উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

ভারতের দ্বিতীয় প্রভাত – ১০

দশম পরিচ্ছেদ

মরীচিকা—বিভীষিকা!
কালো অরণ্য!
মানুষের প্রাণ হেথা
অতি নগণ্য!

.

সে রাজ্যের নাম মহাকান্তার—মগধ ও ওড়িশার মধ্যবর্তী প্রদেশে তার অবস্থান। তারই রাজা হচ্ছে ব্যাঘ্ররাজ। বাঘ থাকে বনে এবং মহাকান্তার বলতে ভীষণ নিবিড় অরণ্যই বোঝায়। কাজেই রাজার ও রাজ্যের নাম হয়েছে এমন অদ্ভুত।

কিন্তু সাধারণত নিবিড় অরণ্য বললে আমাদের মনে বনের যে ছবি জেগে ওঠে, মহাকান্তারের আসল দৃশ্য তার চেয়েও ভয়ানক। এখানে এসে দাঁড়লে মনে হবে, সৃষ্টি-প্রভাতের যে পৃথিবীতে মানুষ জন্মায়নি, আমরা যেন সেই পৃথিবীরই কোনও এক অংশে গিয়ে উপস্থিত হয়েছি।

যেখানে মানুষের বসতি নেই সেখানকার কথা বলতে গেলে আগে স্তব্ধতার বর্ণনা দিতে হয়। মহাকান্তারেরও অধিকাংশ স্থানে মানুষের কোনও সাড়াই পাওয়া যায় না। কিন্তু এ অরণ্য-সাম্রাজ্য নিস্তব্ধ নয়। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড নানা জাতের নানা বৃক্ষ সর্বদাই জাগিয়ে রেখেছে মর্মর-গর্জন! পাহাড়ে পাহাড়ে, গুহায় গুহায় ঢুকে ঝোড়ো হাওয়া করছে অশ্রান্ত চিৎকার এবং তারপর যেন কাকে খুঁজে না পেয়ে আবার বাইরে বেরিয়ে পড়ে ক্রুদ্ধ নিশ্বাসে রাশি রাশি শুকনো পাতা উড়িয়ে তুলছে। যেন বনবাসী অদৃশ্য প্রেতাত্মাদের মাংসহীন অস্থি-কঙ্কালের খড়মড় খড়মড় শব্দ! লক্ষ লক্ষ লতা লক্ষ লক্ষ বৃক্ষের আপাদমস্তক জড়িয়ে যেসব জাল ফেলেছে, ঘন পাতার যবনিকা ভেদ করে তাদের দেখা যায় না এবং দুপুরের প্রখর সূর্যকরও সে দুর্ভেদ্য আবরণের ভিতর দিয়ে নীচেকার অনন্ত গুল্ম ও কাঁটাঝোপের উপরে এসে পড়তে পারে না। অরণ্যের তলায় বিরাজ করে রাত্রিময় দিবসের ভয়াবহ অন্ধকার এবং তারই মধ্যে থেকে থেকে জাগে মাতঙ্গদের বৃংহিত ও পৃথিবী কাঁপানো পদশব্দ এবং ব্যাঘ্র-ভালুকের হিংস্র কণ্ঠধ্বনি এবং হতভাগ্য নানা জীবের মৃত্যু আর্তনাদ!

এই মহাকান্তারেরই স্থানে স্থানে বনজঙ্গল কেটে মানুষেরা বসবাস করবার চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু বিরাট অরণ্যের বিপুল জঠরের ভিতর থেকে তাদের আবিষ্কার করা প্রায় অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হবে না। সেসব গ্রামের অবস্থা হয়েছে যেন মহাসাগরের মাঝে মিশিয়ে যাওয়া এক-এক ঘটি জলের মতো।

মহাকান্তারের অধিপতি ব্যাঘ্ররাজ—যেমন তার নাম, তেমনই তার আকৃতি, তেমনই তার প্রকৃতি! সে হচ্ছে এক অনার্য রাজা, ঘোরকৃষ্ণবর্ণ প্রায় পাঁচ হাত উঁচু দানবের মতো তার দেহ—তার এক-একখানা হাত সাধারণ মানুষের উরুর মতো মোটা এবং পায়ের তালে তার মাটি কাঁপে থরথরিয়ে! তার মিষ্ট কথাও শোনায় বাঘের গর্জনের মতো এবং সে যখন অট্টহাস্য করে লোকের কানে লেগে যায় তালা!

মানুষ হলেও ব্যাঘ্ররাজের একমাত্র সম্বল হচ্ছে পশুশক্তি। দয়ামায়া-স্নেহের কোনও ধারই সে ধারে না। তাই মহাকান্তারের আশপাশের রাজ্যের বাসিন্দারা তার নাম শুনলেই চোখের সামনে দেখে মৃত্যুর স্বপ্ন। কারণ, সে যখন অরণ্যের অন্ধকার ছেড়ে দেশে দেশে দস্যুতা করতে বেরোয়, তখন আকাশের বুক রাঙা করে দিকে দিকে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে গ্রাম ও নগর, পথে পথে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে নরনারী-শিশু-বৃদ্ধ-যুবার মৃতদেহ, সর্বত্র ছড়িয়ে যায় হাজার হাজার মানুষের কাতর ক্রন্দন।

কিন্তু বাইরের কোনও রাজ্যের কোনও সাহসী রাজাও ব্যাঘ্ররাজের মুল্লুকে ঢুকে তার সঙ্গে শক্তি পরীক্ষা করতে আসেন না। প্রথম প্রথম দু-একজন সে চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু মহাকান্তারের মৃত্যু-ভীষণ অন্ধকারজালে, তার ক্ষুধার্ত উদর থেকে আজ পর্যন্ত কোনও বিদেশিই মুক্তিলাভ করতে পারেনি।

আজ ব্যাঘ্ররাজের পরামর্শ-সভা বসেছে। পরামর্শ-সভা বললে বোধহয় ঠিক হবে না। ব্যাঘ্ররাজ জীবনে কারুর পরামর্শে কান পাতেনি। সে মন্ত্রী, সেনাপতি ও অন্যান্য সর্দারদের আহ্বান করে কেবল হুকুম দেওয়ার জন্যেই।

তার গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা বাঘের ছালে, কোমরে ঝুলছে তরবারি, হাতে দুলছে গদা বা মুগুর। মাথার ঝুলে-পড়া লম্বা লম্বা চুলে ও গোঁফ-দাড়িতে তার মুখের অধিকাংশ ঢাকা পড়ে গিয়েছে—তারই ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে অজগরের মতো কুতকুতে তীব্র দুটো চক্ষু, বনমানুষের মতো থ্যাবড়া নাক ও কাফ্রির মতো পুরু ঠোঁটের ফাঁকে জানোয়ারের মতো বড় বড় দাঁত!

ব্যাঘ্ররাজ অতিশয় উত্তেজিতভাবে তখন আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠেছে। হাতের গদাটা সশব্দে আসনের উপরে রেখে দিয়ে সে বললে, ‘সুমুদ্দুরগুপ্ত মহাকান্তারের প্রান্তে এসে হাজির হয়েছে বলে তোমরা ভয় পাচ্ছ কেন? তোমরা কি জানে না, আমার এই মহাকান্তারের চারিধারে কত রাজার অস্থিচূর্ণ ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে আছে? আসুক সুমুদ্দুরগুপ্ত, সে আমার করবে কি?’

সেনাপতি বললে, ‘আমিও মহারাজের মত সমর্থন করি। আমাকে আদেশ দিন, সৈন্যরাও প্রস্তুত, আমরা এই মুহূর্তে যুদ্ধযাত্রা করতে রাজি আছি।’

মন্ত্রী বললে, ‘মহারাজ, সমুদ্রগুপ্ত সাধারণ শত্রু নয়, সে কত সহজে কোশলরাজ মহেন্দ্রকে হারিয়ে দিয়েছে, তা কি আপনি শোনেননি?’

ব্যাঘ্ররাজ ক্রুদ্ধস্বরে বললে, ‘শুনেছি হে মন্ত্রী, শুনেছি। কোশলরাজ মহেন্দ্র কি আমারও হাতের মার খায়নি? তার হাত থেকে আমিও কি মালরাজার মেয়ে দত্তাদেবীকে ছিনিয়ে আনিনি? মহেন্দ্র আর আমি কি সমান? হেঁঃ! মন্ত্রী, তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি বেজায় কম। সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে দেখো, আমার গদা ওখানে শুয়ে আছে। বেশি যদি ঘ্যান ঘ্যান করো তাহলে এখনই আমার গদা তোমার বউকে বিধবা না করে ছাড়বে না! হেঁঃ, সুমুদ্দুরগুপ্ত না পুকুরগুপ্ত, খালগুপ্ত! একবার আমার হুঙ্কার শুনলেই তার নাড়ি ছেড়ে যাবে! হেঁঃ!’

বুদ্ধিমান মন্ত্রী আড়চোখ একবার গদার দিকে চেয়েই নিরাপদ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়বার চেষ্টা করলে।

ব্যাঘ্ররাজ বললে, ‘কী হে মন্ত্রী, সরে পড়ছ বড় যে?’

‘আজ্ঞে না মহারাজ, সরে পড়ব কেন? কী আদেশ বলুন।’

‘পুকুরগুপ্ত কত সৈন্য নিয়ে এসেছে সে খবর রাখো?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ। সমুদ্রগুপ্ত যে অসংখ্য সৈন্য নিয়ে দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছে, এ খবর আমি পেয়েছি। কিন্তু সে মহাকান্তারের দিকে এসেছে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে।’

‘মোটে পঞ্চাশ হাজার?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ।’

‘সেনাপতি, আমাদের কত সৈন্য আছে?’

‘পঁচিশ হাজার।’

‘পঁচিশ হাজার? হেঁঃ! ব্যাঘ্ররাজের এক-একজন সৈন্য পুকুরগুপ্তের চার চারজন সৈন্যের সমান! কী বলো হে সেনাপতি, তাই নয় কি?’

‘নিশ্চয়ই মহারাজ, নিশ্চয়ই!’

‘তুমি কী বলো হে মন্ত্রী?’

মন্ত্রী আর একবার গদার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘নিশ্চয় মহারাজ, নিশ্চয়!’

‘হেঃ’! মন্ত্রী, আমার গদার ভয়ে তুমি ও-কথা বলছ না তো?’

‘সে কী মহারাজ, আপনার মন্ত্রী হয়ে গদাকে আবার কীসের ভয়? ও গদার ঘা খেয়ে খেয়ে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে যে!’

‘তা যা বলেছ, পেটে খেলেই পিঠে সয়! হেঁঃ, মাইনেটি তো বড় কম পাও না! যাক ও কথা! সেনাপতি, তুমিই যুদ্ধে যাও! আমি আর ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করব না।’

সেনাপতি বিদায় নিলে।

ব্যাঘ্ররাজ বললে, ‘মন্ত্রী, মনে আছে তো, মালবরাজার মেয়ে দত্তাদেবী আমার কাছ থেকে দু-মাস সময় চেয়েছিল, আজ সে সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাবে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ!’

‘তাহলে বোঝা যাচ্ছে, দত্তাদেবীর সঙ্গে আজ বাদে কাল আমার বিয়ে হবে! হেঁঃ, কী আনন্দ মন্ত্রী, কী আনন্দ! কাল সকালে উঠেই তুমি বিয়ের সব বন্দোবস্ত করে ফেলো—বুঝেছ?’

‘বুঝেছি।’

ব্যাঘ্ররাজ গর্জন করে বললে, ‘বুঝেছ না ছাই বুঝেছ, ঘোড়ার ডিম বুঝেছ! হেঁঃ, কী বুঝেছ বলো দেখি?’

