ভালবাসার অন্ধকারে – ২

০২.

ঘনশ্যাম কোনও-কোনও দিন দেরি করে বাড়ি ফেরে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সে ইঞ্জেকশন দেওয়ার কল অ্যাটেন্ড করতে যায় এবাড়ি ওবাড়ি। সে ডাক্তার নয়। কিন্তু ডাক্তার হাসপাতালের সংসর্গে ওষুধপত্র এবং ইঞ্জেকশনের অভিজ্ঞতা আছে তার। গার্গী বোঝে ঘনশ্যাম বাড়তি রোজাগারের ধান্দায় থাকে। কখনও তার এমন সন্দেহও হয়েছে, তার স্বামী হাসপাতালের ওষুধ-পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত কি না। কিন্তু ঘনশ্যাম এমন সিরিয়াস প্রকৃতির মানুষ তাকে জিজ্ঞেস করতেই বাধে গার্গীর। তা ছাড়া ঘনশ্যামের হাবভাব বা কথাবার্তায় কোনও লুকোচুরির ছাপ সে এ পর্যন্ত লক্ষ্য করেনি।

এদিন বিকেলে গার্গী মনে মনে গৌতমের প্রতীক্ষা করছিল। জীবনে প্রথম ভালবাসা তীব্র মাদকতাময় প্রতীক্ষা। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে গেল, গৌতম এল না। হঠকারিতার জন্য সেকি লজ্জা পেয়েছে? গার্গী অস্থির হয়ে ঘরবার করছিল। সন্ধ্যার মুখে ঘনশ্যাম বাড়ি ফিরল। বলল, “ভেবেছিলুম, আমার দেরি দেখে বেড়াতে বেরিয়েছ। গৌতম আসেনি?”

গার্গী ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “না। সবসময় খালি গৌতম-গৌতম কোরো না তো!”

“কী আশ্চর্য!” ঘনশ্যাম একটু হাসল। মুখে ক্লান্তির ছাপ। “ইয়ে–এক কাপ চা পেলে ভাল হতো।”

 “এমন করে বলছ কেন? কোনও দিন আমি চা করে খাওয়াই না?” গার্গী চটে গেল।

ঘনশ্যাম বারান্দায় একটা চেয়ার এনে বসে বলল, “আজ বড্ড ঝামেলা গেল। গ্রাম থেকে একটা মেন্টাল পেশেন্ট এসেছিল। সে এমন ভাঙচুর শুরু করল, আটকানো কঠিন! আমাকে বোতল ছুঁড়েছিল। একটুর জন্য বেঁচে গেছি। সেই নিয়ে তারপর এদিকে এক কাণ্ড। হরবাবুর ইনসমনিয়া। ঠিক ঘুমের ওষুধ নয়, নার্ভ ঠাণ্ডা রাখার জন্য ট্রাংকুলাইজার দিতুম। কাল দিয়েছিলুম নাইট্রাজেপাম। ১০ মিলিগ্রাম। ভদ্রলোক দুটো ট্যাবলেট খেয়ে কেলেংকারি করে বসেছিলেন। আসলে আনঅফিসিয়াল ডাক্তারি করার বিপদ আছে।”

গার্গী কিচেনের বারান্দায় একটা টেবিলে কুকার জ্বেলে কেটলি চাপাচ্ছিল। কথাগুলো শুনে বলল, “কী হয়েছে হরুবাবুর?”

“হয়নি, হতে পারত। খামোকা হরুবাবুর ভাইপো তপু আমাকে গালমন্দ করল।”

 “তপু?” গার্গী চমকে উঠেছিল। “সেই গুণ্ডাটা?”

ঘনশ্যাম শ্বাস ছেড়ে বলল, “হ্যা! ছেড়ে দাও। দেশে আইন-কানুন বলে তো আজকাল কিছু নেই। আমার চৌদ্দপুরুষের ভাগ্য, গায়ে হাত তোলেনি।”

গার্গী ফুঁসে উঠল। “তপুকে ইচ্ছে করলে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারি জানো?”

