২
তিন দিনের দিন সকাল থেকেই সারা জাহাজেই বেশ একটু চাঞ্চল্য। কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে সবাই চোখের ওপর আড়াআড়িভাবে হাত রেখে জলের ওপারে চেয়ে চেয়ে কী দেখছে।
জলের রং আর ঘন নীল নয়, ফিকে সবুজ।
ক্যাপ্টেনও চোখে দূরবিন লাগিয়ে নিজের ছোটো ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এ কদিনে ওরা শিখে গেছে। যে লোকগুলো জাহাজের কাজ করে, তাদের সারেং বলে।
একজন সারেংকে ডেকে তপু জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে? তোমরা সবাই ওরকম করে কী দেখছ?
সারেং হাসল।
একটু পরেই মাটি দেখা যাবে। বর্মার মাটি। মাঙ্কি পয়েন্ট। ওই দেখো, ডাঙা আর দূরে নেই।
দিপু আর তপু চেয়ে দেখল।
রেলিংয়ের পাশে পাশে বিরাট আকারের সাদা সাদা পাখি। উড়ছে। ঠিক যেন পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে জাহাজটাকে।
কী ওগুলো?
ওই তো সি-গাল পাখি। ওরা ডাঙার খবর নিয়ে আসে। সেইজন্য ওদের মারা বারণ। কেউ মারতেও পারবে না, ধরতেও নয়।
কথার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা রেলিংয়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
ওই তো কালো দাগ। জল শেষ হয়ে, মাটির রেখা।
দিপু আর তপু কিন্তু চোখ কুঁচকে সেদিকে চেয়েও কিছু দেখতে পেল না।
তবে একটু পরেই ফিকে সবুজ জল ঘোলাটে হয়ে এল। কাদা-গোলা।
এবার সবুজ রেখাও স্পষ্ট দেখা গেল।
গাছপালা-ঢাকা মাটির চিহ্ন।
বিরাট একটা আর্তনাদ করে জাহাজটা দাঁড়িয়ে পড়ল। মাঝখানে।
কী হল?
তপু প্রায় চিৎকার করে উঠল, কী হবে?
জাহাজ হঠাৎ থেমে গেল যে?
সারেং হাত নেড়ে দিপু আর তপুকে ডাকল, এদিকে এসো। ওই দেখো।
দিপু আর তপু এদিকের রেলিংয়ে এসে দাঁড়াল।
ঠিক জাহাজের পাশে একটা সাদা মোটর লঞ্চ এসে দাঁড়িয়েছে। জাহাজ থেকে একটা সিঁড়ি নামিয়ে দেওয়া হয়েছে জলের ওপর।
সারেং বলল, ওটা পাইলটের লঞ্চ। ওই দেখো সাদা পোশাক-পরা পাইলট সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছে।
কী করবে পাইলট?
সমুদ্রের পথঘাট ক্যাপ্টেনের সব জানা। জাহাজ নিয়ে আসতে তার কোনও অসুবিধা নেই, কিন্তু নদীতেই মুশকিল। কোথায় জল কম, কোথায় জলের চোরাটান আছে সে সম্বন্ধে পাইলট ওয়াকিবহাল। তাই মোহানা থেকে রেঙ্গুন বন্দর পর্যন্ত এই পাইলটই জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাবে।
এটা কী নদী?
এর নাম লেইং। ইরাবতীর একটা শাখা।
সারেঙের কথা শেষ হবার আগেই জাহাজ চলতে শুরু করল। জল কেটে কেটে।
এখন দু-পাশের তীরভূমি বেশ স্পষ্ট। লোকজনও দেখা গেল। দু-একটা কলকারখানা।
ঘণ্টাকয়েকের মধ্যে জাহাজ জেটিতে নোঙর ফেলল।
জাহাজ থামতেই ডাক্তার এসে পাশে দাঁড়াল।
শোনো, তোমরা যেন নেমো না। অচেনা জায়গা, বিপদে পড়বে। এখানে জাহাজ দিন দুয়েক থাকবে। মাল খালাস করে সিঙ্গাপুর চলে যাবে। তার আগে জাহাজ কোম্পানির অফিসে তোমাদের দিয়ে আসব। আজ বৃহস্পতিবার, শনিবার ফেরার জাহাজ আছে। এস. এস. এডাভানা কলকাতায় ফিরে যাবে, সেই জাহাজে তোমাদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করব।
দিপু আর তপু কোনও কথা বলল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনল।
ডাক্তার সরে যেতে দিপু তপুকে বলল, তপু, যেরকম করেই হোক এদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমাদের পালাতে হবে, না হলে ভীষণ বিপদ।
কী বিপদ?
কী বিপদ বুঝতে পারছিস না? আরও দুটো কঞ্চি বাবা আমাদের পিঠে ভাঙবে। বাড়ি থেকে পালানোর কী শাস্তি ভাবতে গেলেই তো বুক কেঁপে উঠছে।
কিন্তু এখানে কোথায় যাব? কেউ তো আমাদের চেনে না।
তপু যেন একটু সন্দেহ প্রকাশ করল।
এই জাহাজেই কি কেউ আমাদের চিনত? একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল তো?
