উপন্যাস
গল্প

ভয়ের মুখোশ – ৩

প্রথমে তপু চোখ মেলল। তারপর দিপু।

দুজনে বড়ো একটা খাটে শুয়ে ছিল।

এদিক-ওদিক চোখ ফেরাতেই চায়ের দোকানে দেখা লোকটা নজরে পড়ল। দেয়াল ঘেঁষে একটা চেয়ারে বসে ছিল।

এদের চোখ মেলতে দেখে সে খাটের পাশে এসে দাঁড়াল।

কী, শরীর কেমন লাগছে?

তপু চেঁচিয়ে উঠল, শরীরের খোঁজ নিচ্ছ? তুমিই তো নাকে ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করিয়ে দিয়েছিলে।

লোকটা হাসল। আকর্ণবিস্তৃত হাসি, কিন্তু নিঃশব্দ।

হাসি থামতে বলল, এমনি কি আর তোমরা আসতে? চেঁচামেচি শুরু করে লোক জড়ো করে ফেলতে। আমি পড়তাম মুশকিলে।

দরজায় খট করে একটা শব্দ হল।

দিপু আর তপুকে সচকিত করে সেই চীনেটা ঘরে ঢুকল।

তাকে দেখে বর্মি লোকটা বলল, এই যে আ লিমখুড়ো এসে গেছে। তোমাদের সঙ্গে খুড়োর তো চেনা আছেই।

আ লিম এগিয়ে এসে দিপু আর তপুর পিঠ চাপড়াল।

বাহাদুর ছেলে। কাল রাতে পুলিশের লোকটাকে খুব ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছ। তোমরা ধরা পড়লেই মুশকিলে পড়তাম। তোমাদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করত।

দিপু হঠাৎ বলল, পুলিশের লোকই বা তোমার আড্ডায় হামলা করল কেন?

খাটের এক প্রান্তে বসে পড়ে আ লিম মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, আর বলো কেন। ওদের কাণ্ডকারখানাই আলাদা। যত শান্তিপ্রিয় লোকদের পিছনে লাগাই ওদের স্বভাব।

দিপু আর তপু কিছু বলল না। ওটা জুয়ার আড্ডা সেটা যে ওদের অজানা নয় এ কথা জানতে পারলে আ লিম হয়তো খেপেই যাবে।

আ লিম বলল, যাক, তোমরা খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম করে নাও। বিকালে তোমাদের এক জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাব।

কথা শেষ করে আ লিম আর দাঁড়াল না। খাট থেকে নেমে বেরিয়ে গেল।

তখন দিপু বর্মিটাকে বলল, তুমি যে বলেছিলে আমাদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দেবে।

বর্মিকে মুখ মুচকে হাসল।

কী হবে দেশে ফিরে? এখানে থেকে যাও। এ বড়ো মজার দেশ। যাক আগে তোমাদের খাওয়ার বন্দোবস্ত করি।

খাওয়াদাওয়া ভালো। থাকার ব্যবস্থাও উত্তম।

তবে জানলা দিয়ে বাইরে চোখ ফিরিয়ে দেখতে পেল দুজন বর্মি ছোকরা পাহারা দিচ্ছে। দরজাও বাইরে থেকে বন্ধ।

আ লিম এল বিকাল হবার সঙ্গে সঙ্গে।

এই নাও, তোমাদের জন্য নতুন পোশাক এনেছি, পরে নাও। এবার আমরা বেড়াতে বের হব।

আ লিম খাটের ওপর দুটো নতুন শার্ট আর নতুন প্যান্ট ফেলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

দিপু বলল, এই জামা-প্যান্টটার আর পদার্থ নেই। নতুন পোশাক পরি, কী বল?

তপু ম্লান হাসল, খুড়ো যখন বলেছে, তখন পরতেই হবে। এখানে আমাদের মতামতের কোনও দাম নেই।

একটু পরে আবার আ লিম ঢুকল।

পরা হয়ে গেছে। বেশ বেশ, চলো, বের হই এবার।

তিনজনে বের হল।

কালো একটা মোটর সামনে। সমস্ত কাচগুলো কালো রং দেওয়া। বাইরে থেকে ভিতরের কিছু দেখার উপায় নেই।

এরা উঠতেই মোটর ছেড়ে দিল।

বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না, ভিতর থেকে কাচে চোখ রাখলে বাইরের সবকিছু দেখতে পাওয়া যায়।

দিপু আর তপু কাচে চোখ রেখে দেখতে লাগল।

একটু গিয়েই চোখে পড়ল সোনালি রং করা গম্বুজাকৃতি একটা মন্দির। সিঁড়ি বেয়ে অনেকে উঠেছে।

এটা কীসের মন্দির?

তপু জিজ্ঞাসা করল।

আ লিম দেখল না। গাড়ির মধ্যে চোখ রেখেই বলল, ওটা হচ্ছে সুলে প্যাগোডা। মানে, ছোটো ফয়া। বুদ্ধদেবের মূর্তি আছে এখানে।

প্যাগোডা পার হয়ে মোটর ছুটল। অনেকটা যাবার পর দু-পাশের দৃশ্য দেখে তপু আর দিপুর মনে হল, মোটর শহরের সীমানা পার হয়ে গ্রামে ঢুকছে। বাঁশের বেড়া দেওয়া ছোটো ছোটো কাঠের বাড়ি। বিরাট সাইজের কাঠের গুঁড়ি কোথাও স্তূপাকার করা।

একসময়ে মোটর থামল।

চারদিকে ফাঁকা মাঠ। ছোটো ছোটো ঝোপ। একটা বড়ো নালা। তার ওপর বাঁশের সাঁকো।

আ লিম বলল, আমার একটা উপকার করতে পারবে?

উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করল।

এই মাঠটা পার হয়ে একটা কাঠের একতলা বাড়ি দেখতে পাবে। তার মালিকের হাতে এই প্যাকেটটা দিয়ে আসতে হবে। বলবে, এ মাসের খোরাক। আমিই যেতাম কিন্তু সকাল থেকে কোমরে একটা ব্যথা হয়েছে, চলতে কষ্ট হচ্ছে।

দিপু বলল, কিন্তু আমাদের ভাষা ও লোকটা বুঝবে কেন?

