পাঁচ
রবিন মাইক্রোফিলাটা রিওয়াইও করে ফিরিয়ে দিল লাইব্রেরিয়ানকে। একসঙ্গে বেরিয়ে এল ওরা, দাঁড়াল বাইক র্যাকের কাছে।
‘কী ব্যাপার?’ প্রশ্ন করল রবিন। ‘এত চিন্তা কীসের? তোমাদের ওটা কি হানাবাড়ি?’
মুহূর্তের জন্য রবিনের দিকে চেয়ে রইল মুসা।
‘হ্যাঁ,’বলল। ‘আমার তাই মনে হয়।’
মুসা রবিনকে সব কথা খুলে বলল।
‘তুমিই একমাত্র ওকে দেখতে পাচ্ছ?’ মুসার কথা শেষ হলে জিজ্ঞেস করল রবিন
‘জানি না।’
‘কালকে রাতে কী করছ তুমি?’
‘বাসায় থাকব, সম্ভবত,’ বলল মুসা। ‘টিভি দেখব।’
‘আমি টিকিট জোগাড় করতে পারলে খেলায় যাবে?’
‘ফাস্ট ওখানে আছে কিনা দেখতে?’
‘হ্যাঁ, আমিও হয়তো ওকে দেখতে পাব।’
‘কিন্তু অভিশাপের ব্যাপারটা কী হবে? ওকে দেখলে ও তোমাকে ধরতে আসবে।’
রবিন এক মুহূর্ত ভেবে নিল।
‘আগে খেলা দেখতে যাই, তারপর যা হয় হবে।
.
মুসা যখন বলপার্কের বাইরে ফ্ল্যাগ পোলে গেল, রবিন ওর জন্য অপেক্ষা করছিল।
‘আমার চাচাও এসেছে,’ বলল ও।
‘তুমি ওঁকে বলেছ?’
‘বিল ফাস্টের কথা বলিনি, শুধু খেলার কথা বলেছি। চাচা খেলা দেখার সুযোগ পেলে ছাড়ে না।’
মুসা টিকেট লাইনের দিকে হেঁটে গেল, কিন্তু রবিন ওর শার্টের পকেট থেকে গোটা দুই টিকেট বের করল।
‘চাচা টিকেট কিনে দিয়েছে,’ বলল।
নিজেদের আসনে যাওয়ার পর, রবিনের চাচা ঝুঁকে পড়লেন মুসার হাত ঝাঁকিয়ে দিতে।
‘জোসেফ মিলফোর্ড,’ বললেন। ‘গ্লাড টু মীট ইউ।’
ওঁর হাত ঝাঁকিয়ে দিল মুসা।
‘মুসা আমান, টিকেটের জন্য ধন্যবাদ।’
‘মাই প্লেজার,’ বললেন মি. মিলফোর্ড। ‘তোমাকে চিনি চিনি মনে হচ্ছে।’
‘মনে হয় না।’
মি. মিলফোর্ড মুসার দিকে দু’মুহূর্ত চেয়ে থেকে মনে করার চেষ্টা করলেন।
‘দ্য আস্ট্রোস,’ শেষমেশ বললেন। ‘তুমি পিচার। ফাস্টবলে দু’বার আমার ছেলেকে আউট করেছ।’
মুখের চেহারা লাল হয়ে গেল মুসার।
‘সরি।’
‘না, না,’ মি. মিলফোর্ড বললেন। ‘তোমার রিয়েল ট্যালেন্ট আছে। তোমাকে আমার টীমে পেলে ভাল হত। সামান্য কোচিং পেলে তোমাকে হারানো খুব কঠিন হবে।’
খেলোয়াড়রা মাঠে জায়গা নিয়েছে, রবিন তাদের গা গরম করতে দেখছে, ওদিকে মি. মিলফোর্ড আর মুসা ওর দু’পাশ থেকে কথা বলে চলেছে।
‘তোমার একটা সমস্যা আছে,’ বললেন মি.মিলফোর্ড, ‘সামান্য প্র্যাকটিস দরকার। কী সেটা?’