আর কোনও কথা হল না। মাল নামানো শুরু হল। কুলির দল লাফিয়ে লাফিয়ে জাহাজের ওপর উঠল। কতকগুলো সারেং সেজেগুজে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল।
দুই ভাই রেলিংয়ের ধারে বসে বসে দেখল।
সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে চা খাওয়া সেরে দুজনে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। এদিক-ওদিক চেয়ে দেখল। কেউ কোথাও নেই। ক্যাপ্টেন বেরিয়েছে। ডাক্তার ওপরের ডেকে বসে বই পড়ছে।
চল, নামি।
দুজনে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে জেটিতে এসে দাঁড়াল।
জেটির বাইরে সোজা রাস্তা। দু-ধারে আলো জ্বলছে। জেটির ওপর তখনও কিছু মাল পড়ে রয়েছে।
রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই দিপু বলল, ওই দেখ বর্মি যাচ্ছে।
পরনে কালো ছোটো কোট, রঙিন লুঙ্গি, পায়ে চটি একটা লোক হনহন করে এদিক থেকে ওদিকে চলে গেল।
তপু বলল, এ তো আবার আর-একটা মুশকিল।
কী?
এদের ভাষাও তো বুঝব না। এক কথা বললে আর-এক কথা শুনবে। মহাঝামেলা হবে তা-ই নিয়ে।
দিপু বলল, এগিয়ে চল। এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো নিরাপদ নয়। ডাক্তার একবার দেখতে পেলে লোক দিয়ে ধরে ফেলবে।
ছোটো একটা পার্ক। দুজনে পার্কের মধ্যে ঢুকল।
কয়েক পা গিয়েই থেমে গেল।
ঝাঁকড়া গাছের নীচে একটা বেঞ্চ। জায়গাটা অন্ধকার। লোকটাকে দেখা গেল না। তার গলার স্বর শোনা গেল।
কে তোমরা?
দুজনে এদিক-ওদিক দেখতে লাগল।
বেঞ্চ থেকে যে লোকটা এগিয়ে এসে তাদের কাছে দাঁড়াল, তার পরনে কালো জামা, কালো ঝলঝলে প্যান্ট। গোঁফজোড়া সরু হয়ে দু-পাশের ঠোঁটের ওপর নেমে এসেছে। চোখের বালাই নেই। নাকের অবস্থাও তা-ই।
লোকটা চীনে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু চীনে এত সুন্দর বাংলা বলছে কী করে?
দিপু বলল, আমরা বাঙালি। কলকাতা থেকে জাহাজে করে বেড়াতে এসেছি।
এখানে কোথায় যাবে?
কোথায় যাব এখনও ঠিক করিনি। এখানে আমাদের জানাশোনা কোনও লোক তো নেই।
তোমাদের সঙ্গে কে আছে?
কেউ নেই। আমরা দুজনেই বেরিয়েছি।
চীনেটি আরও কয়েক পা এগিয়ে দিপু আর তপুর মাঝখানে এসে দাঁড়াল। দুটো হাত রাখল দুজনের কাঁধে।
হেসে বলল, চাকরি করবে তোমরা?
ওরা যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেল।
তপু বলল, চাকরি পেলে আর কে না করে, কিন্তু আমাদের মতন এত ছোটো ছেলেকে কে চাকরি দেবে?
চীনেটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে অনেকক্ষণ ধরে হাসল। একসময়ে হাসি থামিয়ে বলল,ছোটো ছেলেদের জন্যও চাকরি আছে বই কী। এমন চাকরি আছে যা কেবল ছোটোদেরই উপযুক্ত। তোমরা করবে কি না বলো?
দিপু বলল, বললাম তো করব।
বেশ, তাহলে এসো।
চীনে এগিয়ে চলল। দিপু আর তপু তাকে অনুসরণ করল।
পার্কের বাইরে একটা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল।
চীনে কাছে গিয়ে দু-হাতে তালি দিল। গাড়োয়ানটা একটু দূরে ছিল, ছুটে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল।
চিনে হাসতে হাসতে বলল, উঠে পড়ো খুদে ভাইরা। তোমাদের একটা ব্যবস্থা করে তবে নিশ্চিন্ত হতে পারব।
প্রথমে দিপু আর তপু তারপর চীনেটি গাড়িতে উঠে বসল।
দিপু আর তপু পাশাপাশি। উলটোদিকে চীনে।
গাড়ি ছাড়তে দিপু জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা তুমি তো জাতে চিনে, তা-ই না?
চীনে হাসতে হাসতে বলল, আমার নাক দেখে বুঝতে পারছ না? যখনই দেখবে এক চোখের জল গড়িয়ে আর-এক চোখে পড়ছে, তখন বুঝবে লোকটা চীনে।
চীনের কথায় দিপু আর তপু দুজনেই খুব জোরে হেসে উঠল।
এবার তপু বলল, কিন্তু এত ভালো বাংলা শিখলে কী করে?
এবার চীনেটা আরও জোরে হেসে উঠল, আরে আমি জাতে চীনে হলে কী হবে, কোনওদিন কি আমি গেছি চীন দেশে? আমরা তিন পুরুষ কলকাতার বাসিন্দা। ট্যাংরায় আমাদের চামড়ার কারখানা। আমি অবশ্য বছর কুড়ি বর্মায় এসেছি ব্যাবসা করতে।
তোমার কীসের ব্যাবসা?
