উপন্যাস
গল্প

ভয়ের মুখোশ – ১

চায়ের দোকানের সামনে একটা বেঞ্চ পাতা ছিল। তার ওপর দুজনে একেবারে পাশাপাশি। দিপু আর তপু। দীপক আর তপেন।

দুজনে একই বাড়ির ছেলে। গলির একেবারে কোণে যে লাল রঙের বাড়ি, তারই একতলার ভাড়াটে। খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাই। প্রায় একবয়সি। খুব হিসাব করে দেখলে জানা যায় দিপু তপুর চেয়ে মাস দুয়েকের বড়ো।

পাড়ার হিন্দু নিকেতনে দুজনে আট ক্লাসে পড়ে। পড়ে মানে বইখাতা হাতে করে স্কুলে যায় ওই পর্যন্ত, ক্লাসে বেশিক্ষণ থাকে না। বেরিয়ে পড়ে। তারপর সারাটা দুপুর টোটো করে ঘুরে বেড়ায়।

এখন লোকের বাগান বিশেষ নেই। গাছপালা কেটে কারখানা চালু হচ্ছে। কাজেই পরের বাগানের ফলপাকুড় চুরি করার সুবিধা নেই। খালবিলে মাছ ধরার সুযোগও কম।

দুজনে শহরতলির পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। কোথাও সাধুর ভেলকিবাজি দেখে, কোথাও বানরনাচ, আবার কোনও কোনওদিন বইখাতা মাথায় পার্কে টানা ঘুম লাগায়।

এর জন্য বাড়িতে যে লাঞ্ছনা জোটে না, এমন নয়।

তপেনের বাপ নেই। অনেকদিন মারা গেছে। দিপুর বাবাই অভিভাবক। ধরেন যখন, তখন দুজনকে আধমরা করেন। আস্ত কঞ্চি পিঠের ওপর ভাঙেন।

দিনকয়েক ঠিক থাকে। স্কুলে যায়। বাড়িতে মাস্টারের কাছেও পড়তে বসে। তারপর আবার যে কে সেই।

দিপু-তপুর মায়েরা কান্নাকাটি করে। বিশেষ করে তপুর মা। এখন থেকে যদি লেখাপড়া না করে, এভাবে দুরন্তপনা চালায়, তবে ভবিষ্যতে দুজনে যে দুটি ডাকাত হয়ে উঠবে সে বিষয়ে কারো সন্দেহ নেই।

সেদিন রবিবার। স্কুলের বালাই নেই, লেখাপড়ার পাঠ নয়। ভোরবেলা দু-কাপ চা আর দুখানা রুটি খেয়ে দুজনে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। বেঞ্চে বসে বসে ভাবছে এরপর কী করা যায়।

ন্যাশনাল আয়রন কোম্পানির পিছনের মাঠে বিরাট শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। কলকাতা থেকে বিখ্যাত যাত্রার দল এসেছে। মাথুর পালা হবে।

তপু আর দিপু দুজনেই বসে বসে ভাবছে, বাড়িতে কী বলে তারা দুজনে ওই যাত্রার আসরে গিয়ে বসবে। সারারাতের ব্যাপার। বাড়ি থেকে যেতে দেবে এমন সম্ভাবনা কম।

দিপু বলল, তপু একটা মতলব বের কর।

তপু বসে বসে হাতের আঙুল কামড়াচ্ছিল, আঙুলটা মুখ থেকে বের করে বলল, আমি বলি কী, চলেই যাই দুজনে, ভোর ভোর চুপি চুপি ফিরে আসব এখন।

দিপু মাথা নাড়ল, দূর, তা হবে না। বাবা কীরকম কড়া লোক জানিস তো। রাত্রিবেলা ঘুরে ঘুরে ঘরগুলো একবার দেখবে, আবার ভোরবেলা উঁকি দেবে ঘরে ঘরে। সব ঠিক আছে কি না। রাত বারোটার আগে বাবা শুতে যায় না, আবার ওঠে সেই ভোর চারটেয়।

