৬
দুর্যোধনের পাশা-চক্রান্ত পাণ্ডবদের জীবনে এমনই একটা ঘটনা, যা থেকে প্রত্যেক পাণ্ডব-চরিত্র সম্বন্ধে নতুন করে ভাবতে হয়। পাশাখেলার সর্বনাশা ফল সমস্ত পাণ্ডবভাই এবং দ্রৌপদীর ওপরেও নেমে এসেছে। এই নিরিখে যুধিষ্ঠির অথবা অর্জুনের চরিত্র যেমন নতুন ভাব-ভাবনায় প্রকাশিত, তেমনই ভীমের চরিত্রেও আমরা এখন থেকে নতুন এক মাত্রা লক্ষ করতে থাকব। বস্তুত পাশাখেলা যদি না হত, তা হলে বড় জোর কী হত? যুধিষ্ঠিরের শাসনে পাণ্ডবরা আরও আরও রাজসম্পদ বৃদ্ধি করতেন। তাঁরা বড় সুখে থাকতেন। কিন্তু মহাকাব্যের কবি শুধু সুখে সন্তুষ্ট নন। মানুষের মনের মধ্যে যে অনির্বাণ দ্বন্দ্ব চলে, সেই দ্বন্দ্ব কেমন করে একজনকে কাছে আনে, অন্যকে দূরে ঠেলে দেয়, কেমন করে একজনকে মাহাত্ম্য দেয় অন্যকে অবহাস—সেই সব বিচিত্র ভাব-কৌতুকের ততোধিক বিচিত্র পরিণতি দেখানোর জন্যই মহাকবি পাশাখেলার আয়োজন করেছেন।
পাশাখেলার মধ্যে অনন্ত কুটিলতা আছে, কপটতাও আছে। কিন্তু মানুষের মধ্যেও যে কুটিল-কপট বৃত্তিগুলি আছে, সেগুলিরও একটা বিষয় চাই প্রকাশ হবার জন্য। মনুষ্য-হৃদয়ের অন্তরালে থাকা মৌন-মূক ভাব, সাধারণ অবস্থায় যা প্রকাশ করলে হয়তো বিপরীত শোনাত, সেইগুলি প্রকাশের জন্যও একটা কুটিল পরিস্থিতি দরকার, নইলে সে ভাব চিরকাল না জানাই থেকে যেত। মানুষগুলিও হয়ে থাকত অচেনা।
কে ভেবেছিল ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এমন মানুষ? এই এতদিন নিত্য উঠতে-বসতে যাঁকে ধর্মের প্রতিরূপে দেখতে পেয়েছি, সেই যুধিষ্ঠির পাশাখেলায় এমন প্রমত্ত হয়ে উঠবেন—কে জানত? কে জানত—পাকা জুয়াড়ির মতো দানের পর দান চেলে একে একে তিনি প্রিয়তম ভাইদের পণ রাখবেন পাশা খেলায়? পঞ্চপাণ্ডবের প্রিয়তমা দ্রৌপদীকে পাশার পণে বাঁধা দিয়ে নিজেকে নিম্নতা-নীচতার শেষ স্তরে নিয়ে আসবেন, তাই বা কে জানত? অন্যদিকে এই যে ভীম, যাকে অন্যেরা খানিকটা বুদ্ধিহীন এবং অনেকটাই হৃদয়হীন ভেবে এসেছেন এতকাল, তাঁর মধ্যেও যে পঞ্চপাণ্ডবের এক-পঞ্চমাংশ রমণীর জন্য এত বড় একটা সম্পূর্ণ হৃদয় একেবারে সাজানো থাকতে পারে—সেটাই কি একটুও বোঝা যেত ওই পাশাখেলা না হলে? তাই বলি, অন্য কারও কথা থাক অন্তত দ্রৌপদীর জীবনে যুধিষ্ঠিরের পাশাখেলাটা যতই অভিশাপের মতো নেমে আসুক, এর মধ্যে ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো লুকিয়ে ছিলেন ভীম।
একটা সাদামাটা কথা এখানে আগেই বলে নিই। নারদ ইন্দ্রপ্রস্থের সভায় এসে পাণ্ডবদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন—তোমরা বাপু! দ্রৌপদীকে নিয়ে সুন্দ-উপসুন্দের লড়াই কোরো না। পাঁচ ভাই অথচ বউ একটা। তোমরা প্রত্যেকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দ্রৌপদীর অধিকারসুখ ভোগ কোরো, নচেৎ এই সুন্দরী রমণীকে নিয়ে তোমাদের বিসংবাদ অবশ্যম্ভাবী। পাণ্ডবভাইরা সবাই এ কথার সারবত্তা মেনে নিয়েছিলেন। তদবধি দ্রৌপদীকে তাঁরা লাভ করছিলেন একেক বছরের জন্য। জীবন বয়ে যাচ্ছিল রুটিন-মাফিক মন্দাক্রান্তা তালে। এর মধ্যে দ্রৌপদী ইন্দ্রপ্রস্থের রানি হয়েছেন। স্বামীদের একেক জনকে সঙ্গ-সুখ দিয়ে যাচ্ছেন নারদের প্রথামাফিক। এর মধ্যে কোনও বৈচিত্র্য ছিল না।