ব্যাবসা কি আমার একটা, নানা রকমের ব্যাবসা। তোমরা থাকতে থাকতেই সব জানতে পারবে। তোমাদের মতন সেয়ানা ছেলেই তো খুঁজেছিলাম এতদিন।
সেয়ানা বলাতে দিপু আর তপু দুজনেই খুব খুশি হল।
দিপু বলল, আমাদের মাইনে কিন্তু একটু বেশি দিতে হবে। আমাদের এই একটি শার্ট আর একটি প্যান্ট সম্বল। জামাকাপড় কিনতে হবে আমাদের।
তা ছাড়া কিছু টাকা আমরা দেশেও পাঠাতে চাই।
তপুর হঠাৎ বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। বিধবা মা-কে কিছু টাকা পাঠানো দরকার।
গাড়ির মধ্যেটা অন্ধকার। চীনেটা হেসে উঠতেই তার দুটো সোনা-বাঁধানো দাঁত চকচক করে উঠল।
চীনে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলল, সব হবে, সব হবে। এখন নামো, আমরা এসে গেছি।
ছোট্ট কাঠের একতলা বাড়ি। সবই অন্ধকার। কেবল একটা ঘর থেকে মিটমিটে আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
দিপু আর তপু আশা করেছিল লোকটা যেরকম ব্যাবসার ফিরিস্তি দিচ্ছিল, বাড়িটাও সেই অনুপাতে জমজমাট হবে।
বাড়ির পিছনেই নদী। অন্ধকারে গোটা দুয়েক পালতোলা নৌকার কাঠামো দেখা যাচ্ছে।
এসো এসো, নেমে এসো।
চীনেটা হাসতে হাসতে আপ্যায়ন করল।
দিপু বলল, বাড়িটা এত অন্ধকার কেন?
আমি ছিলাম না বাড়িতে তাই অন্ধকার। এইবার আলো জ্বলবে। চলে এসো তোমরা। ঠান্ডায় আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকো না।
দিপু আর তপু চীনের পিছন পিছন বাড়ির মধ্যে ঢুকল।
একতলায় পৌঁছে চীনে বলল, ডানদিকে একটা ঘর আছে সেটাতে ঢুকে পড়ো। আমি বাতির বন্দোবস্ত করছি।
হাত দিয়ে অনুভব করে তপু বলল, দরজা যে বন্ধ।
অন্ধকারে চীনের হাসির শব্দ শোনা গেল, দূর বোকা ছেলে, বন্ধ হবে কেন? ভেজানো আছে, ঠেললেই খুলে যাবে।
সত্যিই তা-ই। তপু হাত দিয়ে ঠেলতেই দরজা খুলে গেল।
খুব সাবধানে পা টিপে টিপে দিপু আর তপু ভিতরে ঢুকল।
তারপরই চমকে উঠল।
পিছনে সশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল বাইরে থেকে যেন শিকলও তুলে দেওয়া হল।
দিপু আর তপু দুজনেই দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
আরে, দরজা বন্ধ করলে কেন? শুনছ, দরজা খোলো।
কোনও উত্তর নেই। ফাঁকা ঘরে ওদের চিৎকারের প্রতিধ্বনিই ফিরে এল।
দুজনে প্রাণপণ শক্তিতে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল।
খুট করে একটা শব্দ।
দিপু আর তপু ফিরে দাঁড়াল।
পিছনের কাঠের দেয়ালে চৌকো একটা গর্ত। তার মধ্যে চীনের মুখটা দেখা গেল। কাছে বোধহয় বাতিও রয়েছে কারণ সেই বাতির আলো চীনের মুখের ওপর এসে পড়েছে।
পৈশাচিক একটা হাসি, তারপরই তীক্ষ্ন কণ্ঠস্বর।
খোকাবাবুরা বিশ্রাম করো, একটু পরে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দিপু চিৎকার করে উঠল, এভাবে আমাদের বন্ধ রাখলে কেন? কী মতলব তোমার?
চীনে দুটো চোখের অদ্ভুত ভঙ্গি করে বলল, ছেলেমানুষ, বিদেশে পথ হারাবে, তাই ভালো জায়গায় রেখে দিয়েছি।
আমরা চেঁচাব। পুলিশে খবর দেব।
দিপু আর তপু দুজনেই প্রাণপণ শক্তিতে চেঁচাতে লাগল।
কেন চেঁচিয়ে নিজেদের গলা ভাঙবে? এ ঘরের আওয়াজ বাইরে যায় না।
বদমায়েশ কোথাকার, তোমাকে খুন করব।
শূন্যে ঘুসি ছুড়তে গিয়ে দুজনে দেখল, চীনের মুখটা গর্ত থেকে সরে গেছে, তার বদলে ম্লানদীপ্তি একটা লন্ঠন লোহার শিকে ঝুলছে।
সেই আলোয় কামরাটা দিপু আর তপু ভালো করে দেখল।
এককোণে খড়ের বিছানা পাতা। এদিকে কাঠের ছোটো টেবিল, নীচে দুটো টুল। মেঝেটা সিমেন্টের, কিন্তু অনেক জায়গায় সিমেন্ট উঠে মাটি বেরিয়ে পড়েছে।
দিপু খড়ের বিছানার ওপর বসল। তপু টুলের ওপর।
দিপু ক্লান্ত গলায় বলল, মনে হচ্ছে আমরা ডাকাতের পাল্লায় পড়েছি।
ডাকাতের পাল্লায়? তপুর কেমন একটু সন্দেহ হল, ডাকাত আমাদের ধরে কী করবে? আমাদের না আছে টাকাপয়সা, না আছে সোনার গয়না। বোধহয় লোকটার উদ্দেশ্য অন্য।
কী উদ্দেশ্য?
আমাদের ওপর নির্যাতন করে আমাদের ঠিকানা জোগাড় করবে, তারপর জ্যাঠাকে লিখবে— তোমাদের ছেলে যদি ফেরত চাও, তাহলে দশ হাজার টাকা অমুক জায়গায়, অমুক লোকের হাতে দিয়ে এসো।
কিন্তু বাবা অত টাকা পাবে কোথায়?
