উপন্যাস
গল্প

ভয়ের মুখোশ – ৪

জলের বোতলও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। অবশ্য স্নানের ঘরের চৌবাচ্চায় তখনও জল রয়েছে। দরকার হলে সেই জলই পান করবে।

দুজনে এক চুমুকে বোতলের জল শেষ করে ফেলল।

টিন আর বোতলগুলো আছড়ে ফেলল মাটিতে। একেবারে তলায় কিছু সিরাপ, কিছু জেলি লেগে ছিল, আঙুল দিয়ে দিপু আর তপু যার নাগাল পাচ্ছিল না, কাচের টুকরোগুলো তুলে নিয়ে তা-ই চাটতে লাগল।

খেতে খেতে একটু পরে নোনতা স্বাদ লাগতেই দুজনে চমকে উঠল।

হাত দিয়ে দেখল, ঠোঁট কেটে দরদর ধারায় রক্ত পড়ছে।

জল দিয়ে দুজনে ঠোঁট ধুয়ে ফেলল। তারপর আবার ফিরে গিয়ে বসল বিছানায়।

কথা বলবার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। শরীর ভীষণ দুর্বল।

অনেকক্ষণ পরে তপু বলল।

দিপু, কে আগে শেষ হবে কিছু ঠিক নেই। যদি আমি আগে যাই, আর কোনওরকমে তুই মুক্তি পাস, তাহলে দেখিস আমার দেহটা যেন শেয়াল-কুকুরে না খায়; একটা সদগতি হয়।

কান্নায় গলার স্বর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তপু আর কথা বলতে পারল না।

দিপুর চোখেও জল। দুটো ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে।

সারারাত দুজনে এপাশ-ওপাশ করল। চোখে একফোঁটা ঘুম এল না।

পরের দিন দিপু উঠে দাঁড়াল, কিন্তু তপু পারল না। সে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে রইল।

দিপু বলল, কী মনে হচ্ছে জানিস তপু।

তপু কোনও উত্তর দিল না। শুধু দুটো ভ্রূ তুলল।

যদি সুড়ঙ্গের মধ্যে না থেকে, ওপরে কোনও জঙ্গলের ধারে এই অবস্থা হত, তাহলে গাছের একটা পাতাও আস্ত থাকত না। সব খেয়ে শেষ করতাম।

আবার দিপু খোঁজা শুরু করল।

শুধু আলমারির ভিতরটা নয়, সারা মেঝে। যদি অন্যদিনের খাবারের একটু অংশও মেঝের ওপর পড়ে থাকে। কিন্তু না, কোথাও কিছু নেই।

নিজের জন্য দিপু অতটা ভাবছে না। ভাবছে তপুর জন্য। বয়সের অল্প ব্যবধান, ভাই হলেও দুজনে বন্ধুর মতন। ছেলেবেলা থেকে একভাবে একসঙ্গে মানুষ হয়েছে।

যদি দুজনে একসঙ্গে শেষ হয়ে যায়, তাহলে ক্ষোভের কিছু নেই। একজনের চরম দুর্দশা আর-একজনকে চোখে দেখতে হবে না।

কিন্তু তা কি হবে? ঈশ্বর কি এত করুণাময় হবেন?

অন্তত দিপু আর তপুর প্রতি ঈশ্বরের করুণা যে কম, সে পরিচয় তারা পেয়েছে এর আগে। কোনওদিনই তিনি এদের প্রতি সদয় নন। সদয় হলে তাদের এমন অবস্থা হবে কেন?

আচ্ছন্নের মতন দুজনে শুয়ে রইল।

মাঝরাতে হঠাৎ দুম দুম শব্দে দিপুর ঘুম ভেঙে গেল। বিছানার ওপর উঠে বসেই সে চমকে উঠল।

তপু উঠে পাগলের মতন কাঠের দেওয়ালে ঘুসি মারছে।

তার চুল উসকোখুসকো, দুটো চোখ লাল।

জড়ানো গলায় কেবল বলছে, খোল, খোল, খোল।

দিপু বুঝতে পারল তপু প্রকৃতিস্থ নয়। অনাহারে তার মাথার গোলমাল হয়েছে।

দিপু লাফিয়ে গিয়ে তপুকে জড়িয়ে ধরল।

এই তপু তপু, কী করছিস।

তপু কোনও উত্তর দিল না। দিপুর দিকে ফিরেও দেখল না।

দেয়ালে অনবরত ঘুসি মারতে লাগল।

এত জোরে তপু ঘুসি মারছে, একটু পরেই তার হাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে।

দিপু তপুকে টেনে সরিয়ে আনার চেষ্টা করল দেয়ালের কাছ থেকে। পারল না। তপুর গায়ে যেন অসীম শক্তি।

