উপন্যাস
গল্প

ভয়ের মুখোশ – ৫

একটা বাঁক ঘুরতেই স্টেশন দেখা গেল। সামনে অনেকগুলো রিকশা আর মোটরের ভিড়। কিছু লোকও ছোটাছুটি করছে।

দুজনে স্টেশনের এলাকার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল।

একটা সান্ত্বনা, এখানে অনেক লোকজন রয়েছে, কেউ হঠাৎ কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।

দিপু আর তপু লোহার বেড়ার ফাঁক দিয়ে প্ল্যাটফর্মের ওপর চলে এল। অনেকগুলো বেঞ্চ পাতা রয়েছে। তার একটার ওপর গিয়ে বসল।

দিপুই বলল, এখানে বসে ট্রেনের চলাচল লক্ষ করি। যে ট্রেনে দেখব ভিড় বেশি, সেটাতে চড়ে বসব। তাহলে বিনা টিকিটে শহরে গিয়ে পৌঁছাতে পারব।

তপু কিছু বলল না। চুপচাপ বসে রইল।

অনেকগুলো ট্রেন এল, গেল, কিন্তু দুজনে সাহস করে চড়তে পারল না।

এদিকে বেলা বাড়ছে। এভাবে কতক্ষণ বসে থাকবে প্ল্যাটফর্মে?

কে তোমরা?

গম্ভীর আওয়াজে দুজনেই চমকে মুখ ফেরাল।

রেলের পোশাক-পরা একজন টিকিট চেকার এসে দাঁড়িয়েছে।

ভদ্রলোক বাঙালি। পরিষ্কার উচ্চারণ।

দিপু বলল, আমাদের পয়সা নেই, তাই ট্রেনে চড়তে পারছি না।

যাবে কোথায় তোমরা?

শহরে।

তার মানে রেঙ্গুনে। সেখানে কে আছে?

এবার দিপু আর তপু কথা বলতে পারল না। কী বলবে? কে আছে শহরে? কার কাছে তারা যাবে?

কী হল? একেবারে থেমে গেলে যে?

আমরা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি, মানে বাংলা দেশ থেকে।

তোমাদের চেহারা দেখে সেইরকমই মালুম হচ্ছে। ওঠো, এসো আমার সঙ্গে।

দিপু আর তপু দাঁড়িয়ে উঠল।

তপু বলল, কোথায়?

শ্বশুরবাড়ি নিশ্চয় নয়। গেলেই বুঝতে পারবে।

দুজনকে নিয়ে টিকিট চেকার প্ল্যাটফর্মের বাইরে এল।

টিকিটঘরের সামনে প্রহরারত একজন বর্মি পুলিশ ছিল, তাকে হাত নেড়ে ডাকল।

পুলিশ আসতে তাকে চাপা গলায় ফিসফিস করে কী বলল।

পুলিশ মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল।

টিকিট চেকারের কান বাঁচিয়ে দিপু বলল, এবার উপায়?

তপু মৃদুকণ্ঠে উত্তর দিল, ঠিক আছে, পুলিশেই দিক। আর এভাবে ঘুরতে পারছি না। যা বলবার পুলিশের কাছেই বলব।

একটু পরেই পুলিশ ফিরে এল। হেঁটে নয়, লাল একটা ভ্যানে চড়ে। ভ্যানের মধ্যে থেকেই দিপু আর তপুকে ইশারায় ডাকল।

দিপু আর তপু একটু ইতস্তত করে ভ্যানে উঠে বসল।

দরজা বন্ধ হতে সব অন্ধকার। বাইরের কিছু বোঝবার উপায় নেই।

শুধু এইটুকু বোঝা গেল, মোটর খুব দ্রুতবেগে বাঁকের পর বাঁক পার হচ্ছে।

একসময় ভ্যান থামল।

পুলিশ নেমে দরজা খুলে দিল।

ছোটো একতলা বাড়ি। সামনে কতকগুলো পুলিশ ঘুরছে। গোটাকয়েক মোটর সাইকেলও রয়েছে।

নামো। নামো।

পুলিশের হাত নাড়ার ভঙ্গিতে মনে হল নামতে বলছে। দিপু আর তপু নেমে পড়ল।

সামনের ঘরে বিরাটবপু একটি পুলিশ অফিসার। তার কানে কানে পুলিশ কী বলতেই সে হাত দিয়ে কোণের একটা ঘর দেখিয়ে দিল।

সেইদিকেই বোধহয় হাজত। দিপু আর তপুকে হাজতে কাটাতে হবে।

ঠিকই তা-ই, এবার পুলিশ দিপু আর তপুর শার্টের কলার ধরে টেনে নিয়ে চলল।

বাধা দিয়ে লাভ নেই, তাহলে নির্যাতন শুরু হবে।

দিপু আর তপু ভাবল, রাখুক হাজতে, আপত্তি নেই, শুধু যেন খেতে দেয়। না খেতে দিয়ে না মারে।

দরজা খুলে তার মধ্যে দুজনকে ঢুকিয়ে পুলিশ সজোরে দরজা বন্ধ করে দিল।

হাঃ, হাঃ, হাঃ, হাঃ।

হাসির শব্দে দুজনে চমকে মুখ তুলল, তারপর আর অনেকক্ষণ চোখ নামাতে পারল না।

কোণের দিকে একটা বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে আ লিম।

দিপু বলল, সর্বনাশ, তাহলে সবটাই ফাঁকি! টিকিট চেকার, পুলিশ সব নকল? আমাদের ধরে আনার ফন্দি!

