করে হাসাহাসি আরম্ভ করলেন—হসন্তি স্ম নৃপাধমাঃ। অনেকক্ষণ ধরে রাজাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুনতে শুনতে ভীষ্মের মনমেজাজ চড়তে আরম্ভ করল। সেকালের দিনের অস্ত্রধারী রাজারা পরশুরামের শিষ্য ভীষ্মকে চিনতেন না, তা নয়। ভীষ্মও তাঁদের কথার শান্ত জবাব দিতে পারতেন, এমনকী যে কারণে তাঁর কাশীতে আসা সেই বিচিত্রবীর্যের কথাটাও তিনি বলেই দিতে পারতেন। কিন্তু তার জন্য একটা সম্মানজনক পরিবেশ পরিস্থিতি এবং ভদ্র বাক্যবিনিময় তাঁর কাছে অপেক্ষিত ছিল। সমবেত রাজারা সেই মর্যাদা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেননি। উপরন্তু তাঁর মতো ক্ষত্রিয়ের প্রতিজ্ঞাত ব্রহ্মচর্য নিয়ে ঠাট্টামশকরা চলেছে। অতএব ভীষ্ম আর সহ্য করলেন না। ক্ষত্রিয়ের প্রতিজ্ঞা নিয়ে যখন তাঁকে উপহাস করেছেন রাজারা, তখন ক্ষত্রিয়ের বৃত্তিতেই ভীষ্ম তাঁদের কথার জবাব দেবেন।

অতএব এইসব রাজাদের কাছে তিনি বিচিত্রবীর্যের বিবাহপ্রস্তাব করে নিজের জবাবদিহি রটনা করলেন না। তিনি ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং যুদ্ধ করেই যখন এই রাজাদের জবাব দিতে হবে, তখন কেন তিনি কাশীতে এসেছেন, তার কারণ জানানোরই কোনও প্রয়োজন বোধ করলেন না ভীষ্ম। একবার তিনি শুধু লোকপ্রচলিত বিবাহের নিয়মগুলি বললেন এবং তারপরেই তাঁর সদর্প ঘোষণা—ক্ষত্রিয় পুরুষেরা স্বয়ংবর সভাতে এসে বিপক্ষীয় রাজাদের পরাজিত করে কন্যা হরণ করে নিয়ে যাওয়াটাই বেশি পছন্দ করেন এবং সেই হৃত কন্যার সঙ্গে বিবাহটাই ক্ষত্রিয় পুরুষের সবচেয়ে প্রশস্ত বিবাহ। অতএব এই যে রাজারা সব! আমি আমার নিজের জোরে এই তিন কন্যাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছি—জিহীর্ষামি বলাদিতঃ। আপনাদের শক্তি অনুসারে জয় বা পরাজয়ের জন্য চেষ্টা করতে থাকুন। আমি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রইলাম—স্থিতো’হং পৃথিবীপালা যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ। ভীষ্ম কাশীরাজের তিন কন্যাকে রথে চড়িয়ে আরও একবার রাজাদের যুদ্ধের আমন্ত্রণ জানিয়ে রথ চালিয়ে দিলেন হস্তিনাপুরীর দিকে।

আমাকে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন করেন—কী প্রয়োজন ছিল ভীষ্মের? কাশীরাজ্যে তাঁর যাবার কী প্রয়োজন ছিল? আর গেলেনই যখন, তখন গিয়ে কেন বললেন না—আমি নয়। আমি আমার বৈমাত্রেয় ভাই তরুণ বিচিত্রবীর্যের জন্য বধূ নিয়ে যেতে এসেছি। না, ভীষ্ম এসব বলেননি, বলার প্রয়োজনও বোধ করেননি। তিনি জানেন—ক্ষত্রিয় পুরুষেরা জোর করে কন্যা হরণ করেন। তিনিও তাই করছেন, তাতে দোষ কী, অত জবাবদিহিরই বা কী আছে। নিজের ক্ষমতায় এবং ক্ষাত্রশক্তিতে তিনি যা করছেন, তা প্রতিরোধ করার যদি কেউ থাকেন তো করে দেখুন—এই হল ভীষ্মের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। দ্বিতীয় যে যুক্তিটা আছে—সে হল তাঁর অবচেতনের কথা। সে কথা মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে বলেননি বটে, তবে ভীষ্ম মহাকাব্যের অন্যতম বিরাট চরিত্র বলেই সে কথা আমাদের ভাবতে হবে।

এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক ঔপন্যাসিক লিখেছিলেন—প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই—সে তার বয়স যাই হোক—এক অভিমানী কিশোর থাকে। আমাদের যুক্তি বুঝতে হলে ভীষ্মের অন্তরশায়ী সেই অভিমানী কিশোরটিকে মনে রাখা চাই। আজ থেকে কত বছর আগে এই ভীষ্ম তাঁর পিতার বিয়ের জন্য কৈবর্তপল্লিতে গিয়ে প্রায় নিজের সমবয়সি একটি মা নিয়ে এসেছিলেন। আজ সেই পিতারই অন্য এক পুত্রের জন্য তিনি কাশীরাজ্যে এসেছেন ভাইয়ের বউ নিয়ে যেতে। আমরা কি এইসব মুহূর্তে একবারও এই প্রৌঢ়-বৃদ্ধ মানুষটির অন্তরশায়ী অভিমানী কিশোরকে দেখেছি। আমি বলি—দেখেছি, কিন্তু বুঝিনি। কাশীরাজ্যে এসে যে মানুষটি কোনও কথা না বলে কোনও জবাবদিহি না করে বরাসনে বসেছিলেন, সেই মানুষটিই হল সেই অভিমানী কিশোর।

আমরা এমন মানুষ অনেক দেখেছি—পুরুষ অথবা স্ত্রী যেই হোক—দেখেছি, তাঁরা কেউ এ জন্মে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন না। অন্য মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, স্ত্রী-পুত্রলাভের পরিণতির সঙ্গে মনের পরিণতি ঘটে, পরিবর্তনও ঘটে। কিন্তু বিয়ের পিঁড়ি না-ছোঁয়া মানুষদের অনেকের মধ্যেই আমরা এই পরিবর্তন দেখি না, পরিণতি তো নয়ই। যে যৌবনকাল থেকে তাঁরা এই কৌমার্য বহন করে উত্তর প্রৌঢ়তায় পৌঁছোচ্ছেন, তাঁদের অনেকের মধ্যেই দেখি সেই কৌমার্যের মনটুকু থেকে যায়, কুমারবয়সের আমোদটুকু রয়ে যায়। ভীষ্মের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তিনি বিচিত্রবীর্যের জন্য মেয়ে আনতে গেছেন বটে, কিন্তু স্বয়ংবরসভার বরাসনে বসলে যে আমোদটুকু হয়, সেই আমোদমাত্রই তিনি উপলব্ধি করতে চেয়েছেন, তার বেশি কিছু নয়। তাঁর অসীম শক্তি আছে, নিপুণ অস্ত্রকৌশল তাঁর অধিগত, অতএব তরুণ রাজাদের মতো একই সঙ্গে সমাসনে বসলেই বা কে আমায় কী করতে পারে—এইরকম একটা বেপরোয়া ভাব নিয়েই ভীষ্ম একটু আমোদ পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রখর বাস্তব সে আমোদ তাঁকে পেতে দিল কই? কাশীরাজের তিন সুন্দরী কন্যা ‘বৃদ্ধ’ বলে তাঁর দিকে মুখ বেঁকিয়ে চলে গেলেন, আর তরুণ রাজারা বৃদ্ধের আমোদে দুয়ো দিলেন, ঠাট্টা করলেন। ভীষ্মের ক্রোধাগ্নি উদ্দীপিত হল—ক্ষত্রিয়াণাং বচঃ শ্রুত্বা ভীষ্মশ্চুক্রোধ ভারত।

অভিমানী কিশোর-বুড়ো ভাবলেন—বুড়ো তো বুড়ো, তোরা স্বয়ংবরা হয়েছিস, আর আমিও ক্ষত্রিয় পুরুষ। তোদের তারুণ্যের শক্তি থাকে তো আটকা এই বুড়োকে, ডেকে আন তোদের তরুণ রাজাদের—তে যতধ্বং পরং শক্ত্যা বিজয়ায়েতরায় বা। ভীষ্মের হাঁকডাক শুনে স্বয়ংবরসভার বিবাহেচ্ছু রাজাদের ক্রোধ চরম বিন্দুতে পৌঁছোল। যে রমণীদের তাঁরা নিজেদের ভবিষ্যদ্‌ভোগ্যা ভেবে সরসতা লাভ করছিলেন, তাদের তুলে নিয়ে গেল এক বুড়ো! তাও এত কথা শুনিয়ে। রাজারা হাত কামড়ে ঠোঁট কামড়ে, মণিমুক্তোর ভূষণ খুলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। রণসাজে সেজে তূরীভেরি বাজিয়ে তাঁরা ছুটলেন ভীষ্মের পেছন পেছন। ভীষ্ম একা, রাজারা অনেক। ভয়ংকর যুদ্ধ আরম্ভ হল—একস্য চ বহূনাঞ্চ তুমুলং লোমহর্ষণম্।

ভীষ্ম পরশুরামের শিষ্য, সেই অল্প বয়সে, বাণবর্ষণের পরম্পরায় তিনি গঙ্গানদীর স্রোত বেঁধে ফেলেছিলেন। এই পরিণত বয়সে তাঁর বাণবর্ষণের ক্ষিপ্রতায় শত্রু রাজারাও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ভীষ্মের দিকে। তাঁরা যুদ্ধে হারলেন, লজ্জায় অধোমুখ হয়ে ভীষ্মের প্রশংসা করতে করতেই ঘরের দিকে রওনা দিতে হল তাঁদের—শত্রবো’প্যভ্যপূজয়ন্‌। আপন ক্ষমতায় যুদ্ধ জিতে নিশ্চিন্ত মনে কল্পিত ভ্রাতৃবধূদের নিয়ে তিনি ফিরে চললেন হস্তিনাপুরের পথে—কন্যাভিঃ সহিতো প্রায়াদ্‌ ভারতো ভারতান্‌ প্রতি।

ভীষ্ম এখনও পর্যন্ত কন্যাদের বলেননি যে, তিনি তাঁদের পাণিপ্রার্থী নন। তিনি তাঁদের শুধু রথে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন মাত্র। যাঁরা এই মুহূর্তে ভীষ্মের এই ইচ্ছাকৃত মৌনতায় ক্ষুব্ধ তাঁদের জানাই—ভীষ্মকে আমরা যতই এক বৃদ্ধ পিতামহের মানসিকতায় দেখি না কেন, অন্তরে তিনি যে এক ভীষণ রসিক মানুষ, অভিমানী তো বটেই। এই মেয়েরা তাঁকে বুড়ো বলে অপমান করেছে। অতএব তিনিও তাঁদের ‘টেনশন’ রেখেই দিয়েছেন। ভাব দেখাচ্ছেন—যেমন অপমান করেছিলি, এখন বোঝ এই বুড়োই তোদের গতি। যৌবনের প্রথম উন্মেষে যে মধুর সরসতায় তিনি ব্রহ্মচারী থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সেই সরসতাই তাঁকে এমন রসিকটি করে তুলেছে।