শরীরের ওপর স্বামীর অধিকার—বিবাহিতা রমণীর এই স্বতঃসিদ্ধ অধিকার দিয়ে দ্রৌপদীর মতো বিদগ্ধা রূপসীর বড় কিছু যায় আসে না। কিন্তু মন? দ্রুপদের রাজসভায় এক ব্রাহ্মণ যুবকের বেশে যে বীর লক্ষ্যভেদ করে তাঁকে জিতে নিয়েছিলেন, যাঁকে তিনি শুভদৃষ্টির প্রথম লগ্নে একমাত্র স্বামী বলে ভেবেছিলেন, তাঁর জন্য দ্রৌপদীর অনেক অপেক্ষা ছিল। কিন্তু অর্জুনকে সে ভাবে পাওয়া আর হল কই? একে তো কুন্তীর বাক্য সামলাতে পাঁচ পাঁচটি পুরুষ তাঁর স্বামী হলেন। তার মধ্যে নিজেদেরই নিয়মের ফাঁদে পড়ে অর্জুনকে যেতে হল আকালিক বনবাসে। কিন্তু বনবাসের ব্রহ্মচর্য ভেঙে যাদবনন্দিনী সুভদ্রাকে নিয়ে অর্জুন যেদিন বাড়ি ফিরলেন, সেদিনও অর্জুনের জন্য দ্রৌপদীর অপেক্ষা আছে। তিনি অভিমান করেছেন, কেঁদেছেন কিন্তু অর্জুনকে হৃদয় থেকে মুক্ত করেননি।
অথচ যে বেচারা অর্জুনের সঙ্গে এক তালে যুদ্ধ জয় করে দ্রুপদ-সভা থেকে একই সঙ্গে অর্জুন এবং দ্রৌপদীর পেছন পেছন সেই কুম্ভকারের পর্ণশালায় ফিরে এলেন, তাঁর জন্য কি দ্রৌপদীর এতটুকু সরসতা ছিল? ভীম ধীরোদাত্ত নায়ক তো নন, বরঞ্চ ধীরোদ্ধতই তাঁর সংজ্ঞা হওয়া উচিত। বিদগ্ধতা তাঁর মধ্যে যত, সরলতা তার চেয়ে বেশি। কিন্তু পঞ্চপাণ্ডবের একতমা নায়িকাকে—আমিই তোমাকে একমাত্র ভালবাসি—এ কথাটা সরলভাবেও বলার উপায় ছিল না ভীমের। অথচ কী আশ্চর্য, পাশাখেলার মতো এক কুটিল পরিস্থিতিতে যুধিষ্ঠির যখন একের পর এক বাজি রেখে হারছেন এবং শেষ চালে পঞ্চস্বামিগর্বিতা দ্রৌপদীকেও হেরে বসলেন, সেই সময় থেকে যুধিষ্ঠির অথবা তাঁর লক্ষ্যভেদী স্বামী অর্জুনকে দ্রৌপদী যেভাবে চিনলেন, তার থেকে অন্যতর এক বৈশিষ্ট্যে তিনি চিনলেন ভীমকে।
বলা বাহুল্য, যুধিষ্ঠির যখন বিদুরের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে কুরুসভায় পাশা খেলতে এলেন, তখন যুধিষ্ঠির কোনও ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করেননি, এবং ভীমও আগ বাড়িয়ে তাঁকে একটিও উপদেশ দেননি। এমনকী যুধিষ্ঠির যখন ভীমকে বাজি রাখলেন তখনও যুধিষ্ঠিরকে তিনি একটুও অতিক্রম করেননি। ভীমকে বাজি রাখার সময় পণ হিসেবে ভীম যে কতটা মূল্যবান, তার একটা বর্ণনা দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠির। তিনি সম্পূর্ণ সচেতনভাবে বলছেন—ভীম এই পঞ্চপাণ্ডবের নেতা, আমাদের সমস্ত যুদ্ধেও তিনি নেতা। ইন্দ্র যেমন একা সমস্ত দৈত্য-দানবের সঙ্গে লড়াই করতে পারেন, এই আমাদের ভীমও তেমনি। সিংহের মতো তাঁর কাঁধ-জোড়া, হাতে ওই ভারী গদা, ওঁর সমান বীর নেই এই ত্রিভুবনে। হ্যাঁ, ভীম তাকান একটু তেরছাভাবে এবং সব সময়ই তিনি ক্ষেপে থাকেন—সদাত্যমর্ষী।
