৫
অকারণে পাণ্ডব-মধ্যমকে বিষ দিলেন দুর্যোধন। ভীম রক্ষা পেলেন। জতুগৃহে পুরোচনের সুব্যবস্থায় সমস্ত পাণ্ডবদের মেরে ফেলতে চাইলেন দুর্যোধন। পাণ্ডবরা সেই বিপদ থেকেও উদ্ধার পেলেন প্রধানত ভীমের ক্ষিপ্রতা এবং শক্তির কারণে। যুধিষ্ঠির অন্তত কুন্তীর কাছে এই কথা বলেছেন। বলেছেন—যার জন্য আমরা জতুগৃহের আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছি, যার জন্য পুরোচন মারা পড়েছে—যস্য বীরস্য বীর্ষেন মুক্তা জতুগৃহাদ্বয়ম্—সেই ভীমকে তুমি বক-রাক্ষসের কাছে পাঠিয়ো না। বস্তুত মা-ভাইদের সুরঙ্গ-পথে পাঠিয়ে দিয়ে পুরোচনের ঘরে আগুন দেওয়া, অন্য সব ঘরগুলিতে আগুন লাগানো এবং পরিশেষে অগ্নিত্রস্ত থমকে যাওয়া পাণ্ডবদের বাইরে বয়ে নিয়ে যাওয়া—এ সবই তো ভীমের কাজ।
এর মধ্যে হিড়িম্ব-বকের মতো কুখ্যাত শক্তিশালী বীরদের ধ্বংস করে ভীম তাঁর অমানুষিক শক্তির জন্য বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। এই সমস্ত খবর এক-এক করে দুর্যোধনের কানে পৌঁছেছিল। ভীমকে জন্ম থেকেই তিনি তাঁর উচ্চাশার একমাত্র অন্তরায় মনে করতেন এবং এখন দ্রৌপদীর সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবের বিয়ের খবর যখন হস্তিনায় এসে পৌঁছল, তখনও পাণ্ডবদের ওপর তাঁর যত না রাগ হল, তার থেকেও বেশি রাগ হল ভীমের ওপর। দ্রৌপদীর বিয়ের পর কুরুসভায় পাণ্ডবদের নিয়ে যে জল্পনা-কল্পনা আরম্ভ হল, তাতে দুর্যোধনের অনেক চিন্তা-ভাবনার মধ্যে ভীমের চিন্তাই ছিল সবচেয়ে আশঙ্কাময়। ভীমের সম্বন্ধে দুর্যোধনের এই আশঙ্কা পিতা ধৃতরাষ্ট্র, পরম্পরাসূত্রে পাওয়া।
ছোটবেলায় যখন থেকে তাঁর প্রিয় পুত্রগুলি ভীমের হাতে ক্রীড়াচ্ছলে পর্যুদস্ত হত, তখন থেকেই মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ভীমকে দেখতে পারতেন না। ভবিষ্যতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যখন প্রায় লাগ-লাগ, তখনও ভীমের চিন্তাই ধৃতরাষ্ট্রকে চিন্তিত করেছে। শেষে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শান্ত হওয়ার পরেও শুধু ভীমকে মেরে ফেলার জন্য এই অন্ধ পিতা লৌহ-ভীম গুঁড়ো করে ফেলেছিলেন। ভীমের প্রতি ধৃতরাষ্ট্রের এই হিংসাই রূপ ধারণ করেছে দুর্যোধনের মধ্যে।
যে দ্রৌপদীকে বিয়ে করার জন্য দূর্যোধন কর্ণকে সঙ্গে নিয়ে সদলবলে পাঞ্চাল-সভায় গিয়েছিলেন, সেই দ্রৌপদীকে তো পাওয়াই হল না, উপরন্তু তিনি শুনলেন—বারণাবতের আগুন থেকে পাণ্ডবরা বেঁচেছেন এবং দ্রৌপদী মালা দিয়েছেন তাঁদেরই গলায়। সেদিন কুরুসভায় মিটিংয়ের পর মিটিং চলল। পাণ্ডবদের মধ্যে কী করে ভাঙন ধরানো যায়, এই নিয়ে দুঃশাসন, কর্ণ, শকুনির সঙ্গে দুর্যোধনের একান্ত আলোচনা