বলতে পারেন, নিরীহ যুবতীদের নিয়ে বৃদ্ধের এই রসিকতা মোটেই ভাল নয়, তা হলে বলব—তিনি তাঁর পিতার জন্য নির্দিষ্ট আপন বিমাতাকেও নিজের রথে চড়িয়েই নিয়ে এসেছিলেন পিতার সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য—রথমারোপ্য ভাবিনীম্‌। তফাত এইটুকুই যে, তাঁর বিমাতা জানতেন কার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবে। আর এই কন্যারা এখনও জানেন না যে, তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছেন কুমার বিচিত্রবীর্য। তাঁরা ভাবছেন—এই বুড়োই তাঁদের স্বামী হবেন। ভাবী ভাইবউদের সঙ্গে এই রসিকতার লোভটুকু যে বৃদ্ধ সামলাতে পারছেন না, তাঁকে দুষ্টু বলতে পারি, দুষ্টু-রসিক বলতে পারি, কিন্তু খল বলতে পারি না। আর যা বলতে পারি, তা বাঙাল ভাষায় দাঁড়ায়—রঙ্গিলা ভাসুর তুমি ক্যান্‌ দ্যাওর হইলা না।

অতএব সেই পিতার বিবাহের দিন থেকেই ভীষ্ম যেভাবে কৌরব পরিবারের সর্বময় স্বাত্মপ্রযুক্ত অভিভাবক নিযুক্ত হয়েছিলেন, সেই অভিভাবকত্বের জোরেই আজও তিনি ভ্রাতৃবধূদের রথে চড়িয়ে নিয়ে আসছেন। তাঁকে কেউ দোষের ভাগী করেন না। পিতা শান্তনুও তাঁকে কোনও কিছু বলেননি, সময়বয়সি জননী সত্যবতীও কিছু বলেননি এবং ভাই বিচিত্রবীর্যও তাঁকে কিছু বলবেন না। যিনি যৌবনের সমস্ত সুখে জলাঞ্জলি দিয়ে সমস্ত পরিবারের জন্য আত্মবলি দেন, তাঁর দোষ ধরার মতো আহাম্মক আমরা অন্তত নই। তাঁর ইতস্তত ব্যবহারগুলি তাঁর অনুকূলে দেখলে পরে ভীষ্মের ওপর কখনও রাগ হবে না, বরং মায়া হবে।

ভীষ্মের অসামান্য অস্ত্রনৈপুণ্যে যুগপৎ ভীত এবং মুগ্ধ হয়ে স্বয়ংবরসভায় পূর্বাগত রাজারা যখন বিপরীত দিকে ফিরে যাচ্ছেন, তখন সৌভদেশের রাজা শাল্ব একাকী ভীষ্মের পিছনে তাড়া করলেন। সৌভপতি শাল্ব অসামান্য বীর। ভবিষ্যতে স্বয়ং কৃষ্ণের হাতে তিনি পর্যদস্ত হবেন। কিন্তু এখন তাঁর যুবক বয়স। এখনকার ভারতবর্ষের পশ্চিম অঞ্চলের একাংশ, যেটাকে আমরা আলওয়ার বলি, সেই আলওয়ারই ছিল তখনকার সৌভদেশ। শাল্ব সে দেশের প্রবল পরাক্রান্ত রাজা।

যে তিন রমণীকে ভীষ্ম জোর করে রথে উঠিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠা যিনি, সেই অম্বা শাল্বরাজার পূর্বপ্রণয়িনী ছিলেন। যেভাবেই হোক, কাশীরাজ্যেই অম্বার সঙ্গে শাল্বরাজার প্রথম দেখাশোনা এবং প্রণয় সংঘটিত হয়। স্বয়ং কাশীরাজেরও তাঁদের প্রণয়-পরিণতিতে আপত্তি ছিল না। ঠিক ছিল—কাশীরাজ্যের স্বয়ংবরসভায় অন্যান্য রাজাদের সঙ্গে শাল্বরাজাও এসে বরাসনে বসবেন। আর অম্বা সেই স্বয়ংবরসভায় ঢুকে অন্যান্য রাজাদের দিকে দু-একবার লোকদেখানো দৃষ্টিপাত করেই শাল্বরাজার গলায় বরমাল্য ঝুলিয়ে দেবেন। পূর্বপ্রণয় এইভাবেই বিবাহে রূপান্তরিত হবে। এই ঠিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কুরু-প্রৌঢ় ভীষ্ম এসে জুটলেন স্বয়ংবরসভায় আর প্রণয়ীযুগলের সমস্ত পরিকল্পনা বিপর্যস্ত হয়ে গেল।

স্বয়ংবরসভায় সমাগত রাজারা যখন ভীষ্মের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে রণে ভঙ্গ দিলেন, তখন শাল্বরাজ নিজের কারণেই আত্মপ্রকাশ করতে বাধ্য হলেন। তিনি একা ভীষ্মের পেছনে ধাওয়া করলেন নিজের অমিত শক্তির ওপর নির্ভর করে।—ততস্তং পৃষ্ঠতো রাজন্‌ শাল্বরাজো মহারথঃ। তাঁর পূর্বপ্রণয়িনীকে অন্য একজন জোর করে রথে তুলেছে এবং সেও নিশ্চয়ই তাঁর প্রণয়িনীর পাণিপ্রার্থী—এইরকম একটা ধারণা করেই শাল্বরাজা ভীষ্মকে আঘাত হানলেন পিছন থেকে। মহাভারতের কবি উপমাটি দিয়েছেন চমৎকার। বলেছেন—একটি হস্তী হস্তিনীর পেছন পেছন যেতে থাকলে, তার থেকে বেশি শক্তিমান যূথপতি হস্তী যেমন পূর্বগামী হস্তীটির পিছনে দাঁত দিয়ে আঘাত করে, শাল্বও সেইভাবেই ভীষ্মকে আঘাত করলেন পিছন থেকে—বারণং জঘনে ভিন্দন্ দন্তাভ্যামপরো যথা।

শাল্বরাজ ভীষ্মকে কটুক্তি করে বললেন—স্ত্রীলোকের কামনা খুব পেয়ে বসেছে, ব্যাটা! থাম—স্ত্রীকামস্তিষ্ঠ তিষ্ঠেতি। ভীষ্ম নিরুদ্বেগে পেছন দিকে মুখ ঘোরালেন। আকুঞ্চিত ললাটে জিজ্ঞাসার চিহ্ন অঙ্কিত হল—এটি আবার কে? একমুহূর্তে ভীষ্ম রথ ঘোরালেন শাল্বরাজের দিকে। মহাভারতের কবি আবারও উপমা দিলেন—একটি গাভীর জন্য দুটি মহাবৃষ যেমন গর্জন করতে করতে পরস্পরের অভিমুখী হয়, ভীষ্ম এবং শাল্ব সেইভাবেই পরস্পরের অভিমুখী হলেন—তৌ বৃষাবিব নর্দন্তৌ বলিনৌ বাসিতান্তরে। দুই মহাবীরের যুদ্ধকৌতুক দেখার জন্য পূর্বে বিজিত রাজারা যুদ্ধভূমির দুই ধারে দাঁড়িয়ে গেলেন।

ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ হল। শাল্বরাজা যথেষ্ট বীরত্ব দেখালেন বটে কিন্তু সেদিন ভীষ্ম ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তিনি সারথিকে বললেন—আমার রথটা একেবারে ওর সামনে নিয়ে ফেলো তো। তারপর গরুড় যেমন সাপ ধরে তেমন করেই মারব এটাকে—যাবদেনং নিহন্মদ্য ভূজঙ্গমিব পক্ষিরাট্‌। বললেন বটে, কিন্তু বিবাহসভায় এসে এক বিবাহেচ্ছু রাজাকে তিনি মৃত্যুদণ্ড দিলেন না। শাল্বরাজার সারথি মারা পড়ল, তাঁর ঘোড়াগুলিও মারা পড়ল। আর এমনভাবেই শাল্বরাজাকে বাণে বাণে পর্যুদস্ত করলেন ভীষ্ম যাতে শাল্বরাজার জীবনটাই অবশিষ্ট রইল শুধু—জিত্বা বিসর্জয়ামাস জীবন্তং নৃপসত্তমম্‌। ক্ষুব্ধ, জর্জরিত, অপমানিত শাল্বরাজা নিজের দেশে ফিরে গেলেন। আর কুরুকুলপতি ভীষ্মও বিনা বাধায় রথ চালিয়ে দিলেন হস্তিনাপুরের দিকে। অনেক নদী বন পাহাড় পেরিয়ে কাশীরাজের তিন কন্যাকে নিয়ে ভীষ্ম পৌঁছোলেন হস্তিনায়। মহাভারতের কবি এতক্ষণ মধুর রসিক ভীষ্মের কীর্তিকলাপ বর্ণনা করে এইবার ছোট্ট মন্তব্য করলেন—শ্বশুর যেমন পুত্রবধূদের সঙ্গে ব্যবহার করেন, বড় ভাই যেমন ব্যবহার করেন আপন কনিষ্ঠা ভগিনীদের সঙ্গে—স্নুষা ইব স ধর্মাত্মা ভগিনীরিব চানুজাঃ—অথবা পিতা যেমন ব্যবহার করেন তাঁর আত্মজা কন্যাগুলির সঙ্গে, ভীষ্ম সেই ব্যবহারেই কাশীরাজের তিন কন্যাকে কুরু দেশে নিয়ে এলেন। নিয়ে এলেন শুধু তাঁর বৈমাত্রেয় ছোট ভাইটি খুশি হবেন বলে—ভ্রাতুঃ প্রিয়চিকীর্ষয়া।

কাশীরাজের তিন কন্যাকে নিয়ে ভীষ্ম এবার উপস্থিত হলেন জননী সত্যবতীর কাছে। সত্যবতীর চরণবন্দনা করে ভীষ্ম বললেন—তোমার ছেলের বিয়ের জন্য তিন তিনটি মেয়ে নিয়ে এসেছি, মা! ওঁদের স্বয়ংবর হচ্ছিল, ফলে নিজের বীরত্ব প্রকাশ করে অন্য রাজাদের পরাজিত করে আমি ওঁদের হরণ করে নিয়ে এসেছি। এমন কাজে ক্ষত্রিয়দের দোষ হয় না বলেই আমি এ কাজ করেছি এবং করেছি বিচিত্রবীর্যের জন্য—বিচিত্রবীর্যস্য কৃতে বীর্যশুল্কা হৃতা ময়া। ভীষ্মের চেষ্টা এবং ত্যাগে সত্যবতী একেবারে মুগ্ধ অভিভূত হয়ে গেলেন। কোনওদিনই এই বয়স্ক পুত্রটিকে তিনি অবহেলা করেননি। আজ বৈমাত্রেয় ভাইয়ের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করে ভীষ্মের এগিয়ে যাওয়া দেখে সত্যবতী সত্যিকারের মুগ্ধ হলেন। সার্থক জননীর মতো ভীষ্মর মস্তকাঘ্রাণ করে তিনি বললেন—পুত্র! ভাগ্যবশে তোমার কোনও ক্ষতি হয়নি। এতগুলি রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে জিতে এসেছ তুমি। তোমার যে কিছু হয়নি, এই আমার ভাগ্য—আহ সত্যবতী হৃষ্টা দিষ্ট্যা পুত্র জিতং ত্বয়া।

