ভয়-ভুতুড়ে – ১

এক

প্রথম ইনিংসের শেষ দিক। রকি বীচের মাইনর লীগ টিম বুলডগের ব্যাট করার পালা। কিশোর আর মুসা বসে ছিল থার্ড বেসের উপরে।

‘বুলডগরা ব্যাট করতে এলে,’ মুসা বলল কিশোরকে, ‘আমি আউটফিল্ড ফেন্সের পিছনে নেমে যাব, যাতে বিল পিটারসন হোম-রান হিট করলে, আমি বলটা পেতে পারি। আসবে আমার সাথে?’

নাক দিয়ে খোঁত জাতীয় একটা শব্দ করল কিশোর।

‘তুমি এখনও ছেলেমানুষ রয়ে গেলে,’ বলল।

আউটফিল্ড ফেন্সের পিছনে পাহাড়টা বাইল মুসা। লক্ষ করল বিল পিটারসন প্রথম দুটো পিচ সুইং করল না। পিটারসন এইমাত্র ব্যাট করতে নেমেছে। সে বুলডগের বিগ হিটার, এবং মুসা জানে আজ রাতে অন্তত একটা বলকে সে মাঠ ছাড়া করবেই করবে।

তৃতীয় পিচে মুসা ওকে ব্যাট ঘোরাতে দেখল। ব্যাটে-বলে মধুর সংযোগ। বলটা সাঁ করে শূন্যে উঠে উজ্জ্বল আলোর আড়ালে হারিয়ে গেল। জনতা উল্লাসে চেঁচাচ্ছে, বলটা ফিরিয়ে দিতে বলছে, মুসা হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে ওটা কোথায় পড়ছে দেখার চেষ্টা করল। বলটা দেখতে পেল ও। ওর ডান দিকে পড়ছে। পাহাড় বেয়ে দৌড়ে নেমে গেল, এবং বলটা আছড়ে পড়ল ওর দাস্তানায়। আঙুলগুলো টাটিয়ে উঠলেও বলটা পেয়ে ব্যথা ভুলে গেল ও।

জনতার বাঁধভাঙা উল্লাস, মুহূর্তের জন্য মুসার ধারণা হলো ওর ক্যাচটাকে প্রশংসা করা হচ্ছে। কিন্তু পরমুহূর্তে টের পেল ফেন্সের ওপাশে আঁধারের মধ্যে দর্শকরা দেখতে পাচ্ছে না ওকে। তারা হোম রানের জন্য হৈ-হৈ করছে।

ঠিক এসময় চোখের কোণে ছেলেটিকে লক্ষ করল মুসা। ফেন্সের ছায়ায় ত্রিশ ফীট দূরে দাঁড়িয়ে। মুসার সমবয়সী, তবে গায়ে-গতরে অনেক বড়। পুরানো ফ্যাশনের এক বেসবল শার্ট পরনে তার। বুকের কাছে লেখা: ‘ফ্যালকনস’। হাতে বেসবল দস্তানা। আঙুলগুলো বেরিয়ে রয়েছে, লেসিং ছেঁড়া যেন। মাথায় হাস্যকর হেয়ারকাট।

মুসা ছেলেটির দিকে চেয়ে মৃদু হাসল, কিন্তু হাসিটা ফিরিয়ে দিল না সে। মুসার উপরে শীতল দৃষ্টি ধরে রেখে ধীর পায়ে ওর দিকে হেঁটে আসছে। বলটা চায়, ভাবল মুসা।

‘ও এখানে আরেকটা বল পাঠাবে,’ বলল ও। ‘ওটা তুমি নিয়ো।’

ছেলেটি কিছু বলল না। স্রেফ হেঁটে আসতে লাগল মুসার দিকে। মুখের চেহারায় মরা মানুষের অভিব্যক্তি। জমে গেল মুসা। অদ্ভুত কিছু একটা আছে এই ছেলেটির মধ্যে, ভুতুড়ে কিছু। হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হলো মুসার।

ছেলেটির মুখে কথা নেই। ক্রমেই কাছিয়ে আসছে সে। ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। পিছু হটে যেতে লাগল মুসা।