এই অতিসংক্ষিপ্ত পণ-গুণবর্ণনার মধ্যেও যুধিষ্ঠির এটা বুঝেছিলেন যে, ভীমকে কোনও ভাবেই বাজি রাখা উচিত নয়—অনর্হতা রাজপুত্ৰেণ তেন দিব্যামি। তা ছাড়া ভীমকে অত রাগী জেনেও যুধিষ্ঠিরের কিন্তু এমন কোনও অবিশ্বাস ছিল না ভীমের ওপর যে, ওই পণ রাখার মুহূর্তে ভীম তাঁকে অতিক্রম করবেন। অতিক্রম করেনওনি, কারণ নিজের জন্য তিনি সামান্যই ভাবেন। গায়ে অসীম শক্তি, অতএব যে অবস্থাতেই পড়ুন, তিনি নিজের জন্য ভাবেন না। এমনকী দ্রৌপদীকে পণ রাখার সময়েও তিনি কিছু বলেননি। কারণ, যে যুধিষ্ঠির নিজের কাছেই নিজে করুণার পাত্র—তিনি তো নিজেকেই হেরে বসে আছেন—সেই যুধিষ্ঠিরকেই বা বলে কী লাভ? ভীম কিছুই বলেননি।
কিন্তু একসময় দুর্যোধন, কর্ণ এবং দুঃশাসনের ঔদ্ধত্য অত্যন্ত বেড়ে গেল। পাণ্ডব-কুলের রাজবধূকে নিয়ে তাঁরা ছিনিমিনি খেলা আরম্ভ করলেন। তাঁদের একজন দ্রৌপদীকে কুরুসভায় টেনে আনতে বলছেন। অন্যজন তাঁর বস্ত্র কেড়ে নেবার সুপরামর্শ দিচ্ছেন। আর আরেকজন তাঁর বস্ত্র উন্মোচন করা আরম্ভ করলেন সবার সামনে। একবস্ত্রা রজস্বলা দ্রৌপদী রাগে, দুঃখে, অপমানে যখন জর্জরিত, কুরুসভার বৃদ্ধরা যখন লজ্জায় মাথা তুলতে পারছেন না, এবং পাণ্ডবভাইরা যখন দ্রৌপদীর কোপ-কটাক্ষে ভস্মীভূত হচ্ছেন—তখন যে-কজন লোকের মুখ দিয়ে কথা বেরনো উচিত ছিল অথবা কথা বেরলে হয়তো কাজ হত, তাঁদের মধ্যে তিনজনকে আমরা চিহ্নিত করতে চাই। এক ভীষ্ম, দুই ধৃতরাষ্ট্র এবং তৃতীয়—খানিকটা নিরুপায় হলেও, যুধিষ্ঠির। কেন, তার কারণ বলতে গেলে প্রবন্ধ দীর্ঘায়িত হবে।
কিন্তু এই তিন জনের কেউই যখন রা’ কাড়লেন না, তখন একমাত্র যাঁর মুখ দিয়ে একরাশ কথা বেরিয়ে এল, তিনি ভীম। কথাগুলির মধ্যে যে খুব যুক্তির তীব্রতা ছিল, তা মোটেই নয়, ছিল না কোনও রাজনৈতিক মাহাত্ম্যও। এমনকী যুধিষ্ঠির পাণ্ডবভাইদের নিয়ে যেভাবে পণের জালে জড়িয়ে পড়লেন, তার মধ্যে থেকে বেরতে গেলে যে ধরনের যুক্তিসিদ্ধি থাকা দরকার, সে সিদ্ধিও তাঁর কথার মধ্যে ছিল না। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে কখনও কখনও যেমন যুক্তি-তর্কের থেকেও পেশিপ্রদর্শন কার্যকরী হয়ে পড়ে—বিশেষত অন্য উপায় না থাকলে—ভীম সেই কাজটিই করলেন। যাঁরা বলেন, ভীমের বুদ্ধি বড় মোটা দাগের, তাঁদের জানাতে চাই—দ্রৌপদী যে শেষ পর্যন্ত তাঁর অপমান-জাল থেকে মুক্ত হলেন, তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিলেন ভীম। ভীম যে কথাগুলি বলেছিলেন, সেই সূত্র ধরে অনেক কথা এসেছে কুরুসভায়। তার ওপরে এখনকার গণতন্ত্রেও যেমন রাজনৈতিকভাবে কার্য-সিদ্ধি না হলে পিটিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হয়, ঠিক তেমন করেই ভীমের মাধ্যমে আমরা একটা ‘ক্রুড্’ ক্ষাত্রশক্তির প্রয়োগ দেখতে পাই। সে মুহূর্তে রাজনৈতিক দিক দিয়েও এই পেশিপ্রদর্শনের প্রয়োজন ছিল।