‘আজ্ঞে না মহারাজ, আমি কিছুই বুঝিনি!’

‘তাই বলো, তুমি কিছু বুঝলে কি বোকার মতো আমার মন্ত্রী হতে আসতে? কিন্তু বোঝো আর না বোঝো, যা বললুম মনে রেখো। এখন চলো, রাজধানীর সিংহদ্বারের ওপরে নহবতখানায় বসে মজা করে যুদ্ধ দেখা যাক।’

আশ্চর্য ব্যাপার, এটা কল্পনাই করা যায় না। ব্যাঘ্ররাজ যা বলেছিল তাই হল।

রাজধানীর সামনেই এক মস্ত মাঠ—তার দুই দিকেই গভীর অরণ্য।

মাঠের মধ্যে খানিকক্ষণ যুদ্ধ হওয়ার পরেই মগধ সৈন্যেরা বেগে পলায়ন করতে লাগল এবং তাদের পিছনে পিছনে ছুটল জয়ধ্বনি করতে করতে মহাকান্তারের সৈন্যগণ!

সিংহদ্বারের উপর থেকে বিকট আনন্দে চেঁচিয়ে ব্যাঘ্ররাজ বললে, ‘দেখছ হে মন্ত্রী, দেখছ? মহাকান্তারের বীরত্বটা দেখছ তো? তবু আমি যুদ্ধে নামিনি।’

মন্ত্রী প্রকাশ্যে কিছু না বলে মাথা নাড়তে নাড়তে মনে মনেই বললে, ‘দিগ্বিজয়ী মগধ সৈন্যরা এত সহজে পালাবে? অসম্ভব। ভেতরে নিশ্চয়ই কোনও ফন্দি আছে। কিন্তু ফন্দিটা যে কী হতে পারে সেটা বোঝা গেল না।’

ব্যাঘ্ররাজ উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘মন্ত্রী, মগধের দর্প তো চূর্ণ হল, আমি বাঘগড়ে দত্তাদেবীর সঙ্গে দেখা করতে চললুম।’

ব্যাঘ্ররাজ চলে গেল, মন্ত্রী কিন্তু সেখান থেকে নড়ল না। দূর মাঠের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মগধ সৈন্যেদের তাড়া করে মহাকান্তারের সৈন্যেরা তখন অনেক দূরে এগিয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ মন্ত্রীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হল মাঠের দুই পাশের বনের দিকে। চমকে উঠে সে বললে, অ্যাঁ! আগে ছিল অর্ধচন্দ্র ব্যূহ, এখন হচ্ছে চক্রব্যূহ! কী সর্বনাশ, কী সর্বনাশ!’

একাদশ পরিচ্ছেদ

 হরিণ ছোটে অন্ধবনে,
সেই নিশানা-নেই ঠিকানা!
হায় সে ভীরু পায়নি খবর
ব্যাঘ্র কোথায় দিচ্ছে হানা!

.

মগধ সৈন্যের সঙ্গে মহাকান্তারের সৈন্যদের যুদ্ধ হচ্ছিল নগরের সিংহদ্বারের—অর্থাৎ সামনের দিকে।

সেখান থেকে বাঘগড়ে যেতে হলে নগরের পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে ক্রোশ তিনেক পথ পেরুতে হয়। এ পথ বাইরের কেউ চেনে না। কাজেই নগরে কোনও বিপদের সম্ভাবনা দেখলে ব্যাঘ্ররাজ এইখানে এসেই আশ্রয় গ্রহণ করত। এবং নিরাপদ বলেই সে দত্তাদেবীকে লুকিয়ে রেখেছিল বাঘগড়ে।

রাজধানী থেকে বাঘগড়ের পথ ক্রোশ তিনেকের বেশি নয় বটে, কিন্তু কোনও অপরিচিত ব্যক্তির পক্ষে ও-পথে হাঁটবার চেষ্টা করা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

মহাকান্তারের বিভীষণ মূর্তি এইখানেই ফুটে উঠেছে ভালো করে। কেবল অরণ্যই যে এখানে বেশি নিবিড় ও দুর্ভেদ্য, তা নয়। একটানা পাহাড়, চড়াই-উতরাই, গিরিসঙ্কট, জলপ্রপাত, নদী ও খাদ প্রভৃতি একত্রে মিলে এ স্থানটাকে মানুষের অগম্য করে তোলবার চেষ্টা করেছে। বনবাসী হাতিরা পর্যন্ত এদিকটা মাড়াতে চায় না। যদিও বনের অন্ধকার এখানে যখন-তখন কেঁপে ওঠে বাঘের ধমকে ও ভালুকের ঘুৎকারে এবং ভয়াবহ অজগররা নীরবে শিকার খুঁজে বেড়ায় এর যেখানে-সেখানে। যে মানুষ এখানকার গুপ্তপথ চেনে সেও যদি একবার অন্যমনস্ক হয় তাহলে সেই মুহূর্তেই তার মৃত্যুসম্ভাবনা।

শহর থেকে বাঘগড়ে যাওয়ার এই অতি দুর্গম পথটি রীতিমতো সুরক্ষিত। ব্যাঘ্ররাজ পথের উপরে পাহারা দেওয়ার জন্যে প্রায় চারিশত রক্ষী সৈন্য নিযুক্ত করেছেন। তাদের কারুকেই চোখে দেখা যায় না। অন্ধ গিরিগুহার ভিতরে, বড় বড় পাথরের আড়ালে, প্রকাণ্ড বনস্পতির পত্রবহুল ডালে ডালে নিঃশব্দ ছায়ার মতো তারা আত্মগোপন করে থাকে—হাতে তাদের ধারালো বর্শা, ধনুকবাণ! শত্রু কিছু জানবার-বোঝবার আগেই ইহলোকের গণ্ডি ছাড়িয়ে হাজির হবে একেবারে পরলোকের সীমানায়!

বাঘগড়ের পিছনেও আর একটা দুর্গম গুপ্তপথ আছে। কিন্তু সেদিক দিয়ে বাইরের শত্রু আসবার সম্ভাবনা নেই, কারণ বাইরের কেউ তার অস্তিত্ব জানে না। ভবিষ্যতে যদি কখনও চূড়ান্ত বিপদে দরকার হয়, ব্যাঘ্ররাজ সেইজন্যে নিজের ব্যবহারের জন্যে এই পালাবার পথটি তৈরি করে রেখেছে। এদিকে পঞ্চাশ ক্রোশের মধ্যে কোনও লোকালয় নেই বলে পথে পাহারা দেওয়ার জন্যে রক্ষী রাখবারও দরকার হয়নি।

হয়তো সবদিকে আটঘাট বাঁধা বলেই দুর্গ হিসাবে বাঘগড়কে দুর্ভেদ্য করবার চেষ্টা হয়নি। ধরতে গেলে তাকে গড় না বলে প্রাসাদ বলাই উচিত। সেকালে কেবল রাজবাড়ি নয়, অধিকাংশ সাধারণ ধনীর চারিদিকে গড়খাই কাটা উঁচু পাঁচিল ঘেরা অট্টালিকাকেও দুর্গ বলে মনে হত। প্রাচীনকালে, এমনকি মধ্যযুগেও আইনের বাঁধন এমন কঠিন ছিল না, দেশে সর্বদাই ছিল অশান্তির সম্ভাবনা। কেবল বিদেশি শত্রু নয়—বড় বড় ডাকাতদের সশস্ত্র দলও যখন তখন গৃহস্থদের করত আক্রমণ। এই সব কারণে যার কিছুমাত্র সঙ্গতি ছিল, সেই-ই নিজের বাড়িকে যতটা সম্ভব দুর্গের আদর্শে গড়ে তোলবার চেষ্টা করত।

এই বাঘগড়ে বন্দিনী হয়েছেন মালব রাজকুমারী দত্তাদেবী।

প্রাসাদের তিনতলার ছাদে সুদূর অরণ্য ও পর্বতমালার দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দত্তাদেবী দাঁড়িয়েছিলেন। পাশেই তাঁর পরিচারিকা বা সহচরী লক্ষ্মী। ইনিও মালব দেশের মেয়ে, দত্তাদেবীর সঙ্গে বন্দিত্ব স্বীকার করেছেন।

দত্তা বললেন, ‘আজ আমার শেষ স্বাধীনতার দিন, লক্ষ্মী!’

‘দেবী, আজও কি আপনি নিজেকে স্বাধীন বলে মনে করছেন? আপনি যে বন্দিনী, এ কথা কি ভুলে গিয়েছেন?’

একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দত্তা বললেন, ‘কিছুই ভুলিনি লক্ষ্মী! ব্যাঘ্ররাজ বন্দি করেছে কেবল আমার দেহকে, এখনও মন আমার নিজেরই আছে। কিন্তু সে আমাকে আজ পর্যন্ত সময় দিয়েছে, আজ যদি এখান থেকে উদ্ধার না পাই, তবে কাল সে আমাকে বিবাহ করবে—তখন আমার দেহ আর মন দুই-ই হবে বন্দি!’

ভাঙা-ভাঙা গলায় লক্ষ্মী বললেন, ‘দেবী, সেই অসীম দুর্ভাগ্যের জন্যই প্রস্তুত হন। যাঁর আশায় আপনি পথ চেয়ে আছেন, সেই সমুদ্রগুপ্ত তো আজও এলেন না!’

‘ব্যাঘ্ররাজের এক সর্দারকে আমার গায়ের সমস্ত অলঙ্কারের লোভ দেখিয়ে বশীভূত করেছি। সে যে মহারাজা সমুদ্রগুপ্তকে আহ্বান করতে গিয়েছে সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস, হয় সে পথে কোনও বিপদে পড়েছে, নয় মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি।’

‘দেবী, এটাও তো হতে পারে যে মহারাজা সমুদ্রগুপ্ত আপনার দূতের প্রস্তাবে কর্ণপাত করেননি?’

‘অসম্ভব লক্ষ্মী, অসম্ভব! মনের চোখে আমি দ্বাপরের ভীষ্ম, কর্ণ, অর্জুনের যেসব বীরমূর্তি দেখতে পাই, সমুদ্রগুপ্তের কথা ভাবলে তাঁদের কথাই স্মরণ হয়! যে মহাবীর আর্যাবর্তের অতীত গৌরবকে ফিরিয়ে আনবার জন্যে দৃঢ় পণ করেছেন, অনার্য নররাক্ষসের কবলে বন্দিনী আর্যকন্যার কাতর ক্রন্দনে তিনি কর্ণপাত করবেন না, এ অসম্ভব কথা তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বোলো না!’

লক্ষ্মী কথা শুনতে শুনতে কান পেতে যেন আরও কিছু শুনছিলেন। তিনি বললেন, ‘খুব দূর থেকে অস্পষ্ট সমুদ্রগর্জনের মতো একটা কোলাহল শুনতে পাচ্ছেন কি?’

সেটা হচ্ছে রাজধানীর অনতিদূরে যে যুদ্ধ চলছে তারই গোলমাল। দুই পক্ষের প্রায় পঁচাশি হাজার সৈনিকের সিংহনাদ বা আর্তনাদ ও অস্ত্রঝঞ্ঝনা, মহাকান্তারের তিন-চার ক্রোশব্যাপী নদী-জঙ্গল-পাহাড়ের উপর দিয়ে বাতাস বহন করে আনছে তারই কিছু কিছু নমুনা!

দত্তাও শুনলেন। হতাশভাবে বললেন, ‘কাল আমার বলিদান। রাজধানীর রাক্ষসরা তাই হয়তো আজ থেকেই উৎসব আরম্ভ করেছে!’