দিপু প্রাণপণ চেষ্টায় তাকে সরিয়ে আনার জন্য টানল।

দুজনেই জড়াজড়ি করে সিঁড়ির ওপর গড়িয়ে পড়ল।

পাছে গড়িয়ে আরও নীচে পড়ে যায়, সেই ভয়ে দিপু জোরে সিঁড়ির একটা ইট আঁকড়ে ধরল।

আশ্চর্য কাণ্ড, সঙ্গে সঙ্গে ইটটা খসে পড়ল। ফাঁকের মধ্যে চকচকে হাতল।

কিছু না ভেবেই দিপু হাতলটা ধরে টানল।

ঘড়ঘড় শব্দে কাঠের দেয়াল ফাঁক হয়ে গেল।

দু-তিন মিনিট তপু আর দিপু কোনও কথা বলতে পারল না। নির্বাক বিস্ময়ে সেই ফাঁকের দিকে চেয়ে রইল।

তপু ছুটে এপারে আসছিল, দিপু বাধা দিল।

দাঁড়া তপু, এখন যাসনি। আমি আগে উঁকি দিয়ে চারদিক দেখে আসি।

তপু বস্তায় হেলান দিয়ে বসল।

দিপু সাবধানে পা ফেলে দেয়ালের কাছে এল।

মুখ বাড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখল।

আশ্চর্য কাণ্ড, সমস্ত জার অদৃশ্য। সাপের চিহ্নমাত্রও নেই।

তার মানে, দিপু আর তপু যখন সুড়ঙ্গপুরীতে ছিল, তখন নিশ্চয় কেউ এসেছিল এখানে।

দিপু পাশের ঘরে গেল।

আরও তাজ্জব ব্যাপার, মৃতদেহ নেই। সব পরিষ্কার।

দিপু আবার ফিরে গিয়ে ফাঁকের কাছে দাঁড়াল, ভিতরদিকে চেয়ে ডাকল, এই তপু, বাইরে চলে আয়।

কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত তপুর চলার শক্তি ছিল না। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর, কিন্তু মুক্তির আনন্দে তপু সব যন্ত্রণা ভুলল। লাফিয়ে এপারে চলে এল। চলে এসেই দাঁড়িয়ে পড়ল।

কী হল?

দিপু জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা ফাঁকটা বন্ধ হচ্ছে না কেন? আমরা যখন ভিতরে ঢুকেছিলাম, তখন তো সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

তপুর এই প্রশ্নের উত্তরে দিপু ভ্রূ কোঁচকাল।

যাক গে, যা ইচ্ছা হোক। চল, আমরা এখান থেকে পালাবার ব্যবস্থা করি।

তপু বলল, এখন নয়। আর-একটু অন্ধকার হোক। কিছু বলা যায় না, কেউ হয়তো এ বাড়ির ওপর নজর রাখছে।

দিপু আর তপু এদিকের ঘরে এসে দাঁড়াল।

যেখানে মৃতদেহ পড়ে ছিল, সেখানে ঝুঁকে পড়ে দেখল। মেঝেটা যেন চকচক করছে। তেল পড়লে যেমন হয়।

এদিকে একটা ছোটো ঘর। সেখানে ঢুকেই দুজনে লাফিয়ে উঠল।

র‌্যাকের ওপর সারি সারি ডিম। খোঁজ করলে আরও কিছু হয়তো পাওয়া যেতে পারে।

দেয়াল আলমারিটা খুলে দুজনে দেখল। কোথাও কিছু নেই।

র‌্যাকে দেশলাই পাওয়া গেল।

এ ঘর থেকে দিপু পুরোনো কাগজ জোগাড় করল। খালি টিন।

এক-একজন গোটা চারেক করে ডিমসেদ্ধ খেয়ে একটু ধাতস্থ হল।

তারপর একেবারে কোণের ঘরে এসে দুজনে বসল।

তপু বলল, একদিন আমরা যে অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ পেয়েছিলাম, সেইদিনই বোধহয়, কেউ এসে সাপসুদ্ধ জার আর মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে।

কারা সরাবে? পুলিশের লোক?

পুলিশের লোক না-ও হতে পারে। হয়তো যে লোকটা মারা গেছে, তাদের বিপক্ষ দলের কেউ। যাতে কেউ লাশ পরীক্ষা না করতে পারে, সেইজন্য।

তপু গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছে দেখে দিপু জিজ্ঞাসা করল, কী রে, কী ভাবছিস?

আমি ভাবছি ফাটলটা বন্ধ হচ্ছে না কেন? কলকবজা কি গোলমাল হয়ে গেল!

থাক খোলা, আমাদের কী।

উঁহু, তপু মাথা নাড়ল, পরীক্ষা করে একবার দেখতে হচ্ছে।

সে কী রে, তুই আবার ওর মধ্যে ঢুকবি নাকি?

আবার! মাথা খারাপ?