ঘনশ্যাম তাকাল।

 গার্গী চাপা স্বরে বলল, “চা খেয়ে নাও, সব বলছি।”

ঘনশ্যামের যেন কোন ব্যাপারে কৌতূহল নেই, গার্গী বরাবর দেখে আসছে! ওর কেঠো নীরস চেহারার মতো যেন ওর মন। তবে নিজের কথাটা বেশি করেই বলার স্বভাব আছে। অন্যর কথায় তত কান করে না।

একটু পরে চায়ের কাপ ওর হাতে তুলে দিয়ে গার্গী আস্তে বলল, “তুমি এত গৌতম গৌতম করো। গৌতমের খাতিরেই জিনিসটা নিতে হলো। কী জিনিস জানেনা?”

ঘনশ্যাম আবার নিষ্পলক চোখে তাকাল শুধু।

গার্গী ফিসফিস করে বলল, “তপুর রিভলভার। একটা জুতোর বাক্সয় ভরে গৌতম দিয়ে গেল। খাটের তলায় লুকিয়ে রেখেছি।”

“রিভলভার।”

“তাই বলল গৌতম। তপুদের বাড়িতে নাকি পুলিশ-রেড হবে।” গার্গী দম নিয়ে বলল, “আমি সাহস পাইনি খুলে দেখতে। তুমি দেখবে তো দেখ গিয়ে। আর শোন! গৌতমকে বলে দিও, এভাবে যেন কক্ষণো”

ঘনশ্যাম কেমন হাসল। “ছেড়ে দাও। গৌতম ভাল ছেলে। রেখে গেছে। নিয়ে যাবে’খন।”

বাড়িতে বেআইনি সাংঘাতিক একটা চোরাই জিনিস থাকলে সব নিরীহ মানুষের মনে একটা দুরুদুরু ভয় আর উৎকণ্ঠা থাকা স্বাভাবিক। গার্গীর মনে সেটা ছিল না, তা নয়। কিন্তু গৌতমের কাছে নিঃশেষে আত্মসমর্পণে আর নিষিদ্ধ ভালবাসার গোপন সুখ সেটা চাপা দিয়ে রেখেছিল। ঘটনাটা ঘনশ্যামকে ঝোঁকের বশে বলে ফেলে সে গৌতমের ওপর রাগ দেখিয়ে আসলে কৈফিয়ত দিতেই চেয়েছিল। কিন্তু ঘনশ্যামের এই নির্বিকার ভাব তাকে আশ্বস্ত করল।

তবু গার্গী না বলে পরল না, “গৌতম যদি এত ভাল, তা হলে গুণ্ডাদের সঙ্গে মেশে কেন? আমার কিন্তু বড্ড ভয় করছে।”

ঘনশ্যাম চায়ে চুমুক দিয়ে ফের সেইরকম কেঠো হাসি হাসল। “যখন ওটা নিয়েই ফেলেছ, তখন আর ভয় কিসের? জেনেশুনেই তো নিয়েছ।”

“কী করব?” গার্গী আবার ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “তোমার খাতিরের লোক। তুমি ওকে পাত্তা দাও বলেই–এখন তো বেশ বলছ! যদি ওকে না করে দিতুম, তুমি বলতে”

ঘনশ্যাম বলল, “ছেড়ে দাও।”

গার্গী স্বামীর এতখানি নির্বিকার আচরণ আজ সহ্য করতে পারছিল না। “না। তুমি শোনো, ওকে ডেকে নিয়ে এস। ওটা নিয়ে যেতে বলো। যদি কোনভাবে পুলিশ জেনে যায়, কী হবে বুঝতে পারছ? সেই দুপুর থেকে আমি তোমার এথ তাকাচ্ছি তুমি এলে আপদটা বিদায় করব ভেবে। না, না! তুমি এক্ষুণি যাও। ওকে বুঝিয়ে বলল, অন্যকে খামোকা বিপদের মুখে ফেলে দেওয়া কি ভাল?”

ঘনশ্যাম গা করল না। আস্তেসুস্থে চা খেয়ে সিগারেট ধরাল। তারপর একটু হাসল। “কই, চলো তো জিনিসটা দেখি।”

গার্গী দ্রুত ঘরে ঢুকে খাটের তলা থেকে জুতোর বাক্সটা বের করল। মশার উৎপাতের জন্য সব জানলা বন্ধ। ঘনশ্যাম ঘরে ঢুকলে সে দরজাটাও বন্ধ করে ফ্যান চালিয়ে দিল। ঘরে ষাট ওয়াট বাল্বের আলো। বলল, “তুমি খুলে দেখ। আমার ভয় করছে। সাবধানে খুলবে কিন্তু! যদি গুলি বেরিয়ে যায়, কেলেংকারি হবে।”