কোথায় পালিয়েছিলি শয়তানের বাচ্চারা? আ লিম বজ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করল।

তপু বলল, আপনি যেখানে পাঠিয়েছিলেন, সেখানে গিয়েছিলাম। তারপর বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম, আপনি তো কিছু করলেনও না।

চোপরাও মিথ্যেবাদী, আ লিম গর্জন করে উঠল, সর্বনাশ করে এসেছিস। যে প্যাকেটটা দিয়েছিলাম, সেটা টেবিলের ওপর রেখে এসেছিস। সেই প্যাকেট পুলিশের হাতে পড়েছে।

দিপু আর তপু ভাবতে শুরু করল।

চেয়ারে বসা লোকটার কাছে গিয়ে প্যাকেটটা টেবিলের ওপরই তারা রেখে এসেছিল, তারপর লোকটা আচমকা মেঝের ওপর পড়ে যাওয়ার পর থেকে সবকিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। প্যাকেটের কথা আর মনেই ছিল না। সেই প্যাকেটটা পড়েছে পুলিশের হাতে।

কী, চুপ করে আছিস যে?

দিপু বলল, লোকটা মারা গেছে দেখে আমরা এমন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে আর কিছু মনে ছিল না আমাদের।

মনে ছিল না আমাদের! আ লিম ভেংচি কাটল, এতদিন আমার দলে রয়েছিস, কাজ করেছিস আমার সঙ্গে, আর খেয়াল নেই যে প্যাকেটের ওপর আমার গুপ্ত আস্তানার ঠিকানা রয়েছে?

এবার তপু প্রতিবাদ করল, কতদিন আবার আছি আপনার সঙ্গে? আমরা কি আপনার দলের লোক? আপনি তো কদিন হল ভুলিয়ে আমাদের ধরে রেখেছেন।

দিপুও সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমাদের জাহাজে উঠিয়ে দিন, আমরা যে দেশের ছেলে সে দেশে চলে যাই। এসব ঝামেলা আমাদের ভালো লাগছে না।

আ লিম ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, থানার মধ্যে বসে ইনিয়েবিনিয়ে খুব মিথ্যা কথা বলছিস। তবে, শুনে রাখ, এটা মোটেই থানা নয়। সব সাজানো ব্যাপার। আমার আর-এক কারসাজি। মিথ্যা কথা বললে প্রাণ নিয়ে এখান থেকে বের হতে পারবি না।

দিপু অবাক কণ্ঠে বলল, বা রে, মিথ্যা বলছি কি না, আপনি জানেন না? আমরা এ দেশে এসেছি দশ দিনও নয়। এ দেশের ভাষা জানি না, পথঘাট চিনি না। তার ওপর পদে পদে বিপদ ঘটছে। আপনি সে লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়লে, সে তো বন্দুকের গুলিতেই খতম করে দিত আমাদের দুজনকে।

কোন লোকটা? আ লিম চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসল।

পোড়োবাড়িতে যে লোকটা মারা গিয়েছিল তার যমজ ভাই। সে-ই তো রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল, ভান করে, আমরা তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে গিয়ে বিপদে পড়লাম।

আ লিম নির্বাক। একটি কথাও বলল না।

তপু প্রায় কান্না-জড়ানো গলায় বলল, আপনার দুটি হাত ধরে মিনতি করছি আমাদের কোনওরকমে জেটিতে পৌঁছে দিন। আমরা যেমন করে পারি ফেরবার ব্যবস্থা করব।

তপুর কথা শেষ হতেই এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল।

আ লিম দাঁড়িয়ে উঠে দু-হাতে নিজের মুখটা চাপল, তারপরই পাতলা রবারের মুখোশটা তার পায়ের তলায় খসে পড়ল।

কোথায় আ লিম! এ তো সম্পূর্ণ অন্য একটা লোক!

টকটকে গৌরবর্ণ, কোঁকড়ানো পিঙ্গল চুলের রাশ, তীক্ষ্ন দু-চোখের দৃষ্টি।

দিপু আর তপু আর্তনাদ করে পিছনে সরে গেল।

শোনো, ভয় পেয়ো না, জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর, আমি আ লিম সেজে তোমাদের পরীক্ষা করছিলাম। মনে হচ্ছে, তোমরা আ লিমের দলের নও। ভয় দেখিয়ে আ লিম তোমাদের দিয়ে তার কাজ হাসিল করত। একটা বড়ো সুবিধা, তোমরা পথঘাট চেনো না, এ দেশের ভাষাও জানো না, কাজেই তোমরা প্রায় অন্ধ আর বোবা লোকের শামিল।

অনেক কষ্টে সাহসে ভর করে দিপু প্রশ্ন করল। আপনি কে?

