ভীম – ৪

ভীমের এই জাগরণ একেবারে ব্যর্থ গেল না। এই একটা রাতের মধ্যে ভীমের জীবনে এমন কতগুলি ঘটনা ঘটে গেল, যাতে বাচ্চাদের আবার তৈরি হতে হবে হাতে তালি বাজানোর জন্য। সঙ্গে অবশ্য যুবকদেরও তৈরি থাকতে হবে—রমণীর মুখে প্রথম শারীরিক আহ্বান ভীমের মতো পুরুষের কাছে কেমন লাগে—সেটা শোনার জন্য।

বনের যে জায়গাটায় কুন্তী আর অন্য পাণ্ডবভাইরা ঘুমিয়ে ছিলেন, তার কাছেই এক শাল গাছে বাস করত এক রাক্ষস। তার নাম হিড়িম্ব।

গল্পটা বাচ্চাদের মনোমত করে লিখতে পারলে বেশ হত। কিন্তু সে উপায় কোথায়? আমাকে এখন বিশ্লেষণ করে বলতে হবে যে, রাক্ষস বলতে আমরা যেমনটি কল্পনায় দেখতে পাই আমাদের মতো বুড়োদের তেমনটি ভাবা মোটেই উচিত নয়। মহাভারতের কবি ভীমের প্রতিতুলনায় সত্যের সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে হিড়িম্বকে একটা রাক্ষসের আকার দিয়েছেন বটে, কিন্তু হিড়িম্বের শারীরিক গঠনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নৃতত্ত্ববিদ্ পণ্ডিতের হাতে পড়লে তাঁরা পরিষ্কার বলে দেবেন—হিড়িম্ব কোন ধরনের মানুষ।

হ্যাঁ, সে বনে বাস করে, তার প্রকৃতিও বন্য এবং নরমাংস খাওয়াও তার অভ্যাস আছে। কিন্তু তার কালো গায়ের রঙ, পিঙ্গল চোখ, দীর্ঘ ঊরুমুল, দীর্ঘ উদর, লালচে চুল-দাড়ি, বিশাল গলা এবং স্কন্ধদেশ, অপিচ কান দুটি পেরেকের মতো আস্তে আস্তে সরু হয়ে গেছে—এই সব লক্ষণ পেলে নৃতাত্ত্বিকরা আর্যেতর কোনও জনগোষ্ঠীর মধ্যেই যে হিড়িম্বকে চিহ্নিত করে দেবেন—সে কথা প্রায় নিঃসন্দেহেই আমি বলতে পারি।

যাই হোক, বিশাল-শরীর সেই তথাকথিত রাক্ষস মানুষের গন্ধ পাওয়া মাত্রই হাত দুটি উঁচু করে মাথার তৈলহীন রুক্ষ চুলগুলি চুলকোতে আরম্ভ করল। তারপর সে তার বোন হিড়িম্বাকে বলল—আহা, কতদিন পর নরমাংসের গন্ধ পেলাম। এই গন্ধেই আমার জিবে জল আসছে—জিঘ্রতঃ প্রসুতা স্নেহাৎ জিহ্বা পর্যেতি মে মুখাৎ। মাংস খাওয়ার আনন্দে রাক্ষস হিড়িম্বাকেই আদেশ দিল—যা, তুইই ওগুলোকে মেরে নিয়ে আয়। ওরা যেখানে শুয়ে আছে সেটা আমাদেরই এলাকা, অতএব কোনও ভয় নেই তোর—অস্মদ্-বিষয়-সুপ্তেভ্যো নৈতেভ্যো ভয়মস্তি তে।

এই যে সভ্য সমাজের বাইরে এই বিশেষ জন-জাতির একটি নির্দিষ্ট এলাকাও আছে—এই খবরটা নৃতাত্ত্বিকের উৎসাহ আরও বৃদ্ধি করবে। যাই হোক, হিড়িম্বের কথায় হিড়িম্বা-বোন চলল পাণ্ডবদের মারতে। চার ভাই আর মা ঘুমোচ্ছেন, জেগে আছেন শুধু ভীমসেন। হিড়িম্বার বড় ভাল লাগল। ওই শালখুঁটির মতো লম্বা, বিশালদেহী পুরুষ, ফরসা রাঙা রাঙা চেহারা, পদ্মের পাপড়ির মতো চোখ—হিড়িম্বা একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল, রাক্ষসের কূলে কলঙ্ক দিয়ে সে এই বলিষ্ঠ মানুষটিকে কামনা করল স্বামীর উপযুক্ততায়—রাক্ষসী কাময়ামাস…ভর্তা যুক্তো ভবেন্মম।

ভীমের সম্বন্ধে রাক্ষসীর এই স্বামী-কল্পনা এক মুহূর্তের মধ্যে তাকে এই সার-সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিল যে, ভাইয়ের প্রতি ভালবাসার থেকেও স্বামীর প্রতি ভালবাসাটা অনেক বেশি তীব্র হয়—পতিস্নেহো’ তিবলবান্ তথা ন ভ্রাতৃসৌহৃদম্। হিড়িম্বা ভাবল—আজ যদি ভাইয়ের কথায় এঁদের মেরে ফেলি তাহলে যতটুকু আনন্দ হবে, তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ হবে যদি এঁরা বেঁচে থাকেন, অর্থাৎ ভীম বেঁচে থাকেন।

আমার ধারণা—ভীমের বিশাল বলিষ্ঠ চেহারা দেখেই হিড়িম্বা বুঝেছিল যে, তার পক্ষে ভাইয়ের আদেশ পালন করা অসম্ভব। তারমধ্যে সে প্রেমেও পড়ে গেল। মহাভারত বলছে—মায়াবিনী রাক্ষসী। সে নানা রূপ ধারণ করতে পারে। হিড়িম্বা তাই সুন্দরী মানুষী রমণীর বেশে ভীমের সামনে এল—কৃত্বা মানুষম্ উত্তমম্। আমি আবারও বলি—হিড়িম্বা মানুষী নয়—এটা আমার কল্পনার বাইরে। তবে কী, নগরের প্রত্যন্ত দেশ বনের মধ্যে যে জন-জাতির বসতি, তারা সাজে না গোজে না, মনুষ্য-সমাজের সভ্য অলঙ্কৃতি তারা ব্যবহার করে না। আমাদের মা-ঠাকুমারা রুক্ষকেশী অব্যবস্থিতবাসা কিশোরী মেয়েটিকে বলতেন—কেমন রাক্ষুসীর মতো চেহারা হয়েছে দেখ না, চুলে তেল নেই, গায়ে ময়লা ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার এই মেয়ে একটু সেজে এলেই তাঁরা বলতেন—এই তো, এবারে ঠিক মানুষের মতো দেখাচ্ছে। এখানেও ওই একই ব্যাপার। আমার ধারণা—ভীমকে দেখে মুগ্ধ হয়েই হিড়িম্বা অনেক সাজল। এতই সাজল যে—যেহেতু সে কোনওদিনই সাজেনি, তাই অনেক সেজে তার ভীষণ লজ্জাই করতে লাগল। সাজগোজের লজ্জায় সে নুয়েই পড়ল—বিলজ্জমানেব নতা দিব্যাভরণভূষিতা।

আর্য গোষ্ঠীর বাইরে যে জনজাতিরা আছেন, তাঁদের মধ্যে সুন্দরীও আছেন অনেক। অসম্ভব সারল্য থাকার ফলে সামান্য অলঙ্করণেই এঁদের লজ্জা হয়, নইলে স্বভাবে এঁরা খুব অপ্রতিভ বা সলজ্জ হন না। মনের কথাও প্রকাশ করেন অকপটে। অনেক সেজেগুজে হিড়িম্বার একটু লজ্জা-লজ্জা ভাব হয়েছিল বটে তবে স্পষ্ট ভাষা-ব্যক্তিতে নিজের মন প্রকাশ করার ব্যাপারে তার কোনও লজ্জা ছিল না। তার কথাবার্তাও যথেষ্ট সভ্য মানুষোচিত।