তপু উঠে এদিক-ওদিক ঘুরে একটা মোটা কাঠের টুকরো নিয়ে এল। সেটা নিয়ে সজোরে সিঁড়ির ধাপের ওপর আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ঘড় করে শব্দ। দেয়ালের ফাঁকটা বন্ধ হয়ে গেল।

তপু ঠিক সময়ে সরে এসেছিল।

সে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বলল, আমি ঠিক তা-ই ভেবেছি।

কী ভেবেছিস?

এদিক থেকে ছিটকে যখন আমরা ওদিকে গিয়ে পড়েছিলাম, তখন সিঁড়ির ওই ধাপের ওপর পড়ার জন্য দেয়ালটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ধাপের ওপর ভার পড়লে ফাঁকটা বন্ধ হয়ে যায়, এইরকম কিছু কলকবজার ব্যাপার আছে।

ইতিমধ্যে বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে।

দিপু বলল, চল, এবার আমরা বেরিয়ে পড়ি।

তপু উঠে পড়ল।

দাঁড়া, বাকি ডিম ক-টা সঙ্গে নিই। কখন কী অবস্থায় থাকি কিছু বলা যায় না। সঙ্গে রসদ থাকা দরকার।

একটা কাগজের মধ্যে ডিমগুলো নিয়ে তপু দিপুর পাশে এসে দাঁড়াল।

কিছু বলা যায় না, আবার নতুন কোন বিপদের মধ্যে গিয়ে পড়বে দুজনে। এ দেশের মাটিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে একটার পর একটা বিপদ চলেছে। প্রাণে যে বেঁচে আছে, এই যথেষ্ট।

এগোতে গিয়েই দুজনে দাঁড়িয়ে পড়ল। দরজা বন্ধ।

মনে পড়ে গেল, এ ঘরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

দিপু বলল, এখন উপায়! কী করে বাইরে যাব!

এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে তপু বলল, নিশ্চয় কোথাও কোনও কলকবজা আছে। সেটাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।

কী করে করবি?

মনে করে দেখ, প্রথমে এ ঘরে ঢুকে কে কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।

একটু পরেই তপুর নিজেরই মনে পড়ে গেল।

আমি হোঁচট খেয়েছিলাম, টাল সামলাতে দেয়ালের এই মাদুরটা আঁকড়ে ধরি, এই না?

দিপু ঘাড় নাড়ল।

তপু দেয়ালের মাদুরটা সরাল। ছোটো একটা হাতল নীচের দিকে নামানো।

সে হাতলটা ওপরদিকে ঠেলে দিতেই কাজ হল। কাঁপতে কাঁপতে দরজাটা খুলে গেল।

দুজনে আর একতিল বিলম্ব না করে ছুটে বেরিয়ে এল।

মাঠের মধ্যে এসে এদিক-ওদিক চোখ ফিরিয়ে দেখল। ধারেকাছে কাউকে দেখা গেল না।

তপু বলল, এরপর কোথায় যাব?

দিপু বলল, আমাদের নদীর ওপারে যেতে হবে। শহরে। তারপর ভাগ্যে যা আছে, হবে।

চল।

মেঠোপথ ধরে দুজনে এগোল।

কয়েক পা গিয়েই তপু দাঁড়াল। দিপুর দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, ওই যে ঝোপ দেখছিস?

দিপু ঘাড় নাড়ল।

সুড়ঙ্গপুরীর বাতাস বেরোবার নলটা ওর মধ্যে আছে, তাই চট করে কারো নজরে পড়ে না।

একটু দাঁড়িয়ে থেকে আবার দুজনে হাঁটতে আরম্ভ করল।

নদীর ধারে যখন এসে পৌঁছাল, বেশ রাত হয়েছে। কাছাকাছি একটাও সাম্পান নেই।

ঘাটের ওপর তপু আর দিপু বসল। চোখ রইল জলের দিকে। যদি কোনও সাম্পান চোখে পড়ে, ডাকবে।

আধ ঘণ্টার ওপর কিছু দেখতে পেল না।

একটা মোটর লঞ্চ তিরবেগে জল কেটে বেরিয়ে গেল।

তারপর ঢেউয়ের দোলার ওপর একটা সাম্পান দেখা গেল। সাম্পানটা এদিকেই আসছে।

দুজনেই মাথার ওপর হাত তুলে চেঁচাতে লাগল।

মাঝি দেখতে পেয়েছিল। সাম্পানটা ঘাট বরাবর এনে রাখল।

এখানে সব মাঝিই ভারতীয়। চট্টগ্রামের অধিবাসী, কাজেই কথা বলতে কোনও অসুবিধা হল না।

মাঝিকে দিপু বলল, আমরা ওপারে যাব।

সঙ্গে বড়ো কেউ নেই?

তপু ঘাড় নাড়ল, না।

ঠিক আছে, চলে এসো।

সাম্পান যখন নদীর মাঝামাঝি, তখন দিপু জিজ্ঞাসা করল, ওপারের নাম কী?

বইঠা চালাতে চালাতে মাঝি বলল, ডালা।

তারপরই কী খেয়াল হতে মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা এ দেশে নতুন বুঝি?