দুঃশাসনের বস্ত্র-হরণের দুরাগ্রহ যখন চরমে পৌঁছল, তখন ভীম কিন্তু কুরুসভার কাউকে কিছুটি বললেন না। শুধু বড়ভাই যুধিষ্ঠিরকে এক হাত নিলেন। ভীম যুধিষ্ঠিরের থেকে মাত্র এক বছরের ছোট। কিন্তু তবুও যুধিষ্ঠিরকে কোনওদিন তিনি লঙ্ঘন করেননি। কিন্তু আজ এই পাণ্ডববধূর চরম অপমানের মুহূর্তে ভীম আর থাকতে পারলেন না। বললেন—দাদা! বদমাশ লোকেরা বেশ্যা রমণীকেও কখনও বাজি রাখে না। তুমি রাজ্য-সম্পদ, হাতী-ঘোড়া বাজি রেখেছ এবং হেরেছ, তাতে আমার রাগ হয়নি একটুও। তুমি আমাদের বাজি রেখে হেরেছ, নিজেকে হেরেছ, তাতেও আমার কিছু বলার নেই। কারণ তুমি আমাদের সবারই অধিকারী। কিন্তু দ্রৌপদীকে বাজি রেখে তুমি নিজের অধিকারকেই অতিক্রম করেছ—ইমং ত্বতিক্রমং মন্যে দ্রৌপদী যত্র পণ্যতে।
ভাবটা এই, দ্রৌপদী শুধু তোমার একার স্ত্রী নন। আমার স্ত্রীকে তুমি বাজি রাখ কোন অধিকারে? ভীম এতই রেগে গিয়েছিলেন যে অনুজ সহদেবকে তিনি আগুন নিয়ে আসার ‘অর্ডার’ দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরের পাশাখেলার হাতটি পুড়িয়ে দেবার জন্য। ঠিক এই মুহুর্তে ‘রিফাইনড’ ক্ষাত্র-শক্তির প্রতীক অর্জুনের হস্তক্ষেপে ‘ক্রুড’ ক্ষাত্র-শক্তির প্রতিরূপ ভীম নিবারিত হন। শত্রুপক্ষের সামনে এটা যে অত্যন্ত লোক-হাসানো ব্যাপার হয়ে যাবে এবং সবার সামনে ধার্মিক ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে অপমান করা যে উচিত নয়—এটা ভীমকে বুঝতে বাধ্য করেন অর্জুন।
অর্জুন তাঁর পরিশীলিত বুদ্ধিতে ভীমকে বুঝিয়ে ছাড়েন যে, যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয়ের ধর্ম অনুসারেই আহুত হয়ে পাশা খেলতে আসেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে তঞ্চকতা করা হয়েছে কপট-পাশার বাজিতে। ভীম শান্ত হন। অর্থাৎ অর্জুন কিন্তু ‘ক্রুড’ ক্ষাত্রশক্তিকে শুধুমাত্র একটু মোচড় দিয়ে ঘুরিয়ে দিলেন শত্রুপক্ষের দিকে। সে কথায় আবার পরে আসছি।
যাই হোক, ভীমের কথার সূত্র ধরে দ্রৌপদীকে প্রথম লজ্জামুক্ত করার চেষ্টা করেন দুর্যোধনেরই ছোট ভাই বিকর্ণ। কিন্তু তাঁর এই চেষ্টা কর্ণের দাপটে এবং বক্তৃতায় দাঁড়াতে পারেনি। দুঃশাসন নির্লজ্জভাবে দ্রৌপদীর বস্ত্রাকর্ষণ আরম্ভ করলেন। তারপর দ্রৌপদীর আর্তি, কাতরতা এবং সৌভাগ্যে অত্যন্ত অলৌকিকভাবে এই বস্ত্রমোচন বন্ধ হল। কুরুসভার সাধারণ রাজমণ্ডলীর মধ্য থেকে ধিক্কারধ্বনি উঠল কৌরবদের বিরুদ্ধেই। দ্রৌপদীর অসহায় অবস্থা দেখে অনেক আগে থেকেই ভীম দাঁতে দাঁত ঘষছিলেন এবং হাতে হাত নিষ্পেষণ করছিলেন ক্রোধে, অপমানে। কিন্তু সমবেত রাজমণ্ডলীর ওই অনুকূল ধিক্কার কাজে লাগিয়ে ভীম বলে উঠলেন—ক্ষত্রিয় রাজারা সব শুনুন মন দিয়ে। এমন কথা আগে কেউ বলেনি, ভবিষ্যতেও কেউ বলবে না। আর আমি যা বলছি, তা যদি আমি না করতে পারি, তবে জানবেন, আমি আমার বাপ-ঠাকুরদার ছেলে নই—পিতামহানাং পূর্বেষাং নাহং গতিমবাপ্নুয়াম্। বাংলার ‘ইডিয়মে’ কথাটার যেমন অনুবাদ হওয়া উচিত, তাই করলাম।