সেই নিরাশা-মাখা কণ্ঠস্বর শুনে লক্ষ্মীর চোখে এল জল। পাছে দত্তা দেখতে পান তাই তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন তাড়াতাড়ি। কিন্তু পরমুহূর্তেই আর একটা শব্দ শুনে লক্ষ্মী দ্রুতপদে ছাদের ধারে ছুটে গেলেন। সেখান থেকে একবার সামনের দিকে চেয়েই তিনি আর্তস্বরে বলে উঠলেন, ‘দেবী, দেবী!’

‘কী লক্ষ্মী?’

‘দূরে বনের পথে চারজন অশ্বারোহী!’

দত্তাও ছুটে গিয়ে দেখলেন।

‘দেবী, ওদের একজনের চেহারা দেখুন! প্রকাণ্ড মানুষের মতো মূর্তি, বাঘছালের পোশাক! ব্যাঘ্ররাজ আসছে।’

‘হুঁ, আমার বলির আয়োজন করতে!’ বলতে বলতে দত্তাদেবীর দুই চক্ষে জ্বলে উঠল অগ্নিশিখা! তীব্র স্বরে আবার তিনি বললেন, ‘লক্ষ্মী, প্রাণ বড়, না মান বড়?’

‘মান বড় দেবী, মান বড়!’

‘তাহলে তুমি কি আমার সঙ্গে যেতে পারবে?’

‘কোথায়?’

‘বাঘগড়ের পিছনকার বনে? ওখানে কেউ পাহারা দেয় না।’

‘দেয় দেবী। ওখানে পাহারা দেয় হিংস্র জন্তুরা—বাঘ, ভালুক, বরাহ, অজগর।’

‘কিন্তু ব্যাঘ্ররাজের চেয়ে তারা ভয়ানক নয়! তারা মানুষের মান কেড়ে নেয় না। আমি প্রাণ দিতে প্রস্তুত আছি।…লক্ষ্মী, লক্ষ্মী, আর দেরি নয়! ওই শোনো, ঘোড়ার পায়ের শব্দ কত কাছে এসে পড়ল! আর দেরি করলে পালাবারও সময় পাব না। আমি পিছনের দরজা দিয়ে এখনই বেরিয়ে যাব—তোমার যদি ভয় তবে তুমি এখানেই থাকো। বিদায় লক্ষ্মী!’

‘আপনার সঙ্গে যখন এখানে এসেছি, তখন অন্য কোথাও যেতে আমার ভয় হবে না!’

দুজনে প্রাণপণে ছুটে ছাদ থেকে নেমে গেলেন।

ওদিকে ঘোড়ার পায়ের শব্দ বাঘগড়ের ভিতরে এসে থামল।

একলাফে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে ব্যাঘ্ররাজ প্রাসাদের উপরে উঠে এল এবং একেবারে প্রবেশ করলে দত্তাদেবীর ঘরে।

ঘরে কেউ নেই। ব্যাঘ্ররাজ চিৎকার করে ডাকলে, ‘দত্তাদেবী, দত্তাদেবী কোথায়? আমি এসেছি, শুনতে পাচ্ছ না?’

তবু কারুর সাড়া নেই।

‘প্রহরী, প্রহরী! শিগগির দত্তাদেবীকে ডেকে আন!’

প্রহরীরা চারিদিকে ছুটল। ব্যাঘ্ররাজ দুম দুম শব্দে মেঝে কাঁপিয়ে ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল। প্রহরীরা খানিক পরে এসে ভয়ে ভয়ে জানালে, প্রাসাদের কোথাও দত্তাদেবীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ব্যাঘ্ররাজ কটমট করে দুই চোখ পাকিয়ে এবং দুই পাটি দাঁত বার করে খিঁচিয়ে বলে উঠল, ‘কী! খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? আমার সামনে এত বড় অলক্ষুণে কথা বলবার সাহস হল তোদের? জানিস, এখুনি সবাইকে শূলে চড়িয়ে দেব?’

এমন সময় হন্তদন্তের মতো মন্ত্রীমহাশয়ের প্রবেশ।

ব্যাঘ্ররাজ তেড়ে উঠে বললে, ‘হেঃ! তুমি আবার আমার পিছুপিছু এখানে মরতে এলে কেন? কে তোমাকে ডেকেছে?’

‘মহারাজ, মহারাজ!’

‘চুপ করো মন্ত্রী, বাজে কথা এখন ভালো লাগছে না। জানো, দত্তাদেবীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘মহারাজ, ওদিকে যে সর্বনাশ উপস্থিত!’

‘মন্ত্রী, গদার বাড়ি দু-এক ঘা না খেলে তোমার মুখ বন্ধ হবে না বুঝি!’

‘মহারাজ, এতক্ষণে বোধ হয় মগধ সৈন্যরা রাজধানী দখল করেছে।’

ব্যাঘ্ররাজ এবারে গর্জন না করে অট্টহাস্যে ঘর কাঁপিয়ে বললে, ‘আমার সঙ্গে এসেছ ঠাট্টা করতে? স্বচক্ষে দেখে এলুম—’

‘স্বচক্ষে যা দেখেছেন ভুল দেখেছেন। মগধ সৈন্যরা পালাচ্ছিল বটে, কিন্তু সেটা হচ্ছে তাদের কৌশল!’

ব্যাঘ্ররাজের রাগ এইবারে জল হয়ে এল। হতভম্বের মতো বললে, ‘কৌশল?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ! যুদ্ধক্ষেত্রের দুইপাশে ছিল গভীর বন। মগধের হাজার কুড়ি সৈন্য মাঝখানে ছিল অর্ধচন্দ্রের আকারে। আমরা আক্রমণ করতেই আপনি তাদের পালিয়ে যেতে দেখেছেন তো?—কিন্তু তারা পালায়নি,—মহাকান্তারের সৈন্যদের ভুলিয়ে নিজেদের অর্ধচন্দ্র বূহ্যের আরও ভিতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।’

‘তারপর মন্ত্রী, তারপর?’

‘তারপর হঠাৎ দেখি, যুদ্ধক্ষেত্রের দুইধারের বন থেকে পিল পিল করে মগধ সৈন্য বেরিয়ে আসছে। যেসব শত্রু পালাচ্ছিল আচমকা তারা ফিরে দাঁড়িয়ে আমাদের সৈন্যদের আক্রমণ করলে। আমরা সে আক্রমণও হয়তো সহ্য করতে পারতুম, কিন্তু দেখতে দেখতে দুইধারের বন থেকে আরও প্রায় হাজার তিরিশ মগধ সৈন্য বেরিয়ে মহাকান্তারের সৈন্যদের ডান, বাম ও পিছন দিক থেকে ঘিরে ফেললে। সেই পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের যে অবস্থা হল তা আর বলবার নয়। মগধের জয়নাদে আর মহাকান্তারের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভরে গেল! আমি আর সইতে না পেরে আপনাকে খবর দেওয়ার জন্যে প্রাণপণে ছুটে আসছি। এতক্ষণে আমাদের সব সৈন্য যে হত বা বন্দি হয়েছে সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই—হয়তো মগধ সৈন্যরা আমাদের রাজধানীও অধিকার করেছে।’

রবারের বলের ভিতর থেকে হাওয়া বেরিয়ে গেলে সেটা যেমন চুপসে যায়, মন্ত্রীর কথা শুনতে শুনতে ব্যাঘ্ররাজের মুখের অবস্থাও হল কতকটা সেইরকম। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বললে, ‘মন্ত্রী, তোমার বাক্যি শুনে আমার পিলে ভয়ানক চমকে যাচ্ছে যে। মহাকান্তারের রাজধানীতে মগধের সৈন্য! আজ আমি কার মুখ দেখে উঠেছি?’

আচম্বিতে বাঘগড়ের প্রাকার থেকে ভোঁ ভোঁ রবে বেজে উঠল প্রহরীর ভেরি!

ব্যাঘ্ররাজ চমকে লাফ মেরে বললে, ‘মন্ত্রী, ও আবার কী বাবা?’

একজন লোক দৌড়ে এসে সভয়ে খবর দিলে, ‘মহারাজ! বাঘগড়ের পিছনকার বনের ভিতর দিয়ে দলে দলে শত্রু আসছে!’

—মন্ত্রী, মন্ত্রী, একী শুনি? বাঘগড়ের পিছনকার বনের গুপ্তপথের সন্ধান শত্রুরা জানলে কেমন করে?’

—মহারাজ, আমাদের রাজ্যে নিশ্চয় কোনও বিশ্বাসঘাতক আছে!’

আবার ভেরি বাজল ভোঁ ভোঁ!

আবার আর একটা লোক এসে খবর দিলে, ‘মহারাজ, হাজার হাজার শত্রু রাজধানীর দিক থেকে বাঘগড়ের পথ দিয়ে ছুটে আসছে!’

ব্যাঘ্ররাজ ধপাস করে একখানা আসনের উপরে বসে পড়ে বললে, ‘কী হবে মন্ত্রী, এখন কী হবে? সামনে শত্রু, পিছনে শত্রু! বাঘগড় তো নামে মাত্র কেল্লা! শত্রুদের ঠেকাই কেমন করে? ও বাবা, এ আমার কি হল গো!’

মন্ত্রী বললে, ‘মহারাজ, শত্রুদের দৃষ্টি দেখছি বাঘগড়ের দিকেই! ওরা নিশ্চয় দত্তাদেবীর খোঁজেই এদিকে আসছে!’

ব্যাঘ্ররাজ মাথায় করাঘাত করে বললে, ‘হায় রে আমার পোড়াকপাল! কেন ও কালসাপিনিকে ধরতে গিয়েছিলুম!’

‘মহারাজ, আর আক্ষেপ করারও সময় নেই! যদি বাঁচতে চান তো তাড়াতাড়ি বাঘগড়ের পিছনকার গুপ্তদ্বার খুলে বনের ভিতরে গিয়ে লুকিয়ে থাকবেন চলুন!’

মন্ত্রী ছুট মারলে—পিছনে ব্যাঘ্ররাজও!

গুপ্তদ্বার খুলে বাইরে যেতে তাদের কিছুমাত্র দেরি হল না।

দত্তাদেবী আর লক্ষ্মীও এই পথেই পলায়ন করেছেন। একই পথ ধরে ছুটল বাঘ ও হরিণ!

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

আঁধার পথেও এগিয়ে গেল
পথ হারাল যারা,
সামনে হঠাৎ জাগল কখন
উজল ধ্রুবতারা।

.

কোথায় আকাশ, কোথায় বাতাস! সে যেন অন্ধকারের অনন্ত সাম্রাজ্য! উপরে, নীচে, এপাশে, ওপাশে অন্ধকারের পরে যেন অন্ধকারের তরঙ্গ! সে যেন বিরাট এক ক্ষুধার্ত বিভীষিকা, পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলবার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে!

লক্ষ্মী প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘দেবী, চোখ আর পা কিছুই যে চলছে না! নীচে পথ নেই, মাথার ওপরে ঘন পাতার ভেতরে একটা ফুটো, আলোর একটা রেখা পর্যন্ত নেই!’

দত্তা বললেন, ‘তবু আমাদের এগুতে হবে! চলো লক্ষ্মী, দু-হাতে বনজঙ্গল ঠেলে আরও ভেতরে গিয়ে লুকোই চলে! এ অন্ধকারকে এখন আমার বন্ধু বলে মনে হচ্ছে। এখানে কেউ আমাদের দেখতে পাবে না!’

