ভালবাসার অন্ধকারে – ৪

০৪.

 ঘনশ্যাম বাড়ি ফিরেছিল সওয়া সাতটা নাগাদ। তাকে দেখেই গার্গী কান্না জড়ান গলায় বলেছিল, “সব দোষ আমার। পঞ্চমুখী শিবের মন্দির দর্শনে গিয়ে–”

তাকে থামিয়ে গৌতম সংক্ষেপে ঘটনাটা বলেছিল ঘনশ্যামকে। ঘনশ্যাম ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। কিন্তু সাইকেল হারানোর কথা শুনে সে একটু চ্যাঁচামেচি করেছিল। “মন্দির দর্শনের যাবার আর দিন পেলে না? দেখ তো এবার আমি রোজ কী করে অফিসে যাব? পাক্কা এক কিমি রাস্তা! একটা নতুন সাইকেলের যা দাম হয়েছে। নাহ্, তোমার আর বুদ্ধিসুদ্ধি হলো না এ বয়সেও। একটেরে এই বাড়ি, পেছনে জঙ্গল। কতদিন পইপই করে বলেছি, চোর ডাকাতের জায়গা। মেরে ফেললেও একটা লোক এসে জিজ্ঞেস করবে না কী হয়েছে।”

সেটা ঠিক। তাছাড়া টিভিতে এই সময় কী একটা দারুণ সিরিয়াল চলছে। আশেপাশের কোয়ার্টার থেকে জনপ্রাণীটি বেরুনোর আশা নেই। গার্গীও ততটা মিশুকে স্বভাবের মেয়ে নয়।

গৌতম বলছিল, “থানায় খবর দেওয়া দরকার, শ্যামদা। আমি বৌদিকে, একা ফেলে যেতে পারছিলুম না।”

ঘনশ্যাম বাঁকা মুখে বলেছিল, “পুলিশ কিছু করবে না। তবে সাইকেলটা যদি দয়া করে উদ্ধার করে দেয়। দেখি বড়বাবুকে বলে।”

গার্গী ভাঙাগলায় বলেছিল, “সেই জুতোর বাক্সটা নিয়ে গেছে!”

ঘনশ্যাম চমকে উঠেছিল প্রথমে। পরে বলেছিল, “নতুন জুতো দেখে নিয়ে গেছে। তবে বোঝা যাচ্ছে চোর একা ছিল না। গৌতম তুমি আছ যখন, আরও কিছুক্ষণ থাকো। আমি থানায় যাই।”

ঘনশ্যাম তক্ষুণি টর্চ হাতে বেরিয়ে গিয়েছিল। গৌতম বলেছিল “মাঝখান থেকে আমারই সর্বনাশ হলো হয়তো। তপু যদি কাকে বলে গিয়ে থাকে, আমার কাছে ওর ফায়ারআর্মস আছে, আমার প্রব্লেম হবে। ওর গ্যাংয়ের ছেলেগুলো ডেঞ্জারাস।”

গার্গী ঝাঁঝালো কান্নাজড়ানো গলায় বলেছিল, “তোমার পাপেই তো”

“ভ্যাট! কী পাপ? অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট।”

একটু পরে গার্গী বলেছিল, “সুটকেসটায় আমার অনেক পুরনো জিনিস ছিল। ছোটবেলার কত সব স্মৃতি। সাইকেল-ফাইকেল নিল, নিল। ওটা কেন, নিল?”

