পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বীরের বাহু ধরায় অতুল,
নয় সে কোথাও নিঃস্ব,
মরুভূমেও সৃষ্টি করে
নতুন কত বিশ্ব!
.
চন্দ্রপ্রকাশের পদধ্বনি মিলিয়ে যেতে না যেতেই ঘরের বাইরে শোনা গেল বহুকণ্ঠে কোলাহল ও সঙ্গে সঙ্গে জয়ধ্বনি—’জয়, মহারাজা কচগুপ্তের জয়!’
কুমারদেবী নিজের মনেই অভিভূত স্বরে বললেন, ‘এখনও অভিষেক হয়নি, এখনও মহারাজের মৃতদেহ শীতল হয়নি, এরই মধ্যে কচ হয়েছে মহারাজা! কী সুপুত্র!’
ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল কয়েকজন সশস্ত্র সৈন্য। কিন্তু তারা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করবার আগেই, কুমারদেবী তাড়াতাড়ি এগিয়ে তাদের সামনে নিয়ে দাঁড়ালেন। তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী চাও তোমরা?’
মহারানিকে দেখে সৈনিকরা থতোমতো খেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়াল। কেবল তাদের একজন বললে, ‘আমরা এসেছি কুমার চন্দ্রপ্রকাশের—’
বাধা দিয়ে কুমারদেবী বললেন, ‘না, কুমার নয়—বলো যুবরাজ চন্দ্রপ্রকাশ!’
পিছন থেকে ক্রুদ্ধ স্বরে শোনা গেল, আমি হচ্ছি জ্যেষ্ঠ পুত্র। এ রাজ্যের যুবরাজ হচ্ছি আমি।’
কুমারদেবী বললেন, ‘কে, কচ? কিন্তু কে বললে তুমি যুবরাজ? শুনছি তো এরই মধ্যে তুমি নাকি মহারাজা উপাধি পেয়েছ!’
কচ এগিয়ে এসে বললেন, ‘সিংহাসন শূন্য হলে তা প্রাপ্য হয় যুবরাজেরই। সেইজন্যেই আমার সৈনিকরা আমাকে ‘মহারাজা’ বলে সম্বোধন করছে।
প্রধানমন্ত্রী এতক্ষণ পরে কথা কইলেন। হতভম্ব ভাবটা সামলে নিয়ে তিনি বলনে, ‘রাজকুমার, স্বর্গীয় মহারাজের আদেশে এখন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়েছে চন্দ্রপ্রকাশ। সুতরাং ‘মহারাজা’ উপাধির উপরে আপনার আর কোনওই দাবি নেই!’
কচ কর্কশস্বরে বললেন, ‘বৃদ্ধ, আমার মুখের উপরে কথা কইতে তুমি সাহস করো! স্বর্গীয় মহারাজের আদেশ? কে শুনেছে তাঁর আদেশ?’
ঘরের ভিতর থেকে মন্ত্রীরা সমস্বরে বললেন, ‘আমরা সবাই শুনেছি।’
প্রচণ্ড ক্রোধে প্রায় আত্মহারা হয়ে কচ চিৎকার করে বললেন, ‘ষড়যন্ত্র। রাজভৃত্যদের এতবড় স্পর্ধা! সৈন্যগণ ওদের বন্দি করো। আর, সব ষড়যন্ত্রের মূল চন্দ্রপ্রকাশ কাপুরুষের মতো ঘরের ভিতরে কোথায় লুকিয়ে আছে, খুঁজে দেখো।’
কুমারদেবীর দুই চক্ষে জ্বলে উঠল আগুনের ফিনকি। দরজার দিকে দুই বাহু বিস্তার করে গম্ভীর স্বরে তিনি বললেন, ‘স্বর্গীয় মহারাজা শুয়ে আছেন এখানে শেষ-শয়ানে। সাধারণ সৈনিক এসে এ ঘরের পবিত্রতা নষ্ট করবে? আমি বেঁচে থাকতে তা হবে না! কচ—কচ, তোমার আদেশ প্রত্যাহার করো।’
কচ অধীর স্বরে বললেন, ‘সৈন্যগণ, এখন নারীর মিনতি শোনবার সময় নেই, যাও—আমার আদেশ পালন করো!’
কুমারদেবী বললেন, ‘কচ, আমি নারী হতে পারি, কিন্তু আমি তোমাদের মাতা!’
কচ উপহাসের হাসি হেসে বললেন, ‘ভুলে যাবেন না, আপনি আমার বিমাতা।’
কুমারদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘উত্তম। কিন্তু জেনে রাখো কচ, তোমার সৈন্যদের এ ঘরে ঢুকতে হবে আমার মৃতদেহ মাড়িয়ে!’
কচ বললেন, ‘শুনুন মহারানি, আমি এই শেষবার অনুরোধ করছি, হয় পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ান, নয় চন্দ্রপ্রকাশকে আমাদের হাতে এখনই সমর্পণ করুন।’
‘চন্দ্রপ্রকাশ এ ঘরে নেই।’
‘মিথ্যা কথা!’
তীব্রস্বরে কুমারদেবী বললেন, ‘কী! কার সঙ্গে কথা কইছ সে কথা কি তুমি ভুলে গিয়েছ? হতভাগ্য পুত্র, তুমি কি জানো না পবিত্র লিচ্ছবি রাজবংশে আমার জন্ম, স্বর্গীয় মহারাজা পর্যন্ত চিরদিন আমার বংশমর্যাদা রক্ষা করে চলতেন? এত স্পর্ধা তোমার, আমায় বলো মিথ্যাবাদী? তুমি কি ভাবছ, চন্দ্রপ্রকাশ এখানে থাকলে আমার এই অপমান সে সহ্য করত?’
হা হা করে হেসে উঠে কচ বললেন, ‘অপমান সহ্য করা ছাড়া তার আর উপায় কী—আমার সৈন্যদের হাতে হাতে জ্বলছে শাণিত তরবারি!…নারী, নারী, পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াও, আমার ধৈর্যের উপরে আর অত্যাচার কোরো না!’
প্রধানমন্ত্রী ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘মহারানি, আপনি সরে আসুন, ওরা এসে দেখে যাক রাজকুমার ঘরের ভিতরে আছেন কিনা!’
গর্বিত, দৃঢ়স্বরে কুমারদেবী বললেন, ‘না, না মন্ত্রীমশাই, মহারাজের পবিত্র দেহ যেখানে আছে, এই হিংস্র পশুদের সেখানে আমি কিছুতেই পদার্পণ করতে দেব না। আমার স্বামীর, আমার দেবতার গায়ে পড়বে কুকুরের ছায়া? অসম্ভব!’
কচ কঠোর স্বরে বললেন, ‘সৈন্যগণ, এই নারীকে তোমরা বন্দি করো।’
পিছন থেকে সুগম্ভীর কণ্ঠস্বর জাগল, ‘দাদা, কাকে তুমি বন্দি করবে?’
সচমকে ফিরে কচ সবিস্ময়ে দেখলেন, বিস্তৃত অলিন্দের উপরে এসে আবির্ভূত হয়েছেন চন্দ্রপ্রকাশ এবং তাঁর পিছনে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে একদল লিচ্ছবি সৈন্য। প্রত্যেক সৈন্যের মস্তকে ও দেহে শিরস্ত্রাণ বর্ম, হাতে বর্শা, কোমরে তরবারি।
কুমারদেবী সভয়ে বলে উঠলেন, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, চন্দ্রপ্রকাশ। তুমিও আমার কথার অবাধ্য? হা অদৃষ্ট, মহারাজের শেষ নিশ্বাস-বায়ু হয়তো এখনও এখান থেকে লুপ্ত হয়নি, এর মধ্যেই রাজবাড়ির সমস্ত রীতিনীতি বদলে গেল? বেশ, তাহলে তোমরা দুই ভাই মিলে যত খুশি হানাহানি রক্তারক্তি করো, সে দৃশ্য আমি আর স্বচক্ষে দেখব না। কিন্তু দয়া করে একদিন তোমরা অপেক্ষা করো, ভ্রাতৃবিরোধ দেখবার আগেই মহারাজের সঙ্গে আমি সহগমন করতে চাই!’