‘রিলিয পয়েন্ট.’ মাঠ থেকে চোখ না সরিয়ে বলল রবিন।
‘হ্যাঁ, তোমার রিলিয পয়েন্ট ফার্ম আপ করতে হবে। তোমার হাত ক্লান্ত হয়ে পড়লে সামনের দিকে হড়কে যায়, ফলে থ্রোটা নিচু হয়ে যায়।’
এত ভাল আসনে মুসা আগে কখনও বসেনি। অতিরিক্ত ভাল। মাঠের এতটাই কাছে, আউটফিল্ড ফেন্সের উল্টোদিক দেখতে পাচ্ছে না ও।
তৃতীয় ইনিংসে, মুসা আর রবিন মি. মিলফোর্ডের অনুমতি নিয়ে নাচো কিনতে গেল। আপার ডেকে উঠে আউটফিল্ডের দিকে হাঁটা দিল। আলো থেকে বাঁচাতে চোখ ঢেকেছে মুসা।
‘ওই যে,’ তর্জনী তাক করল ও। রেলিঙের উপর দিয়ে দেখার জন্য ঝুঁকে পড়ল ওরা। ‘মাঠের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’
রবিন চোখ পিট পিট করে আরেকটু ঝুঁকে পড়ল রেলিঙের উপরে। ‘এখন পাহাড় চূড়ার দিকে হাঁটছে,’ রবিনকে বলল মুসা। ‘দেখতে পাচ্ছ, মাঠে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করছে। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে দেখতে চাইছে।’
রবিন মুসার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল।
‘আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না,’ বলল। ‘ও কোথায়?’
মুসা চাইল। ছেলেটি পাহাড় বেয়ে নেমে ফেন্সের দিকে আসছে, কিন্তু হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে মুসার দিকে চাইল। এমনভাবে মুসার দিকে চেয়ে রয়েছে, ও যেন স্ট্যাণ্ডের একমাত্র দর্শক। রেইলের পেছনে মাথা নোয়াল মুসা।
‘কী হলো?’ প্রশ্ন করল রবিন। ওর পাশে গুটিসুটি মেরে বসল। ‘ও আমাকে দেখে ফেলেছে।’
রেলিঙের উপর দিয়ে উঁকি দিল রবিন।
‘কই, আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।’
‘আমাকে পাগল ভাবছ না তো?’
‘না, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করেছি।’
‘কী করব বুঝতে পারছি না,’ বলল মুসা। ‘আমাকে ধরতে আসছে ও। একবার চেষ্টাও করেছে।’
‘এসো,’ বলল রবিন, রেইলের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে হাত ছানি দিল।
নাচো কিনতে গেল ওরা।
‘এর মানে কী?’ প্রশ্ন করল মুসা। শুধু আমিই ওকে দেখছি কেন?’
‘তুমি ওর বাসায় থাকো সে জন্যে হতে পারে। কিংবা ও যখন মারা যায় তখন তোমার বয়সী ছিল। আমার জানা নেই। হয়তো ও তোমার কাছে কিছু চায়। জিনিসটা পেয়ে গেলে হয়তো আর দেখা দেবে না।’
‘কী? যে বলটা আমি লুকেছিলাম?’
‘জানি না। কিছু একটা,’ বলল রবিন। ‘প্রতিশোধ। বদলা নেয়া। ভূতের গল্পে যেমনটা থাকে আর কী।’
‘ও আমার কাছে কী চায়?’
‘সেটা নির্ভর করে বিল ফাস্ট কী চেয়েছিল যেটা পায়নি?’
‘জানি না।’
‘তুমি বলেছিলে ও বেসবল গ্লাভ পরে ছিল। কোন কিশোর খেলার সময় গ্লাভ আনে কেন?’
‘হোম-রান ক্যাচ করতে।’
‘কাজেই, মারা যাওয়ার দিন কী করতে পারেনি বিল ফাস্ট?’
‘ড্যানি সিম্পসন, বলল মুসা। ও সিম্পসনের একটা হোম-রান ক্যাচ করতে চেয়েছিল।’
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
‘ও চায় তুমি ওকে হেল্প করো,’ বলল। ‘হয়তো যারা হেল্প করতে পারবে বলে আশা করে তাদের দেখা দেয়, আর হেল্প না করলে খেপে যায়।’
‘সাহায্য? ওকে কীভাবে সাহায্য করব আমি?’ মুসার প্রশ্ন।
‘ড্যানি সিম্পসনকে ফিরিয়ে আনো।’
‘ড্যা-ড্যানি সিম্পসন?’ তুতলে বলল মুসা। ‘সে উধাও হয়ে গেছে। বেঁচে আছে কিনা তাই বা কে জানে।’
‘বিল ফাস্ট আর কী জন্যেই বা অপেক্ষা করছে? এত বছর ধরে ফেন্সের বাইরে ঘুর ঘুর করছে কেন?’
‘ড্যানি সিম্পসন,’ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল মুসা। ‘চল্লিশ বছর আগে উধাও হয়ে গেছে এমন লোককে খোঁজা শুরু করব কীভাবে?’