‘না দেবী, না! আমার মনে হচ্ছে, এখানে শত শত অজানা শত্রু অদৃশ্য চক্ষু মেলে আমাদের পানে তাকিয়ে আছে! তাদের হাত ছাড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই—কোনও উপায় নেই!’ লক্ষ্মীর গলার আওয়াজ শুনে বোধ হয়, এইবারে তিনি কেঁদে ফেলবেন।

দত্তা লক্ষ্মীর পিঠের উপর একখানি হাত রেখে ধীরে ধীরে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না লক্ষ্মী, তাহলে আমাদের বিপদ বাড়বে বই কমবে না। এই ভয়ানক গহন বনে আমাদের কপালে যদি মৃত্যু লেখা থাকে, তাহলেও এই সান্ত্বনা নিয়ে মরতে পারব যে ব্যাঘ্ররাজকে ফাঁকি দিয়েছি!’

ফোঁস করে একটা বিশ্রী গর্জন জেগে উঠল—লক্ষ্মীর পায়ের উপর দিয়ে তীব্র গতিতে চলে গেল যেন একটা শীতল ও ভয়াবহ শব্দ-বিদ্যুৎ! এবারে লক্ষ্মী ভয়ার্ত চিৎকার না করে থাকতে পারলেন না।

‘চুপ চুপ! হল কী লক্ষ্মী?’

‘পায়ের ওপর দিয়ে একটা সাপ চলে গেল! দেবী, আর আমি এগুতে পারব না, কপালে যা আছে তাই হবে!’

‘তাহলে তুমি এইখানে থাকো, আমি একলাই অগ্রসর হব।’

‘কোথায় অগ্রসর হবেন? সামনের দিকে চেয়ে দেখুন! মাগো!’

দশ-বারো হাত তফাতে অন্ধকার হয়ে উঠেছে যেন অগ্নিময়! চারটে বড় বড় বুভুক্ষু চক্ষু দপ দপ করে জ্বলছে! ও কাদের চোখ? বাঘ, না বাঘিনী? ভালুক? বরাহ? কিছুই বোঝা যায় না!

দুই হাতে মুখ ঢেকে প্রাণের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন লক্ষ্মী।

দীপ্ত চোখগুলো নিভে গেল। অন্ধকারের মধ্যে শুকনো পাতা মাড়ানোর শব্দ হল! জন্তু দুটো চলে যাচ্ছে।

দত্তা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ভয় নেই লক্ষ্মী! মৃত্যু আপাতত আমাদের গ্রহণ করলে না।’

পরমুহূর্তেই অন্ধকার যেন আচম্বিতে ভাষা পেয়ে বললে, ‘কে? কে এখানে কথা কইছে?’

দত্তা অন্ধের মতো দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটলেন—পিছনে পিছনে লক্ষ্মীও।

কখনও বড় বড় গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে, কখনও কাঁটাঝোপে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, কখনও মাটির উপরে পড়েই আবার উঠে তাঁরা ছুটতে লাগলেন এবং প্রতিমুহূর্তেই তাঁদের মনে হতে লাগল এই মুহূর্তেই জীবনের শেষ মুহূর্ত। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলেন তাঁদের পিছনেও উঠেছে একাধিক পায়ের দ্রুত পদশব্দ! যারা পালাচ্ছে আর যারা অনুসরণ করছে তারা কেউ কারুকে দেখতে পাচ্ছে না—কেবল পদশব্দের পিছু নিয়েছে শব্দ।

ছুটতে ছুটতে দত্তা লক্ষ করলেন, অরণ্য আর তত দুর্ভেদ্য নয়, অন্ধকার আর তত গাঢ় নয়, মাথার উপরে মাঝে মাঝে আলোর আভাস, মাঝে মাঝে ফুটে উঠছে সমুজ্জ্বল আকাশের এক-একটা টুকরো। দারুণ ভয়ে তাঁর সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন হয়ে গেল। অন্ধকারের যে নিবিড়তা এতক্ষণ তাঁদের রক্ষা করছিল, এইবারে তার সাহায্য বুঝি হারাতে হয়!

পিছন থেকে বিকট চিৎকার জাগল, ‘পেয়েছি মন্ত্রী, আমার বউকে পেয়েছি!’

ব্যাঘ্ররাজ ও মন্ত্রী তখন দত্তাদের খুব কাছে এসে পড়েছে।

অন্ধকারের রাজ্য শেষ হল—একখণ্ড খোলা জমির উপরে বিরাজ করছে দিনের আলো।

আর পালাবার চেষ্টা করা মিছে বুঝে দত্তা ও লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে পড়লেন।

ব্যাঘ্ররাজও দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ‘বাব্বা, তুমি বউ, না উড়োপাখি? একেবারে বেদম হয়ে গিয়েছি যে!’

মন্ত্রী বললে, ‘মহারাজ, এখানে অপেক্ষা করা কি যুক্তিসঙ্গত হবে? বনের গুপ্তপথ দিয়ে শত্রু আসছে সে কথা কি ভুলে গেলেন?’

‘হেঁঃ! সে কথাও ভুলিনি, আমার বউকেও ভুলব না! হারাধন যখন ফিরে পেয়েছি তখন তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাব।’

‘মহারাজ, শাস্তরে বলে, পথে নারী বিবর্জিতা।’

‘মরছি হাঁপিয়ে, এখন আবার শাস্তর-ফাস্তর নিয়ে গোলমাল কোরো না বাপু।’

‘আমার কথা শুনুন মহারাজ! ওই দত্তাদেবীর জন্যেই আজ আপনার এত বিপদ! আমি বলি কি, ও-আপদকে আপনি বনবাস দিয়ে যান!’

‘মন্ত্রী, গদাটা আমি ভুলে ফেলে এসেছি বলেই তুমি এত মুখ নাড়ছ বুঝি? কিন্তু জানো তো, আমার হাত গদার চেয়ে কম শক্ত নয়!’ ব্যাঘ্ররাজ ভারী ভারী পা ফেলে দত্তার দিকে এগিয়ে গেল।

দত্তা পায়ে পায়ে পিছোতে পিছোতে বললেন, ‘রাজা, আমার কাছে আসবেন না।’

‘কাছে আসব না মানে? হেঁঃ, তুমি না আমার বউ হবে?’

‘আপনার স্ত্রী হবার আগে আমি আত্মহত্যা করব।’

‘এ আবার কী রকম উলটো কথা হল? এমন কথা তো ছিল না!’

‘মালবের রাজকুমারীর সঙ্গে কোনও পশুর বিয়ে হতে পারে না!’

ব্যাঘ্ররাজের কুতকুতে চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে ও তাঁর বাঁদুরে থ্যাবড়া নাকটা ফুলে উঠল, এমন আশ্চর্য কথা আজ পর্যন্ত তার মুখের সামনে আর কেউ বলতে সাহস করেনি। সে বললে, ‘আমি পশু? ওহে মন্ত্রী, মেয়েটা কী হে?’

মন্ত্রী মনে মনে বললে, মেয়েটা অত্যুক্তি করেনি। মুখে সান্ত্বনা দিয়ে বললে, ‘মহারাজ, দত্তাদেবী আপনাকে বোধ হয় পশুরাজ বলতে চান। আপনি পুরুষসিংহ কিনা?’

অমনই বুক ফুলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, দুইদিকে দুই বাহু ছড়িয়ে ব্যাঘ্ররাজ সগর্বে বললে, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! বউ, একবার আমার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখো দেখি, সত্যিই আমি পুরুষসিংহ কিনা! এমন চেহারা কটা দেখেছ?’

মন্ত্রী মনে মনে বললে, মানুষের সৌভাগ্য যে পৃথিবীতে এমন চেহারা বেশি দেখা যায় না।

দত্তা কিছু বললেন না, তাঁর দুই চোখে বিজাতীয় ঘৃণা।

ব্যাঘ্ররাজ হঠাৎ লাফ মেরে দত্তাকে ধরতে গেল।

দত্তা তাড়াতাড়ি পিছনে সরে গেলেন।

লক্ষ্মী আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কে আছ রক্ষা করো, রক্ষা করো!’

ব্যাঘ্ররাজ অট্টহাস্য করে বললে, ‘ভয় নেই, আমিই তোমাদের রক্ষা করব!’

‘রক্ষা করে, রক্ষা করো!’

‘ওহে মন্ত্রী, একেই বুঝি অরণ্যে রোদন বলে? ও বোকা মেয়েটা চেঁচিয়ে কাকে ডাকতে চায়?’

পিছন থেকে গম্ভীর স্বরে কে বললে, ‘আমাকে।’

ব্যাঘ্ররাজ চমকে ফিরে সবিস্ময়ে দেখলে এক দীর্ঘদেহ সৈনিক স্থির পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন! মাথায় শিরস্ত্রাণ, দেহে বর্ম, পৃষ্ঠে তূণ ও ধনু, কটিবন্ধে তরবারি, ডান হাতে বর্শাদণ্ড। মুখ দেখলেই বুঝতে বিলম্ব হয় না যে তিনি কোনও অসাধারণ পুরুষ।

ব্যাঘ্ররাজ আগন্তুকের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললে, ‘বন থেকে বেরুল টিয়ে, সোনার টোপর মাথায় দিয়ে। তুমি কে বট হে?’

‘আমি সমুদ্রগুপ্ত।’

ব্যাঘ্ররাজের চোখ দুটি যেন ঠিকরে পড়বার মতো হল। বিস্ময়ের আতিশয্যে সে কথা বলতে পারলে না।

দত্তা দৌড়ে সমদ্রগুপ্তের কাছে গিয়ে অবশ হয়ে বসে পড়লেন।

সমুদ্রগুপ্ত প্রশান্ত নেত্রে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেবী, শ্রেষ্ঠ ফুল দেখলেই চেনা যায়, পরিচয়ের দরকার হয় না। মালব-রাজকুমারী, আমার প্রণাম গ্রহণ করুন।’

ব্যাঘ্ররাজ চিৎকার করে বললে, ‘ওহে সমুদ্দুরগুপ্ত, তুমি জানো আমি কে?’

সমুদ্রগুপ্ত একটু হেসে বললেন, ‘নিকৃষ্ট পশুকে দেখলেই চেনা যায়। তুমি ব্যাঘ্ররাজ। এতক্ষণে আমার সৈন্যরা তোমার রাজধানী দখল করছে। পাছে মালব-রাজকুমারীকে নিয়ে তুমি এইদিক দিয়ে পালিয়ে যাও, সেই ভয়েই গুপ্তপথ দিয়ে আমি বাঘগড়ে যাচ্ছিলুম।’

‘একা?’

‘একটু আড়ালেই আমার একহাজার সৈন্য অপেক্ষা করছে। তুমি কি তাদের দেখতে চাও? একবার ভেরি বাজালেই তারা আসবে।’

মন্ত্রী চুপিচুপি বললে, ‘এখন বুঝুন মহারাজ, এদিকে এসে আপনি কী অন্যায় করেছেন।’

দাঁতে দাঁত ঘষে ব্যাঘ্ররাজ বললে, ‘কী বলব সমুদ্দুরগুপ্ত, নিতান্ত একলা পড়ে গেছি, নইলে তোমাকে একবার দেখে নিতুম।’

সমুদ্রগুপ্ত সে কথার জবাব না দিয়ে হেঁট হয়ে দত্তার হাত ধরে তুলে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

ব্যাঘ্ররাজ গর্জন করে বললে, ‘কী! আমার বউ-এর গায়ে হাত! মন্ত্রী, মন্ত্রী, থাবড়া মেরে সমুদ্দুরগুপ্ত গালটা ভেঙে দিয়ে এসো তো!’

