ভাঁজকরা একটা কাগজ

ভাঁজকরা একটা কাগজ

শামিম-আরা বেগমের মুখে তার পূর্বপুরুষদের গল্প শুনছিলাম কফি খেতে খেতে। এমন সময় বাইরে মোটরগাড়ির শব্দ শোনা গেল। বেগমসায়েবা আবুকে ডেকে বললেন, “দেখে আয় তো বেটা, কে এল।”

আবু পশ্চিমের বারান্দায় বেরিয়ে চাপা স্বরে বলল, “পুলিশ!”

 বেগমসায়েবা দ্রুত অন্দরমহলে চলে গেলেন। তারপর পুলিস অফিসার মিঃ ভদ্রের আবির্ভাব ঘটল। কর্নেল তাকে খাতির করে বসালেন। তারপর আবুকে বললেন, “দেখ তো আবু, যদি আরেক কাপ কফি আনতে পারো।”

আবু চলে গেলে কর্নেল বললেন, “আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে মিঃ ভদ্র!”

মিঃ ভদ্র একটু হাসলেন। “সদর থেকে মর্গের প্রাথমিক রিপোর্ট নিয়ে এসেছেন সেকেন্ড অফিসার। আপনার অনুমান সত্য, কর্নেল তাহের মিয়ার মাথার পিছনে প্রথমে গুলি করা হয়েছিল।”

“রাইফেলের গুলি!”

মিঃ ভদ্র অবাক হয়ে নড়ে বসলেন। “এক্সাক্টলি। রাইফেলের বুলেট। প্রথমে গুলি করে মেরে তারপর শক্ত কিছু দিয়ে মাথার পেছনটা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে, যাতে”

কর্নেল ওঁর কথার ওপর বললেন, “কিন্তু গুলিটা?”

“কানের পাশে হাড়ের খাঁজে আটকে ছিল।”

কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে চোখ বুজে বললেন, “কিন্তু জর্জিস সাহেবের মাথায় অবশ্য গুলি করা হয়নি। তাকে ইট বা লোহার মুগুর দিয়ে মারা হয়েছিল। তার মর্গের রিপোর্ট তো আপনি দেখেছেন বলছিলেন?”

“হুউ। আপনি গিয়ে দেখে আসতে পারেন থানায়”।

কর্নেল একটু পরে চোখ খুলে বললেন, “তাহের মিয়ার খুনী ভেবেছিল পাগল নাসির খায়ের ওপর খুনের দায়টা চাপাবে।”

মিঃ ভদ্র হাসলেন। “আমার খালি অবাক লাগছে, গুলি মাথায় নিয়ে তাহের দর্জি অন্তত দশ মিটার দৌড়ে এল কী করে?”

“দৌড়ে আসেননি–প্রথমে যা ভেবেছিলাম।” কর্নেল বললেন। “গুলি খেয়ে উনি পড়ে গিয়েছিলেন। তারপর ওঁর পা ধরে টেনে আনা হয়েছিল।”

“কেন?”

“এই বাড়ির পুবদিকের সদর রাস্তা থেকে কবরখানার ওই অংশটা সোজা চোখে পড়ে। মাথার খুলি যেভাবে থেঁতলে দেওয়া হয়েছে, তাতে অন্তত মিনিট, পাঁচেক সময় লাগার কথা। কাজেই রাস্তা থেকে কারুর চোখে পড়বে না এমন জায়গায় বডি সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার হয়েছিল।

এইসব বীভৎস ব্যাপার দুজনে আলোচনা করছেন নির্বিকার মুখে। আমার গা ঘুলিয়ে উঠেছিল শুনতে-শুনতে। তাই দক্ষিণের খোলা বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরালাম। কিছুটা দূরে পোড়ো জমির ওধারে কবরখানাটা এখন অন্ধকার হয়ে আছে। তাকাতে গা ছমছম করছিল। তবে এখন আর এই গা ছমছম করাটা ভূতপ্রেত বা সেই অন্যগ্রহের পলাতক প্রাণীটির জন্য নয়, জাভেদ পাঠানের জন্য। সে কি এখন রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে? আশ্চর্য সাহস লোকটার, কবরখানায় সে আড়াই বছর ধরে লুকিয়ে আছে!

