০৬.
কাঁটালিয়াঘাটে মারামারি খুনোখুনি লোকের গা-সওয়া। ভোটের রাজনীতির হাওয়া উঠলে এটা বেড়ে যায়। কিন্তু এই শরতে ভোটের হাওয়া নেই। তপু খুন হওয়ার পর চাপা উত্তেজনা থাকলেও লোকে আশঙ্কা করেছিল, যে-কোনও সময় মুখোমুখি সংঘর্ষ বাধতে পারে বড়জোর। কিন্তু এমন করে পাঞ্জাবের সন্ত্রাসবাদী রীতিতে খুনোখুনি হওয়ার কথা কেউ কল্পনাও করেনি। পদ্ধতিটা একেবারে নতুন। তাই সন্ত্রাসের শিহরন ছড়িয়ে পড়েছিল প্রতিটি মানুষের মনে। সন্ধ্যার আগেই ঘাটবাজার খাঁ খাঁ হয়ে যাচ্ছিল। রাস্তাঘাটে কদাচিৎ মানুষজন দেখা যাচ্ছিল। এম এল এ বাবুর আত্মীয় ছিলেন করালী কবিরাজ। সত্তরের ওপর বয়স। লাঠি হাতে চলাফেরা করেন। তাকে খুন করার একটা কারণ অবশ্য আঁচ করেছিল লোকে। তার ছোটছেলে গোপাল কেলোর দলে ভিড়েছিল। তপু খুন হওয়ার পর সে গা ঢাকা দিয়েছে। পুলিশের খাতায় সে অন্যতম আসামী। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সব দিক বজায় রেখে চলতে হয়। কাঁটালিয়াঘাটে পরদিনই বাইরে থেকে আরও পুলিশ এনে মোতায়েন করা হয়েছে। গঙ্গার ধরে নেতাজি পার্কে পুলিশ রাইফেল হাতে টহল দিচ্ছে। গলিঘুজির মোড়েমোড়ে সশস্ত্র পুলিশ। তবু লোকের স্বস্তি নেই। হিটলিস্টের ক যে কবরেজমশাই, কেউ কল্পনাও করেনি। এবার দ্বিতীয় নামের আদ্যক্ষর খ। যাদের নামের গোড়ায় খ আছে, তারা আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেছে। যারা নির্দল নির্বিরোধী খ, তারাও খুঁটিয়ে চিন্তাভাবনা করছে, কোনও সূত্রে দুই শিবিরের সঙ্গে অতীতেও দৈবাৎ কোনও সম্পর্ক ছিল কি না।
দিনের বেলায় ততকিছু আতঙ্ক নেই অবশ্য। কিন্তু সন্ধ্যার মুখে ওই লোডশেডিং বড় বিপত্তিকর। বিদ্যুৎ সাবস্টেশনে গোপেশ্বরবাবু এবং পুলিশ আফিসাররা এ নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্যুৎ অফিসাররা জানিয়েছেন, তাদের কিছু করার নেই। কখন কোন ট্রান্সমিশন লাইন ট্রিপ করবে, আগে থেকে বলা কঠিন তবু তাঁরা চেষ্টা করবেন, যাতে লোডশেডিং যতটা সম্ভব কমানো যায়।
কবরেজমশাই খুন হওয়ার পর তিনটে দিন আর কিছু ঘটল না। ঘনশ্যাম বিকেলে বেড়াতে যেতে নিষেধ করেছিল গার্গীকে। একটা লুডো কিনে এনে দিয়েছিল। বলেছিল, “বরং ঘরে বসে লুডো খেলবে। গৌতম না এলে একা একা খেলবে। সময় কেটে যাবে। আমি সকাল-সকাল ফিরতে চেষ্টা করব।”
গৌতম এই তিনটে দিন কম এসেছে। গার্গী অভিমান দেখিয়েছে। অভিমান ভাঙাতে অনেক আদর করেছে গৌতম। বলেছে, “আসলে মা বড্ড কড়াকড়ি শুরু করেছেন। সবেধন নীলমণি আমি। এনিওয়ে, রাগটাগ ছেড়ে লুডো বের করো। খেলি।”
লুডো খেলতে খেলতে হঠাৎ একসময়
যৌবন যৌবনের কাছাকাছি হলে হয়তো এটাই অনিবার্য। শরীরে-শরীরে সাপলুডো খেলা।