চলল। দুর্যোধনের প্রস্তাব-গুচ্ছের মধ্যে চর লাগিয়ে পাণ্ডবদের ওপর দ্রৌপদীর মন বিষিয়ে দেওয়া থেকে আরম্ভ করে সুন্দরী বেশ্যা পাঠিয়ে প্রত্যেক পাণ্ডবকে প্রলুব্ধ করার প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু এই সবগুলি প্রস্তাবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ছিল—ভীমকে কোনওরকমে মেরে ফেলা। দুর্যোধন বলেছিলেন—পেশাদার খুনেরা গুম খুন করুক ভীমকে। কেন না পাণ্ডবদের সবার মধ্যে ওই ওটার শক্তিই সবচেয়ে বেশি, পালের গোদা—স হি তেষাং বলাধিকঃ।
রাগের মুখে দুর্যোধনের মুখে অনেক সত্যি কথা বেরিয়েছে। ভীমের সম্বন্ধে যা তিনি ভাবেন, অথচ মুখে বলেন না ; নিজের অহঙ্কারে যাকে তিনি প্রায়ই তুচ্ছ করেন, অন্তত মৌখিকভাবে যাঁকে তিনি লঘু করেন, সেই ভীমের সম্বন্ধে দুর্যোধন এই মুহূর্তে অনেক মনের কথা বলে ফেলেছেন। দুর্যোধন বলেছেন—এই যে যুধিষ্ঠির এতকাল আমাদের গ্রাহ্যির মধ্যে আনেনি, তার কারণও ওই ভীম—তমাশ্ৰিত্য হি কৌন্তেয়ঃ পুরা চাস্মান্ ন মন্যতে। আরও একটা কথা। আসলে ওই ভীমটাকে যদি মেরে ফেলা যায়, তবে পাণ্ডবরা সবাই এতটাই নিরুৎসাহ এবং নিস্তেজ হয়ে যাবে যে, ওরা আর আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ-টুদ্ধর মধ্যে যাবেই না। কারণ ভীমই ওদের প্রধান অবলম্বন—স হি তেষাং ব্যপাশ্রয়ঃ।
ভীমের সম্বন্ধে কথা বলতে গিয়ে দুর্যোধন অর্জুনেরও মুল্যায়ন করে ফেলেছেন। দুর্যোধনের কাছে ভীমের গুরুত্ব এতটাই যে, ভীম ছাড়া অর্জুন কোনও ‘ফ্যাক্টর’ই নন। তিনি বলেছেন—ভীম যদি পেছনে থাকে তবে অর্জুনকেও যুদ্ধে জয় করা মুশকিল। আর ভীম ছাড়া অর্জুন আমাদের কর্ণের নখের যুগ্যিও নয়—রাবেয়স্য ন পাদভাক্।
দুর্যোধনের কথাটাও সেই মাদাম বিয়ার্দোর কাছাকাছি এসে যাচ্ছে। দুর্যোধন নিজে যেহেতু অপরিশীলিত ক্ষাত্রশক্তির প্রতিরূপ, অতএব তাঁর বিশ্বাসটাও তাঁর স্বরূপেরই প্রতিফলন। শুদ্ধ এবং মহান ক্ষাত্রশক্তির প্রতীক অর্জুনকে তিনি ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন না। অর্জুনের থেকেও ভীমের শক্তিতে তাঁর বিশ্বাস বেশি। তাঁর মতে—ভীমকে কোনওমতে মেরে ফেলা সম্ভব হলে পাণ্ডবদের কারও ট্যাঁফোঁ করার শক্তি হবে না—ন যতিষ্যন্তি দুর্বলাঃ।
আমাদের দৃষ্টিতে দুর্যোধনের কথার মধ্যে তাঁর নিজের বুঝটুকুই হয়তো প্রতিফলিত হয়েছে, হয়তো ভীমের সম্বন্ধে ধৃতরাষ্ট্রেরও এই বোধই ছিল, কিন্তু যাই হোক দুর্যোধনের কথামতো ভীমকে গুম খুন বা অন্য কিছু করা হয়নি। কুরুসভায় ভীষ্ম, দ্রোণ এবং বিদুরের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের হস্তক্ষেপে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে পাণ্ডবদের উত্তরাধিকার সমস্যা মেটাতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি পাণ্ডবদের রাজ্যাংশ দিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে পাঠিয়ে দিলেন। তবে এই দেওয়ার পেছনে তাঁর বদান্যতা ছিল না বিন্দুমাত্র। যা ছিল, তা হল ভীম এবং অর্জুনের শক্তির অপ্রতিরোধ্যতা এবং ভীতি।