রামবাবু তাহলে গিরগিটির মতো যে জ্যান্ত মড়াটাকে কবরে ঢুকতে দেখেছিলেন, সে ওই জাভেদই বটে! কিন্তু রামবাবু কেন গিরগিটির সঙ্গে তার উপমা দিলেন মাথায় আসে না। নাকি কবরে ঢোকার সময় জাভেদ শুয়ে পড়ে কাত হয়েছিল–হয়তো ঢোকার জায়গাটা সংকীর্ণ, তাই ওই ভঙ্গিতে ঢুকতে হয়! কিন্তু কথা হল, একটা কবরের ভেতর কতটুকুই বা খালি জায়গা থাকে যে একজন জ্যান্ত লোক দিব্যি আড়াই বছর কাটিয়ে দিতে পারে?..

খোলা বারান্দায় ঠাণ্ডাটা বড্ড বেশি। আর ঘরের ভেতর থেকে তখন জাভেদের নাম শোনা যাচ্ছে। তাই ঘরে ঢুকে চুপচাপ বসে পড়লাম। মিঃ ভদ্র কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, “জাভেদ শুধু স্মাগলার ‘হলে কথা ছিল। সে এলাকার ডাকাতদের লিড করত। বর্ডার এরিয়ায় এটাই বড় সমস্যা যে পদ্মা পেরিয়ে গেলে আমরা হেল্পলেস। তবে জাভেদ গা ঢাকা দিয়েছিল কনস্টেবল মোতি সিংকে খুন করার পর। তখনও আমি এ থানায় আসিনি। কনস্টেবল খুন হলে তার প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক। কাজেই তাকে গা ঢাকা দিতে হয়েছিল। আমার ধারণা সে পদ্মার ওপারেই থেকে গেছে। কারণ সে জানে, এপারে এলেই তার কী অবস্থা হবে।”

বুঝলাম, কর্নেল ওঁকে জাভেদ ওরফে ইদ্রিস আলির কথা বলেননি। বললেই ভাল করতেন। কবরখানা ঘিরে ফেলে প্রত্যেকটি কবর পরীক্ষা করে দেখলেই ধরা পড়ে যেত, কোন কবরটি তার আস্তানা। কর্নেলের দিকে তাকালে উনি মুচকি হেসে বললেন, “তুমি কি অন্যগ্রহের প্রাণীটিকে দেখতে গিয়েছিলে, জয়ন্ত? আমার মনে হয়, প্রাণীটিকে ডিসটার্ব না করাই ভাল। ওদের শরীর অ্যান্টি-ম্যাটারে তৈরি। সাবধান।”

মিঃ ভদ্র অবাক চোখে তাকালেন। “অন্য গ্রহের প্রাণী! কী ব্যাপার?”

“মিঃ ভদ্র, আশা করি এরিখ ফন দানিকেনের বই পড়েছেন! ওই কবরখানায় নাকি”।

পুলিশ অফিসার হো হো করে হেসে ফেললেন। “বুঝেছি, বুঝেছি। কবরখানার জিনের কথা তো? বেগমসায়েবার স্টেটমেন্টে কথাটা আছে। তবে জেনে রাখুন, জিন-টিন বা অন্য গ্রহের প্রাণীটি আসলে এক ধড়িবাজ স্মাগলার। কবরখানার দিকে আমাদের বরাবর নজর আছে। গতমাসে এক রাত্রে ওখানে হানা দিয়েছিলাম। কাউকে ধরতে পারিনি। তবে কিলো দুই গাঁজার একটা প্যাকেট আর পাঁচটা বিদেশী ক্যালকুলেটার পাওয়া গিয়েছিল। তাড়া খেয়ে ব্যাটাচ্ছেলেরা সেগুলো ফেলে পালিয়েছিল।”

আরও কিছুক্ষণ স্মাগলারদের গল্প করে মিঃ ভদ্র উঠলেন। কর্নেল ওঁকে বিদায় দিতে গেলেন। জিপের গরগর আওয়াজ দূরে মিলিয়ে গেলে গোয়েন্দাপ্রবর ফিরে এলেন। তখন বললাম, “জাভেদ পাঠানের কথাটা ওঁকে জানালেই পারতেন!”

কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে বললেন, “চুপ”

বেগমসায়েবার কাশির শব্দ শোনা গেল। পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে চাপা স্বরে বললেন, “এক মুশকিল হয়েছে কর্নেলসায়েব। ছোটকু এসে কখন দাঁড়িয়ে ছিল সদর গেটে। আমার মেয়েরা দেখতে পেয়ে তাকে ডেকে এনেছে। আমার তো খুব ডর লাগছে”

“ছোটকু মানে আপনার ছোট ভাই নাসির খাঁ কি?”

“জী হ।”

বেগমসায়েবার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, বিপন্ন বোধ করছেন। কিন্তু কর্নেলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, বললেন, “আপনাকে আমি বলেছি, ওঁর জন্য একটুও ভাববেন না। এক কাজ করুন। বাড়তি কোনো ঘর আছে কি বাড়িতে?”

“আছে। কিন্তু

“আপনাকে উনি পছন্দ নাও করতে পারেন। কিন্তু আপনার মেয়েদের সম্ভবত উনি স্নেহ করেন। মেয়েদের আড়ালে ডেকে বলে দিন, সেই ঘরে ওঁকে বিছানা করে দিক। খেতে চাইলে খেতে দিক। তারপর বাইরে থেকে দরজা আটকে দেবেন আপনি। যেন আর না বেরুতে পারেন।”

বেগমসায়েবা আরও উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “সর্বনাশ! তাহলে তো ঘরের ভেতর চেঁচামেচি হুলুস্থুল করবে সব ভাঙচুর করবে।”

“তেমন কিছু করলে আমি তো আছি–ডাকবেন।”

শামিম-আরা ইতস্তত করছিলেন। তখন কর্নেল বললেন, “আপনাকে আমি বলেছি, এখনও বলছি, আপনার স্বামীকে আপনার ছোট ভাই খুন করেননি। নাসির খাঁ সম্পর্কে এই ভুল ধারণা আপনার মাথায় ঢুকিয়েছেন আপনার দাদা বড় নবাবসাহেব। না–তারও দোষ নেই। তাকে যা বোঝানো হয়েছে, তিনি তাই বুঝেছেন।”

বেগমসায়েবা কুণ্ঠিতভাবে অন্দরমহলে চলে গেলেন।

কর্নেল তার কিটব্যাগের ভেতর থেকে একটা বই বের করে চেয়ারে আরাম করে বসলেন। একটু হেসে বললাম, “জাহানাবাদের ইতিহাস পড়ে কি এ খুনোখুনির রহস্যের সূত্র মিলবে, ভাবছেন?”

বইয়ের পাতায় চোখ রেখে কর্নেল বললেন, “এ বইটা জাহানাবাদের ইতিহাস নয়, জয়ন্ত! ভারতের ইতিহাস।”

আরও হেসে বললাম, “মিঃ ভদ্র তাহলে ঠিকই বলছিলেন, মশা মারতে কামান দাগা! ভারতের ইতিহাস পড়ে–ওঃ ভাবা যায় না”

“ডার্লিং, তোমাকে রামবাবুতে পেয়েছে, সাবধান।”

 “রামবাবু জিনিয়াস লোক। তিনিও ঠিক বলেছিলেন।”

কর্নেল বইটা টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসে কান খাড়া করে কী শুনে বললেন, “নাঃ, সব ঠিক আছে। নাসির খাঁ ভাগ্নীদের সত্যি খুব স্নেহ করেন। ওই শোনো!”