আমি গোয়েন্দা ম্যালকম। অনেকদিন থেকেই আমি আ লিমের দলের সন্ধানে রয়েছি। তোমাদের কাছে আমার কিছু প্রশ্ন আছে।

বলুন।

পোড়োবাড়িতে যে একটা খুন হবে, আমি জানতাম, কিন্তু আমার পৌঁছাতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে তো তোমাদের দেখতে পেলাম না। অথচ তোমরা বলছ, মৃত লোকটা চেয়ারের ওপর বসে ছিল, তোমাদের ধাক্কায় মেঝেয় লুটিয়ে পড়েছে।

তপু বলল, আমরা গুপ্ত সুড়ঙ্গের মধ্যে ছিলাম।

গুপ্ত সুড়ঙ্গ? ওখানে গুপ্ত সুড়ঙ্গ আছে? গুপ্ত সুড়ঙ্গ যে আছে, তা-ই বা তোমরা জানলে কী করে? গোয়েন্দা ম্যালকমের চোখে যেন সন্দেহের ছায়া নামল।

দিপু বলল, আমাদের একবার নিয়ে চলুন সেখানে, তাহলেই সব বুঝতে পারবেন।

ম্যালকম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, চলো তাহলে।

তপু আর পারল না। বলেই ফেলল, তার আগে কিছু আমাদের খেতে দিন। অনেকক্ষণ কিছু খাইনি।

ও, আমি ভারী দুঃখিত। এ কথাটা আমার মনেই ছিল না।

থানার একটা ঘরেই খাওয়ার ব্যবস্থা হল। বেশ ভালো ব্যবস্থা।

আহার শেষ হতে তিনজনে থানার সামনে দাঁড়ানো মোটরে গিয়ে উঠল।

ম্যালকমই চালাল। পিছনের সিটে দিপু আর তপু।

সেই নদীর ধার! তিনজনে আবার সাম্পানে উঠল।

হাঁটাপথ ধরে গিয়ে পোড়োবাড়িতে উপস্থিত হল।

ম্যালকম হাতলের কারসাজি দেখল। তারপর তিনজনে সুড়ঙ্গপথে নেমে গেল। ম্যালকমের হাতে জোরালো টর্চ।

দিপু বলল, এই দেখুন, এই বস্তার বালিশে আমরা শুয়েছি।

ম্যালকম হাঁটু মুড়ে বসে কোমর থেকে ছোরা বের করে বস্তার গায়ে বসিয়ে দিল। ফুটো দিয়ে ঝুরঝুর করে কীসের গুঁড়ো ঝরে পড়ল।

ম্যালকম সেই গুঁড়ো হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে দেখে বলল, এসব হচ্ছে কোকেন। নেশার জিনিস। এইগুলোর জন্যই এদের মধ্যে শত্রুতা।

কীসের শত্রুতা?

সব জানতে পারবে। এখানে আর কী দেখবার আছে বল?

ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখানো হল, তারপর তিনজনে উঠে এল।

বাইরে বের হবার সময় ম্যালকম পকেট থেকে একটা বড়ো তালা বের করে দরজায় আটকে দিল।

তপু সব লক্ষ করে বলল, এর আগে দরজায় তালা দেননি কেন?

দিইনি তার কারণ, আমি জানতাম, যে প্যাকেটটা ফেলে গেছে, সে প্যাকেট নিতে আসবে। আমি আ লিমের দলের কারো অপেক্ষায় ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম। বাড়ির মধ্যে কদিন পরে তোমাদের বের হতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ আমি তখন গুপ্ত সুড়ঙ্গপুরীর রহস্যের কথা জানতাম না। ভেবেই পাইনি কোথা থেকে তোমরা এলে। তাই তোমাদের পিছু নিলাম।

পিছু নিলেন?

হ্যাঁ, তোমরা পার হবার আগে অন্য ঘাট থেকে মোটর বোটে পার হয়ে গিয়েছিলাম।

একটা আলো আমাদের পিছনে আসছিল।

হ্যাঁ, সেটা আমারই সাইকেলের আলো। তারপর লোকটা আহত সেজে তোমাদের যখন বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল, তখনও আমি দূর থেকে তোমাদের অনুসরণ করেছিলাম। লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমিই তোমাদের বাঁচাই। লোকটাকে পিছমোড়া করে বেঁধে এসেছিলাম, তারপর গ্রেপ্তার করে হাজতে রেখে দিয়েছি।

তবু জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু লোকটা আমাদের গুলি করতে চেয়েছিল কেন? আমরা তো তার কোনও ক্ষতি করিনি।

ম্যালকম হাসল, সে মস্ত বড়ো কাহিনি। চলো থানায় ফিরে যাই, সেখানে গিয়ে তোমাদের সব বলব।

বিকালের দিকে থানার পাশে কোয়ার্টারের বারান্দায় তিনজন বসল। পাশাপাশি।

একটা ইজিচেয়ারে ম্যালকম। দুটো চেয়ারে দিপু আর তপু।

একটা চুরুট ধরিয়ে ম্যালকম বলতে আরম্ভ করল, রেঙ্গুন শহরে দুটো দল আছে। একটা আ লিমের দল, আর-একটা সোলেমানের দল। দুটো দলই আবগারি জিনিস পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে এদিক-ওদিক চালান দেয়। এসব নিষিদ্ধ জিনিসের চালানের ব্যাপারে রেষারেষি থাকেই। সেই রেষারেষি থেকে খুন ও জখম হয়। কতকগুলো লোক আছে, তাদের আফিম, কোকেনেও ভালো নেশা হয় না, তারা সাপের বিষ পর্যন্ত হজম করে।