কত নির্জন নিরিবিলি সময়ে গার্গী সুটকেসটা খুলে স্মৃতিকে সামনে সাজিয়ে বসে থাকত। পুরনো গন্ধ তাকে আবিষ্ট করত। সে আবার হু হু করে কেঁদে উঠেছিল। গৌতম তার পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। “চোরেদের স্বভাব হলো, যা হাতের কাছে পাবে নেবে।”

পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর রঞ্জিত মিত্র আর দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে ঘনশ্যাম এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এসেছিল। রঞ্জিতবাবু তালাগুলো পরীক্ষা করে বলেছিলেন, “এসব কমন তালা সহজেই খোলা যায়। ঘরের দরজার তালাটা নামী কোম্পানির। কিন্তু এ পর্যন্ত চারটে বার্গলারি কেসে দেখলুম, এই তালাও চোরেরা সহজে খুলে ফেলছে।”

সাইকেলটা অনেক বছরের পুরনো। মোটামুটি একটা বর্ণনা দিয়েছিল ঘনশ্যাম। রঞ্জিতবাবু খুব আশ্বাস আর পরামর্শ দিয়ে গেলেন। কেসডায়েরি থানায় লিখিয়ে এসেছিল ঘনশ্যাম।

সে রাতে গার্গী কিছু খেল না। ঘনশ্যাম তাকে খাওয়াতে পারল না। শেষে রাগ করে নিজেও খেল না। সে নরম স্বভাবের মানুষ, তাতে রাগ করে উপোস থাকার পাত্র নয়। কিন্তু আসার পথে যেটুকু খাওয়া হয়েছে, তাই যথেষ্ট যতক্ষণ সে জেগে থাকল, সাইকেলটা নিয়ে আপন মনে বকবক করছিল। সাইকেলটা তার জীবনের অনেক সুখদুঃখের স্মৃতি।

গার্গীরও ইচ্ছে করছিল, বলে যে, স্যুটকেসটাও তার কাছে তাই। কিন্তু চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে রইল।

ভোরবেলা গৌতমের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল ওদের। গৌতম পেছনের জানলা দিয়ে ডাকছিল। এ রাতে ওই জানলাটা বন্ধ ছিল। ঘনশ্যাম মশারি থেকে বেরিয়ে গিয়ে জানালা খুলল। দেখল, গৌতম একটা স্যুটকেস আর সেই জুতোর বাক্সটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চাপাস্বরে সে বলল, “ঝোঁপের মধ্যে পড়েছিল। শিগগির দরজা খুলুন।”

ঘনশ্যাম সদর দরজা খুলে দিলে গৌতম ঢুকল। একটু গলা চড়িয়ে বলল সে, “বৌদি! তোমার সুটকেস! দেখ কিছু চুরি গেছে নাকি।”

গার্গী ছটফটিয়ে বেরিয়ে এল। ঘনশ্যাম গুম হয়ে বলল, “উইপনটা আছে তো?”

গার্গীর হাতে সুটকেসটা দিয়ে গৌতম বিষণ্ণ হাসল। “নাহ্! জুতোসুষ্টু মেরে, দিয়েছে চোরেরা। খালি বাক্সটা পড়েছিল। আসলে আমি সারারাত ঘুমতে পারিনি। খালি মনে হচ্ছিল, এমন কিছু ঘটবে। বিশেষ করে বৌদির স্যুটকেসটা–”

গার্গী সুটকেস খুলে দেখছিল। একটু খুশিমাখা মুখে বলল, “সব আছে। নোবার মতো কিছু তো নেই এর মধ্যে।”

গৌতম বলল, “সাইকেলে নিশ্চয় তালা, দেওয়া ছিল না শ্যামদা?”

 ঘনশ্যাম আস্তে বলল, “নাহ্।”

 “কাজেই সাইকেলে চেপে পালিয়ে যাওয়া সোজা।” গৌতম হাসবার চেষ্টা করল। “আপনার সাইকেলটার যা অবস্থা ছিল দেখেছি। এবার বরং নতুন একটা কেনা হয়ে যাবে।”

কথাটা বলেই সে জুতোর বাক্সটা নিয়ে চলে গেল। গার্গীর মধ্যে এতক্ষণে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছিল। ডালাভাঙা স্যুটকেসটা ঘরে রেখে এসে সে বলল, “নাও যা হবার হয়ে গেছে। সব আমারই দোষ। আমাকে ইচ্ছে হলে মারো।” বলে সে বাথরুমে ঢুকল।