কান পেতে কিছু শুনতে পেলাম না। বললাম, “শোনার মতো কিছু কানে। আসছে না। অবশ্য আপনার কথা আলাদা। আপনার মাথার পেছন দিকেও কান। আছে।”

“নাসির খাঁ গুণী লোক। অসাধারণ গাইতে পারেন জানা ছিল না!”

 নড়ে বসলাম। “কী আশ্চর্য। আমি ভাবছি ট্রানজিস্টার বাজছে।”

 “ট্রানজিস্টারে গানের সঙ্গে বাজনও থাকে, জয়ন্ত!”

 “অনেক সময় নাও থাকতে পারে। খালি গলায় গান গাইতেও শুনেছি অবশ্য।”

কর্নেল বোধ করি বিরক্ত হলেন। আবার বইটা খুলে বসলেন। এই সময় আবু ছেলেটা এল ভেতর থেকে। তার মুখে মিটিমিটি হাসি। বলল, “মাজী বললেন এখনই খাবেন, না পরে খাবেন?”

কর্নেল বললেন, “অসুবিধে না হলে আধঘণ্টা পরে। মোটে তো আটটা বাজে।”

আবু চলে যাচ্ছিল। জিগ্যেস করলাম, “আবু ভেতরে গান গাইছে কে?”

আবু ফিক করে হেসে বলল, “জী, পাগলানবাব।”

কর্নেল আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকালেন। বললাম, “ঘাট মানছি কর্নেল। তা আবু, পাগলানবাব এত ভাল গাইতে পারেন?”

আবু বলল, “ওরে বাবা! পাগলা হবার আগে কত বড় বড় ফাংশনে গান গাইতেন ছোটনবাব! এইতো গত বছর নবতখানার কাছে ফাংশেন হল। কলকাতা থেকে, গাইয়ে এসেছিল। ছোটনবাবও গেয়েছিলেন। সবাই বলল, আমাদের ছোটনবাবের পায়ের কাছে লাগে না কেউ।”

ভেতর থেকে ডাক এলে আবু বিরক্ত মুখে চলে গেল। ছেলেটার একমুহূর্ত অবসর নেই। সবসময় ওকে চর্কির মতো ঘুরে ফরমাস খেটে বেড়াতে হয়।

গানটা থেমে গেল হঠাৎ। আবার গুমোট স্তব্ধতা। শীত ক্রমশ বাড়ছে। দক্ষিণেরও দরজা দুটো বন্ধ করে দিলাম। তারপর বললাম, “এটা কি ভারতের ইতিহাস পড়ার সময়?”

কর্নেল মুখ তুলে একটু হাসলেন। “তুমি নিশ্চয় একাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত পর্যটক এবং পণ্ডিত আল-বিরুনির নাম শুনেছ?”

“হয়তো শুনেছি। কিন্তু হঠাৎ আল-বিরুনি কেন?”

“আল-বিরুনি ছিলেন লুঠেরা বাদশা সেই সুলতান মামুদের সভাপণ্ডিত। গজনীর এই মামুদ শাহ ভারতে হানা দিতে এলে তাকেও সঙ্গে আসতে হয়েছিল। সে আমলের রাজাবাদশাহদের ওই স্বভাব ছিল। যেখানেই যাবেন, সঙ্গে সভাপণ্ডিতটি থাকা চাই। তো মামুদ শাহ্ ভারত থেকে লুণ্ঠন করে নিয়ে গেলেন ধনরত্ন। আর পণ্ডিত আল-বিরুনিও পিছিয়ে থাকার পাত্র নন। তিনি লুণ্ঠন করে নিয়ে গেলেন ভারতের জ্ঞানভাণ্ডারের অজস্র রত্ন।”

হাসতে হাসতে বললাম, “এমন করে বলবেন না! জ্ঞান কি লুঠের মাল? জ্ঞান অর্জন করার জিনিস।”