ঘনশ্যাম দড়িটা সাবধানেই খুলল। তারপর বাক্সটা খুলতেই দেখা গেল, ভেতরে দুটো বুট জুতো ঠাসাঠাসি করে রাখা।

গার্গী একটু অবাক হয়ে বলল, “জুতো! তবে যে গৌতম বলল–” বলেই সে হেসে ফেলল। “গৌতমের চালাকি! কোনও মানে হয়? মিছিমিছি ভয় দেখিয়ে গেল। সবসময় স্টান্ট, আর দুষ্টুমি।”

ঘনশ্যাম একটা জুতো বের করে ভেতরে হাত ভরল। তারপর একটা রুপোলি ছোট্ট আগ্নেয়াস্ত্র বের করল। গার্গী চমকে উঠে তাকিয়ে রইল। ঘনশ্যাম খুঁটিয়ে অস্ত্রটা দেখে আস্তে বলল, “চীনা রিভলভার।”

শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে গার্গী বলল, “কী করে বুঝলে?”

 “এই যে চীনা ভাষায় কী সব লেখা আছে। হ্যাঁমার নেই। কাজেই অটোমেটিক।” বলে সে গুলির কেসটা অনেক টেপাটেপি করে খুলল। কেসে গুলি ভরা নেই। কেসটা বন্ধ করে সে অন্য জুতোয় হাত ভরে কাগজের একটা মোড়ক বের করল। মোড়কের ভেতর অনেকগুলো খুদে গুলি। নেলপালিশের শিশির গড়ন। মাথায় সুচালো কালো একচিলতে জিনিস দেখিয়ে সে বলল, “এই কালচে অংশটা দেখছ, এটাই আসল গুলি। সিসের টুকরো। ট্রিগার টানলে এইটে বেরিয়ে যায়। মানুষের গায়ে লাগলে কী হয় জানো? মাংসের ভেতর ঢুকে চক্কর মেরে বেড়ায়। স্পিড শেষ হলে একখানে আটকে থাকে।”

গার্গী রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল। বলল, “তুমি কী করে জানলে গো?”

তার কণ্ঠস্বরে ছটফটানি ছিল। ঘনশ্যাম একটু হাসল। “আমার এক ক্লাসফ্রেন্ড শ্যামল বউবাজার থানায় পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিল। আমার তো জানো সবতাতে আগ্রহ আছে। পিস্তল কাকে বলে, রিভলভারই বা কাকে বলে, সব বুঝিয়ে দিয়েছিল। পিস্তলে আঠারোটা পর্যন্ত গুলি থাকে। কিন্তু পিস্তলের গুলি বডিতে সোজা ঢুকে যায়। আর রিভলভারের নলের ভেতরটা ঘোরানো স্কুর প্যাঁচের মতো। তাই গুলি ঘুরতে ঘুরতে বেরিয়ে গিয়ে বডিতে ঢোকে। ঢুকেও কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ায়।

 “চুপ করো! আমার ভয় করছে।” গার্গী ব্যস্তভাবে বলল।

“যেমন ছিল, তেমনি রেখে দাও। আর শোনো, এক্ষুণি গিয়ে গৌতমকে ডেকে আনো।”

ঘনশ্যাম বাক্সটা আগের মত দড়ি দিয়ে বেঁধে বলল, “গৌতম কি আমাকে কিছু বলতে বারণ করেছিল?”

“না। জানালা দিয়ে বাক্সটা ঢুকিয়ে রাখতে বলল। তোমার কথা কিছু বলেনি।”

“থাক। রেখে দাও। ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। নিয়ে যাবে’খন।”

গার্গী বাক্সটা খাটের তলায় লুকিয়ে রেখে দরজা খুলে দিল। ঘনশ্যাম খাটে বসে সিগারেট টানতে থাকল। মুখে একই নির্বিকার উদাসীন ভাব।

গার্গী তাকে লক্ষ্য করছিল। একটু পরে বলল, “তুমি এখন কিছু খাবে?”