সেদিন বিকেলে গার্গী জেদ ধরল, “চলো কিছুক্ষণ ঘুরে আসি। বাড়িতে থেকে হাঁপ ধরে গেল। এখানে আসার পর কী যে হয়েছে, বিকেলটা বাইরে ছুটোছুটি করে বেড়াতে ইচ্ছে করে।”
গৌতম বলল, “আমারও। কলকাতায় থাকলে একরকম। এখানে এলে অন্যরকম। খালি টো টো ঘুরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তোমার বর জানতে পারলে চটে যাবে যে।”
“বেশি দূর যাব না। বাঁধের ওপর কিছুক্ষণ ঘুরব।”
দুজনে বেরুল। ছাতিম গাছটার পাশ দিয়ে গিয়ে বাঁধে উঠল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে কী এক নেশায় পেয়ে গেল গার্গীকে। বলল, “চলো, সুইস গেটে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি।”
ডাইনে গঙ্গা, গাছপালার ফাঁকে। বাঁ-দিকে পোভড়া ইটভাটার খাল আর ঝোঁপঝাড়। একটা জলনিকাশী নালা এসে গঙ্গায় মিশেছে। সেখানে সুইস গেট। ছোট্ট ব্রিজ। ব্রিজের কালভার্টে পাশাপাশি দু’জনে বসল।
ওরা কথা বলছিল। নির্জন প্রকৃতিতে প্রেমিক-প্রেমিকারা যে-সব কথা বলে, চপল মাদকতাময় সেইসব কথা। হাতে সঙ্গে হাতের খেলা। প্রকৃতিতে সে স্বাধীনতা ছড়িয়ে আছে, সেই স্বাধীনতা ভূতের মতো পেয়ে বসেছিল।
একবার বাঁ-দিকে, যে পথে এসেছে ওরা, ঘুরে গার্গী দেখেছিল, দূরে বাঁধের নিচে একটুকরো ঘাসের জমিতে মাথায় টুপিপরা একটা লোক দু হাঁটুতে হাত রেখে ঝুঁকল। তারপর সোজা হলো এবং হঠাৎ মাটিতে মাথা ঠেকাল। বাঁধের ওপর একটা সাইকেল দাঁড়িয়ে আছে। গার্গী বলল, “ও কী করছে লোকটা?”
গৌতম হাসল। “নামাজ পড়ছে। তুমি মুসলমানদের নামাজ পড়া দেখনি?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। দেখেছি।”
“আমার বেশ লাগে এই ব্যাপারটা। নির্জনে কারও কাছে সারেন্ডার করা।”
“আমরা প্রণাম করি। সে-ও সারেন্ডার।”
“আমি করি একমাত্র তোমার কাছে।”
“ছি! ও কী কথা!”
“সত্যি গার্গী! ওসই ঈশ্বর-টিশ্বরে আমার বিশ্বাস নেই। তবে হ্যাঁ, একটা ন্যাচারাল ব্লাইন্ড ফোর্স আছে ফিল করি।”
“ব্লাইন্ড বলছ কেন?”
“অব কোর্স ব্লাইন্ড! তা না হলে মানুষ যা খুশি করতে পারছে কেন? তুমি ভেবে দেখ, এত খুনোখুনি এত সব যুদ্ধ–একেকটা যুদ্ধ কী সাংঘাতিক ব্যাপার কল্পনা করো। তারপর ফ্লাড। আমি মেডিকেল টিমে কতবার কত জায়গায় ফ্লাডের সময় গেছি। ওঃ! হরিফাইং! ব্লাইন্ড ফোর্স ছাড়া কী?”
আজ এলোমেলো বাতাস বইছিল। দিনশেষের ধূসরতা ঘনিয়ে এসেছে কখন, কথায় কথায় দু’জনেরই খেয়াল হয়নি। গৌতম বলল, “এই! এবার উঠে পড়ো।”
দুজন বাঁধের উপর দিয়ে ফিরে আসছিল। গার্গী গুন গুন করে কি গান গাইছিল। গৌতম বলল, “বাহ্! তুমি এত ভালো গাইতে পারো, অথচ চেপে রেখেছ? গলা ছেড়ে গাও!”