না দিতে পারলে আমাদের হয়তো কেটে ফেলবে।
তাহলে উপায়?
উপায়, বলা যে আমাদের তিন কূলে কেউ নেই। কে উদ্ধার করবে টাকা দিয়ে?
তাতে কি রেহাই পাব?
কী জানি, লোকটার কী মতলব সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। নদী খুব কাছে। জলের ছলাৎছল শব্দ শোনা যাচ্ছে।
দিপু আর তপু দুজনেই দুর্দান্ত ছেলে। ভয় কাকে বলে জানে না। বয়সের চেয়ে অনেক সাহসী।
কিন্তু এই থমথমে পরিবেশে, নিজের দেশ থেকে এতদূরে একটু চিন্তিতই হয়ে পড়ল।
আজ রাতটা হয়তো কিছু করবে না, কাল ভোরে চীনে আবার সামনে এসে দাঁড়াবে। তখন তার মতলব বোঝা যাবে।
ঠিক দিপুর মাথার কাছে একটা শব্দ হতে সে লাফিয়ে খড়ের বিছানা থেকে উঠে এল।
মাথার ওপর একটা ফোকর, তার মধ্য দিয়ে একটা টিফিন কেরিয়ার টেবিলের ওপর নেমে এল।
বোঝা গেল একটা বাঁকানো তারের সঙ্গে টিফিন কেরিয়ারটা আটকানো ছিল। টেবিলের ওপর টিফিন কেরিয়ারটা বসিয়েই তারটা ফোকর দিয়ে আবার ওপরে উঠে গেল।
দুজনেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল।
তাদের মনে হয়েছিল অদৃশ্য জায়গা থেকে চীনেটা হয়তো খাওয়ার নির্দেশ দেবে।
দশ মিনিট কেটে গেল। কোথাও কোনও শব্দ নেই।
দিপু বলল, আয় দেখি টিফিন কেরিয়ারে কী আছে।
সে এগিয়ে টিফিন কেরিয়ার খুলে বাটিগুলো টেবিলের ওপর সাজাল। দুটো বাটিতে লম্বা লম্বা চালের ভাত। দুটো বাটিতে থোড়ের ঝোল। আর একটা জায়গায় দুটো পেঁয়াজ।
খাবারের চেহারা দেখে চোখে জল এল। কদিন জাহাজে খাওয়াটা বেশ ভালোই হচ্ছিল। সেরকম জিনিস তারা বাড়িতেও কোনওদিন চোখে দেখেনি।
তপু বলল, আয়, আরম্ভ করে দিই।
হাত বাড়িয়েও দিপু হাত গুটিয়ে নিল।
এতে বিষ মেশানো নেই তো?
তপু বলল, এখন আমাদের মেরে ফেলে চীনের লাভ কী? মেরে ফেলবার জন্য নিশ্চয় কষ্ট করে এতদূর নিয়ে আসেনি। আমরা যদি ওর উদ্দেশ্য সফল না করতে পারি, তখন মেরে ফেলার কথা ভাববে।
আর দ্বিধা না করে দুজনে খেতে শুরু করল।
খাওয়া শেষ করে দুজনে খড়ের বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে পড়ল।
শরীর খুবই পরিশ্রান্ত, কিন্তু উদবেগের জন্য ঘুম এল না। দুজনেই এপাশ-ওপাশ করতে লাগল।
একসময়ে কামরা অন্ধকার হয়ে গেল। বোধহয় লন্ঠন নিভে গেল কিংবা সেটাকে কেউ ফুটো দিয়ে টেনে ওপরে তুলে নিয়েছে।
রাত গভীর হতে, সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল, কেবল নদীর জলের আছড়ানির শব্দ একটু একটু করে জোর হতে লাগল।
বোধহয় একটু তন্দ্রা এসেছিল, কিন্তু একটা হাসির আওয়াজে তপু জেগে উঠল।
দিপু, দিপু।
খুব ফিসফিস করে তপু ডাকল, বল, আমি জেগে আছি।
দিপুর গলাটা কেঁপে কেঁপে উঠল, হাসির আওয়াজ শুনতে পেলি?
হ্যাঁ।
কেউ বোধহয় এ ঘরে ঢুকবে।
কী জানি, বুঝতে পারছি না।
হঠাৎ আবার হাসির শব্দ। একজনের নয়, একাধিক লোকের। মনে হল হাসির আওয়াজটা যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
দিপু পিছনের দেয়ালে কান পাতল। ঠিক পিছন থেকেই যেন শব্দটা আসছে।
তারপর অনেকক্ষণ দুজনের আর ঘুম এল না।
.
খুব জোর একটা আওয়াজ হতে দুজনেই চমকে উঠে বসল।
দরজা খোলা। ঠিক দরজার গোড়ায় চীনেটা দাঁড়িয়ে আছে।
কী, ভালো ঘুম হয়েছিল তো?
দিপু চোখ মুছতে লাগল। তপু একদৃষ্টে চেয়ে রইল চীনের দিকে।
বিনা মতলবে চীনে নিশ্চয় এসে দাঁড়ায়নি।
দিপু চেঁচিয়ে উঠল, কেন তুমি এভাবে আমাদের আটকে রেখেছ?