কর্নেল কান দিলেন না। বললেন, “মামুদ শাহ যখন হিন্দুদের মন্দির ভেঙে ধনরত্ন লুঠ করছেন, তখন তাঁর সভাপণ্ডিত মন্দিরের ধর্মশাস্ত্রবিদদের কাছে জ্ঞানরত্ন কেড়ে নিচ্ছেন। জয়ন্ত! তুমি ঠিক বলেছ জ্ঞান লুঠের জিনিস নয়। কিন্তু জ্ঞান অর্জন করতে হলেও একধরনের শক্তির দরকার নয় কি? সেই শক্তির নাম মেধা। মেধার জোর না থাকলে অপরের মেধা করায়ত্ত হয় না। আল-বিরুনি যখন ফিরে গেলেন স্বদেশে, তখন তিনি ভারতীয় মেধায় প্রজ্ঞাবান। পতঞ্জলির যোগশাস্ত্র থেকে শুরু করে অসংখ্য বিদ্যা তার করায়ত্ত। ফার্সিতে পতঞ্জলি-শাস্ত্র অনুবাদ করেন আল-বিরুনি। তারপর লেখেন ভারতের ইতিহাস। তার নাম দেন তারিখ-ই-হিন্দুস্তান।” কর্নেল তাঁর বইটা দেখিয়ে বললেন। “এই সেই তারিখ-ই-হিন্দুস্তানের ইংরেজি অনুবাদ।”

 “খুব ভাল। কিন্তু এই বইটা নিয়ে এসে মন দিয়ে পড়ার সঙ্গে জাহানাবাদ রহস্যের সম্পর্কটা কী।”

“আছে। আল-বিরুনি শুধু পণ্ডিত না, দক্ষ চিত্রকরও ছিলেন। সে আমলে তো ছাপাখানা ছিল না। তাই সব পণ্ডিতকে দক্ষ লিপিকারও হতে হত। পাণ্ডুলিপিকে সাজানোর জন্য তাঁরা ছবিও আঁকতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে আল-বিরুনির মূল পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে যায়। তার অনুলিপি উদ্ধার করা হয়েছিল। তাতে কোনো ছবি ছিল না। অথচ ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে আল-বিরুনি অনেক। ছবিও এঁকেছিলেন।” কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, “ছবির উল্লেখ তার এই বইতে আছে। কিন্তু আমার আগ্রহ অন্যত্র। আল-বিরুনি লিখেছেন,, দেশে ফেরার সময় ক’জন হিন্দু পণ্ডিতের সঙ্গে তিনি ইসলামধর্ম নিয়ে আলোচনা করেন। প্রফেটের জীবনকাহিনী শোনান তাঁকে। প্রসঙ্গক্রমে প্রফেটের ঈশ্বরসন্নিধানে সশরীরে স্বর্গে যাত্রার কথাও বলেন। তখন হিন্দু পণ্ডিত অবিশ্বাস প্রকাশ করে বলেন, আপনাদের প্রফেট স্বর্গে গেছেন কী উপায়ে? আল-বিরুনি তাকে একটি ছবি এঁকে বলেন, এই বাহনে চেপে প্রফেট স্বর্গে গিয়েছিলেন।”

উত্তেজিতভাবে বললাম, “বোররাখ!”

“বোররাখ।” কর্নেল আস্তে বললেন। “একাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত পণ্ডিত আল-বিরুনির নিজের হাতে আঁকা বোররাখের ছবি সেই হিন্দু পণ্ডিতের কাছে থেকে গিয়েছিল। তার নাম ছিল দয়ারাম শাস্ত্রী। শাস্ত্রীজীর এক বংশধর ছবিটি উপহার দেন মোগল বাদশাহ আকবরকে। মোল্লা জাঁহাবাজ খানের লেখা রোজনামচায় এর উল্লেখ আছে। চীনা সিল্কের ওপর আঁকা সেই অসাধারণ ছবিটি অবশেষে বাদশা ঔরঙ্গজেবের পাল্লায় পড়ে ভূলুণ্ঠিত হয়। যাই হোক, তুমি ভাবছ–সেই ছবি সম্পর্কে এত পড়াশুনা করে, এমন কী আল-বিরুনির বইয়ের অনুবাদ যোগাড় করে জাহানাবাদ এসেছি–আমি কি অন্তর্যামী?”