আমরা ইন্দ্রপ্রস্থের প্রতিষ্ঠা এবং যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞের বিস্তারিত বিবরণে যাচ্ছি না। কিন্তু রাজসূয়ের আগে যুধিষ্ঠিরের সমস্ত দুর্ভাবনা দূর করার ব্যাপারেও ভীম যে কতখানি সহায় হয়েছিলেন সেটা না বললে অন্যায় হবে। মুনি-ঋষিদের প্রস্তাবে নেচে উঠে যুধিষ্ঠির যখন রাজসূয়যজ্ঞ করবেন বলে ভাবলেন, সেই সময় মহামতি কৃষ্ণ তাঁকে জরাসন্ধের কথা বলে ভয় দেখালেন। মগধরাজ জরাসন্ধ তখন সমগ্র পূর্বাঞ্চলের একচ্ছত্র সম্রাট। ভারতের অন্যত্রও তখনও এমন কোনও রাজা ছিলেন না, যিনি জরাসন্ধকে ভয় না পেতেন বা সমীহ না করতেন। ধান-মাড়াইয়ের জন্য পোঁতা মধ্যদণ্ডটিকে ঘিরে যেমন গরুগুলি চারদিকে ঘোরে, সেকালের ভারতীয় রাজমণ্ডলে জরাসন্ধ ছিলেন সেই মধ্য-স্তম্ভটির মতো। সমস্ত রাজমণ্ডল তাঁকেই কেন্দ্র করে আপন ক্রিয়াকলাপ চালাত। স্বয়ং কৃষ্ণ পর্যন্ত তাঁর ভয়ে আত্মীয়স্বজন নিয়ে সমুদ্রের মধ্যবর্তী দ্বারকাপুরীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
কৃষ্ণের কাছে জরাসন্ধের বিস্তৃত বিবরণ শুনে যুধিষ্ঠিরের সমস্ত উৎসাহ প্রায় চলে যায় আর কি। তিনি বললেন—তুমি যেমনটি বলছ কৃষ্ণ তাতে বুঝি আর রাজসূয়যজ্ঞ করা হল না। এত ঝামেলার চেয়ে আমার কাছে বাপু শান্তির মূল্য অনেক বেশি, আর শান্তি পেলেই আমার মঙ্গল—শমমেব পরং মন্যে শমাৎ ক্ষেমৎ পরং মম। যুধিষ্ঠির যখন জরাসন্ধের ব্যাপারে প্রায় হাত গুটিয়ে নিলেন, তখন যে মানুষটি প্রথম তাঁকে চাঙ্গা করে তুললেন, তিনি কিন্তু ভীম। অন্য একজনের শক্তিমত্তার প্রশংসা, তাও আবার সেই শক্তিমত্তা দাদা যুধিষ্ঠিরের আকাঙ্ক্ষাকে পীড়িত করছে, সে শক্তিমত্তা কৃষ্ণকে দ্বারকায় তাড়িয়ে নিয়ে গেছে—অতএব এই শক্তির প্রশংসা ভীম চুপ করে বসে শুনবেন না।
তবে হ্যাঁ, অন্য ক্ষেত্রে তিনি একা যে যুদ্ধের দায়িত্ব নিতেন, এখানে সেই, দ্রুত প্রতিক্রিয়া তাঁর হল না। কৃষ্ণের মুখে জরাসন্ধের বিরাট রাজনৈতিক প্রতিপত্তির কথা শুনে তিনি যেমন একদিকে প্রতিপক্ষের শক্তি সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নিয়েছেন, তেমনই অন্যদিকে নিজের সামর্থ্যেও তিনি অবিচল। অর্থাৎ একজনের প্রবল শক্তি আছে বলেই সে অপ্রতিরোধ্য এবং অজেয়—এই ভেবে ভীম কখনই তাঁর আত্মবিশ্বাস হারান না। জরাসন্ধের কথায় যুধিষ্ঠির যখন একটু গুটিয়ে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে ভীম বলেছেন—দাদা! যে রাজা শত্রুর বিরুদ্ধে কোনও চেষ্টা না করেই গুটিয়ে বসে থাকে, তাকে দেখতে লাগে ঠিক একটা উইয়ের ঢিবির মতো। এতই পলকা, এতই শক্তিহীন অথচ একজন রাজার প্রতিরূপে রাজার আকারে সে দাঁড়িয়ে থাকে।