গার্গী বলল, “ভ্যাট! ও কিছু না।”
বাঁ-দিকে গঙ্গার ধারে গাছপালায় পাখিরা তুমুল চ্যাঁচামেচি করছে। দূরে রেল লাইনে একটা মালগাড়ির শব্দ কতক্ষণ। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কাঁটালিয়াঘাট টাউনশিপে আলো জ্বলে উঠেছে এখনই। আজ হয়তো লোডশেডিং হবে না। বাঁক ঘুরে ধূসর আলোয় সেই সাইকেলটা দেখা গেল। একই ভাবে বাঁধের উপর দাঁড় করানো আছে।
কিছুটা এগিয়ে যাবার পর গৌতম থমকে দাঁড়াল। গার্গী বলল, “কি ব্যাপার?”
গৌতম বলল, “লোকটা–এসো তো দেখি।”
সে চলার গতি বাড়াল। গার্গী একটু পিছিয়ে পড়ল। গৌতম সাইকেলটার কাছে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়িয়েছে। তারপর গার্গী দেখল, সে নীচের ঘাস জমিতে নামল।
গার্গী তখনও বুঝতে পারেনি, কী হয়েছে।
কাছাকাছি গিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। সেই নামাজপড়া লোকটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে ঘাসে। দুটো হাত সামনে ছড়ানো। তার টুপিটা খসে পড়েছে। মাথার একটা পাশ থেকে টাটকা রক্ত গড়িয়ে তার কাঁধ এবং পিঠ অব্দি জামাকে রাঙিয়ে দিয়েছে। গার্গী মুখ ফিরিয়ে নিল।
গৌতম কঁপা কাঁপা গলায় বলল, “মার্ডার! এখানে থাকা উচিত নয় আর। চলো!”
দু’জনে হন্তদন্ত হাঁটতে থাকল। গার্গী হাঁটতে পারছিল না। আতঙ্কে তার গলা শুকিয়ে গেছে। কোনও কথা বলতে পারছিল না সে।
ছাতিমতলায় পৌঁছে গৌতম বলল, “কী করা উচিত, বুঝতে পারছি না। পুলিশকে খবর দিতে গেলে জেরার চোটে অস্থির করবে। এস তো!”
ঘনশ্যাম বাড়িতে ছিল। গৌতম ও গার্গীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে হাসল। “পেত্নীটা তাড়া করেছে নাকি?”
গৌতম ব্যস্তভাবে বলল, “আবার মার্ডার। এক মুসলমান ভদ্রলোককে নামাজ পড়তে দেখেছিলুম। ফেরার সময় দেখি, মাডার্ড হয়ে পড়ে আছেন। একটা সাইকেল-”
ঘনশ্যাম চমকে উঠেছিল। দ্রুত বলল, “সর্বনাশ! খয়রুল হাজি নয় তো? ফেরার সময় দেখা হয়েছিল। বলল, মাঠে ধান দেখতে যাচ্ছি।”
গৌতম বলল, “কী করা উচিত বলুন তো শ্যামদা।”
ঘনশ্যাম একটু ভেবে নিয়ে বলল, “পুলিশ–নাহ্! ওদিকটা লোকজন ছিল?”