বা, ঠিক কথা বলেছ, আ লিম খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠল, কথাটা আমার খেয়ালই হয়নি। কোনও কথা বলতে হবে না, তোমরা দুজনে বরং একসঙ্গে মাথায় একটা হাত রেখো। তাহলেই আমার বন্ধু বুঝতে পারবে।

দিপু আর তপু সাঁকো পার হয়ে এগিয়ে চলল।

অনেকটা যাবার পর পিছন ফিরে দেখল, আ লিম মোটরের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে।

এটার মধ্যে কী আছে বল তো তপু?

বোঝাই যাচ্ছে কোনও নিষিদ্ধ জিনিস। গাঁজা, আফিম কিংবা কোকেন। বুড়োর কোমরে ব্যথার কথা সব বাজে, বিপদটা আমাদের ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দিল। ধরা পড়ি তো আমরা পড়ব।

দিপু একবার এদিক-ওদিক দেখে বলল, চারদিক ফাঁকা। পালাবার চেষ্টা করলে হয়।

উঁহু, নিশ্চয় চারদিকে বুড়োর চর আছে। পালানো সম্ভব হবে না। ধরা পড়লে নির্যাতন শুরু হবে। একেবারে খতম করে দেওয়াও বিচিত্র নয়।

দুজনে দ্রুত পা ফেলে চলতে লাগল।

একটা খালের ধারে একতলা বাংলো। চারদিকে বাগান। ধারেকাছে যখন আর কোনও বাড়ি নেই, তখন এটাই হবে।

লোহার ফটক। বন্ধ।

কাছে গিয়েই দিপু আর তপুর খেয়াল হল, কী বলে ডাকবে? লোকটার নাম তো জানা নেই। এ বাড়িতে অনেকগুলো লোক যদি থাকে, তাহলে প্যাকেটটা কার হাতে দেবে?

দুজনে আলোচনা করতে করতে গেটের কাছে এসে দাঁড়াল।

হাত দিয়ে গেটটা তো নাড়ানো যাক। দেখি কে আসে।

গেটটা হাত দিয়ে ধাক্কা দেবার সঙ্গে সঙ্গে বিরাট শব্দ।

চমকে দুজনে পিছিয়ে এল।

গেটের ওপারে নেকড়ে বাঘের সাইজের এক কুকুর। লকলক করছে জিভ। দুটো থাবা গেটের ওপর দিয়ে বিকট গর্জন করে চলেছে।

কী ভাগ্যিস, গেটটা বন্ধ ছিল, না হলে বাঘের মতন ওই কুকুরটা এতক্ষণে দুজনের টুঁটি কামড়ে ধরত।

পালিয়ে যাবে কি না ভাববার মুখেই বারান্দায় একটি লোক এসে দাঁড়াল। মাথাজোড়া চকচকে টাক, ঝোলা গোঁফ, চোখ দুটো এত ছোটো যে আছে কি না বোঝাই দুষ্কর।

কে? কী চাই।

উত্তরে দিপু প্যাকেটটা তুলে ধরল। তপু একটা হাত রাখল নিজের মাথায়।

মনে হল প্যাকেটটা দেখে লোকটা যেন একটু প্রসন্ন হল।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কুকুরটাকে কী বলল। অমন বাঘের মতন তেজি কুকুর পলকে শান্ত হয়ে গেল।

গেটটা খুলতেই দিপু আর তপু কিন্তু বেশ কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু না, কুকুরটা এল না। ল্যাজ গুটিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেল।

লোকটা এগিয়ে এসে এদিক-ওদিক দেখল তারপর কোনও কথাবার্তা নয়, চিলের মতন ছোঁ মেরে প্যাকেটটা নিয়েই বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেট বন্ধ করে দিল।

দিপু আর তপু তো অবাক।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারা ফেরার পথ ধরল।

পথে তপু বলল, আমাদের দিয়ে কেন এসব করাচ্ছে বুঝতে পারছিস?

পারছি বই কী। পুলিশ যদি ধরে আমাদের ধরবে। তা ছাড়া আমরা এ দেশে নতুন, পথঘাট চিনি না, ওদের আস্তানাও জানি না। কাজেই পুলিশের কাছে কিছুই বলতে পারব না।

আমাদের তাহলে সাবধান হওয়া উচিত।

সাবধান আর কী করে হব? এদের কাজ করব না বললে হয়তো মেরেই ফেলবে।

তা সত্যি।

সাঁকো পার হয়ে দুজনে রাস্তায় এসেই অবাক।

রাস্তা ফাঁকা। মোটর কোথাও নেই। আ লিমও নয়।

চারদিকে একটু একটু করে অন্ধকার নামছে। কাছাকাছি বসতি নেই বলে, আলোও দেখা যাচ্ছে না। এধারে-ওধারে জোনাকির মেলা।

তা-ই তো মোটর কোথায় গেল?

তপুর কণ্ঠস্বরে বোঝা গেল সে ভয় পেয়েছে।

আমাদের ফেলে চলে গেল নাকি?

কিন্তু তাতে চীনের লাভ?

কী জানি, হয়তো পুলিশ ঘোরাফেরা করছিল, দেখে মোটর নিয়ে সরে পড়েছে।

উপায়?

চল, যেদিক থেকে এসেছি, সেইদিকে হাঁটতে আরম্ভ করি।

দুজনে তা-ই করল। বুঝতে পারল এতটা পথ হেঁটে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। ঠিক করল, রাস্তায় যদি কোনও বাড়ি পায়, সেখানে আশ্রয় চাইবে।

তাতেও অসুবিধা কম নয়। এ দেশের ভাষা জানে না। নিজেদের বিপদের কথা বোঝাবে কী করে?

কিছুটা গিয়েই দুজনে চমকে উঠল।

মোটরের হর্ন, অথচ ধারেকাছে কোথাও মোটর নেই।

দুজনে দাঁড়াল।

একটু পরেই ঝোপের আড়াল থেকে একটা মোটর বেরিয়ে এল। মোটর থেকে আ লিম নামল।

আরে, দুজনে হনহন করে চলেছ কোথায়?