মন্ত্রী বললে, ‘মহারাজ, ও কাজটা আমার চেয়ে আপনিই ভালো করে করতে পারবেন। আমি এখন পালালুম।’

ব্যাঘ্ররাজ ব্যস্ত হয়ে বললে, ‘দাঁড়াও হে মন্ত্রী, দাঁড়াও! আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি!’

সমুদ্রগুপ্ত ভেরি বার করে ফুঁ দিলেন!

ব্যাঘ্ররাজ সভয়ে বললে, ‘ও মন্ত্রী, ও যে আবার শিঙে বাজায় গো!’

মন্ত্রী হতাশভাবে বললে, ‘এইবারে আমাদেরও শিঙে ফুঁকতে হবে! ওই দেখুন, চারিধার থেকে দলে দলে সেপাই আসছে।’

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

শিকেয় তুলে গল্পকথাগুলি,
ঘাঁটব এবার ইতিহাসের ঝুলি!

.

ব্যাঘ্ররাজকে পরাজিত করে সমুদ্রগুপ্ত দিগবিজয় ব্রত সমাপ্ত করবার জন্যে আবার অন্য দিকে যাত্রা করলেন।

এই ফাঁকে আমরা দু-একটা কথা বলে নিই। বাজে নয়, কাজের কথা।

একশো বছর আগে সমুদ্রগুপ্তের নামও কেউ জানত না বললে অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু তারপরে পণ্ডিতদের প্রাণপণ চেষ্টায় বহু শিলালিপি, প্রাচীন মুদ্রা ও অন্যান্য প্রমাণ আবিষ্কৃত হয়েছে। আজ ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মতে তিনি হচ্ছেন প্রাচীন ভারতের নেপোলিয়ন এবং মাত্র তিন বৎসরের মধ্যে প্রায় সমগ্র ভারত (তিন হাজার মাইল) জয় করে তিনি প্রমাণিত করেছেন, তাঁর কীর্তিকাহিনি অনায়াসেই আলেকজান্ডারের দিগবিজয়ের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে!

এক হিসাবে আলেকজান্ডারের চেয়ে সমুদ্রগুপ্তকে শ্রেষ্ঠ প্রতিভার অধিকারী বলা চলে। প্রথমত, সমুদ্রগুপ্ত কেবল দিগ্বিজয়ী ছিলেন না, কাব্য ও সংগীতেও তিনি প্রথম শ্রেণির শিল্পী বলে বিখ্যাত। দ্বিতীয়ত, আলেকজান্ডারের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই তার সাম্রাজ্যের পতন হয়। কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত এমন দৃঢ় ভিত্তির উপরে সাম্রাজ্য স্থাপন করে গিয়েছিলেন যে তার পরমায়ু হয়েছিল প্রায় দুই শত বৎসর।

সমুদ্রগুপ্তের দ্বারা প্রচারিত তিনটি স্বর্ণমুদ্রার প্রতিলিপি আমরা দেখেছি। এই সচিত্র মুদ্রা তিনটি চমৎকার। এর লেখাগুলি বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় ব্রাহ্মী অক্ষরে। মুদ্রাগুলির ছবি থেকে চতুর্থ শতাব্দীর ভারতীয় সাজপোশাক ও আসবাবের কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায় এবং সমুদ্রগুপ্ত ও তাঁর পিতা-মাতার আকৃতি-প্রকৃতি সম্বন্ধেও অল্পবিস্তর আন্দাজ করা যেতে পারে। মুদ্রা তিনটির বর্ণনা দিলুম।

প্রথম মুদ্রা : শিল্পী সমুদ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসে বীণা বাজাচ্ছেন। সিংহাসন বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি, এ সে রকম সিংহাসন নয়। একখানা সামনের দিকে লম্বাটে, কিছু বেশি উঁচু, বাহারি পায়াওয়ালা জলচৌকির উপরে চেয়ারের মতো পিঠ রাখবার জায়গা থাকলে দেখতে যে রকম হয় এই সিংহাসন হচ্ছে সেই রকম। এ সিংহাসনকে ভারতীয় কৌচ বলাও চলে। অবশ্য, সিংহাসনটি কী দিয়ে তৈরি সেটা বলা কঠিন। সোনা-রুপো বা অন্য কোনও ধাতুরও হতে পারে, কাঠের বা হাতির দাঁতেরও হতে পারে। ডান পায়ের উপর দিয়ে বাঁ-পা ঝুলিয়ে সমুদ্রগুপ্ত উপবিষ্ট, বাঁ-পায়ের তলায় পাদপীঠ। তাঁর পেশিবদ্ধ, চওড়া বুক। প্রভামণ্ডলের মাঝখানে খালি মাথা, কানে প্রায় কাঁধ পর্যন্ত ঝুলে পড়া কুণ্ডল, গলায় হার। পরনে হাঁটুর উপরে খাটো কাপড়—সেকালের রাজারাজড়ারা যে রাজসভার বাইরে বেশি কাপড়-চোপড় পরতেন না, এটা হচ্ছে তারই প্রমাণ। তাঁর হাতের বীণাটি অলাবুহীন, ধনুকাকৃতি—অনেকটা প্রাচীন ইউরোপীয় বীণার মতো। নাকটি বেশ দেখা যায়। গঠন ছিপছিপে, কিন্তু বলিষ্ঠ। মুদ্রার চারিধারে মণ্ডলাকারে লেখা—’মহারাজাধিরাজ শ্রীসমুদ্রগুপ্তঃ’।

দ্বিতীয় মুদ্রা : যোদ্ধা, দিগবিজয়ী সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত দাঁড়িয়ে আছেন। মাথায় শিরস্ত্রাণ, কানে কুণ্ডল, ঊর্ধ্বোত্থিত বাম হাতে ধনুক, ডান হাতে তরবারি কিংবা দণ্ড, পরনে পাজামা, পায়ে পাদুকা। অশ্বারোহীর বেশ। সমুদ্রগুপ্ত বৈষ্ণব ছিলেন, তাই তাঁর সামনে গরুড়ধ্বজার উপরে গরুড়ের মূর্তি। সমুদ্রগুপ্তের এ মূর্তির মুখেও বিশেষরূপে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর সুদীর্ঘ নাসিকাটি।

তৃতীয় মুদ্রা : সমুদ্রগুপ্ত এর উপরে দেখিয়েছেন তাঁর পিতা প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও মাতা কুমারদেবীকে। এটি নাকি তাঁদের বিবাহের স্মারক মুদ্রা। মা কুমারদেবী মহাসম্ভ্রান্ত ও প্রাচীন লিচ্ছবি রাজবংশের মেয়ে বলে সমুদ্রগুপ্ত যথেষ্ট গর্ব অনুভব করতেন। চন্দ্রগুপ্তের যোদ্ধার বেশ। কুমারদেবীর দেহের উপর-অংশ অনাবৃত। পণ্ডিতেরা বলেন, সেকালের রাজপরিবারেরও মেয়েরা খালি বা আদুল গায়ে থাকতেন (কিন্তু গুপ্ত-রাজত্বেই মহাকবি কালিদাসের উদয় হয়েছিল, তাঁর কাব্যে কি এর নজির আছে?)। চন্দ্রগুপ্ত ডান হাতে করে রানি কুমারদেবীর হাতে কী একটা গহনা পরিয়ে দিচ্ছেন, তাঁর বাঁ হাতে অর্ধচন্দ্র-পতাকা। তাঁর বাঁ পাশে উপর থেকে নীচে লেখা ‘চন্দ্রগুপ্ত’ এবং নারীমূর্তির ডান পাশে লেখা ‘শ্রীকুমারদেবী।’

সমুদ্রগুপ্ত প্রভৃতির চেহারা ও পোশাকের কথা বলা হল। কিন্তু কী রকম ফৌজ নিয়ে তিনি দিগবিজয়ে বেরিয়েছিলেন, এবারে সেটা দেখা দরকার। তবে এ বিভাগে আমাদের অল্পবিস্তর অনুমানের সাহায্য নিতে হবে, কারণ, সমুদ্রগুপ্ত নিজের দিগবিজয় কাহিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন বটে, কিন্তু নিজের বাহিনীর বর্ণনা দেননি।

তবে আমাদের অনুমান বিশেষ ভ্রান্ত হবে না। কারণ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ভারতের যুদ্ধশাস্ত্র সেনাগঠনের যেসব নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল, কয়েক শতাব্দীর মধ্যে তার আর কোনও অদল-বদল হয়নি বললেও চলে। রামায়ণে—বিশেষ করে মহাভারতে ফৌজ ও যুদ্ধরীতির যেসব বর্ণনা পড়ি, কবিকল্পনার অত্যুক্তি ত্যাগ করলে দেখি আলেকজান্ডারের ভারতীয় অভিযানের সময়েও সেসব বর্ণনার অনেকটাই হুবহু মিলে যায়। সমুদ্রগুপ্তেরও ঢের পরে, সপ্তম শতাব্দীর সম্রাট হর্ষবর্ধন প্রাচীন রীতির কিছু কিছু ত্যাগ করেছিলেন। ভারতীয় ফৌজের প্রধান একটি অঙ্গ—অর্থাৎ রথারোহী সৈন্যদল তিনি গঠন করেননি। যদিও হর্ষবর্ধনের যুগে অন্যান্য যুদ্ধের সময়ে যে রথ ব্যবহৃত হত তার প্রমাণ আছে। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের বর্ণনায় দেখি, একজন ভারতীয় সেনাপতি চার ঘোড়ায় টানা রথে চেপে এক দেহরক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেছেন।

এ গেল সপ্তম শতাব্দীর কথা। এরও প্রায় একহাজার বছর আগেকার যবনিকা তুললে দেখা যাবে, গ্রিকদের বিরুদ্ধে রাজা পুরুর রথারোহী সৈন্যেরা যুদ্ধে চলেছে। প্রত্যেক রথে জোড়া চার ঘোড়া এবং প্রত্যেক রথের উপরে রয়েছে যে ছয়জন করে আরোহী, তাদের মধ্যে দুজন হচ্ছে ঢাল-বাহী, দুজন ধনুকধারী এবং দুজন সারথি। শত্রুদের ভিতরে গিয়ে পড়লে, হাতাহাতি যুদ্ধের সময়ে সারথিরাও ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে ধনুর্বাণ নিয়ে লড়াই করে।

এক হাজার বছরের ভিতরে যে দেশে একমাত্র হর্ষবর্ধন (তাও সপ্তম শতকে) ছাড়া আর কেউ ফৌজ গঠনে ভিন্ন উপায় অবলম্বন করেননি, সে দেশে চতুর্থ শতকের যোদ্ধা সমুদ্রগুপ্তও যে ফৌজে প্রাচীন ধারাই বজায় রেখেছিলেন, এটা অনুমান করা কঠিন নয়। অন্তত হর্ষবর্ধনের আগে আর কেউ যে ভিন্নভাবে ভারতীয় ফৌজ গঠন করেছিলেন, এর কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।

আলেকজান্ডারের ভারতীয় অভিযান দেখে কিছু কিছু নতুন শিক্ষা পেয়ে মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর চন্দ্রগুপ্ত হয়তো স্বগঠিত ফৌজকে অল্পবিস্তর পরিবর্তিত করেছিলেন এবং তারপর থেকে খুব সম্ভব মৌর্য ফৌজই ছিল ভারতের আদর্শস্থানীয়। কিন্তু প্রথম ভারত সম্রাট মৌর্য চন্দ্রগুপ্তও চিরাচরিত প্রথা অনুসারে ফৌজের প্রধান চার অঙ্গই বজায় রেখেছিলেন, যথা—অশ্বারোহী, পদাতিক, হস্তী ও রথ। এবং সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত সেনাবিভাগের এই চতুরঙ্গ অবলম্বন করেই প্রত্যেক রাজা করতেন যুদ্ধযাত্রা।

