ভাবনা
আমি একটি চতুর্থ স্তরের রবোট। আমার কপোট্রন কিউ ৪২ ধরনের–এটি গৃহস্থালি কাজে পারদর্শী। আমি এই মুহূর্তে আমার মনিবের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছি, তিনি আমাকে কিছু আদেশ দেবেন এবং তিনি আদেশ দেয়া মাত্র আমি সেই আদেশ পালন করব। আমার কপোট্রন একটি তথ্য সেকেন্ডে একুশ ট্রিলিয়ন বার পর্যালোচনা করতে পারে, সেই তুলনায় আমার মনিব অত্যন্ত ধীরগতিসম্পন্ন। তিনি একজন জৈবিক মানুষ। জৈবিক মানুষের বায়ো যোগাযোগ হয় খুব ধীরে। আমি প্রায় তিন শ মিলি সেকেন্ড ধরে অপেক্ষা করে আছি এবং এই সময়ে প্রায় সাত ট্রিলিয়ন তথ্যকে পর্যালোচনা করে ফেলেছি তবুও তিনি আদেশটি উচ্চারণ করতে পারেন নি। তিনি সেকেন্ডে মাত্র কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন এবং তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি শেষ পর্যন্ত প্রথম শব্দটি উচ্চারণ করতে শুরু করেছেন। আমি আমার শব্দগ্রাহক যন্ত্রকে তীক্ষ্ণ করে এনেছি প্রত্যেকটি শব্দকে যেন নির্ভুলভাবে শুনতে পারি।
আমার মনিবের ভোকাল কর্ডে কম্পন শুরু হয়েছে। এক দশমিক তিন–চতুর্থাংশ কিলোহার্টজ–তিন ডি. বি.শব্দটি আমার শব্দগ্রাহক যন্ত্রে নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে। শব্দটি হচ্ছে :
দূর।
দূর। আমার কপোট্রনে রাখা অসংখ্য শব্দের সাথে ‘দূর’ শব্দটি মিলিয়ে দেখতে শুরু করেছি। আমার মনিব পরের শব্দটি উচ্চারণ করতে কমপক্ষে আরো অর্ধসেকেন্ড সময় নেবেন। এই সুদীর্ঘ সময়ে আমি প্রায় দশ ট্রিলিয়ন বার এই শব্দটিকে নানাভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে পারি। আমার কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কাজেই শব্দটিকে আমি মাত্র একভাবে পর্যালোচনা করে ভিন্ন ভিন্নভাবে পর্যালোচনা করব। আমি একই সাথে নয়টি ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি শুরু করেছি। কপোট্রনের মূল শব্দভাণ্ডার থেকে ‘দূর’ শব্দটি খুব সহজে পাওয়া গেছে। দূর শব্দটির অর্থ যেটি কাছে নয়। আরো বৈজ্ঞানিক অর্থে বলা যায় যার ভিতরে অন্য এক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে খানিকটা স্থান রয়ে গেছে। দূর শব্দটি বিশেষণ, তার বিশেষ্য রূপ। হচ্ছে দূরত্ব। মানুষেরা নানাভাবে দূর শব্দটি ব্যবহার করে। যেমন– যখন দুজন মানুষের ভিতরে ঘনিষ্ঠতা কমে যায়, তারা বলে দুজনের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আবার যখন মানুষ কারো সাথে অভিমান করে তখন তারা বলে যে আমি তোমাকে ছেড়ে দূরে চলে যাব। যে জিনিসটি কাছে নয় সেটি বোঝাতে তারা এই শব্দটি ব্যবহার করে। যেমন তারা বলে এন্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জ পৃথিবী থেকে বহু দূরে। আমার মনিব দূর শব্দটি ঠিক কোন্ অর্থে ব্যবহার করেছেন আমি এখনো জানি না। সেটি সঠিকভাবে বোঝার জন্যে পরের শব্দগুলো শুনতে হবে। কিন্তু যেহেতু এখনো আমার দীর্ঘ সময় রয়ে গেছে, আমি ‘দূর’ শব্দটি ব্যবহার করে সম্ভাব্য সবগুলো বাক্য তৈরি করে রাখব। তাহলে আমার মনিব যখন পুরো বাক্যটি উচ্চারণ করবেন আমার সেটা ব্যাখ্যা করতে কোনোই অসুবিধে হবে না