বেরিয়ে আসার পরও দেখল, ঘনশ্যাম উঠোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

গার্গী বলল, “আশ্চর্য মানুষ তুমি! সারারাত কিছু খাওনি। মুখ ধুয়ে এসো। লুচি করে দিচ্ছি। আর সাইকেল গেছে–বেশ তো! আমার কাঁকন দুটো বেচে আমিই তোমাকে নতুন সাইকেল কিনে দেব। রাগ করে বলছি না। আমার মায়ের দেওয়া গয়না। আমার গয়না পরতে ভাল লাগে না।”

ঘনশ্যাম গলার ভেতর বলল, “নাহ। ও সব কথা আমি ভাবছি না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তপু হারামজাদার গ্যাংয়ের কেউ গোপনে আড়ি পেতে ব্যাপারটা সম্ভবত দেখেছিল। সে-ই এ কাজ করেছে। সাইকেল চুরি বা তোমার স্যুটকেস চুরিটা একটা চালাকি। কে জানে, সাইকেলটা গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে। কিনা। হুঁ, শুধু জুতোর বাক্স নিয়ে গেলে তার একটা রিস্ক ছিল। ভেবেছিল গৌতম তপুর চেলাদের জানিয়ে দেবে। গৌতম কথাটা জানালে ওদের মধ্যে পরস্পর সন্দেহ ঝগড়াঝাটি বেধে যাবে। কে জিনিসটা হাতাল?” শ্বাস ছাড়ল ঘনশ্যাম। “ক্রিমিনালদের স্বভাব আমি জানি। স্বার্থের জন্য ওরা জোট বাঁধে। কিন্তু প্রত্যেকে ওরা আলাদা করে নিজের নিজের ফিকির মাথায় নিয়ে ঘোরে। দরকার হলে একজন আরেকজনকে ল্যাং মারতে দেরি করে না।”

“আহ্! আবার বুকনি ঝাড়তে শুরু করলে বাসিমুখে!”

 ঘনশ্যাম গম্ভীর মুখে বাথরুমে ঢুকল।…

.

এদিন সাইকেল নেই বলে ঘনশ্যাম একটু আগেই অফিসের জন্য বেরুচ্ছিল। গার্গী ইতস্তত করে বলল, “আমার একা থাকতে ভয় করবে, জানো? এরপর কখন ডাকাত বদমাশ এসে আমাকে মেরে রেখে গেলেই হলো।”

ঘনশ্যাম বলল, “গৌতমকে বলে যাচ্ছি বরং।”

“খালি গৌতম আর গৌতম!” গার্গী ঝেঁঝে উঠল। “একে তো সবার আমাকে দেখে চোখ টাটায়, তারপর কিছু স্ক্যান্ডাল রটিয়ে ফেললেই হলো। তুমি কোয়ার্টার বদলানোর চেষ্টা করো বরং।”

ঘনশ্যাম হাসল। “কোথায় কোয়ার্টার? মেন্টাল স্টাফের জন্য কোয়ার্টারই নেই। এটা জেনারেল স্টাফের জন্য। লাকিলি খালি ছিল বলে ম্যানেজ করেছি। তা-ও আনঅফিসিয়ালি। যে কোনও দিন জেনারেল স্টাফের কেউ বদলি হয়ে এলে পাত্তাড়ি গুটোতে হবে।”

গার্গী অবাক হয়ে বলল, “সে কী! বহরমপুরে থাকার সময় যে বলেছিল কাঁটালিয়াঘাটে কোয়ার্টার অ্যালট করা আছে?”