তপু বলল, ঘরে ঢুকে জ্যাঠা গায়ে হাত দিয়ে তো আর দেখবে না। জানালা দিয়ে দেখবে। আমরা দিব্যি বালিশের ওপর চাদর ঢাকা দিয়ে রাখব। জ্যাঠা বুঝতে পারবে না।

ব্যবস্থাটা দীপকের খুব মনঃপূত হল না। নিজের বাপকে সে খুব ভালো করেই চেনে। পাশবালিশ দিয়ে তাঁকে ঠকানো যাবে না। অন্য কিছু একটা ভাবতে হবে।

কিন্তু অন্য কিছু ভাববার আর সময় পেল না। হইচই-চিৎকার—চমকে রাস্তার দিকে চোখ ফেরাল।

একটা কানা ভিখারি রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাচ্ছিল, লাঠি ঠুকে ঠুকে, হঠাৎ ইট-বোঝাই একটা লরি এসে পড়ল।

দিপু আর তপু যখন গিয়ে পৌঁছোল দেখল চাপ চাপ রক্তের মাঝখানে ভিখারিটা নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে। বেঁচে আছে কি না কে জানে!

লরিটা পালাতে পারেনি। লোকেরা আটকে রেখেছিল।

দিপু আর তপু ধরাধরি করে ভিখারিকে লরির ওপর তুলল। ড্রাইভারকে বলল দ্রুত হাসপাতালের দিকে চালাতে।

মাঝপথ থেকে একটা পুলিশও উঠে বসল ড্রাইভারের পাশে।

শহরের হাসপাতালে যখন গিয়ে পৌঁছাল, তখন দুপুরের রোদ চারদিক জ্বালিয়ে দিচ্ছে। প্রায় আধ ঘণ্টার ওপর অপেক্ষা করার ওপর ভিখারিকে এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হল। দিপু আর তপু বাইরে বসে রইল।

একটা নার্স এসে তাদের সামনে যখন দাঁড়াল তখন প্রায় পাঁচটা। দিপু আর তপু দুজনেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।

কী হল? কেমন আছে?

দিপু প্রশ্ন করল।

নার্স ধীরে ধীরে মাথা দোলাল। খুব মৃদুকণ্ঠে বলল, মারা গেছে। বাঁচানো গেল না।

দিপু আর তপু উঠে দাঁড়াল। ওই কানা ভিখারিকে তারা চিনত। লাঠি হাতে করে বাড়ির দরজায় দরজায় গান গেয়ে ভিক্ষা করে বেড়াত। চমৎকার গানের গলা।

মনে আছে, কতদিন বাড়ির লোকের চোখ এড়িয়ে ভাঁড়ারঘর থেকে দিপু আর তপু চাল-আলু এনে ভিখারির ঝুলিতে ফেলে দিয়েছে।

ভিখারিটা শেষ হয়ে গেল। আর কোনওদিন তার গান শোনা যাবে না।

দুজনে ক্লান্ত পায়ে, পরিশ্রান্ত দেহে যখন বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াল, তখন চারদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে।

দরজার কড়ায় আর হাত রাখতে হল না, দীপকের বাবা লিকলিকে বেত হাতে উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দুজনের ওপর। তারপরই এলোপাথাড়ি মার।

সেই সাতসকালে চা আর রুটি খেয়ে দুজনে বেরিয়েছিল, সারাটা দিন পেটে কিছু পড়েনি, তারপর উদবেগ আর উৎকণ্ঠায় দুজনেই ব্যাকুল ছিল।

চিৎকার করে আসল ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করল, কোনও ফল হল না। রাগ চণ্ডাল, রাগলে দীপকের বাবা চণ্ডালেরও অধম। দুজনের চুলের মুঠি ধরে অবিশ্রান্ত প্রহার। বাড়ির লোক দীপকের বাপকে খুব চেনে, সেইজন্য কেউ বাড়ির বাইরে এল না।

দীপকের বাবা নিজে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়লেন তখন বেতটা উঠানে আছড়ে ফেলে দিয়ে পাশের ছোটো দরজা দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন।

একটা পেঁপে গাছের তলায় দিপু আর তপু নির্জীবের মতন পড়ে রইল। শরীরের অনেক জায়গা কেটে রক্তপাত হচ্ছে। দু-এক জায়গায় কালশিটে পড়েছে। তালু পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ।

এই সময় একটু জল পেলে হত। কিন্তু কোথায় জল? কে দেবে জল?