চন্দ্রপ্রকাশ ব্যথিত স্বরে বললেন, ‘মা, মা, তুমিও আমাকে ভুল বুঝো না মা! আমি তোমার অবাধ্য ছেলে নই!’
‘অবাধ্য ছেলে নও? তবে কেন তুমি আবার এখানে ফিরে এলে?’
‘মা, বাধ্যতারও কি একটা সীমা নেই? লিচ্ছবি সৈন্যদের সঙ্গে আমি তো গঙ্গাপার হয়ে বৈশালী রাজ্যের দিকে যাত্রা করেছিলুম। কিন্তু যেতে যেতে হঠাৎ আমার ভয় হল, মগধের রাজবাড়িতে হয়তো তোমার জীবনও আর নিরাপদ নয়। লিচ্ছবি সেনাপতিও সেই সন্দেহ প্রকাশ করলেন। তাই আমি ফিরে এসেছি আর দেখছি যে আমার ভয় অমূলক নয়।’
‘অন্যায় করেছ চন্দ্রপ্রকাশ, অন্যায় করেছ। আমার মতো তুচ্ছ এক নারীর জন্যে তুমি কি স্বদেশের প্রতি তোমার কর্তব্য পালন করবে না, নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবে? শ্রীরামচন্দ্র যেদিন পিতার কাছে নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবার জন্যে অরণ্যে যাত্রা করেন, সেদিন কি মা কৌশল্যার দুই চোখ শুকনো ছিল? কিন্তু মায়ের চোখে অশ্রু দেখে শ্রীরামচন্দ্র কি নিজের প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গিয়েছিলেন?’
চন্দ্রপ্রকাশ বললেন, ‘প্রতিজ্ঞা আমি ভুলি নি মা, আমি কেবল তোমাকে রক্ষা করতে এসেছি।’
‘আমাকে রক্ষা করতে এসে যদি তোমার প্রাণ যায়, তাহলে কে সফল করবে আমার স্বামীর সারা জীবনের সাধনা, কে প্রতিষ্ঠিত করবে একচ্ছত্র স্বাধীন ভারতে সনাতন আর্য আদর্শ?’
‘মা, আর তুমি আমার বিপদের কথা ভেবে ভয় পেয়ো না। ফেরবার পথে স্বচক্ষে দেখেছি, সমস্ত পাটলিপুত্রের প্রজারা দলে দলে ছুটে আসছে প্রাসাদের দিকে—সকলেই করছে আমার নামে জয়ধ্বনি! দাদার পক্ষে আছে প্রাসাদের কয়েকজন বিশ্বাসঘাতক রক্ষীসৈন্য মাত্র! এখানে দাঁড়িয়ে সেই হতভাগ্যরা তোমাকে কেবল ভয় দেখাতে পারে, কিন্তু সারা পাটলিপুত্রের সামনে তারা ভেসে যাবে বন্যার তোড়ে খড়কুটোর মতো!’
কচ এতক্ষণ অবাক হয়ে সব শুনছিলেন। এতক্ষণ পরে তিনি আবার চিৎকার করে বললেন, ‘আক্রমণ করো, আক্রমণ করো! সৈন্যগণ, চন্দ্রপ্রকাশকে বন্দি করো—বধ করো! একমাত্র চন্দ্রপ্রকাশই হচ্ছে আমাদের পথে কণ্টকের মতো, ও কাঁটা তুলে ফেললেই সমস্ত পাটলিপুত্র আমার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়বে!’ এই বলেই তিনি নিজের খাপ থেকে তরবারি খুলে ফেললেন।
চন্দ্রপ্রকাশও নিজের অসিকে কোশমুক্ত করে বললেন, ‘দাদা, তুমি ভুলে যাচ্ছ, এখন আমি আর একলা নই! আমি যখন প্রাসাদে ফিরে আসি, তখনও তোমার অনুচররা অস্ত্র নিয়ে আমাকে বাধা দিতে এসেছিল। কিন্তু তারা এখন রক্তাক্ত মাটির উপরে শুয়ে চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে!’
কচ তরবারি তুলে এগুতে এগুতে আবার বললেন, ‘আক্রমণ করো! হত্যা করো!’
কুমারদেবী ছুটে গিয়ে দুই দলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ক্ষান্ত হও, তোমরা ক্ষান্ত হও!’
আচম্বিতে প্রাসাদের বাইরে জাগল সমুদ্র-নির্ঘোষের মতো এমন গভীর কোলাহল যে, সকলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বিস্ময়ে চমৎকৃত হয়ে! তারপরেই শোনা গেল অসংখ্য অস্ত্রে অস্ত্রে ঝনৎকার, ভয়াবহ গর্জন, প্রচণ্ড চিৎকার, বিষম আর্তনাদ এবং সঙ্গে সঙ্গে হাজারহাজার কণ্ঠে জয়-নিনাদ!
প্রধানমন্ত্রী জানালার ধারে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘পাটলিপুত্রের প্রজারা প্রাসাদ আক্রমণ করেছে, তারা সিংহদ্বার ভেঙে আঙিনায় ঢুকেছে, যুবরাজ চন্দ্রপ্রকাশের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে, প্রাসাদের অনেক প্রহরীর প্রাণ গিয়েছে, অনেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছে!’
কুমারদেবী কঠিন স্বরে বললেন, ‘অপূর্ব! ঘরের ভিতরে মগধের মহারাজের মৃতদেহ, ঘরের বাইরে মগধের রাজপুত্ররা পরস্পরের কণ্ঠচ্ছেদ করতে উদ্যত, প্রাসাদের বাইরে মগধের প্রজারা বিদ্রোহী, প্রাসাদের ভিতরে মগধের সৈন্যরা বিশ্বাসঘাতক! অপূর্ব! মগধের ভবিষ্যৎ কী উজ্জ্বল! কচ, চন্দ্রপ্রকাশ, এখনও কি তোমাদের রক্ততৃষা শান্ত হয়নি?’
চন্দ্রপ্রকাশ তরবারি নামিয়ে বললেন, ‘মা, আমি তো কারুকে আক্রমণ করতে চাই না।’
‘তাহলে শীঘ্র প্রাসাদের বাইরে গিয়ে প্রজাদের শান্ত করে এসো।’
‘তোমাকে এইখানে একলা রেখে?’
‘হ্যাঁ শীঘ্র যাও। এখনও ইতস্তত করছ? যাও!’
চন্দ্রপ্রকাশ দ্রুতপদে প্রস্থান করলেন।
কুমারদেবী ফিরে শান্ত স্বরে বললেন, ‘বৎস কচ, দেখছ, রাজ্যলোভে তুমি কী সর্বনাশের আয়োজন করেছ?’
কচ নীরবে মাথা নত করলেন।
‘শোনো কচ। মহারাজের নিজের হাতে গড়া এত বড় রাজ্য যদি ভ্রাতৃবিরোধের ফলে ছারখার হয়ে যায়, তবে তার চেয়ে দুভার্গ্য আমার কল্পনায় আসে না। তুমি পাটলিপুত্রের সিংহাসনে বসতে চাও? বেশ, তোমার বাসনাই পূর্ণ হোক। আমাদের কেবল কিছুদিন সময় দাও, মহারাজের অন্ত্যেষ্টি আর পারলৌকিক ক্রিয়া শেষ হোক—তারপর তুমি করবে রাজ্যশাসন, আর আমরা যাব নির্বাসনে!’
কচ সন্দেহপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘নির্বাসনে?’
‘হ্যাঁ, আমি যাব আমার পিতৃরাজ্যে ফিরে, আর চন্দ্রপ্রকাশ যাবে তার প্রতিজ্ঞাপালনের পথে। পাটলিপুত্র ছাড়া পৃথিবীতে আরও অনেক রাজ্যের—আরও অনেক সিংহাসনের অভাব নেই। এ বসুন্ধরা হচ্ছে বীরের ভোগ্য, আমার পুত্র বীর।’
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বাহু কারুর শক্ত হলেই
বীর-বাহু তো বলব না।
বীরত্ব দেয় আত্মা কেবল,—
এ নয় আমার কল্পনা।
.