“নাহ্। কাকেও তো দেখলুম না।”
“মুসলমানপাড়ায় খবর না হয় দিলে। কিন্তু ওরা পুলিশকে তোমার কথা বলবে। সে-ও এক বিপদ। পুলিশ জেরা করবে, ওদিকে কেন গিয়েছিলে।”
“আমিও ঠিক তা-ই ভেবেছি।”
ঘনশ্যাম গম্ভীরমুখে বলল, “তোমার বৌদি সঙ্গে ছিল। কাজেই স্ক্যান্ডালেরও রিস্ক আছে। বরং চেপে যাও। কেউ না কেউ বডি দেখতে পাবে।”
গার্গী দরজার কাছে মেঝেয় বসে পড়েছিল। ঘনশ্যাম তাকে বলল, “তোমাদের বলেছিলুম, বাইরে যেও-টেও না। বড্ড জেদ তোমার। আর গেলে গেলে, ওই নিরিবিলি শ্মশানমশান জঙ্গল এলাকায়। যাও, হাতেমুখে জল দাও। ঘাড়ে জল দিও। নার্ভাসনেস কেটে যাবে। একটা ট্যাবলেট দিচ্ছি। খেয়ে নিও। মার্ডার ফার্ডার দেখলে প্রচণ্ড শক লাগে নার্ভে। বিশেষ করে মেয়েদের। ওঠ, আমি চা করে দিচ্ছি। গরম-গরম চায়ের সঙ্গে ট্যাবলেটটা খেয়ে নেবে।”
গৌতম বলল, “আমি যাচ্ছি শ্যামদা।”
“নো, নো! ঘনশ্যাম হাত নাড়ল। “আগে ব্রেন ঠাণ্ডা করে নাও। হাতমুখ ধোও। চা খাও। কিছুক্ষণ বসো।”
সে কিচেনের সামনে গেল চা করতে। কুকার জ্বেলে কেটলি চাপিয়ে এসে দেখল, গার্গী বাথরুমে ঢুকেছে। সে গৌতমকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, বন্ধ বাথরুমের ভেতর গার্গীর ওয়াক ভোলার শব্দ শোনা গেল। বাথরুমের দরজায় গিয়ে সে বলল, “বমি হচ্ছে নাকি? নিজের জেদে খালি কষ্ট পাবে। মার্ডার্ড বডি দেখলে আমারও ভীষণ গা ঘুলোয়।”
একটু পরে গার্গী বেরিয়ে ঘরে ঢুকল। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘনশ্যাম দরজার কাছ থেকে বলল, “বমি বন্ধের ট্যাবলেট দেব?”
গার্গী আস্তে বলল, “না।”
বমিভাবটা নতুন নয়। ক’দিন থেকে এটা হচ্ছে। সে একটা কিছু আঁচ: করেছে, শরীরে যেন কী একটা পরিবর্তন ঘটেছে। মুখ ফুটে বলতে বেধেছে স্বামীকে। গৌতমকেও বলেনি। শরীর জুড়ে কী এক নতুন অনুভূতি।
গৌতম হাতমুখ ধুয়ে এসে চেয়ারে বসল। ঘনশ্যাম চা করে আনল। গৌতমকে দিয়ে সে ঘরে গেল গার্গীকে চা দিতে। গার্গী হাত নেড়ে বলল, “নাহ্। বমি হয়ে যাবে।”
“কিচ্ছু হবে না। ওটা নার্ভাসনেস। একটা ট্যাবলেট দিচ্ছি।”
“আহ্ চা খাব না।” গার্গী পাশ ফিরে শুল।
ঘনশ্যাম বাইরের চেয়ারে বসে বলল, “খয়রুল হাজিকে কী ভাবে মেরেছে দেখলে।” গৌতম চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “মাথার বাঁ-দিকে গুলি করেছে মনে হলো।”
“গুলি? তার মানে কবরেজমশাইয়ের মতো?”
“হ্যাঁ। সম্ভবত মাটিতে মাথা লুটিয়ে নামাজ পড়ার সময় গুলি করেছে। বাঁ দিকে ঝোঁপের আড়াল দিয়ে মার্ডারার এসে গুলি করেছে। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জেও হতে পারে।”
“তোমরা কোথায় ছিলে? কত দূরে?”
“সুইস গেটে বসেছিলুম।”
“গুলির শব্দ শুনতে পাওনি?”
“নাহ্। উল্টোদিকে বাতাস। তাছাড়া মালগাড়ির শব্দ হচ্ছিল।”
ঘনশ্যাম একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ টানতে থাকল। তারপর বলল, “তা হলে খ-তে খয়রুল হাজি। হাজিসায়েবও গোপেশ্বরবাবুর পার্টির লোক কিন্তু আমার ভাবনা হচ্ছে, এই থেকে না কমিউন্যাল কিছু বেধে যায়।”
গার্গী দ্রুত বেরিয়ে এসে বাথরুমে ঢুকল। আবার বমির শব্দ। ঘনশ্যাম হন্তদন্ত গিয়ে বলল, “ধরব? দেখো, মাথা ঘুরে পড়ে যেও না।”
গৌতম চায়ের কাপ রেখে উঠে দাঁড়াল। শ্যামদা! আমি চলি।” বলে সে বেরিয়ে গেল।
সে রাতে বিছানায় শুয়ে হঠাৎ ঘনশ্যাম সন্দিগ্ধস্বরে বলল, “এ মাসে তোমার পিরিয়ড হয়নি?”