সোলেমান সাপের বিষ দিয়ে বড়ি তৈরি করত, বিশেষ মহলে সেই বড়ির দারুণ চল ছিল। সোলেমানের যে যমজ ভাই ছিল সেটা আমরা জানতাম না, জানতে পারলে ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে যেত।

কেন? তপু জিজ্ঞাসা করল।

কারণ যতবারই এই সাপের বিষে কারো মৃত্যু হয়েছে— আমাদের সন্দেহ থাকলেও সোলেমানকে ধরতে পারিনি, কারণ সাক্ষীরা চেহারার যে বিবরণ দিয়েছে তাতে বেশ বোঝা গেছে যে সোলেমানই বড়ির প্যাকেট সে বাড়ির মালিককে দিয়েছে। সোলেমানকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে কয়েকবার, কিন্তু প্রত্যেকবারই সে নির্ভুলভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে যে সেই সময় সে ঘটনাস্থল থেকে তিনশো কি দুশো মাইল দূরে ছিল।

কী করে? দিপু অবাক হল।

যখন এক জায়গায় সোলেমান বড়ির প্যাকেট দিচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে তার যমজ ভাই দুশো মাইল দূরের কোনও শহরে জজ-ম্যাজিস্ট্রেট-সিভিল সার্জনদের একটা বিরাট পার্টি দিয়েছে। তাঁরা সবাই একবাক্যে বলেছেন যে সোলেমান সেই সময়ে তাঁদের মধ্যে ছিল। দুজনেই এক নাম ব্যবহার করত, এবং চেহারার এত মিল, যা তোমরা নিজেদের চোখেই দেখেছ যে, একজনকে আর-একজন ভাবা খুবই স্বাভাবিক।

সোলেমানকে খুন করেছিল তারই এক সহকারী।

সহকারী? তপু জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ। আ লিম তাকে টাকা দিয়ে নিজের দলে নিয়ে এসেছিল।

কিন্তু কী করে মারল? তার দেহে তো কোনও আঘাতের চিহ্ন দেখলাম না।

তোমরা আর কী করে দেখবে? আমাদেরই অনেক খোঁজ করে আঘাতের চিহ্ন বের করতে হয়েছিল। ডাক্তার মৃত্যুর কারণ বলেছিল বিষপ্রয়োগ। এমন তীব্র বিষ যে মুখে দিলে মুখ পুড়ে যাবার কথা। তারপর অনেক চেষ্টার পর ঘাড়ে একটা ছোটো দাগ দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম, ঘাড়ের পেশির ওপর কেউ ইঞ্জেকশন দিয়েছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু।

ম্যালকম একটু দম নিল, তারপর বলল, সোলেমানকে যে আ লিমের লোক মেরেছে সেটা তার ভাই সন্দেহ করেছিল। তোমরা আ লিমের দলের লোক সেটাই তার বিশ্বাস, অবশ্য আমার নিজেরও তা-ই ধারণা ছিল। সেইজন্যই সোলেমানের ভাই তোমাদের খতম করে দিতে চেয়েছিল।

তাকে আপনি কি মেরে ফেলেছেন? দিপু ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল।

না, না, ম্যালকম হাসল, আমরা পুলিশ, আমরা মানুষ মারি না। বললাম যে তাকে হাজতে রেখেছি। অনেক কিছু কথা ইতিমধ্যে সে বলেও ফেলেছে।

কিন্তু আপনি আ লিমের ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন কেন?

তপুর এই প্রশ্নের উত্তরে ম্যালকম আবার মুচকি হাসল, তারপর বলতে লাগল, যদি সত্যি তোমরা আ লিমের দলের হতে তাহলে আ লিমের কাছে সবকিছুই বলতে। এভাবে বার বার তার দলের লোক নও বলে আপত্তি করতে না। তোমাদের মুখের চেহারা, কথাবার্তার ধরন দেখেই বুঝতে পারলাম, তোমাদের আ লিম ধরে এনেছে। তার দলে অনেক ছোটো ছোটো ছেলে আছে তা জানতাম, আর এও জানতাম যে এইসব ছেলেদের বেশি দিন দলে রাখে না। কিছু কাজ করে নিয়ে শেষ করে দেয়। তোমাদেরও তা-ই দিত।

আমাদেরও দিত?

হ্যাঁ দিত, কারণ সব গুপ্ত আস্তানার সন্ধান জানে এমন ছেলে বেঁচে থাক এটা সে চায় না। কোথায় কোথায় সে নিষিদ্ধ জিনিস চালান দেয়, এসব জানে এমন লোক থাকুক, এটাও তার অভিপ্রায় নয়!

আ লিমকে ধরেছেন আপনারা?