 “তাই তো মনে হচ্ছে!”

কর্নেল চোখ বুজে চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, “গতকাল সকালে শেয়ালদা স্টেশনে দাঁড়িয়ে তুমি যখন ট্রেন ফেলের আশঙ্কায় আমার মুণ্ডুপাত করছিলে, তখন আমি বিড্ডুর জন্য ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে ছিলাম পার্ক স্ট্রিট এলাকায় জাহানাবাদ প্যালেসের সেই গলির ভেতর। যাই হোক, বিড্ডুর কাছেই জানতে পেরেছিলাম ছবিটা বোররাখ নামে অদ্ভুত প্রাণীর। তখন ট্রেন ছাড়তে আধঘণ্টা দেরি। আবার বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। তুমি তো জানো, আমার প্রাচীন ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বে নৃতত্ত্বে প্রচণ্ড আগ্রহ। কাজেই আমার সংগ্রহে এসব বই প্রচুর। বাড়ি ফিরে মার্কিন চিত্রকলাবিশারদ আর্নল্ড সায়েবের পেন্টিং ইন ইসলাম বইটাতে বোররাখ খুঁজলাম। পেয়ে গেলাম। অমনি মনে পড়ে গেল মোল্লা জাহাবাজ খানের রোজনামচার কথা। তাতেও পড়েছি আল-বিরুনির আঁকা বোররাখের ছবির কথা। তারপর যথাসময়ে স্টেশনে পৌঁছে দেখি, তুমি রামবাবু বেচারাকে খামোকা শাসাচ্ছ।”

 “শাসাব কেন? রামবাবুকে আপনার বাড়িতে ফোন করতে বলছিলাম। রামবাবু বলছিলেন, স্টেশনের ফোন সবসময় অকেজো। আমি কেন আসার পথে আপনাকে নিয়ে এলাম না বলে উল্টে রামবাবু আমাকে বকাবকি করছিলেন। কথা হল, আমার তো ড্রাইভার নেই। গাড়ি নিয়ে আপনাকে ইলিয়ট রোড থেকে তুলে না হয় আনলাম। তারপর গাড়িটার কী হবে? রামবাবু তা কিছুতেই বুঝতে চান না। তাছাড়া, স্টেশনে আসার সময় ট্যাক্সিও পাইনি। এসেছি বাসে। অথচ রামবাবু–”

মিনা এসে আদাব দিয়ে বলল, “মাজী বলছেন খানা জুড়িয়ে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। এখন যদি খেয়ে নেন, ভাল হয়।”

কর্নেল বললেন, “ছোটনবাব খেয়েছেন?”

মিনা হাসল। “জী হাঁ। খাওয়াদাওয়া করে ভাগ্নীদের সঙ্গে গল্প করছেন। বোঝাই যায় না, উনি পাগল হয়ে গেছেন। ভাল জামা-কাপড় পরে একেবারে ফিটবাবুটি!”

“কী গল্প করছেন?”

“কী সব আবোল-তাবোল কথা। বোঝা যায় না। মুনা-রুনা পড়েছে বিপদে। উঠে আসতেও দিচ্ছেন না।”

আমি বললাম, “তাহলে আর পাগলামি করল কোথায়?”

মিনা বলল, “পাগল কি সহজে সারে? তবে এখনকার মতো যেন সেরে গেছে।”

আবু এসে দিদিকে তাড়া দিল। মিনা ভেতরে গেল। আবুর হাতে একটা নকশাকাটা সুন্দর কাপড়। কাপড়টা টেবিলে ঢাকা দিয়ে তার ওপর খাবারের প্লেট রাখা হয়। জিগ্যেস করলে আবু সকালে বলেছিল, “একে বলে দস্তরখান।” কর্নেল বলেছিলেন, “খানদানি মুসলিম পরিবারে এই ‘দস্তরখান’ বিছিয়েই খেতে দেওয়ার রীতি আছে।”