গার্গী আস্তে বলল, “না।”
“তাই বলো!” ঘনশ্যাম খিকখিক করে হাসল অন্ধকারে। তারপর দু’হাতে গার্গীকে বুকে টেনে বলল, “বোকা মেয়ে! বুঝতে পারছ না তুমি এতদিনে মা হতে চলেছ?”
গার্গী কোনও সাড়া দিল না …
.
অনেকদিন বৃষ্টি হয়নি। ধানক্ষেতে জল শুকিয়ে গেছে। খয়রুল হাজি বিকেলে সাইকেলে চেপে উত্তরের মাঠে জমি দেখতে বেরিয়েছিলেন। পরদিন পাম্পসেট বসিয়ে পোড়ো ইটভাটার খাল থেকে জলসেচের ব্যবস্থা করার ইচ্ছা ছিল। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল, তখনও ফিরলেন না। দিনকাল খারাপ। তাঁর ছেলেরা লোকজন নিয়ে অস্ত্রশস্ত্র আর টর্চ নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছিল তাকে। বাঁধে সাইকেল দাঁড় করানো দেখে তারা ছুটে যায়। মাথায় রক্ত মেখে হাজি সাহেবকে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে।
আবার কাঁটালিয়াঘাটে ঝিমিয়ে পড়া সন্ত্রাস ফিরে এল। হিট লিস্টে খ ছিল। খয়রুল হাজির বডি বড়ল। লোকেরা তার ছেলেদের বকাবকি করল। নামে খ আছে, অথচ বাবাকে তারা সাবধান করে দেয়নি কেন? তারা আসলে ভেবেছিল। এটা হিন্দুপাড়ার বাবুদের দলাদলি।
আজকাল সব দলাদলিই রাজনীতির। রাজনীতিতে হিন্দুমুসলমান নেই। আর রাজনীতিরই চাপে ই এফ আর পর্যন্ত এসে গেল। দৈবাৎ না হিন্দু-মুসলমান বেধে যায়। কাঁটালিয়াঘাট পুলিশেবন্দুকে আবার ছয়লাপ। সন্ধের পর টহলদারি। ১৪৪ ধারা জারি। ঘাটবাজার খাঁ খাঁ করে।
কিন্তু কালীপুজোর দিন এসে গেল। কোনও গ-এর মৃত্যু হলো না। কাঁটালিয়াঘাটে কালীপুজোরই ধুমটা বেশি। লক্ষ টাকার বাজি পোড়ে। বাইশখানা ঠাকুর হয়। শ্মশানকালীর পোডড়া মন্দিরের ভোল ফেরানো হয়। ততদিনে সন্ত্রাস কিছুটা থিতিয়ে এলেও এবার তত বেশি ধুম হলো না। গঙ্গার ধারে বাজি অবশ্য পুড়ল। শ্মশনকালীতলায় তান্ত্রিক মোনাখ্যাপা মড়ার খুলিও নাচাল। পুলিশের নির্দেশে যাত্রার আসর বন্ধ।
ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন সকালে গৌতম এল। “শ্যামদা! আমার ছুটি ফুরুল। আগামীকাল মর্নিংয়ে কলকাতা যাচ্ছি। এবার সামনে একজামিনেশন। কোনও দিকে মন দেবার উপায় থাকবে না।”
ঘনশ্যাম বলল। “এঃ হে! বড় ভুল হয়ে গেছে। তুমি কাল যাবে জানলে একসঙ্গেই যেতুম।”
“কলকাতা যাবেন নাকি?”