চীনের হাসি অম্লান। হাসলে মাংসের আড়ালে দুটো চোখ অদৃশ্য হয়ে যায়।
হাসতে হাসতেই বলল, তোমাদের একটা ভালো চাকরি দেব, তাই এখানে রেখেছি। তোমরা যদি আমার কথা শোনো, তাহলে খুব উন্নতি হবে তোমাদের। ভালো জামাকাপড় পাবে, আর পকেট বোঝাই পয়সা। দু-হাতে খরচ করবে। আর কথা যদি না শোনো—
না শুনি তো কী হবে?
হাসি না থামিয়ে চীনে বলল, না শোনো তো—
কথা শেষ না করে সে পা দিয়ে দেয়ালের গায়ে একটা বোতামে চাপ দিল।
সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ঘড় করে একদিকের পার্টিশন সরে গেল। লোহার গরাদ। তার পিছনে একটা চিতাবাঘ গর্জন করে উঠল।
দিপু আর তপু লাফ দিয়ে একপাশে সরে গেল।
ভয় নেই, ভয় নেই জোড়া খোকাবাবু, ওটা বন্ধ রয়েছে। এখন কিছু করতে পারবে না। তবে বোতামটা আর-একটু জোরে টিপলে ওই গরাদগুলোও সরে যাবে, তখন ও এ ঘরে ঢুকে পড়বে তোমাদের সঙ্গে মোলাকাত করতে।
চীনের অসাধ্য কোনও কাজ নেই, সেটা দিপু আর তপু বেশ বুঝতে পারল।
তপু বলল, কী কাজ করতে হবে?
বলব, বলব, সময়ে সব বলব। ব্যস্ত হোয়ো না। তোমাদের বয়সি একটি ছেলে একবার খুব তেজ দেখিয়েছিল; হুঁ হুঁ মাংসটা গেল লালির পেটে, আর হাড়গুলো বস্তাবন্দি করে নদীর জলে ফেলে দিলাম। তাই বলছি, কখনো গুরুজনের অবাধ্য হতে নেই। তোমাদের চা খাওয়ার অভ্যাস আছে তো?
কেউ ভয়ে কোনও উত্তর দিল না।
চীনে একটু বাইরে ঝুঁকে সজোরে হাততালি দিল।
মিনিটকয়েকের মধ্যে বেঁটে কদাকার একটা লোক এসে দাঁড়াল।
চীনে তাকে খুব চেঁচিয়ে বলল, এই চা নিয়ে আয়।
লোকটা চলে যেতে চীনে বলল, এ ব্যাটা আবার বোবা আর কালা। খুব চেঁচাতে হয় আমাকে।
তপু একবার মুখ ধোবার কথা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কী ভেবে সামলে নিল।
চা এল, সঙ্গে আধপোড়া রুটি।
চীনেটা দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রইল।
দিপু আর তপু ভাবল, এইবার চীনেটা বোধহয় আস্তে আস্তে দেশের বাড়ির খোঁজখবর নেবে। ঠিকানা চাইবে। যাতে চিঠি লিখতে পারে।
কিন্তু সেরকম কিছু করল না।
শুধু বলল, আজ রাতে একটু জেগে থেকো খোকারা। আজ থেকেই তোমাদের চাকরিতে লাগিয়ে দেব।
দিপু বলল, কীসের চাকরি?
আরে, বেশি জিজ্ঞাসা কোরো না। বললাম যে ভালো চাকরি। জীবনভর চাকরি করতে হবে।
কথা শেষ করে চীনেটা হাসল।
চীনের এই হাসিতেই ভয় লাগে। এর চেয়ে যদি গালাগাল দিত কিংবা ধমক, দিপু আর তপু সহ্য করত, কিন্তু এই হাসি অসহ্য।
তপু বলল, আমাদের চাকরিতে দরকার নেই, তুমি আমাদের জাহাজেই রেখে এসো।
দূর, তা কি হয়! আগে কেমন মজার চাকরি তা-ই দেখো।
চীনেটা সরে গেল।
বোঝা গেল বাইরে থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তালাচাবি দেবার শব্দও কানে এল।
সারাটা দুপুর একভাবে কাটল। ঠিক বারোটায় রেকাবিতে ভাত আর তরকারি এল। কয়েক গ্রাস মুখে ঠেকিয়েই দুজনে রেকাবি সরিয়ে রাখল।
ঠান্ডা, শক্ত ভাত। বিস্বাদ তরকারি।
দুজনের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এল।
দুপুর কেটে বিকাল হল। বিকালের পর সন্ধ্যা।
রাতের খাওয়া শেষ করে দুজনে সবে শুয়েছে। একটু তন্দ্রার ভাব নেমেছে চোখে, এমন সময় ঝনাৎ করে দরজা খোলার শব্দ হল।
কই হে ওঠো, ওঠো, চাকরি করবে তো উঠে পড়ো।
দুজনে ধড়মড় করে উঠে বসল।
চীনেটা এগিয়ে এসে দু-হাতে দুজনকে ধরল, তারপর আধো-অন্ধকারে পা টিপে টিপে এগোতে আরম্ভ করল।
চারপাশে ঘন আগাছা, ইটের পাঁজা, মাঝখানে সংকীর্ণ রাস্তা। খুব কাছে না গেলে দেখাই যায় না।
চীনে রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, খুব সাবধানে নেমে যাও।
তপু বলল, নামব কী, পথই যে দেখতে পাচ্ছি না।
সঙ্গে সঙ্গে টর্চের উজ্জ্বল আলোয় রাস্তা আলোকিত হয়ে গেল।
দিপু আর তপু দুজনেই দেখল, চওড়া সিঁড়ির ধাপ নীচের দিকে নেমে গিয়েছে।
নামো, নামো, দেরি কোরো না।
