ছয়
পরদিন সকালে বাইক নিয়ে মিশেলের বেসবল কার্ডের দোকানে যাওয়ার আগে, গত রাতের সমস্ত ঘটনা রবিনকে জানিয়েছে মুসা।
‘খুব ভয়ের ব্যাপার,’ বলল রবিন। ‘বিল ফাস্ট যা চায় সেটা তাড়াতাড়ি পেতে হবে আমাদের…নইলে, থাকগে। জিনিসটা জোগাড় করা দরকার।’
মুসা মিশেলের দোকানের দরজা খুলে রবিনকে অনুসরণ করে ভিতরে ঢুকল।
‘অ্যাই, মিশেল, এ রবিন,’ বলল মুসা।
মিশেল টুল থেকে না উঠে কাউন্টারের উপর ঝুঁকে পড়ল। রবিনের সঙ্গে করমর্দন করল।
‘জোসেফ মিলফোর্ড তোমার চাচা না? উনি খুব ভাল কোচ।’
‘মিশেল, আমার একটা বেসবল প্রশ্ন আছে,’ বলল মুসা। ড্যানি সিম্পসনকে নিয়ে।
‘বলে ফেলো।’
‘তাঁকে খুঁজে বের করতে চাই।’
মিশেল হাসতে শুরু করল।
‘ড্যানি সিম্পসন?’ বলে মাথা নাড়ল। ‘ঠাট্টা করছ? তারচেয়ে এলভিসকে খুঁজে পাওয়া সহজ।’
‘তাঁর সাথে কথা বলা দরকার।’
‘কেন?’
‘ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিছু কথা জিজ্ঞেস করার আছে।’
মিশেল আবারও হাসতে লাগল।
‘ছেলে ড্যানি সিম্পসনকে খুঁজে বের করতে চায়, তাকে যাতে কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে পারে।’
‘আমি সিরিয়াস, বলল মুসা। ‘আপনি ড্যানি সিম্পসনকে খুঁজতে চাইলে কী করতেন? ‘
‘তোমার জবাব হচ্ছে,’ মিশেল সামনে ঝুঁকে মুসার মুখের উপর থেকে রবিনের উপর চোখ সরিয়ে আবারও মুসার উপর ফিরিয়ে আনল। ‘হোম।’
‘ব্যস, এটুকুই?’
মাথা ঝাঁকাল মিশেল।
‘আমি ওর হোমটাউনের কথা বলছি না। ‘হোম’ যে কোন জায়গা হতে পারে। ও এমন কোনখানে যাবে যেখানে সবাই গোপনীয়তা রক্ষা করবে। সিম্পসন যখন উধাও হয়ে যায় তখন সে বিখ্যাত লোক। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই তার পাশের বাসায় থাকে। কোন না কোন দোকানদার তার কাছে সদাই বেচে, বাসায় কেউ না কেউ মেইল ডেলিভারি দেয়। এতগুলো মানুষকে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়। সে জায়গাটা যেখানেই হোক সেটা-হোম। এবং সেখানেই গেছে ড্যানি সিম্পসন।’
‘এখন আমরা কী করতে পারি?’ বাইকের কাছে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল মুসা।
‘প্রায় দশটা বাজে,’ বলল রবিন। ‘শীঘ্রি লাইব্রেরি খুলবে। ড্যানি সিম্পসন সম্পর্কে যা জানা যায় জেনে নেয়া দরকার। আমরা হয়তো কোন ব্লু পেয়ে যেতে পারি।’
লাইব্রেরিতে যাওয়ার পর, রবিন মুসাকে দেখাল খবরের কাগজে কীভাবে সিম্পসন খুঁজতে হয়। ম্যাগাজিনগুলো খুঁজল ও।
দিন শেষে, মাত্র এক পাতা খাঁটি খবর পেল ওরা। শীটটায় লেখা:
নাম: ড্যানি সিম্পসন
জন্ম: মে ১৬, ১৯৩২, লস এঞ্জেলেস?