“তখন আমিও কি জানতুম? তবে বাসার খোঁজ করছি। দেখা যাক্।” বলে সে পা বাড়াল। “গৌতমকে বলে যাচ্ছি। যদি না থাকে বাড়িতে, কী আর করা যাবে? তুমি দরজা ভাল করে এঁটে দিও। অচেনা কাকেও ভেতরে বসতে ডেকো না।”

সে চলে যাওয়ার পর গার্গী আস্তে শ্বাস ছাড়ল। মুহূর্তের জন্য তার মনে একটা পাপবোধ স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বালা দিল। একজন সাদাসিধে ভালোমানুষ তার স্বামী। আজ অব্দি তেমন কোনও খারাপ ব্যবহার করেনি তার সঙ্গে। বাচ্চাকাচ্চা না হওয়ার জন্য নিজেকেই দায়ী করেছে। একবার হাসতে হাসতে বলেছিল, “বাবা-টাবা হওয়ার জন্য যে রকম পুরুষত্ব থাকা উচিত, আমার তা হয়তো নেই।”পুরনো কিছু কথা আলতো ভেসে এল মনে। ঘনশ্যাম মাঝে মাঝে শারীরিকভাবে অপটু হয়ে পড়ে। আপনমনে বলে, “তোমার শরীরে কী যেন আছে। আমাকে নার্ভাস করে ফেলে। এ মুহূর্তে কিছুক্ষণ লোকটার জন্য গার্গী দুঃখবোধ করল। একটু অনুতাপও জাগল। মনে হলো, সে বিশ্বাসভঙ্গ করছে। একটা চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও সে ভাবল। গৌতমকে এবার থেকে এড়িয়ে চলবে।

কিন্তু আরও কিছুক্ষণ পরে সেই অসহ্য একাকিত্ব গার্গীকে ঘিরে ধরল। তরপর সে অনুভব করল, দুটি দুপুরের নিষিদ্ধ গোপন শারীরিক সুখের স্মৃতি তাকে নাড়া দিচ্ছে। বাঘিনী মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে যেমন হিংস্র আর ধূর্ত হয়ে ওঠে, তেমনি ক্রুর আর লোভী হঠকারিতার বোধ তরঙ্গের মতো তার ওপর আছড়ে পড়েছিল।

কতক্ষণ পরে গৌতমের সাড়া পেয়ে গার্গী ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর একটু দেরি করেই সদর দরজা খুলে দিল। গৌতমকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বলল, “বসব না। একটা কথা বলতে এলুম। তোমার বরের সাইকেলটা পাওয়া গেছে।”

গার্গী ব্যস্তভাবে বলল, “কোথায়? কার কাছে?”.

“সাউথে কোদালিয়া বলে একটা গ্রাম আছে। বেশি দূরে নয়। ওখানে জেলেদের জালে আটকে ছিল। ওরা থানায় জমা দিয়ে এসেছে শুনলুম।”

“ওকে খবর দেওয়া দরকার। সাইকেল-সাইকেল করে পাগল হয়ে গেছে।

“খবর পেয়ে যাবে।”

 “তুমি বসবে না?”

গৌতম একটু হাসল। “বৃসতুম। কিন্তু”

“কিন্তু কী?”

 “কিছু না। আমি একটু ভাবনায় পড়ে গেছি। মন ভালো নেই।”

 “জুতোর বাক্সটা কী করলে?”

 “ছিড়ে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছি।”

 “তাহলে ভাবনা কিসের?”

“চোর সাইকেলটা নিল না কেন? রিভলভারটা চুরিই কি কারও মোটিভ ছিল?”

গার্গী আঁচলে মুখের ঘাম মুছে বলল, “আমার বরও ঠিক এই কথাটা বলছিল, জানো? কেউ নিশ্চয় জানত ব্যাপারটা। আড়ি পেতে দেখেছিল সম্ভবত। তপুরই গ্যাংয়ের কেউ হবে।”

গৌতম চিন্তিত মুখে বলল, “আমারও তা-ই মনে হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে, তপুর গ্যাংয়ের অন্য কেউ জানতে পারলে, কিংবা ধরো, তপু কাউকে জানিয়ে থাকলে সে আমাকে চার্জ করতে পারে।”

গার্গী বলল, “কিচ্ছু হবে না। এত ভেবো না তো। তপু কাকেও জানিয়ে গিয়ে থাকলে এতক্ষণ সে তোমাকে চাইত। তা ছাড়া যে ওটা চুরি করেছে, সে লুকিয়ে রাখবে। কাকেও জানতেই দেবে না। এস, বড্ড রোদ।”

গৌতম বলল, “পরে আসব’খন। আমি তপুর গ্যাংয়ের ছেলেদের নার্ভ ফিল করে বেড়াচ্ছি।”

“আসবে না?”