“নাহ্। ঘাটবাজারে নরেনের পাল্লায় পড়ে দুটো সিঙ্গাড়া খেয়েছি।” ঘনশ্যাম হাত বাড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে সিগারেটটা খুঁজে দিল। বলল, “নরেনেরও একই প্রব্লেম। এখান থেকে ট্রান্সফার হতে পারলে বেঁচে যায়। ওদের হেলেথ সেন্টারে ইউনিয়নবাজি। তার ওপর মস্তানদের গ্যাংয়ের হামলা। পরশু একটা ইনজুরি কেসের পেশেন্ট মারা গেল। তাই নিয়ে ভাঙচুর মারধর। আজকাল ল অ্যান্ড অর্ডার বলে কিছু নেই।”

ঘনশ্যাম হাসপাতালের গল্প করতে লাগল। রোজ তা-ই করে। গার্গীর মনে হয়, একটা রোবোটের সঙ্গে সে সংসার করছে। কোনও আবেগ নেই। জীবনের উত্তাপ নেই। এমন কি, রাতের শয্যায় শরীরে শরীর মেলানোর যে জৈব উন্মাদনা, তাও ঘনশ্যামের মধ্যে যেন নেই। খাওয়া-দাওয়া, অফিস যাওয়া ও ফিরে আসা বা জীবনযাপনের আরও অনেক রীতির মধ্যে তার যে রুটিনবাঁধা আচরণ, দাম্পত্য জীবনেও তা-ই। এ রাতে স্বামীর পাশে শুয়ে সহসা গার্গীর মনে পতনের পাপবোধ জেগে উঠেছিল এবং অনুশোচনায় আক্রান্ত গার্গী মনেপ্রাণে চাইছিল, তার স্বামী তাকে বাঁচাক পাল্টা তীব্র ভালবাসা দিয়ে। সে তার বুকে হাত রেখে গালে ঠোঁট ঠেকাল। কিন্তু ঘনশ্যাম সাড়া দিল না। একটু পরে তার নাক ডাকতে থাকল। তখন গার্গী ঘুরে শুল।

.

সকালে ঘনশ্যাম রোজকার মতো বাজারে গিয়েছিল।

গার্গী গৌতমের প্রতীক্ষা করছিল। একটু পরে সে নিজের আচরণে নিজেই অবাক হয়েছিল। এমন করে সে তো এতদিন কারও প্রতীক্ষা করেনি! ছটফটানি ভরা এই পথ চেয়ে থাকা তার জীবনে একেবারে নতুন। আগে গৌতম এলে তার ভাল লেগেছে। কিন্তু তার পথ তাকিয়ে থাকেনি। গার্গীর মনে হচ্ছিল, হঠাৎ সে নিজে নতুন হয়ে উঠেছে, তেমনি গৌতমও তার কাছে নতুন হয়ে উঠেছে।

আর এই ছটফটানির মধ্যে আনন্দভরা আবেগ আছে। নিষিদ্ধ সৌন্দর্যে সাজানো যৌবনপূর্ণ পৌরুষের প্রতি আহ্বান আছে।

গার্গীর মধ্যে সেই আবেগ ছিল, যে আবেগে বৃক্ষেরা ফুলবতী হয়। নদী হয় স্রোতবতী। আকাশ ভরে মেঘ জমে ওঠে। বৃষ্টির ধারা ভাসিয়ে দেয় ধুলোমাটির জগৎটাকে। এ আবেগ প্রকৃতির খুব গভীর গোপন আবেগ। দিন মাস ঋতু বর্ষচক্র বহমান সেই টানে। রোদ-জ্যোৎস্না-অন্ধকারের খেলা চলে জীবজগৎকে ঘিরে।

গার্গী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিল। গৌতম তাকে অসাধারণ সুন্দরী বলেছিল। সত্যি কি সে তা-ই?

“ওদিকে এক কাণ্ড!” ঘনশ্যামের সাড়া পেয়ে সে বেরুল। ঘনশ্যাম সাইকেল উঠোনে রেখে বাজারের থলে হাতে বারান্দায় উঠল। মুখটা গম্ভীর।

গার্গী বলল, “কী?”

 “কাল রাত্তিরে আবার বেধেছিল দুই গ্যাংয়ে। খুব বোমাবাজি হয়েছে।”

 গার্গী দ্রুত বলল, “হ্যাঁ। অনেক রাত্রে শব্দ শুনেছিলুম যেন।”

ঘনশ্যাম থলেটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে একটু হাসল। “তপু হারামজাদা খুব বেড়েছিল। গেল!”

গার্গী চমকে উঠল। “গেল মানে?”