ভীম বললেন—আমি যদি যুদ্ধে এই ভরত-বংশের কলঙ্ক পাপী দুঃশাসনটার বুক চিরে রক্ত না খাই, তবে যেন আমি বাপ-ঠাকুরদার পথে না যেতে পারি। ভীমের এই প্রতিজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে কুরুসভার সর্বত্র ধিক্কার শব্দ উচ্চতর হয়েছে। বিদুর দ্রৌপদীর পক্ষ নিয়েছেন কর্ণ-দুর্যোধনদের কঠোর প্রতিপক্ষতায়, ভীমের আস্ফালন, রাজমণ্ডলীর ধিক্কার এবং বিদুরের প্রতিবাদ—এই তিনটি বিরুদ্ধতার নিরিখে কর্ণ-দুর্যোধনেরা দ্রৌপদীকে কিন্তু সবার সামনে আর অপমান করার সাহস দেখাননি। কর্ণ দুঃশাসনকে প্রায় কানে কানে বলেছেন—ঝি-টাকে ঘরে নিয়ে যাও দুঃশাসন—কৃষ্ণাং দাসীং গৃহান্ নয়।
দুঃশাসন আবারও দ্রৌপদীকে টানাটানি আরম্ভ করলে, দ্রৌপদী এবার নিজেই বাধা দিয়েছেন। প্রশ্ন করেছেন কুরুসভার বৃদ্ধ মন্ত্রীদের। যুধিষ্ঠির নিজেকে হেরে গিয়েও তাঁকে বাজি রাখতে পারেন কি না—এই প্রশ্নের বৈধতা নিয়ে দ্রৌপদী কুরুসভার বিশাল কক্ষকে উত্তাল করে দিয়েছেন। মহামতি ভীষ্ম প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে নিজের ঝামেলা ছেড়ে দিয়েছেন যুধিষ্ঠিরের ওপর।
ভীষ্মের এই দ্বৈধভাবের সুযোগ নিয়েছেন দুর্যোধন। তিনি বলেছেন—হ্যাঁ, বলুন না যুধিষ্ঠির, বলুন তিনি। শুধু যুধিষ্ঠির কেন, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব—দ্রৌপদীর সব স্বামীরাই বলুন—আমরা যুধিষ্ঠিরের রাখা পণেই তাঁকে জিতেছি কিনা? দুর্যোধন খুব ভালভাবেই জানতেন—যুধিষ্ঠির তাঁর ধর্মত্যাগ করে মিথ্যাভাষী হবেন না। এমনকী ভীম-অর্জুনরাও যে যুধিষ্ঠিরকে অতিক্রম করে তাঁর অপমান করবেন না, সেটাও দুর্যোধন জানতেন। কিন্তু নীতিগত দিক দিয়ে কথার দাম অথবা এই সত্য ছাড়াও আরও এক মানবিক সত্য যে জীবনের ক্ষেত্রে থেকে যায়—সে কথাটা যুধিষ্ঠির অথবা অর্জুনের মতো লোকেরা না বললেও ভীম সেই কথাটাই ধরে বসলেন।
যুধিষ্ঠিরের পণ অথবা সত্যের ধার দিয়েও ভীম গেলেন না। তাঁর ভাবটা এই—হ্যাঁ, দ্রৌপদীকে হয় বাজিতে হেরেছেন যুধিষ্ঠির, কিন্তু তাই বলে একটি বিবাহিতা রমণীর নারীত্ব নিয়ে সবার সামনে ছিনিমিনি খেলবি তোরা? এখানে সত্য-ফত্য বৃথা, তোরা যেমন লোক, তোদের দরকার শুধু বেদম পেটানি। যুধিষ্ঠির যে সভ্যতায় সত্যরক্ষা করেছেন, সেই সভ্যতার বোধ তোদের থাকলে পাণ্ডবের কুলবধুকে তোরা অন্য মর্যাদায় দেখতিস। ভীমের ভাবটা এই। মনে আছে নিশ্চয়ই, একটু আগেই অর্জুন তাঁর কথার মোচড়ে ভীমের রাগ যুধিষ্ঠিরের ওপর থেকে শত্রুপক্ষের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। ভীম কিন্তু সেই মোচড়েই কথা বলছেন।