“দুটোয় আসব।”

 এখন আসবে না?

 “কী আশ্চর্য! বলছি তো”

 “বুঝেছি। আমাকে ঘেন্না ধরে গেছে!”

 গৌতম উঠোনেই ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলল, “তুমি আমার স্বর্গ!”

গার্গী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “সব সময় অসভ্যতা! কে দেখে ফেলবে, বেরোও! তোমাকে আর আসতে হবে না।”

সে ঠেলে ওকে বের করে দিল। গৌতম হাসতে হাসতে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে গার্গী বারান্দায় ফিরল। উঠোনঘেরা পাঁচিল যথেষ্ট উঁচু নেই। বারান্দায় দাঁড়ালে বাইরেটা দেখা যায়। কেউ কোথাও নেই দেখে সে আশ্বস্ত হলো। অন্যদিনের মতো স্নান করে এসে রান্নায় বসল সে।

আজ একটু দেরি করে খেতে এল ঘনশ্যাম। গার্গী তাকে সাইকেলটার কথা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ঘনশ্যাম উজ্জ্বল মুখে বলল, “আমার থিওরি!

সাইকেলটা পাওয়া গেছে। থানা থেকে হসপিটালে ফোন করেছিল আমাকে। গিয়ে আইডেন্টিফাই করলুম। ওবেলা ডেলিভারি পাব। পুলিশের হাতে কিছু পড়লে বের করা প্রব্লেম। গৌতমের বাবাকে বলায় ফোন করে বড়বাবুকে বলে দিয়েছেন।”

গার্গী একটু কৌতুক করে বলল, “সাইকেল চুরি গিয়ে না হয় ফেরত পেতে। আমি যদি চুরি যেতম?”

ঘনশ্যাম কৌতুকটা নিল না। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, “তুমি ইচ্ছে না করলে কেউ তোমাকে চুরি করবে না। হুঁ, রেপ অ্যান্ড মার্ডারের কথা আলাদা।”

গার্গী হঠাৎ চটে গেল। “ছাড়ো তো। হাত-মুখ ধুয়ে এস। ভাত বাড়ছি।”

ঘনশ্যাম একটু হাসল। “তুমি বলেছিলে পুজোর সময় ছুটি নিয়ে বাইরে যেতে। আসতে আসতে কথাটা ভাবছিলাম। বাইরে গেলে এই ঝামেলাটা হতে না। আমারও বড় হাঁপ ধরে গেছে। তো দেখি, পুজোটা যা।”

বসে সে বাথরুমে গিয়ে অন্যদিনের মতো সাবান দিয়ে রগড়ে হাত দুটো ধুল। পা ধুল। মুখে জল ছিটিয়ে মুখ ধুল। তোয়ালেতে হাত-মুখ মুছতে মুছতে ফের বলল, “সাইকেলটা জলে নাকানিচুবোনি খেয়ে কী অবস্থা হয়েছে দেখলে খারাপ লাগে। পার্ট বাই পার্ট খুলে আয়েলিং করাতে হবে। খামোকা একগাদা খরচা করাবে ব্যাটাছেলেরা। যা নেবার, তা তো নিলি। খামোকা এত ছলচাতুরীর কী দরকার ছিল? ঠিক আছে। একটা অজুহাত না হয় সাজালি। তো সাইকেলটা খামোকা গঙ্গায় ফেলতে গেলি কেন? স্রেফ বদমাইশি। থানায় রঞ্জিতবাবু কাল যে এস আই ভদ্রলোক এসেছিলেন, বললে, শ্যামবাবু! আপনার সাইকেলটা বদলান। চোরও এই বাতিল মাল পছন্দ করেনি। রাগ করে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে গেছে!” অদ্ভুত ফিক ফিক শব্দে হাসতে লাগল ঘনশ্যাম।