দিপু মাথা দোলাল, অর্থাৎ হাঁ।

মাঝি আবার প্রশ্ন করল, এখানে থাকো কোথায়?

দিপু একটু ঢোক গিলে বলল, জেটির কাছে এক হোটেলে আছি।

কোন জেটি?

দিপু আর তপু উত্তর দেবার আগে মাঝি নিজেই বলল, ব্রুকিং স্ট্রিট জেটির কাছে তো? বুঝেছি, রয়েল হোটেল।

দিপু আর তপু কথা বাড়াল না। বুঝতে পারল, কথা বাড়ালে বিপদে পড়বে।

সাম্পান এপারে ঘাটে এসে লাগল।

কাদায় একটা বাঁশ পুঁতে সাম্পান বেঁধে মাঝি বলল, দাও, ভাড়াটা মিটিয়ে দাও। অনেক রাত হয়েছে।

তপু আর দিপু নিজেদের পকেট থেকে পয়সা বের করল। আট আনা আর চার আনা। সবসুদ্ধ বারো আনা। এই পয়সা নিয়েই তারা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল।

বারো আনা পয়সা মাঝির হাতে দিতেই সে রেগে উঠল।

তার মানে? এত রাতে পার করালাম, তাও দুজনকে। ভাড়া মাত্র বারো আনা!

আমাদের কাছে আর একটি পয়সাও নেই, বিশ্বাস করো।

দরদস্তুর না করে সাম্পানে ওঠো কেন? আমি দু-টাকা ভাড়া চাই।

দিপু মাঝির কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

তুমি বরং আমাদের পকেটে হাত দিয়ে দেখো। যদি কিছু পাও, নিয়ে নিয়ো।

মাঝি দুজনের দিকে ভালো করে দেখল, তারপর বলল, ওই কাগজের ঠোঙায় কী?

তপু ভয়ে ভয়ে বলল, ডিম।

ক-টা?

গোটা আষ্টেক আছে।

দাও ওগুলো আমাকে।

কথার সঙ্গে সঙ্গে মাঝি খপ করে তপুর হাত থেকে কাগজের ঠোঙাটা কেড়ে নিল।

বাঁশ থেকে দড়ি খুলে নিয়ে চেঁচিয়ে বলল, যাও, যাও, নেমে পড়ো। আমি সাম্পান ছাড়ব।

অগত্যা দুজনে লাফিয়ে কাদার ওপর নেমে পড়ল। কাদা ভেঙে রাস্তার ওপর এসে উঠল। রাস্তা ফাঁকা। কোথাও কিছু নেই।

দিপু রাস্তার একপাশে বসে পড়ে বলল, এখন উপায়?

উপায় আর কী। শহরের দিকে হাঁটা যাক। কোনওরকমে যদি সেই জেটিতে গিয়ে পৌঁছাতে পারি, আর দেখি কোনও জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে, তাহলে ক্যাপ্টেনের হাতে-পায়ে ধরে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করব।

দিপু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, শহর তো অনেকটা পথ।

দুজনে হাঁটতে আরম্ভ করল।

মাঝে মাঝে দু-একটা কুকুরের চিৎকার শোনা গেল। গোটাকয়েক কুকুর তাদের তেড়েও এল। ঢিল ছুড়ে দুজনে তাদের তাড়াল।

পথে বার দুয়েক বিশ্রাম করে নিল।

কিছুক্ষণ পরে দিপুর খেয়াল হল, দেখ তপু, পিছনে একটা আলো দেখা যাচ্ছে।

তপু চেয়ে দেখল, আলোটা স্থির নয়, চলমান।

দুজনে একপাশে সরে এসে দাঁড়াল। যাতে আলোটা এগিয়ে তাদের পাশ কাটাতে পারে। কিন্তু আশ্চর্য, আলোটা এগোল না। সমান দূরত্ব রেখে একভাবে জ্বলতে লাগল।

কেউ আমাদের অনুসরণ করছে না তো?

তার আর আশ্চর্য কী।

বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দুজনে আবার চলতে আরম্ভ করল।

এক জায়গায় অনেকগুলো গাছের জটলা। ডাল বেয়ে কিছু লতাগাছ উঠে জায়গাটা ঝুপসি অন্ধকার করে রেখেছে।

কাছাকাছি এগিয়ে আসতেই দিপু আর তপুর কানে একটা গোঙানির শব্দ এল।

কোথায় যেন কে কাঁদছে?