সবাই বলেন—কেন গেলেন ভীষ্ম? কেন এই বুড়ো বয়সে স্বয়ংবরসভায় গিয়ে এমন ‘সিন’ তৈরি করলেন তিনি? এঁরা যদি একবারও বুঝতেন—কুরুবংশের অঙ্কুরগুলি সযত্নে রক্ষা করার জন্য ভীষ্মের আকুলতা কতখানি। তিনি নিজে রাজা হবেন না, অথচ আপন পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্রটি বেঘোরে মারা গেছেন। এখন একমাত্র ভরসা ছোট ভাই বিচিত্রবীর্য। স্বয়ংবরসভায় গিয়ে যদি যুদ্ধবিগ্রহ লাগে এবং যে যুদ্ধবিগ্রহ তখনকার দিনে প্রায়ই হত, তো সেখানে একা এই কুলের প্রদীপিকাস্বরূপ বিচিত্রবীর্যের যদি কোনও প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে, সেইজন্যই বিচিত্রবীর্যকে ভীষ্ম যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে ঠেলে দেননি। তিনি নিজে গেছেন, নিজের জীবন বিপন্ন করে। তবু অপমানও তাঁর কম সইতে হয়নি। কাজেই আজ যখন সত্যবতী তাঁর কর্মচেষ্টার সমাদর করলেন, তখনই ভীষ্ম সার্থক মনে করলেন নিজের জীবন। নিন্দুকরাও সঙ্গে সঙ্গে বুঝল কেন এই বুড়ো বয়সে এহেন রোমাঞ্চকর অভিযান।

কন্যাদের বিবাহ নিয়ে এবারে আসল কথাবার্তা আরম্ভ হল। বিবাহের দিনক্ষণ মাঙ্গলিক সব কিছু নিয়ে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা চলল। এত যে দিন গেল, তবু কিন্তু সেই কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যাটির মুখে কোনও কথা শোনা যায়নি, তাঁর পূর্ব প্রণয়ের কথাও না। বিজিত শাল্বরাজ যেদিন নতমুখে রাজধানীতে ফিরে গেলেন, সেদিনও অম্বা কিছু বলেননি এবং এখনও এই রাজধানীতে আসার পরেও—ভীষ্মের কথা ছেড়েই দিলাম, তিনি জননী সত্যবতীর কাছেও তো কিছু বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি কিচ্ছুটি বললেন না।

তারপরে একদিন যখন বিচিত্রবীর্যের বিবাহ সংক্রান্ত আলোচনার জন্য ভীষ্ম ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বসে আছেন, ঠিক তখনই একসময় অম্বা এসে উপস্থিত হলেন সকলের সামনে। সামান্য হেসে তিনি ভীষ্মকে বললেন—ধর্মজ্ঞ, আমার একটু কথা আছে আপনার সঙ্গে। ভীষ্ম উৎকর্ণ হতেই অম্বা বললেন—অনেক আগেই, আমাদের ওই স্বয়ংবরসভা সংঘটিত হওয়ার অনেক আগেই আমি মনে মনে সৌভপতি শাল্বরাজকে বরণ করেছি—ময়া সৌভপতিঃ পূর্বং মনসাভিবৃতঃ পতিঃ। আর শাল্বরাজও আমার ইচ্ছে মেনে নিয়ে আমাকেই বিবাহ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। এমনকী এ বিবাহে আমার পিতা কাশীরাজেরও সম্মতি ছিল—এষ কামশ্চ মে পিতুঃ। সামান্য কটি কথা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে বলে অম্বা বুঝিয়ে দিলেন যে, যদি সুস্থভাবে স্বয়ংবরসভার কাজ শেষ হত, তা হলে অম্বার হস্তস্থিত বরমাল্যখানি তখনই শাল্বরাজের কণ্ঠে শোভা পেত—ময়া বরয়িতব্যো’ভূছ্‌ছাল্ব-স্তস্মিন্ স্বয়ম্বরে।

অম্বা যতটুকু কথা বলেছেন, তাতে বোঝা যায়—তাঁর ইচ্ছাগুলি একেবারে বিলাসমাত্র ছিল না। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর জীবনের যতটুকু অনর্থ ঘটেছে, তা ভীষ্মের জন্যই ঘটেছে। নইলে এক নরনারীর ঈপ্সিত মিলনই এখানে একমাত্র ঘটনা নয়, সম্পূর্ণ একটি পরিবার অম্বার ইচ্ছানুযায়ী কাজ করছিল। অম্বা বেশ বুদ্ধি করেই কথাগুলি পেড়েছেন এবং তা পেড়েছেন এক ব্রাহ্মণসভার সামনে। বাগদত্তা কন্যাকে সে যুগে অনেক ক্ষেত্রেই বিবাহিতা রমণীর সাযুজ্যে দেখা হত। কাজেই ভীষ্ম যদি অম্বার কথা নাও মেনে নেন, সে ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণরা এক রমণীর পূর্বপ্রণয় এবং বাগদানের সংকল্পকে মাথায় রেখে বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে যাতে তাঁর বিয়ে না হয়, সে বিষয়ে ভীষ্মকে সৎ পরামর্শ দেবেন। আর ব্রাহ্মণদের কথার ওপর ভীষ্মের ব্যক্তিগত মত এবং কর্তৃত্ব কোনওটাই তেমন করে খাটবে না।

যাই হোক, ভীষ্ম ধর্মজ্ঞ ব্যক্তি, যুদ্ধ এবং রাজনীতি ছাড়াও জীবনের অন্যান্য বিচিত্র ক্ষেত্রেও তাঁর অভিজ্ঞতা এবং বুদ্ধি কিছু কম নয়। অতএব, যে রমণী একবার অন্য পুরুষের প্রেমে আবদ্ধ হয়েছিল তাকে জোর করে ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলে দুটি জীবনই যে বঞ্চিত হয়ে থাকবে, সে কথা ভীষ্ম সঙ্গে সঙ্গেই বুঝেছেন। অম্বা নিজেও ভীষ্মকে বলেছিলেন—আপনি আমাকে জোর করে এখানে নিয়ে এসেছেন বটে, কিন্তু জোর করে আপনার ভাইকে ভালবাসাবেন কী করে, কীভাবেই বা এই কুরুবাড়িতে ধরে রাখবেন আমাকে? সে কি আপনার ধর্মে সইবে, আপনি না কৌরব—বাসয়েথা গৃহে ভীষ্ম কৌরবঃ সন্ বিশেষতঃ? অম্বা বললেন—রাজধর্ম নয়, যুক্তিতর্কও নয়, আপনি আপনার বুদ্ধি এবং মন দিয়ে বিচার করে দেখুন যে, এখানে আপনি আমাকে ধরে রাখতে পারেন কি না—এতদ্‌বুদ্ধ্যা বিনিশ্চিত্য মনসা ভরতর্ষভ। অম্বা জানিয়ে দিলেন—শাল্বরাজ এখনও আমার জন্য অপেক্ষা করছেন—স মাং প্রতীক্ষতে ব্যক্তম্‌—অতএব আপনি আপনার ধর্ম এবং বিচারবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে আমার প্রতি সুবিচার করুন।

সমবেত ব্রাহ্মণদের মধ্যে অম্বার এই পরিষ্কার বক্তব্য থেকে ভীষ্ম যেমন বিব্রত হয়ে পড়লেন, তাতে আরও ভাল করে বোঝা গেল যে, সে যুগের ভারতবর্ষে স্ত্রী-স্বাধীনতা এমন কিছু কম ছিল না। যারা বলেন—সে কালের ভারতবর্ষ মানেই স্ত্রীলোকের আতঙ্ক আর অত্যাচারের ইতিহাস, তাঁদের কাছে আমরা অম্বার উদাহরণ দিয়ে থাকি। রাজধানীর অন্দরমহল ছেড়ে এসে ব্রাহ্মণদের সামনে ভীষ্মের মতো বিশালবুদ্ধি মানুষকে অপ্রতিভ করে দিতে তাঁর এতটুকু অসুবিধে হয়নি। ভীষ্ম তাঁর কথা শুনে অসম্ভব বিব্রত হয়েছেন এবং ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আলোচনা করে—বিনিশ্চিত্য স ধর্মজ্ঞো ব্রাহ্মণৈৰ্বেদপারগৈঃ—যথাশীঘ্র তাঁকে শাল্বরাজার কাছে যাবার অনুমতি দিলেন। শুধু অনুমতি নয়, অম্বা যাতে নির্বিঘ্নে এবং সুরক্ষিতভাবে শাল্বরাজার দেশে ফিরে যেতে পারেন তার জন্য একজন ব্রাহ্মণ এবং একটি ধাত্রীরও ব্যবস্থা করে দিলেন ভীষ্ম।

যথাসময়ে অম্বা শাল্বপুরে পৌঁছোলেন। শাল্বরাজার সঙ্গে দেখা হলে অম্বা সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করলেন তাঁর কাছে। বললেন—আমি তোমার কাছেই এসেছি চিরকালের জন্য। তুমি আমাকে সাভিনন্দনে গ্রহণ করো, আমি চিরকাল তোমার ভাল চাই বলেই এইভাবে চলে এসেছি—অভিনন্দস্ব মাং রাজন্ সদাপ্রিয়হিতে রতাম্‌। অম্বা আরও বললেন—আমি সুচিরকাল তোমার কথাই ভেবে এসেছি আর তুমিও আমাকে তোমার স্ত্রী হিসেবেই চেয়েছিলে—ত্বং হি মে মনসা ধ্যাতস্ত্বয়া চাপ্যুপমন্ত্রিতা। অতএব আমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেই তুমি তোমার ধর্ম পালন করো।

অম্বার কথা শুনে শাল্বরাজ মোটেই পুলকিত হলেন না। বাঁকা হাসি হেসে তিনি ভীষ্মের কথা তুললেন। বললেন—একজন পুরুষ যে রমণীকে স্ত্রী-কামনায় হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল, সে রমণী তো অন্যের। তাঁকে আমি স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করি কী করে—ত্বয়াণ্যপূর্বয়া নাহং ভার্যার্থী বরবৰ্ণিনী। ভদ্রে! তুমি ভীষ্মের কাছেই যাও। সে সমস্ত রাজাদের পরাজিত করে তোমাকে জোর করেই ধরে নিয়ে গিয়েছিল, স্পর্শও করেছিল তোমাকে—পরামৃষ্য মহাযুদ্ধে নির্জিত্য পৃথিবীপতীন্‌। শাল্বরাজের কথা শুনে অম্বা একেবারে নির্বাক হয়ে গেলেন। অম্বার হৃদয়ে শেষ আঘাত হেনে শাল্বরাজ কথা শেষ করে বললেন—আরও একটা কথা। ভীষ্ম যখন সমস্ত রাজাদের জয় করে তোমাকে নিয়ে গেলেন, তখন তো বেশ খুশি খুশিই দেখাচ্ছিল তোমাকে—ত্বং হি ভীষ্মেণ নির্জিত্য নীতা প্রীতিমতী তদা।