মহারানি কুমারদেবী ফিরে গেলেন তাঁর পিতৃরাজ্যে বৈশালীতে।
চন্দ্রপ্রকাশ ধরলেন অযোধ্যার পথ। সঙ্গে তাঁর এক হাজার লিচ্ছবি সৈন্য।
পাটলিপুত্রের নাগরিকেরা দলে দলে এসে তাঁর পথ জুড়ে দাঁড়াল। সাশ্রুনেত্রে তারা আবেদন জানালে—’যুবরাজ, আমাদের ত্যাগ করে কোথায় চললে তুমি? সিংহাসন গ্রহণ না করো, আমাদেরও তোমার নির্বাসনের সঙ্গী করে নাও।’
জনতার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন বসুবন্ধু—তাঁর প্রশান্ত মুখ স্নিগ্ধ হাসির আভায় সুমধুর। তাঁকে দেখেই চন্দ্রপ্রকাশ ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে তাঁর পদধূলি গ্রহণ করলেন।
বসুবন্ধু দুই হাত তুলে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘বৎস, মগধের সিংহাসনকে রাজ্যলোভে তুমি যে রক্তাক্ত করে তুললে না, এজন্যে আমার আনন্দের সীমা নেই। মানুষের তরবারি বড় নয়, বড় হচ্ছে মানুষের আত্মাই! আসল যোদ্ধা বলি আমি তাঁকেই, আত্মার শক্তিতে যিনি দিগ্বিজয় করতে পারেন।’
চন্দ্রপ্রকাশ বিনীতভাবে বললেন, ‘গুরুদেব, আমাকে ক্ষমা করবেন। বুদ্ধদেব আত্মার শক্তিতেই দিগবিজয় করেছিলেন, তাঁর হাতে ছিল না বটে তরবারি। কিন্তু আপনি কি বলতে চান, আত্মার শক্তি না থাকলে কেউ তরবারি ধারণ করতে পারে? অর্জুন যখন সশস্ত্র হয়ে দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছিলেন তখন কি তাঁর আত্মা ছিল দুর্বল? বাহু তো বীরেরও আছে ভীরুরও আছে—কিন্তু সত্যিকার তরবারি চালনা করে কে? বাহু, না আত্মা?…না গুরুদেব, আমি সিংহাসন ত্যাগ করলুম বটে, কিন্তু তরবারি ত্যাগ করিনি! এখন এই তরবারিই আমার একমাত্র সম্বল। এই তরবারি হাতে করেই এখন আমি জীবনের গহনবনে নিজের পথ কেটে নিতে চাই!’
বসুবন্ধু বিস্মিত স্বরে বললেন, ‘বৎস, তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারলুম না।’
চন্দ্রপ্রকাশ বললেন, ‘প্রভু, মৃত্যুশয্যায় শুয়ে পিতা আমাকে আদেশ দিয়ে গেছেন—’পাটলিপুত্রের সিংহাসন পেয়ে তোমার প্রথম কর্তব্য হবে, দিগবিজয়ীর ধর্ম পালন করা, স্বাধীন ভারতে আবার আর্য আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা!’
‘কিন্তু চন্দ্রপ্রকাশ, পাটলিপুত্রের সিংহাসন তো তুমি গ্রহণ করোনি?’
‘গ্রহণ করিনি মায়ের আদেশে, গুরুদেব! কিন্তু পিতা বলেছেন আমাকে কাপুরুষ সংহার, যবন দমন করতে, ফিরিয়ে আনতে স্বাধীন ভারতে আবার ক্ষাত্র যুগকে! তাই আমি চলেছি আজ পিতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা সফল করতে!’
হঠাং পিছন থেকে নারীকণ্ঠে শোনা গেল, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, চন্দ্রপ্রকাশ! তোমার পিতা শক্তিমান মহারাজা হয়েও যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা সফল করতে পারেননি, রাজ্যহারা সহায়হীন তুমি কেমন করে তা সফল করবে?’
চন্দ্রপ্রকাশ পিছন ফিরে দেখলেন, ইতিমধ্যে পদ্মাবতী কখন সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। একটু হেসে বললেন, ‘পদ্মা, এইমাত্র গুরুদেব বলছিলেন আত্মার শক্তিতে দিগবিজয় করবার জন্যে। সেই আত্মার শক্তি আমার আছে বলেই মনে করি। হতে পারি আমি সহায়সম্পদহীন—’
চন্দ্রপ্রকাশকে বাধা দিয়ে জনতার বহু কণ্ঠ একসঙ্গে বলে উঠল, ‘না, না, যুবরাজ! আমরা আপনার সহায় হব—আমরা সঙ্গে যাব!’
চন্দ্রপ্রকাশ উচ্চৈস্বরে বললেন, ‘বন্ধুগণ, একি তোমাদের মনের কথা?’
‘মনের কথা যুবরাজ, মনের কথা! আমরা আপনি ছাড়া আর কারুকে মানব না! আপনার জন্যে আমরা প্রাণ দিতে পারি।’
চন্দ্রপ্রকাশ মাথা নেড়ে বললেন, ‘কেবল প্রাণ নয় বন্ধুগণ, কেবল প্রাণ নয়! প্রাণের চেয়ে বড় হচ্ছে মানুষের আত্মা—দেশের কাজে, জাতির কাজে সেই আত্মাকে তোমরা দান করতে পারবে?’
‘যুবরাজ, আমাদের আত্মা, আমাদের ইহকাল, আমাদের পরকাল সমস্তই আমরা দান করব!’
গম্ভীরস্বরে চন্দ্রপ্রকাশ বললেন, ‘তাহলে সমুজ্জ্বল এই ভারতের ভবিষ্যৎ! বন্ধুগণ, বুঝতে পারছি আমাদের মধ্যে যে প্রাণশক্তি আছে, পাটলিপুত্রের ক্ষুদ্র সিংহাসন তা ধারণ করতে পারবে না—এর জন্যে দরকার মহাভারতের মহাসিংহাসন! গুরুদেব, তাহলে এখন আমাকে বিদায় দিন!’
বসুবন্ধু উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, কোনও কাজ করবার আগে ভেবে দেখা উচিত!’
চন্দ্রপ্রকাশ উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘আর আমি ভাবনার ধার ধারি না গুরুদেব! বাড়িতে যখন আগুন লাগে তখন কেউ মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে বসে না—তখন চাই কাজ! ভারত জুড়ে আজ আগুন লেগেছে—যবনের অত্যাচারের আগুনে ভারতের মন্দির, মঠ, তপোবন পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, শত শত কাপুরুষ রাজা অধর্মের আগুন জ্বেলে ভারতের নিজস্ব সমস্ত পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। এখন নেভাতে হবে সেই প্রচণ্ড আগুন! কিন্তু নদীর জলে নয়—চোখের জলেও নয়, সে ভারতব্যাপী আগুন নিভবে কেবল রক্তসাগরের ভীষণ বন্যায়।’
বসুবন্ধু আহত কণ্ঠে বললেন, ‘রক্তসাগরের বন্যায়? আমার প্রেমের শিক্ষা সব ভুলে গেলে চন্দ্রপ্রকাশ?’
‘ভুলিনি গুরুদেব, ভুলিনি! যে আকাশে থাকে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, সেখানেই দেখা দেয় উল্কা আর ধূমকেতু! কিন্তু উল্কাকে পেয়ে আকাশ কি চাঁদের মুখ ভুলে যেতে পারে? ভারতব্যাপী রক্তসাগরে মরব বলে আমরা ডুব দেব না, সাঁতার কেটে উঠব আবার শ্যামল তীরে!…বন্ধুগণ!’
হাজার হাজার কণ্ঠ সাড়া দিলে—’যুবরাজ!’
‘এখন কিন্তু রক্ত চাই, কেবল রক্ত! কেবল অত্যাচারী, কাপুরুষের, যবনের রক্ত নয়—আমাদেরও বুকের রক্ত! তবেই আমরা পাব পুরোনো প্রাণের বদলে নতুন প্রাণ—তবেই আমরা দেখব জীর্ণতার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নতুন সৃষ্টি! ধরো তরবারি, গাও মৃত্যু-গান, ডাকো কল্কি অবতারকে—যুগে যুগে যিনি অধর্মের কবল থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করেন!’