দিপু বলল, রাত্রে শকুনের বাচ্চা ঠিক ওইরকমভাবে কাঁদে। তাড়াতাড়ি চল।

তাড়াতাড়ি যেতে গিয়েও কিন্তু পারল না। দাঁড়িয়ে পড়তে হল।

মানুষের গোঙানির শব্দ। যন্ত্রণায় কে যেন ছটফট করছে। খুব কাছে।

একবার দেখে এলে হয়। তপু বলল।

আবার কোনও বিপদের মধ্যে গিয়ে পড়ব। দিপু সাবধান করে দিল।

উঁকি দিয়ে দেখি ব্যাপারটা কী।

একটা কচুঝোপের ফাঁক দিয়ে দেখেই দুজনে চমকে উঠল।

আকাশে ম্লান জ্যোৎস্না। আবছা সবকিছু দেখা যাচ্ছে।

একটা লোক ঘাসের ওপর শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে চাপ চাপ রক্ত।

সে-ও বোধহয় দিপু আর তপুকে দেখতে পেয়েছিল। অনেক কষ্টে একটা হাত তুলে দুজনকে ডাকল।

একটু ইতস্তত করে দিপু আর তপু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।

মুখের নীচেটা মাফলার দিয়ে ঢাকা। দুটো চোখে যন্ত্রণার ছায়া।

হাত বাড়িয়ে দিপুর একটা হাত ধরল, আর-একটা হাত প্রসারিত করে দিল তপুর দিকে।

তপু তার একটা হাত আঁকড়ে ধরল।

দুজনের সাহায্যে লোকটা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল।

দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে একটু দূরে দেখিয়ে জড়ানো গলায় কী বলল।

যেদিকে লোকটা আঙুল নির্দেশ করল সেদিকে চোখ দুটো কুঁচকে দুজনে দেখল। কতকগুলো গাছের ফাঁকে একটা সাদা রঙের বাড়ি।

লোকটা ইঙ্গিত করে যা বলল, তাতে দিপু আর তপু এইটুকু বুঝতে পারল লোকটা ওই বাড়িতে যেতে চায়। আর সেজন্য তার দিপু আর তপুর সাহায্যের প্রয়োজন।

লোকটার যেমন অবস্থা, একলা হাঁটা তার পক্ষে অসম্ভব।

দিপু আর তপু লোকটার হাত নিজেদের কাঁধের ওপর রেখে আস্তে আস্তে পা ফেলে রাস্তা ছেড়ে মাঠের ওপর দিয়ে চলতে লাগল। জোরে চললে পাছে লোকটার ঝাঁকুনি লাগে সেজন্য যথাসম্ভব সতর্ক হল।

বাড়ির কাছ বরাবর এসে তপু একবার পিছন ফিরে দেখল।

ঠিক ঝোপটার পাশে আলোটা স্থির হয়ে রয়েছে।

দিপুকে কথাটা বলতে গিয়েই তপু থেমে গেল।

লোকটা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল।

তপুরই দোষ। সে ঘাড় ফিরিয়ে পিছনদিকে দেখতে গিয়ে লোকটার হাতে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল।

বাড়ির দরজা বন্ধ ছিল, কিন্তু দিপু হাত রাখতেই খুলে গেল।

খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওরা তিনজনে ভিতরে ঢুকল না।

দরজা সম্বন্ধে দিপু আর তপুর ভয় ছিল।

তাই দুজনে দরজাটা ভালো করে পরীক্ষা করে তবে বাড়ির মধ্যে পা রাখল। হঠাৎ আবার দরজাটা না বন্ধ হয়ে যায়।

সেরকম কিছু হল না। একটা বড়ো সোফার ওপর লোকটাকে সাবধানে শুইয়ে দিয়ে দুজনে বেরোতে গিয়েই বাধা পেল।

লোকটা হাততালি দিল।

ওরা ফিরতে হাতের ভঙ্গিতে জল চাইল। জল যে পাশের ঘরে পাওয়া যাবে তাও ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল।

পাশে ছোটো একটা ঘর। গ্লাস, প্লেট সাজানো। মাঝখানে টেবিল, চেয়ার। বোধহয় খাওয়ার ঘর।

তপু বলল, এ বাড়িটা বোধহয় লোকটারই হবে, কিন্তু কে ওভাবে মাথায় চোট মারল?

দিপু গ্লাসে জল ভরতে ভরতে বলল, বোধহয় ডাকাতরা আক্রমণ করে পয়সাকড়ি সব কেড়ে নিয়েছে। দয়া করে প্রাণে মারেনি।

লোকটাকে জল দিয়ে যদি কিছু খেতে চাই, নিশ্চয় না বলবে না।

দেখা যাক।

দুজনে আবার এদিকের ঘরে এল। দিপুর হাতে জলের গ্লাস। পিছনে তপু।

এ ঘরে ঢুকেই দুজনে ভয়ে চিৎকার করে উঠল।

দিপুর হাত থেকে ঝনঝন শব্দে গ্লাসটা মেঝের ওপর পড়ে চুরমার হয়ে গেল।

যে লোকটা কিছুক্ষণ আগে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তার ধারে পড়ে কাতরাচ্ছিল, সে যে এভাবে এর মধ্যে রিভলভার হাতে নিয়ে বসবে সেটা দিপু আর তপু ধারণাও করতে পারেনি।

কিন্তু আরও বিস্ময়ের কথা, এ লোকটার চেহারার সঙ্গে নদীর ওপারে পোড়োবাড়িতে চেয়ারের ওপর মৃত লোকটার চেহারার কোনও প্রভেদ নেই।

তাহলে সে লোকটা কি মৃতের ভান করেছিল?