“যাব কী! এক্ষুণি খেয়েই ট্রেন ধরতে যাব। আজ বারাসাতে পিসেমশাইয়ের বাড়িতে থাকব। কাল মর্নিংয়ে কলকাতা যাব। রাইটার্সে জরুরী কাজ। খুলেই বলি, তোমার বাবার চিঠি নিয়ে যাচ্ছি ট্রান্সফারের তদ্বিরে।”
“বৌদি যাচ্ছে তো সঙ্গে?”
ঘনশ্যাম একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “ওর শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। এই অবস্থায় ট্রেনজার্নির ধকল রিস্ক নেওয়া উচিত হবে না। তাছাড়া পিসেমশাইয়ের বাড়ি তোমার বৌদি যেতে চায় না।”
গার্গী রান্না করছিল। গৌতম তার দিকে তাকিয়ে বলল, “বৌদি রাত্রে একা থাকতে পারবে? পাড়ার কাকেও–”
গার্গী বলল, “না। আমার জন্য পাহারার দরকার নেই।”
ঘনশ্যাম বলল, “জাস্ট একটা রাত। তোমাকে থাকতে বলতুম। কিন্তু তোমার বাড়িতে কী ভাববে? বরং একটু রাত অব্দি তুমি থেকো। ভোরে এসে খোঁজ নিও।”
গার্গী ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “আমার পাহারার দরকার নেই।”
“আহা! দিনকাল খারাপ। যা চলছে এখানে!”
গৌতম কৌতুকে বলল, “এবার হিটলিস্টে গ। সাবধান!”
গার্গী হেসে ফেলল, “তুমিও গ। তুমি সাবধান।”
ঘনশ্যাম খিকখিক করে খুব হাসল। “তারপর ঘ-তে আমি। পরপারে গিয়ে তিনজনের দেখা হবে।” বলে সে বাথরুমে স্নান করতে ঢুকল।…
সারা দুপুর গার্গী ও গৌতম লুডো খেলে আর কথা বলে কাটাল। গৌতম আজ শেষদিন শরীরের খেলা খেলতে চাইছিল। গার্গী তার চোখে চোখ রেখে, বলল, “তুমি জানো? আমি মা হতে চলেছি।”
“মাই গুডনেস!” গৌতম চটাস করে একটা চুমু খেল। “অ্যাদ্দিন বলোনি?”
“তুমি তো ডাক্তারি পড়ছ। তোমার বোঝা উচিত ছিল।”
গৌতম একটু চুপ করে থেকে বলল, “ক্রেডিটটা কার? তোমার বরের, না আমার, এটাই প্রশ্ন।”
“শাট আপ! খালি অসভ্যতা!” বলে গার্গী উঠে দাঁড়াল। “এই! চলো না আজ শেষদিনের বেড়ানোটা বেড়িয়ে নিই। বেশি দূর যেতে পারব না। কাছাকাছি গঙ্গার ধারে বসে থাকব।”
গৌতম একটু দ্বিধার সঙ্গে বলল, “বেশ তো! চলো!”
দরজায় তালা এঁটে দু’জনে বেরুল। ছাতিমতলা পেরিয়ে বাঁধে উঠে গার্গী বলল, “ওখানটা ফাঁকা জায়গা। চলো, ওখানে গিয়ে বসি।”
গঙ্গার ধরে এখানে কারা অনেকগুলো গাছ কেটে নিয়ে গেছে। গোড়াগুলো খোঁচার মতো দেখাচ্ছে। ঘন দূর্বাঘাসে দু’জনে বসল। একটু পরে গৌতম বলল, “তোমার মায়ের রূপটা মনে ভেসে আসছে। ফিরে এসে দেখব”
গার্গী তার হাতটা নিয়ে বলল, “ওসব কথা থাক। গিয়েই তো তুমি গার্লফ্রেন্ডের পাল্লায় পড়ে আমাকে ভুলে যাবে।”
গৌতম কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা তীব্র তীক্ষ্ণ শব্দ, বারুদের গন্ধ। সে পড়ে গেল। গার্গী মুখ ঘুরিয়েছিল সহজাত বোধে। আবার তেমনি একটা শব্দ। তার কপালে কী ঢুকে গেল। সে-ও গড়িয়ে পড়ল।…’
.