‘আমি আমার সিটে ফিরে যাচ্ছি,’ বলল ও। কিন্তু ছেলেটি জিন্দালাশের মত হেঁটে আসতেই লাগল। দৌড়তে ইচ্ছে করল মুসার, কিন্তু পা নড়ল না।

ছেলেটি দশ ফীটের মধ্যে চলে এলে মুসা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে,’ বলে, বলটা ছুঁড়ে দিল। ‘এই নাও—’

বলটা ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল। উজ্জ্বল আলো থেকে চোখ ঢেকে চারধারে দৃষ্টি বুলাল মুসা। ছেলেটি নেই। ছায়ার আড়ালে একা ও।

নিজের আসনে ফিরে, বারবার ফেন্সের ওপাশের আঁধারে চোখ ফেরাল মুসা। ছেলেটা আছে কিনা দেখার জন্য। আলো এতটাই চোখ ধাঁধানো, ওদের পিছনে অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে। এমনকী তারারাও অদৃশ্য।

দু’দিন পর। দিনের খেলায় কিশোরের সঙ্গে এসেছে মুসা। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। খেলা চলছে ঢিমে তালে। ফেন্সের ওপাশে নজর বুলাল মুসা। ওর ধারণা ছেলেটিকে পাহাড়চূড়ায় উঠে ফেন্সের পিছনে কষ্টেসৃষ্টে নেমে যেতে দেখেছে।

চতুর্থ ইনিংসে পিটারসন দ্বিতীয়বারের মত ব্যাট করতে এল। দু’জন আউট হয়ে গেছে এবং বেসে কেউ নেই। পিটারসনের প্রথম দফা খেলা শেষ, এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ওর ভুলে একটা রান স্কোর হয়েছে। উন্মাদের মতন দেখাচ্ছে ওকে। প্রথম পিচে সজোরে হাঁকাল ও এবং ব্যাট বলের অনেক দূর দিয়ে গেল।

‘টেক ইট ইজি!’ চেঁচাল কিশোর।

দ্বিতীয় পিচ সামান্য বাইরে ছিল, পিটারসন লাফিয়ে হিট করল, এবং দর্শকরা উঠে দাঁড়াল। মুসাও সটান দাঁড়িয়ে পড়েছে। দেখতে পেল বলটা সেন্টার-ফিল্ড ফেন্সের কমপক্ষে ন’ফীট উপর দিয়ে ভেসে গেল। পাহাড়ের এক পাশে, সেই ছেলেটির পায়ের কাছে বাউন্স খেল বলটা।

নড়ল না ছেলেটি। বলটা দেখেছে বলে মনে হলো না। আরেকটি ছেলে পড়িমরি রাইট-ফিল্ড ব্লিচার্স থেকে নেমে দৌড়ে গেল পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়া বলটা কুড়োতে।

‘ও বলটা নিল না কেন?’ জোরে বলে উঠল মুসা।

‘কী?’ কিশোরের প্রশ্ন।

‘ওই ছেলেটা, বলটা নিল না কেন?’

‘নিয়েছে তো,’ বলল কিশোর, ‘ওই যে, নীল শার্ট পরা।’ আঙুল তাক করে দেখাল দ্বিতীয় একটি ছেলে ব্লিচার্সে উঠে বসে অন্য ছেলেদের সঙ্গে হাই-ফাইভ বিনিময় করছে।

‘ও না,’ বলল মুসা। ‘যে ছেলেটা পুরোটা সময় ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল।’

‘কোন ছেলে?’

‘ওই যে ওখানে,’ বলল মুসা, পাহাড়ে দাঁড়ানো একাকী মূর্তিটার দিকে তর্জনী তাক করল।

‘কোথায়?’ প্রশ্ন করল কিশোর। ‘পাহাড়ে, কানা নাকি তুমি?’

কিশোর সামনে ঝুঁকে চোখ পিটপিট করল। মুসার দিকে চেয়ে তারপর ফেন্সের ওপাশে চাইল। মুহূর্তখানেক পরে হাসি ফুটল ওর মুখে। ‘ও, বুঝেছি,’ বলল। ‘বিল ফাস্টের ভূত। মজা করছে?’

‘কী!’