তা-ই বা কী করে সম্ভব!

গায়ে হাত ঠেকতেই লোকটা যেভাবে মেঝের ওপর ছিটকে পড়েছিল, সেটা জীবিত লোকের পক্ষে কোনওরকমেই সম্ভব নয়।

দিপু আর তপু এগোবার চেষ্টা করতে গিয়েই থেমে গেল।

লোকটা ভাঙা-ভাঙা বাংলায় বলল, সাবধান, শয়তানের বাচ্চারা আর এক-পা এগোলেই খতম করে দেব। আমার রিভলভারে সাইলেন্সার লাগানো আছে। একটু শব্দ হবে না। শুধু সামান্য একটু ধোঁয়া, ব্যাস, কাজ শেষ।

দুজনে দরজার গোড়ায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

লোকটা দাঁতে দাঁত চেপে আবার বলতে লাগল, সত্যি কথা বল, আমার যমজ ভাইকে কে শেষ করেছে?

এবার দিপু আর তপু বুঝতে পারল। তাহলে যে লোকটা মারা গেছে, সে এর যমজ ভাই। তাই চেহারায় এমন মিল।

তপু কাঁপতে কাঁপতে বলল, কে শেষ করেছে, আমরা কী করে জানব?

সে আর কথা শেষ করতে পারল না। লোকটা মেঝের ওপর সজোরে বুট ঠুকল।

চোপরাও মিথ্যাবাদী কেউটের ছানা! তোরা আ লিমের চর সেটা আমার জানতে বাকি নেই। ঠিক কি না বল?

এবার দিপু মাথা নাড়ল—না, আমরা কারো চর নই। আমরা বিদেশে এসে বিপদে পড়েছি।

তাহলে পোড়োবাড়ির মধ্যে কী করতে ঢুকেছিলি?

আমরা একটা প্যাকেট নিয়ে গিয়েছিলাম।

কীসের প্যাকেট?

তা জানি না।

কে পাঠিয়েছিল?

দিপু আর তপু চুপ করে রইল।

লোকটা বিশ্রীভাবে চেঁচিয়ে উঠল।

চুপ করে থেকে বিশেষ লাভ হবে না। দুটো গুলিতে দুজনের খুলি ফাটিয়ে দেব। উত্তর দে।

তপু বলল, আ লিম পাঠিয়েছিল।

এবার লোকটা প্রচণ্ড বেগে হেসে উঠল। পৈশাচিক হাসি। সে হাসিতে মনে হল বাড়ির জানলা-দরজাগুলোও যেন ঝনঝন করে কেঁপে উঠল।

তবু তোরা বলতে চাস, তোরা আ লিমের চর নোস। আ লিম কেন প্যাকেট পাঠিয়েছিল জানিস?

একটু থেমে, উত্তরের অপেক্ষা না করে, লোকটাই বলতে আরম্ভ করল, প্যাকেট পাঠানো একটা ছল। তোদের এইজন্য পাঠিয়েছিল যে তোরা ফিরে এসে বলবি যে লোকটি মরে গেছে, তাই কাউকে প্যাকেটটা দিয়ে আসতে পারিসনি। লোকটা সত্যি মরেছে কি না, সেই খবরটা শুধু আ লিম তোদের মারফত জানতে চেয়েছিল। তার নিজের যাবার সাহস ছিল না, পাছে পুলিশের হাতে পড়ে, কিংবা আমাদের হাতে পড়ে।

লোকটা জামার হাতায় মুখটা মুছে নিয়ে বলল, ঠিক সময়ে খবর পেলে আ লিমের অবশ্য নিস্তারও ছিল না। আমি যে আবার একটু কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে খবর পেলাম, ভাইকে শেষ করে দিয়েছে। এ খবরও পেলাম দুটো পুঁচকে ছোঁড়া ভিতরে ঢুকেছে, কিন্তু বের হতে কেউ দেখেনি। এ কদিন তোরা কোথায় ছিলি?