কথাটা বলেই হয়তো ভীমের মনে হল যে, জরাসন্ধ, বক রাক্ষস অথবা হিড়িম্ব নন। অর্থাৎ যুধিষ্ঠির যে পিছিয়ে আসছেন তার পেছনেও যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ এ অন্য কেউ নন, ইনি জরাসন্ধ। ভীম সুর পালটিয়ে তর্কের খাতিরে জরাসন্ধকে প্রায় অজেয় ধরে নিয়েই বললেন—দুর্বল লোকও যেভাবে বলবান লোককে পর্যুদস্ত করতে পারে, তার একমাত্র রাস্তা হল কৌশল। নিরলস ভাবে সদা সর্বদা চেষ্টা করে গেলে একটা দুর্বল লোকও কৌশলের মাধ্যমে বলবানকে নাস্তানাবুদ করে দিতে পারে।
বস্তুত কৌশলের কথা ভীমকে মানায় না। কৌশলের ধারও তিনি ধারেন না। তবে তিনি বোক তো নন, অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে তিনি বুঝেছেন যে, জরাসন্ধের মতো প্রবল-প্রতাপ শত্রুকে ধ্বংস করতে গেলে কৌশলের প্রয়োজন। তবে কৌশলের ব্যাপারে যে তাঁর মাথাটা বড় কাজ করে না, সেটা জানাতে ভীমের কোনও লজ্জা নেই। একই সঙ্গে শক্তির প্রয়োজন যেখানে, সেখানে জরাসন্ধের মতো শত্রুর মুখোমুখি হতেও যে তাঁর কোনও ভয় নেই সেটাও তিনি গর্ব করে বলেছেন। বলেছেন—কৌশল! কৌশলের ব্যাপারটা কৃষ্ণের এক্তিয়ার, আমার নয়। তবে আমার আছে শক্তি, সেটাও ফেলনা নয়। আর অর্জুন যে কোনও যুদ্ধকে জয়ে পরিণত করতে পারেন—কৃষ্ণে নয়ো ময়ি বলং জয়ঃ পার্থে ধনঞ্জয়ে। এই কৌশল, শক্তি আর জয়ের সূত্রেই আমরা জরাসন্ধকে বিনাশ করব।
কৃষ্ণ ভীমের কথা মেনে নিয়েছেন। জরাসন্ধের বিরুদ্ধে ভীমকে একটু উসকেও দিয়েছেন। কারণ তিনি জানতেন—সমস্ত কৌশল প্রয়োগ করার পরেই যেটা দরকার হবে, সেটা হচ্ছে অমানুষিক দৈহিক শক্তি, যেটা ভীমের ছিল। কৃষ্ণ বলেছিলেন—ব্যূহ রচনা করে, যুদ্ধযাত্রা করে জরাসন্ধের ধারে কাছে যাওয়া যাবে না। জরাসন্ধকে ধরতে হবে একাকী এবং তাও সবার সামনে নয়। ধরব আমরা তিনজন। কিন্তু জরাসন্ধের আত্মসম্মানের বোধ এতটাই বেশি যে, একক যুদ্ধে আমাদের মতো দোহারা লোকের সঙ্গে সে লড়বেই না। নিজের অপমানের ভয়ে, নিজের যশের লোভে এবং সবচেয়ে বড় কথা—নিজের শক্তি দেখানোর জন্যই সে ভীমকে বেছে নেবে। আর তা হলেই কেল্লা ফতে। কৃষ্ণ বললেন—ভীম একমাত্র লোক যে তাকে যমের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত—নিধনায়ান্তকো যথা।