হিড়িম্বা ভীমকে বলল—পুরুষের মধ্যে পুরুষ আমার! তুমি কে? কোথেকে আসছ তুমি? এত সুন্দর মানুষ—এঁরা সব শুয়ে আছেন এখানে, এঁরাই বা কে? এই যে সুন্দরী মহিলাটি নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন—ইনিই বা কে? তোমরা কি জান না—এখানে হিড়িম্ব রাক্ষস থাকে। সে তোমাদের মেরে মাংস খেতে চায়, আমাকে সেই জন্যেই সে এখানে পাঠিয়েছে। কিন্তু দেবতার মতো সুন্দর তোমার এই চেহারা দেখে অন্য কোনও মানুষকে আর আমার স্বামী হিসেবে পাওয়ার অভিলাষ চলে গেছে। আমার মনের কথা আমি পরিষ্কার জানালাম, এখন তোমার যা মনে হয় কর তোমার জন্য কামনায় আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে, তুমি আমাকে গ্রহণ কর—ভজমানাং ভজস্ব মাম্। আমি এই নরখাদক রাক্ষসের হাত থেকে তোমায় বাঁচাব। তারপর চলে যাব দুর্গম কোনও গিরিগুহায়, যেখানে কেউ আমাদের খুঁজে পাবে—নাৎস্যাবো গিরিদুর্গেষু ভর্ত্তা ভব মমানঘ।

অসীম দাম্পত্য-রস অনুভব করার জন্য হিড়িম্বা সুরম্য আরামস্থলীর কথা চিন্তা করতে পারে না। আপন জনগোষ্ঠীর জ্ঞান-বিচারে পর্বতের দুর্গম স্থানগুলিই তার কাছে যৌবনের বিহারভূমি। আরও বেশি আনন্দের জন্য সে ভীমকে লোভ দেখায়—আমি আকাশচারিণী, অতএব আমি ইচ্ছা করলেই যেখানে সেখানে যেতে পারি-কামতো বিচরামি চ। অতএব তুমি আমার সঙ্গে গেলে অনেক অনেক আনন্দ পাবে—অতুলাম্ আপ্নুহি প্রীতিং তত্র তত্র ময়া সহ।

আসলে হিড়িম্বা যে জনগোষ্ঠীর স্ত্রীলোক তাতে সে যেমন একটি পুরুষ মানুষকে সটান পছন্দ করার মধ্যে কোনও লজ্জা বোধ করে না তেমনই সবার সামনে দিয়ে প্রিয়তম ব্যক্তিকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতেও তার কোনও লজ্জা নেই। আমরা আর্যেতর জনগোষ্ঠীর আরও এক রমণী উলপীকেও একই ভাবে অর্জুনকে মোহিত করতে দেখেছি। কিন্তু পাঁচজন ঘুমন্ত প্রাণীকে রাক্ষসের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে কামনার তৃপ্তি ঘটাবেন—এমন মানুষ ভীম নন। তিনি হিড়িম্বাকে বললেন দ্যাখো হে রাক্ষসী। তোমার ভাইয়ের ভয়ে আমি এই সুখ-শায়িত মা-ভাইদের নিদ্রার ব্যাঘাত করব না। আর ওই রাক্ষসের এমন ক্ষমতা হবে না যে, আমার শক্তি সহ্য করতে পারবে।

‘রাক্ষসী’ বলে ডেকেই ভীমের বোধহয় একটু খারাপ লাগল। সম্পূর্ণ আত্মসমর্পিতা এক সুন্দরী রমণীকে ‘রাক্ষসী’ বলে ডাকাটা তাঁর উচিত হয়নি। একটু নরম হয়ে ভীম বললেন—তুমি যাও বা থাক—যা ইচ্ছে কর অথবা তোমার ভাইকেই পাঠিয়ে দাও এখানে—গচ্ছ বা তিষ্ঠ বা ‘ভদ্রে’ যদ্বাপীচ্ছসি তৎ কুরু। ভীম হিড়িম্বাকে পুরো আমল দিলেন না বটে, তবে তাকে ডাকলেন ‘ভদ্রে’ ‘তন্বঙ্গী’ ইত্যাদি সম্বোধনে। কিন্তু ভীম যত ভাল সম্বোধনই করুন, ভীমের বকা খেয়ে হিড়িম্বার সম্বোধন পরিবর্তিত হল অর্থাৎ ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’ হল।

হিড়িম্বা অনেকক্ষণ আসছে না দেখে তার ভাই নরমাংস খাওয়ার লোভে নিজেই হুড়মুড়িয়ে রওনা দিল পাণ্ডবদের দিকে। ভাইয়ের আগমন-শব্দে সচকিত হিড়িম্বা ভীমকে বলল—ওই আসছে হিড়িম্ব। এখন আমি যা বলি শুনুন। আপনি আমার এই নিতম্বদেশে আরোহণ করুন, আমি আপনাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাব। অথবা জাগান আপনার ভাইদের। জাগান মাকে। আপনাদের সবাইকে আমি পিঠে করে নিয়ে যাব।

হিড়িম্বা হয়তো বনের পথঘাট বিশেষভাবে জানত, তাই এমন একটা প্রস্তাব দিয়েছে। ভীম অবশ্য গেলেন না। বরঞ্চ সাদর সম্ভাষণে—একেবারে মহাকাব্যের নায়ক পুরুষেরা অভীপ্সিতা নায়িকাকে যেভাবে সম্ভাষণ করে, সেই—ভিতু মেয়ে কোথাকার, চারুলোচনে—ইত্যাদির পালা শেষ করে কথার মাত্রায় নিজের লিপ্সা এবং নৈকট্য দুইই প্রকট করে ফেললেন। সুন্দরী রমণীর কাছে নিজেকে একটু জাহির করার লোভও সম্বরণ করতে পারলেন না ভীম। বললেন—ওহে বিপুলনিতম্বে—বলতেই পারেন, কারণ স্বয়ং হিড়িম্বাই ভীমকে বলেছিলেন—আপনি আমার নিতম্বদেশে আরোহণ করুন—আরুহেমাং মম শ্রোণিং—অতএব যথেষ্ট সচেতনভাবেই ভীম বললেন—আমার জন্য ভয় কোরো না। আমি থাকতে তোমার ওই রাক্ষস আমাদের কিছুই করতে পারবে না। তোমার সামনেই আমি ওকে মেরে ফেলব।

ভীম এবার এই সরলা রমণীর কাছে নিজের শারীরিক সামর্থ্যের পরিচয় দেওয়ার জন্য একটু ব্যগ্র হয়ে উঠলেন। এই রাক্ষসী রমণীটিকে তাঁর ভাল লাগছে। ভীম বললেন—এই যে আমার হাত দুটো দেখছ, হাতির শুঁড় যেমন লম্বা আর গোল এ-দুটিও তেমনই। এই ঊরু দেখছ? পাথর, পাথর। আর এই বিশাল আমার বুক। অপরিচিতা রমণীর কাছে নিজের এই প্রত্যঙ্গ বর্ণনায় কোনও লজ্জা পাননি ভীম। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখব—পাশাখেলার আসরে দুর্যোধন দ্রৌপদীকে ঊরু দেখিয়ে ভীমের দিক থেকে ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা লাভ করেছিলেন ; কিন্তু এখন এই নবীনা রমণীকে ভীম যে বাহু, ঊরু, বুক সবই দেখাচ্ছেন তার কী? উত্তর একটাই। হিড়িম্ব-বধের সামর্থ্য তাঁর আছে কি না—শুধু এটা দেখানোই ভীমের উদ্দেশ্য। হিড়িম্বার প্রতি রসের কোনও ইঙ্গিত করার কোনও প্রয়োজনই নেই তাঁর, কারণ, হিড়িম্বা মোহিত হয়েই আছে।