প্রাথমিক হিসেবে সম্ভাব্য বাক্য হতে পারে প্রায় নয় লক্ষ এগার হাজার সাত শ নয়। এই নয় লক্ষ এগার হাজার সাত শ নয়টি বাক্যের ভিতরে প্রায় দুই লক্ষ চার হাজার তিন শ চারটি বাক্য পরিপূর্ণ অর্থজ্ঞাপক নয়। বাকি সাত লক্ষ সাত হাজার চার শ পাঁচটি বাক্যকে তুলনামূলকভাবে যাচাই করা যাক। তাহলে যখন পুরো বাক্যটি উচ্চারিত হবে তার ব্যাখ্যা বের করতে কোনোই সময় নষ্ট হবে না। এই সাত লক্ষ সাত হাজার চার শ পাঁচটি বাক্যকে তার আপেক্ষিক গুরুত্ব এবং সময়োপযোগিতা হিসেবে সাজানো যাক :
১. দূর থেকে চিঠি এসেছে।
২. দূর থেকে খবর এসেছে।
৩. দূর থেকে আহ্বান এসেছে।
৪. দূর থেকে বাণী এসেছে।
ঃ
ঃ
৬০৩৪২১. দূর গ্রহের আগন্তুক ইভেশেঙ্কু আপনার রক্তপাত করতে চায়।
৬০৩৪২১. দূর গ্রহের আগন্তুক ইভেশেন্ধু
মহাজাগতিক বিস্ফোরণ ঘটাতে চায়।
ঃ
ঃ
( তিন শ মিলি সেকেন্ড পর১)
গত তিন শ মিলি সেকেন্ড আমি দূর শব্দটি নিয়ে সম্ভাব্য সবগুলো বাক্য তৈরি করেছি। বাক্যগুলো ব্যাখ্যা করেছি এবং বিশ্লেষণ করেছি। তারপরও আমার হাতে প্রচুর সময় রয়ে গিয়েছে। সেই সময়টিতে আমি বাঁধাকপি দিয়ে ভেড়ার মাংস রান্না করার একটি নতুন পদ্ধতি দাঁড় করিয়েছি, ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্রের তালিকা তৈরি করেছি, শেলফের বই, কম্পিউটারের ক্রিস্টাল, যোগাযোগ কেন্দ্রের মূল মডিউলের সংখ্যা নির্ণয় করেছি। ঘরের বিদ্যুৎপ্রবাহের পরিমাণ বের করেছি এবং ভোল্টেজের গড় তারতম্য দশমিকের পর সাত ঘর পর্যন্ত নির্ণয় করা হয়েছে। পুরো ব্যাপারগুলো সতের বার করার পর অর্ধসেকেন্ড সময় পার। হয়েছে এবং মনে হচ্ছে আমার মনিব দ্বিতীয় শব্দটি উচ্চারণ করতে প্রস্তুত হয়েছেন। আমি আমার মনিবের ভোকাল কর্ডটির সূক্ষ্ম কম্পন অনুভব করতে শুরু করেছি। আমার শব্দগ্রাহক যন্ত্র এবং কম্পন অনুধাবন মডিউলটি প্রস্তুত রয়েছে। তিনি শেষ পর্যন্ত শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। শব্দটি হচ্ছে :
হ
হ? হ একটি অস্বাভাবিক শব্দ। আমার শব্দগ্রাহক যন্ত্রে সম্ভবত একটা ত্রুটি হয়েছে এবং পুরো শব্দটি ধরা যায় নি। সেটি কোনো সমস্যা নয়। পরবর্তী অর্ধসেকেন্ডে আমি প্রায় দশ ট্রিলিয়ন বার বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করতে পারব। প্রকৃত শব্দটি কী ছিল সেটি বের করতে আমার কোনো অসুবিধে হবে না। আমার মনিব যখন শব্দটি উচ্চারণ করেছেন, আমি তখন শব্দটি আমার স্মৃতিতে লিপিবদ্ধ করে রেখেছি। শব্দটি আমি এক্ষুনি চার হাজার বার শুনে নিতে পারি।
আমি শব্দটি এক হাজার একুশ বার শুনে নিয়েছি আমার শব্দগ্রাহক যন্ত্রে, কোনো ত্রুটি নেই। আমার মনিব প্রকৃত অর্থেই হ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। হ শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয় না। আমার কপোট্রন থেকে পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে এটি হও শব্দটির অপভ্রংশ। কিংবা এটি অন্য কোনো শব্দের প্রথম অংশটি। আমার মনিব নিজেই এখন পরের অংশ উচ্চারণ করে শব্দটি পূর্ণাঙ্গ করবেন। আমার মনিব কিংবা মানব সম্প্রদায় প্রায় সবসময়েই অর্থহীন শব্দ উচ্চারণ করে এবং বক্তব্য থেকে এই সমস্ত অর্থহীন শব্দ সরিয়ে পুরো বাক্যগুলোকে বিশ্লেষণ করতে হয়। কাজেই পরবর্তী শব্দের জন্যে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। যতক্ষণ অপেক্ষা করছি ততক্ষণ এই দুটি শব্দ ব্যবহার করে সম্ভাব্য। বাক্যগুলোকে প্রস্তুত করা যাক।