জনতার ভিতর থেকে কোশমুক্ত হয়ে হাজার হাজার তরবারি শূন্যে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিল তীব্র বিদ্যুৎ-মালা! হাজার হাজার কণ্ঠ বলে উঠল—’আমরা মারব—আমরা মরব। জয়, যুবরাজ চন্দ্রপ্রকাশের জয়!’
দৃপ্তকণ্ঠে চন্দ্রপ্রকাশ বললেন, ‘না—না বন্ধু, আজ থেকে আমি আর চন্দ্রপ্রকাশ নই। আজ এইখানে দাঁড়িয়ে আমার স্বর্গীয় পিতার নাম নিয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করছি, ভারতের পূর্ব-সমুদ্র থেকে পশ্চিম-সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত নতুন এক স্বাধীন আর্যাবর্ত গড়ে তুলব! এ প্রতিজ্ঞা যাতে সর্বক্ষণ মনে থাকে, সেইজন্যে আমি নাম গ্রহণ করলুম—সমুদ্রগুপ্ত!’
জনতা বিপুল উৎসাহে বলে উঠলেন—’জয়, সমুদ্রগুপ্তের জয়!’
সমুদ্রগুপ্ত বললেন, ‘শোনো বন্ধুগণ! আপাতত তোমরা নিজের নিজের বাড়িতে ফিরে যাও, আমিও যাত্রা করি পবিত্র অযোধ্যাধামে। একদিন এই অযোধ্যা ছিল মহাক্ষত্রিয় সূর্যবংশের রাজা শ্রীরামচন্দ্রের রাজধানী। বহুযুগ পরে আবার অযোধ্যার গৌরব ফিরিয়ে আনবার জন্যে যথাসময়ে আমি তোমাদের আহ্বান করব। …প্রণাম গুরুদেব! বিদায় পদ্মা!’
সমুদ্রগুপ্ত তাঁর ঘোড়ার উপর চড়ে বসলেন। পদ্মাবতী ঘোড়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াল—তার দুই চোখ করছে ছলছল।
সমুদ্রগুপ্ত একটু বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কী পদ্মা, তোমার মুখ অমন ম্লান কেন? চলেছি পিতৃব্রত উদ্যাপন করতে, তুমি কি হাসি মুখে আমাকে বিদায় দেবে না?’
ভাঙা ভাঙা গলায় পদ্মাবতী বললে, ‘চন্দ্রপ্রকাশ—’
‘আর চন্দ্রপ্রকাশ নই পদ্মা, সমুদ্রগুপ্ত!’
‘না চন্দ্রপ্রকাশ, না! যে নাম ধরে তুমি রক্তসাগরে সাঁতার কাটতে চাও, সে নামে আমি তোমাকে ডাকতে পারব না। আমার কাছে চিরদিন তুমি চন্দ্রপ্রকাশই থাকবে!’
‘বেশ, তাই ভালো পদ্মা! এখন পথ আমাকে ডাক দিয়েছে, আর সময় নেই। তুমি কী বলতে চাও, বলো।’
‘চন্দ্রপ্রকাশ, এতদিন তোমার সঙ্গে লেখাপড়া শিখেছি, গল্প-খেলা করেছি, গান গেয়েছি, বাঁশি বাজিয়েছি। আর আজ তুমি একেবারেই আমাকে ফেলে চলে যাবে?’
‘ভয় নেই পদ্মা, ভয় নেই! কর্তব্য শেষ করে আবার আমি ফিরে আসব, আবার বাঁশি বাজাব, আবার গান শুনব। বিদায়—’ সমুদ্রগুপ্ত ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলেন। তাঁর পিছনে পিছনে ছুটল এক হাজার লিচ্ছবি সওয়ার!
ঘোড়ার পায়ের ধুলো যখন দূরে মিলিয়ে গেল, পদ্মাবতীও তখনও শূন্যদৃষ্টিতে পথের পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খানিকক্ষণ পরে তার দুই চোখ উপছে অশ্রু ঝরতে লাগল।
বসুবন্ধু এগিয়ে এসে মমতাভরে মেয়ের মাথার উপরে হাত রেখে ধীরে ধীরে বললেন, ‘মিছেই তুই কাঁদছিস পদ্মা! সিংহের শাবক শুনেছে বনের ডাক, ঘরোয়া স্নেহ দিয়ে আর ওকে ধরে রাখতে পারবি না!’
পিতার বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পদ্মাবতী বললে, ‘বাবা, পাটলিপুত্রে আর আমি থাকতে পারব না!’
‘আমিও পারব না মা, আমিও পারব না। কচের রাজ্যে বাস করার চেয়ে অরণ্যে বাস করা ভালো!’
‘তবে আমরাও অযোধ্যায় যাই চলো!’
‘অযোধ্যায়! কেন, সেখানে চন্দ্রপ্রকাশ আছে বলে? কিন্তু শুনলি তো, দুদিন পরে অযোধ্যা ছেড়ে সে দিগ্বিজয়ে বেরুবে?’
‘তবু অযোধ্যাই ভালো, বাবা! আরও দুদিন তো চন্দ্রপ্রকাশের সঙ্গে থাকতে পারব?’
সপ্তম পরিচ্ছেদ
নরম বটে নারীর বাহু;
সেই বাহুতেই বন্দি রাহু!
.
‘সৈন্যগণ! আজ তোমরা যে পবিত্র পুরীর আশ্রয় গ্রহণ করেছ, এর চেয়ে স্মরণীয় নগর ভারতে আর দ্বিতীয় নেই! এ হচ্ছে অযোধ্যাধাম—মহারাজা দিলীপ, রঘু, ভগীরথ, রামচন্দ্রের লীলাভূমি! এরই কীর্তিগাথা উচ্চারণ করে মহাকবি বাল্মীকি আজ অমর হয়েছেন। আমি পাটলিপুত্রের ছেলে, আমার সামনে জাগছে বটে মগধের দিগবিজয়ী চন্দ্রগুপ্তের আদর্শ, কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের সামনে ছিল পৃথিবীজয়ী রঘুরই আদর্শ। তিনি একদিন অযোধ্যারই সিংহদ্বার দিয়ে বেরিয়েছিলেন বিশ্বজয় করতে। তাঁর অপূর্ব তরবারির অগ্নিজ্বালা দেখে কেবল সমগ্র ভারতই তাঁকে প্রণাম জানায়নি, তাঁর পায়ের তলায় লক্ষ লক্ষ মাথা নত করেছিল অভারতীয় যবনরা পর্যন্ত। তাঁরই পৌত্র শ্রীরামচন্দ্রের বীরত্ব কাহিনি তোমাদের কাছে আর নতুন করে বলবার দরকার নেই। একদিন এই অযোধ্যা ছিল আসমুদ্র হিমাচলের অধিশ্বরী, আজ আমরাও আবার তার পূর্বগৌরব ফিরিয়ে আনতে চাই! সম্রাট রঘুর পদচিহ্নই হবে আমাদের অগ্রগতির সহায়—উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিমের সর্বত্রই পড়বে আমাদের তরবারির ছায়া! অযোধ্যার রঘু করেছিলেন পৃথিবী-বিজয়, অযোধ্যার রামচন্দ্র করেছিলেন ভারত ও লঙ্কা জয়, আর আজ অযোধ্যার সমুদ্রগুপ্তও করতে চায় সমগ্র আর্যাবর্ত জয়! আমরা আদর্শচ্যুত হিন্দু কাপুরুষ বধ করব, স্বদেশের শত্রু যবন বধ করব, অত্যাচারী শক বধ করব,—উত্তপ্ত রক্তবাদলের ধারায় আর্যাবর্তের আহত আত্মার উপর থেকে বহুযুগের সঞ্চিত কলঙ্কের চিহ্ন মুছিয়ে দেব! কিন্তু মনে রেখো ভারতের সন্তানগণ! এ হচ্ছে অতি কঠোর ব্রত। এ ব্রত উদ্যাপন করতে গেলে তোমাদের সকলেই প্রাণের মায়া ত্যাগ করতে হবে—শত্রুর রক্তের সঙ্গে মেশাতে হবে তোমাদের নিজেদের রক্ত। আমি মৃত্যুপণ করেছি, তোমাদেরও করতে হবে মৃত্যপণ। তোমাদের অনেকেই আর দেশে ফিরে আসতে পারবে না, এটা জেনেও তোমরা কি আমার সঙ্গে যাত্রা করতে রাজি আছ?’