কৃষ্ণ যা যা বলেছিলেন, তাই তাইই ঘটেছিল, ঠিক অঙ্কের ছকের মতো। চোরা পথে ব্রাহ্মণের বেশ ধরে তাঁরা যখন জরাসন্ধের সম্মুখীন হলেন, তখন যত কৌশলই করা হয়ে থাক, জরাসন্ধ তাঁদের সন্দেহ করেছিলেন। একক যুদ্ধের আহ্বান যখন এল তখন সুযোগ থাকতেও তিনি প্রধান মল্ল ভীমকেই প্রতিপক্ষ হিসেবে পছন্দ করলেন। কারণ হৃষ্ট-পুষ্ট চেহারার ভীমকেই একমাত্র বীর বলে জরাসন্ধের পছন্দ হয়েছিল। ভীম-জরাসন্ধের মল্লযুদ্ধ আরম্ভ হল। মল্লবীর হিসেবে জরাসন্ধের যথেষ্ট সুনাম ছিল। অন্যদিকে হিড়িম্ব বককে শাস্তি দিয়ে ভীমও তখন মল্লপ্রধানদের অন্যতম। মল্লযুদ্ধে প্যাঁচ-পয়জার দু’জনেই যত রকম জানেন, সবই প্রয়োগ করলেন। যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল কবে সেই কার্তিক মাসের প্রথম দিনে। দুই মল্লের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ ; অবিশ্রান্ত যুদ্ধ চলছে—অনাহারং দিবারাত্রম্ অবিশ্রান্তমবর্তত। দুই বীরের শক্তি এবং কুস্তি করার দক্ষতা প্রায় একইরকম দেখা গেল, অন্তত তেরোদিন ধরে। চতুর্দশীর দিনে জরাসন্ধ বেশ খানিকটা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন।
অনেকেই আছেন যাঁরা এই সুযোগে ভীমকে খানিকটা নিরেট বোকা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। রামায়ণ-মহাভারতের বাংলাভাষী কবিরা গল্প কথায় নতুন রূপ দেবার জন্য ভীমকে একজন মোটা-সোটা, মোটা বুদ্ধির শক্তিমান লোক বলে দেখাবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁরা এটা ভুলে যান যে, গায়ে অমানুষী শক্তি থাকলে, যত্রতত্র সেই প্রতিফলন ঘটতেই পারে কিন্তু, তাই বলে গায়ে-গতরে লম্বা-চওড়া হলেই তার বুদ্ধিটাও মোটা হবে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। নতুন গল্পের মোহে এবং ভীমের প্রতিতুলনায় কৃষ্ণকে বেশি চালাক দেখানোর জন্য নতুন কবিরা লিখেছেন—দুই মল্লবীরের সমানে-সমানে যুদ্ধ চলছে এবং ভীম জরাসন্ধের ওপরে কিছুতেই টেক্কা দিতে পারছেন না। এইরকম একটা সময়ে কৃষ্ণ নাকি একটি দুব্বোঘাস তুলে নিয়ে হাত দিয়ে সেই দূর্বাদল দু’ভাগ করে ভীমকে ইশারা করতে লাগলেন। অর্থাৎ জরাসন্ধের জন্মরহস্যে তাঁর দেহের দুই অর্ধাংশ যেভাবে জোড়া দেওয়া হয়েছিল, সেই জোড়া খুলে ফেলার ইঙ্গিত আর কি! কাশীরামের ভাষায়ঃ
যথাশক্তি বৃকোদর করেন প্রহার।
তথাপি না হয় জরাসন্ধের সংহার॥
আশ্চর্য দেখিয়া ভীম বলেন কৃষ্ণেরে।
যথাশক্তি করিলাম প্রহার ইহারে॥
ইহার মরণে আমি, না দেখি উপায়।
এত শুনি ডাকিয়া বলেন যদুরায়॥
পূর্বে সন্ধি কহিয়াছি কেন বিস্মরণ।
সেইরূপে জরাসন্ধ হইবে নিধন॥
বৃকোদরে দেখাইয়া দিলেন শ্রীনাথ।
দুই করে ধরি চিরিলেন বেণীপাত॥