কী করব, রাস্তায় মোটর দেখতে পেলাম না।

আ লিম হাসল। আধো-অন্ধকারে তার সোনা-বাঁধানো দাঁতগুলো চকচক করে উঠল।

রাস্তার মাঝখানে মোটর রাখতে আছে। ফাঁকা রাস্তা, কখন আর কোনও গাড়ি এসে ধাক্কা লাগিয়ে দেবে, তাই একপাশে মোটর সরিয়ে রেখেছিলাম। নাও নাও, উঠে এসো।

দিপু আর তপু মোটরে উঠে বসল।

মোটর চলতে শুরু হতে আ লিম জিজ্ঞাসা করল, জিনিসটা ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছ তো?

তপু বলল, তা দিয়েছি, কিন্তু কী সাংঘাতিক কুকুর। কামড়ালে আর বাঁচতে হত না আমাদের।

আ লিম আবার হাসল।

বুঝলে না, ওরকম ফাঁকা জায়গায় থাকে, বিপদ ঘটতে কতক্ষণ। সেইজন্যই বাঘা কুকুর রেখেছে।

দিপু প্রশ্ন করল, আচ্ছা, ও জিনিসটা কী? যেটা আমরা দিয়ে এলাম।

অন্ধকারে আ লিমের মুখ দেখা গেল না। মনে হল দাঁতে দাঁত চেপে সে যেন অস্ফুট একটা শব্দ করল।

তারপর ঢোঁক গিলে বলল, ওষুধ ওষুধ। বেচারি হাঁপানিতে ভুগছে। বাড়ি থেকেও বের হতে পারে না, তাই ওষুধ পাঠিয়ে দিলাম।

সারাটা রাস্তা আর কোনও কথা হল না।

পুরোনো আস্তানায় পৌঁছে বর্মি লোকটির হাতে দুজনকে ছেড়ে দিয়ে আ লিম চলে গেল।

খাওয়াদাওয়ার পর তিনজনে কথা হল।

দিপুই শুরু করল, তুমি আমাদের দেশে ফেরার কী করলে?

একটা কাঠি দিয়ে বর্মি দাঁত খুঁটছিল। খুঁটতে খুঁটতেই বলল, দেশে ফিরে আর কী করবে তোমরা? এখানে থেকে যাও, তোমাদের ভালো হবে।

দিপু রেগে উঠল, ছাই ভালো হবে। রোজ রোজ আমাদের দিয়ে গাঁজা-কোকেন চালান দেবার চেষ্টা। পুলিশের কাছে ধরা পড়লে কী হাল হবে আমাদের?

দিপুর কথার সঙ্গে সঙ্গে বর্মির সারা মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। দাঁত দিয়ে ঠোঁটটা চেপে ধরে বজ্রকঠিন স্বরে বলল, বেশি চালাক হবার চেষ্টা কোরো না, বিপদে পড়বে। ঠিক যা বলব, সেইটুকু করে যাবে। কোনও কথা বলবে না। তোমাদের মতন অবাধ্য গোটা তিনেক ছেলে আমাদের হাতে এসেছিল। মেজাজ দেখিয়েছিল, তিনটেই চিতাবাঘের খোরাক হয়ে গেছে। সাবধান।

বর্মিটা উঠে বেরিয়ে গেল।

অনেক রাত পর্যন্ত দুজনের চোখে ঘুম এল না। বিছানায় চুপচাপ বসে রইল। কথা বলতেও সাহস হল না। এরা বাংলা বোঝে। বলা যায় না, চারদিকে হয়তো কান পেতে রেখেছে।

পরের দিন উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেল।

যখন উঠল, তখন রোদের তেজ খুব কড়া।

বিছানায় বসে দেখল, টেবিলের ওপর দু-কাপ চা আর দু-বাটি শিমের বিচিসিদ্ধ পড়ে রয়েছে।

মুখ-হাত ধুয়ে দুজনে খেয়ে নিল।

আ লিম এল বিকালের দিকে।

নাও নাও, মুখ-হাত ধুয়ে নাও। বিকালে একটু না বের হলে শরীর থাকবে কী করে?

ওদের স্বাস্থ্যের জন্য এত উদবেগের আসল কারণ বুঝতে দুজনেরই কোনও অসুবিধা হল না। কিন্তু এও বুঝল, এটা আদেশ। এ আদেশ মানতেই হবে।

সেই মোটর, তবে আজ মোটর নদীর ধার দিয়ে চলল।

কয়েকটা জাহাজও দিপু-তপুর চোখে পড়ল আর সেই সঙ্গে তাদের দুটো চোখ জলে ভরে উঠল।

কোনওরকমে যদি একটা জাহাজে ওরা উঠতে পারত তাহলে ক্যাপ্টেনের হাতে-পায়ে ধরে যেমন করে হোক দেশে ফেরার ব্যবস্থা করত।

মোটর থামল। যেখানে থামল সেখানে কোনও জেটি নেই। কাদা ভরতি জমি। কিছু সাম্পান মাঝখানে ঘোরাফেরা করছে।

আ লিম নেমে এদিক-ওদিক দেখল, তারপর চাপা গলায় ড্রাইভারকে কী বলল। ড্রাইভার বিচিত্র ঢঙে হর্ন বাজাতে শুরু করল। প্যাঁ প্যাঁ পোঁ। প্যাঁ প্যাঁ পোঁ।

বারকয়েক বাজাতেই মাঝদরিয়া থেকে একজন মাঝি সাম্পানের ওপর দাঁড়িয়ে, দুটো হাত মুখের পাশে দিয়ে চিৎকার করল, তারপরই জল কেটে কেটে সাম্পান ডাঙার দিকে নিয়ে এল।

বাঁশের একটি খুঁটিতে সাম্পান বেঁধে মাঝি কাদা ভেঙে ওপরে উঠে আ লিমকে সেলাম করল।

আ লিম দিপু আর তপুকে দেখিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় কী বলল। মাঝি ঘাড় নাড়ল।

তারপর আ লিম দিপু আর তপুর দিকে ফিরে বলল, তোমরা সাম্পানে ওপারে চলে যাও। ঘাটে একজন লোক থাকবে। তোমরা যেতেই জিজ্ঞাসা করবে, ওপারে চালের দর কীরকম? তোমরা বলবে, এপারের মতনই। ব্যাস, তারপর লোকটা তোমাদের পথ দেখিয়ে যে বাড়িতে নিয়ে যাবে, সে বাড়ির মালিককে এই প্যাকেটটা দিয়ে আসবে। বুঝতে পেরেছ?