আকাশ কাঁপিয়ে বিরাট জনতার মধ্যে দৃপ্ত স্বর জাগল—’মৃত্যুপণ, মৃত্যুপণ! আমরা মৃত্যুপণ করলুম! জয়, মহাবীর সমুদ্রগুপ্তের জয়!’
প্রকাণ্ড প্রাসাদ। প্রভাত সূর্যের প্রখর কিরণে প্রাসাদের অমল শুভ্রতা জ্বলছে যেন জ্বল জ্বল করে। অলিন্দের উপরে দাঁড়িয়ে আছেন সমুদ্রগুপ্ত—পরনে তাঁর যোদ্ধার বেশ, হস্তে তাঁর মুক্ত কৃপাণ।
প্রাসাদের সামনেই মস্ত একটি ফর্দা জায়গা পরিপূর্ণ করে যে বিপুল জনতার সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে কত হাজার লোক আছে আন্দাজে তা বলা অসম্ভব। তার মধ্যে অশ্বারোহী আছে, গজারোহী আছে, রথারোহী আছে, পদাতিক আছে, সে জনতার মধ্যে সুসজ্জিত সৈনিক ছাড়া আর কারুর স্থান হয়নি।
তিনমাস ধরে প্রাণপণ চেষ্টায় সমুদ্রগুপ্ত এই বৃহৎ বাহিনী সংগ্রহ করেছেন এবং আজ তাঁর সৈন্য পরিদর্শনের দিন।
এতক্ষণ ধরে তিনি জ্বলন্ত ভাষায় সৈন্যদের উত্তেজিত করেছিলেন, এখন তাদের মুখে মৃত্যুপণের কথা শুনে সমুদ্রগুপ্তের ওষ্ঠাধরে ফুটে উঠল প্রসন্ন হাসি।
তিনি আবার উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘সৈন্যগণ, তোমরা আমার সাধুবাদ গ্রহণ করো। দিগ্বিজয় করবে তোমরাই, আমি কেবল তোমাদের পথপ্রদর্শক মাত্র। তোমাদের সাজসজ্জা, নিয়মানুবর্তিতা দেখে আমি অত্যন্ত তুষ্ট হয়েছি, আর তোমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা শুনে বুঝতে পারছি, আমার আদর্শ তোমরা গ্রহণ করতে পেরেছ। আর এক সপ্তাহ পরেই তোমাদের সঙ্গে হবে আমার যাত্রা শুরু। আজ আমার আর কোনও বক্তব্য নেই। তোমরা এখন সৈন্যাবাসে ফিরে যাও।’
হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিকদের মধ্যে জাগ্রত হল গতির চাঞ্চল্য। শোনা গেল সেনাপতিদের উচ্চ আদেশবাণী।…দলে দলে বিভক্ত হয়ে শ্রেণিবদ্ধ সৈন্যরা ফিরে চলল সেনাবাসের দিকে—শত শত পতাকাদণ্ডে, রথচূড়ার এবং হাজার হজার বর্শায় শূন্য হয়ে উঠল কণ্টকিত!
সমুদ্রগুপ্ত গর্ব-প্রফুল্ল দৃষ্টিতে তাঁর সযত্নে সংগৃহীত বাহিনীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর তারা সকলে যখন অদৃশ্য হল, তিনি তখন ধীরে ধীরে অলিন্দ ছেড়ে প্রাসাদের ভিতর প্রবেশ করলেন এবং পোশাক ছাড়বার জন্যে গেলেন নিজের ঘরের ভিতর।
ঘরে ঢুকে দেখলেন, গবাক্ষের কাছে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে পদ্মাবতী। শুধোলেন, ‘পদ্মা, তুমি এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে কেন?’
সে কথার জবাব না দিয়ে পদ্মা প্রশ্ন করল, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, তুমি এঘর থেকে কখন বেরিয়ে গিয়েছ?’
‘সূর্যোদয়ের আগে। কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?’
‘তাহলে তুমি যাওয়ার পরে এ ঘরে অন্য কেউ ঢুকেছিল।’
‘আশ্চর্য কী, ভৃত্যরা!’
‘ভৃত্য নয় চন্দ্রপ্রকাশ, ভৃত্য নয়। ভৃত্যরা উদ্যানের ভিতর থেকে গবাক্ষপথ দিয়ে কাদামাখা পায়ে ঘরের ভিতরে ঢোকে না। এই দেখো—’
সমুদ্রগুপ্ত বিস্মিত চোখে দেখলেন, গবাক্ষের কাছ থেকে একসার কর্দমাক্ত পদচিহ্ন বরাবর তাঁর শয্যার কাছ পর্যন্ত চলে গিয়েছে এবং আর একসার পদচিহ্ন আবার ফিরে এসেছে গবাক্ষের কাছে।
‘দেখছ চন্দ্রপ্রকাশ? গবাক্ষ দিয়ে কেউ ঘরের ভিতরে ঢুকে আবার গবাক্ষপথেই উদ্যানের ভিতরে ফিরে গিয়েছে! কাল রাতে বৃষ্টি পড়েছিল বলেই সে তার কর্দমাক্ত পদচিহ্ন গোপন করতে পারেনি! কিন্তু কে সে?’
সমুদ্রগুপ্ত হাস্য করে বললেন, ‘চোর এসেছিল পদ্মা! কিন্তু এ ঘরে ধনরত্ন না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছে।…উদ্যানে ও কে ভ্রমণ করছে? কবি হরিসেন? পদ্মা, এই নাও আমার তরবারি আর ধনুক-বাণ, কবির সঙ্গে একটু আলাপ করে আসি।’
‘কিন্তু চন্দ্রপ্রকাশ, এই সাহসী চোরের কথা এত সহজে তুমি উড়িয়ে দিও না—’
‘পদ্মা, ও-জন্যে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই। যাদের চোর ধরা ব্যবসা তাদের খবর দাও’—বলতে বলতে সমুদ্রগুপ্ত ঘরের ভিতর থেকে অদৃশ্য হলেন।
উদ্যানের ভিতরে গিয়ে সমুদ্রগুপ্ত দেখলেন, হরিসেন একটি লতাকুঞ্জের ছায়ায় মর্মর-বেদির উপরে বসে আছেন।
তাঁকে দেখে হরিসেন সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে উঠতেই সমুদ্রগুপ্ত বললেন, ‘বসো কবি, বসো। আমি এসেছি তোমার সঙ্গে কিঞ্চিৎ কাব্যচর্চা করতে।’
হরিসেন বললেন, ‘রাজকুমার, আমার কবিতা আজ পলাতকা!’
‘পলাতকা কেন?’
‘যুদ্ধের দামামা শুনে আমার কবিতা আজ ভয় পেয়েছে!’
‘কবিতা ভয় পেয়েছে যুদ্ধের দামামা শুনে? ভুল কবি, ভুল। কবিতা কি কেবল কোমলা? তার বুকে কি বজ্রের আগুন বাস করে না? ক্রৌঞ্চ পাখির মৃত্যু-ব্যথায় বাল্মীকির যে কবিতা হয়েছিল কেঁদে সারা, বীরবর রামচন্দ্রের সঙ্গে সেও কি শত শত যুদ্ধযাত্রা করে অস্ত্র ঝনঝনার ছন্দে ছন্দে নৃত্য করতে পারেনি? হরিসেন, বন্ধু! যোদ্ধারা কেবল অস্ত্র ধরতে পারে, কিন্তু দেশ জাগাবার মন্ত্র শোনাবে তোমরাই। দেশ না জাগলে অস্ত্র ধরে কোনও লাভ নেই। শোনো কবি, তুমি প্রস্তুত হও,—আমার সঙ্গে তুমিও যাবে দিগ্বিজয়ে!’