ভীমের সাহসে বুঝি আরও মুগ্ধ হল হিড়িম্বা। সসম্ভ্রমে এবং সলজ্জে সে বলল—না, না, আমি আপনাকে একটুও খাটো করছি না। আমার কাছে আপনি দেবতার মতো—নাবমন্যে নরব্যাঘ্র! ত্বামহং দেবরূপিনম্। তবে কী, রাক্ষসদের অমানুষিক শক্তি আমি দেখেছি তো, তাই বলছিলাম আর কি।

হিড়িম্ব রাক্ষস দেখল—সময় অনেকটা চলে গেছে, অথচ হিড়িম্বা ফিরছে না। সে এবার নিজেই রওনা দিল। খানিকটা দূর থেকেই সে তার বোন এবং ভীমের কথাবার্তা শুনতে পেল। আর একটু এগিয়েই সে হিড়িম্বাকে দেখতেও পেল। দেখতে পেল—তার চেহারা ঠিক মানুষের মতো।

এখানে একটা কথা বলার প্রয়োজন বোধ করি। হিড়িম্বাকে নিয়ে পরশুরাম অথবা লীলা মজুমদার অথবা আরও অনেকেই যথেষ্ট রসিকতা করেছেন। সাহিত্যরসের পুষ্টিতে হিড়িম্বার এই সাহায্য আমি ছোট করে দেখছি না কিংবা এই স্বনামধন্য সাহিত্যিকদেরও কোনও ত্রুটি ধরছি না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে হিড়িম্বার চরিত্র আমার কাছে অংশত ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’র মত। হিড়িম্বার একমাত্র দোষ, সে রাক্ষসী বলে পরিচিত।

আবারও বলি-দেবতা আর রাক্ষসে মূলত বেশি ভেদ নেই। ইতিহাস-পুরাণে এঁরা একই বাপের ছেলে, তবে মা আলাদা এই যা। রাক্ষসদের কারও দশটা মাথা, কারও বারোটা হাত, ইয়া দাঁত, ইয়া গোঁফ—এগুলি বর্ণনা মাত্র। ব্যক্তিগত ক্ষমতা এবং ভয়ঙ্কর প্রকৃতি বোঝানোর জন্যই কবিদের এই কল্পনা। কিন্তু এটা ঠিক—রাক্ষসদের সংস্কৃতি, আচার এবং বেশ-বাস দেবতা বা মানুষের থেকে আলাদা এবং তারমধ্যেও একটা ভয়ঙ্কর ভাব আছে। হিড়িম্বা যখনই মানুষের রূপ ধরে ভীমের কাছে এল, তখনই বুঝতে হবে—সে সাধারণ মানুষের রীতিনীতি মেনে, সভ্য মানুষ যেভাবে সাজে, সেইভাবে সেজে এসেছে ভীমের মন ভোলানোর জন্য। রামায়ণেও আমরা শূর্পণখাকে একই ভাবে রামের কাছে সেজে আসতে দেখেছি।

হিড়িম্ব রাক্ষস দেখল—তার বোন হিড়িম্বা মানুষের সাজে সেজেছে। তার মুখখানা চাঁদের মতো সুন্দর দেখাচ্ছে। মাথায় ফুল গুঁজে দারুণ খোঁপা বেঁধেছে। ভুরু, নাক, চোখ—সব কিছুর মধ্যেই একটা সজ্জার স্পর্শ আছে। এমন কী আধুনিক যুবতীদের মতো সে তার গায়ের চামড়াকে কোন যাদুতে আরও নরম করে তুলেছে যেন। নখগুলি পরিষ্কার করে আরও সুন্দর করে তুলেছে—সুভ্রু-নাসাক্ষি-কেশান্তাং সুকুমার-নখত্বচম্। সোনার গয়নার সঙ্গে এমন একখানা কাপড় পরেছে সে, যাতে তার সুন্দর প্রত্যঙ্গ-সংস্থান ভীমের চোখ না এড়ায়—সুসূক্ষ্মাম্বরধারিণীম্। ভীম যে মুগ্ধ হয়েছেন, তা আমরা আগেই টের পেয়েছি, আর হিড়িম্বা তো আগেই মুগ্ধ ছিলেন। তার ভাই পর্যন্ত তাকে ডেকেছে ‘বিপ্রমোহিতা’ বলে—মানে বিশেষ এবং প্রকৃষ্টভাবে মোহিতা।

শুধু তাই নয়, হিড়িম্ব রাক্ষস তার বোনের এই সাভিলাষ পুরুষাভিসার মোটেই পছন্দ করেননি। তার মতে এই ব্যবহার অসতীসুলভ শুধু নয়, এ ব্যবহার তার পূর্বজ রাক্ষস-প্রধানদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিয়েছে—পূর্বেষাং রাক্ষসেন্দ্রাণাং সর্বেষাং অযশস্করি। জানি না—কোন বিশাল কীর্তিশালী রাবণ-বংশ বা বিভীষণ-বংশে এই হিড়িম্বের জন্ম, কিন্তু সুসভ্য নগরের কাছাকাছি বাস করে—কেননা, ভীম জল নিয়ে এসে দেখেছিলেন কাছেই এক নগর-নাতিদূরেণ নগরং বনাদস্মাদ্ধি লক্ষয়ে—হিড়িম্ব যে নাগরিক বৃত্তির অনুকরণে তার বোনকে ‘অসতী, পুরুষকামী’ বলে গালাগালি দিয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ দেখি না।

যাই হোক, হিড়িম্ব ঠিক করল—এই মানুষগুলির সঙ্গে তার অপ্রিয়কারী বোনকেও সে মেরে ফেলবে। কিন্তু ওই অপরিচিতা রমণীর সঙ্গে কতক সময় কথা বলেই ভীমের এত ভাল লেগেছিল, এতটুকু সময়ের মধ্যেই ওই রাক্ষস-রমণীর সম্বন্ধে তাঁর এতটাই অধিকার জন্মেছিল যে, তিনি সক্রোধে হিড়িম্বকে বললেন—তুই আমাকে আগে মার, তারপর তোর বোনকে মারবি। বিশেষত সে তোর অপকার করেনি, করেছি আমি।

আমার ধারণা—হিড়িম্বার বয়স ছিল কম। তাই জীবনের প্রথম পুরুষ সমাগম তাকে রোমাঞ্চিত করেছিল। ভীম বলেছেন—এই বালিকা আমাকে দেখে নিজেকে সংযত করতে পারেনি। মনুষ্যশরীরে অন্তর-চারী ভালবাসার দেবতা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে আমার কাছে—নহীয়ং স্ববশা বালা কাময়ত্যদ্য মামিহ। আমার চেহারা দেখে ও মুগ্ধ হয়েছে, ও আমাকে চায়—তাতে ওর অপরাধ কী? অন্যায় যদি কেউ করে থাকে তবে সে সেই ভালবাসার দেবতা অনঙ্গ, তুই ওকে বকছিস কেন—অনঙ্গেন কৃতে দোষে নেমাং গর্হিতুমর্হসি।

কতটা সরল আমাদের এই ভীম। তাঁর এই সরলতার নিরিখে হিড়িম্বার মতো সরলা রমণীই যে তাঁর সবচেয়ে উপযুক্ত স্ত্রী হবেন—এ কথা বলাই বাহুল্য। হিড়িম্বা যেমন স্পষ্ট ভাষায় ভীমের রূপমুগ্ধতা স্বীকার করেছে, ঠিক তেমনই স্পষ্টভাবে ভীমও তাঁর স্বীকারোক্তিতে ‘এলিভেটেড’ বোধ করেছেন। বলেছেন—ও আমার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে আমাকে কামনা করেছে, এতে ওর দোষ কী—কাময়ত্যদ্য মাং ভীরুস্তব নৈষাপরাধ্যতি। ভীম আত্মবোধে সঙ্গে সঙ্গে এই অপরিচিতা রমণীর অধিকারিত্ব অঙ্গীকার করে নিয়ে হিড়িম্ব-রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছেন।