.
সে রাতে, মুসা এতটাই ভীত ছিল ঘুমোতে পারল না। মুহূর্তের জন্যও চোখ বুজতে সাহস পেল না-চোখ খুললেই বুঝি বিল ফাস্টের ভূতের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে যাবে।
রাত দুটোর দিকে পাজামা পরে পা টিপে-টিপে নীচে নেমে এল ও। টিভি খুলল। লিভিং রূমের সব কটা বাতি জ্বালল। সোফাটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখল, পিছন থেকে কেউ যাতে আসতে না পারে। পুরানো এক সিনেমা দেখার চেষ্টা করল ও, কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ল কয়েক মিনিট না যেতেই। ক’ ঘণ্টা পরে ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙল। টিভিতে ব্যায়ামের এক অনুষ্ঠান চলছে। দেয়াল ঘড়ির দিকে চাইল মুসা। পাঁচটা বেজে গেছে। দিনের আলো ফুটি-ফুটি করছে। কোন কিছুই ঘটেনি।
জানালায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে লাফিয়ে উঠল মুসা। হেসে উঠে পর্দাটা টেনে দিল। প্রতিবিম্বের দিকে চাইল। চুল এক পাশে খাড়া হয়ে আছে। চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। এবার মুখটাকে পিছনে দেখতে পেল।
পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল মুসা। বিল ফাস্টের মুখ ওর মুখের উপর ব্যঙ্গ ঝরাচ্ছে। এক মুহূর্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল মুসা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ওর কাঁধে ঠাণ্ডা একটা হাত রাখল ভূতটা। মুসা মাথা নুইয়ে, হাঁচড়ে পাঁচড়ে ওটার পাশ দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল, কিন্তু একটা হাত ওর পাজামা-শার্ট চেপে ধরল, এবং ওর চটিজোড়া পা থেকে খসে চকচকে কাঠের মেঝেতে হড়কে গেল।
মুসা ব্যানিস্টার চেপে ধরে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। ওর পাজামার কয়েকটা বোতাম ছিঁড়ে গেল। পিছনের হাতটাকে চাপড় মেরে শরীর মুচড়ে মুক্ত হতে চাইল, কিন্তু বিল ফাস্ট খুবই শক্তিশালী। খালি হাত দিয়ে শার্টের অন্য বোতামগুলো খুলে ফেলল মুসা এবং কিলবিলিয়ে বেরিয়ে এল পাজামা শার্ট থেকে। সিঁড়িতে পড়ে গেল ও। ‘বাঁচাও,’ দুর্বল কণ্ঠে ডাকল, হাঁচড়ে পাঁচড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে ‘বাঁচাও!’
সিঁড়ির মাথায় পৌছে গেছে প্রায় এসময় বরফশীতল হাতটা ওর গোড়ালি চেপে ধরে টানতে লাগল। কয়েক ধাপ পিছলে নেমে গেল ও, তারপর ব্যানিস্টার চেপে ধরল। ওকে ধরে রাখা হাতটার দিকে চাইল। ঠাণ্ডা আঙুলগুলো পেঁচিয়ে ধরছে মুক্ত পা-টা, এবং হাঁটু জোড়া টেনে উপরে তুলে ফেলা হয়েছে।
‘বাঁচাও!’ চেঁচাল ও। ব্যানিস্টার ধরে-থাকা হাতটা হড়কে যেতে শুরু করেছে। ‘বাবা! বাবা!’
মুসার মুঠো ছুটে গেছে এসময় দড়াম করে ওর বাবার বেডরূমের দরজাটা খুলে গেল। ধাপের উপর পড়ে গেল মুসা। হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে পড়ল ওর বাবা যেখানে দাঁড়িয়ে। সিঁড়ির মাথায় পৌছে পিছু ফিরে চাইল, কেউ নেই।
‘কী হয়েছে? এত চেঁচামেচি কীসের?’ ওর বাবা প্রশ্ন করলেন।
সিঁড়ির দিকে চোখ ফেরাল মুসা। দ্বিতীয় ধাপে পড়ে রয়েছে একটা পুরানো বেসবল দস্তানা। লিভিং রুমে টিভির আলো জ্বলছে।
মি. আমান ওকে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন।
‘তুমি ঠিক আছ তো, মুসা? দুঃস্বপ্ন দেখেছ?’
মুসার শ্বাস ফিরে পেতে এক মুহূর্ত লাগল।
‘হ্যাঁ,’ কাঁপা কণ্ঠে বলল। ‘দুঃস্বপ্নই ছিল ওটা।’