তাড়া খেয়ে দিপু আর তপু নামতে শুরু করল। ঘোরানো সিঁড়ি। দু-ধারে কাঠের রেলিং। একেবারে চাতালে নেমে দুজনেই অবাক হয়ে গেল।
টর্চের আলোর আর দরকার নেই। চারদিকে আলোর ব্যবস্থা। দিনের মতন পরিষ্কার।
কাঠের একটা পার্টিশন। তার ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে।
এবার দিপু আর তপু বুঝতে পারল, কাল রাতে এই হাসির শব্দই তারা শুনতে পেয়েছিল।
এবার চীনে একেবারে পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, এসো আমার সঙ্গে। এদিক-ওদিক দেখবার দরকার নেই।
এভাবে সতর্ক না করলে দিপু আর তপু হয়তো কোনওদিকেই দেখত না। সোজা চলে যেত। কিন্তু চীনের কথাতে দুজনেরই সন্দেহ হল। তাহলে এদিকে-ওদিকে নিশ্চয় কিছু দেখবার আছে।
লাল পরদা টাঙানো। শীতের মধ্যেও ভিতরে পাখা ঘুরছে। সেই পাখার বাতাসে মাঝে মাঝে পরদাটা উড়ছে। তার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল।
সামনে পাশার মতন একটা ছক ফেলা। চারদিকে চারজন বসে আছে। পরনে ছোটো ছোটো কোট আর রঙিন লুঙ্গি। মাথাতেও রঙিন কাপড়ের টুকরো বাঁধা।
একটা কৌটায় হাড়ের একটা ঘুঁটি নিয়ে ফেলছে আর যে জিতছে, সে-ই বোধহয় আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে হেসে উঠছে।
চারজনের পাশেই চারটে গড়গড়া। কেউ নলটা হাতে ধরে আছে, কেউ টানছে।
একেবারে দুজনের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়ে বলল, এইখানে তোমাদের কাজ করতে হবে। যারা খেলছে, সেবা করতে হবে তাদের।
সেবা?
সেবা মানে যে লোকগুলো খেলছে তাদের তরিবত করা। সময়ে চা খাবার দেওয়া, অন্য সব ফাইফরমাশ খাটা।
দিপু আর তপু কোনও উত্তর দিল না। বুঝতেই পারল উত্তর দিয়ে কোনও লাভ নেই। চীনে যা বলবে, তা করতেই হবে। অমান্য করলেই সর্বনাশ।
পরের দিন থেকেই দুজনে কাজে লেগে গেল।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কাজের আসল চেহারা মালুম হল। পাঁচ মিনিট অন্তর কালো চা দেওয়া, একটু দেরি হলেই লোকগুলো খেপে খেত। কাছে ডেকে চুলের মুঠি ধরে বেধড়ক প্রহার।
কত রাত পর্যন্ত যে খেলা চলত, তার ঠিক নেই। দিপু আর তপুকে জেগে অপেক্ষা করতে হত আসরের একপাশে।
তারপর সবাই চলে গেলে সেই বোবা আর কালা লোকটা এসে দাঁড়াত। ইঙ্গিতে দুজনকে পিছন পিছন যেতে বলত।
সেই পুরোনো কামরা, পুরোনো খড়ের শয্যা।
দিন পনেরো পরেই বিপদ হল।
যেটা শুধু খেলার আসর বলে দিপু আর তপু মনে করেছিল, কদিনেই বুঝতে পারল সেটা আসলে জুয়ার আড্ডা।
এক-একজন খেলোয়াড়ের পাশে স্তূপীকৃত নোট। খেলার সঙ্গে সঙ্গে সেই নোট হাতবদল করে। যে হারে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, এবং তার সব তাল পড়ে দিপু আর তপুর ওপর।
মাঝরাতে দুজনে কালো চা এনে আসরে রাখছিল। লোকগুলোর তন্ময়তা দেখে মনে হল খেলাটা খুব জোর জমেছে। কেউ কোনও কথা বলছে না। কেবল ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ।
হঠাৎ দুম করে একটা শব্দ। মনে হল বন্দুকের।
সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো পাশে রাখা নিজেদের নোটগুলো নিয়ে পকেটে পুরল।
আবার দুম করে আওয়াজ। এবার যেন আরও কাছে।
একটা লোক হাতের ছোটো লাঠিটা দিয়ে ঝুলন্ত লন্ঠনগুলোর ওপর সজোরে আঘাত করল। লন্ঠনের কাচগুলো ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বাতি নিভে সব অন্ধকার।
দিপু আর তপু বুঝতে পারল, সেই জমাট অন্ধকারে একটা ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে। সবাই যেন একটা দিক লক্ষ করে ছুটেছে।
দিপু অন্ধকারের মধ্যে তপুর হাতটা আঁকড়ে ধরে বলল।
এই তপু, শিগগির ওদের পিছনে পিছনে চল। ওরা অন্যদিক দিয়ে বের হবার রাস্তা জানে।
দুজনে ছুটতে শুরু করল।
ততক্ষণে সিঁড়িতে একটা টর্চের আলো দেখা গেল। টর্চ নিয়ে কে যেন দ্রুত নেমে আসছে।
সেই টর্চের স্বল্প আলোতেই দেখা গেল একটা আলমারি। তার পাল্লা খুলে সবাই ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে।