নিজের শক্তির ওপর গভীর বিশ্বাসে এই যুদ্ধটা ভীম এতই সহজে নিয়েছেন যে, যুদ্ধ-প্রক্রিয়া আরম্ভ হওয়ার আগেই ভীম হিড়িম্বকে অন্তত বত্রিশ হাত দূরে টেনে নিয়ে গেলেন। এই আকালিক মুহূর্তেও তাঁর খেয়াল আছে—তাঁর মা-ভাইরা সব পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছেন। মহাভারত বলেছে—ভীম হিড়িম্বকে এমনভাবে টেনে নিয়ে গেলেন, ঠিক যেন বনের মধ্যে একটা সিংহ ধরে নিয়ে গেল হরিণকে।

‘বক্সিং রিং’-এ আমরা দেখেছি—যে বেশি ঘুসি চালাতে পারে না, সেই দুর্বলপক্ষ আত্মরক্ষার জন্য বলবত্তর পক্ষকে চেপে জড়িয়ে ধরে। হিড়িম্বও তাই করল। ভীমকে চেপে ধরে সে চেঁচাতে লাগল। পাণ্ডবভাইরা সব ধড়মড়িয়ে জেগে উঠলেন সেই চেঁচানিতে। জেগে উঠলেন কুন্তীও। সবাই জেগে উঠে সামনে দেখলেন—অপরূপা এক সুন্দরী দাঁড়িয়ে আছে। কুন্তী অবাক হয়ে বললেন—কে গো তুমি—বনদেবতা, না, অপ্সরা? এখানে এই বনের মধ্যে কোথা থেকে এলে তুমি—কুতশ্চাগমনং তব।

হিড়িম্বা নামে রাক্ষসী হলেও এখন কাব্যের ছোঁয়া লেগেছে তার মনে। সে বলল—এই যে নীল মেঘের মতো বিশাল বন দেখছেন—এ হল হিড়িম্ব রাক্ষসের বন, আমিও এইখানেই থাকি। আমি তার বোন। হিড়িম্ব তোমার ছেলেদের মারতে পাঠিয়েছিল আমাকে। কিন্তু সোনার বরণ তোমার বলবান ছেলেটিকে দেখে আমার ভীষণ ভীষণ ভাল লাগে। আমি তোমার ছেলেটিকে আমার স্বামী হিসেবে বরণ করে নিলাম—ততো ময়া বৃতো ভর্ত্তা তব পুত্রো মহাবলঃ।

হিড়িম্বা সব আনুপূর্বিক বলল। বক্তব্য সরল, লজ্জাহীন, ঋজু এবং ভয়ঙ্কর রকমের আত্মবিশ্বাসী। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির রীতিনীতি সে জানে না। তার স্বামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে পাণ্ডব-জননীর মতামতের কোনও মূল্য আছে কি না জানে না। সে বলে—হিড়িম্বর হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি তোমার ছেলেকে হেথা থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে যায়নি। এতক্ষণ হিড়িম্বা কুন্তীকে যে বিবরণ দিচ্ছিল, তাতে বারবার—তোমার ছেলেকে এই বললাম, তোমার ছেলে এই বলল—এইভাবে কথা বলছিল। কিন্তু ঘটনার বিবরণের শেষে ভীমের কথা বলার সময় এবার কুন্তীর পুত্র-পরিচয়ের সঙ্গে নিজের সম্বন্ধটাও সগর্বে যোগ করল। সে বলল—আমার স্বামী অর্থাৎ কিনা তোমার ওই ছেলে এখন ওই রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে—স তেন মম কাস্তেন তব পুত্রেণ ধীমতা। সে এখন নিশ্চিন্ত—তার স্বামীর সঙ্গে তার ভাই পারবে না।

হিড়িম্বার এই অকপট কথাগুলির মধ্যে, ভীমের সম্বন্ধে তার সরল আন্তরিকতার মধ্যে আমি ভারতবর্ষের আদিম জনজাতীয় স্ত্রীলোকের হৃদয়খানি খুঁজে পাই। হিড়িম্বার কথায় আবার পরে আসছি। আপাতত দেখছি—মানুষ রাক্ষসের যুদ্ধের খবর শোনা মাত্র—পাণ্ডবভাইরা ভীমের কাছে ছুটে গেলেন।

ভীম এমন একজন যুদ্ধবীর, যিনি যুদ্ধকালে বড়ই একরোখা এবং একাগ্র। এই সময়ে যে তাঁকে বিরক্ত করে বা একাগ্রতা নষ্ট করে তার ওপরেও তিনি রেগে যান। যুদ্ধের মত্ততা তাঁর এমনই যে, এই সময় তাঁকে থামতে বলাও বড় সাহসের পরিচয়। যুধিষ্ঠির বা অন্য কোনও ভাইই এ সাহস করলেন না। শুধু অর্জুন—অত্যন্ত সুনিপুণভাবে অন্য কথায় ভুলিয়ে যিনি চিরকালই ভীমকে শান্ত করেছেন, সেই অর্জুন ভীমকে বললেন—এই রাক্ষসটার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ কি না, সেটা আমরা সঠিক বুঝতে পারছি না দাদা। আমি কিন্তু প্রস্তুত, দরকার হলে আমিও এটাকে মারতে পারি।

অর্থাৎ অর্জুন ভীমকে বাজিয়ে নিলেন—তিনি ঠিক কী চান অর্জুনের কাছ থেকে। সেকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হলেও দাদা ভীমকে তাঁর একথা বলার সাহস নেই যে, তুমি ওই রাক্ষসকে আমার হাতে ছেড়ে দাও, আমি এক বাণে ওটাকে সাবাড় করে ফেলছি। অর্জুন সবিনয়ে বললেন—আমি আপনার সাহায্যে প্রস্তুত—সাহায্যে’স্মি স্থিতঃ পার্থঃ। ভীম বললেন—তুমি ব্যস্ত হয়ো না, অর্জুন! তুমি নিরপেক্ষভাবে দেখে যাও শুধু—উদাসীনো নিরীক্ষস্ব—অর্থাৎ আমি তোমার দাদা বলে আমার ওপর পক্ষপাতী হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই তোমার। তুমি শুধু দেখে যাও।

হিড়িম্ব তখন ভীমের দুই হাতের মধ্যে এসে গেছে। এই পেশিবহুল পাথরের মতো হাত দুটির ওপর ভীমের নিজেরই অনেক বিশ্বাস আছে। অতএব বাহুবন্দি রাক্ষসকে ভীম এক লহমায় মেরে ফেলতে চান না, তাকে তিনি খেলাতে লাগলেন। এই একবার একটু চাপ দিচ্ছেন, হিড়িম্ব চেঁচিয়ে উঠছে, আবার একটু আলগা করছেন, হিড়িম্ব নিঃশ্বাস নিচ্ছে—এই খেলাটায় ভীম বেশ মজা পাচ্ছেন। ছোট ভাই অর্জুন কিন্তু এসব ব্যাপারে একেবারে ‘প্রোফেশনাল’। যাকে মারতে হবে, তাকে তিনি সময় দিতে চান না। ওদিকে ভীমের সম্মানেও আঘাত দেওয়া চলবে না। অতএব অন্য পন্থায় অর্জুন বললেন—আমাদের যে এখান থেকে যেতে হবে দাদা, বেশি দেরি করলে কি চলে? তুমি বরং একটু তাড়াতাড়ি করো, রাক্ষসটার সঙ্গে আর খেলা কোরো না, মারো ওকে—ত্বরস্ব ভীম মা ক্ৰীড় জহি রক্ষো বিভীষণম্।