ঘাড় নেড়ে, আ লিমের কাছ থেকে মাঝারি সাইজের একটা প্যাকেট নিয়ে দিপু আর তপু মাঝির সঙ্গে নেমে গেল।

খুব সন্তর্পণে কাদার ওপর দিয়ে দিপু আর তপু সাম্পানে এসে বসার সঙ্গে সঙ্গে মোটর ছেড়ে দিল।

দিপু চুপি চুপি তপুকে জিজ্ঞাসা করল, আমাদের ফেরার কী হবে?

তপু বলল, ভগবান জানেন। বোধহয় ওপারের লোকটাই তার নির্দেশ দেবে।

ওপারে পৌঁছাতে আধ ঘণ্টা লাগল।

ভাঙা একটা ঘাট। ইট-বের-করা। কাছেপিঠে কেউ নেই।

দুজনে সমস্যায় পড়ল। তাহলে কে নিয়ে যাবে পথ দেখিয়ে?

মাঝি নামিয়ে দিয়েই সাম্পান নিয়ে সরে গেল।

দিপুর হাতে প্যাকেটটা ছিল। শার্টের মধ্যে।

দুজনে ঘাটের চাতালে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখল। কাউকে দেখতে পেল না।

অনেক দূরে কয়েকটা বস্তি। দু-একটা কারখানাও দেখা যাচ্ছে। চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উঠছে। ওগুলো বোধহয় চালের কল। বইতে দিপু আর তপু পড়েছিল বর্মা দেশ চালের জন্য বিখ্যাত।

কিন্তু লোক না থাকলে কী করবে এই প্যাকেট নিয়ে? ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।

ফিরেই বা যাবে কী করে? সাম্পান অনেক দূরে চলে গেছে।

মুশকিল হল তো। তপু বলল।

ঘাটের কাছে বিরাট ঝাঁকড়া একটা বট গাছ। বড়ো বড়ো ঝুরি মাটিতে নেমেছে। নীচেটা অন্ধকার।

দুজনে এসে বট গাছতলায় দাঁড়াল।

তারপর একটু উঁকি দিয়েই তপু দিপুকে বলল, ওই দেখ।

দিপু সেদিকে দেখেই ভ্রূ কোঁচকাল।

বট গাছের নীচে একজন বুড়ো মুচি। খুব বুড়ো। মুখের গালের মাংস ঝুলে পড়েছে। চোখে চশমা। চশমার ডাঁটি নেই, সুতো দিয়ে কানের সঙ্গে জড়ানো। একমনে একটা চটিতে পেরেক ঠুকছে।

দিপু বলল, এ ছাড়া তো আর ধারেকাছে লোক দেখছি না।

তপু বলল, চল, ওর সামনে গিয়েই দাঁড়ানো যাক।

দুজনে মুচির সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

মুচি মুখ তুলল না। ওদের ছায়ার দিকে চোখ রেখে বলল, চাউলকা ও তরফমে কেয়া দাম?

দিপু আর তপু দুজনেই সামান্য হিন্দি জানত। তাদের বাড়ির গয়লা হিন্দুস্থানি। তা ছাড়া তাদের বাড়ির আশপাশে কলকারখানা। সেখানে অনেক হিন্দুস্থানি শ্রমিক ছিল। তাদের কল্যাণে ওরা দুজনেই হিন্দি শিখেছিল।

দিপু বলল, এ তরফকা মাফিক একই হ্যায়।

এবার মুচি মুখ তুলে দুজনকে দেখল, তারপর জুতো সারাবার সরঞ্জাম বগলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

দু-এক মিনিট, তারপরই মুচি চলতে আরম্ভ করল।

দিপু আর তপু পিছন পিছন চলতে লাগল।

একটু পরেই মুচি এত দ্রুত চলতে লাগল যে, দিপু আর তপুর পক্ষে তাল রাখাই দুষ্কর হয়ে উঠল।

তপু বলল, চলা দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না মুচিটা এত বুড়ো।

দিপু চাপা গলায় বলল, কিছু বলা যায় না। সবই হয়তো ছদ্মবেশ।

পাকা রাস্তা শেষ হয়ে কাঁচা পথ শুরু হল। দু-পাশে জলা। ছোটো ছোটো কুঁড়ে। শুয়োর আর মুরগির পাল চরছে।

এঁকেবেঁকে অনেকটা চলার পর মুচি থামল।

একটা পোড়োবাড়ি। ইটের ফাটলের পাশে পাশে বট-অশ্বত্থের চারা। পিছনদিকটা ধসে গিয়েছে। ইটের টুকরো সাজানা ছোটো রাস্তা। পাঁচিল বোধহয় একটা ছিল একসময়ে, এখন তার চিহ্ন নেই। মাঝে মাঝে কেবল ইটের চাঙড়।

একদম সিধা আন্দার চলা জাও। একদম আন্দার।

মুচি হাত প্রসারিত করে বাড়ির মধ্যেটা দেখিয়ে দিল।

দিপু আর তপু আশা করেছিল, মুচি আর দাঁড়াবে না। চলে যাবে।

হলও তা-ই। মুচি হনহন করে পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওরা বাড়ির মধ্যে ঢুকছে কি না এটা একবার ফিরেও দেখল না।

দিপু আর তপু আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকল।

চৌকাঠের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই একঝাঁক পায়রা ঝটপট করে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল।

ওরা একটু অপেক্ষা করে চৌকাঠ পার হল।

কেউ কোথাও নেই। ঘরদোরের ধুলোভরা অবস্থা দেখে মনে হয়, এ বাড়িতে অনেকদিন বোধহয় কোনও লোকের বাস ছিল না।

এমন এক জায়গায় আ লিম প্যাকেট দেবার জন্য কেন পাঠাল?