বিস্ময়ে অভিভূত স্বরে হরিসেন বললেন, ‘আমিও যাব দিগ্বিজয়ে! রাজকুমার, লেখনী চালনা করে আমি কি শত্রু বধ করতে পারি?’
‘তরবারি চালনা করে মানুষ মারা যায় বটে, কিন্তু লেখনী চালনা করে তোমরা মানুষকে অমর করতে পারো! বাল্মীকির কাব্যই আজও রামচন্দ্রকে জীবন্ত করে রেখেছে। বন্ধু, আমি চাই তুমিও আমার দিগবিজয় স্বচক্ষে দেখে বর্ণনা করো। যদি সফল হই তোমার কাব্যের প্রসাদে আমিও অমর হয়ে থাকব যুগ-যুগান্ত পর্যন্ত! কবি,—’
হঠাৎ পিছনে এক আর্তনাদ উঠল, সমুদ্রগুপ্ত ও হরিসেন দুজনেই সচমকে ফিরে দেখলেন, একটা মনুষ্য-মূর্তি উদ্যান-পথে পড়ে বিষম যন্ত্রণায় ছটফট করছে!
সমুদ্রগুপ্ত তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই সে মূর্তি নিস্পন্দ!
হরিসেন বললেন, ‘রাজকুমার, এর বুকে বিঁধে রয়েছে একটা তির!’
সমুদ্রগুপ্ত ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘আমার উদ্যানে নরহত্যা। কে এ কাজ করলে?’
‘আমি করেছি চন্দ্রপ্রকাশ, তোমারই ধনুকে বাণ জুড়ে আমি একে হত্যা করেছি!’ সমুদ্রগুপ্ত বিপুল বিস্ময়ে দেখলেন, একটা গাছের আড়াল থেকে ধনুক-হাতে বেরিয়ে এল পদ্মাবতী!
‘পদ্মা!’
‘বিস্মিত হচ্ছ কেন চন্দ্রপ্রকাশ! তুমি কি ভুলে গিয়েছ ধনুর্বিদ্যা শিখেছি আমি তোমার কাছ থেকেই?’
‘ভুলিনি। এও জানি তোমার লক্ষ্য অব্যর্থ। কিন্তু তুমি লক্ষ করতে কেবল গাছের ফুল আর ফলকে। তোমার বাণে কোনওদিন একটা পাখি পর্যন্ত মরেনি, আর আজ তুমি করলে কিনা নরহত্যা!’
‘এজন্যে আমি দুঃখিত বটে, কিন্তু কী করব বলো চন্দ্রপ্রকাশ? তোমার শয়নগৃহের গবাক্ষ থেকে দেখতে পেলুম, এই লোকটা চোরের মতো পা টিপে টিপে একখানা শাণিত ছোরা নিয়ে তোমার পিছনে পিছনে আসছে। তখনই তোমার ধনুকবাণ নিয়ে আমিও বাইরে বেরিয়ে এলুম। তারপর যখন তোমাকে লক্ষ করে লোকটা অস্ত্র তুললে, আমাকেও বাধ্য হয়েই বাণ ত্যাগ করতে হল!’
‘গুপ্তঘাতক! তাহলে এরই পদচিহ্ন দেখেছি আমার ঘরে! পদ্মা—পদ্মা, তুমিই আমার জীবন রক্ষা করলে! তখন এ কথা—’
সমুদ্রগুপ্তের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল, প্রাসাদের ভিতর থেকে বেরিয়ে সৈনিক বেশধারী এক পুরুষ বেগে দৌড়ে আসছে, তার সর্বাঙ্গ ধূলি-ধূসরিত!
সমুদ্রগুপ্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘মগধ সেনানী মহানন্দ?’
মহানন্দ কাছে এসে জানু পেতে বসে পড়ে বললে, ‘জয় মগধের মহারাজা সমুদ্রগুপ্তের জয়! তাহলে আমি ঠিক সময়েই আসতে পেরেছি।’
‘মহানন্দ, মগধের মহারাজা হচ্ছেন আমার দাদা।’
‘কচ এখন পরলোকে। মন্ত্রীরা তাঁকে হত্যা করেছেন।’
‘হত্যা করেছেন!’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ! একে তো কচের অত্যাচারে এরই মধ্যে রাজ্যময় হাহাকার উঠেছিল, তার উপরে মন্ত্রীরা চরের মুখে খবর পান যে আপনাকে হত্যা করবার জন্যে কচ এক গুপ্তঘাতক পাঠিয়েছেন। তাই শুনে মন্ত্রীরা ক্রুদ্ধ হয়ে কচকে হত্যা করে আপনাকে সাবধান করবার জন্যে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন!’
‘ওইদিকে চেয়ে দেখো মহানন্দ, সেই ঘাতক এখন নিজেই নিহত! আমার বান্ধবী পদ্মাবতী ওর কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করেছেন। এদিকে এগিয়ে এসো বান্ধবী, তোমাকে একবার ভালো করে দেখি! বন্ধু হরিসেন, নারীও কি তোমার কবিতার মতো কোমলা নয়? দেখো দরকার হলে কোমলা নারীও বজ্রের মতো কঠিন হতে পারে কিনা!’
পদ্মাবতী লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে বললে, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, তোমার ধনুক ফিরিয়ে নাও।’
মহানন্দ বললে, ‘মহারাজ, মগধের সিংহাসন খালি। এখন আপনাকে যে পাটলিপুত্রে প্রত্যাগমন করতে হবে!’
সমুদ্রগুপ্ত বললেন, ‘অসম্ভব! তুমি কি শোনোনি, মহানন্দ, স্বর্গীয় পিতৃদেবের মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, আর্যাবর্ত জুড়ে স্বাধীন ভারত-সাম্রাজ্য স্থাপন না করে পাটলিপুত্রে আর ফিরে আসব না?’
‘তাহলে রাজ্যচালনা করবে কে?’
‘আমার মাতা মহারানি কুমারদেবী, আর আমার গুরুদেব বসুবন্ধু।’
অষ্টম পরিচ্ছেদ
একতা, একতা, একতা!
একতার জোরে মানুষের কাছে
হারে যে দানব-দেবতা।
তারপর এক বৎসর কেটে গেছে।
.