ভীম আর দেরি করেননি। সমস্ত শরীরের বল যেন নিজের হাত দুটিতে সংগৃহীত করে কালো কদাকার হিড়িম্বকে মাথার ওপর তুলে ঘোরাতে লাগলেন। বস্তুত এটাও কিন্তু খেলাই ছিল। ভীম নৃশংস স্বভাবের মানুষ, তিনি শত্রুকে তারিয়ে তারিয়ে শেষ করতে চান। কিন্তু পরিশীলিত ক্ষত্রিয় অর্জুন আবার তাঁকে অনুরোধ করেন। এবারে তাঁর ভাষাটা আরও ঋজু, আরও সোজা। অর্জুন বললেন—তোমার কাজ তুমি করেছ দাদা, তুমি পরিশ্রান্ত। এটাকে এবার আমার হাতে ছেড়ে দাও, আমি মারি। ভীম অর্জুনের কথা শুনে রেগে গেলেন। অর্জুন এইটাই চাইছিলেন। অর্জুনের কথা ফুরোবার সঙ্গে সঙ্গে ভীম হিড়িম্বকে মাটিতে ফেলে পশুর মতো মেরে ফেললেন। মারাটা কেমন? মাথাটা দুপায়ের মাঝখানে ঢুকিয়ে কোমর ভেঙে একবারে তালগোল পাকিয়ে তবেই ভীমের নৃশংসতার শান্তি হল।

হিড়িম্ব মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে অর্জুন বললেন—সামনেই শহর। এখানে আর একটুও দেরি নয়। দুর্যোধন যাতে খুঁজে না পায় আমাদের সেই চিন্তা করতে হবে না? পাঁচ ভাই পাণ্ডব আর কুন্তী অর্জুনের কথায় সায় দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পথ চলতে আরম্ভ করলেন। তাঁদের পিছন পিছন চলল হিড়িম্বা—অযাচিতা, অনুল্লিখিত—প্রযযুঃ পুরুষব্যাঘ্রা হিড়িম্বা চৈব রাক্ষসী।

হঠাৎই ভীমের মনটা কেমন ঘুরে গেল। এই একটু আগে যে রাক্ষসী সুন্দরীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভীম একটু সরসই হয়ে উঠেছিলেন, সেই ভীমের মনটা হঠাৎই কেমন ঘুরে গেল। আসলে এইটাই ভীমের স্বভাব। একটা ‘অবসেশন’ রয়ে গেছে। এই যে এতক্ষণ ধরে পরিশ্রম করে, হিড়িম্ব রাক্ষসকে মারতে হয়েছে, সেই মারামারির মধ্যে যে একটা ‘ইনারশিয়া’ তৈরি হয়েছিল, সেইটাই ভীমকে এখনও তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। অতএব যেই তিনি দেখলেন হিড়িম্বা তাঁদের পিছন পিছন চলেছে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন—রাক্ষসেরা অনেক মোহিনী মায়া জানে, তাই ভাইয়ের মতো তোমারও মরাই উচিত।

আমার ধারণা—ভীমের মনে হিড়িম্বার সম্বন্ধে যতটুকু সন্দেহ ছিল, তার চেয়ে লজ্জা ছিল বেশি। এই একটু আগে ভাইদের নিদ্রার অনুকুলতায় যে রমণীর সঙ্গে নির্জন রহস্যালাপ করেছেন, নিজের শারীরশক্তির বিবরণ দিয়েছেন, তারই ভাই পাণ্ডবদের খেতে এসেছিল, তাকে মারতে হয়েছে, অথচ তার ভগিনী বড় ভাল—এ-কথাটা সোজাসুজি বলা ভীমের পক্ষে সম্মানজনক ছিল না। বরঞ্চ লোক-দেখানো বা ভাই-দেখানোভাবে যেই তিনি বলে উঠলেন—তোমারও মরাই উচিত, সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের দিক থেকে তাঁরই অভীপ্সিত বাধাটি এসেছে—রাগের বশে মেয়েদের গায়ে হাত তুলো না। তুমি মহাবল হিড়িম্বকে মেরেছ, তার ভগিনী যদি ক্রুদ্ধাও হয়, তবু সে আমাদের কী করবে?

কথাটা কি ভীমও জানতেন না? জানতেন। জানতেন বলেই অমন একটা অগভীর অসংকল্পিত উক্তি আকাশে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাতেই কাজ হয়েছে। সেই বিশাল বনভূমির মধ্যে হিড়িম্বা স্বয়ং এবার যুধিষ্ঠিরকে নমস্কার করে জননী কুন্তীর উদ্দেশে সুগভীর সরলতায় বলে উঠল—ভালবাসলে মেয়েদের কত কষ্ট হয়, তা আপনি জানেন—আর্যে জানাসি যদ্‌দুঃখমিহ স্ত্রীণামনজঙ্গম্।

প্রাচীনেরা উপরিউক্ত সংস্কৃত পংক্তিটির অর্থ করেছেন—আর্যে! স্ত্রীলোকের কামজনিত যে কী দুঃখ হয়, তাহা আপনি জানেন। যেন কুন্তী এই বেদনার বড় সমঝদার। আমার ধারণা—‘অনঙ্গজ দুঃখ’ অর্থ ‘কামনাজনিত দুঃখ’ না করে ভালবাসার দুঃখই করা উচিত। কেননা, মদনভস্মের পর গভীর রতিবিলাপ-সঙ্গীত আর শিবের আশীর্বাদের মধ্যেই অনঙ্গের পুনর্ভবতার তাৎপর্য। সেটাকে ভালবাসা বলাই ভাল, শারীরিক অভিসন্ধি তার মধ্যে যতটুকুই থাকুক, হয়তো হিড়িম্বার ক্ষেত্রে সেটা বেশিই আছে, তবু সেটা ভালবাসার অঙ্গই বটে। কুন্তীকে দেখে যে ভাবেই হোক, হিড়িম্বার মনে হয়েছে—মেয়েদের চরম অভীপ্সার কথাটি তিনি সহ-অনুভবে বুঝবেন। ভীমসেনকে চেয়ে না পাওয়ার দুঃখ আর কেউ না বুঝুক কুন্তী অন্তত বুঝবেন।

আর সত্যিই তো হিড়িম্বা মিথ্যা কথা কিছু বলেনি। চরম অসবর্ণ বিয়েতে যেভাবে নিজের আত্মীয়-স্বজন, কুলাচার এবং নিজের বন্ধু-বান্ধব ত্যাগ করে মেয়েদের অন্যতর অতি পৃথক এক কুল-ধর্ম এবং কুলাচারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়, হিড়িম্বার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে—ময়া হি উৎসৃজ্য সুহৃদঃ স্বধর্মং স্বজনং তথা—আমি আমার সুহৃদ-বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন ত্যাগ করে তোমার কাছে এসেছি। তাছাড়া ভীমকে প্রথম দেখেই সে এমন প্রেমে পড়েছে যে, কুন্তীকে হিড়িম্বা বলেছে—প্রত্যাখ্যান তাকে মৃত্যুর পথ দেখাবে। রাক্ষসী হলে কি হবে হিড়িম্বা ব্রাহ্মণোচিত ধর্ম সম্বন্ধেও দু-চার কথা শুনিয়ে দিয়েছে তার হবু শাশুড়িকে। বলেছে—বিপদের সময় যে পরের ধর্ম রক্ষা করে, সেই না ধর্ম ব্যাপারটা বোঝে। আমাকে যদি এখন এই ভীম ছাড়া অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মানতে হয় তো পাতকী হব না আমি। এই ধর্মচ্যুত হওয়ার মধ্যেই তো আমার বিপদ।

রাক্ষসীর মুখে এত ধর্মাধর্মের কথা শুনে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের পক্ষে চুপ করে থাকাই কঠিন হল। যুধিষ্ঠির হিড়িম্বাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে এই মিলনোৎসুকা রমণীকে মিলনের সুযোগ দিয়েছেন। অবশ্য এই মিলনের মধ্যে তাঁর একটি শর্ত ছিল। সেটা বোধহয় খানিকটা ভীমের জন্যই। হয়তো যুধিষ্ঠিরের ভয় ছিল—অজ্ঞাতকুলশীলা এই রমণী সরল ভীমকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে ভালবাসার রসে একেবারে মজিয়ে দেয় যদি। হিড়িম্বার আত্মনিবেদনের মধ্যে মানসিক মোহ যত ছিল, শারীরিক তাড়না ছিল তার চেয়ে বেশি। যুধিষ্ঠির তাই হিড়িম্বাকে বলেছেন—দিনের বেলায় তুমি এর সঙ্গে যত ইচ্ছে বিহার করা, মনে যা চায় তাই করো—অহঃসু বিহরানেন যথাকামং মনোজবা—কিন্তু রাতের বেলায় আমাদের ভাইকে তুমি ফিরিয়ে দেবে আমাদের কাছে।

যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে ভীম ভাবলেন ধর্মের নীতি-নির্ধারণে তিনিই বা কম কীসে? ভীম দাদাকে টেক্কা দিয়ে বললেন—সুন্দরী! যতদিন না তোমার ছেলে হবে, ততদিন তোমার বাসনা পূরণ করব আমি। ভীম জানেন—পুত্রজন্মের মধ্যে একটি রমণীর চরম প্রাপ্তি সূচিত হয়। ভোগ-বিলাস এবং শারীরবৃত্তিরও খানিকটা নিবৃত্তি ঘটে পুত্রজন্মের সার্থকতার মধ্যে। অন্তত পুরাতন শাস্ত্রকারেরা সেই রকমই ভাবতেন। ভাইদের দুশ্চিন্তা এবং হিড়িম্বার দ্ব্যর্থহীন মিলন-কামনার মধ্যে সামঞ্জস্য ঘটানোর জন্য ভীমের ব্যবস্থাপত্র ছিল যতখানি শাস্ত্রানুসারী, ততখানিই বাস্তব।

আবার সরলতার প্রশ্ন যদি আসে, সেদিক দিয়েও ভীমকে দেখুন। তিনি একবারও কায়দা করে বললেন না—দাদা যুধিষ্ঠির থাকতে আমার পক্ষে কি এই বিবাহ সম্ভব? তিনি দেখেছেন—হিড়িম্বা শুধু তাঁর ব্যাপারেই উৎসুক, অতএব দ্বিধা না করে তিনি হিড়িম্বার হাত ধরে চলে গেছেন উপযুক্ত বিহারভূমির খোঁজে। বন-জঙ্গল-পাহাড়, সাগর-সরোবর-গুহা এমনকী মুনির আশ্রমও আছে এই তালিকায়—এমনি করে কোনও সুন্দর-নির্জন স্থানই বোধহয় বাদ গেল না, যেখানে হিড়িম্বার সঙ্গে রতি-সুখ-সার অভিসার বাদ পড়ল ভীমের। এই সময়ে ভীমকে দেখে বোঝা যায় না যে রাক্ষসী বলে এই আর্যপুত্রের অসুবিধা হয়েছে কোনও। রাক্ষসী হিড়িম্বা বিচিত্র বেশে বিচিত্র রতি-কৌতুকে ভীমকে একেবারে মোহিত করে রেখেছিল—বিভ্রতী পরমং রূপং রময়ামাস পাণ্ডবম্।

সময়ে ভীম-হিড়িম্বার ছেলে হল। চেহারাটা দেখতে তত সুবিধের নয়, মাতুল হিড়িম্বের আভাসটাই চেহারার মধ্যে বেশি। আর তার নিজের বৈশিষ্ট্য হল—মাথাটা যেন একটা ঘটের মতো, তারমধ্যে আবার চুল নেই, যদি বা থাকে তাও আবার কেমন খাড়া খাড়া। কচ মানে চুল। এই ঘটের মাথায় খাড়া চুলে বাবা-মার কাছে তিনি ঘটোৎকচ নাম পেলেন। মনস্বিনী কুন্তী কিন্তু রাক্ষসীর গর্ভজাত এই উৎকট চেহারার পুত্রটিকেই কুরুবংশের মর্যাদায় সম্মান দিয়েছেন। বলেছেন—তুমি কুরুবংশের ছেলে। আমার কাছে তুমি ভীমেরই মতো—ত্বং কুরূণাং কুলে জাতঃ সাক্ষাদ্ ভীম সমো হ্যসি। পঞ্চপাণ্ডবের তুমিই জ্যেষ্ঠ পুত্র। এই সম্মান যতখানি ঘটোৎকচের ততখানিই ভীমের। বোঝা যায় রাক্ষসী-বিবাহ সত্ত্বেও জননী কুন্তী ভীমের ওপর যথেষ্ট প্রীত ছিলেন।

পাণ্ডবরা তখনও বনেই রয়ে গেছেন। এ-বন সে-বন ঘুরে পাণ্ডবরা এসে পৌঁছলেন একচক্রা নগরে। এখানে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে তাঁদের থাকবার ব্যবস্থা হল। অবশ্য খাবার জোটানোর একমাত্র উপায় ছিল মৃগয়া এবং ভিক্ষা। এতে যা জুটত, তা আবার ভাগ হত দুই ভাগে। এই দুই ভাগের এক ভাগ কুন্তী তাঁর অন্য চার ছেলের সঙ্গে ভাগ করে খেতেন। আর এক ভাগ পুরো ভীমের। যেমন তাঁর চেহারা, তেমনই তাঁর খোরাক। এমন খোরাকি ছিল বলেই হয়তো অমানুষিক দৈহিক শক্তির অধিকারী রাক্ষস-নামধারী অতিবল ব্যক্তিদের সঙ্গে লড়াই করাটা একমাত্র ভীমের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

সেদিনও পাণ্ডবরা সবাই ভিক্ষায় বেরিয়েছেন। দুর্যোধনের নজর এড়ানোর জন্য সকলেই ব্রহ্মচারীর বেশে আছেন। ভীম সেদিন ভিক্ষায় যাননি। জননী কুন্তীর সঙ্গে সেদিন তিনি বাড়িতেই রয়ে গেছেন। হঠাৎই তাঁদের বাড়িওয়ালা ব্রাহ্মণের বাড়ি থেকে কান্নার রোল উঠল। আর্তনাদ এবং বিলাপের যতটুকু শোনা গেল তাতে কুন্তী বুঝলেন ব্রাহ্মণের বিপদ কম নয়। অজানা বিদেশ-বিভুঁইতে এই ব্রাহ্মণ সবাইকে বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন বলে কুন্তীর কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না। বাড়িওয়ালা ব্রাহ্মণকে খানিকটা প্রত্যুপকার করার বাসনা নিয়েই তিনি তাঁর বাড়িতে গেলেন। কুন্তী যা শুনলেন, তাতে বোঝা গেল—সে বাড়িতে আত্মবলিদানের একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরম্ভ হয়েছে রীতিমতো। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল—বক-রাক্ষস বলে এক রাক্ষসের কাছে একেকবারে একেকটি পুরুষমানুষকে নানা উপহার নিয়ে যেতে হয়। রাক্ষস পশুর সঙ্গে মানুষটাকেও খায়। এবারে ওই বাড়িওয়ালা ব্রাহ্মণের পালা পড়েছে। অতএব সংসারে চারটি প্রাণীর মধ্যে অন্তত তিনজন প্রত্যেকেই আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে এবং অন্যদের বাঁচাতে চাইছে। সব শুনে কুন্তী বিনা দ্বিধায় বললেন—আপনাদের কাউকে যেতে হবে না। আমার তো পাঁচটি ছেলে, তাদের মধ্যে একজন ওই দুই রাক্ষসের কাছে যাবে—মম পঞ্চ সুতা ব্ৰহ্মণ্ তেষামেকো গমিষ্যতি।

জননী কুন্তী তাঁর অন্য কোনও ছেলের সঙ্গে পরামর্শ করলেন না, নিজেও দু’বার ভাবলেন না, অথচ ব্রাহ্মণকে কথা দিয়ে দিলেন—আমার এক ছেলে যাবে। ব্রাহ্মণ নিজেও স্বার্থপরের মতো পরের ছেলেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাননি। তবু কুন্তী মানেননি। তিনি ব্রাহ্মণকে সঙ্গে নিয়ে ভীমের কাছে এসেছেন এবং ভীম সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছেন। নিজের বাহুবলের ওপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস। ভিক্ষা সেরে এসে যুধিষ্ঠির জননী কুন্তীকে যাচ্ছেতাই করে বলেছেন। বলেছেন—মা! তোমার কি দুঃখে-কষ্টে জ্ঞান-বুদ্ধি সব লোপ পেল? নইলে, যার ভরসায় আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমই, যার ভরসায় আমরা হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের চিন্তা করি, যার ভয়ে দুর্যোধন-শকুনিরা ত্রস্ত হয়ে আছে, তুমি কি না মা হয়ে কার না কার ছেলের জন্য নিজের ছেলেকে মেরে ফেলতে চাইছ—কথং পরসুতস্যার্থে স্বসুতং ত্যক্তুমিচ্ছসি?