আরও ভিতরে ঢুকল।

একটা হলঘর। বড়ো একটা খাওয়ার টেবিল। দু-পাশে গোটা ছয়েক চেয়ার। টেবিল খালি। কোনও খাবার জিনিস নেই।

হলঘর পেরিয়ে ওরা পাশের একটা ঘরে ঢুকল।

ছোটো ঘর। এপাশে একটা ক্যানভাসের খাট। কোণের দিকে একটা চেয়ার। তার সামনে টেবিল।

দরজার কাছে দাঁড়াতেই দেখতে পেল, একটা লোক চেয়ারে পিছন ফিরে বসে আছে। একটু যেন ঝুঁকে পড়েছে টেবিলের ওপর। বোধহয় কিছু পড়ছে।

একেবারে তন্ময় হয়ে, কারণ দিপু আর তপুর পায়ের শব্দেও লোকটি ফিরল না।

দিপু বলল, কী করা যায়?

তপু বলল, চেঁচিয়ে ডাকব।

কী বলে ডাকবি?

তার চেয়ে এক কাজ করি।

কী কাজ?

দরজায় ঠকঠক করি, তাহলেই ফিরে দেখবে।

তা-ই ঠিক হল।

প্রথমে তপু, তারপর দিপু, শেষকালে একসঙ্গে দুজনে ঠকঠক করতে লাগল দরজায়।

লোকটার সাড় নেই।

তা-ই তো, লোকটা বসে বসে ঘুমাচ্ছে নাকি?

কিন্তু কী ঘুম রে বাবা, এত আওয়াজেও ঘুম ভাঙছে না।

আমাদের যে দেরি হয়ে যাবে। এতটা পথ হেঁটে ফিরতে হবে, তারপর নদী পার হয়ে ওপারে যেতে হবে। কী করা যায়?

চল, আমরা এগিয়ে টেবিলের ওপর প্যাকেটটা রেখে আসি।

দুজনে ঘরের মধ্যে ঢুকল।

অদ্ভুত ঘর। একটা জানালা পর্যন্ত নেই। টেবিলের ওপর ল্যাম্প জ্বলছে। খুব জোর পাওয়ার। দেয়ালে গোটা তিনেক ছবি, দুটো সরু মাদুর টাঙানো, মাদুরের ওপর প্রাকৃতিক দৃশ্য।

দুজনে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

লোকটার ঝুঁকে পড়ে বসাটা যেন অস্বাভাবিক।

পরনে শার্ট আর প্যান্ট। পা খালি। লোকটার মুখটা দেখা গেল না।

এবারে সাহস করে দিপু লোকটাকে একটা ঠেলা দিল। মৃদু ঠেলা।

সঙ্গে সঙ্গে লোকটা কাত হয়ে মেঝের ওপর পড়ে গেল।

চেয়ারটা ছিটকে পড়ল এপাশে।

দিপু আর তপু চিৎকার করে একদিকে সরে গেল।

লোকটা মারা গেছে! দিপু কাঁপতে কাঁপতে কথাগুলো বলল।

কিন্তু মরেও এভাবে চেয়ারে বসে ছিল কী করে?

বোধহয় চেয়ারের হাতলে কোনওরকমে আটকে গিয়েছিল, ধাক্কা দিতে পড়ে গিয়েছে।

বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুজনের মনে সাহস এল।

তপু টেবিল ল্যাম্পটা নামিয়ে মেঝের ওপর নিয়ে এল।

লোকটা বোধহয় এ দেশি। দুটো চোখ বিস্ফারিত। যেন কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে। অথচ কোথাও গুলির কিংবা ছোরার দাগ দেখতে পেল না।

তাহলে কী করে মরল লোকটা?

বিষে মৃত্যু হলে, দিপু আর তপু শুনেছিল যে, মৃতদেহ নীল হয়ে যায়। সেরকম তো কিছু হয়নি।

আর নয়, চল আমরা পালাই এখান থেকে।

তপু বাতিটা মেঝের ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল।

চল।

দুজনে আস্তে আস্তে বাইরের দিকে এগোতে লাগল।

দুটো পা ঠকঠক করে কাঁপছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া তাদের এই প্রথম।

কোনওরকমে মুক্ত আকাশের তলায় গিয়ে দাঁড়াতে পারলে যেন বাঁচে।

যেতে যেতে তপু হোঁচট খেল। দেয়ালে টাঙানো মাদুরটা চেপে ধরে কোনওরকমে টাল সামলাল।

সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্য কাণ্ড। সমস্ত দেয়ালগুলো থরথর করে কেঁপে উঠল। ঠিক যেন ভূমিকম্প।

কাছে দড়াম করে একটা শব্দ হল। কীসের শব্দ তখন ওরা বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারল চৌকাঠের কাছে গিয়ে।

বাইরে যাবার ভারী কাঠের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। সর্বনাশ!

দিপু আর তপু প্রাণপণ শক্তিতে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। চিৎকার করল।

দরজা এক ইঞ্চি ফাঁক হল না। বাইরে থেকে কেউ এল না সাহায্যের জন্য।

দুজনে আবার ঘরের মধ্যে ফিরে এল।

অন্য কোনওদিক দিয়ে বাইরে যাবার পথ আছে কি না তার খোঁজে এদিক-ওদিক দেখল। পাশে একটা খুব ছোটো ঘর রয়েছে। আপাতত ঘুটঘুটে অন্ধকার।

দিপু টেবিল ল্যাম্পটা টেনে এদিকের ঘরে নিয়ে আসার চেষ্টা করল। ছোটো তার। বেশি দূর আনা গেল না।

অল্প আলোতে যেটুকু দেখা গেল তাতেই দিপু আর তপুর আতঙ্কে দুটো চোখ কপালে উঠল।

কাচের ছোটো-বড়ো জার। তার মধ্যে নানা রকমের সাপ। কেউ চুপচাপ নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে, কেউ ফণা প্রসারিত করে কাচের ওপর ছোবল দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে নীল বিষ গড়িয়ে পড়ছে।