“ডেড। বডি ঝাঁঝরা।” ঘনশ্যাম চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাল। “ক্লাব থেকে বাড়ি ফিরছিল। এদিকে কেলোরা ওত পেতে ছিল। বুড়ো শিবতলার ওখানে এসেছে, অমনি বোম চার্জ করেছে। তপুর সঙ্গেও কয়েকজন ছিল। থাকলে কী হবে? আনএক্সপেক্টে অ্যাটাক। পরে বোমাটোমা এনে খুব ফাটিয়েছে। ততক্ষণে কেলোরা ভ্যানিশ। পুলিশের যা নিয়ম–তিনঘণ্টা পরে এসে নিরীহ লোকদের ধরে হম্বিতম্বি–”

 “গৌতম?” গলা কেঁপে গেল গার্গীর। “গৌতমকে ধরেনি তো?”

ঘনশ্যাম আবার হাসল। “গৌতমের কী? সে তো আউট সাইডার। রাস্তায় দেখা হলো। বলল, যাচ্ছি। কথা আছে। আমি কিছু বললাম না অবিশ্যি।”

গার্গী শুকনো মুখে বলল, “তপু মরে গেছে?”

শুনছ কি? বডি প্রায় টুকরো টুকরো। একসঙ্গে কয়েকটা বোমার এক্সপ্লোশন!” ঘনশ্যাম ধোঁয়ার রিঙ পাকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, “একেই বলে নিয়তি। কাল বিকেলে আমাকে শাসাচ্ছিল ব্যাটাচ্ছেলে। একবার ভাবলুম, যাব নাকি গোপেশ্বরবাবুর কাছে। ওঁরই চেলা ছিল শুওরের বাচ্চা। পরে ব্রতীনবাবার পার্টিতে ঢোকে। পারল ব্রতীনবাবু বাঁচাতে? ওর নাম গলাকাটা কালী। মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে ব্রতীনবাবুর সঙ্গে ঘোরে বডিগার্ড হয়ে। তবে জানো? কাঁটালিয়াঘাটে আবার অশান্তি শুরু হলো। বহরমপুরে থাকতেই শুনেছিলুম ডেঞ্জারাস জায়গা। অনেক চেষ্টা করেও ট্রান্সফার ঠেকাতে পারলুম না।”

গার্গী আস্তে বলল, “তোমার কী? তুমি তো কোনও পার্টিতে নেই।”

 “নেই। তবে কথা কী জানো “।

 “না। এখানকার কোনও ব্যাপারে তুমি নাক গলাবে না।”

ঘনশ্যাম একটু চুপ করে থেকে বলল, “আজকাল প্রব্লেম হলো, কোনও একটা পক্ষে না ঢুকলে মাথা বাঁচানো কঠিন। রাম মারবে, নয়তো রাবণ মারবে। হাসপিট্যাল কমপ্লেক্সে তিনটে ইউনিয়ন। তিনটের সঙ্গে লোক্যাল লিডারদের কানেকশান আছে। আমাদের মতো নিরীহ লোকেদের হয়েছে জ্বালা।”

সদর দরজা খোলা ছিল। গৌতম ঢুকেই দরজা বন্ধ করল।

 গার্গী কিচেনের সামনে মেঝেয় থলে থেকে তরিতরকারি ঢালছিল। একটা আধকেজিটাক পোনা এনেছে ঘনশ্যাম। সেটা নড়ছে। গার্গী গৌতমের দিকে তাকাল।

গৌতমের মুখ গম্ভীর। বারান্দায় উঠে বলল, “পুরো ছুটিটা আর কাটানো হলো না হয়তো।”

ঘনশ্যাম বলল, “কেন?”

 গৌতম গার্গীর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে চাপা স্বরে বলল, “আমি একটা অপকর্ম করে ফেলেছি। অবশ্য বৌদির কোনও দোষ নেই। তা হলেও শ্যামদাকে বলা উচিত ছিল। কাল বিকেলে একটা কাজে জড়িয়ে গেলুম। আসা হলো না। তো”–

গার্গী আস্তে বলল, “তোমার দাদাকে বলে দিয়েছি। আমার ভয় করছিল।”

গৌতম ঘনশ্যামের দিকে তাকাল। ঘনশ্যাম একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল, “তপুটা বোকা। উইপনটা সঙ্গে থাকলে বেঁচে যেত হয় তো।”

