ভালবাসার অন্ধকারে – ৫

০৫.

পুজোর চারটে দিনে আনন্দে কাটাল গার্গী। কাঁটালিয়াঘাটে বারোখানা ঠাকুর হয়। টাউনশিপ এলাকাতেই তিনখানা। সবচেয়ে বেশি জাঁকজমক হয় ঘাটবাজারের ব্যবসায়ী সমিতির পুজোয়। বাজারের পেছনদিকটায় পুরনো স্কুলের খেলার মাঠে কলকাতার যাত্রা সপ্তমী অষ্টমী নবমী তিনটে রাত। গৌতমের সঙ্গে যাত্রা দেখতে পাঠিয়েছিল ঘনশ্যাম। সে বাড়ি পাহারা দেবে। দশমীর দিন তার ছুটি। কিন্তু চুপচাপ বসে থাকা তার ধাতে নেই। কোথায় কোথায় ইঞ্জেকশন দেওয়া আর ছোটখাটো ডাক্তারির করে বেড়াল। বিকেলে গার্গীর টানে সে ঘাটে বিসর্জন দেখতে গেল। গৌতম ক্যামেরায় বিসর্জনের অনেক ছবি তুলল। ঘনশ্যাম আর গার্গীরও কয়েকটা ছবি নিল। ঘনশ্যাম বিব্রত মুখে বলছিল, “আরে! আমার এই কুচ্ছিত চেহারার ছবি তুলে কী হবে?”

পরদিন থেকে আবার অফিস। আবার সেই রুটিনবাঁধা জীবন ঘনশ্যামের। গার্গী আগেভাগে বলে রাখে বিকেলে বেড়াতে যাওয়ার কথা। সে একটু করে সাহসী হয়ে উঠেছে। পঞ্চমুখী শিবের মন্দিরেও ঘুরে এল একদিন গৌতমের সঙ্গে। বাকি ফিল্মগুলো সেখানেই শেষ করে দিল গৌতম।

ছবিগুলো প্রিন্ট করে এনে গার্গীকে দিয়েছিল। গার্গী নিঃসংকোচে স্বামীকে দেখিয়েছিল। দেখে খুব প্রশংসা করেছিল ঘনশ্যাম। একটা ছবি সে বাঁধিয়ে এনে দেবে বলেছিল।

আবার একদিন বিলের ধারে সরকারি জঙ্গলটায় একটা বিকেল কাটাল গার্গী ও গৌতম। সেই সময় জঙ্গলের ভিতরে কিংবা বিলের পশ্চিমে রেলব্রিজের কাছে আবছা গুলির শব্দ শুনতে পেল ওরা। গার্গী বলল, “পাখি মারতে বেরিয়েছে কেউ। কোনও মানে হয়? পাখিগুলো-”

তাকে থামিয়ে গৌতম বলল, “বন্দুকের শব্দ বলে মনে হলো না!”

 “তা হলে কেউ পটকা ফাটালো।”

“নাহ্। কলকাতায় আমি একবার দুদলের বোমাবাজির মধ্যে পড়ে গিয়েছিলুম। তারপর পুলিশের গাড়ি এল। এক অফিসার রিভলভার থেকে ফায়ার করল। ঠিক সেই রকম শব্দ। ওঠ! এখানে থাকা ঠিক নয়।”

দুজনে বাঁধ ধরে ফিরে এল। তখনও ঘনশ্যাম ফেরেনি। পৌনে ছটায় আজকাল আবছা আঁধার হয়ে যায়। তাতে পুজোর পর আবার লোডশেডিং বেড়ে গেছে। গার্গী হেরিকেন জ্বেলেছে সবে, ঘনশ্যাম সাইকেলের বেল বাজিয়ে ফিরল। গৌতমকে দেখে সে হাসল। “যাক গে! আমি ভেবেছিলাম, তোমার বৌদি একা থাকবে। লোডশেডিং। তাছাড়া ওই ছাতিম গাছটার পেত্নির ভয়।”

গার্গী বলল, “আমার ভয়টায় নেই।”

সে হেরিকেনটা কিচেনের সামনে টেবিলে রেখে কুকার জ্বালাল। গৌতমকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। ঘনশ্যাম বলল, “কী গৌতম? বৌদির সঙ্গে ঝগড়া করেছ নাকি?”

গৌতম আস্তে বলল, “বিকেলে জঙ্গলের ওদিকে রিভলভারের গুলির শব্দ শুনলুম শ্যামদা! কী ব্যাপার কে জানে! আমরা বেড়াতে যাচ্ছিলুম। পালিয়ে এলুম তক্ষুণি।”

ঘনশ্যাম চমকানো স্বরে বলল, “বলো কী? কাকেও দেখতে পাওনি?”