এ দৃশ্য দেখে দিপু এত ভয় পেয়ে গেল যে তার হাত কেঁপে টেবিল ল্যাম্পটা আছড়ে পড়ল। মাটিতে পড়বার আগে সেটা কাছের একটা কাচের জারের ওপর পড়ল।

ছোট্ট জার, তার ভিতরের সাপটাও ছোটো। হলদে রং, তার ওপর কালো কালো ফোঁটা।

কিন্তু জার থেকে বাইরে এসে সেই ছোট্ট সাপটা ল্যাজে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। দুটো চোখ যেন জ্বলছে। লকলক করছে চেরা জিভ। ফোঁস ফোঁস শব্দ।

প্রথমেই সাপটা টেবিল ল্যাম্পটার ওপর ছোবল দিল। ল্যাম্পটা মাটিতে পড়ে ছিল, ছোবলের সঙ্গে সঙ্গে আরও গড়িয়ে গেল। তারটা সরে যাওয়াতে নিভে গেল।

ঘন অন্ধকার। কোথাও একটু আলো নেই। সেই ঘন অন্ধকারের মধ্যে বিষাক্ত, ক্রুদ্ধ সেই সাপ গর্জন করে বেড়াচ্ছে। অন্য জারের কাচে তার ল্যাজের আছড়ানি শোনা যাচ্ছে। সামনে যা পাচ্ছে, তাতেই বোধহয় ছোবল দিচ্ছে।

সেই ঘরে দিপু আর তপু পাগলের মতন একদিক থেকে আর-একদিকে ছুটোছুটি করতে লাগল।

কিছু দেখা যাচ্ছে না। কোনওরকমে যদি কোনও জারের ওপর গিয়ে পড়ে, তাহলে আর দেখতে হবে না। বিষাক্ত দংশনে দুজনেই শেষ হয়ে যাবে।

আর চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেই মৃত্যু এড়াতে পারবে, এমন সম্ভাবনাও কম। সাপটা নিষ্ফল আক্রোশে সারাটা ঘর ছুটে বেড়াচ্ছে।

কোনওরকমে পাশের ঘরে চলে যাবে তাও সম্ভব নয়। দরজার গোড়াতেই জারের ভাঙা কাচ আর টেবিল ল্যাম্প পড়ে রয়েছে। ছুটতে গিয়ে পায়ে কাচ ফুটলে, কিংবা তার জড়িয়ে গেলেও বিপদ কম নয়।

দিপু আর তপু ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল।

হঠাৎ ছপাৎ করে একটা শব্দ। দিপুর পাশের দেয়ালে সাপটা আছড়ে পড়ল।

মা গো! বলে দিপু লাফিয়ে উঠল। লাফিয়ে উঠতেই দেয়ালে একটা হাতলে হাত ঠেকে গেল। সেটা আঁকড়ে ধরে সে ঝুলতে লাগল।

পায়ের তলায় সাপটা গর্জন করে চলেছে।

তপু বেগতিক দেখে দিপুর কোমর জড়িয়ে দুটো পা গুটিয়ে নিল।

কিন্তু এভাবে ছোটো একটা হাতল ধরে দিপু কতক্ষণ ঝুলে থাকবে, তার ওপর তপুর ভারও তার ওপর।

সাপটাও বোধহয় ওদের সন্ধান পেয়েছে। লাফিয়ে উঠে বার বার দেয়ালে ছোবল দিচ্ছে। প্রায় তপুর পায়ের কাছ বরাবর।

হাত দুটো পিছলে যাচ্ছে, তাই দিপু প্রাণপণ শক্তিতে হাতলটা আঁকড়ে ধরল।

হঠাৎ খট করে একটা শব্দ, তারপরই ঘড়ঘড় করে একটানা আওয়াজ। মনে হল দেয়ালটা আস্তে আস্তে যেন সরে যাচ্ছে।

কী হচ্ছে বোঝবার আগেই দিপু আর তপু গড়িয়ে পড়ল। দেওয়ালের ওপাশে। আবার শব্দ করে দেয়ালটা বন্ধ হয়ে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তপু প্রথমে উঠে বসল।

জায়গাটা খুব অন্ধকার নয়। কোথা থেকে ম্লান নীলচে আলো আসছে।

তপু আস্তে আস্তে ডাকল, দিপু, দিপু।

একটু দূর থেকে ক্ষীণকণ্ঠে উত্তর এল, উঁ।

শব্দ অনুসরণ করে হামাগুড়ি দিয়ে তপু এগিয়ে গেল। এত নিচু ছাদ, উঠে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।

দুটো বস্তার মাঝখানে দিপু পড়ে রয়েছে।

তপু কাছে গিয়ে হাত ঠেকাতেই দিপু উঠে বসল।

বেশি লেগেছে?

দিপু মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল।

না, আচমকা ছিটকে পড়ে কেমন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

দুজনে পাশাপাশি বসল।

তপু বলল, আমাদের সঙ্গে সাপটা তো এদিকে ঢুকে পড়েনি?

দিপু একবার এদিক-ওদিক চেয়ে বলল, বোধহয় না। দেয়াল ফাঁক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি পাদুটো ছুড়তেই মনে হল সাপটা পায়ের ধাক্কায় যেন ছিটকে গেল। খুব ঠান্ডা বরফের মতন একটা স্পর্শ।

কিন্তু এ জায়গাটা কী?

কিছু বুঝতে পারছি না। একবার ঘুরে দেখা যাক।

সিঁড়ির মতন দুটো ধাপ। তারপর প্রশস্ত একটা হল।

একটা টেবিল, চারটে চেয়ার। পাশে একটা আলমারি।

দিপু আলমারি খুলে ফেলল।

পাঁউরুটি, বিস্কুট, টিন ভরতি মাছ, সিরাপ, আরও নানা রকমের জিনিস সাজানো। দিপু আর থাকতে পারল না।

বলল, জায়গাটা পরে দেখব, আগে আয়, খেয়ে নিই। খিদেয় চোখে অন্ধকার দেখছি।

দুজনে পেট পুরে খেয়ে নিল।

শরীর কিছুটা ঠিক হল। পেটের মধ্যে মাঝে মাঝে যে যন্ত্রণা হচ্ছিল, সেটা কমল। দিপু আর তপু দুজনেরই।

চল, এদিক-ওদিক দেখি এইবার।

আমার মনে হয়, এটা বোধহয় ওদের লুকোবার জায়গা।

কাদের?