না, ম্যালকম আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল, এখনও তাকে ধরা সম্ভব হয়নি। তার জুয়ার আড্ডায় একবার আমরা হানা দিয়েছিলাম, কিন্তু কাউকে ধরতে পারিনি। সকলে পলকের মধ্যে যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে সেখানেও বোধহয় কোনও হাতলের কারসাজি ছিল।

দিপু আর তপু একসঙ্গে ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ, আপনাদের হামলার সময় আমরাও সেখানে ছিলাম। সেখানেও এক সুড়ঙ্গপথ আছে নদী পর্যন্ত।

ম্যালকম এবারে খুব মৃদুকণ্ঠে বলল, সেই গুপ্ত আস্তানার সন্ধান সেবারেও একটি ছেলে দিয়েছিল। আ লিমের দলের ছেলে। জাতে বর্মি। বেচারি।

কেন, বেচারি কেন? তপু প্রশ্ন করল।

তাকে আমি তোমাদের মতনই নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলাম। বিশেষ করে বলে দিয়েছিলাম, যেন বাড়ির বাইরে না যায়। কিছুদিন ছেলেটি আমার কথা শুনেছিল। বাড়ির মধ্যেই ছিল! কিন্তু ক্রমে ক্রমে তার সাহস বাড়ল। প্রথমে বাগানে ঘুরে বেড়াত, একদিন বাড়ির বাইরে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি।

ফিরে আসেনি?

না, জীবন্ত আর ফিরে আসেনি। দিন তিনেক পরে আমার নামে একটা পার্সেল এসেছিল। আমার এক বোন থাকে ইয়েমেদিনে, তার কাছ থেকে। খুলেই চমকে উঠেছিলাম।

কী ছিল তাতে? দিপু জিজ্ঞাসা করল।

সেই ছেলেটির মাথা!

দিপু আর তপুর কণ্ঠ থেকে ভয়ার্ত স্বর বের হল।

সঙ্গে একটা চিঠিও ছিল। তাতে লেখা, আ লিম বিশ্বাসঘাতককে ক্ষমা করে না।

চেয়ার ছেড়ে দিপু আর তপু ম্যালকমের দু-পাশে এসে দাঁড়াল।

তপু বলল, তাহলে কী হবে? আমরা কী করে বাঁচব?

ম্যালকম দুটো হাত প্রসারিত করে দুজনের পিঠে রাখল। বলল, ভয় নেই, তোমরা যদি এ বাড়ির বাইরে না যাও তাহলে কোনও ক্ষতি কেউ তোমাদের করতে পারবে না। আমি বাড়ির চারপাশে সাদা পোশাকে পাহারাও রেখেছি, তারা তোমাদের ওপর দৃষ্টি রাখবে।

আমরা আমাদের ঘর থেকেই বের হব না। দিপু কাঁপা গলায় বলল।

ম্যালকম বলল, উপস্থিত কালই তো আমাদের সঙ্গে বের হতে হবে। সেই গুপ্ত আস্তানা আমরা চিনি, কিন্তু সুড়ঙ্গপথটা আমাদের দেখিয়ে দিতে হবে।

দিপু আর তপুর বিবর্ণ মুখের দিকে চেয়ে ম্যালকম আবার বলল, কোনও ভয় নেই, আমাদের সঙ্গে বন্দুক-পিস্তল নিয়ে কিছু পুলিশ থাকবে।

একটা কালো মোটর। ভিতরে ম্যালকম, দিপু আর তপু। সঙ্গে গোটা ছয়েক পুলিশ। বন্দুক আর পিস্তল উঁচিয়ে।

খুব সাবধানে চারদিকে দৃষ্টি রেখে মোটর এগিয়ে চলল।

পথে কোনও লোক কৌতূহলবশত দাঁড়ালেই পুলিশ চিৎকার করে তাদের হটিয়ে দিল।

অনেকটা যাবার পর ম্যালকম ড্রাইভারকে কী বলল।

পাশে নদী! এদিকে ঝাঁকড়া গাছের সার।

ম্যালকম বলল, ঠিক আছে, এটাই সেই আস্তানা, যেখানে একবার আমরা এসেছিলাম। এই তো আগাছার ঝোপ আর ইটের পাঁজা।

দিপু আর তপুর দিকে ফিরে ম্যালকম বলল, এবার আস্তে আস্তে নেমে এসো তোমরা।

দিপু আর তপু নামতে যাবার মুখেই বিপর্যয়।

দারুণ একটা শব্দে আশপাশের মাটি থরথর করে কেঁপে উঠল। ধুলার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।

ম্যালকম আচমকা দিপু আর তপুর হাত ধরে শুইয়ে না দিলে মারাত্মক কাণ্ড হত। মোটরের জানলার কাচগুলো ভেঙে চারদিকে ছিটকে পড়ল। সেই কাচের একটা খণ্ড শরীরে লাগলে খুবই বিপদ হত।

ম্যালকম নিজেও সটান শুয়ে পড়েছিল।

অনেকক্ষণ পরে ম্যালকম উঠে বসল। এদিক-ওদিক দেখে সবাইকে বলল, উঠে পড়ো।

পুলিশরাও এদিক-ওদিক টান হয়ে শুয়ে পড়েছিল। এবার তারাও উঠে দাঁড়াল।

বেশ একটু দূরে কিছু লোকের জটলা। আওয়াজ শুনে এসে জড়ো হয়েছে, কিন্তু সাহস করে সামনে আসতে পারছে না।

দিপু বলল, কীসের শব্দ বলুন তো?