হায়! আজ কী শুনতে হচ্ছে অম্বাকে! তাঁর স্বপ্নের প্রেমিক, যাঁর ওপর সমস্ত বিশ্বাস নিয়ে তিনি এখানে চলে এসেছেন, যাঁর প্রতীক্ষার কথা জানিয়ে ভীষ্মের কাছ থেকে তিনি সসম্মানে মুক্ত হয়ে চলে এসেছেন, তিনি এখন বলছেন—ভীষ্ম তোমাকে নিয়ে যাবার সময় বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছিল তোমাকে। অম্বা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেছেন বটে—মোটেই নয়, মোটেই আমাকে খুশি খুশি দেখাচ্ছিল না। ভীষ্ম আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে গেলেন, আর তাতে আমি খুশি হব? তুমি এমন ভাবলে কী করে। বিশেষ করে একথা তুমি এমন করে বোলো না—মৈবং বদ মহীপাল…নাস্মি প্রীতিমতী নীতা। আমি রীতমতো কাঁদতে কাঁদতে ভীষ্মের রথে উঠেছিলাম এবং তিনি আমাকে নিয়েও গেছেন জোর করে, সমস্ত রাজাদের বাধা বিপর্যস্ত করে—বলান্নীতাস্মি রুদতী বিদ্রাব্য পৃথিবীপতীন্‌।

অম্বা খুব জোরেই প্রতিবাদ করেছিলেন বটে, কিন্তু এক সুন্দরী যুবতীর অযান্ত্রিক মনের কথা কে বলতে পারে! শাল্বরাজাও বা কেন একমুহূর্তের জন্য সেই রথারূঢ়া বিপন্না রমণীর মুখে প্রীতির আভাস দেখতে পেলেন? যে মুহূর্তে প্রৌঢ়-বৃদ্ধ ভীষ্ম শাল্বরাজাকেও অনায়াসে জয় করে তাঁকে শুধু প্রাণদান করে ছেড়ে দিলেন, তখন সেই মুহূর্তে এই যুবতী রমণীর অযান্ত্রিক মনের মধ্যে কোনও অবাক বিস্ময় জাগেনি তো? শাল্বরাজের মতো মহাবীরকে যে ব্যক্তি অমন করে পরাভূত করতে পারেন, তাঁর প্রতি সুন্দরী অম্বার কোনও বীরপূজার ভাব জাগ্রত হয়নি তো? হয়তো প্রকাশ্য চেতন মনে তেমন কিছু হয়নি, কিন্তু যুবতীর অবচেতন থেকে সে ভাব এক মুহূর্তের জন্যও যদি অম্বার মুখে ছায়া ফেলে থাকে, তবে সেই মুহূর্তটি হয়তো শাল্বরাজের চোখেই ধরা পড়ে থাকবে, অম্বা হয়তো তা জানেনও না।

যে মুহূর্তে শাল্বরাজাকে শুধু প্রাণে না মেরে ছেড়ে দিলেন ভীষ্ম, সেই মুহূর্তে কাশীরাজবালার মুগ্ধ বালিকাহৃদয় কি একবারের তরেও ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল? নইলে শাল্বকে তিনি অত ভালবাসেন, তো সেই ভালবাসার মানুষটির কথা রথের ওপর দাঁড়িয়েই ভীষ্মকে বললেন না কেন? কেন বললেন না—যাঁকে তুমি বাণে বাণে ধূলিশায়িত করেছ, ওই ধূলিশায়ী মানুষটিই আমার ভালবাসার মানুষ। অম্বা বলেননি। কেন বলেননি? আহত পরাজিত ব্যক্তিটিকে প্রেমিক বলতে লজ্জা হয়েছে কি অম্বার? যে লজ্জা ভেঙে তিনি ব্রাহ্মণদের সভায় এসে সোচ্চারে শাল্বের নাম উচ্চারণ করেছিলেন, ভালবাসার সেই দৃঢ় উচ্চারণ হস্তিনাপুরের গমনপথেই শব্দিত হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি; কত নদী বন পাহাড় পেরিয়ে সেই প্রৌঢ়-বৃদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে তিনি এসেছেন। অথচ একবারের তরেও শাল্বরাজের নামও তিনি উচ্চারণ করলেন না।

আমরা বেশ জানি—ভীষ্মের পরবর্তী আচরণ থেকেই জানি—তিনি বাধা দিতেন না। অথচ, না রথে উঠবার সময়, না রথে যেতে যেতে, না তাঁর একান্ত প্রিয়তম শাল্বরাজ যুদ্ধে প্রতিহত হওয়ার সময়—একবারও তাঁর নাম উচ্চারণ করলেন না অম্বা। অন্তত সেই মুহূর্তে ভীষ্মের মুখের মধ্যে তিনি কী দেখেছিলেন? হয়তো সেই খণ্ড মুহূর্তটিই চিত্রার্পিত হয়ে আছে শাল্বরাজার হৃদয়ে—অম্বাকে খুশি খুশি দেখাচ্ছিল—নীতা প্রীতিমতী তদা। হয়তো এই চিত্রার্পিত মুহূর্তটি সত্য নয়, হয়তো বা কি সত্যই। রমণীর হৃদয় কে জানে?

অম্বা শাল্বরাজের আচরণে হতবাক হয়ে গেলেন। বললেন—-দেখো, আমার বয়স বেশি নয়, আমি নিজে কোনও অপরাধও করিনি, সবচেয়ে বড় কথা—আমি তোমাকে ভালবাসি, অতএব তুমি আমাকে ভালবাসবে—ভজস্ব মাং শাল্বপতে ভক্তাং বালামনাগসাম্‌। সবশেষে অম্বা ভাবলেন যে, একটু বুঝিয়ে বললে যদি শাল্বরাজের হৃদয় শান্ত হয়। অম্বা বুঝিয়ে বললেন—যুদ্ধে হারবেন না বলে ভীষ্মের সেদিন রোখ চেপে গিয়েছিল, এবং ঠিক সেই জন্যই তোমাকে সেদিন তিনি অমন করে হারিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমি আমার সমস্ত বৃত্তান্ত বিয়ের আগেই ভীষ্মকে জানিয়েছি। তাঁর অনুমতি নিয়েই আমি চিরদিনের মতো তোমার কাছে চলে এসেছি—অনুজ্ঞাতা চ তেনাস্মি তবৈব বশমাগতা। তা ছাড়া আসল কথাটা তো তুমি বুঝবে। ভীষ্ম তো মোটেই আমাকে চাইছেন না। তিনি নিজে কোনও বিয়েও করতে চান না যে, আমাকে চাইবেন—ন হি ভীষ্মো মহাবুদ্ধির্মামিচ্ছতি বিশাম্পতে। তিনি তাঁর ভাইয়ের বিয়ের জন্য কন্যা হরণ করেছেন। আমার অন্য দুই বোনের সঙ্গে তাঁর ভাইয়ের বিয়েও হয়ে গেছে। কাজেই আর অসুবিধে কীসের, অন্যায়টাই বা এখানে কোথায়?

সমস্ত বৃত্তান্ত সঠিক জানানো সত্ত্বেও শাল্বরাজের হৃদয় বিগলিত হল না। অম্বা মাথা ছুঁয়ে বুক ছুঁয়ে কত প্রতিজ্ঞা করলেন, কুমারী হৃদয়ের সমস্ত সত্তা জর্জরিত করে শাল্বরাজের অনুগ্রহ যাচনা করলেন কত; কিন্তু সব ব্যর্থ হল। মস্তকস্পর্শ হৃদয়স্পর্শের মতো সর্বাঙ্গীন প্রতিজ্ঞা ব্যর্থ হল, বিপর্যস্ত হল কুমারীর বিশ্বাস। মহাভারতে আছে—সাপ যেমন পুরনো খোলস ছেড়ে ফেলে, অম্বাকে সেইভাবেই ত্যাগ করলেন শাল্বরাজ—জীর্ণাং ত্বচমিবোরগঃ।

অম্বা এরপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন। কামনা প্রতিহত হলেই মানুষ ক্রুদ্ধ হয়—কামাৎ ক্রোধো’ভিজায়তে। অম্বা বললেন—তুমি আমাকে ত্যাগ করছ বলেই যে আমি খুব অস্থানে পতিত হব, এমনটি তুমি ভেবো না। এমন ভদ্র সজ্জন নিশ্চয়ই আছেন এই পৃথিবীতে, যিনি আমাকে আশ্রয় দেবেন। এতক্ষণ যাই বলুন শাল্বরাজ, এবার তিনিও সত্যি কথা বলেছেন। বলেছেন—আমার বিনীত অনুরোধ—তুমি ফিরে যাও এখান থেকে। যেহেতু ভীষ্ম তোমাকে একবার গ্রহণ করেছেন, অতএব আর আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিতে পারি না। কারণ আমি ভীষ্মকে ভয় করি—বিভেমি ভীষ্মাৎ সুশ্রোণি ত্বঞ্চ ভীষ্ম-পরিগ্রহঃ।

হয়তো শাল্বরাজের এই অতিসত্যকথন—ভীষ্ম তোমাকে গ্রহণ করেছেন, তুমি ভীষ্মের পরিগ্রহ—হয়তো এই কঠিন সত্যটি অম্বার সমস্ত বিড়ম্বনা তৈরি করেছে বলেই তাঁর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ভীষ্মের ওপর।

যে অম্বার সঙ্গে ভীষ্মের কোনও সম্পর্ক তৈরি হল না, সেই তাঁকে নিয়ে ভীষ্মকে চিন্তা করতে হয়েছে তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। মহাভারতের নীতিধর্মের যুক্তিতে যদি ভীষ্মের চরিত্র বুঝতে হয়, তা হলে ভীষ্মকে মাহাত্ম্যমণ্ডিত করতে সময় লাগবে না। ভীষ্ম চরিত্রের যে কত মহৎ দিক আছে, কত যে বিশাল তার গভীরতা, তা একটি বড় গ্রন্থ লিখেও শেষ করা যাবে না। কিন্তু এখানে আমরা মানুষ ভীষ্মকে দেখতে চাইছি, গম্ভীর থির জলে একটি সামান্য উপলখণ্ডও যে কীভাবে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ তোলে, সেগুলি দেখে নিয়েই তবে ভীষ্মচরিত্রের গভীরতায় অবতরণ করব আমরা।

এই এক সামান্যা নারী, তিনি কাশীরাজবালা অম্বা। তাঁর অন্য দুই ভগিনীর চেয়ে কীসেই বা তাঁর বিশেষত্ব? অম্বিকা এবং অম্বালিকার যেমন রাজসম্বন্ধে বিবাহ হয়েছে, তাঁরও তাই হতে পারত। কিন্তু এক জায়গায় বিদায় নিয়ে আর এক জায়গায় তিনি যখন প্রত্যাখ্যাত হলেন, তখন থেকেই মহামতি ভীষ্মের সঙ্গে পরোক্ষভাবে, অতিপরোক্ষভাবে জড়িয়ে গেলেন। অনেকে এমন বলেন যে, শাল্বরাজার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি আবারও ভীষ্মের কাছে যান এবং ভীষ্মের কাছেও তিনি প্রত্যাখ্যাত হন। কিন্তু এমন ঘটনা মহাভারতে নেই। মহাভারতে যেমনটি আছে, তাতে শাল্বরাজার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে যাবার সময় অম্বা অনেক কাঁদলেন। তাঁর এমন ধারণা হল যে, জগতে দ্বিতীয়া এমন কোনও রমণী নেই যে নাকি তাঁর মতো দুরবস্থায় পড়েছে—পৃথিব্যাং নাস্তি যুবতি-র্বিষমস্থতরা ময়া। তার মধ্যে শাল্বরাজের কথা যত গৌরব করে তিনি ভীষ্মের কাছে বলে এসেছেন, তাতে দ্বিতীয়বার হস্তিনায় গিয়ে ভীষ্মের সামনে দাঁড়াতে তাঁর আত্মসম্মানে বেধেছে। তিনি নিজেই বলেছেন—আমার আর ফিরে যাবার মুখ নেই সেখানে—ন চ শক্যং ময়া গন্তুং তত্র বারণসাহ্বয়ম্।