এই এক বৎসর ধরে সমুদ্রগুপ্তের রক্তপতাকা দেখা দিয়েছে আর্যাবর্তের অর্থাৎ উত্তর ভারতের দেশে দেশে।
আগেই বলেছি উত্তর ভারত ভাগ করে নিয়েছিল ছোট ছোট হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রভৃতি ভারতীয় রাজারা এবং শক, হুন ও গ্রিক প্রভৃতি যবনরা। খাঁটি ভারতীয় রাজাদের মধ্যে বীরত্বের অভাব ছিল, এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু বৃহত্তর শত্রুর আবির্ভাব হলে একা একা লড়বার ক্ষমতা না থাকলেও তাঁরা একত্রে দলবদ্ধ হতে জানতেন না।
এই বিপজ্জনক স্বভাবটা হচ্ছে একেবারেই ভারতের নিজস্ব। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই এই কুস্বভাবের জন্যে ভারতবর্ষ বার বার বিদেশি শত্রুর করতলগত হয়েছে। এ স্বভাব না থাকলে ভারতবর্ষের শিয়রে আজও যে ব্রিটিশ সিংহের গর্জন শোনা যেত না, একথা জোর করে বলা যায়।
ইউরোপের ধরা হচ্ছে স্বতন্ত্র। এই কয়েক শত বৎসর আগেও ইউরোপের বিভিন্ন জাতি মুসলমানদের বিরুদ্ধে একত্রে দাঁড়িয়ে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেছিল বারংবার।
কিন্তু দুর্দশাগ্রস্ত ভারতের ইতিহাসেও একটা ব্যাপার অনেকবার দেখা গিয়েছে। শত শত বৎসর অন্তত দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ ভারতবর্ষের ক্রন্দন যখন গগনভেদী হয়ে উঠেছে, তখন এখানে অবতারের মতো আবির্ভূত হয়েছেন এক-একজন মহামানব। যেমন চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত ও হর্ষবর্ধন। এঁরা প্রত্যেকেই আপন আপন ব্যক্তিত্বের অপূর্ব মহিমায় ভারতবাসীদের প্রাণে এনেছেন বিচিত্র প্রেরণা, এবং জোর করে একতাহীন রাজাদের দমন করে সমগ্র আর্যাবর্তকে ঐক্যসূত্রে বেঁধে বিদেশি শত্রুদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ভারতের ধর্মকাব্যে অমর হয়ে আছে। এ যুদ্ধ কবে হয়েছিল এবং এর ঐতিহাসিক ভিত্তি কতটুকু সেকথা কেউ নিশ্চয় করে বলতে পারে না। কিন্তু এ যুদ্ধের ইতিহাস যে ভারতের সত্যিকার স্বভাবের ইতিহাস সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। সমগ্র আর্যাবর্ত যেন আত্মহত্যা করবার জন্যেই বদ্ধপরিকর হয়ে কয়েকদিনব্যাপী এক মহাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছিল। ভীম, অর্জুন, ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণ প্রভৃতি যোদ্ধা যতই বীরত্ব প্রকাশ করে থাকুন, তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন তুচ্ছ কারণে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ নয়, তা হচ্ছে ভারতের পক্ষে লজ্জাকর। কারণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যদি ঐতিহাসিক হয় তবে বলতে হবে যে তার ফলে ভারতের ক্ষাত্রবীর্য একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল বলেই সেই সুযোগে হয়তো পারসি ও গ্রিক প্রভৃতি যবনরা ভরসা করে পঞ্চনদের তীরে প্রথম আগমন করতে পেরেছিল।
কিন্তু একতা-মন্ত্রের যে কত গুণ, ভারতবর্ষ নিজেও একবার সে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল। সে হচ্ছে ষষ্ঠ শতাব্দীর কথা। পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতবর্ষের উপরে ভেঙে পড়ে হুন-যবনদের প্রবল বন্যা। এই হুনদের চেহারা ছিল যেমন রাক্ষসের মতো তাদের প্রকৃতিও ছিল তেমনই ভয়ানক এবং সংখ্যাতেও তারা ছিল অগণ্য। এই হুনদের অন্যতম নেতা আটিলার নাম শুনলে আজও ইউরোপ শিউরে ওঠে। ঐতিহাসিক গিবন তাদের চেহারার বর্ণনা দিয়েছেন—’সাধারণ মনুষ্যজাতির সঙ্গে হুনদের চেহারা মেলে না। তাদের দুই কাঁধ খুব চওড়া, নাক খাঁদা, কুৎকুতে কালো চোখ একেবারে কোটরগত, দাড়ি-গোঁফ গজায় না।’
ভারতে আটিলার ব্রত নিয়ে এসেছিল মিহিরগুল। লক্ষ লক্ষ সঙ্গী নিয়ে নগ্ন তরবারি খুলে সে সমগ্র আর্যাবর্ত জুড়ে প্রলয়নৃত্য করে বেড়িয়েছিল। রক্তসাগরে ভেসে, গ্রাম-নগর পুড়িয়ে দিয়ে, নারীর উপর অত্যাচার করে ভারতবর্ষকে সে যেন এক মহাশ্মশানে পরিণত করতে চেয়েছিল। সেই সময়ে মধ্য ভারতের এক রাজা যশোধর্মণ বুঝলেন, এখনও ভারতবাসীরা যদি একতার মর্ম গ্রহণ করতে না পারে, তাহলে আর আর্যাবর্তের রক্ষা নেই।
যশোধর্মণের যুক্তি শুনে ভারতের অন্যান্য রাজারা সেই প্রথম হিংসা ও ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে একতাবদ্ধ হলেন। তার সুফল ফলতেও দেরি লাগল না। আনুমানিক ৫২৮ খ্রিস্টাব্দে একতাবদ্ধ রাজাদের নিয়ে যশোধর্মণ এমনভাবে মিহিরগুলকে আক্রমণ ও পরাজিত করলেন যে হুনদের বিষদাঁত একেবারেই ভেঙে গেল।
কিন্তু ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্যের কথা যে যশোধর্মণের আদর্শ এখানে দীর্ঘকাল স্থায়ী হতে পারেনি। এমনই মাটির গুণ।
শক ও হুণ প্রভৃতি যবনরা ছিল ভারতবর্ষের পক্ষে অভিশাপের মতো। মহাভারতের মহাবীর শ্রীকৃষ্ণ পর্যন্ত বারবার তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে শ্রান্ত হয়ে শেষটা পশ্চিম ভারতের শেষ প্রান্তে সমুদ্রের ধারে পালিয়ে গিয়ে দ্বারকানগর বসিয়ে নিরাপদ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
সমুদ্রগুপ্তের যুগে যবনরা বোধহয় খুব বেশি প্রবল বা একতাবদ্ধ ছিল না। তারাও নানা স্থানে আলাদা আলাদা ছোট-বড় রাজ্য স্থাপন করে বাস করত।
উত্তর ভারতের এই সমস্ত একতাহীন হিন্দু, বৌদ্ধ ও যবন রাজা সমুদ্রগুপ্তের ভীষণ আক্রমণে মহাঝড়ে বনস্পতির মতো ধরাতলশায়ী হল। সমুদ্রগুপ্ত তাদের কারুকেই ক্ষমা করলেন না, নিজের সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য সকলের রাজ্যই একে একে নিলেন। অশোকস্তম্ভের গায়ে সমুদ্রগুপ্তের নিকটে পরাজিত প্রধান প্রধান নয়জন উত্তর ভারতীয় রাজার নাম খোদাই আছে বটে, কিন্তু একজন ছাড়া আর কারুর সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। ওই একজনের নাম হচ্ছে গণপতি নাগ, তাঁর রাজধানী ছিল পদ্মাবতী নগরে। সে স্থান এখন মহারাজা সিন্ধিয়ার রাজ্যের অন্তর্গত।
আজকের দিনে এক রাজা যদি শখ করে অন্যের রাজ্য কেড়ে নেন, তাহলে তাঁর নিন্দার সীমা থাকে না। কিন্তু সমুদ্রগুপ্তের যুগ ছিল প্রবলের যুগ, দুর্বলকে দমন করাই ছিল যেন তখন প্রবলের প্রধান কর্তব্য। সুতরাং আজকের মাপকাঠিতে সমুদ্রগুপ্তকে বিচার করা সঙ্গত হবে না। হিটলার ও মুসোলিনি আজ আবার যেই পুরাতন যুগধর্মকেই পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, দুর্বলের উপরে প্রভুত্ব করবার ইচ্ছাটা হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক ও চিরন্তন ইচ্ছা।
উত্তর ভারতের প্রায় সমস্ত দেশ জয় করে সমুদ্রগুপ্ত আবার অযোধ্যায় ফিরে এলেন। কিন্তু তখনও তাঁর দিগ্বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা শান্ত হয়নি, কারণ তখনও দক্ষিণ ভারত রয়েছে তাঁর নাগালের বাইরে এবং পিতার কাছে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সমগ্র ভারতের উপরে তুলবেন তাঁর গৌরবময় পতাকা।
নবম পরিচ্ছেদ
সুন্দরী সে, সুন্দরী!
চরণ-কমল সন্ধানে তার
মধুপ ওঠে গুঞ্জরি!
.
বাতাস বহন করে নিয়ে যাচ্ছে শত শত মঙ্গলশঙ্খের সুগম্ভীর আনন্দকল্লোল, জনতার অশ্রান্ত ঐকতানে ঘনঘন বেজে উঠেছে অনাহত জয়গীতিকা, পথে পথে ঝরে পড়ছে লাজাঞ্জলির পর লাজাঞ্জলি!