এখানে মনে রাখতে হবে, ব্যাসের মহাভারত ক্ষত্রিয় যুদ্ধবীরের কাহিনী। সেই কাহিনীর অন্যতম নায়কের পূর্বের কথা এত ‘বিস্মরণ’ হয় না যে, ‘বেণীপাত’ চিরে তাঁকে মনে করিয়ে দিতে হবে। কৃষ্ণকে কৌশলী প্রমাণ করার জন্য ভীমকে এত জড় এবং বোকা ভাবার কারণ নেই। হ্যাঁ, বিস্মরণ একবার হয়েছিল। সে দুর্যোধনের বেলায়। তার কারণ পরে বলব। কার্তিক মাসের চতুর্দশ দিনে নিজের অর্ধেক বয়সের একটি ছেলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন জরাসন্ধ। তাঁর হাত আর চলে না, পা চলে না। ক্ষত্রিয়-বীরের যুদ্ধনীতিতে একটি ক্লান্ত বা অত্যন্ত আহত প্রতিপক্ষকে আঘাত করা খুবই অনৈতিক বলে গণ্য হত। হয়তো সেই কারণে ভীম জরাসন্ধকে একটু-আধটু ছেড়ে দিচ্ছিলেন। তাঁকে হয়তো অতটা আঘাত করছিলেন না, যতটা ভীম পারেন।
মহাভারতে দেখছি—ঠিক এই সময়ে সুচতুর কৃষ্ণ ভীমকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন—ওরকম করে মেরো না, ভাই। শত্রু ক্লান্ত হলে তাকে অমন করে মারতে নেই। কেন না জানই তো—এই অবস্থায় এত মার দিলে শত্রু যে প্রাণে মারা যাবে—জহ্যাজ্ জীবিতমাত্মনঃ। অতএব তুমি ভাই অমন করে মেরো না—তস্মাত্তে নৈব কৌন্তেয় পীড়নীয়ো জনাধিপঃ। তুমি বরং ওঁর সমানে সমানে হাতাহাতি করে যুদ্ধটা চালিয়ে যাও।
কৃষ্ণের এই সম্পূর্ণ কথাগুলির মধ্যে ব্যঞ্জনাটা ঠিক উলটো। অর্থাৎ শত্রু ক্লান্ত হয়ে গেছে। ঠিক এই অবস্থায় তোমার যত শক্তি আছে কাজে লাগিয়ে জরাসন্ধকে মেরে ফ্যালো। কৃষ্ণের ইঙ্গিত বুঝতে ভীমের এক মুহূর্ত দেরি হয়নি। কারণ জরাসন্ধের সঙ্গে লড়াইয়ে তিনি অনেক এগিয়ে ছিলেন এবং শত্রুর করুণ অবস্থা দেখে তাঁর হয়তো মায়াও লাগছিল। কিন্তু কৃষ্ণের কথায় এবার তিনি দ্বিগুণ বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লেন জরাসন্ধের ওপর। শক্তি প্রদর্শনের তুঙ্গ মুহূর্তে জরাসন্ধকে তিনি হাতে তুলে মাথার ওপর দিয়ে বাঁই বাঁই করে ঘোরাতে আরম্ভ করলেন—উৎক্ষিপ্য ভ্ৰাময়ামাস বলবন্তং মহাবলঃ।
আমরা এই কিছুদিন আগেও দারা সিংকে এইসব কাণ্ডকারখানা করতে দেখেছি। ভীম জরাসন্ধকে মাথার উপর ঘুরিয়ে মাটিতে ফেললেন। প্রথমেই তাঁর পিঠের শিরদাঁড়া দিলেন ভেঙে ; তারপর দুই পায়ে ধরে একেবারে মাঝ-বরাবর ফেঁড়ে ফেললেন জরাসন্ধকে। জরাসন্ধের জন্মরহস্য তাঁর স্মরণেই ছিল অতএব যুদ্ধের অন্তিম কল্পে জরাসন্ধের শরীরের সন্ধি-বিচ্ছেদে তাঁর ভুল হয়নি। জরাসন্ধকে মেরে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ভীমের জয়-গর্জন চরমে উঠল। মুষ্টি-যুদ্ধ, ক্যারাটে বা এইরকম দৈহিক যুদ্ধে গর্জন একটি অঙ্গ। অতএব বাচ্চালোগ ফির তালি বাজাও—যুদ্ধজয় করে ভীম এমনই চেঁচাতে লাগলেন যেন হিমালয় ভেঙে পড়ল, যেন বিদীর্ণ হল পৃথিবী।