কোথায় ছিল বলতে গিয়েই দিপু থেমে গেল। তারা যে এদের পালাবার গুপ্ত সুড়ঙ্গ দেখেছে সে কথা জানতে পারলে লোকটা হয়তো আরও খেপে যাবে।

হাতে তো রিভলভার রয়েইছে, আঙুলের একটু কারসাজি, ব্যাস, তাদের দুটো দেহ মেঝেয় লুটাবে।

তাই দিপু একটু ভেবে নিয়ে বলল, কী করব—চারদিকে সাপ। আমরা ভয়ে রান্নাঘরে ঢুকে বসে ছিলাম।

সাপ তো কাচের জারের মধ্যে।

বেরিয়ে আসতে কতক্ষণ, তপু বলল, যেভাবে জারের ওপর ছোবল দিচ্ছিল।

হুঁ, লোকটাও যেন কী ভাবল, তারপর বলল, আমি নদীর ওপারে কদিন পাহারা দিচ্ছি। প্রায় সারা দিনরাত। জানি, একদিন তোদের এপারে আসতেই হবে। আজ তোদের বাগে পেয়েছি।

দিপু বলল, কিন্তু বিশ্বাস করো, আমাদের কোনও দোষ নেই। এসব ব্যাপারের আমরা কিছু জানি না। আমরা জাহাজ থেকে নেমে আ লিমের কবলে পড়েছি।

আবার লোকটা হাসল, ছাদ-ফাটানো হাসি।

বলল, ওসব মায়াকান্নায় আমি ভুলি না। তোদের নিস্তার নেই। আ লিমের দলের কারো পরিত্রাণ নেই। নে, কে তোদের ইষ্টদেবতা তার নাম কর। দু-মিনিট সময় দিচ্ছি।

এবার দিপু আর তপু দুজনেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, আমাদের কথা বিশ্বাস করো। আমরা তোমাকে একটুও মিথ্যা বলিনি।

চোপ। একটা কথাও নয়।

চমকে উঠে দিপু আর তপু পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল।

ইষ্টদেবতার নাম তপু আর দিপুর জানা নেই।

দিপুর চোখের সামনে তার বাবা আর মা-র চেহারা ভেসে উঠল। তপুর মনে এল তার অসহায় মায়ের ছবি।

আর জীবনে কোনওদিন তাদের সঙ্গে দেখা হবে না। তারা জানতেও পারবে না, কীভাবে বিদেশে বেঘোরে দুটি কিশোর প্রাণ হারাল।

হয়তো কাজ শেষ করে এই নরাধম দুজনের দেহ মাটিতে পুঁতে ফেলবে, তারপর মাংসের গন্ধে কুকুর-শেয়ালের দল সেই দেহ বের করে নিয়ে নিজেদের ভোজে লাগাবে।

হয়েছে। এবার দাঁড়া সোজা হয়ে।

রুক্ষ কঠিন কণ্ঠস্বর।

দুজন দুজনকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। দুজনের চোখ জলে ভরতি। সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সব অস্পষ্ট।

আর দু-এক মিনিটের মধ্যে চোখের সামনে চিরদিনের মতন অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে।

দুম।

আচমকা একটা শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের একমাত্র বাতি নিভে গেল।

ভারী একটা জিনিস পড়ার আওয়াজ।

অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারল না। মনে হল দুটো লোক যেন ধস্তাধস্তি করছে। প্রাণপণ বিক্রমে। মরণপণ করে।

অন্ধকারে দিপু হাত বাড়িয়ে তপুর হাতটা আকর্ষণ করে।

পালিয়ে যাবার ইঙ্গিত।

দুজনে আস্তে আস্তে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।

সন্তর্পণে দরজাটা ঠেলে বাইরে চলে এল।

বাইরে খুব অন্ধকার নয়। তরল জ্যোৎস্নায় সবকিছু প্রায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

দুজনে ছুটতে লাগল ঊর্ধ্বশ্বাসে।

রাস্তার কাছ বরাবর এসে দুজনে দাঁড়িয়ে পড়ল।

তপু বলল, না, রাস্তার দিকে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমাদের কেউ না কেউ দেখে ফেলবে। তার চেয়ে আয় আমরা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ি।

একটু ইতস্তত করে দুজনে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।

বিরাট কতকগুলো গাছ। বোধহয় বট আর অশ্বত্থ। বড়ো বড়ো ঝুরি নেমেছে ডাল থেকে। তলায় অনেক আগাছা।

যদি সাপখোপের উপদ্রব না থাকে তাহলে লুকোবার পক্ষে আদর্শ জায়গা।

রাস্তা বেশি দূর নয়।

দুজনে গুঁড়ি দিয়ে একটা ঝোপের পাশে বসল।

দিনের আলো ফুটুক, তারপর রাস্তায় বের হবে।

বোধহয় এক ঘণ্টার বেশি।

দুজনে দেখল, বাড়ির দিক থেকে একটা আলো এগিয়ে আসছে।

ঠিক এইরকম আলো ওদের অনুসরণ করছিল।

দুজনে বুকে হেঁটে হেঁটে রাস্তার ধারের একটা গাছের আড়ালে বসল।

কাছে আসতে বুঝতে পারল একটা সাইকেল।

এতক্ষণ সাইকেলটা খুব জোরে আসছিল, রাস্তার কাছে আসতেই তার গতি কমে গেল।

রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আরোহী কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক দেখল, তারপর দ্রুতবেগে চলে গেল শহরের দিকে।

সাইকেল পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দিপু বলল, লোকটাকে দেখেছিস?