 “নাহ্। শব্দটা ঠিক ট্রেস করতে পারিনি।”

“দেখ আবার কোনও খুনজখম হলো নাকি।” ঘনশ্যাম সিগারেট ধরিয়ে। বলল। “তপুকে মার্ডারের রিভেঞ্জ ব্রতীনবাবুরা নেবে, সে তো জানা। কেলো কতদিন গা ঢাকা দিয়ে বেড়াবে? তবে এখানে পিস্তল-রিভলভার দুই দলেরই আছে শুনেছি। দেখলুমও তো স্বচক্ষে।”

গার্গী একটু হেসে বলল, “গৌতম এত ভীতু জানতুম না। কচি ছেলের মতো ভয়ে সারা!”

গৌতম চুপ করে রইল। ঘনশ্যাম বলল, “তোমার এত ভয়ের কী। তুমি তো কোনও দলে নেই–আউটসাইডার। তাছাড়া এতদিন যখন কেউ তোমাকে জিনিসটা চায়নি, তখন এটা সিওর যে, তপু কাকেও বলে যায়নি। তবে সাবধানে থাকা ভাল। বনবাদাড়ের দিকে যেও-টেও না। বেড়াতে গেলে ঘাটবাজারের ওদিকে যেও। বিউটিফুল স্পট আছে। গঙ্গার নর্থের দিকটা বাজে। সাউথে বরং নিট আ্যান্ড ক্লিন। কেন? গঙ্গার ধারে এত সুন্দর পার্ক করে দিয়েছে মিউনিসিপ্যালিটি। সে কাদের জন্য?”

সে অভ্যাসমতো বকবক করতে লাগল। একটু পরে গার্গী দু’কাপ চা এনে দিল। হেরিকেনটা ঘরের দরজার সামনে রেখে নিজের কাপটা নিয়ে মেঝেয় বসল। গৌতম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ও কী! তুমি মেঝেয় বসবে আর আমি চেয়ারে বসে থাকব”

ঘনশ্যাম তার হাত ধরে টেনে চেয়ারে বসাল। “ও সব ফর্মালিটি রাখো তো! তোমার বৌদির মেঝেয় বসা অভ্যাস আছে।”

গার্গী বাঁকা হেসে বলল, “অভ্যাস আছে বৈকি। ছোটবেলা থেকে মেঝেয় বসে খেয়ে বড় হয়েছি। আমার বাবা চেয়ারটেবিলে বসে খাওয়া পছন্দ করতেন না। করলেই বা ডাইনিং চেয়ারটেবিল কেনার পয়সা পাবেন কোথায়?”

“কী কথায় কী?” ঘনশ্যাম খিকখিক করে হাসল। “ব্যাপারটা খুলেই বলি গৌতম। আসলে এই কোয়ার্টারটা পরস্মৈপদী। আজ আছি, কাল নেই। তাই সাজানোর জন্য ফার্নিচার কিনিনি। ঠাকুরের কৃপায় বারাসাতে একটুখানি জায়গা কিনে রেখেছি। সেখানেও তো ভাড়াবাড়িতে মানুষ হয়েছিলুম। ইচ্ছে আছে, সামনের বছর থেকে বাড়িটা শুরু করব। মেন্টাল হসপিটালের স্টাফ-কোয়ার্টার নেই। তো কী করব বলো? তোমার বৌদির নিজের ঘরবাড়ি হবে। সেখানেই থাকবে। চেষ্টাচরিত্র করে যদি কলকাতায় কোনও হসপিট্যালে ট্রান্সফার হতে পারি, আর অসুবিধে কিসের? ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করব। মোট কথা, এই হচ্ছে আমার ফিউচার প্ল্যান?” চায়ে চুমুক দিল ঘনশ্যাম। “ভাই গৌতম! এই পৃথিবীতে যার পায়ের তলায় নিজের মাটি নেই, তার কিছু নেই।”

গৌতম বলল, “ঠিক বলেছেন শ্যামদা।”

গার্গী বলল, “বাড়ি হতে হতে আমি বুড়ি হয়ে গঙ্গাযাত্রা করব। হুঁ, বাড়ির কথা শুধু কানেই শুনি!”