শ্যামও নেই কুলও নেই এমন অবস্থায় অম্বার মন দ্বিধা দ্বন্দ্বে দীর্ণ হয়ে উঠল। নানা অকারণ স্বগ্রথিত ভাবনার শৃঙ্খল—এটা যদি না হত, তা হলে ওটা হত না, ভীষ্মকে যদি শাল্বরাজার কথা না বলতাম, তা হলে ভীষ্ম আমাকে ছেড়ে দিতেন না—এইসব কল্পিত ‘যদি’র শৃঙ্খল বানিয়ে অম্বা কাকে ঠিক দোষী সাব্যস্ত করবেন, তা ঠিক করে উঠতে পারলেন না—কিন্নু গর্হাম্যথাত্মানম্ অথ ভীষ্মং দুরাসদম্।

তবে এই সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাপিয়ে তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় হয়ে উঠল ভবিষ্যতের আশ্রয়ভাবনা, একটি যুবতী রমণীর নিরাপত্তার ভাবনা। নিজের বাপের বাড়িতেও তাঁর ফিরে যাবার ইচ্ছে নেই। পিতার ওপর তাঁর রাগও আছে যথেষ্ট। অম্বার ধারণা—কাশীরাজ যদি স্বয়ংবরের ব্যবস্থা না করে সোজাসুজি শাল্বরাজার সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়ে দিতেন, তা হলে আর এই অহেতুক ঝামেলা কিছু হত না। কিন্তু তাঁর পিতা রাজকীর্তি স্থাপনের জন্য স্বয়ংবরের ব্যবস্থা করলেন এবং সেখানে বেশ্যাদের মতো অতগুলি রাজার সামনে এসে দাঁড়াতে হল তাঁকে। সেখানেও আবার যাঁর শক্তি বেশি, সে তাঁকে হরণ করে নিয়ে গেল—যেনাহং বীর্যশুল্কেন পণ্যস্ত্রীব প্রচোদিতা।

অম্বা নিজেকেও কম দোষ দিলেন না। শাল্বরাজার কথা তিনি সময়মতো ভীষ্মকে বলেননি, তারজন্য নিজের মূর্খতাও তিনি নিজেই স্বীকার করে নিলেন। ভাবলেন—যেমন কর্ম করেছি তেমনই ফল পেয়েছি—তস্যাহং ফলনিবৃত্তির্যদাপন্নাস্মি মূঢ়বৎ। নিজের দোষ, পিতার দোষ এবং সমস্ত সংকটময় পরিস্থিতির দোষ—সবকিছু স্বীকার করে নিয়েও অম্বা কিন্তু একবারের তরেও উচ্চারণ করলেন না—মনের গভীরে আকস্মিকভাবে উদ্‌গত সেই বুদবুদোপম সুখের কথা। ভীষ্মের যুদ্ধকৌশলে, বীরত্বে, ব্যক্তিত্বে এবং মহত্ত্বে তাঁর যে মোহ তৈরি হয়েছিল অবচেতনায়—যা দূর থেকে শাল্বরাজ পর্যন্ত লক্ষ করেছেন, সেই সামান্য মোহটুকুর জন্যই যে তাঁর এই সর্বব্যাপ্ত ক্ষতি হয়ে গেল, সে কথা অম্বা একবারও স্বগতভাবে উচ্চারণ করলেন না। কিন্তু তিনি মুখে কিছু না বললেও মহাভারতের কবি তা বুঝিয়ে দিয়েছেন মনস্তাত্ত্বিকের মন্ত্রণা মিশিয়ে। এক মুহূর্তের জন্য হলেও তাঁর ওই সামান্য অথচ গভীর সুখটুকু বিপরীতভাবে প্রতিফলিত হল ভীষ্মের ওপর তাঁর ভয়ংকর ক্রোধের মধ্য দিয়ে।

ভীষ্ম তাঁর কোনও ক্ষতি করেননি, বরঞ্চ অম্বার অনুরোধে তাঁর প্রতি মহানুভবতা দেখিয়েও তাঁর ক্রোধ থেকে রেহাই পেলেন না ভীষ্ম। আপন পিতা, শাল্বরাজ এবং অবশ্যই নিজেকেও ছেড়ে দিয়ে সমস্ত অন্যায়ের জন্য অম্বা দায়ী করলেন ভীষ্মকে—অনয়স্যাস্য তু মুখং ভীষ্মঃ শান্তনবো মম। অম্বা আগে দুঃখ করে বলেছিলেন—‘ভীষ্ম যদি আমায় ছেড়ে না দিতেন’—অর্থাৎ তাতে তাঁর এইটুকু সান্ত্বনা থাকত যে, ভীষ্ম ছাড়েননি বলেই তিনি শাল্বরাজের কাছে আসতে পারেননি। আরও একটা সান্ত্বনা থাকত—তিনি এমন নিরাশ্রয় হয়ে পড়তেন না, অন্তত স্ত্রীলোকের জীবনযাপন করার নিশ্চিন্ত নিরাপত্তাটুকু তাঁর থাকত। কিন্তু এখানে যে তিনি নিজেই সবচেয়ে বড় দোষী—কারণ তিনিই শাল্বরাজের কথা ভীষ্মকে জানিয়েছেন—সে বিচার তিনি করলেন না। শুধু ভীষ্মের মহানুভবতার কারণেই যেহেতু তাঁর জীবনের বিপর্যয় ঘটল, অতএব অম্বার মনে হল—প্রতিশোধ যদি কারও ওপর নিতে হয়, তো ভীষ্মের ওপরেই তা নিতে হবে, কেন না তাঁর সমস্ত দুঃখের জন্য তিনিই দায়ি—সা ভীষ্মে প্রতিকর্তব্যং দুঃখহেতুঃ স মে মতঃ।

এখানে ভীষ্মের প্রতি অম্বার এই দুর্দম প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই ভীষ্মের প্রতি তাঁর অবচেতন কামনার অনুমান করতে পারেন মনস্তত্ত্ববিদেরা। নইলে সবাইকে ছেড়ে মোটামুটি নির্দোষ এক ব্যক্তির প্রতি এই প্রতিশোধস্পৃহা তৈরি হবে কেন? অম্বা ঠিক করলেন—ভীষ্মকে শাস্তি দিতে হবে। হয় ভীষ্মের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী অথবা অধিকতর অস্ত্ৰকুশলী ব্যক্তির দ্বারা ভীষ্মকে মার খাওয়াতে হবে, নয়তো তপস্যা ইত্যাদির মাধ্যমে ভীষ্মকে নত করতে হবে। প্রথম উপায় একান্তই লৌকিক, অতএব সেটাই চেষ্টা করতে হবে প্রথম। প্রথম উপায় কাজে না লাগলে অলৌকিকতার আশ্রয় নিয়ে দেবতার তপস্যা করতে হবে। তবে সবার আগে অম্বার প্রয়োজন একটি নিরাপদ আশ্রয়।

শাল্ব-নগরীর সীমা পেরিয়ে আসতেই গভীর বনের প্রান্তে এক ঋষির আশ্রম চোখে পড়ল অম্বার। আরণ্যক ঋষি-মুনিরা তাঁকে সেদিনকার রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করে দিলেন আশ্রমেই। পরের দিন অম্বা নিজের জীবনের সমস্ত দুর্ঘটনার কথা ইনিয়েবিনিয়ে ঋষিদের বললেন। একেবারে স্বয়ংবরসভায় ভীষ্মের হরণক্রিয়া থেকে শাল্বরাজের প্রত্যাখ্যান পর্যন্ত। আপাতদৃষ্টিতে মহামতি ভীষ্মের ব্যবহারে খুব দোষ খুঁজে পাওয়া যাবে না বলেই সুচতুরা অম্বা শাল্বরাজের ওপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিয়ে বললেন—দেখুন, শাল্বরাজ আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, আমার মনে আনন্দ বলে কিছু নেই—প্রত্যাখ্যাতা নিরানন্দা শাল্বেন চ নিরাকৃতা। অম্বা আরও জানালেন যে, এই প্রত্যাখ্যাত জীবন বহন করে নিজের পিতৃগৃহেও তিনি ফিরতে চান না। বরঞ্চ মুনি-ঋষিদের মতো প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে অবশিষ্ট জীবন তিনি তপস্যায় কাটিয়ে দিতে চান—প্রব্রজ্যমহমিচ্ছামি তপস্তপ্স্যামি দুশ্চরম্‌।

অম্বার অবস্থা শুনে মুনি-ঋষিদের যথেষ্ট মায়া হল। তাঁরা কেউ শাল্বকে দুষলেন, কেউ বা ভীষ্মকে। কিন্তু সবার শেষে যখন আশ্রয়ের কথা উঠল, তখন ঋষিরা খুব বাস্তববাদী ভঙ্গিতে বললেন—তোমার এই বয়সে তপস্যা চলে না, মা! তা ছাড়া তোমার মতো একটি যুবতী মেয়ে আশ্রমে থাকলে আশ্রমে আগন্তুক রাজা মহারাজারা তোমার প্রতি আকৃষ্ট হবেন, কেউ বা তোমাকে বিয়েও করতে চাইবেন। নিস্তরঙ্গ আশ্রমের মধ্যে তখন সে এক নতুন সমস্যা হবে। কাজেই ওইসব প্রব্রজ্যা তপস্যার কথা তুমি ভেবো না—প্রার্থয়িষ্যন্তি রাজানঃ তস্মান্ মৈবং মনঃ কৃথাঃ। তারচেয়ে তুমি বরং মা, বাপের বাড়িতেই ফিরে যাও। স্বামীর ঘরে স্বস্তি না হলে বাপের বাড়িতেই মেয়েদের সবচেয়ে ভাল আশ্রয়—গতিঃ পতিঃ সমস্থায়া বিষমে চ পিতা গতিঃ।

অম্বা ঋষি-মুনিদের উপদেশ ধৈর্য ধরে শুনলেন বটে, কিন্তু বাস্তব অবস্থায় সমাজের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তাঁর প্রতি, সে বিষয়ে তাঁর বাস্তব জ্ঞান আছে। তিনি বোঝালেন যে, পূর্বে তিনি বাপের বাড়িতে যে মর্যাদা এবং আদর লাভ করে এসেছেন, এখন এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই মর্যাদা এবং আদর তাঁর জুটবে না। অম্বা বললেন—আপনারা সুপরামর্শ দিয়েছেন, আপনাদের মঙ্গল বিধান করুন বিধাতা, কিন্তু বাপের বাড়ি আমি ফিরতে পারব না—নাহং গমিষ্যে ভদ্রং বস্তত্র যত্র পিতা মম। আমি তপস্যাই করব এবং আমার সুরক্ষার ভার আপনাদের।