ম্যালকম লাফিয়ে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে বলল, বোমার। কেউ আমাদের লক্ষ করে বোমা ছুড়ছিল। ক্ষতি করতে পারেনি, কারণ বোমাটা আগেই ফেটে দিয়েছে।

অনেকক্ষণ সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

ইটের পাঁজার ফাঁক থেকে তখনও অল্প অল্প ধোঁয়া বের হচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর ধোঁয়া কমে যেতে ম্যালকম পুলিশদের দিকে ফিরে হুকুম দিল, এগিয়ে চলো, কিন্তু খুব সাবধানে।

প্রথমে পুলিশের দল, তারপর ম্যালকম, সব শেষে দিপু আর তপু পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল।

ইটের পাঁজার পাশ দিয়ে একটু নেমেই থেমে পড়ল।

অল্প অল্প ধোঁয়া তখনও বের হচ্ছে। মেঝের অনেকটা জুড়ে কালো দাগ। নীচ দিয়ে নদীর ধারে যাবার গুপ্ত পথ খোলা রয়েছে।

ঠিক কালো দাগের পাশে বীভৎস একটা মূর্তি। মুখের কিছু অংশ উড়ে গেছে। রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে স্থানে স্থানে।

তবু চেনা গেল। আ লিম।

ম্যালকম কিছুক্ষণ নিচু হয়ে মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করল, তারপর বলল, আ লিম বোমাটা ছুড়তে গিয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, অবশ্য আমাদের সৌভাগ্যবশত, বোমাটা ইটে ধাক্কা লেগে আবার ফিরে এসে তার গায়ের ওপরই পড়েছে। বোমাটা কী ভয়ংকর বুঝতেই পারছ। যার শব্দতরঙ্গে মোটরের কাচ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, সে বোমাটা সরাসরি পড়লে আমাদের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যেত না।

ম্যালকম কথা শেষ করে পুলিশদের দিকে চোখ ফেরাল। বলল, অপরাধের ফল মৃত্যু। এতদিন ধরে এ লাইনে কাজ করে এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ হয়েছি।

সকলে আস্তে আস্তে নেমে মাঝখানে এসে দাঁড়াল।

এইখানে জুয়ার আসর বসত। পুলিশ সেবার হামলা দেবার পর থেকে বোধহয় আসর আর বসেনি।

দিপু বলল, গুপ্ত সড়ক তো দেখতেই পাচ্ছেন?

ম্যালকম ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। আ লিম রাস্তা পরিষ্কার করেই রেখেছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের খতম করে নদীপথে সে সরে পড়বে। নদীর ধারে নিশ্চয় যাবার ব্যবস্থাও সে করে রেখেছিল। চলো, নামি।

সকলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াল।

নদীর বুকে গোটা তিনেক জাহাজ। একেবারে মাঝখানে। অনেকগুলো সাম্পান এখানে-ওখানে ভাসছে।

অনেক দূরে ছোটো একটা কালো বিন্দু।

ম্যালকম পকেট থেকে দূরবিন বের করে চোখে লাগিয়ে দেখল, তারপর বলল, ওই একটা মোটর লঞ্চ ছুটে দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে। বোধহয় এই মোটর লঞ্চটাই এখানে অপেক্ষা করছিল। গোলমাল দেখে সরে পড়েছে।

সবাই ওপরে উঠে এল।

ম্যালকম একজন পুলিশকে ডেকে বলল, তুমি হেড কোয়ার্টারে চলে যাও। একটা ফোটোগ্রাফার নিয়ে এসে আ লিমের ফোটো তোলার ব্যবস্থা করো। আর একজন বারুদ বিশারদকেও নিয়ে আসবে। বোমার টুকরোগুলো তুলে নিয়ে রিপোর্ট দেবে।

হঠাৎ তপুর মনে পড়ে গেল।

একবার ওপরে চলুন, এর পাশেই আমাদের আটকে রেখেছিল।

দিপু বলল, একটা চিতাবাঘও আছে ওখানে। ওদের কথা না শুনলে বলেছিল, আমাদের চিতাবাঘের মুখে ফেলে দেবে।

তা-ই নাকি? ম্যালকম বলল, চলো তো দেখে আসি।

পুলিশরা রাস্তায় সার দিয়ে দাঁড়াল।

ভিতরে ঢুকল ম্যালকম, দিপু আর তপু।

ম্যালকম হাতের পিস্তলটা উঁচু করে ধরে রইল।

দরজায় বিরাট একটা তালা।

একবার টেনে দেখে ম্যালকম বেরিয়ে এসে একটা পুলিশকে ডাকল।

পুলিশ কাছে আসতে তাকে নিচু গলায় কী বলতেই সে ছুটে মোটরের ভিতর থেকে চাবির গোছা নিয়ে এল।

ম্যালকম একটা-দুটো করে কয়েকটা চাবি তালার মধ্যে ঘোরাতে ঘোরাতে শব্দ করে তালাটা খুলে গেল।

আনন্দে দিপু চিৎকার করে উঠল, খুলেছে, খুলেছে।

দরজাটা ঠেলে দিপু ভিতরে ঢুকল।

সঙ্গে সঙ্গে একটা গর্জন। দিপুর মনে হল পীত রঙের একটা বিদ্যুৎ এককোণ থেকে ছুটে এল।

সেই মুহূর্তেই প্রচণ্ড এক ধাক্কায় দিপু হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

গুড়ুম।

ম্যালকমের পিস্তল অগ্নিবর্ষণ করল। অব্যর্থ লক্ষ্য।

দিপু যখন চোখ মেলল, দেখল মাথার কাছে ম্যালকম আর তপু বসে।

ম্যালকম জিজ্ঞাসা করল, কী শরীর ঠিক হয়েছে?