আলো এসে গেল। গৌতম চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠল। “চলি শ্যামদা! চলি গার্গী” বলেই সেই জিভ কাটল। “সরি! মাঝেমাঝে গার্গীবৌদি বলে ফেলি।” আসলে সে সামলে নিল।

ঘনশ্যাম বলল, “কী আশ্চর্য! আমাকে শ্যামদা বললে ওকেই বা গার্গীবৌদি বলবে না কেন? শুধু গার্গী বললেও কোনও দোষ দেখি না। আজকাল নাম ধরে ডাকার ফ্যাশান হয়েছে সমবয়সী ছেলেমেয়েদের। দেখ ভাই, আমাকে চেহারা হাবভাবে সেকালে দেখালেও আমি মডার্ন মাইন্ডেড।”

গৌতম সিরিয়াস হয়ে বলল, “হ্যাঁ। সেটা বোঝা যায় তা না হলে

তাকে থামিয়ে ঘনশ্যামও সিরিয়াস হয়ে বলল, “তুমি আমার ভাইয়ের মতো। তা ছাড়া তোমরা সমবয়সী। পরস্পর ফ্রিলি মিশবে। এতে দোষটা কোথায়?”

গার্গী তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে ছিল। কথাটা এতদিনের অভিজ্ঞতায় বিশ্বাস করা চলে। ঘনশ্যামের নির্বিকার মুখ দেখে অবশ্য মনের কথা বোঝা কঠিন। কিন্তু এখনও এমন কোন আচরণ চোখে পড়েনি, যাতে গার্গী ভাবতে পারে, তার স্বামী তার চরিত্র সম্পর্কে সন্দিগ্ধ।

তবু একবার যাচাই করার ইচ্ছে পেয়ে বসল গার্গীকে। গৌতম চলে যাওয়ার পর সে বলল, “শোনো! কাল থেকে আমি আর গৌতমের সঙ্গে মিশব না।”

ঘনশ্যাম তাকাল। “কেন মিশবে না?”

 “এমনি।”

 একটু পরে ঘনশ্যাম আস্তে বলল, “ও কোনও খারাপ ব্যবহার করেছে?”

 গার্গী ঝাঁঝাল স্বরে বলল, “না।”

 “তা হলে?”

একটু চুপ করে থাকার পর গার্গী বলল, “কবে লোকে কী বলবে-টলবে। আমার ভাবতে খারাপ লাগে।”

ঘনশ্যাম সিগারেট ধরাল। ধোঁয়ার সঙ্গে বলল, “লোকের কথার ধার আমি ধারি না। যে যা খুশি বলুক। এই যে তুমি একা থাকো, কে তোমাকে গার্ড দেবে? গৌতম অনেস্ট ছেলে। আমি ওকে স্টাডি করেই তোমার সঙ্গে মিশতে দিয়েছি।”

গার্গী চোখে হেসে বলল, “আমি খারাপ হতে পারি তো?”

ঘনশ্যাম হাসল। “কেউ খারাপ হলে আমার সাধ্য কী ঠেকাই। তবে লোককে স্টাডি করা আমার স্বভাব। ইচ্ছে থাকলেও অনেকে খারাপ হতে পারে না। বিশেষ করে মেয়েরা। কেন জানো? খারাপ হতে গেলে সাহসের দরকার হয়। ভাল হবার জন্য কোনও সাহস লাগে না।”

গার্গী মনে মনে বলল, শালুক চিনেছে গোপালঠাকুর!…

.

সকালে ঘনশ্যাম বাজার থেকে ফিরে বলল, “যা বলেছিলুম! দুই গ্যাংয়ে বেধে গেল বলে! ঘাটের ওদিকে কারা এক পোস্টার সেঁটেছে। সাংঘাতিক সব কথা লেখা।”

গার্গী বাজারের থলে নিয়ে বলল, “কী লেখা?”

ঘনশ্যাম বারান্দায় চেয়ারে বসে মুখে রহস্য ফুটিয়ে বলল, “লাল কালিতে লিখেছে–তপুকে আমরা ভুলছি না। ভুলব না। তারপর লিখেছে–”আমাদের হিটলিস্ট ক খ গ ঘ।”

“তার মানে?”

“কিছু বোঝা গেল না। ভিড় করে সবাই দেখছে। কেউ কেউ বলল, ক-তে কালিচরণ, তার মানে কেলো। খ-তে খোকা। ওর আসল নাম জানি না। গ-তে গোপেশ্বরবাবু এম এল এ, সেটা বোঝাই যায়। ঘ-তে হয়তো আমি!” ঘনশ্যাম হেসে ফেলল।

গার্গী বলল, “বাজে কথা বোল না তো!”

“দাশু হাজরা ঠাট্টা করে বলল, শ্যামবাবু! সাবধান!” ঘনশ্যাম হাসতে গিয়ে গম্ভীর হলো। “অদ্ভুত জায়গা বটে! যা শুনে এসেছিলুম, তার একশো গুণ সাংঘাতিক। হুঁ, ঘ-তে নাকি ঘোঁতন। কে ঘোঁতন জানি না। সবাই বলছে। কেলোর ডানহাত।”

“পুলিশকে খবর দেয়নি কেউ?”