১. দূর হতে চিঠি
এসেছে।
২. দূর হতে খবর এসেছে।
৩. দূর হতে বার্তা এসেছে।
( আরো তিন শ মিলি সেকেন্ড পরে)
দেখা যাচ্ছে আমার মনিব পরবর্তী শব্দটি উচ্চারণ করার জন্যে প্রস্তুতি নিয়েছেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তার ভোকাল কর্ড কম্পনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। মানুষের কথা বিশ্লেষণ করার সময় তাদের মুখের ভাবভঙ্গিও বিশ্লেষণ করতে হয়। আমি যদি আমার মনিবের মুখের ভাবভঙ্গি মান এবং গুরুত্বের ক্রমানুসারে সাজাই তাহলে সেগুলো হবে :
১. ক্রোধ।
২.
বিরক্তি
৩. অধৈর্য
৪. ঘৃণা
৫.
তাচ্ছিল্য
এবং
৬. উপহাস
মানুষের মুখে যদি এই অনুভূতিগুলো থাকে তাহলে সেগুলো সাধারণত তাদের বক্তব্যে বিচিত্র শব্দ এবং অপ্রাসঙ্গিক অর্থের সৃষ্টি করে। এটি একটি জরুরি অবস্থা। আমার মনে হয় কপোট্রনের টার্বো পাওয়ার চালু করা উচিত। প্রতি সেকেন্ডে আমার এখন অন্তত পঞ্চাশ ট্রিলিয়ন তথ্য পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। পরবর্তী শব্দটি পর্যালোচনা করার জন্য এখন আমার বিশেষ মডিউলটি চালু করা প্রয়োজন। এটি নিঃসন্দেহে একটি জরুরি অবস্থা। আমার মনিবের ভোকাল কর্ডের কম্পন শুরু হয়ে গেছে। তিনি যে শব্দটি উচ্চারণ করেছেন সেটি হচ্ছে :
হতভাগা
হতভাগা। এটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ নয়। আমার কপোট্রনের অর্থ অনুযায়ী এই শব্দের অর্থ যার ভাগ্য সুপ্রসন্ন নয়। ভাগ্য শব্দটি শুধুমাত্র মানবসমাজে ব্যবহৃত। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে তারা খারাপ ভাগ্যপ্রসূত বলে বর্ণনা করে। এই ক্ষেত্রে হতভাগা শব্দটি কাকে বলা হয়েছে সেটা সবার আগে নির্ধারণ করতে হবে। এই ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ নেই তাই শব্দটি নিঃসন্দেহে আমার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। আমার উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করা। এখন তিনটি পূর্ণাঙ্গ শব্দ রয়েছে। মনিবের মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ বাক্য উচ্চারণ করেছেন। এই বাক্যটিতে আর কোনো শব্দ নেই। এখন এই তিনটি শব্দ ব্যবহার করে যে বাক্য তৈরি হয়েছে সেটি হচ্ছে :
দূর হ হতভাগা
বাক্যটি বিশ্লেষণের প্রয়োজন। বাক্যটি ব্যবহার করার সময়ে আমার মনিবের মুখের অনুভূতিও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। মুখের অনুভূতি হচ্ছে ক্রোধ, বিরক্তি, অধৈর্য, ঘৃণা, তাচ্ছিল্য এবং উপহাস। এই অনুভূতিগুলো মুখে রেখে তিনি উচ্চারণ করেছেন, ‘দূর হ হতভাগা’। আমার হাতে সময় রয়েছে প্রায় অর্ধসেকেন্ড। এই সময়ের মাঝে আমাকে এই বাক্যটির অর্থ বের করে একটি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এটি নিঃসন্দেহে একটি জটিল প্রক্রিয়া ….।