আশ্রমের মুনি-ঋষি ব্রাহ্মণরা অম্বার কথায় খুবই বিচলিত বোধ করলেন, বিব্রত তো বটেই। ঠিক এই সময়ে আশ্রমে এক নতুন আগন্তুক এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর নাম হোত্ৰবাহন। হোত্ৰবাহন রাজর্ষি। তিনি রাজা বটে কিন্তু তপস্যা এবং বৈরাগ্যের শক্তিতে তিনি এক মহাপুরুষ। স্বয়ং পরশুরাম তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু। সবচেয়ে বড় কথা—অম্বার সঙ্গে তাঁর কিছু আত্মীয় সম্বন্ধও আছে। রাজর্ষি হোত্ৰবাহন অম্বার মাতামহ অর্থাৎ মায়ের বাবা, দাদু।

রাজর্ষি হোত্ৰবাহন রাজকর্ম করেন বটে কিন্তু তাঁর তপঃসিদ্ধির জন্য মুনি-ঋষিরাও তাঁকে প্রভূত সম্মান করেন। অম্বার মুখে তাঁর কষ্টকাহিনী শুনে হোত্ৰবাহনের খুবই মায়া হল এবং আত্মীয়তার গভীর সম্বন্ধ থাকায় তিনি অম্বাকে সমস্ত আশ্বাস দিয়ে বললেন— তোমাকে বাপের বাড়িও যেতে হবে না, অন্য কোথাও যেতে হবে না। তুমি আমার কাছেই থাকবে। শুধু তাই নয়, যে বিষয়ে তোমার কষ্ট আছে, সেই কষ্ট দূর করার ভারও আমার। আমি তোমার দাদু বলেই এ দায়িত্ব এখন আমার—দুঃখং ছিন্দাম্যহং তে বৈ মাতুস্তে জনকো হ্যহম্‌। হোত্ৰবাহন অম্বাকে সুপরামর্শ দিয়ে বললেন—তুমি ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ পরশুরামের কাছে গিয়ে তোমার দুঃখের কথা জানাও। মহাকালের আগুনের মতো তাঁর তেজ। তিনিই একমাত্র পারেন ভীষ্মকে যুদ্ধে হারাতে, এমনকী তাঁর কথা না শুনলে তাঁকে মেরে ফেলতেও তিনিই একমাত্র সক্ষম—হনিষ্যতি রণে ভীষ্মং ন করিষ্যতি চেদ্‌বচঃ। হোত্ৰবাহন নাতনিকে বোঝালেন যে, পরশুরাম তাঁর বন্ধু মানুষ এবং হোত্ৰবাহনকে তিনি ভালও বাসেন যথেষ্ট। অতএব ভীষ্মের ওপর প্রতিশোধ নেবার ব্যবস্থা একটা হবেই—মম রামঃ সখা বৎসে প্রীতিযুক্তঃ সুহৃচ্চ মে।

রাজর্ষি হোত্ৰবাহন অম্বার মাতামহ, অতএব তাঁর মাধ্যমে পরশুরামকে ধরে ভীষ্মের ওপর প্রতিশোধ তুলবেন অম্বা—এটা আমাদের কাছে খুব বড় খবর নয়। আমাদের কাছে এর চেয়েও বড় খবর হল—রাজর্ষি হোত্ৰবাহন সৃঞ্জয় বংশের রাজা।—স চ রাজা বয়োবৃদ্ধঃ সৃঞ্জয়ো হোত্রবাহনঃ। সৃঞ্জয় হলেন পাঞ্চাল দ্রুপদের পূর্বপুরুষ। তাঁর নামেই প্রসিদ্ধ পাঞ্চাল বংশের ধারা চলে আসছে। ভবিষ্যতে যিনি দ্রৌপদী, ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং শিখণ্ডীর পিতা বলে পরিচিত হবেন, সেই পাঞ্চাল দ্রুপদও সৃঞ্জয়বংশীয়। ওদিকে অম্বার মা, যিনি কাশীরাজের স্ত্রী তিনিও সৃঞ্জয়বংশীয় হোত্ৰবাহনের মেয়ে।

ভীষ্মের বিপক্ষে সৃঞ্জয়-পাঞ্চালদের এই সম্পর্ক মিশে যাওয়াটা মহাভারতের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীকালে অম্বার মধ্যে শিখণ্ডীর রূপান্তর এবং এখন সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহনের ভীষ্মবধের পরিকল্পনার মধ্যে বহু পরবর্তীকালের রাজনৈতিক তাৎপর্য নিহিত আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম পাণ্ডব-পক্ষপাতী হওয়া সত্ত্বেও কেন পাণ্ডবপক্ষে যোগ না দিয়ে কৌরবপক্ষে থেকে গেলেন—এই রাজনৈতিক কূট সমাধানের জন্য যাঁরা ভীষ্মের মুখের কথাটাকেই বড় বলে মনে করেন, তাঁরা আর যাই বুঝুন, মহাভারতের রাজনৈতিক তাৎপর্য কিচ্ছু বোঝেন না। ভীষ্ম নাকি এমন ভাব প্রকাশ করেছিলেন যে, তিনি কুরুবাড়ির অন্ন খেয়েছেন, অতএব সেই অন্নঋণ পরিশোধ করার জন্যই তাঁকে কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করতে হবে। কারণ মানুষ অর্থ এবং অন্নের দাস।

ভীষ্মের এই যুক্তিটা একেবারেই মৌখিকতা, এর মধ্যে গভীর কোনও সত্য নেই। পরবর্তীকালে মহাভারতীয় যুদ্ধের পক্ষস্থিতি এবং তার রাজনৈতিক মেরুকরণ খেয়াল করে দেখুন—কাশীর রাজা পাণ্ডবপক্ষে থেকে যুদ্ধ করেছেন এবং পাঞ্চাল সৃঞ্জয়রাও যোগ দিয়েছিলেন পাণ্ডবপক্ষে। কাশীর রাজার মেয়েদের হরণ করতে গিয়ে ভীষ্ম যেভাবে অপমানিত হয়েছিলেন এবং সেই রাজকুমারীদের অন্যতম অম্বার সূত্র ধরে সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহন পরশুরামকে দিয়ে যেভাবে মার খাওয়ানোর পরিকল্পনা করছেন, তাতে ভীষ্মের পক্ষে পাণ্ডবদের হয়ে যুদ্ধ করার রাজনৈতিক সমস্যা ছিল। কাশীর রাজা এবং পাঞ্চালরা যে পক্ষে আছেন, সে পক্ষে থেকে ভীষ্মের যুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি এই কারণেই। সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহন তাঁর নাতনির কষ্টে সমব্যথী হয়ে তাঁর বন্ধু পরশুরামকে দিয়ে ভীষ্মকে শাস্তি দিতে চাইছেন—এই সমস্ত পশ্চাৎ পরিকল্পনা আমরা ভীষ্মের মুখেই শুনতে পাচ্ছি মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে, অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ যখন প্রায় লাগে লাগে। বোঝা যায় এইসময় পর্যন্তও কাশীরাজ এবং সৃঞ্জয় পাঞ্চালদের সম্বন্ধে ভীষ্মের বিমুখতা অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই বর্তমান। কীভাবে, কত সুপরিকল্পিতভাবে কাশী-পাঞ্চালের জোট ভীষ্মের পিছনে লেগেছিল, সেসব ঘটনা ভীষ্ম নিজেই উদ্যোগপর্বে বর্ণনা করেছেন কুরুবাড়ির যোদ্ধা নেতাদের সামনে। ভীষ্মের বিরুদ্ধে কাশী এবং পাঞ্চালদের এই মিত্রতা আরম্ভ হয়েছিল সেই বিচিত্রবীর্যের বিবাহের সময় থেকে এবং সেটা প্রধানত তখনকার হস্তিনাপুরের সর্বময় কর্তা ভীষ্মের বিরুদ্ধে। ভীষ্ম পাণ্ডবদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের পক্ষে যোগ দেননি এই রাজনৈতিক বিরুদ্ধতার কারণেই।

সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহনের আনুকূল্যে পরশুরামের সঙ্গে অম্বার দেখা হয় এবং তাঁর কাছে ভীষ্মকে চরম শাস্তি দেবার আর্জি পেশ করেন অম্বা। অম্বার শেষ সিদ্ধান্ত—আপনি আমার দুঃখ দূর করুন, ভগবন! মারুন ওই ভীষ্ম নামের মানুষটাকে—ভীষ্মং জহি মহাবাহো যৎকৃতে দুঃখমীদৃশম্। বন্ধু হোত্ৰবাহনের কথায় পরশুরাম ভীষ্মকে শাস্তি দেবার ব্যাপারে পূর্বে যথেষ্টই আশ্বাস দিয়েছিলেন অম্বাকে। কিন্তু এখন অম্বার মুখে এমন স্পষ্ট অনুরোধে তাঁর একটু দ্বিধাই হল। ভীষ্ম এককালে তাঁর পরম প্রিয় অস্ত্রশিষ্য ছিলেন। শিষ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করা বা তাঁকে বধ করা—কোনওটাই পরশুরামের পরম ইপ্সিত ছিল না। পরশুরাম একটু বুঝিয়েও বললেন অম্বাকে। বললেন—দেখো রাজকন্যে! আরও একবার ভেবে দেখো। তোমার ছোট বোনদের সম্বন্ধ মনে রাখলে ভীষ্ম তোমার গুরুজন বটে। কিন্তু আমি যদি তাঁকে অনুরোধ করি, তা হলে তোমার গুরুজন হওয়া সত্ত্বেও তিনি তোমার পাদুটো মাথায় বয়ে নিয়ে যাবেন—শিরসা বন্দনার্হো’পি গ্রহীষ্যতি গিরা মম।

পরশুরামের কথায় একটুও বিগলিত হলেন না অম্বা। রমণীর প্রতিহত প্রেম উপযুক্ত সুযোগে ধ্বংসের আকার ধারণ করেছে। অম্বা বললেন—আপনি যদি আমার তুষ্টির কথা একটুও ভাবেন, তা হলে মারতেই হবে ভীষ্মকে, মারতেই হবে—জহি ভীষ্মং রণে রাম মম চেদিচ্ছসি প্রিয়ম্‌। অম্বার কথার সঙ্গে রাজর্ষি হোত্রবাহনের নিঃশব্দ প্রভাব মিশ্রিত হল এবং পরশুরাম অম্বা এবং অন্যান্য মুনি ঋষিদের সঙ্গে নিয়ে কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন ভীষ্মকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। যদিও পরশুরামের মনে এই ছিল যে, কথা না শুনলে তিনি ভীষ্মকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন ঠিকই, কিন্তু তিনি তবুও দেখবেন, যাতে ভাল কথাতেই কাজ হয়ে যায়—তথৈব চ করিষ্যামি যথা সাস্নৈব লপ্স্যতে।