 “কে জানে! মরুক ব্যাটারা খুনোখুনি করে। আমাদের কী?”

কিছুক্ষণ পরে ঘনশ্যাম অফিসে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে, গৌতম এল। তার মুখে ছায়া ছমছম করছে। বারান্দার চেয়ারে ধপ করে বসে বলল, “শ্যামদা! সাংঘাতিক সিচুয়েশন। শুনেছেন? ঘাটের ওখানে মন্দিরের গায়ে পোস্টার পড়েছে।”

ঘনশ্যাম বলল, “দেখেছি। হিটলিস্ট দিয়েছে। ক খ গ ঘ কে কে হতে পারে বলো তো? কতজন তো কতরকম বলছে। তোমার আইডিয়াটা শুনি।”

গৌতম বলল, “ক কেলো, এটা সিওর। বাকিগুলো বুঝতে পারছি না।”

“কেন? খ-তে খোকা। খোকাকে তুমি চিনবে সম্ভবত। ওদের ক্লাবে তো যেতে-টেতে তুমি।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। খোকা। মানে শ্যামল। ঠিক বলেছেন।” গৌতম একটু নার্ভাস হাসল। “গ আমি নই তো?”

গার্গী বলল, “নাহ্! আমি।”

সে চোখে হাসছিল। ঘনশ্যাম রসিকতা করে বলল, “বলা যায় না। তপুর চোরাই উইপন লুকিয়ে রেখেছিলে তুমি!”

বেশ করেছি।” বলে গার্গী গৌতমের দিকে তাকাল। “তুমি কি কেলোর গ্যাংয়ের গুণ্ডা যে ভয় পাচ্ছ?”

ঘনশ্যাম একই রসিকতার সুরে বলল, “গৌতমের গ-ও হতে পারে। গৌতমও তপুর উইপন লুকোতে এনেছিল?”

গার্গী চোখ পাকিয়ে বলল, “বাজে জোক কোরো না তো। কে আড়ি পেতে শুনবে।”

ঘনশ্যাম বলল, “গৌতম এখনও বড্ড ছেলেমানুষ। গ-তে গোপেশ্বরবাবু, তা-ও বুঝতে এত দেরি হচ্ছে? ঘ-তে ঘোঁতন। আমি চিনি-টিনি না। লোকে বলছে।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঘোঁতন।” গৌতম বলল। “লান্টুদার ছোটভাই মৃণাল। সাংঘাতিক ছেলে। খোকা আর ঘোঁতন দুজনেই আগে তপুর গ্যাংয়ে ছিল। ক্লাবে যেতে দেখেছি।”

ঘনশ্যাম বেরিয়ে গেল। সাইকেলটা সবুজ রঙ করে নিয়েছে। নতুন দেখাচ্ছে।

গার্গী চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বলল, “কিন্তু তুমি ঘন-ঘন এমন করে আসবে না তো! যখন-তখন এসে খালি–”

গৌতম একটু হাসল। “কী খালি? কথাটা পুরো বলো!”

 “ন্যাকা! বোঝ না?”

“একটা পদ্যে আছে, রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপরতন আশা করেনা কী যেন! সম্ভবত রবিঠাকুরের। অবশ্য সিচুয়েশন খারাপ। কালীপুজো অব্দি কাটিয়ে যাব ভেবেছিলুম। কী করব কে জানে।”

“তুমি যাবে না।”

 “আঁচলে বেঁধে রাখবে? শ্যামদা টের পেলে তোমাকে ডিভোর্স করবে।”

“যদি তা-ই করে, আমাকে তুমি–”

গৌতম দ্রুত বলল, “কী বলছ? সবসময় আজকাল তুমি কেন যেন বড্ড সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছ গার্গী।”

গার্গী শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “হাঁ, আমি সিরিয়াস। আবার মাঝেমাঝে ভয় হয়, দৈবাৎ ও টের পেলে কী হবে? যদি সত্যি আমাকে তাড়িয়ে দেয়, কোথায় যাব আমি? কার কাছে যাব?”

গার্গীর চোখে জল দেখে গৌতম বলল, “তুমি কেন ওসব ভাবছ? আমি তো আছি?”

“এখন বলছ। তখন–” গার্গী হঠাৎ দু’হাতে মুখ ঢেকে ঘরে ঢুকে গেল। খাটে বসে বালিশে মুখ গুজল।

গৌতম গিয়ে তার পিঠে হাত রেখে বলল, “গার্গী! শোনো! প্লিজ—কাঁদে না! আহ্! আমার কথাটা তো শোনো!”