মল্লযুদ্ধে জরাসন্ধকে জয় করার সঙ্গে সঙ্গে দু’দিক দিয়ে ভীমের মর্যাদা চর্তুগুণ বেড়ে গেল। একদিকে দৈহিক শক্তিতে তিনি অদ্বিতীয় বলে গণ্য হলেন। অন্যদিকে জরাসন্ধকে মারার একটা রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল। সমগ্র ভারতবর্ষ জরাসন্ধের কৃপাপ্রার্থী ছিল। এমনকী তাঁর মধ্যে দুর্যোধনও ছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক গুরুত্বের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ালেন কৃষ্ণ এবং পাণ্ডবেরা। এ সব ব্যাপার নিয়ে আমি ‘মহাভারতের ভারত-যুদ্ধ এবং কৃষ্ণ’ নামের বইটিতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে যেটা বলার, সেটা হল—গোটা পূর্বভারতের শ্রেষ্ঠতম নৃপতি জরাসন্ধকে ভীম বধ করেছিলেন বলেই বোধহয় যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞে ভীমকেই পূর্ব ভারতের অন্য রাজ্যগুলি জয় করতে পাঠানো হয়েছিল। জরাসন্ধ-বিজেতা ভীম—শুধু এই একটি বিশেষণের মধ্যেই যে ‘টেরর্’ তৈরি হয়েছিল, সেটাকে রাজা হিসেবে যুধিষ্ঠির কাজে লাগিয়েছেন।
পূর্বদিক বলতে আমাদের অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্রবর্ধন, আসাম, সুহ্মদেশ—এইসব জায়গাগুলিকে ভীম করদ রাজ্যে পরিণত করলেন। অপিচ এসব দেশ থেকে ধন-রত্ন, জিনিস-পত্র যা পেলেন, সব এনে নিবেদন করলেন যুধিষ্ঠিরের পায়ে। পরম সমারোহে রাজসূয়ের শেষ পর্ব আরম্ভ হল। গণ্য-মান্য সব রাজারা এসেছেন। কিন্তু এইখানেও একটা গণ্ডগোল বেঁধে গেল চেদিরাজ শিশুপালকে নিয়ে। তিনি স্বৰ্গত জরাসন্ধের পুত্রপ্রতিম ছিলেন। রাজসূয়যজ্ঞের সম্মান-অর্ঘ্য যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে নিবেদন করায় শিশুপাল রেগে-মেগে অস্থির হলেন। কৃষ্ণকে এবং তাঁর সঙ্গে পাণ্ডবদেরও তিনি যথেচ্ছ গালাগালি দিতে আরম্ভ করলেন। গালাগালি যখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেল, তখন ভীমকে আরও একবার দেখলাম সেই রুদ্র মূর্তিতে দাঁতে দাঁত ঘষে, পেশী ফুলিয়ে শিশুপালের দিকে ধেয়ে আসতে। আমরা মুহূর্তের মধ্যে আরও একটা দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হই। কারণ ভীম লাফিয়ে এসে শিশুপালকে ধরে ফেলেছিলেন আর কি। কিন্তু ঠিক ওই অবস্থাতেই তাঁকে ধরে ফেলেন কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম। যজ্ঞের শেষ পর্বে তাঁরই বাড়ির একজন, নিমন্ত্রিত অতিথিকে মেরে ফেলবে—এটা হয়তো তিনি চাননি। ভীষ্মের কথায় এবং যুক্তিতে ভীম শান্ত হয়েছেন, তাঁকে অতিক্রমও করেননি—নাতিচক্রাম ভীষ্মস্য।