পরশুরাম কুরুক্ষেত্রে এসেই ভীষ্মের কাছে দূত পাঠালেন—আমি এসেছি—প্রাপ্তো’স্মি। খবর শুনে ভীষ্ম যথোচিত সম্মান পুরঃসর পাদ্যঅর্ঘ্য নিয়ে উপস্থিত হলেন পরশুরামের কাছে। ভীষ্ম প্রণাম করে দাঁড়াতেই পরশুরাম বললেন—ভীষ্ম! এ তোমার কেমন ব্যবহার? তুমি নিজে যখন বিয়েই করবে না তখন কেনই বা এই নিরপরাধ মেয়েটিকে তুলে এনেছিলে। আর তুলেই আনলে যখন তখন কেনই বা তাকে ত্যাগ করলে। মেয়েটির কোনও কলঙ্ক ছিল না, অথচ তুমি এর সর্বনাশ এবং ধর্মনাশ দুই-ই করেছ—বিভ্রংশিতা ত্বয়া হীয়ং ধর্মদাস্তে যশস্বিনী। তুমি একে স্পর্শ করেছিলে বলেই শাল্বরাজ একে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সব কথার শেষে পরশুরাম বললেন—সে এখন যা হবার তা হয়ে গেছে। তুমি এই মুহূর্তে আমার আদেশ মেনে এই কন্যাকে গ্রহণ করো, যাতে এই রাজপুত্রী নারীজীবনের সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে—তস্মাদিমাং মন্নিয়োগাৎ প্রতিগৃহ্নীষ্ব ভারত।

ভীষ্ম জানেন যে, কাশীরাজের কন্যাগুলিকে হরণ করার মধ্যে তাঁর কিছু হঠকারিতা বা সামান্য অপরিণতির স্পর্শ থাকতে পারে, কিন্তু অন্যায় কিছু নেই। ভীষ্ম তাই সশ্রদ্ধভাবে উত্তর দিলেন—আমি এই রমণীকে আর আমার ভাইয়ের হাতে তুলে দিতে পারি না। ইনি আমাকে শাল্বরাজের প্রতি তাঁর অনুরক্তির কথা জানিয়েছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে আমি তাঁকে মুক্তি দিয়েছি। এখন সব জেনেশুনে কীভাবে এক পরানুরক্তা রমণীকে আমাদের ঘরে নিয়ে তুলতে পারি?

পরশুরাম যুদ্ধের ভয় দেখালেন, হত্যার ভয় দেখালেন, কিন্তু ভীষ্ম নিজের যুক্তি থেকে সরে এলেন না। অগ্ন্যুৎপাতের মতো দুই মহাবীরের উগ্র বাক্যবিনিময় চলল অনেকক্ষণ ধরে। শেষে যুদ্ধও আরম্ভ হল একুশবার ক্ষত্রিয়হন্তা পরশুরামের সঙ্গে ভীষ্মের। মহাভারতের কবি প্রায় আট অধ্যায় জুড়ে এই যুদ্ধের বর্ণনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন, যুদ্ধের পরিণতি মহাবীর পরশুরামের বিপক্ষে যাচ্ছিল, তিনি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছিলেন। শুভার্থী মানুষেরা এই যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা আরম্ভ করতেই পরশুরাম সরে দাঁড়ালেন এবং ভীষ্মও সঙ্গে সঙ্গে আনত হয়ে গুরুর চরণবন্দনা করলেন।

পরশুরাম এত খুশি হলেন বলার নয়। আপন শিষ্যের গর্বে গর্বিত হয়ে তিনি বললেন—এই পৃথিবীতে তোমার মতো ক্ষত্রিয়বীর আর দ্বিতীয়টি নেই—ত্বৎসমো নাস্তি লোকে’স্মিন ক্ষত্রিয়ঃ পৃথিবীচরঃ। আমি পরম সন্তুষ্ট হয়েছি। ভীষ্মের প্রশংসা করেই পরশুরাম অম্বাকে নিজের করুণ অসহায়তার কথা জানালেন। বললেন—আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও আমি ভীষ্মের কতটুকু ক্ষতি করতে পেরেছি, লোকে তা দেখেছে। প্রত্যক্ষমেতল্‌-লোকানাম্‌—আমি ভীষ্মকে জয় করতে পারিনি। পরশুরাম নিজের অক্ষমতা সম্পূর্ণ প্রকট করে অম্বাকে শেষ পরামর্শ দিয়ে বললেন—আমার কথা যদি শোন, তবে তুমি ভীষ্মেরই শরণাপন্ন হও। তিনিই তোমার পরমা গতি—ভীষ্মমেব প্রপদ্যস্ব ন তে’ন্যা বিদ্যতে গতিঃ।

যাঁকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন অম্বা, পরশুরাম তাঁরই কাছে ফিরে যেতে বলছেন তাঁকে। এও কি তাঁর পক্ষে সম্ভব! পরশুরামের মতো মহাবীর যাঁর কাছে হেরে যাচ্ছেন, তাঁকে সবার সামনে প্রশংসা না করে উপায় নেই অম্বার। হয়তো সেই অবাক বিস্ময় আবারও তাঁকে আচ্ছন্ন করেছিল, যে আচ্ছন্নতাকে শাল্বরাজ নিজের সংজ্ঞায় বলেছিলেন—তোমাকে খুশি খুশি লাগছিল। কিন্তু সেই আচ্ছন্নতা কাটিয়ে অম্বা দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন—ভীষ্ম দেব দানব সবার অপরাজেয় হতে পারেন, কিন্তু তাই বলে কোনওভাবেই আমি আর ভীষ্মের কাছে ফিরে যেতে পারি না। বরঞ্চ আমি সেই চেষ্টা করব যাতে আমি নিজেই ভীষ্মকে বধ করতে পারি। কিন্তু আমি কিছুতেই ভীষ্মের শরণাপন্ন হব না—ন চাহমেনং যাস্যামি পুনর্ভীষ্মং কথঞ্চন।

এইসমস্ত ঘটনার শেষে ভীষ্মের প্রতি অম্বার প্রকৃত হৃদয় কীভাবেই বা আমরা ব্যাখ্যা করব। শাল্বরাজকে তিনি বিবাহ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন, তাঁর ওপরে অম্বার এতটুকু রাগ নেই। অথচ ভীষ্মের ওপর তাঁর এত রাগ কীসের? তিনি একান্ত সমাজ-সচল প্রক্রিয়াতে নিতান্ত ক্ষত্রিয়োচিতভাবে অম্বাকে হরণ করেছিলেন। অথচ অম্বা শাল্বরাজের প্রত্যাখ্যানে অপমানিত বোধ করলেন না। তাঁর যত অপমান হল ভীষ্ম তাঁকে স্বয়ংবরসভা থেকে তুলে এনেছেন বলে। আমাদের মতো মানুষেরা এখানে টিপ্পনী কেটে বলবেই যে, আসলে শাল্বরাজের থেকেও ভীষ্মের ব্যাপারে তাঁর মুগ্ধতা বেশি। আর সেই মুগ্ধতাই বিপ্রতীপভাবে এমন চরম প্রতিশোধস্পৃহায় রূপান্তরিত হয়েছে। ভীষ্মবধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে অম্বা বনে চলে গেলেন।

এদিকে পরশুরামকে যুদ্ধে জয় করে ভীষ্ম ব্রাহ্মণদের স্তুতি-মাঙ্গলিক আর জয়কার শুনতে শুনতে হস্তিনায় প্রবেশ করলেন। ঘটনার সমস্ত বিবরণ তিনি জানালেন জননী সত্যবতীকে। হস্তিনাপুরে তখন মহারাজ বিচিত্রবীর্য রাজ্য শাসন করছেন। ভীষ্ম রইলেন তাঁর অভিভাবকের মতো। ভালই চলছিল সব। বিচিত্রবীর্যের রোমাঞ্চিত বৈবাহিক জীবন, হস্তিনাপুরের রাজ্য শাসন, ভীষ্মের অভিভাবকত্ব সবই ভালই চলছিল। কিন্তু সমস্ত ঘটনার মধ্যে একটিমাত্র ব্যথা—তাও সুখের মতো কোনও ব্যথা কি না কে জানে—একটিমাত্র ব্যথা মহামতি ভীষ্মকে বিচলিত করছিল। এক সুন্দরী রমণীর জীবন এবং যৌবন তাঁরই কারণে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। সে একবারও বলে না যে, ভীষ্মকে তার ভাল লেগেছে, ভীষ্মকে ভালবেসে সে হস্তিনাপুরে থাকতেও চায় না। সে শুধু ভীষ্মকে মারতে চায়। রমণীর বিচিত্র এই মনস্তত্ত্ব ভীষ্ম কেমনভাবে গ্রহণ করেন, মহাভারতের কবি তা বলেননি। তবে ভীষ্মও বুঝি তাঁর হাতে মরতে চান। যেদিন থেকে ভীষ্মবধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে অম্বা বনে তপস্যা করতে গেছেন, তদবধি ভীষ্ম কতগুলি বিশ্বস্ত গুপ্তচরকে লাগিয়ে রেখেছেন—সেই বনগতা রমণীর সমস্ত গতিবিধি লক্ষ করার জন্য। শেষজীবনে এসে ভীষ্ম নিজের মুখেই জানিয়েছেন—হ্যাঁ। সেইসমস্ত গুপ্তচরেরা অম্বার প্রতিদিনের কথা, কল্পনা এবং ব্যবহার আমার কাছে নিবেদন করত যথাযথভাবে—

পুরুষাশ্চাদিশং প্রাজ্ঞান্‌ কন্যাবৃত্তান্তকর্মনি॥

দিবসে দিবসে হ্যস্যা গতি-জল্পিত-চেষ্টিতম্‌।

প্রত্যাহরংশ্চ মে যুক্তাঃ স্থিতাঃ প্রিয়হিতে সদা॥

ভীষ্মের জীবনের ওপর দিয়ে এত বড় যে একটা ঝড় বয়ে চলে গেল, এরমধ্যে আপনারা মহারাজ বিচিত্রবীর্যকে একবারও লক্ষ করেছেন কি? অম্বাকে নিয়ে ভীষ্ম যে এত বিব্রত হলেন, পরশুরাম যে তাঁকে মারতে আসলেন, এই গোটা সময়ের মধ্যে হস্তিনাপুরের মহারাজ বিচিত্রবীর্য অথবা ভীষ্মের পুত্রোপম কনিষ্ঠ ভাই বিচিত্রবীর্যকে একবারও তাঁর পাশে এসে দাঁড়াতে দেখলেন কি? ভীষ্মের অপার স্নেহমমতা এবং আদর পেয়ে পেয়ে বিচিত্রবীর্যের পাওয়ার অভ্যাস এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, সংসার এবং রাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্রে তাঁরও যে কিছু করার আছে, কোথাও যে তাঁরও আগ বাড়িয়ে যাওয়া দরকার, সেটা তাঁর বোধের মধ্যেই ছিল না। পিতা শান্তনু মারা যাবার পর কুলজ্যেষ্ঠ চিত্রাঙ্গদও যখন স্বর্গবাসী হলেন তখন বিচিত্রবীর্যকে নিয়ে ভীষ্মের যে আতঙ্ক গেছে, সেটা আমরা বুঝি। ভীষ্ম তাঁকে আদর দিয়েছেন, প্রশ্রয় দিয়েছেন, সেটাও তো ভীষ্মের দিক থেকে কোনও অগৌরবের বিষয় বলে চিহ্নিত করা যায় না।