কুন্তী ছেলের ওপর কেন এত ভরসা করেছেন, তা আমরা জানি। হিড়িম্ব রাক্ষসের সঙ্গে ভীমের যুদ্ধ তিনি প্রত্যক্ষ দেখেছেন। জতুগৃহ থেকে কী কষ্টে ভীম মা-ভাইদের বয়ে এনেছেন, তাও দেখেছেন। ভীমের সাহস এবং অতিমানবিক শক্তিই তাঁর মনে এই দৃঢ় বিশ্বাস এনে দিয়েছে যে, আর কেউ না পারুক, আমার ভীম ঠিক পারবে। যুধিষ্ঠিরকে তিনি শান্ত করে বলেছেন—ওরে তুই কী বুঝবি, ওর কত ক্ষমতা! ও যখন জন্মেই আমার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল, সেদিন ওর শরীরের চাপে গোটা পাথরটাই ভেঙে গিয়েছিল। আমি সেদিন থেকেই জানি—ও কতটা পারে, আর কতটা পারে না। অতএব আমি যা করেছি, জেনে বুঝেই করেছি—যা বলেছি, বুঝেশুনেই বলেছি—তদহং প্রজ্ঞয়া জ্ঞাত্বা বলং ভীমস্য পাণ্ডব।

আসলে যে ছেলে পারে, তার ওপরে বাবা-মায়ের চাপ চিরকালই বেশি। বাপ-মায়ের মনের মধ্যে ছেলে-মেয়ের সম্বন্ধে একটা ‘এগ্‌জিবিশনিজম্’ কাজ করে। যে ভাল লেখা-পড়া করে বাবা-মা তাঁকে আরও পড়াশুনোর চাপের মধ্যে রাখেন, যে মেয়ে সুন্দরী, তাকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেও সময় বুঝে মানুষ দেখে মাঝে মাঝে তাকে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দেন। একইভাবে হিড়িম্ব রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ দেখেই কুন্তী বুঝেছেন বক-রাক্ষসটাও এর কাছে কিছুই নয়—হিড়িম্বস্য বধাচ্চৈব বিশ্বাসো মে বৃকোদরে।

আর সত্যিই তো ভীমের ভাব-সাব দেখে কুন্তীমায়ের অনুকারে আমাদের তো হাততালি দিতে ইচ্ছে হবে আবার। ভীম খাবার-দাবার নিয়ে বনে পৌঁছলেন সকালবেলা। পোঁটলা-পাটলি খুলে খাবার অন্ন ব্যঞ্জন সাজিয়ে বক-রাক্ষসের নাম ধরে ডাকতে আরম্ভ করলেন এবং বকের জন্য নির্দিষ্ট খাদ্যসম্ভার তিনি নিজেই খেতে আরম্ভ করলেন। বক এল। তার চেহারা হিড়িম্ব রাক্ষসের মতোই এবং তাঁর গোত্রও এক—যেমনটি আগে বলেছি। তার খাবার ভীম খাচ্ছেন দেখে সে তো কড়া ভাষায়—তোর মরার ইচ্ছে হয়েছে,—ইত্যাদি বলে ভীমকে খানিকটা শাসানি দিল।

ভীম ভ্রুক্ষেপ না করে হিন্দি সিনেমার নায়কের কায়দায় খেয়ে চললেন। বক ধেয়ে এল, ভীম তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিপাতে একবার তাকে দেখে নিয়ে আবার খেতে লাগলেন। বক এবার রেগে ভীমের পিছনে এসে তাঁর পিঠে একটা ঘুসি চালাল। ভীম তাকিয়েও দেখলেন না। নারায়ণ দেবনাথের বাঁটুলের মতো—কে রে পিঠে সুড়সুড়ি দিচ্ছে—এইভাবে খাবারের দিকেই মন দিলেন—নৈবাবলোকয়ামাস রাক্ষসং ভুঙ্‌ক্ত এব সঃ। বক এবার গাছ-টাছ তুলে আনতে গেল। কিন্তু ভীমের যেন কোনও তাড়া নেই। মারামারি শুরুর তুঙ্গ-মুহূর্তেও হিন্দি সিনেমার নায়ক যেমন নির্বিকার চিত্তে সিগারেট টানে, শেষ সুখটান দেয়, তারপর একটু কেশেও নেয়, ভীমও তেমনই তাঁর খাওয়া শেষ করলেন, হাত ধুলেন, তারপর হাত মুছে বেশ হৃষ্টমনে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েই রাক্ষসের ছোঁড়া গাছটা লুফে নিলেন বাঁ হাতে, মুখে কিন্তু এখনও তাঁর খাবার তৃপ্তিটুকু লেগেই আছে।

আপনারাই বলুন, ‘হলে’ থাকলে এই সময় সামনের সিটগুলো থেকে হাততালি পড়ত কিনা। আমরা এই যুদ্ধের অবধারিত ফল জানি। বকের গলা টিপে, কোমর ভেঙ্গে, তাকে তালগোল না পাকানো পর্যন্ত ভীম তাকে ছাড়বেন না—এ আমরা জানি। বক-রাক্ষসকে কাঁধে বয়ে নিয়ে নগরের দ্বারে ফেলে রেখে এলেন ভীম। বুঝিয়ে দিলেন—পাড়ার লোকের হাড় জ্বালিয়ে বক আর তোলা তুলতে আসবে না। এরপরে যেটা মহাভারতে অনুল্লিখিত, সেটা হল—বকের মৃত শরীর ফেলে দিয়ে—যেন কিছুই হয়নি, এইভাবে হাতের ধুলো ঝেড়ে চলে এলেন নিজের বাড়িতে। মা-ভাইদের খবর দিলেন—ব্যাপারটা মিটে গেছে।

এক্ষুনি যে নগরের কথা বললাম, এই নগরের নাম একচক্রা। এখানে অনেকদিন থাকার ফলে পাণ্ডবদের ভিক্ষা পাওয়ার অসুবিধে হচ্ছিল। জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে ফেরার পরেই পাণ্ডবরা দুর্যোধনকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন। ভিক্ষাবৃত্তিতেই তাঁদের জীবন কাটছিল। কিন্তু এক জায়গায় আর কত ভিক্ষা মেলে। তা ছাড়া ওই ছোট্ট নগরের দর্শনীয় স্থান থেকে সবকিছুই তাঁদের কাছে একঘেয়ে হয়ে গেছে। জননী কুন্তীও প্রস্তাব দিলেন—চল, এবার পাঞ্চালরাজ্যে যাই। সেখানে ভিক্ষাও ভাল মিলবে আর শহরটাও বেশ বড়। এরমধ্যে নানা জনের মুখে দ্রৌপদীর রূপ-গুণ, স্বয়ম্বরের আয়োজনের খবরও তাঁদের কানে এসে পৌঁছল। তাঁরা এবার সবাই মিলে চললেন পাঞ্চাল-রাজ্যে নতুনত্বের আশায়।

ভীমকে এবার একটা অদ্ভুত পরিবেশে আমরা দেখতে পাব। দেখতে পাব, চার ভাইয়ের সঙ্গে তিনি বসে আছেন দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর-সভায়। ব্রাহ্মণের বেশ। কেউ তাঁকে চেনে না।