যারা এইসব গাঁজা, আফিম, কোকেনের ব্যাবসা করে। সেইজন্য সারা বাড়িতে এতসব কলকবজা বসানো। পুলিশ হানা দিলে এইখানে কিছুদিন লুকিয়ে থাকে।

লোকটাকে মারলে কে?

দিপু বলল, কী জানি! দলের কেউ হয়তো। এসব ব্যাবসায় ভাগ নিয়ে রেষারেষি হয়। বইতে পড়িসনি?

তপু ঘাড় নাড়তে গিয়েই থেমে গেল। লাফিয়ে টেবিলের ওপর শুয়ে পড়ে বলল, সাপ, সাপ।

ঠিক পাশেই সোঁ সোঁ করে শব্দ। একটানা।

দিপুও তপুর মতন টেবিলের ওপর উঠতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার নজরে পড়ে গেল।

ছাদ ফুঁড়ে একটা টিনের নল ওপরে উঠেছে। বাইরে থেকে বাতাস সেই নলের মধ্যে দিয়ে ভিতরে ঢুকছে, তারই সোঁ সোঁ আওয়াজ।

ব্যাপারটা বুঝলি তপু, সাপ নয়।

তবে?

বিজ্ঞানের বইতে পড়িসনি, অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না? মাটির তলার এইসব কামরায় ওই নল দিয়ে বাতাস আসছে।

কিন্তু কোনওরকমে যদি ওই বাতাস বন্ধ হয়ে যায়?

তাহলেই আমরা খতম।

তপু টেবিল থেকে নেমে পড়ল। এখানে ছাদ খুব নিচু নয়, তারা কোনওরকমে দাঁড়াতে পারে।

বলল, চল, এদিক-ওদিক ঘুরে দেখি, বের হবার কোনও রাস্তা আছে নাকি।

দুজনে হাঁটতে লাগল। বেশি হাঁটতেও হল না। সামনেই বাধা। পাথরের শক্ত দেয়াল। অর্থাৎ, পথ বন্ধ।

দিপু বলল, তার মানে?

তপু পাথরের দেয়ালের নানা জায়গায় ঘুসি মেরে দেখল। সবটাই নিরেট, কোথাও ফাঁপা নয়।

মেঝের ওপর বসে পড়ে তপু বলল, তাহলে বুঝতে হবে বের হবার অন্য কোনও পথ নেই। যেখান দিয়ে ঢুকেছিলাম, সেখান দিয়েই বের হতে হয়।

কিন্তু তা কী করে হবে, সে দরজা তো বন্ধ।

বন্ধ হোক, এদিক থেকেও খোলবার কোনও কলকবজা নিশ্চয় আছে। বোধহয় বিপদের আশঙ্কা দেখলে হাতল টেনে এই সুড়ঙ্গঘরে সবাই চলে আসত, কিছুদিন কাটিয়ে আবার কোনওরকমে এদিক থেকে দেয়াল সরিয়ে ওদিকে চলে যেত। চল, ওই দেয়ালের কাছে গিয়ে একবার দেখি।

দুজনে যেখান দিয়ে ছিটকে পড়েছিল, আবার সেখানে গিয়ে দাঁড়াল।

এদিকে পাথর নয়, পালিশ করা কাঠের দেয়াল।

দিপু আর তপু তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনও হাতল বা বোতাম দেখতে পেল না।

ক্লান্ত হয়ে দুজনে সিঁড়ির ধাপে বসে পড়ল।

দিপু বলল, আচ্ছা, খাওয়ার ঘর তো রয়েছে, কিন্তু লোকগুলো শোয় কোথায়?

দুজনেই এদিক-ওদিক দেখল।

প্রথমে আলো থেকে এসে আধো-অন্ধকারে দেখতে অসুবিধা হচ্ছিল। এখন এখানে কিছুকাল কাটাবার পর চারদিক বেশ পরিষ্কার।

দিপুই এদিক-ওদিক দেখে বলল, আমার মনে হচ্ছে এই নরম বস্তাগুলোর ওপরই বোধহয় শুত। ভিতরে কী আছে কে জানে, বেশ নরম বলে মনে হচ্ছে।

দিপু আর তপু উঠে দাঁড়িয়ে বস্তাগুলো দেখল। কোণের দিকে গোটা তিনেক ছোটো ছোটো বস্তা। বোঝা গেল, এগুলো মাথার বালিশ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আর বড়ো বস্তাগুলো শোবার গদি।

এত নরম, ভিতরে কী আছে?

দিপু টিপে টিপে দেখল।

দাঁড়া, দেখছি আমি।

তপু খাওয়ার ঘরে চলে গেল। আলমারির মধ্যে সে ছুরি-কাঁটাচামচ দেখেছিল। একটা কাঁটা হাতে করে ফিরে এল।

কাঁটাটা সজোরে বস্তার এককোণে বসিয়ে দিতেই কালো গুঁড়ো হাতের ওপর ঝরে পড়ল।

সেগুলো নিয়ে আলোর নীচে গিয়ে দুজনে দাঁড়াল।

দেখেই বুঝতে পারল এগুলো কাঠের মিহি গুঁড়ো।

এইজন্যই এগুলোর ওপর ছিটকে পড়তে দুজনের বিশেষ লাগেনি।

এবার তপু বলল, এবার আমাদের কী কর্তব্য?