তপু ঘাড় নাড়ল—হুঁ, আ লিম।

তার মানে, এ লোকটাও হয়তো খুন হল।

খুন?

নিশ্চয়, লোকটাকে খুন না করে আ লিম বের হত না।

আ লিম আমাদের নিয়ে গেল না সঙ্গে করে?

এতক্ষণ বোধহয় বাড়িতে আমাদেরই খোঁজ করছিল। রাস্তায় এসেও এদিক-ওদিক দেখছিল আমাদের খোঁজে। তপু বলল।

আমাদের দেখতে না পেয়েছে ভালোই হয়েছে, আ লিমের ফাঁদে আর নিজেদের জড়াতে চাই না।

দিপু চোখ বন্ধ করে হাই তুলল।

ক্লান্তিতে দুজনের শরীর ভেঙে পড়ছে। চোখ খুলে রাখাই দুষ্কর। গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দুজনে চোখ বুজল।

ঘুম ভাঙল পাখির কলরবে। ভোর হয়েছে। রাস্তা দিয়ে দু-একজন লোক চলছে। সকলেরই মাথায় ঝুড়ি। ঝুড়ি ভরতি আনাজ-তরকারি।

গ্রাম থেকে তরিতরকারি নিয়ে বোধহয় শহরে যাচ্ছে। বিক্রির জন্য।

দুজনে উঠে রাস্তায় এল।

একজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, শহর এখান থেকে কতদূর?

লোকটা বর্মি, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর হাত-মুখ নেড়ে কী বলতে বলতে চলে গেল।

বোঝা গেল, এদের ভাষা লোকটা বুঝতে পারল না।

দুজনে হাঁটতে আরম্ভ করল। পেটের মধ্যে আবার মোচড় দিচ্ছে। কিছু একটু খেতে পেলে হত।

ভাগ্য ভালো। এবার যে লোকটা দুধের বালতি নিয়ে পাশ কাটিয়ে গেল, তাকে হিন্দুস্থানি বলেই মনে হল।

দিপু জিজ্ঞাসা করল, এখান থেকে শহর কতদূর?

কোন শহর?

তপু বলল, রেঙ্গুন।

নামটা সারেংদের মুখে জাহাজে সে শুনেছিল।

রেঙ্গুন? বিস্ময়ে লোকটা দুটো চোখ কপালে তুলল, তোমরা হেঁটে রেঙ্গুন যাবে নাকি? সে তো এখান থেকে অনেক দূর। এ জায়গার নাম কেমেনডাইন। তার চেয়ে এক কাজ করো, খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বাঁহাতি একটা রাস্তা পাবে, সেটা ধরে গেলে স্টেশনে পৌঁছে যাবে। সেখান থেকে বরং ট্রেনে চেপে যাও।

লোকটা আর দাঁড়াল না। তিরবেগে ছুটে চলে গেল।

দিপু বলল, ট্রেনে তো চাপব, কিন্তু ভাড়া? শেষকালে হাজতে পুরবে।

তপু কী ভাবল, তারপর বলল, স্টেশনের কাছে হয়তো খাবারের দোকান থাকবে। আমাদের কাছে যা পয়সা আছে তাতে দু-একটা পাঁউরুটি নিশ্চয় পাওয়া যাবে। কিন্তু একটু পেটে না পড়লে চোখে অন্ধকার দেখছি।

স্টেশন পর্যন্ত আর যেতে হল না। পথেই পাওয়া গেল।

একটা টিনের চালা। গোটাকয়েক বেঞ্চ আর টেবিল পাতা। গোটাকতক লোক মগে করে চা খাচ্ছে। পোশাক দেখে শ্রমিকশ্রেণির বলেই মনে হল।

কোণের দিকে একটা বেঞ্চে দিপু আর তপু বসে পড়ল। চায়ের অর্ডার দিতে গিয়েই মনে পড়ে গেল, তাদের কাছে একটি পয়সাও নেই। সব পয়সা সাম্পানের মাঝিকে দিয়েছে।

দিপু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এ রাস্তা দিয়ে দু-একটা লরি গেলে বড়ো ভালো হয়। থামিয়ে আমরা উঠে পড়ি।

তপু হেসে বলল, খিদিরপুরে যাওয়ার মতন?

দিপু ঘাড় নাড়ল—হুঁ।

কিন্তু এক ঘণ্টার ওপর অপেক্ষা করেও কোনও লরির সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না। একটা গোরুর গাড়ি এল, তরকারিতে ঠাসা বোঝাই। তিলধারণের স্থান নেই। সেটাতে ওঠা অসম্ভব।

বাধ্য হয়েই আবার হাঁটতে শুরু করল।

একটু পরেই ট্রেনের শব্দ পাওয়া গেল। মনে হয় এতক্ষণ বোধহয় থেমে ছিল, এইবার ছাড়ছে।

তার মানে, স্টেশন খুব দূরে নয়।

সত্যি তা-ই।