ভারতের অতীত গৌরবের প্রতি সমুদ্রগুপ্তের ছিল অতিশয় অনুরাগ। আর্য সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান ও দর্শনকে পুনর্বার নবজীবনে পরিপুষ্ট করে তোলবার চেষ্টাই যে ছিল তার জীবনের সাধনা, এর ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাব নেই। বুদ্ধদেবের জন্মের আগে ভারতের অবস্থা কী রকম ছিল তার কোনও ঐতিহাসিক ছবি নেই বটে, কিন্তু রামায়ণ ও মহাভারত প্রভৃতি মহাকাব্যের মধ্যে আর্য আদর্শ এবং সংস্কৃতি প্রভৃতির বড় অল্প পরিচয় পাওয়া যায় না। সমুদ্রগুপ্ত সেই আদর্শ, সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে আবার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন এবং ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন অধিকতর সমুজ্জ্বল রূপেই। বৌদ্ধধর্মের আসরে তিনি হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং হিন্দু শিল্প ও সাহিত্যকে করেছিলেন বিদেশি প্রভাব থেকে মুক্ত। তাঁর যুগে পালি ও প্রাকৃতের বদলে দেবভাষা সংস্কৃতই হয়েছিল সাহিত্যের ভাষা। অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রথা লুপ্ত হয়েছিল বৌদ্ধদের অহিংস ধর্মের মহিমায়। সমুদ্রগুপ্ত আবার সেই প্রথার পুনঃপ্রচলন করেন। এমনকী তাঁর দিগবিজয় যাত্রার মধ্যেও দেখতে পাই রামায়ণ-মহাভারতে কথিত পৌরাণিক দিগবিজয়ীদের অনুসরণ। সুতরাং ফৌজ গঠনের সময়েও তিনি যে পুরাতন যুদ্ধশাস্ত্রের নিয়ম মেনেই কাজ করতেন এ বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। নিঃসন্দেহ হওয়ার আর একটা বড় কারণ এই যে ফৌজ গঠনে সমুদ্রগুপ্ত নতুন রীতি অবলম্বন করলে পরবর্তী যুগের যোদ্ধারাও পুরাতনকে ছেড়ে এই নতুন ও সফল রীতিই গ্রহণ করত। কিন্তু তা হয়নি। সপ্তম শতাব্দীতেও দেখি, ভারতীয় যুদ্ধক্ষেত্রে ফৌজের প্রাচীন চতুরঙ্গের কোনও অঙ্গের হানি হয়নি।

মৌর্য যুগে ভারতীয় বাহিনী কী ভাবে গঠিত হত তা দেখলেই সকলে সমুদ্রগুপ্তের ফৌজ সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা করতে পারবেন।

সেকালে ভারতের বড় বড় রাজরাজড়াদের কারবার ছিল অগুন্তি সৈন্য নিয়ে। রাজা পুরু মোটে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে গ্রিকদের গতিরোধের চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি খুব বড় দরের রাজা ছিলেন না, গ্রিকদের সংস্পর্শে না এলে আজ তাঁর নাম পর্যন্ত কেউ জানত না। ভারতে তখনকার শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন মগধের মহারাজা নন্দ—যাঁর ভয়ে আলেকজান্ডারকে পর্যন্ত ভারতবিজয় অসমাপ্ত রেখে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করতে হয়েছিল! গ্রিক ঐতিহাসিক প্লিনি বলেন, নন্দের অধীনে ছিল আশি হাজার অশ্বারোহী, দুই লক্ষ পদাতিক, আট হাজার রথ (প্রত্যেক রথে থাকত সারথি ও দুজন করে যোদ্ধা—সুতরাং আট হাজার রথ মানে চব্বিশ হাজার লোক), ছয় হাজার হাতি (প্রত্যেক হাতির উপরে থাকত মাহুত ও তিনজন করে ধনুকধারী—সুতরাং ছয় হাজার হাতি মানে চব্বিশ হাজার লোক)! অতএব মান বাঁচিয়ে সরে পড়ে আলেকজান্ডার বুদ্ধিমানেরই কাজ করেছিলেন।

চন্দ্রগুপ্ত মগধ জয় করে এই সৈন্যসংখ্যা আরও ঢের বাড়িয়ে তুলেছিলেন। তাঁর অধীনে ছিল ছয় লক্ষ পদাতিক সৈন্য, তিরিশ হাজার অশ্বারোহী, ছত্রিশ হাজার গজারোহী এবং চব্বিশ হাজার রথারোহী—মোট ছয় লক্ষ নব্বই হাজার নিয়মিত সৈন্য!

ভারতের অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থাৎ প্রাদেশিক রাজারাও বেশি লোক নিয়ে নাড়াচাড়া করতে না পারলে খুশি হতেন না। অনেক কালের কথা নয়, মধ্যযুগেও বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব (১৫০৯-২৯ খ্রিস্টাব্দ) সাত লক্ষ তিন হাজার পদাতিক, বত্রিশ হাজার ছয়শো অশ্বারোহী ও পাঁচশো একান্ন রণহস্তী নিয়ে এক প্রতিদ্বন্দ্বী রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন!

সমুদ্রগুপ্ত বেরিয়েছিলেন প্রায় সমস্ত ভারত জয় করতে। সুতরাং তাঁর মতো দিগ্বিজয়ীর অধীনে কত লক্ষ সৈন্য ছিল, তা অনুমান করা কঠিন নয়।

এই বিরাট ফৌজের তত্বাবধান করা হত কী উপায়ে, মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের কার্যবিধি দেখলেই আমরা সেটা ধারণা করতে পারব।

চন্দ্রগুপ্ত তাঁর বাহিনীকে ছয় বিভাগে বিভক্ত করেছিলেন। পরিচালনার জন্যে তিনি তিরিশজন প্রধান কর্মচারী রেখেছিলেন—প্রত্যেক বিভাগে পাঁচজন করে। বিভাগগুলি এই :

প্রথম : নৌ বিভাগ। দ্বিতীয় : রসদ বিভাগ। মাল চালান দেওয়ার, দামামাবাহক, সহিস, কারিকর ও ঘেষেড়া প্রভৃতিরও খোরাকের জন্যে ভালো ব্যবস্থা ছিল। তৃতীয় : পদাতিক বিভাগ। চতুর্থ : অশ্বারোহী বিভাগ। পঞ্চম : যুদ্ধরথ বিভাগ। ষষ্ঠ : রণহস্তী বিভাগ।

আগেই বলা হয়েছে, ভারতীয় ফৌজ চিরকালই পদাতিক, অশ্বারোহী, রথ ও হস্তী—এই চার অঙ্গ নিয়ে গঠিত হত। চন্দ্রগুপ্তের প্রতিভা এর সঙ্গে অতিরিক্ত আরও দুটি অঙ্গ জুড়ে দিয়েছিল—রসদ ও নৌ বিভাগ। হয়তো গ্রিকদের ফৌজ পর্যবেক্ষণ করে এই দুটি অঙ্গের প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। সমুদ্রগুপ্তকেও সমগ্র ভারত জুড়ে সৈন্যচালনা করতে হয়েছিল। রসদের সুব্যবস্থা না থাকলে এটা অসম্ভব হত। যাত্রাপথে পড়ত তাঁর বহু সেতুহীন নদ-নদী। সুতরাং তাঁর নৌ বিভাগও না থাকলে চলত না। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, চন্দ্রগুপ্তের দেখাদেখি তিনিও এই দুটি অঙ্গকে পুরাতন চতুরঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন।

চন্দ্রগুপ্ত যথেচ্ছভাবে বা ভাড়াটে সৈন্য জোগাড় করতেন না। তাঁর প্রত্যেক সৈন্য নিজস্ব, তাদের তিনি নিয়মিত মাহিনা দিতেন। ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র, সাজপোশাক ও রসদ—সমস্তই দেওয়া হত রাজভাণ্ডার থেকেই। মধ্যযুগেও ভারতের ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশে এ প্রথা ছিল না। কারণ সৈনিকরা হত হয় ভাড়াটে, নয় নিজেদের ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র, সাজপোশাক সংগ্রহ করত নিজেরাই। অনেক সময়েই তাদের রসদও দেওয়া হত না, তারা যাত্রাপথে যেসব গ্রাম-নগর পড়ত, লুঠ করে পেট ভরাবার ব্যবস্থা করত। সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত তিরিশবৎসরব্যাপী ইউরোপীয় যুদ্ধের সময়ে ওদেশে লোকে বলত—’যার তরবারি নেই, জামাকাপড় বেচে সে তরবারি কিনুক, তা হলেই সেপাই হতে পারবে!’ ওই সময়েই দেখা গিয়েছিল, ব্যাভেরিয়ার ফৌজে লোক আছে এক লক্ষ আশি হাজার, কিন্তু রাজভাণ্ডার রসদ জোগায় মাত্র চল্লিশ হাজার লোকের জন্যে। বাকি এক লক্ষ চল্লিশ হাজার লোক খাবার জোগাড় করত যথেচ্ছভাবে—অর্থাৎ চুরি, রাহাজানি, লুঠপাট প্রভৃতির দ্বারা!

চাণক্যের মত ছিল, ফৌজের পক্ষে সবচেয়ে দরকারি হচ্ছে, রণহস্তীরা। কারণ শত্রুসৈন্য ধ্বংস হয় তাদের দ্বারাই।

প্রত্যেক অশ্বারোহীর কাছে থাকত একখানা করে ঢাল ও দুটি করে বল্লম। পদাতিকের প্রধান অস্ত্র ছিল চওড়া ফলকওয়ালা তরবারি এবং অতিরিক্ত অস্ত্ররূপে তারা সঙ্গে নিত শূল বা ধনুকবাণ। আমরা এখন যেভাবে বাণ ছুড়ি, তারা সেভাবে ছুড়ত না। গ্রিক ঐতিহাসিক এরিয়ান বলেন, ‘ভারতীয় সৈনিকরা ধনুকের এক প্রান্ত মাটির উপরে রেখে, বাঁ-পায়ের চাপ দিয়ে এমন ভয়ানক জোরে বাণ ত্যাগ করত যে, শত্রুদের ঢাল ও লৌহবর্ম পর্যন্ত কোনও কাজে লাগত না!’ বোঝা যাচ্ছে, সেকালের ধনুক হত আকারে রীতিমতো বৃহৎ!

এতক্ষণে প্রাচীন ভারতীয় ফৌজ সম্বন্ধে পাঠকরা নিশ্চয় অল্পবিস্তর ধারণা করতে পেরেছেন। সমুদ্রগুপ্ত এই ধরনের বাহিনী নিয়েই চতুর্থ শতাব্দীর ভারতবর্ষের দিকে দিকে উড়িয়েছিলেন তাঁর রক্তাক্ত বিজয়পতাকা! তিনি বৈষ্ণব ছিলেন বটে, কিন্তু প্রচণ্ড শক্তিমন্ত্রের দ্বারা করতেন বিষ্ণু উপাসনা! একালের গোঁড়া বৈষ্ণবেরা নিরামিষ খায় জীবহত্যার ভয়ে। এ হচ্ছে কেবল তাদের ভীরুতা, শক্তিহীনতা ও কাপুরুষতা লুকোবার বাজে ওজর! কারণ বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীর প্রধান উপাস্য যিনি সেই বিষ্ণু কেবল হাতে পদ্ম নিয়ে কমলবিলাসীরূপে পরিচিত নন, অধর্মের কবল থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে রক্তপাতেও তাঁর যে কিছুমাত্র আপত্তি নেই, ভয়াবহ গদা ও শাণিত সুদর্শন চক্র ধারণ করে সেই সত্যই তিনি প্রকাশ করতে চান।

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

হিন্দু ভারত ঐক্য-বাঁধনে যুক্ত,
জয় মহারাজ! জয় সমুদ্রগুপ্ত!