আজকের দিনেও পিতামাতারা যেমন সন্তানের গায়ে কোনও আঁচ লাগতে দেন না, সংসারের সাধারণ অসাধারণ সমস্ত বিষয়কর্মে নবযুবক পুত্রটিকেও যেমন আজকের পিতামাতারা বাঁচিয়ে চলেন, ভীষ্মও বিচিত্রবীর্যকে সেইভাবেই লালন করেছেন। নইলে, যে স্বয়ংবরসভায় একান্তভাবে বিচিত্রবীর্যেরই যাওয়া উচিত ছিল, সেখানে ভীষ্ম নিজে গিয়ে তাঁর নিজের বিপদ যেমন ঘটালেন, তেমনই বিচিত্রবীর্যেরও এক ধরনের বিপদ ঘটালেন বলে মনে করি। রাজপরিবারের সমস্ত সারভাগ একা পেতে পেতে বিচিত্রবীর্যের এমনই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে, দুটি ভোগ্যা রমণী লাভ করেই তিনি উপলব্ধি করলেন—যেন যথাসাধ্য কাম উপভোগ করার জন্যই তাঁর জন্ম এবং জীবন। তাঁর যে অন্য কোনও কাজ আছে, বয়োজ্যেষ্ঠ ভীষ্মের প্রতি তাঁরও যে কোনও কর্তব্য আছে, তা তিনি বুঝতেই পারলেন না। নইলে, অমন হাঁকডাক করে পরশুরাম ভীষ্মকে রণক্ষেত্রে আহ্বান করলেন, সেখানে হস্তিনাপুরের মহারাজকে আমরা নিশ্চিন্ত মনে কাম-সম্ভোগ করতে দেখছি। আসলে বিবাহের পরেই ভোগাধার দুটি রমণী পেয়ে তিনি এমনই মত্ত হয়ে উঠলেন—তয়োঃ পাণী গৃহীত্বাং তু কামাত্মা সমপদ্যত—যে, তাঁর পিতার সমান ভীষ্ম তাঁরই জন্য কোনও বিপদে পড়লেন, কোথায় যুদ্ধ করতে গেলেন, এসব কিছুই তাঁর বোধের মধ্যে এল না।

ফল যা হবার তাই হল। নিরঙ্কুশ স্ত্রী-সম্ভোগের কারণে বিচিত্রবীর্যের ক্ষয়রোগ হল। তিনি মারা গেলেন। বিচিত্রবীর্যের মারা যাবার আগে বিবাহিত জীবনের সাত সাতটি বছর যখন তিনি স্ত্রী-সম্ভোগে মত্ত ছিলেন, তখন হস্তিনাপুরের রাজ্যশাসনের সমস্ত তদারকি করা ছাড়াও ভীষ্মের জীবনে অম্বার ঝড় বয়ে গেছে। অম্বার আরণ্যক জীবনের সমস্ত খবরাখবর তিনি পেতেন বটে, তবে তাঁরই কারণে ভীষ্মের ‘টেনশন’ বাড়ছিল। একটি স্ত্রীলোক তাঁর স্ত্রী-জীবনের সমস্ত ব্যর্থতার জন্য ভীষ্মকে দায়ি করেছেন এবং তাঁকে মারবার জন্য তপস্যা করছেন, এতে তাঁর ব্যাকুলতা বেড়েছে। উদ্যোগপর্বে গিয়ে ভীষ্ম নিজের মুখে জানাচ্ছেন—অম্বা তপস্যা করবার জন্য বনে গেলে আমি ভীষণ উদ্‌বিগ্ন, বিষণ্ণ এবং চৈতন্যহীনের মতো ব্যবহার করতাম—তদৈব ব্যথিতো দীনো গতচেতা ইবাভবম্‌। এই উদ্‌বেগের মধ্যে তাঁর নিজের মৃত্যুচেতনারও অধিক কোনও সুখের ব্যথা ছিল কি না, তা রসিক জনের অনুভববেদ্য।

আপাতদৃষ্টিতে ভীষ্ম এতই উদ্‌বিগ্ন ছিলেন যে, তিনি নিজের উদ্‌বেগের কারণ আরও দুটি বিশাল ব্যক্তিত্বকে জানিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন লোকশাস্ত্রবিদ্‌ নারদ, অন্যজন বিশালবুদ্ধি ব্যাস, জননী সত্যবতীর সম্পর্কে যিনি ভীষ্মের ভাই-ই বটে—ব্যাসে চৈব তথা কার্যং নারদে’পি নিবেদিতম্‌। দুই ঋষিই ভীষ্মের মনে কোনও শান্তির সুখস্পর্শ দিতে পারেননি। তাঁরা পুরুষকারের ওপর দৈবের বলবত্তা প্রমাণ করে ভীষ্মকে বলেছেন—আপনি স্থির থাকুন। বিচলিত হবেন না। এই সান্ত্বনায় ভীষ্মের মন কতটুকু শান্ত হয়েছিল জানি না, তবে তিনি অম্বার গতিবিধির ওপর নজর রাখা মোটেই বন্ধ করেননি।

ভীষ্ম তাঁর শেষজীবনে এসে আমাদের খবর দিয়েছেন যে, অম্বার নিদারুণ তপস্যা দেখে আরণ্যক মুনি-ঋষিরা একসময় তাঁকে তপস্যা বন্ধ করারও অনুরোধ করেছিলেন। অম্বা শোনেননি এবং রুদ্ধ অভিমানে তিনি বলেছেন—ভীষ্মকে বধ করলেই তবে আমার শান্তি। ভীষ্মের জন্যই আমি চিরকাল দুঃখিনী হয়ে রইলাম, তাঁর জন্যই আমার স্বামীসুখ জুটল না কপালে, তাঁর জন্যই আমার এ হেন অবস্থা, আমি যেন স্ত্রীও নই পুরুষও নই—পতিলোকাদ্‌ বিহীনা চ নৈব স্ত্রী ন পুমানিহ। স্বামীসুখ সংসারসুখ যে রমণীর কাছে অপ্রাপ্ত রয়ে গেল, সে যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বাধিকারটুকু চাইবে, তাতে আশ্চর্য কী? অম্বাকে এক সময়ে আমরা বলতে শুনি—নারীজন্মে আমার ঘেন্না ধরে গেছে, আমি এখন পুরুষ হতে চাই।

আমি অম্বাচরিত্রের আলোচনার সময় অন্যত্র লিখেছি যে, অম্বার এই অদ্ভুত স্বীকারোক্তি থেকে বোঝা যায়—তিনি পরবর্তীকালে কোনও নপুংসক শিখণ্ডীতে রূপান্তরিত হননি। তিনি স্ত্রীই ছিলেন বটে, কিন্তু পুরুষের অস্ত্রবিদ্যা তিনি চরমভাবে শিক্ষা করেছিলেন। অস্বার উপাস্য দেব মহাদেব তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তাঁকে মহারাজ দ্রুপদের ঘরে জন্মানোর আশীর্বাদ দেন, কিন্তু দ্রুপদের ঘরে তিনি কন্যা হয়েই জন্মেছিলেন। স্বয়ং ভীষ্ম নিজ মুখে জানিয়েছেন—আমি গুপ্তচরদের কাছে যা খবর পেয়েছি, তাতে দ্রুপদের ঘরের জাতকটিকে আমি মেয়ে বলেই জানতাম। দ্রুপদ কন্যা লাভ করে তাঁর মেয়েটিকে ছেলে বলে প্রচার করেছিলেন—ছাদয়ামাস তাং কন্যাং পুমানিতি চ সো’ব্রবীৎ। এরপরে অলৌকিক সব কথাকাহিনী আছে, যাতে এক যক্ষের সঙ্গে অম্বার লিঙ্গবিনিময় ঘটে। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে এই কল্পকাহিনী বাদ দিয়ে আমরা যদি সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহনের পূর্বের আশ্বাসটুকু মনে রাখি, তা হলেই বোঝা যাবে যে, সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহন পাঞ্চালদের ঘরের মানুষ বলেই তিনি হয়তো অম্বাকে এনে দিয়েছিলেন দ্রুপদরাজার ঘরে।

দ্রোণাচার্যের ওপর দ্রুপদের যে রাগ ছিল, সে রাগ ভীষ্মের ওপরেও খানিকটা পড়েছিল, কারণ ভীষ্মই দ্রোণাচার্যকে কুরুরাজ্যে গুরুর সম্মানে বরণ করেছিলেন। ফলে অম্বার তপস্যার অন্তে, হয়তো বা অস্ত্রশিক্ষার তপস্যান্তে সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহন যখন সৃঞ্জয়দেরই শ্রেষ্ঠতম পুরুষ দ্রুপদের ঘরে অম্বাকে নিয়ে আসেন, তখন দ্রুপদ তাঁর কন্যা পরিচয় আচ্ছাদন করে নিজের পুত্র বলে তাঁর পরিচয় দিতে থাকেন। কারণ অম্বা এবং তিনি— দুজনেই ভীষ্মের সর্বনাশ চান। একই সঙ্গে দ্রুপদের ওপরে মহাদেবের বরও এখানে সার্থক হয়ে ওঠে। স্ত্রীরূপিণী অম্বার হঠাৎ এই শিখণ্ডীরূপে পরিণতির কথা ভীষ্ম ভালভাবেই জানতেন এবং চিরকালই তিনি শিখণ্ডীকে অম্বা বলেই জেনে এসেছেন—শিখণ্ডিনং মহারাজ পুত্রং স্ত্রীপূর্বিনং তথা।

যাই হোক, অম্বা যখন থেকে শিখণ্ডী নামে এক পুত্র পরিচয়ে দ্রুপদের ঘরে বাস করতে আরম্ভ করেছেন, তখন থেকে ভীষ্মের মনেও একটা শান্তভাব এসেছে। শিখণ্ডী দ্রুপদের অন্য পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে দ্রোণাচার্যের কাছেও একসময় অস্ত্রশিক্ষা করেছেন। কাজেই হস্তিনাপুরের রাজা বিচিত্রবীর্য মারা যাবার সাত-আট বছর আগে থেকে দ্রোণাচার্যের কুরুবাড়িতে অস্ত্রগুরু হয়ে আসা পর্যন্ত অম্বাকে নিয়ে মহামতি ভীষ্মের মানসিক অস্থিরতা চলে। কিন্তু এই সময়টুকুর মধ্যে খোদ হস্তিনাপুরেই এক বিরাট পরিবর্তন আসে এবং সেই পরিবর্তনের মধ্যেও ভীষ্মের ভূমিকা কিছু কম নয়। আপন অন্তরের মধ্যে আপন মৃত্যুরূপিণী অম্বাকে লালন করতে করতে হস্তিনাপুরের পারিবারিক রাজনীতিতে সুস্থিরতা আনবার জন্য ভীষ্মকে যে পরিমাণ ভাবনা ভাবতে হয়েছে, তা একমাত্র ভীষ্মের মতো বিশাল ব্যক্তিত্ব ছাড়া অন্য কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না।