ঘাড় নেড়ে দিপু উঠে বসতেই তার চোখে পড়ে গেল, কোণের দিকে চারটে পা প্রসারিত করে চিতাবাঘটা পড়ে রয়েছে। মৃত।

ম্যালকম বলল, বোঝা গেল, এটা শুধু আ লিমের বন্দিশালা। নতুন নতুন যাদের ধরে আনত, তাদের এই ঘরে আটকে রাখত। চিতাবাঘের ভয় দেখাত। চলো, এবার বাইরে যাই।

তিনজনে বাইরে এসে দাঁড়াল।

ম্যালকমের ইঙ্গিতে দুজন পুলিশ বাঁশে বেঁধে চিতাবাঘের দেহটাও তুলে নিল।

ফেরবার সময় পুলিশের কালো মোটর নয়, ছোটো একটা সবুজ মোটরে তিনজন ফিরল।

গাড়িতে উঠে ম্যালকম বলল, মোটর বদলালাম। কারণ আমার মনে হচ্ছে আ লিমের অনুচরেরা সহজে ছাড়বে না। কালো মোটরের ওপর নজর রাখবে।

কেন, নজর রাখবে কেন?

তপু প্রশ্ন করল।

রাখবে, তার প্রথম কারণ, প্রতিশোধস্পৃহা। আমাকে খতম করার চেষ্টা করবেই। দ্বিতীয় কারণ, আ লিমের মৃতদেহ।

আ লিমের মৃতদেহ? কেন?

দিপু আশ্চর্য হল।

আমার মনে হচ্ছে, কিছু কাগজপত্র বা অন্য কিছু তার কাছে আছে, সে তো দলপতি।

তপু জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু আপনি তো আ লিমের দেহ সার্চ করেছেন?

ম্যালকম গম্ভীরকণ্ঠে বলল, তা করেছি। কিন্তু কিছুই পাইনি।

তবে?

তপুর এ প্রশ্নের ম্যালকম কোনও উত্তর দিল না। বাইরের দিকে চোখ মেলে চুপ করে বসে রইল।

যথাসময়ে মোটর থানার সামনে এসে দাঁড়াল।

দিপু আর তপু ম্যালকমের বাড়ির মধ্যে চলে গেল। ম্যালকম থানায় ঢুকল।

ম্যালকম যখন ফিরল, তখন বেশ রাত।

দিপু আর তপু খাওয়া শেষ করে বারান্দায় বসে ছিল, ম্যালকম ওপরে এল।

কী, তোমরা এখনও শুয়ে পড়োনি?

আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।

হুঁ।

গম্ভীর মুখে ম্যালকম একটা চেয়ারে বসে পড়ল।

কিছুক্ষণ পরে ম্যালকম বলল, আমি যা ভেবেছিলাম, ঠিক তা-ই হয়েছে।

দিপু আর তপু একসঙ্গেই জিজ্ঞাসা করল, কী, কী হয়েছে?

কালো ভ্যানের ওপর আবার আক্রমণ হয়েছে।

আক্রমণ?

হ্যাঁ, ভিড়ের মধ্যে থেকে কে আবার ড্রাইভারকে লক্ষ করে বোমা ছুড়েছিল, কিন্তু এমন একটা ব্যাপার হতে পারে এ বিষয়ে আমি আগেই সজাগ করে দিয়েছিলাম, তাই বিশেষ কোনও ক্ষতি হয়নি। আ লিমের মৃতদেহ নিয়ে মোটর ঠিকই হাসপাতালে পৌঁছাতে পেরেছিল। তা ছাড়া, আমার কাজও হয়েছে।

কী কাজ?

আ লিমের দেহ থেকে দরকারি কাগজ উদ্ধার করতে পেরেছি। হাঁটুর মাংস চিরে পকেটের মতন তৈরি করে একটা কাগজ লুকানো ছিল। ডাক্তারের সহায়তায় মাংস কেটে সে কাগজ সংগ্রহ করেছি।

নিজের শরীরের মধ্যে পকেট তৈরি করে?

হ্যাঁ, ম্যালকম হাসল, এটা অপরাধীদের একটা সাধারণ পন্থা। কয়েদিরা জেল থেকে এইভাবে পয়সাকড়ি বের করে নিয়ে আসে, যারা নিষিদ্ধ জিনিস চালান দেয়, তারা পুলিশের চোখ এড়াবার জন্য শরীরের বিভিন্ন অংশে এইভাবে লুকানোর জায়গা তৈরি করে দেয়।

দিপু আর তপু সব শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল।

একটু পরে দিপু জিজ্ঞাসা করল, যে কাগজটা পেয়েছেন, সেটা নিশ্চয় খুব দরকারি।

ম্যালকম হাসল—হ্যাঁ, দরকারি বইকী। খুব ছোটো একটা ফিলম। খালি চোখে পড়াই যায় না। জোরালো লেন্সের সাহায্যে প্রোজেক্টরের ওপর চড়িয়ে সামনের এক সাদা পরদায় প্রতিফলিত করালাম। ঠিক যেভাবে সিনেমার ছবি দেখায়। লেখাগুলো বহুগুণ বর্ধিত হল। সব ঠিকানা। সারা ব্রহ্মদেশে যেখানে যেখানে আ লিমদের আস্তানা আছে, তার ঠিকানা। বুঝতেই পারছ এটা আমাদের পক্ষে কত দরকারি। ইতিমধ্যে গোপন টেলিগ্রাম চলে গেছে থানায়, থানায় আজ গভীর রাত্রে হানা দিয়ে ধরপাকড় শুরু হবে।