দুর্যোধনের কথার উত্তরে কেউ একটি কথাও বললেন না। যুধিষ্ঠির, অর্জুন, সবাই চুপ করে বসে আছেন। কৌরবদের হর্ষ-বৃদ্ধি হচ্ছে। এবার সমস্ত শব্দ থেমে গেলে ভীম উঠে দাঁড়ালেন। উঁচু করে ধরলেন তাঁর চন্দন-চর্চিত দীর্ঘ বাহু-আদিম দণ্ডের প্রতীক। বললেন—ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আমাদের গুরুর মতো। তিনি যদি পাণ্ডবকুলের প্রভু না হতেন, তাহলে আজ এই অপমান আমরা কোনওভাবেই সহ্য করতাম না—ন প্রভুঃ স্যাৎ কুলস্যাস্য ন বয়ং মর্ষয়েমহি। ভীম আরও বললেন—ধর্মরাজ যদি নিজেকে পরাজিত মনে করেন, তবে নিশ্চয় আমরাও পরাজিতই বটে। তবে হ্যাঁ, আমার যদি কোনও প্রভুত্ব থাকত, তাহলে দ্রৌপদীর চুলে হাত দিয়ে এখনও কোনও ব্যাটা বেঁচে থাকত না এখানে—ন হি মুচ্যেত স জীবন্ পদা ভূমিম্ উপস্পৃশন্।
এই যে নিরুপায় এক অবস্থা—যে অবস্থায় আইন বা নীতিগতভাবে কিছু করা যাচ্ছে না, অথচ অন্যায়টা রুখতে হবে—এ অবস্থায় ভয় দেখানোটাই সব চেয়ে বড় নীতি। ভীম দুটো কথা বলেছেন খুব বুদ্ধি করে। এক, ধর্মরাজ যদি নিজেকে পরাজিত মনে করেন, অর্থাৎ ভীম আশা করছেন—যদি একবারও যুধিষ্ঠির বলতেন—এটা কি কোনও পাশা-খেলা হল? তোমরা বলেছিলে—সুহৃদ্-দ্যুত অর্থাৎ আপোসে মজায় খেলা হবে। তা এ তো দেখছি চরম কপটতা। এমনকী জোর করে আমাকে দিয়ে বাজি রাখিয়েছ?—এসব কথা যদি একবারও বলতেন যুধিষ্ঠির, তাহলে আর ভীমকে আটকায় কে? দুই, ভীম বলেছেন—‘যদি আমার প্রভুত্ব থাকত’ অর্থাৎ এর মধ্যে অর্জুনের সেই মোচড়টাও রয়েছে অর্থাৎ আমি ধর্মরাজকে অতিক্রম করছি না। আবার চরম ভয় দেখাতেও ছাড়ছি না।
নিরুপায় অবস্থায় একটা ‘কন্ডিশন’ দিয়ে ভয় দেখানোটা একটা ‘আর্টে’র মধ্যে পড়ে। আমি একজনকে বলতে শুনেছিলাম—নেহাত আপনি বলে ছেড়ে দিলাম। অন্য কেউ এ কাজ করলে আমি তাকে শুয়োরের বাচ্চা বলতাম। ভীমের কায়দাও প্রায় এই রকম। ভীম বলছেন—আমি ধর্মরাজকে অতিক্রম করছি না বটে, তবে এই হাত দুটো শুধু দেখে রাখ। মুগুর দেখেছিস তো, এও তাই—পশ্যধ্বং বিপুলো বৃত্তেী ভুজৌ মে পরিঘাবিব। এই হাত দুটোর মাঝখানে পড়লে দেবরাজ ইন্দ্রের বাবারও ক্ষমতা নেই যে, বেরিয়ে যাবে। যুধিষ্ঠির একবার চোখের পলকে ইঙ্গিত করুন আমাকে, আমি ধৃতরাষ্ট্রের এই বদমাশ ছেলেগুলোকে শুধু এই হাতের থাবড়া মেরে পিষে দেব—ধার্তরাষ্ট্রান্ ইমান্ পাপান্ নিস্পিষেয়ং তলাসিভিঃ।
এই ভয় দেখানোর ফল কতটা হয়েছিল, পরে বলছি। যুধিষ্ঠির যেহেতু চুপ করেই থাকলেন, তাই কর্ণ-দুর্যোধনদের কথার মাত্রা যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই একটু চড়ে গেল। দুর্যোধন তো অতিরসে নিজের ঊরুটাই দ্রৌপদীকে দেখিয়ে কদর্য ইঙ্গিত করলেন। আর যায় কোথা? ভীমের চোখ দিয়ে আগুন ঝরতে লাগল। গলার জোরে সভা কাঁপিয়ে ভীম বললেন—শুনে রাখুন রাজারা সব। যুদ্ধ যেদিন লাগবে, সেদিন ওই ঊরু যদি আমি গদার বাড়িতে ভেঙে গুঁড়িয়ে না দিই তবে আমি বাপ-ঠাকুরদার বংশে জন্মাইনি।