শিক্ষা: লস এঞ্জেলেস হাই স্কুল, কিংবা হার্ডিং হাই স্কুল, কিংবা বিভিন্ন সময়ে দুটিতেই।
ক্যারিয়ার: হাই স্কুলের সিনিয়র বর্ষে, ১৯৫১ সালে সিটি লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ সিরিজ খেলেছেন। টুইন্স এ টিম (দ্য ডিউকস) ১৯৫২ সালের বসন্তে দলে ভেড়ায়। একই গ্রীষ্মে এ এ টর্নেডোতে চলে যান এবং মৌসুমের শেষ ছটি খেলা ট্রিপল-এ টিম, দ্য জেনারেলসের পক্ষে খেলেন। সেই হয় খেলায় সাতবার হোম-রান হিট করেন। মাইনর লিগের ব্যাটিং গড় ৪২১। ৫৬ বার হোম-রান হিট করেছেন। (মেজর লিগে ১৯৫২ সালের রেকর্ড ছিল ৪৭।) ট্রিপল-এ বলে ১৯৫৩ সালের মৌসুম শুরু করলেও জুলাই ১৫, ১৯৫৩ সালে টুইন্সে ডাক পান। প্রথম মেজর লিগ খেলার পর ১৭ জুলাই, ১৯৫৩ উধাও হয়ে যান।
স্বভাব: রাগী, অহঙ্কারী, নীচ মনা। প্রায়ই সংঘর্ষে জড়াতেন। সহখেলোয়াড় ও কোচরা অপছন্দ করলেও শ্রদ্ধা করতেন।
সারা দিনের খাটুনির তুলনায় এটা এমন কিছুই নয়।
.
সে রাতে, ঘুমানোর সময় একাকী থাকতে চাইল না মুসা। জোরে রেডিও ছাড়ল। ক’মিনিট পরই দেয়ালে কিল মেরে রেডিও বন্ধ করতে বলল কিশোর।
গত ক’রাতের পর, ঘুম ছাড়া আর কিছু চায় না মুসা, কিন্তু জেগে থাকার জন্য রীতিমত লড়াই করে ও। দরজা-জানালার দিকে পিঠ ফেরাতে ভয় পায়, কাজেই দেয়ালে হেলান দিয়ে কাত হয়ে বিছানায় বসে থাকে। কাঠের ব্যাটটা পাশে রাখে।
একটু নড়েচড়ে আরাম করে বসল ও। বিল ফাস্টের কথা ভাবার চেষ্টা করল। জেগে থাকতে হবে।
লাফিয়ে উঠল মুসা। ঘরের ভিতরে কিছু একটা চলেফিরে বেড়াচ্ছে। ব্যাটটার দিকে হাত বাড়াল ও। নেই!
আঁধারে উঁকি মারল মুসা। দরজার কাছে বিশালদেহী এক ছেলে। পিঠ ফিরিয়ে মুসার তাকের জিনিসপত্র ঘাঁটছে। কাঁধের উপরে তোলা একটা বেসবল ব্যাট।
মুসা বিছানায় একটু-একটু করে পাশ কেটে দরজার কাছ থেকে সরে গেল। আশা করছে ছেলেটি ওকে লক্ষ করবে না।
কিছু একটা পতনের জোরাল শব্দ, এবং পাঁই করে ঘুরে গেল ও। মেঝেতে পড়ে রয়েছে ওর বুম বক্সটা। বিল ফাস্ট তাকের কাছ থেকে ধীরে-ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। ভাঙা রেডিওটা দেখছে। এবার মুখ তুলে মুসার দিকে চাইল। এই প্রথম ওকে লক্ষ করল।
মুসা জানালাটার ল্যাচ খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু ওটা আটকে গেছে। লকটা নিয়ে যুঝল ও। বিল ফাস্ট ওর দিকে কয়েক পা এগিয়ে এল। মুসা দেয়ালে পিঠ দিয়ে ভূতটার কাছ থেকে দূরে, কামরার কোনার দিকে সরে গেল।
বিল ফাস্ট কাঁধ থেকে ব্যাটটা তুলল। ভাঙাচোরা রেডিওটার উপরে দাঁড়িয়ে ও এমুহূর্তে।
কোণঠাসা হয়ে পড়েছে মুসা।