ম্যালকম উঠে দাঁড়াল।

ব্যাস, আর নয়। এবার উঠে পড়ো। রাত অনেক হয়েছে।

দিন তিনেক পর থানায় ডাক পড়ল দিপু আর তপুর।

ম্যালকম বসে ছিল। তার পাশে এক পুলিশ অফিসার।

অফিসারটি ওদের নাম, ধাম, অভিভাবকের নাম সব লিখে নিল।

সব হয়ে যেতে ম্যালকম বলল, তোমাদের সাহায্যের জন্যই আমাদের অভিমান অনেকাংশে সফল হয়েছে। আ লিমকে জীবন্ত ধরতে পারিনি বটে, কিন্তু তার অনেক শাগরেদ ধরা পড়েছে। অনেক নিষিদ্ধ জিনিস আমাদের হাতে এসে গেছে।

সরকার পুরস্কারস্বরূপ তোমাদের দুজনকে কিছু টাকা দেবেন। তা ছাড়া তোমাদের দেশে ফিরে যাবার সব খরচও সরকার বহন করবেন।

দেশে ফিরে যেতে পারব!

দিপু আর তপু দুজনের চোখে জল এসে গেল। মাথা নিচু করে তারা দাঁড়িয়ে রইল।

টাকাটা পরের দিনই হাতে এল।

কম নয়। এক-একজনের ভাগে দুশো। এত টাকা একসঙ্গে দিপু আর তপু কোনওদিন দেখেনি।

ম্যালকম কাছে এসে দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়াল।

শোনো, তোমাদের কয়েকটা কথা বলি। এভাবে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে তোমরা কতখানি অন্যায় করেছ, আশা করি এখন বুঝতে পারছ। ভাগ্য ভালো যে বেশি বিপদের মধ্যে পড়োনি। মারাত্মক কিছু হয়ে যেতে পারত। লেখাপড়া শিখে, বড়ো হয়ে দেশভ্রমণে বের হওয়া উচিত। এভাবে চুপি চুপি বাড়ি থেকে পালিয়ে, জাহাজ কোম্পানিকে ফাঁকি দিয়ে, বিদেশে এলে কী হয়, তার স্বাদ তোমরা ভালোভাবেই পেলে। এবার বাড়ি গিয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া করবে, পাপের পথ সর্বদা পরিহার করবে, কারণ পাপের ফল কী সেটা নিজেদের চোখেই দেখে গেলে।

কাল সকালেই তোমাদের জাহাজ ছাড়বে। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি, কোনও অসুবিধা হবে না। আমি থাকতে পারব না। আজ রাতেই একটা কাজে আমাকে শহরের বাইরে যেতে হবে। গুড বাই।

দিপু আর তপু ম্যালকমের প্রসারিত হাতটা একে একে আঁকড়ে ধরল।

তপু বলল, বিদেশের বন্ধু, বিদায়!

সত্যি কোনও অসুবিধা হল না।

একজন পুলিশ অফিসার সঙ্গে করে জাহাজে উঠিয়ে দিয়ে গেল। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথাবার্তা বলল। বোধহয় দিপু আর তপুর সম্বন্ধে।

এ জাহাজের নাম এস. এস. অ্যাঙ্গোরা।

আবার তিন দিন নীল সমুদ্রের ওপর ভেসে-যাওয়া জীবন।

দুজনে ডেক থেকে ডেকে ঘুরে বেড়াল। ক্যাপ্টেন এসে তাদের পিঠ চাপড়াল।

বলল, তোমরা বীর বালক। বিরাট একটা বদমাইশের দলকে ধরতে সরকারকে সাহায্য করেছ।

সারেংরা বিস্মিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল।

তিন দিন পর স্থলের রেখা দেখা গেল। বোঝা গেল মাটি-মায়ের কী দুর্বার আকর্ষণ। সবাই সার দিয়ে দাঁড়াল রেলিং ধরে।

ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হল গাছপালা, বাড়িঘর, কলকারখানা।

জল আর নীল নয়, ঘোলাটে। আশপাশে অনেক স্টিমার, জেলেডিঙি দেখা গেল।

নিজের দেশ, নিজের জন্মভূমি।

রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে দিপু আর তপু প্রণাম করল।

মাথা তুলেই দুজনে অবাক।

জেটি দেখা যাচ্ছে। জেটির বারান্দা ভরতি লোক। তার মধ্যে দিপুর বাবাকে দেখা গেল। তিনি আকুল দৃষ্টিতে জাহাজের দিকে দেখছেন।

দিপু আর তপু রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল। অস্ফুটকণ্ঠে দিপু বলল, বাবা! তপু বলল, জেঠু! তারপর চোখের জলে সামনের পৃথিবী অস্পষ্ট হয়ে গেল।

.

‘শুকতারা’ এপ্রিল ১৯৬৯ থেকে ধারাবাহিক