ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে
ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম
নিঃশব্দ রাত্রির দেশ, তার ওপরে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ
অদূরে খাজুরাহো মন্দিরের চূড়া
মিথুন মূর্তিগুলো দেয়াল ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠেছে আকাশে
নীল মখমলে শুয়ে নক্ষত্রদের মধ্যে চলেছে শারীরিক প্রেম
আমি যে-কোনো দিকে যেতে পারি
অথচ আমার কোনো দিক নেই!
ভারতরর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম
সেই দিনটি ছিল বর্ষণসিক্ত
মাঝে মাঝে এমন হয়, আকাশ নিচে নেমে আসে
গাছগুলি দুহাত বাড়িয়ে ডাকে, এসো, এসো
বোঝা যায় এখন এই পৃথিবী মানুষের জন্য নয়
বস্তু বিশ্বের মধ্যে রয়েছে গহন কোনো বাণী
রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে পায়ের তলার মাটি
এই রকম সময়ে দিক ঠিক করা সহজ নয়
আমি পা বাড়িয়ে থাকি,
কিন্তু কোন্ দিকে যাবো জানি না।
ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম
দিঘির জলে ভাসছে গোলাপি শাড়ি পরা বধূটির শব
তার পায়ের আলতা ধুয়ে যায়নি
তার হাত ভর্তি সবুজ কাচের চুড়ি
তার ওষ্ঠ ও অধর তীব্র বিষের দাহে নীল
যারা সহজে চিৎকার করে তারাও চারদিকে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ
যারা অপরের হাতে নিহত হবার জন্য প্রস্তুত
তারাও আজ একটু একটু খুনী
এই দিঘির কাছে সে প্রত্যেকদিন তার মনের কথা বলতে আসতো
তার তীব্র দুঃখ ছিল না, তার তীব্র সুখ ছিল না
সে শুধু চেয়েছিল মাঝারি ধরনের বেঁচে থাকতে
একটা কোনো জায়গা থেকে তো তার মৃত্যুর জন্য
উত্তর খুঁজে আনতে হবে
কোন্ দিকে? কোন দিকে?
ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপরে দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম
ঝাঁসী, হায়দ্রাবাদ, নাগপুর, কানপুর, এলাহবাদ
বিভিন্নমুখী বাস গোল হয়ে ঘিরে ফোঁস ফোঁস করছে
যে-কোনো একটায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লেই হয়
কিন্তু কেন আমি নাগপুর না গিয়ে এলাহাবাদ যাবো না
অথবা হায়দ্রাবাদ না গিয়ে ঝাঁসী না যাবার কোন্ যুক্তি আছে
ঠিক এক জায়গাতেই যাওয়ার গাড়ি-ভাড়া
আমাকে একবারের বেশি দু’বার সুযোগ দেওয়া হবে না
আমাকে পাঠানো হয়েছে মাত্র একটি জীবন কাটাবার জন্য
একটি জেলখানা থেকে বেরিয়ে শুধু একদিকে যাবার মুক্তি
চোখ বুজে ঝুলির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে শুধু একটি কাগজের টুকরো
আমি চোখ বুজলাম
এইরকম সময়ে মানুষ চোখ বুজে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে
এবং বৃক্ষের মতন স্থাণু হয়।
ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম
চতুর্দিকে সব কিছুই অচেনা
দু’দিক দিয়ে মানুষ আসে যায়, কেউ থামে না
কেউ চোখের দিকে চোখ ফেলে না
কেউ আমার কথা বোঝে না, আমি কারুর কথা বুঝি না
কারুর হাতে উজ্জ্বল নীল রঙের বল, কারুর হাতে পাংশু রঙের থালা
কেউ মুঠো মুঠো বাতাস খায়, কেউ অ্যালকহল দিয়ে দাঁত মাজে
জীবন্ত যুবতীর বুকে শকুন এসে ঠোকরায়, তারা হাসে,
শিশু এসে মায়ের আদর কাড়তে চাইলে মা কাঁদে
পোশাকের দোকানে মানুষ ঝুলছে, অপর মানুষের কোনো পোশাক নেই
মাংসের দোকানে মানুষ ঝুলছে, অপর মানুষের কোনো মাংস নেই
এই ঘোর অচেনা রাজ্যে আমি একটু দাঁড়াবারও জায়গা পাই না
আমি কি এখানকার কেউ নয়
এ আমার দেশ, এ আমার দেশ বলে চিৎকার করে উঠি
কর্ণপাত করে না একজনও
এমনকি আমার দেশও কোনো উত্তর দেয় না!
ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম
একটি ঠিকানাহীন চিঠি এসেছে, আমার যেতে হবে
যেমন ভাবে মৃত্যুর নির্ভুল চিঠি আসে
কিন্তু মৃত্যু কারুর জন্য অপেক্ষা করে না, আমার জন্য
একজন প্রতীক্ষায় বসে আছে
সে কোথায় জানি না, সে কি সমুদ্র কিনারে
কিংবা হিমালয়ের মর্ম ছায়ায়
সে কি বন্যায় ধুয়ে যাওয়া মাটির ওপর নতুন পলিতে দাঁড়িয়ে আছে
সে কি শুকনো জিভ বার করে ক্লান্ত জঙ্গলের মধ্যে একাকী শয়ান
সে কি কোনো বিশাল প্লাটফর্মের পাশের জটলার মধ্যে
বসে আছে জানু পেতে
সে আমার ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া সঙ্গী
সে আমার বড় বড় চোখ
বিস্ময়ের বিমূর্ত ছেলেবেলা
আমি মানচিত্রের গলিঘুজির মধ্যে ছোটাছুটি করি
আমায় যেতে হবে, যেতে হবে!
ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি
সেই ধানক্ষেতের জায়গায় এখন ধানক্ষেত নেই
সেই নদীর ভিতরে নেই নদী
নগর উড়ে গেছে শূন্যে, সেখানে সব ছাদ-খোলা মানুষ
সেই একই মানুষের মধ্যে অন্য মানুষ
রক্ত ছড়ানো গোধূলি আকাশের নিচে এক অলীক দেশ
একদিন যারা অনুসরণকারী ছিল
আজ তারাই পলাতক
মহাকূর্মের পিঠে এক অন্ধ লিখে যাচ্ছে ইতিহাস
এক জননী তার প্রতিটি সন্তানের জন্য
একটি করে মুর্গীর ডিমও প্রসব করতে পারেনি, এই তার খেদ
যেখানে স্থাপত্য ছিল, সেখানে আজ সুড়ঙ্গ
যেখানেই যাই, সেখানেই শুনি এখানে নয়, এখানে নয়
অথচ কোথাও তো হৃদয় থাকবে এবং তার মধ্যে ভালোবাসা
বিজন নদীর ধার দিয়ে আমি হেঁটে চলেছি
উৎস কিংবা মোহনার দিকে!