বিজয়ী বীর সুদূরের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেছেন স্বদেশে, প্রাচীন অযোধ্যা তাঁকে অভিনন্দন দেওয়ার জন্যে উন্মুখ হয়ে উঠেছে।
প্রাসাদ-তোরণে অপেক্ষা করছিলেন রাজমাতা মহারানি কুমারদেবী, রাজগুরু বসুবন্ধু ও রাজবান্ধবী পদ্মাবতী।
প্রণত সমুদ্রগুপ্তকে সানন্দে আশীর্বাদ করে কুমারদেবী বললেন, ‘বাছা, তোমার মতো বীর পুত্র পেয়ে আমার গর্বের আর সীমা নেই। এইবারে মগধের সিংহাসন গ্রহণ করে মায়ের জীবন সার্থক করো।’
সমুদ্রগুপ্ত মায়ের একখানি হাত আদর করে নিজের বুকের উপরে টেনে নিয়ে বললেন, ‘সময় হয়নি মা, এখনও সময় হয়নি। প্রতিজ্ঞা করেছি, সমস্ত ভারত যতদিন না আমাকে সম্রাট বলে মানবে, ততদিন মগধের মুকুট দাবি করব না। কেবল উত্তর ভারত নিয়ে আমি খুশি হতে পারব না—আগে দক্ষিণ ভারত জয় করি, তারপর করব মুকুটধারণ।’
বসুবন্ধু বললেন, ‘বৎস, সন্ন্যাসীকে করে গেছ তুমি রাজপ্রতিনিধি। কিন্তু আমার সন্ন্যাস যে এ ঐশ্বর্য আর সইতে পারছে না, তার আর্তনাদ যে নিশিদিন আমি শুনতে পাচ্ছি! আমাকে মুক্তি দাও বৎস, মুক্তি দাও!’
সমুদ্রগুপ্ত হেসে বললেন, ‘মুক্তি! শিষ্যের স্নেহের রাজ্যে গুরুর মুক্তি যে কোনওদিনই নেই প্রভু! ঐশ্বর্যের মধ্যেও যে সন্ন্যাস নির্লিপ্ত থাকতে পারে, তার চেয়ে গৌরব আছে আর কার? হে রাজতপস্বী, শিষ্যের মুখ চেয়ে আরও কিছুদিন রাজ্যপীড়া ভোগ করুন।’
পদ্মাবতী ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
সমুদ্রগুপ্ত বললেন, ‘কী সংবাদ, পদ্মা? মাতৃদেবীর আর্তনাদ শুনলুম। এইবারে তোমারও আর্তনাদ শুনতে হবে নাকি?’
পদ্মাবতী বললেন, ‘হ্যাঁ চন্দ্রপ্রকাশ! আমার কাছেও এক আর্তনাদ এসেছে, দূর-দুরান্তর থেকে!’
‘দূর-দূরান্তর থেকে। জীবন্মৃত ভারতের অসাড় চরণে মহাসমুদ্রের মাথা কোটা আর্তনাদ আমার মতো তুমিও কি শুনতে পেয়েছ পদ্মা?’
‘অত বেশি শোনবার শক্তি ভগবান আমাকে দেননি!’
‘তবে?’
‘আমার কাছে এসেছে এক নারীর আর্তনাদ!’
‘পদ্মা, তোমার কথা শুনে আমি বিস্মিত হচ্ছি!’
‘মালব-রাজকন্যা দত্তাদেবীর নাম শুনেছ?’
‘মালব-রাজ্য জয় করেছি বটে, কিন্তু রাজকন্যাকে চিনি না।’
‘দত্তাদেবী যাচ্ছিলেন তীর্থ ভ্রমণে। তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে কোশলরাজ মহেন্দ্র পথে তাঁকে বন্দি করেন। কিন্তু দত্তাদেবীকে নিয়ে তিনি নিজের রাজধানীতে ফেরবার আগেই অরণ্য প্রদেশের রাজা ব্যাঘ্ররাজ তাঁর কাছ থেকে দত্তাদেবীকে আবার ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।’
‘ব্যাঘ্ররাজ? হ্যাঁ, তার নাম আমি জানি। বিষম নিষ্ঠুর, প্রবল পরাক্রান্ত এই বন্য রাজা। এর রাজধর্ম হচ্ছে দস্যুতার অত্যাচার। পদ্মা, মালব-রাজকন্যার ভবিষ্যৎ ভেবে আমার দুঃখ হচ্ছে।’
‘কেবল দুঃখিত হলেই তো চলবে না চন্দ্রপ্রকাশ! দত্তাদেবী যে সাহায্য চেয়ে তোমার কাছেই দূত পাঠিয়েছেন।’
‘আমার কাছে! আমি কী করব? আমার চোখের সামনে এখন জেগে আছে খালি মহাভারতের বিরাট মূর্তি। তুচ্ছ এক নারীর আবেদন শোনবার সময় এখন নেই।’
কুমারদেবী বললেন, ‘বাছা, আর্য ভারতবর্ষে বীরের বাহুই চিরদিন নারীর ধর্মরক্ষা করে এসেছে, তুমি কি এ আদর্শ মানো না?’
‘মানি, না মানি। কিন্তু বৃহত্তর কর্তব্য পালন না করে—’
পদ্মাবতী বাধা দিয়ে বললে, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, দত্তাদেবীর আবেদন শুনলে তোমার কর্তব্যপালনে কোনওই বাধা হবে না। তুমি তো দাক্ষিণাত্যে যেতে চাও? তাহলে অরণ্যপ্রদেশ পড়বে তোমার যাত্রাপথেই। ব্যাঘ্ররাজকে দমন না করে তুমি তো অগ্রসর হতে পারবে না!’
সমুদ্রগুপ্ত হেসে বললেন, ‘পদ্মা, আমার মুখ বন্ধ করবার জন্যে তুমি যে দেখছি, সমস্ত যুক্তিই স্থির করে রেখেছ। বেশ, আমি তোমাদের কথাই শুনব! দত্তাদেবীর দূতকে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’
অবিলম্বে দূত এসে অভিবাদন করলে।
সমুদ্রগুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দত্তাদেবী এখন কোথায়?’
‘অরণ্য প্রদেশের এক গিরি দুর্গে তিনি বন্দিনী।’
‘কোন পথে শীঘ্র সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতে পারব?’
‘দক্ষিণ কোশলের মহানদীর উপত্যকার ভিতর দিয়ে।’
‘তাহলে আগে আমাকে কোশল রাজ্যও জয় করতে হবে। কিন্তু দূত, ততদিন দত্তাদেবী আমার জন্যে অপেক্ষা করতে পারবেন কি?’
‘মহারাজ, দুরাত্মা ব্যাঘ্ররাজ রাজকন্যাকে বিবাহ করবার জন্যে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু রাজকন্যা তার কাছে দুই মাস সময় প্রার্থনা করেছেন, সেও রাজি হয়েছে।’
‘কোশলরাজ মহেন্দ্র আর ব্যাঘ্ররাজ দুজনেই যখন দত্তাদেবীর জন্যে লালায়িত, তখন বোধ হচ্ছে তোমাদের রাজকন্যা খুবই সুন্দরী?’
‘অসীম সুন্দরী মহারাজ, সাক্ষাৎ তিলোত্তমা! যেমন রূপ, তেমনই গুণ!’
‘আচ্ছা, যাও দূত! দত্তাদেবীকে জানিও, দুই মাসের মধ্যেই সমুদ্রগুপ্ত সসৈন্যে ব্যাঘ্ররাজের দর্পচূর্ণ করবে।’
দূত চলে গেল। পদ্মাবতী কাছে এসে দুষ্টুমি ভরা হাসি হাসতে হাসতে চুপি চুপি বললে, ‘চন্দ্রপ্রকাশ শুনলে তো?’
‘কী?’
‘দত্তাদেবী হচ্ছেন সাক্ষাৎ তিলোত্তমা।’
‘হুঁ।’
‘দত্তাদেবী কুমারী।’
‘হুঁ।’
‘তুমিও কুমার।’
‘পদ্মা, তুমি কী বলতে চাও?’
‘হয়তো শীঘ্রই তোমাদের বিবাহের ভোজে আমাদের নিমন্ত্রণ হবে।’
‘পদ্মা!’
কিন্তু পদ্মা আর দাঁড়াল না, চঞ্চলা হরিণীর মতো ছুটে পালিয়ে গেল।