.

তিন বছরে ভারতের তিন হাজার মাইলব্যাপী ভূভাগের উপরে নিজের জয়পতাকা উড়িয়ে দিগবিজয়ী সমুদ্রগুপ্ত আবার ফিরে এলেন মগধরাজ্য। তাঁর আগে আর কোনও ভারতীয় বীর এমন অসাধ্য সাধন করতে পারেননি।

এ যুগের কাছে সমুদ্রগুপ্তের এই দিগ্বিজয় কাহিনি হয়তো খুব অসাধারণ বলে মনে হবে না। আধুনিক যুদ্ধনায়করা সুনির্মিত রাস্তা, রেলপথ, মটরযান, বাষ্পীয় পোত ও উড়োজাহাজ প্রভৃতির প্রাসাদে তিন হাজার মাইলকে হয়তো বেশি গ্রাহ্য করবেন না। কিন্তু সেকালে এ সবের কিছুই ছিল না। নিরন্ধ্র অরণ্য, উত্তুঙ্গ পর্বত, প্রশস্ত নদ-নদী পার হয়ে বিপুল বাহিনী নিয়ে পদে পদে বিদেশি শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ভারতের এক প্রান্ত থেকে আর প্রান্তে ছোটাছুটি করা তখনকার দিনে যে কী অসম্ভব ব্যাপার ছিল, আজকের দিনে আমরা তা ধারণাও করতে পারব না।

সমুদ্রগুপ্ত বাধা পেয়েছেন বহুবার, কিন্তু কোথাও তিনি পরাজিত হয়েছেন বা পলায়ন করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর কোনও দিগ্বিজয়ীর সম্বন্ধেই বোধ হয় একথা বলা যায় না (আগেই বলেছি, আলেকজান্ডারকেও নন্দ রাজার ভয়ে ভারতজয় কার্য অসমাপ্ত রেখে পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করতে হয়েছিল)। এবং এটাই হচ্ছে সমুদ্রগুপ্তের অতুলনীয় যুদ্ধ-প্রতিভার প্রধান প্রমাণ।

তাঁকে যে অসংখ্য যুদ্ধ জয় করতে হয়েছিল, এ কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে সেসব যুদ্ধের কোনও ইতিহাসই আর পাওয়ার উপায় নেই। তবে এলাহাবাদের অশোক-স্তম্ভের উপরে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে কবি হরি সেন (ষেণ?) বহু পরাজিত রাজার নাম করেছেন, আমরাও এখানে তাঁদের উল্লেখ করতে পারি।

আর্যাবর্তের বা উত্তর ভারতের অহিছত্রের অধিপতি অচ্যুত (মহাভারতে উক্ত দ্রুপদ রাজা এই অহিছত্রে রাজত্ব করতেন, সম্প্রতি এর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে), মথুরার রাজা নাগ সেন, পদ্মাবতীর (সিন্ধিয়া রাজ্যের আধুনিক নারওয়ার শহরের কাছে) রাজা গণপতি নাগ এবং রুদ্রদেব, মতিল, নাগদত্ত, নন্দী, বলবর্মা ও চন্দ্রবর্মা প্রভৃতি)।

কথিত আছে, রাজা প্রবর সেনের পক্ষ অবলম্বন করে মথুরা। পদ্মাবতী ও অহিছত্রের রাজারা এলাহাবাদের কাছে একসঙ্গে সমুদ্রগুপ্তকে আক্রমণ করে পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন। এতগুলি রাজার বিরুদ্ধে একাকী দাঁড়িয়ে সমুদ্রগুপ্ত জয়মাল্য অর্জন করেছিলেন, এও তাঁর সাহস ও যুদ্ধ-প্রতিভার আর একটি উজ্জ্বল নিদর্শন।

উপরে সর্বশেষে যে চন্দ্রবর্মার নাম করা হয়েছে, তাঁর সম্বন্ধেও কিছু বক্তব্য আছে। তিনি উত্তর ভারতের এক অতি পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন। রাজপুতানার মরুপ্রদেশে পুষ্করণা নামক স্থানে তিনি রাজত্ব করতেন। দিল্লির লৌহ স্তম্ভে উৎকীর্ণ শিলালিপি পড়ে জানা গিয়েছে, সমুদ্রগুপ্তের অভ্যুত্থানের কিছু আগেই তিনি বাংলা থেকে বাল্হিক দেশ পর্যন্ত—অর্থাৎ সমস্ত আর্যাবত নিজের দখলে এনেছিলেন। কিন্তু এত বড় শক্তিশালী রাজাকেও সমুদ্রগুপ্তের সামনে পরাজয় স্বীকার ও মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল।

উত্তরাপথ দখল করবার পর সমুদ্রগুপ্ত অগ্রসর হলেন দক্ষিণাপথে। এদিকে সমুদ্রগুপ্তের কাছে যাঁরা হেরে গিয়েছিলেন তাঁদের কয়েকজনের নাম : ১। দক্ষিণ কোশলের রাজা মহেন্দ্র, ২। মহাকান্তারের অধিপতি ব্যাঘ্ররাজ, ৩। কৌরলদেশের রাজা মন্টরাজ, ৪। কোট্টুর ও পিষ্টপুরের (আধুনিক পিট্টপুরম) রাজা স্বামীদত্ত, ৫। এরন্ডপল্লের রাজা দমন, ৬। কাঞ্চীর রাজা বিষ্ণু গোপ, ৭। অবমুক্তের রাজা নীলরাজ, ৮। বেঙ্গীনগরের রাজা হস্তিবর্মা, ৯। পলক্কের (সম্ভবত নেলোর জেলায়) রাজা উগ্রসেন, ১০। দেবরাষ্ট্রের (আধুনিক মহারাষ্ট্রের) রাজা কুবের, ১১। কুস্থলপুরের (খন্দেশের) রাজা ধনঞ্জয় প্রভৃতি।

সমুদ্রগুপ্তের কাছে মাথা নত করে কর দিত এই সব জাতি বা রাজ্য : ১। সমতট (যা দক্ষিণ থেকে পূর্ববঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত), ২। ডবাক (বোধ হয় ঢাকার পূর্ব নাম), ৩ কামরূপ, ৪। নেপাল, ৫। কর্তৃপুর (আধুনিক কুমায়ুন ও গাড়োয়াল), ৬। আর্জুনায়ন, ৭। যৌধেয়, ৮। মদ্রক (পাঞ্জাব), ৯। আভীর, ১০। সনকানীক (মালব), ১১। কাক, ১২। খরপরিক।

তখনকার ভারতে যেসব রাজা সবচেয়ে বিখ্যাত ও পরাক্রমশালী ছিলেন, সমুদ্রগুপ্তের শিলালিপিতে নিশ্চয়ই কেবলমাত্র তাঁদেরই নাম স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া তাঁর দিগ্বিজয়ের নেশার মধ্যে যে আরও কত রাজার প্রাণ ও রাজ্য লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, সে হিসাব দেওয়া সম্ভব নয়।

শত শত রাজ্যের বিপুল ঐশ্বর্য ভারে ভারে এসে মগধের রাজভাণ্ডারকে করে তুললে যক্ষপতি কুবেরের রত্নভাণ্ডারের মতো। জনবলে, অর্থবলে ও অপূর্ব খ্যাতিতে মগধের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, ভারতবর্ষে এমন রাজ্য আর দ্বিতীয় রইল না। প্রিয়দর্শী সম্রাট অশোকের তিরোধানের পরে মহানগর পাটলিপুত্র কেবল পূর্বগৌরব থেকেই বঞ্চিত হয়নি, তার জীবনীশক্তিও ক্ষীণ হয়ে আসছিল ক্রমশ। সমুদ্রগুপ্তের শৌর্যবীর্য আবার তাকে করে তুললে নবযৌবনে বলীয়ান, বিচিত্র মহিমায় মহীয়ান।

ভারতের সীমান্তে ও আশেপাশের রাজ্যাধিকারীরা সমুদ্রগুপ্তের তরবারির সঙ্গে পরিচিত না হয়েও সসম্ভ্রমে উপলব্ধি করলেন যে বহুকাল পরে হিন্দুস্থানে আবার এমন এক বৃহৎ জ্যোতিষ্কের উদয় হয়েছে, যাকে আর মাথা নামিয়ে স্বীকার না করে উপায় নেই। এঁর সঙ্গে শত্রুতা করলে মৃত্যু অনিবার্য, মিত্রতা রাখতে পারা গর্ব ও সৌভাগ্যের বিষয়। গ্রিক, পারসি ও অন্যান্য জাতীয় বৈদেশিক দস্যুরা দুর্বলতার সুযোগ পেলেই ভারতকে লুণ্ঠন করবার জন্যে ছুটে আসত সাগ্রহে, তারা এখন আর আর্যাবর্তের দিকে ফিরে তাকাতেও ভরসা করল না। নিরাপদ হওয়ার জন্যে কাবুলের কুষাণ রাজা সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করলেন।

এই সময়ে (৩৬০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি) সুদূর সিংহল থেকে দুজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এলেন বুদ্ধগয়ায় তীর্থ করতে। সমুদ্রগুপ্তের উৎসাহে নবজাগ্রত হিন্দুত্বের প্রাথমিক উত্তেজনায় মগধের প্রজারা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের উচিত মতো আদর করেনি, সম্মান দেখায়নি। সন্ন্যাসীরা নানা অসুবিধা ভোগ করে দেশে ফিরে গিয়ে সিংহলের রাজা শ্রীমেঘবর্ণের কাছে সব কথা জানালেন। মেঘবর্ণ তখনই সমুদ্রগুপ্তের কাছে বহূমূল্য উপহার পাঠিয়ে সিংহলী বৌদ্ধদের জন্যে বুদ্ধগয়ায় একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন।

বলেছি, হিন্দু ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে জাগিয়ে তোলাই ছিল সমুদ্রগুপ্তের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য এবং তিনি নিজেও ছিলেন বিষ্ণুর পূজক। কিন্তু তাঁরও কয়েক শতাব্দী আগে শেষ মৌর্য রাজাকে হত্যা করে সেনাপতি পুষ্যমিত্র যেমন মগধের সিংহাসনে হিন্দুত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবার জন্যে অগুন্তি বৌদ্ধ মঠ-মন্দির ভেঙে হাজার হাজার বৌদ্ধকে তরবারির মুখে সমর্পণ করেছিলেন, সমুদ্রগুপ্ত তেমন হিংসুক হিন্দু ছিলেন না। তাঁর মন ছিল পরম উদার, তাই বৌদ্ধ না হয়েও বৌদ্ধ বসুবন্ধুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হননি। সুতরাং তিনি সানন্দেই বুদ্ধগয়ায় নতুন মঠ প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে সিংহলপতির কাছে নিজের সম্মতি জানালেন। সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে রোম ও চিন সাম্রাজ্যের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল।

কিন্তু তিনি পিতার মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিজ্ঞার কথা ভোলেননি। দিগবিজয়ের কর্তব্য সমাপ্ত, কিন্তু এখনও অশ্বমেধ যজ্ঞ করা হয়নি।

বহু শতাব্দী আগে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্যের জন্যে ভারত থেকে অশ্বমেধের প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কারণ ওই দুই ধর্মে জীবহিংসা নিষিদ্ধ। তারপর পুষ্যমিত্রের রাজত্বকালে হিন্দুত্বের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই আবার অশ্বমেধের বৈদিক অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু সেও পাঁচ শতাব্দীরও বেশি আগেকার কথা।