দ্রৌপদীকে বিয়ে করা বা লক্ষ্যভেদ করা—এসব কোনও ‘প্ল্যান’ কোনও পাণ্ডবের মনেই ছিল না। কিন্তু রাজসভায় দ্রৌপদীকে দেখার পর প্রত্যেকেই যে অপলক নয়নে তাঁর দিকেই তাকিয়ে ছিলেন এবং তাঁকে যে সব পাণ্ডবভাইদেরই বেশ পছন্দ হচ্ছিল, সে কথা মহাভারতের কবি লুকোননি। যাই হোক, দ্রুপদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদে সবাই যখন একে একে অসফল হলেন, তখন অর্জুন গেলেন লক্ষ্যভেদ করতে। তিনি লক্ষ্যভেদ করলেন এবং দ্রৌপদীর বরমাল্য লাভ করলেন। এতাবৎ আমাদের ভীমের কোনও ‘ফাংশন’ নেই। কিন্তু যে মুহূর্তে দ্রৌপদীকামী বিফল রাজারা দ্রুপদরাজাকে ছেড়ে অর্জুনকে আক্রমণ করলেন সেই মুহূর্তেই ভীমকে দেখছি—তিনি একটি প্রকাণ্ড গাছ উপড়ে নিয়ে বাড়ি মেরে তার পাতা সাফ করে নিয়েছেন। কৃষ্ণ বলরামকে ভীমের পরিচয় দিয়ে বললেন—ওই যে গাছ নিয়ে রাজাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন যিনি, উনি ভীমসেন। কেন না, ভীম ছাড়া পৃথিবীতে আর কারও এইভাবে যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই—বৃকোদরান্নান্য ইহৈতদদ্য/কর্তুং সমর্থঃ সমরে পৃথিব্যাম্।

আমরা জানি—এই যুদ্ধেও ভীম আবারও অর্জুনের সাহায্যকারীর ভূমিকায়, যে ভূমিকা মাদাম বিয়ার্দো ঠিক করে দিয়েছেন ইন্দ্রের সাহায্যকারী হিসেবে বায়ুর রূপকল্পে। এই যুদ্ধও অর্জুন জিতেছিলেন ভীমের অমানুষিক ক্ষমতায়। যুদ্ধশেষে অর্জুন যখন নব-পরিণীতা বধূকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন, তখন একমাত্র ভীমই ছিলেন তাঁর সঙ্গে। অন্য তিন ভাই যুদ্ধের আগেই যুদ্ধভূমি থেকে বাইরে চলে গেছেন। দিন পরিণত হয়েছে প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায়। নববধুর প্রথম হৃদয়-পাওয়া অর্জুন যখন দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের কাছে উপস্থিত হলেন, তখন কি ভীমের একবারও মনে হয়নি যে, দ্রৌপদীকে লাভ করার ব্যাপারে তাঁরও হক অন্তত পঞ্চাশ ভাগ। তবু এই ভাগের প্রশ্নে তাঁর সন্দেহও নিশ্চয়ই ছিল, কেন না দ্রুপদের কন্যাপণ মীনচক্ষু তিনি ভেদ করেননি।

সত্যি সত্যি অধিকার যাকে বলে তা হয়তো দ্রৌপদীর ওপর ভীমের জন্মাল না, কিন্তু স্বয়ম্বর সভায় প্রথম দেখেই যে রমণীকে ভাল লেগেছিল তাঁকে তিনি অস্বীকার করবেন কী করে? অর্জুন-ভীম দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে সেই কুম্ভকার-গৃহে প্রবেশ করার মুখে দু’জনে যুগপৎ উচ্চারণ করেছিলেন একই কথা—মা! কেমন ভিক্ষা এনেছি দেখো? মা বলেছিলেন—যা এনেছ, সবাই মিলে ভাগ করে নাও। কথাটা দ্রৌপদীর পক্ষে রুচিরোচন নাই হোক, অর্জুনের দিক থেকেও কথাটা তত সুখকর নয়, বিচারসহও নয়, কিন্তু আর সব ভাইদের কাছে কথাটা যে হঠাৎ হাতে স্বর্গ পাওয়ার মতো হল—সেটা আর কেউ না বুঝুন, পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির ঠিক বুঝেছিলেন।

মায়ের কথা ঠিকমতো বিচার করে একটা সুব্যবস্থা করার ভার পড়ল মহামতি যুধিষ্ঠিরের ওপর। তিনি অর্জুনের লক্ষ্যভেদের নিরিখে তাঁকেই বলেছিলেন একা দ্রৌপদীকে বিয়ে করতে। কিন্তু অর্জুন সবিনয়ে বললেন—আগে যুধিষ্ঠিরের বিয়ে হোক, ভীমের বিয়ে হোক, তারপর তো আমি। যুধিষ্ঠির আর দ্বিতীয়বার অর্জুনকে সাধেননি। কারণ, অর্জুন ছাড়াও দ্রৌপদীর প্রতি তাঁর অন্যান্য ভাইদের—ভীমও তার মধ্যে আছেন—যেরকম সরসতা লক্ষ করলেন যুধিষ্ঠির, তাতে তাঁর বুঝতে বাকি রইল না, ভাইদের মধ্যে একজনও যদি অসামান্য দ্রৌপদীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হন, তাহলে নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া-বিবাদ আরম্ভ হয়ে যাবে। নিজেদের মধ্যে যাতে কোনওদিন কোনও কারণে বিভেদ সৃষ্টি না হয় সেই ভয়েই যুধিষ্ঠির সিদ্ধান্ত নিলেন—সুকুমারী দ্রৌপদী আমাদের সকলেরই স্ত্রী হবেন।

ঠিক এই মুহূর্তে আলাদা করে ভীমের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, মহাভারতের কবি তা পরিষ্কার করে লেখেননি। কিন্তু সমস্ত ভাইরা যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে অবধি ওই কথাটাই শুধু ভেবে যাচ্ছিলেন—তমেবার্থং ধ্যায়মানা মনোভিঃ। সবাই ভাবছিলেন বললেও সবার ভাবা একরকম হয় না। অনুমান করা যায়, নকুল যা ভাবছিলেন, ভীম তা ভাবছিলেন না। এমনকী অর্জুন যা ভাবছিলেন ভীম নিশ্চয় তাও ভাবেননি। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে পাণ্ডবভাইদের মধ্যে সমাংশে প্রতিষ্ঠিত করার পর যুধিষ্ঠির যদি মহা-স্থির থেকে থাকেন—কারণ, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেও স্থির থাকতেন, তবে অর্জুন ছিলেন মহান দানের গৌরবে কৃতার্থ। কিন্তু ভীমের কী হয়ে থাকতে পারে?

মহাভারতের শেষ পর্বটা যেহেতু আমরা জানি, তাই কথা বাড়িয়ে লাভ নেই কোনও। কিন্তু ভীমের জীবনের শেষের দিনটি পর্যন্ত সব কথা ভেবেও বলতে পারি—সংসারে কতগুলি লোক থাকে যারা ভালবাসার ক্ষেত্রে ‘রেসিপ্রোসিটির’ ধার ধারে না। এক পঞ্চমাংশ মাত্র দ্রৌপদীর অধিকার লাভ করেই ভীম অন্তত ভেবেছিলেন—এই যথেষ্ট। যাঁকে এত ভাল লেগেছিল (কেন ভাল লেগেছিল, তাও বুঝি তিনি জানেন না)—, ন্যায় অনুসারে যাঁর ওপরে কোনও অধিকারই ছিল না, তার ওপর এই আকস্মিক অধিকার পেয়ে ভীম বুঝি ভেবেছিলেন—এঁকে আমার সব দিতে চাই, প্রতিদানে কী পাচ্ছি, সে হিসেবে আমার দরকার নেই কোনও। কুড়ি শতাংশ হৃদয়ের আইনি পথ বেয়ে একশো ভাগ পুরুষ-হৃদয় উজাড় করে দেওয়ার যে কারণ—তা ভীম তত ভাল করে না জানলেও দ্রৌপদী জানতেন। সে সব কথায় আমরা পরে আসব।