দিপু আর তপু আর একটুও বিলম্ব করল না। আলমারির মধ্যে ঢুকে পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গেই আলমারির পাল্লা দুটো একেবারে এঁটে বন্ধ হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ দুজনে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে রইল। লোকগুলো কোনদিকে গেল কিছু বুঝতে পারল না।
এটুকু বুঝতে পারল, এতদিন যেটাকে আলমারি ভেবে এসেছে, আসলে সেটা আলমারি নয়, বাইরে যাবার রাস্তা।
বোধহয় কোথাও কোনও স্প্রিং আছে, যার সাহায্যে আলমারির পাল্লা দুটো খোলা এবং বন্ধ করা যায়।
আস্তে আস্তে তপু পা ঘষতে লাগল।
মনে হল ভিতরে যেন ধাপ রয়েছে। নীচে নামবার সিঁড়ি।
দিপু।
উঁ।
মনে হচ্ছে নামবার সিঁড়ি আছে। লোকগুলো এখান থেকেই কোথাও চলে গেছে। আমরা নামবার চেষ্টা করি।
দুজনে হাত আঁকড়ে ধরে খুব সাবধানে পা ফেলে নামতে লাগল।
যেন অনন্ত সোপান। শেষ নেই। বেশ কয়েকবার দুজনেই আছাড় খেতে খেতে সামলে নিল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করল, আবার নামতে শুরু করল।
যত নামতে লাগল, ততই নদীর কল্লোল স্পষ্ট হতে লাগল। নদী তো কাছেই, এই সিঁড়ি বোধহয় নদীতেই শেষ হয়েছে।
ভাববার সঙ্গে সঙ্গেই তপু চেঁচিয়ে উঠল, দিপু।
চেঁচাবার কারণ দিপুর বুঝতে অসুবিধা হল না।
জলে দুজনের গোড়ালি ডুবে গেছে।
তপু বলল, আর এগোলে আমরা তো নদীর মধ্যে গিয়ে পড়ব।
দিপু কিছুক্ষণ কী ভাবল, তারপর বলল, এখানে দাঁড়িয়ে থাকাও তো নিরাপদ নয়। জোয়ারের জল এসে আমাদের ডুবিয়ে দেবে। যদি আমরা সিঁড়ি দিয়ে আরও ওপরে উঠে যাই, তাহলেও বাঁচব না। কতক্ষণ এই অন্ধকার গহ্বরে থাকব?
তপু বলল, তার চেয়ে জল ঠেলে এগোই চল। লোকগুলো তো এই পথেই গেছে।
দুজনে এগোতে আরম্ভ করল।
জল হাঁটুর ওপর। স্রোত দেখে বুঝতে পারল, এ জল নদীর।
বেশ কিছুটা যাবার পর সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে এল।
মাথার ওপর অন্ধকার আকাশ। দু-একটা তারা জ্বলছে।
নদীর প্রায় মাঝবরাবর একটা মোটর লঞ্চ দেখা গেল।
তপু সেইদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, হয়তো লোকগুলো ওই লঞ্চেই পালিয়েছে।
দিপু বলল, খুব সম্ভব, কিন্তু আমরা কী করব?
চল, এপাশ দিয়ে যাই। নদীর জল ছেড়ে আমাদের ডাঙায় উঠতে হবে।
এদিকে জল কম, কিন্তু কাদা হাঁটু পর্যন্ত। খাড়া পাড়।
দুজনে কাদার ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল।
সামনেই একটা জেটি। বোধহয় ব্যবহার হয় না। একদিকটা ভেঙে গেছে।
তপু আর দিপু কাঠে পা দিয়ে দিয়ে সেই জেঠির ওপর উঠল।
সর্বাঙ্গে কাদা, বুক পর্যন্ত ভেজা, ক্লান্ত, অবসন্ন দেহ। আর চলবার শক্তি নেই। জেটির এককোণে একটা ছেঁড়া ত্রিপল পড়ে ছিল, কোনওরকমে গিয়ে দুজনে তার ওপর শুয়ে পড়ল।
ব্যাস, আর চোখ খুলে রাখার ক্ষমতা নেই। দুজনে গাঢ় ঘুমে অচেতন।
কিছু লোকের কলরবে ঘুম ভেঙে গেল।
রোদ উঠেছে। নদীতে বোধহয় জোয়ার। জলের শব্দ খুব জোর।
দুজনে উঠে বসল।
জেটির ওপর কয়েকজন ভদ্রলোক পায়চারি করছে। নানা জাতের লোক। ভারতীয় আছে, বর্মিও আছে। দু-একজনের সঙ্গে ছেলেপুলেরাও রয়েছে।
ছেলেরা অবাক চোখ মেলে তপু আর দিপুর দিকে চেয়ে রয়েছে।
অবশ্য তাদের দোষ নেই। একজন আর-একজনের দিকে চেয়েই বিস্ময়ের কারণ বুঝতে পারল। সারা মুখে কাদা, তখনও জামা-প্যান্ট কিছু ভিজে। কিম্ভূতকিমাকার দুটি মূর্তি।
তপু বলল, এবার? এবার কী করবি?
দিপু উঠে দাঁড়াল।
চল এখান থেকে বেরিয়ে পড়ি। খিদেয় পেটের নাড়িভুঁড়ি পাক দিচ্ছে। অন্ধকার দেখছি চোখে।
আমারও তো সেই অবস্থা।
দুজনে ঝোলানো সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল।
দিপু বলল, আয়, আগে মুখ-হাতের কাদা ধুয়ে ফেলি। এমন অবস্থায় দেখলে সবাই পাগল ভাববে।
তপু বলল, কোথায় ধুবি?