….এখন আবু সেই কাপড়টা ভাজ খুলে টেবিলে বিছিয়ে দিল। সেই সময় একটা ভাঁজ করা একটুকরো কাগজ দস্তরখানের ভেতর থেকে টুক করে নিচে পড়ল। আবু সেটা লক্ষ্য করল না। দস্তরখান বিছিয়ে দিয়েই সে চলে গেল। ভাজকরা কাগজটা কুড়িয়ে নিলাম। কিন্তু সেটা কর্নেলেরও চোখে পড়েছিল। উনি তক্ষুনি আমার কাছ থেকে ছোঁ মেরে কেড়ে নিলেন। সেই সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন শামিম-আরা বেগম। বললেন, “আবুর কি বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। নতুন দস্তরখান বের করে রেখেছি। সেটা না এনে দুপুরেরটাই দিয়ে গেছে। ঝুটোর দাগ লেগে আছে–ধোয়া পর্যন্ত হয়নি!” বলে রুষ্টভাবে ডাকলেন আবুকে।

আবু দরজার পর্দা সরিয়ে সাড়া দিল, “মাজী ডাকছেন?”

 “অ্যাই বাঁদর! এই এঁটো দস্তরখান পাততে কে বলল তোকে?” বলে বেগমসায়েবা টেবিল থেকে কাপড়টা টেনে তার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। তারপর বললেন, “আজ ঘর সাফ করেছিলি?”

আবু ভয়ে ভয়ে বলল, “বুবু করেছে বিকেলে।”

বেগমসায়েবা মেঝেয় দৃষ্টি রেখে বললেন, “কী নোংরা হয়ে আছে সব! করিস কী তোরা ভাইবোনে? কাল সকালে যেন দেখি ভালভাবে সাফ করেছিস। নইলে দেখাব মজা তোদের! যা, ধোয়া দস্তরখান এনে পেতে দে।”

বেগমসায়েবা এবার একটু হাসলেন। “আপনাদের খুব অসুবিধে হচ্ছে বুঝতে পারছি, কর্নেলসায়েব। গরিবের বাড়ি বলে মেহেরবানি করে একটু মানিয়ে নেবেন।”

কর্নেল বললেন, “কিছু ভাববেন না। আমাদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।”

বেগমসায়েবা চলে গেলেন ভেতরে। তারপর কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। আমি একটু হাসলাম শুধু। তখন কর্নেলও একটু হেসে আস্তে বললেন, “ভাল রিপোর্টারের জন্য কী গুণ থাকা দরকার বলেছিলাম, জয়ন্ত?”

“অবজার্ভেশন। কিন্তু জিনিসটা কী আগে দেখুন!”

কর্নেল শুধু বললেন, “চুপ।”

রাত দশটায় দেখি, কর্নেল তখনও টেবিল বাতির আলোয় আল-বিরুনির ইতিহাস পড়ছেন। বাইরে কোথাও গেলে আমার ঘুম হয় না। কিছুক্ষণ পরে খুটখাট শব্দ শুনে পাশ ফিরে দেখি, কর্নেল সেই ভাজকরা কাগজটা টেবিলে খুলে রেখে ক্যামেরা তাক করে আছেন। কয়েকবার ফ্লাশবাল্ক ঝলক দিল। গোয়েন্দাপ্রবর কয়েকটা ছবিই তুললেন। মশারি থেকে মুখ বের করলে উনি চোখ কটমটিয়ে তাকালেন। তখন বুঝলাম কিছু জিগ্যেস করা বারণ।

ছবি তোলা হয়ে গেলে কাগজটা আগের মতো ভাঁজ করে মেঝেয় ফেলে দিলেন। তারপর ক্যামেরা গুছিয়ে রেখে মশারির ভেতর ঢুকে গেলেন। টেবিলবাতির আলো নিভিয়ে দিলেন হাত বাড়িয়ে। একটু পরে যথারীতি ওঁর নাকডাকা শুরু হল।….