যুধিষ্ঠিরের এই রাজসূয়যজ্ঞের মধ্যেই কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের বীজ ছিল। সে বীজ রাজনৈতিক দৃষ্টিতে কীভাবে উপ্ত হয়েছিল, সে কথা অন্যত্র বলেছি। কিন্তু ব্যক্তিগত রেষারেষি এবং ঈর্ষার যে কদর্য ভাবনা দুর্যোধনের মনের মধ্যে লুকিয়েছিল, তা নতুন রূপ নিল এই রাজসূয় থেকেই। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় মিটে গেলেও হস্তিনাপুরের যুবরাজ দুর্যোধন আরও কদিন কাটিয়ে গেলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। উদ্দেশ্য খুব সৎ ছিল না। তিনি আগে ইন্দ্রপ্রস্থে আসেননি। কিন্তু রাজসূয়ে এসে দেখলেন—যুধিষ্ঠির তথা পাণ্ডবভাইরা তাঁকে টেক্কা দিয়েছেন। এরকম অসাধারণ রাজপুরী শুধু হস্তিনাপুর কেন, অন্য কোথাওই নেই। ময়দানব কারুকৃত্তম। তাঁরই প্রযত্নে নির্মিত হয়েছে যুধিষ্ঠিরের ইন্দ্রপ্রস্থ। মনের মধ্যে ঈর্ষার আগুনে পুড়তে পুড়তে তিনি ইন্দ্রপ্রস্থের স্ফটিক-স্থাপত্য দেখছিলেন।
ইন্দ্রপ্রস্থে ময়দানব এমনই স্ফটিক-মায়ার ভাস্কর্য তৈরি করেছিলেন যে, দুর্যোধন তার কোনওটাই ঠিক কী, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। যজ্ঞশেষের মন্থর মুহূর্তে কারও কোনও কাজ নেই। পাণ্ডবরাও তাই এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, অকারণে অলস মুহূর্ত কাটাবার জন্য। দুর্যোধন হাঁটতে হাঁটতে স্ফটিকের বিভ্রান্তিতে—যেখানে জল নেই, সেখানে জলের সম্ভবনা করে, কাপড়-চোপড় উঁচু করে জলের মধ্যে নামতে গিয়ে দেখলেন, কিছুই নেই। আবার পূর্বের অভিজ্ঞতায়, যেখানে সত্যিসত্যিই জল আছে সেখানে ভীষণ ‘স্মার্টলি’ পদক্ষেপ করতে গিয়ে দুর্যোধন বিনা প্রস্তুতিতে ধপাস করে জলে পড়ে গেলেন।
পাণ্ডবভাইরা স্বাভাবিকভাবেই দুর্যোধনের গতিবিধি দেখছিলেন। বিশেষত ভীম। যেখানে সেখানে অপ্রস্তুত হওয়া সত্ত্বেও দুর্যোধনের সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা, পাণ্ডবরা দেখছেন জেনেও তাঁদের পাত্তা না দিয়ে একা একা চলা—এগুলি ভীম অনেকক্ষণ থেকেই দেখছিলেন। কিন্তু যে মুহূর্তে দুর্যোধন একেবারে জলেই পড়ে গেলেন, তখন তাঁর এই নাকাল অবস্থা দেখে, ভীম আর হাসি চাপতে পারলেন না। আর ভীমের হাসি তো বুঝতেই পারছেন। যেমন তার আওয়াজ, তেমনই তার দমক। ভীমের দেখাদেখি অন্য পাণ্ডবভাইরাও হাসতে থাকলেন।
ভীমের এই হাসির মধ্যে অপমান করার ব্যঞ্জনা ছিল না কোনও। সব সময় ওস্তাদি-দেখানো যার স্বভাব, সে হঠাৎ এই ধরনের অস্বস্তিতে পড়লে হাসি পাবেই। যাই হোক দুর্যোধন এই হাসির কথা ভোলেননি এবং সাতকাহন করে এই হাসিকে এক চূড়ান্ত গল্পের রূপ দিয়েছেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রর কাছে। এর পেছনে অবশ্য শকুনির বুদ্ধিও কাজ করেছে। আসলে ভীমের হাসির বাহানা দিয়ে দুর্যোধন-শকুনিরা পাণ্ডবদের ঈর্ষনীয় রাজসম্পদ আত্মসাৎ করতে চাইলেন—যার ফল পাশা-খেলা এবং শেষ পর্যন্ত পাণ্ডবদের বনবাস।