কী আর কর্তব্য। শুয়ে পড়া উচিত। নিশ্চয় অনেক রাত হয়েছে। অবশ্য এখানে ঘড়ি যখন নেই আমাদের কাছে, তখন রাতদিন সবই সমান। তবে বিকালে আমরা প্যাকেট হাতে লোকটার ঘরে ঢুকেছিলাম, তারপর অনেক সময় কেটেছে। এখন যে রাত সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই।

দুজনে দুটো বস্তার ওপর শুয়ে পড়ল। ছোটো বস্তা মাথায় দিয়ে।

ভেবেছিল, শুলেই ঘুম আসবে, কিন্তু এল না। নানারকম চিন্তা মাথায় এল।

এমনও তো হতে পারে আর কোনওদিনই দরজা খুলল না। ক্রমে ক্রমে খাবার সব শেষ হয়ে গেল, কিংবা বাইরের বাতাস কোনও কারণে বন্ধ হয়ে গেল, তাহলে দিপু আর তপুর নিশ্চল দেহ বিদেশের এই অন্ধকূপে পড়ে থাকবে। কেউ কোনওদিন খোঁজ পাবে না।

যদি দরজা খুলে যায়, তাহলে যারা খুলবে তারা দিপু আর তপুকে ছাড়বে না। কী করে এখানে এল তার কৈফিয়ত তলব করবে।

যদি প্রয়োজন বোধ করে, কিংবা সন্দেহ করে, তাহলে এদের মতন দুটো ছোটো ছেলেকে শেষ করে দেওয়া একটা সমস্যাই নয়।

হঠাৎ কথাটা মনে হতেই তপু বিছানার ওপর উঠে বসল।

দিপু, দিপু, ঘুমালি?

দিপু ঘুমায়নি। একটা হাত চোখের ওপর রেখে আকাশ-পাতাল ভাবছিল।

সে উত্তর দিল। কী রে তপু?

সেই প্যাকেটটা আমরা কোথায় ফেলে এসেছি?

ওই লোকটার টেবিলের ওপর।

ওই প্যাকেটে কোনওরকম চিহ্ন নেই তো?

কী জানি, লক্ষ করিনি। কেন?

ভাবছি যদি কোনওরকম সংকেতচিহ্ন থাকে, আর মৃত্যুর কিনারা করতে এসে পুলিশের হাতে ওই প্যাকেট পড়ে, তাহলেই সর্বনাশ।

কেন, সর্বনাশ কেন?

সর্বনাশ নয়? পুলিশ হয়তো সেই সংকেতচিহ্ন অনুসরণ করে আ লিমকে গ্রেপ্তার করতে পারে।

করুক, আমাদের কী।

ওদের দলে তো অনেক লোক থাকে। তাদের রাগটা থাকবে আমাদের ওপর। যদি এখান থেকে কোনওরকমে উদ্ধারও পাই, তাহলেও আর নিরাপদে দেশে পৌঁছাতে পারব না। দলের লোক আমাদের শেষ করে দেবে।

তপু চুপ করে শুনল। কিছু বলল না। বলার মতন তার কিছু ছিলও না।

অনেক রাতে, কত রাতে জানবার উপায় নেই, ওদের মনে হল কাঠের দেয়ালের ওপাশে যেন কতকগুলো মানুষের চলার শব্দ পাওয়া গেল। কারা যেন জোরে জোরে হাঁটছে।

দিপু আর তপু দুজনেই উঠে বসল।

কিছু বলা যায় না, এখনই হয়তো কাঠের পার্টিশন ফাঁক হয়ে যাবে। সেই ফাঁক দিয়ে পিস্তল হাতে লোকেরা এপাশে ঢুকে পড়বে।

ঠিক যেমন রহস্যকাহিনিতে ওরা পড়েছে।

তারপর! তারপর কী হবে ওরা ভাবতে পারল না। ভাবতে সাহসই হল না।

দেশের বাড়ির কথাটা মনের সামনে ভেসে উঠল। সেখানকার আত্মীয়স্বজনের কথা।

কিন্তু না, কিছুক্ষণ পরে সব নিঝুম। আওয়াজ থেমে গেল।

দিপু আর তপু ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়ল।

দিপু যখন জাগল, তখন তপু ঘুমাচ্ছে।

তপুকে আর ডাকল না। দিপু উঠে খাওয়ার ঘরে গেল।

জলের বোতল থেকে জল ঢেলে চোখ-মুখ ধুয়ে ফেলল।

ফিরে এসে দেখল তপুও উঠেছে।

দুজনে খাওয়াদাওয়া সেরে আবার সারা এলাকাটা পর্যবেক্ষণ শুরু করল। একেবারে কোণে একটা স্নানের ঘরও আছে। বস্তা আড়াল ছিল বলে দেখতে পায়নি।

একভাবে দুটো দিন দুটো রাত কাটল।

অবশ্য দিপু আর তপুর হিসাবে। বাইরে দিন না রাত বোঝবার উপায় নেই।

তিন দিনের দিন বিপদে পড়ল। আলমারি খালি। খাবার সব শেষ। শুধু জলের বোতল রয়েছে।

দিপু কপাল চাপড়াল।

সর্বনাশ, কী হবে?

তপু কিছু বলল না।

দুজনেই বুঝতে পারছিল খাবার ফুরিয়ে আসছে, কিন্তু দুজনেরই মনের গোপনে আশা ছিল, কিছু একটা হবে। ওরা হয়তো এই পাতাল থেকে মুক্তি পাবে।

কী হবে এইবার?

থালায় পাঁউরুটির গুঁড়ো পড়ে ছিল, দুজনে সেগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেল। সিরাপের বোতলে জল দিয়ে তা-ই পান করল।

বিকালে দুজন আলমারির প্রত্যেকটি তাক ভালো করে খুঁজল।

সব পরিষ্কার। কোথাও একটি দানাও নেই।

একটু তাড়াতাড়ি দুজনে শুয়ে পড়ল।

ভোরে উঠে আর দাঁড়াবার শক্তি নেই। বস্তায় হেলান দিয়ে দুজনে চুপচাপ বসে রইল।

এতদিন যে আশাটুকু নির্ভর করে বাঁচছিল, সেটাও আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। মাটির নীচে এই অন্ধকূপে যে তাদের মৃত্যু এ বিষয়ে আর তাদের কোনও সন্দেহ নেই।

একসময়ে দুজনে উঠল।