বেসবল ব্যাট দিয়ে ভাঙা বুম বক্সটাকে এক পাশে ঠেলে সরিয়ে কাছিয়ে এল বিল ফাস্ট। এক হাতে ব্যাটটা বাড়িয়ে ধরে খোঁচা দিল মুসার কাঁধে। মুসা ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিল ওটা।
মুচকি হাসি ছড়িয়ে পড়ল বিল ফাস্টের মুখে, এবং আবারও সে ব্যাট দিয়ে খোঁচা দিল মুসাকে। মুসা মাথা নুইয়ে দরজার দিকে দৌড় দিল। বিল ফাস্ট ব্যাটটা ফেলে দিয়ে লাফিয়ে পড়ল ওর উদ্দেশে। ফ্রাস্টের মুঠো থেকে কবজি ছুটিয়ে ধাক্কা মেরে দরজা খুলল মুসা। চোখের পলকে হলওয়েতে বেরিয়ে এসে দরজাটা পিছনে লাগিয়ে দিল। দরজাটা আটকে রাখতে চেষ্টা করল ও, কিন্তু নবটা ওর হাত মুচড়ে দিল এবং ওর হাত থেকে ছুটে যাওয়ার আগে সামান্য ফাঁক হলো দরজাটা।
মুসা চেঁচাতে-চেঁচাতে হলওয়ে ধরে টলতে-টলতে ছুটল। ওকে ধাওয়া করল বিল ফাস্ট। ভূতটা এতটাই কাছে ওর, বাবা-মার দরজায় বাড়ি দেয়ার জন্য থামা সম্ভব নয়, কিন্তু পাশ কাটিয়ে দৌড়নোর সময় সাহায্যের জন্য চেঁচাল ও। সিঁড়ি ভেঙে তরতর করে নেমে এল মুসা। শেষের চারটি ধাপ লাফিয়ে টপকাল ও এবং পিচ্ছিল কাঠের মেঝেতে পাজোড়া হড়কে গেল ওর। এক সাইড টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তেই উল্টে গেল ওটা, ছিটকে পড়ল একটা প্রদীপ, কিছু ম্যাগাজিন আর একটা পুরানো বেসবল দস্তানা।
মুসা কসরৎ করে উঠে দাঁড়াল। দুটো শক্তিশালী বাহু ওকে চেপে ধরে বাহু দুটোকে দু’পাশে আটকে দিল। মুসা শরীর মুচড়ে ছোটার চেষ্টা করল। চেঁচাতে চাইল, কিন্তু শ্বাস ফুরিয়ে গেছে। মাটি ছাড়ল মুসার দু’পা। লাথি মারছে, মোচড়ামুচড়ি করছে, কিন্তু বিল ফাস্টের বজ্রমুষ্টি আরও দৃঢ় হলো। মুসার মাথা ঝিমঝিম করছে শ্বাসের অভাবে। কানে শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে জ্ঞান হারাবে।
হঠাৎই কাঠের ঠাণ্ডা মেঝেতে পড়ে গেল ও। সাদা একটা হাত নেমে এল। টেবিল থেকে পড়ে-যাওয়া পুরানো বেসবল দস্তানাটা তুলে নিল।
মুসা টলতে-টলতে কিচেনের দিকে দৌড় দিল। শুনতে পেল পিছনে বিল ফাস্ট ধাওয়া করছে। মুসা কিচেনের দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে ওটা সশব্দে পিছনে লাগিয়ে দিল। ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে উঁকি দিল। পার্শ্ব-দরজা খুলে যাচ্ছে, এবং বাড়ির ভিতরে আলো জ্বলে উঠছে। দরজা পুরোপুরি খুলে যেতে কাউকে দেখা গেল না। কিচেনের বাতি জ্বলে উঠল, এবং মি. আমান আলোকিত দরজায় দাঁড়িয়ে চারদিকে দৃষ্টি বুলাতে লাগলেন।
ঝোপ থেকে গুড়ি মেরে বেরিয়ে এল মুসা।
‘মুসা?’ ওর বাবা বললেন। ‘তুমি?’