এরই মধ্যে কুষাণ সম্রাটদের যুগে বৌদ্ধধর্ম আবার মাথা তোলবার অবসর পায়। তারপর ভারতে আসে অন্ধকারযুগ এবং আর্যাবর্ত হয়ে যায় খণ্ড খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত। সে সময়ে হিন্দু রাজার অভাব ছিল না বটে—কিন্তু তাঁদের কারুর অশ্বমেধের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করবার শক্তি ও সাহস ছিল না। কারণ যিনি মহাশক্তিমান সার্বভৌম সম্রাট নন, তাঁর পক্ষে অশ্বমেধ যজ্ঞের দুরাশা করা বামনের চাঁদ ধরবার দুশ্চেষ্টা করার মতো হাস্যকর।

অশ্বমেধ বিধি হচ্ছে এই : একটি বিশেষ লক্ষণযুক্ত ঘোড়াকে মন্ত্রপূত করে তার মাথায় জয়পত্র বেঁধে নানা দেশে বেড়াবার জন্যে ছেড়ে দেওয়া হত—তার সঙ্গে সঙ্গে থাকত বহু সশস্ত্র রক্ষক। রাজা বা তাঁর প্রতিনিধিও সঙ্গে যেতেন। ঘোড়া কোনও বিদেশি রাজার রাজ্যে ঢুকলে তাঁকে হয় যুদ্ধ করতে, নয় বশ মানতে হত। এক বৎসর ধরে ঘোড়ার সঙ্গে এই যাত্রা চলত। যে যে দেশের ভিতর দিয়ে ঘোড়া অগ্রসর হত তার প্রত্যেকটিরই রাজা যদি অধীনতা স্বীকার করতেন, তাহলে ঘোড়ার মালিক দিগ্বিজয়ী বীরের মতো বশীভূত রাজাদের সঙ্গে নিয়ে স্বদেশে ফিরে আসতেন। কোনও স্থানে পরাজিত হলে লোকে তাঁকে উপহাস করত, সার্বভৌম সম্রাট বলে মানত না এবং তিনি যজ্ঞাধিকারীও হতে পারতেন না। সফল হয়ে ফিরে এলে পর চৈত্র পূর্ণিমায় খুব ঘটা করে যজ্ঞ আরম্ভ হত। ঘোড়াকে দেওয়া হত বলি। ঘোড়ার বুকের চর্বিতে হত যজ্ঞাগ্নির সংস্কার এবং তার দেহের মাংস পুড়িয়ে করা হত হোম। যজ্ঞ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনুষ্ঠাতা উপবাস করে থাকতেন এবং রাত্রে তাঁকে সস্ত্রীক শয্যাহীন মাটির উপরে শুয়ে ঘুমোতে হত।

নির্বিঘ্নে অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান করে সমুদ্রগুপ্ত প্রমাণিত করলেন যে তিনিই হচ্ছেন ভারতের একচ্ছত্র সম্রাট, এখানে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন এমন আর কেউ নেই।

কথিত আছে, এই যজ্ঞ উপলক্ষ্যে ভারতব্যাপী গুপ্তসাম্রাজ্যের রাজধানী পাটলিপুত্র নগরে মহোৎসবের সাড়া পড়ে গিয়েছিল এবং মহারানি দত্তাদেবীকে নিয়ে মহারাজাধিরাজ সমুদ্রগুপ্ত যে যজ্ঞের প্রত্যেকটি নিয়ম পালন করেছিলেন, সে বিষয়েও সন্দেহ নেই। ব্রাহ্মণরা দান পেয়েছিল কোটি কোটি মুদ্রা।

দক্ষিণা দেওয়ার জন্যে, সমুদ্রগুপ্ত নতুন রকমের স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করিয়েছিলেন। তার এক পিঠে আছে যজ্ঞযূপে বাঁধা বলির ঘোড়ার মূর্তি, অন্য পিঠে সমুদ্রগুপ্তের মহারানির মূর্তি। এই দুষ্প্রাপ্য মুদ্রার একটি নমুনা কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রক্ষিত আছে। সমুদ্রগুপ্তের হুকুমে গড়া তাঁর অশ্বমেধের ঘোড়ার একটি পাথরের মূর্তিও হিমালয়ের তলায় বনের ভিতরে আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি আছে লক্ষ্ণৌ-এর জাদুঘরে।

কবি হরিসেন শিলাপটে সমুদ্রগুপ্তের যে সমুজ্জ্বল শব্দচিত্র এঁকে গেছেন তাতে দেখি যে তিনি একাধারে দিগবিজয়ী সম্রাট, গীতবাদ্যে প্রথম শ্রেণির শিল্পী এবং কাব্যরাজ্যেও শ্রেষ্ঠ কবির সমকক্ষ।

দিগবিজয়ের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করার পরও অধিকাংশ দিগবিজয়ীর রক্ত-নেশা পরিতৃপ্ত হয় না এবং অনেক দিগবিজয়ীই অন্তিম শ্বাস ত্যাগ করেছেন রক্তাক্ত তরবারি হাতে করেই। কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত এ-শ্রেণির যুদ্ধপাগল বীর ছিলেন না। যুদ্ধপর্ব যখন সমাপ্ত হল, তখন তিনি একাগ্র চিত্তে নানাদিকে নানা সুব্যবস্থা করে নিজের সাম্রাজ্যের ভিত্তি দৃঢ়তর করে তোলবার চেষ্টায় নিযুক্ত হলেন। এত যত্নে প্রজাপালন করতে লাগলেন যে তাঁর রাজ্য হয়ে উঠল রামরাজ্যের মতো। তাঁর শক্তি ও বীরত্ব দেখে যারা মনে মনে তাঁকে মানত না তারাও ভয়ে হয়ে পড়েছিল বিষহারা নতফণা সর্পের মতো। কঠিন ও দৃঢ় হস্ত রাজদণ্ড ধারণ করে আছে দেখে দস্যু, চোর ও অসাধুদের দল গেল ভেঙে। এইসব কারণে প্রজাদের সুখের সীমা ছিল না—তারা যাপন করত শান্তিময় জীবন। সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর অনতিকাল পরেই চৈনিক ভ্রমণকারী ফা হিয়েন গুপ্তসাম্রাজ্যে এসে দেখেছেন, এখানে গুরুতর অপরাধের সংখ্যা এত কম যে প্রাণদণ্ড দেওয়ার কথা লোকের মনেই পড়ত না এবং রাজ্যের কোথাও ছিল না দস্যুতার উপদ্রব।

কিন্তু কেবল রাজনীতি নিয়েই তিনি মেতে থাকতেন না। কেবল গীত-বাদ্য-কাব্যই তাঁর অবলম্বন ছিল না। হরিসেন বলেন, বিদ্বজ্জ্বন সমাজের মধ্যে থাকতে পারলে সমুদ্রগুপ্ত অত্যন্ত আনন্দিত হতেন। শাস্ত্রালোচনার সুযোগ তিনি ছাড়তেন না।

সব দিক দিয়ে হিন্দুর লুপ্ত গৌরবকে পুনরুদ্ধার করবার জন্যে সমুদ্রগুপ্ত প্রাণপণ চেষ্টার ত্রুটি করেননি। গ্রিক ও পারসিদের প্রার্দুভাবের জন্যে ভারতের শিল্পে ও সাহিত্যে বিদেশি প্রভাব ক্রমেই বেড়ে উঠেছিল, সমুদ্রগুপ্ত দিলেন সেই প্রভাব লুপ্ত করে। কবি, নাট্যকার ও শিল্পীদের ঘুমন্ত দৃষ্টিকে জাগিয়ে তুলে তাদের সামনে দেশের দর্পণ ধরে তিনি বললেন—’একবার নিজেদের মুখের পানে তাকিয়ে দেখ। তোমরা হচ্ছ সুন্দরের বংশধর, নিজেরাও পরমসুন্দর!’ সমুদ্রগুপ্তেরই সাধনমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে অন্ধকারযুগের অত্যাচারিত, জীবন্মৃত ভারত আবার শক্তিধর হয়ে জ্যোতির্মণ্ডলের মধ্যে দৃঢ়পদে দাঁড়িয়ে লাভ করল ধ্রুবদৃষ্টি—দেখতে পেল আপন আত্মার ঐশ্বর্য। পিতৃদত্ত শিক্ষার গুণে বিখ্যাত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা কাব্যে প্রসিদ্ধ বিক্রমাদিত্য মহাভারতের যে বিচিত্র মানস-প্রতিমা সম্পূর্ণ করে বিশ্বের বিস্মিত চোখের সামনে তুলে ধরেন, তার অপূর্ব কাঠামো গড়ে গিয়েছিলেন সমুদ্রগুপ্তই স্বহস্তে। সেই বহু বাহুধারিণী দেবীমূর্তির হাতে কেবল শত্রুঞ্জয় নানা প্রহরণই ছিল না, ছিল বেদ, উপনিষদ, নব নব পুরাণ—ছিল দর্শন, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা—ছিল কাব্য, নাটক, কথাসাহিত্য—ছিল গীত-বাদ্য-নৃত্য ও অভিনয়ের প্রতীক—ছিল চিত্র-ভাস্কর্য-স্থাপত্য প্রভৃতি বিবিধ ললিতকলার নিদর্শন এবং সেই সঙ্গে পরিপূর্ণ ধনধান্যের পসরা। রামায়ণ-মহাভারতের প্রাগৈতিহাসিক যুগ কবিদের কল্পনা-কুহেলিকায় রহস্যময় বলে মনে হয়—তার ভিতর থেকে নিশ্চিতভাবে কিছুই আবিষ্কার করবার উপায় নেই। কিন্তু সমুদ্রগুপ্তের ধ্যানের মন্ত্র হিন্দু-ভারতের যে মহিমময় মূর্তিকে সাকার করল, ঐতিহাসিক কালের আগে ও পরে তার সঙ্গে তুলনীয় আর কিছুই দেখা যায় না। পুত্র বিক্রমাদিত্য ও পৌত্র কুমারগুপ্ত উত্তরসাধক হয়ে সমুদ্রগুপ্তেরই সাধনাকে অগ্রসর করে নিয়ে গিয়েছিলেন—তাঁরা ছিলেন সমুদ্রগুপ্তেরই প্রতিষ্ঠিত আদর্শের অনুসারী।

সমুদ্রগুপ্ত অক্ষরে অক্ষরে পিতৃসত্য পালন করলেন। দিগবিজয়ের দ্বারা খণ্ড খণ্ড ভারতকে সংযুক্ত করে স্থাপন করলেন এক অখণ্ড ও বিরাট সাম্রাজ্য এবং বৈদিক অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে সার্বভৌম সম্রাট হয়ে আর্যাবর্তে ফিরিয়ে আনলেন আবার হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতি—প্রাচীন হিন্দুধর্ম হল আবার নবীন যুবকের মতো।

এই সকল সাধনার আশ্চর্য পরিকল্পনার মধ্যে কোথায় ডুবে যাবে আমাদের মতো ক্ষুদ্র গল্প-লিখিয়ের কাল্পনিক কাহিনির সূত্র—মহাসাগরে সাঁতারুর সৃষ্ট অস্থায়ী জলের মতো। এরপর গালগল্প চলে না। তাই সমুদ্রগুপ্তের নিপুণ হাতের বীণাবাদন শোনবার জন্যে তাঁর রানি দত্তাদেবী আর সখী পদ্মাবতীকে আর আমন্ত্রণ করতে পারলুম না।