ভীমের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে কুরুসভার মধ্যে ভয়ের বাতাস ঢুকে গেল। মহামতি বিদুর চেঁচিয়ে বললেন—বড় ভয়ের কথা, রাজারা সব। ভীম যা বললেন, বড়ই ভয়ের কারণ ঘটল তাতে—পরং ভয়ং পশ্যত ভীমসেনাৎ। ভাল করে বুঝুন সবাই। ভয়ঙ্কর দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে কুরুদের মাথার ওপর। বিদুর কৌরবদের উদ্দেশে বললেন—এ তো পাশা নয়, অতি-পাশার ফল—অতিদ্যূতং কৃতমিদং ধার্তরাষ্ট্রা—তোমাদের সব যাবে। তোমরা আজ রাজসভার মাঝখানে স্ত্রীলোক নিয়ে কামড়া-কামড়ি আরম্ভ করেছ, তোমাদের সব যাবে—যস্মাৎ স্ত্রিয়ং বিবদধ্বং সভায়াম্।
বিদুরের এই আক্ষেপ-ভাষণের পর কুরুসভায় নানা অমঙ্গলের চিহ্ন দেখা গেল। শেয়ালের ডাক, গাধার ডাক—এইসব দুর্নিমিত্তের ছবি এঁকে মহাভারতের কবি সেকালের বিশ্বাসকে সাহিত্যে প্রতিফলিত করলেও আমরা বেশ জানি—মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র গাধা-শেয়ালের ডাকের থেকেও ভীমের ডাকের মূল্য দিয়েছেন বেশি। ধৃতরাষ্ট্র নিজে ভীমকে ভয় পেতেন এবং আজ যখন পরম ক্রোধাবেশে ভীম চরম দুটি প্রতিজ্ঞা করে ফেললেন অপিচ বিদূরও যখন ভীমের ভয় দেখালেন, তখন কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রকে একেবারে ‘অ্যাব্রাপ্টলি’ দ্রৌপদীকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। নিজে যেচে বর দিয়ে দ্রৌপদীকে অথবা পাণ্ডবদের মুক্ত করে দিয়েও তাঁর ভয় যায়নি, তিনি আরও বর দিতে চেয়েছেন, যাতে পাণ্ডবদের বিশেষত ভীমের গভীর অসন্তোষ দূরীভূত হয়।
ভীমের অসন্তোষ দূর হয়নি। অন্তরের অন্তরে তাঁর প্রিয়া পত্নীর অপমানের জ্বালা তুষের মতো জ্বলতে লাগল—খিদত্যেষ মহাবাহুরন্তর্দাহেন বীর্যবান্। অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্র কুরুসভার উত্তাপ বুঝে সাময়িকভাবে পাণ্ডবদের মুক্তি দিলেও ছেলের চাপে যুধিষ্ঠিরকে আবার পাশা খেলতে বাধ্য করেছেন। অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে ধৃতরাষ্ট্র আবারও শকুনিকে ব্যবহার করেছেন এবং বারো বচ্ছরের বনবাস আর এক বছরের অজ্ঞাত বাসের পণ চাপিয়ে দিয়েছেন পাণ্ডবদের ওপর। নিশ্চুপে এই সমস্ত ঘটনা ঘটে যায়নি। ধৃতরাষ্ট্র প্রথমবার পাণ্ডবদের মুক্তি দেওয়ার পর কর্ণের সঙ্গে ভীমের কথা কাটাকাটি হয়। কারণ ভীম উত্তর না দিয়ে থাকেন না। থাকতে পারেন না। যখন পাণ্ডবরা মৃগচর্ম পরে বনবাসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, তখন আবার দুঃশাসনের সঙ্গে ভীমের গরম গরম উতোর-চাপান আরম্ভ হল।