গার্গী সোজা হয়ে বসল। চোখ মুছে বলল, “আমার ভীষণ ভয় করে, গৌতম! একজনের কাছে বিশ্বাস হারানো পাপ মনে হয়। যদি সত্যি জানাজানি হয়, আমার ওই ছাতিম গাছে ঝুলে মরা ছাড়া উপায় থাকবে না।”

গৌতম তার ঠোঁটে চুমু খেয়ে হাসতে হাসতে বলল, “পাগলী কোথাকার! মরতে হলে ঝুলে মরবে কেন? আমি পটাসিয়াম সায়ানাইড এনে দেব। মরছ তা জানতেও পারবে না?”

“তুমি ব্যাপারটা লাইটলি নিও না গৌতম! আমার মনে হয়, এবার আমাদের পরস্পর দূরে যাওয়া ভালো।”

গৌতম ভুরু কুঁচকে তাকাল! “আমাকে আর সহ্য হচ্ছে না এই তো?”

 “আহ্। তুমি একটু বুঝতে চেষ্টা করো।”

“দেখ গার্গী। তুমি আর আমি বাচ্চা নই। তুমি আমি দু’জনে জেনেশুনেই একটা খেলা খেলে চলেছি।”

“খেলা? তুমি একে খেলা বলছ?”

 “ওক্কে! জীবন-মরণ খেলা বলা যাক্। তো হা–একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে, আই এগ্রি। আমরা বড় বেশি শরীর নিয়ে খেলছি। এখানেই কি তোমার ভয়? দেখ গার্গী, হিউমান বডিকে কেন্দ্র করেই মানুষের সবকিছু। কাজেই এতে ওখান ও পাপ-টাপ নেই। আসল কথাটা হলো, আমরা পরস্পরকে ভালবাসি কি না। যদি আমার কথা বলো, আমি তোমাকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি, গার্গী! হিউম্যান বডি ঘেঁটে ছ’টা বছর আমার কাটছে। হিউম্যান বডির মধ্যে কী সব হেভেনলি চার্ম আছে, সেটা তুমিই আমাকে জানিয়ে দিয়েছ।”

গার্গী বাধা দিয়ে বলল, “ফিলসফি ছেড়ে একটু প্রাকটিক্যাল হও। রিস্কটা তুমি বুঝতে চেষ্টা করো আমার দিক থেকে।”

“ঠিক আছে। আমি আর আসব না।”

“আহ্, আমি তা বলিনি। তুমি বড় অবুঝ গৌতম! আমাদের সাবধান হওয়া। দরকার।”

গৌতম হাসল। “ওক্কে! শরীরের খেলাটা কমিয়ে দেব। বডিগার্ডের চাকরিই করব।”

গার্গী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি বসো। আমি স্নান করে নিই। রান্না চাপাতে হবে।”..

এদিনও সন্ধ্যায় লোডশেডিং। গৌতম কিছুক্ষণ ঘনশ্যামের অপেক্ষা করে চলে গেল। বলে গেল, “ভয় পেয়ো না। টর্চটা হাতের রাছে রাখো। শ্যামদা এখনই এসে যাবে। আমার একটা কাজ আছে। না হলে থাকতুম।”

চারদিক জুড়ে আঁধার। গুমোট গরম। হেরিকেনের আলো বারান্দায় রেখে দাঁড়িয়ে রইল গার্গী। তার গা ছমছম করছিল। এত দেরি করছে কেন লোকটা?

কিছুক্ষণ পরে ঘনশ্যাম ফিরল। বলল, “ডেঞ্জারাস ব্যাপার! কিছুক্ষণ আগে করালী কবরেজমশাইকে কে গুলি করে মার্ডার করেছে। পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে। একা বসেছিলেন গঙ্গার ধারের পার্কে। দেখ তো কী সাংঘাতিক কাণ্ড! বুড়ো মানুষ। দূরসম্পর্কে গোপেশ্বরবাবুর কাকা। এই অপরাধ।” সে শ্বাস ছেড়ে ফের বলল, “তবে এই কাঁটালিয়াঘাটে কে কেমন লোক, বলা কঠিন। নিশ্চয় কোনও সিক্রেট ব্যাপার আছে। তা না হলে বুড়ো মানুষকে মারবে কেন? মাথার পেছনে গুলি। বুঝলে? দেখতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। পুলিশ এসে গেছে।”

গার্গী চা করতে গেল। সেই সময় আলো এল…

.