গৌতম বলল, “আসলে পুলিশ-রেডের ভয়ে–আপনি শুনে থাকবেন, গোপেশ্বরবাবু তপুকে শায়েস্তা করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। রুলিং পার্টির এম এল এ-কে পুলিশ খাতির করতে বাধ্য। এনিওয়ে, এখন আমার প্রব্লেম হলো, আমি জানি না তপু কাকেও জানিয়ে গেছে কি না যে, ওটা আমাকে রাখতে দিয়েছিল।”

 গার্গী বলল, “কাকেও বলে গেলে সে তোমাকে চাইবে। তখন দিয়ে দেবে।”

ঘনশ্যামও সায় দিল। “হাঃ! ফেরত দেবে।” বলে সে গার্গীর দিকে ঘুরল। “চা করো। বেচারাকে বড় নার্ভাস দেখাচ্ছে।” সে খিকখিক্‌ শব্দে অদ্ভুত হাসল। তারপর উঠে দাঁড়াল। বসার ঘরে চলে গেল।

গার্গীর চোখে এই মুহূর্তে ভালবাসা ঝিকমিক করে উঠল। মুখ টিপে হেসে সে কুকার ধরাতে উঠে দাঁড়াল।

গৌতম জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল গার্গী হাসল কেন। কিন্তু ঘনশ্যাম এসে গেল একটা চেয়ার নিয়ে। চেয়ারটা রেখে বলল, “বসো। বি কাম অ্যান্ড কোয়ায়েট। একটা ট্রাংকুলাইজার দেব’খন। রাত্তিরে খেয়ে শোবে।”

গৌতম বসে বলল, “সত্যি শ্যামদা, বড্ড আনইজি ফিল করছি। এখানে এসে এভাবে অ্যান্টিসোস্যালদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ব চিন্তাও করিনি। আসলে তরুণ সংঘ ক্লাবে তপুর সঙ্গে আলাপ। তখনও জানতুম না ও একটা ক্রিমিন্যাল!”

ঘনশ্যাম বলল, “চেহারা হাবভাব দেখে মানুষ চেনা যায় না। মেন্টাল হসপিটালে তুমি তো গেছ। দেখেছ তো অত্যন্ত সুস্থ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে য়াকে, সে ভেতরে একজন মেন্টাল পেশেন্ট। তুমি অবিশ্যি পিডিয়াট্রিকের ডাক্তার হতে চলেছ।” আবার অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল সে। “তোমার মধ্যে শিশু-শিশু ভাব আছে। শিশু চিকিৎসায় এটা কাজ দেবে। কিন্তু সেজন্য শিশু সাইকোলজিও তো পড়তে হয়েছে। মূল কথাটা হলো, সাইকোলজি! তোমার বাবা বলেন–”

গৌতম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “প্লিজ শ্যামদা! বরং এই নিন, সিগারেট খান।”

“দাও। তবে জাস্ট আ মিনিট। চা খেয়ে ধরাব।”

গার্গী চুপচাপ চা করছিল। দু’পেয়ালা চা এনে দিয়ে আস্তে বলল, “তুমি ওটা। বরং নিয়ে যাও গৌতম। আমার বড্ড ভয় করছে।”

গৌতম বলল, “এখন নিয়ে যাওয়া তো রিস্কি। তাছাড়া রাখব কোথায়?”

 “ওটা তো জুতোর বাক্স। জুতো বলেই বাড়িতে কোথাও রাখবে।”

“মাথা খারাপ? ওটা নিয়ে ঢুকলেই জুতো দেখতে চাইবে বাড়িসুষ্ঠু।”

ঘনশ্যাম বলল, “হ্যাঁ। রিস্ক আছে। বরং দেখ কয়েকটা দিন। যদি তপু কাকেও জানিয়ে গিয়ে থাকে, সে চাইলে গোপনে ফেরত দেবে। ব্যস্! ল্যাঠা চুকে গেল।”

গৌতম বলল, “যদি কাকেও না জানিয়ে থাকে, আমি ওটা নিয়ে কী করব?”

গার্গী শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “কাছেই গঙ্গা। গঙ্গায় ফেলে দেবে।”

ঘনশ্যাম মাথা নেড়ে সায় দিল। “ঠিক। ঠিক বলেছ। কাছেই মা গঙ্গা। সব পাপ বুকের তলায় লুকিয়ে ফেলবেন।” বলে সে সেইরকম অদ্ভুত শব্দে খিকখিক করে হাসতে লাগল।…

.