দুঃশাসন অত্যন্ত অভদ্রভাবে পাণ্ডবদের নীচতা এবং দারিদ্র ঘোষণা করে দ্রৌপদীকে সুপরামর্শ দিয়েছেন কৌরবদের কাউকে স্বামিত্বে বরণ করার জন্য। অন্য কেউ এ কথার উত্তর দেননি। কিন্তু ভীম এসব কথা সহ্য করতে পারেন না। তিনি বলেছেন—আজকে শকুনির কপট-বিদ্যায় পাশায় জিতে আমার মর্মছেড়া কথাগুলি বলতে তোর মুখে বাধল না। কিন্তু যেদিন যুদ্ধে তোর মর্ম ছিড়ে দেব আক্ষরিক অর্থে, সেদিন তোকে এই কথাগুলিই স্মরণ করিয়ে দেব—তথা স্মারয়িতা তে’হং কৃন্তমর্মাণি সংযুগে। সেদিন যারা তোকে বাঁচাতে আসবে, তাদের সবার সঙ্গে আমি তোর বাস করার জায়গা বানিয়ে দেব যমের বাড়িতে।
দুঃশাসন থামেননি। তাঁর ভাব—পরাজিত ব্যক্তির মুখে কথা সাজে না কোনও। দুঃশাসন কুরুসভার মধ্যে ভীমকে ‘গরু গরু’ বলে ডাকতে লাগলেন। স্বয়ং দুর্যোধন ভীমের হাঁটা-চলা নকল করে ভাইদের মধ্যে নতুন হাস্যরসের অবতারণা করলেন। বস্তুত ভীম যেহেতু অতি সরল, তাই তাঁর কথাবার্তার মধ্যে তিনি নিজেকে প্রকাশ করে ফেলতেন। এটা বুদ্ধির অভাব যতটা, অভ্যাস তার থেকে বেশি। কর্ণের সঙ্গে যখন ভীমের কথা কাটাকাটি হয়, তখন অর্জুন পই-পই করে ভীমকে বলেছিলেন—দাদা, নীচ লোকের সঙ্গে কথা বোলো না, নোংরা কথার উত্তর দিয়ো না। আমরা যা করব বা যা আমাদের করা উচিত, তা আমরা করেই দেখাব এবং আমরা জানি কী করতে হবে—ইতশ্চতুর্দশে বর্ষে দ্রষ্টারো যদ্ ভবিষ্যতি।
কিন্তু ভীম থাকতে পারেননি। কথায় কথা বেড়েছে। দুঃশাসনরা তাঁকে যা-তা অপমান করার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর শরীর বিশাল বলে তাঁর চলাফেরার ভঙ্গি অনুকরণ করে দুর্যোধন ভীমকে চরম অপমান করলেন। দুঃশাসন তাঁকে নেচে নেচে চেঁচিয়ে ডাকলেন ‘গরু-গরু’ বলে। অথচ সেইমুহূর্তে মারামারি করার মতো যথেষ্ট কারণও ছিল না, যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি। ফলত ভীম শুধু একই কথা বারবার বলে যেতে লাগলেন—লাগুক যুদ্ধ। দুঃশাসনের রক্ত যদি না খাই, দুর্যোধনের ঊরু যদি না ভাঙি, তো আমার নাম ভীম নয়। দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনি, কর্ণ—এই দুষ্ট-চতুষ্টয়কে যুদ্ধক্ষেত্রে কে মারবেন, কীভাবে মারবেন—তার একটা ছক শুনিয়ে দিয়ে ভীম শুধু বিশাল, পেশিবহুল, দর্পিত হাত দুটি দেখাতে দেখাতে বনের পথে চললেন। ইঙ্গিত করে গেলেন—তেরো বছরের শেষে যে মহাযুদ্ধ লাগবে, সেদিন শুধু এই হাতের খেলা দেখবি। প্রতিজ্ঞা করে গেলেন—দুর্যোধন। তোকে যেদিন গদার বাড়িতে মাটিতে ফেলে আমার পায়ের তলা দিয়ে ঘষব তোর মাথা, সেদিন তোর এত কথা আর নাচন-কোঁদন কোথায় থাকে, দেখব?
ভীমের এত প্রতিজ্ঞা—যে প্রতিজ্ঞাগুলিকে তাঁর নিরুপায় মুহূর্তগুলিতে অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষা বলে মনে হতে পারে—কিন্তু এই প্রতিজ্ঞাগুলিই তাঁর বনবাসের বহমান কালটুকুকে সহনীয় করে তুলেছিল।