‘ভান করছ তুমি বিল ফাস্টের ভূত দেখেছ। ইউএফও-র কারণে আমি ওকে দেখতে পাচ্ছি না।’

‘কী?’

‘ওহ্, ছেলেমানুষী ছাড়ো, মুসা।’

‘তুমি ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছ না?’

‘না, পাচ্ছি না,’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। ‘তুমিও পাচ্ছ না। এখন আর জ্বালিয়ো না তো, খেলা দেখতে দাও।’

বিল ফাস্টের ভূত। পরের ক’দিন মুসার মনে গেঁথে রইল নামটা। ক’জন বন্ধুকে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু বিল ফাস্টের নাম কেউ শোনেনি। কিশোরকে জিজ্ঞেস করতে চায় না ও। নিজেকে বোকা প্রমাণ করার ইচ্ছে নেই, কিন্তু শেষমেশ সুযোগ এসে গেল।

কিশোর মুসার বাসায় কদিনের জন্য থাকতে এসেছে। মুখে চওড়া হাসি নিয়ে সে মুসার কামরায় এল। জিজ্ঞেস করল ওর সারাদিন কেমন কেটেছে। ডেস্ক থেকে ঘুরে বন্ধুর দিকে চাইল মুসা। কিশোর কিছু একটা চায়, টের পেল। মুসার বিছানার কোনায় কিছুক্ষণ বসে থাকল কিশোর, এটা-সেটা নিয়ে কথা বলল। তারপর মূল প্রসঙ্গে এল।

‘আমার বাইকের চাকা ফুটো হয়ে গেছে। ঠিক করব, কিন্তু আন্টি গাড়ি নিয়ে গেছেন আর আঙ্কল এখনও বাসায় ফেরেননি। তোমার বাইকটা নিয়ে রিপেয়ার কিটের জন্যে ড্রাগ স্টোরে যেতে পারি?’

মৃদু হাসল মুসা।

‘এক শর্তে।’

‘বুঝেছি,’ বলে উঠে দাঁড়াল কিশোর, ‘সামান্য একটা ফেভার চাইছি বলে আমাকে দিয়ে লন পরিষ্কার করাতে চাও?’

‘রিল্যাক্স। আমি শুধু বিল ফাস্টের ভূতের কথা জানতে চাই।’

‘বিল ফাস্টের ভূত? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ও ব্যাপারে এক্সপার্ট।’

তুমি কী জানো স্রেফ সেটাই বলো, আর আমার বাইক নিয়ে যাও।’

‘ঠিক আছে,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর, ফের বিছানায় বসল। ‘বিল ফাস্ট নামে এক ছেলে ছিল। বেসবল খেলা দেখতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ে মারা যায়। এখন সে বল পার্কে হানা দেয়। গল্প শেষ।’

‘এটুকুই?’

‘হুঁ।’

‘ছেলেটার নাম কী ছিল?’

‘বিল ফাস্ট,’ ছদ্ম বিরক্তি প্রকাশ করে বলল কিশোর। ‘তুমি মন দিয়ে শোননি?’

‘আর কিছু নেই? এটাই পুরোটা?’

‘হ্যাঁ। না, এক মিনিট-একটা অভিশাপের কথা শোনা যায়। মানুষ যখন বিল ফাস্টকে দেখে, সে ওদের পিছু নেয় এবং সাথে করে নিয়ে চলে যায়।’

কী বললে?’ ঝট করে সিধে হয়ে বসে প্রশ্ন করল মুসা।

‘যারা ওকে দেখে তারা উধাও হয়ে যায়-বা সেরকমই কিছু হবে। ভুলে গেছি।’

মুসা ঢোক গিলল। কিশোর ওর দিকে দু’মুহূর্ত একদৃষ্টে চেয়ে রইল।

‘রিল্যাক্স,’ বলে হেসে উঠল ও। ‘দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভূত দেখেছ। এটা নিছকই গল্প। তোমার বাইকটা এখন নিতে পারি? আর বিশ মিনিটের মধ্যে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।’

‘হ্যাঁ, নাও,’ শুকনো গলায় বলল মুসা। কিশোর কত সহজেই না ঠাট্টা করতে পারল। আসলে ও তো আর বিল ফাস্টকে দেখেনি।