চল, ওই চায়ের দোকানে একটু জল চেয়ে দেখি। নদীতে নামলে আবার তো কাদার ওপর দিয়ে যেতে হবে।
রাস্তার পাশেই ছোটো একটা চায়ের দোকান।
বিরাট এক কেটলি চাপানো। পাশে একটা বড়ো উনানে রুটি সেঁকা হচ্ছে। সে রুটির সাইজও বিরাট।
টিনের চেয়ার-টেবিল। যারা চা-রুটি খাচ্ছে তাদের দেখে শ্রমিকশ্রেণিরই মনে হল।
দুজনে দোকানের এক ছোকরার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
একটু মুখ ধোবার জল দেবে?
ছোকরা একবার মুখটা তুলে ওদের দিকে দেখল, তারপর বলল, বাইরে বালতি আর মগ আছে।
দোকানে ঢোকবার মুখে জলভরা বালতি ছিল। পাশে মগ।
মুখ-হাত ধোয়া শেষ করে দুজনে আবার দাঁড়াল দোকানের সামনে।
ভীষণ খিদে পেয়েছে। যদি কেউ দয়াপরবশ হয়ে একটু চা কিংবা রুটির টুকরো খেতে দেয়। কারো প্লেটের ভুক্তাবশেষ খেতেও আজ তাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু কেউ তাদের দিকে একবার ফিরেও দেখল না।
দু-একজন করে শ্রমিকরা উঠে যেতে লাগল।
এই শোনো।
খুব মোলায়েম কণ্ঠস্বরে দুজনেই চমকে উঠল।
এতক্ষণ শ্রমিকদের ভিড়ের জন্য চোখে পড়েনি। এবার দেখা গেল।
চোখে কালো চশমা, পরনে দামি ছোটো কোট আর লুঙ্গি, একজন বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল, সে-ই কথা বলল।
তবু নিশ্চিত হবার জন্য তপু বলল, আমাদের?
লোকটা এবার কথা নয়, ইশারায় ওদের কাছে ডাকল।
চল, লোকটা কিছু খেতে দিতেও পারে।
দুজনেই আস্তে আস্তে এগিয়ে লোকটার টেবিলের সামনে দাঁড়াল।
অনেকক্ষণ ধরে দেখছি তোমরা দুজনে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছ। কী ব্যাপার বলো তো?
তপু একটু ইতস্তত করল।
দিপু বলল, আমরা এ দেশে নতুন। জাহাজ থেকে নেমে বেড়াচ্ছিলাম, হঠাৎ জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে।
লোকটা ঘাড় নাড়ল।
তা-ই বুঝি? তাহলে তো তোমরা ভীষণ মুশকিলে পড়েছ।
হ্যাঁ, এইবার তপু বলল, কাল থেকে আমাদের পেটে কিছু পড়েনি।
আহা-হা, তাই তোমাদের মুখ এত শুকনো দেখাচ্ছে। বোসো, বোসো, সামনের চেয়োরে বসে পড়ো।
কথা শেষ হবার আগেই দুটো চেয়ার টেনে দুজনে বসে পড়ল।
লোকটা দোকানের ছোকরাকে হাত নেড়ে ডেকে বলল, এই এদের পেট ভরে খাইয়ে দাও তো।
যতক্ষণ দিপু আর তপু খেল, লোকটা বসে বসে কাগজ পড়তে লাগল।
খাওয়া শেষ হতে কাগজটা ভাঁজ করে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলো, তোমাদের একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে আসি।
দিপুর সঙ্গে তপুর দৃষ্টিবিনিময় হল।
অর্থাৎ, আবার কী ব্যবস্থা! নতুন কোনও বিপদের মধ্যে পড়ব না তো?
দীপু ফিসফিস করে বলল, পৃথিবীর সব লোক অসৎ, তা কি হতে পারে? কিছু ভালো লোকও তো আছে।
তপুর সন্দেহ গেল না।
জিজ্ঞাসা করল, আমাদের জন্য কী ব্যবস্থা করবেন?
চীনেটা পরিষ্কার বাংলা বলত, এ লোকটা ভাঙা-ভাঙা বাংলা বলে। ঘোরতর বিপদের মধ্যে না পড়লে এ ধরনের বাংলা শুনলে দিপু আর তপু দুজনেই হাসাহাসি করত।
লোকটা বলল, জাহাজ কোম্পানির সঙ্গে আমার খুব জানাশোনা। তোমাদের কথা তাদের জানিয়ে দেব, যাতে অন্য একটা জাহাজে তোমাদের ভারতবর্ষে ফিরে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেয়।
আবার ভারতবর্ষ, তার মানে অভিভাবকের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো।
যে অপরাধ দুজনে করেছে তাতে এবার হয়তো পিঠের ছালচামড়া তুলে দেবে।
তবু বিদেশে এই অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে, এভাবে বিপদের পর বিপদের ঝুঁকি নেবার চেয়ে, দেশে ফিরে যাওয়াই ভালো।
রাস্তার ওপর কালো একটা মোটর।
লোকটা মোটরের দরজা খুলে বলল, একটু সাবধানে উঠো, ভিতরে আমার অনেক জিনিস রয়েছে।
সত্যিই তা-ই। সিটের ওপরে, নীচে ছোটো-বড়ো অনেক প্যাকেট।
দুজনে গুঁড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকল।
সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে লোকটা দুজনের নাকের ওপর রুমাল চেপে ধরল দু-হাতে। তীব্র ওষুধের গন্ধ। মাথা ঘুরে গেল। আস্তে আস্তে চোখের ওপর কালো যবনিকা নেমে এল।
.