ভাত-তরকারি বেড়ে আসন পেতে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল গার্গী। বলল, “আচ্ছা, তুমি যে বলছ, শুধু জুতোর বাক্স চুরি করতে ঢুকেছিল–তা হলে আলমারির তালা ভাঙার চেষ্টা করল কেন?”

ঘনশ্যাম পাতে বসে বলল, “ওটা অবিশ্যি সিরিয়াস একটা অ্যাটেম্পট। ক্রিমিনালদের সাইকোলজি। যা নেবার, তা নিয়ে ভেবেছিল, কিছু মালকড়ি গয়নাগাঁটি যদি পেয়ে যায়, সেটা উপরি লাভ। রঞ্জিতবাবু কারেক্ট। ব্যাটাচ্ছেলের ওই পুরনো সাইকেল মনে ধরেনি। রাগ করে ফেলে দিয়েছে।” ডাল ঢেলে মাখিয়ে একগ্লাস ভাত তুলে সে ফের বলল, “কে জানে, আমার ওপর রাগ ছিল কি না। হাসপাতালে চাকরির এই এক প্রবলেম আজকাল।”

“খুব হয়েছে। এবার চুপচাপ খেয়ে নাও তো।”

ঘনশ্যাম তার দিকে তাকিয়ে ভাত মুখে দিল। বলল, “বেলা হয়েছে। তুমিও খেয়ে নিলে পারতে।”

“খাচ্ছি। আর বকবক কোরো না। গলায় ভাত আটকে যাবে।”

ঘনশ্যাম বেরিয়ে যাওয়ার পর অন্যমনস্কভাবে খেতে বসল গার্গী। ঘনশ্যামের বেড়াতে যাওয়ার কথাটা তার বুকে ধাক্কা দিয়েছিল। বিয়ের পর সেই একবার ক’দিনের জন্য দীঘায় হনিমুনের নাম করে বেড়াতে গিয়েছিল দুজনে। তখন কত স্বপ্নসাধ জেগে উঠেছিল গার্গীর জীবনে। পরে দিন-দিনে দেখল সে একটা ভুল লোকের সহগামিনী হয়েছে, যে সৌন্দর্য বোঝে না, আনন্দের স্বাদ নিতে জানে না। শুধু এলেবেলে কথার বুকনি ঝাড়ে। পাইপয়সা হিসেব করে সংসার চালায়। কিছু কেনার ইচ্ছে হলে গার্গীকে মুখ ফুটে টাকা চেয়ে নিতে হয়। এ ভাবে বেঁচে থাকার কী মানে হয়?

খাওয়ার পর উত্তরের জানলার ধারে বসে গার্গীর মনে হলো, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কী একটা সর্বনাশা শক্তি তাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে এবং তাকে যে রক্ষা করতে পারত, সেই মানুষটা বড় বেশি নির্বিকার।

ছাতিম গাছটার দিকে চোখ পড়তেই গার্গীর বুকের ভেতর একটা ঠাণ্ডা হিম ঢিল গড়িয়ে গেল। উজ্জ্বল আশ্বিনের রোদে গাছটাকে ভয়াল আর জৈব দেখাচ্ছে। গাছটা যেন তাকে আকর্ষণ করছে। চোখ ফিরিয়ে নিল গার্গী। ট্রানজিস্টারের নব ঘোরাল। চটুল হিন্দি গানের সুর।

দরজায় আস্তে কড়ানাড়ার শব্দ কানে এল। গার্গী বেরিয়ে গিয়ে বলল, “কে?”

গৌতম।

যৌবন যৌবনকে দরজা খুলে দিল।…

.