তপু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল।

টলতে টলতে দিপুর কাছে গিয়ে চাপাকণ্ঠে ডাকল, দিপু, এই দিপু।

দিপু চোখ চেয়েই ছিল, বলল, কী?

এ বাড়িতে আর থাকব না। কোনও কথাই জ্যাঠা শুনতে চাইল না। বেমালুম পেটালে শুধু।

দিপুও উঠে দাঁড়াল। জামা থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, আমারও থাকতে ইচ্ছা করছে না এ বাড়িতে। চল, কোথাও চলে যাই।

কোথায় যাবি?

যে-কোনও দিকে হোক। এ দেশে বনজঙ্গল কম আছে?

বনজঙ্গল যেমন আছে, তেমনই বাঘ-ভালুকও আছে তো।

থাক-না, এভাবে নির্যাতন সহ্য করার চেয়ে, বাঘ-ভালুকের পেটে যাওয়া ঢের ভালো।

ঠিক বলেছিস, চল।

দিপু আর তপু চলতে শুরু করল।

.

রাত তখনও বেশি হয়নি। পথে লোকচলাচল রয়েছে। দিপু আর তপু আলোর সীমানা থেকে সরে অন্ধকার দিয়ে হাঁটতে লাগল, যাতে কারো চোখে না পড়ে। তা ছাড়া আলোয় শরীরের রক্তাক্ত চিহ্নগুলো দেখা যাবে। লোকে হয়তো প্রশ্ন করবে তা নিয়ে। এই এক অস্বস্তিকর অবস্থা।

প্রায় মাইলখানেক চলার পর দুজনে থামল।

আর তাদের চলার শক্তি নেই। সারা দেহে অসহ্য যন্ত্রণা।

দিপু বলল, আর পারছি না রে তপু।

তপুর অবস্থাও তথৈবচ। চলতে চলতে সে পথে অনেকবার দাঁড়িয়েছিল। এমনকী মনে মনে একবার ভেবেওছিল, দিপুকে বলবে বাড়িতে ফিরে যাবার কথা। লজ্জায় পারেনি।

তপু দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আমারও দুটো পা টনটন করছে।

দিপু এদিক-ওদিক দেখল, তারপর উৎসাহের সুরে বলল, আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে।

কী মতলব?

বলছি।

দিপু বলল না। অনেক দূরে হেডলাইট জ্বালিয়ে একটা লরি আসছিল সেইদিকে চেয়ে রইল।

লরিটা কাছে আসতে দিপু দুটো হাত মাথার ওপর তুলে প্রাণপণ শক্তিতে চেঁচাতে লাগল, থামো, থামো। জরুরি দরকার আছে।

ব্রেক কষে লরিটা থামল। একটু দূরে।

দিপু আর তপু দৌড়ে লরির কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

ড্রাইভার জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রশ্ন করল, কী হয়েছে? থামতে বললে কেন?

দিপু বলল, কোথায় যাচ্ছে লরি?

শহরে। খিদিরপুর ডকে।

আমাদের নিয়ে যাবে লরিতে?

ড্রাইভার বিস্মিত হল—তোমরা দুটো বাচ্চা, এই রাতে কোথায় যাবে?

খিদিরপুরেই যাব আমরা। মাসিমার বাড়ি। পয়সা হারিয়ে ফেলেছি, তাই বাসে উঠতে পারছি না। আমরা খিদিরপুরে নেমে যাব।

ড্রাইভার কিছুক্ষণ কী ভাবল। ঝুঁকে পড়ে দুজনকে দেখল, তারপর দরজা খুলে বলল, উঠে বোসো।

দিপু আর তপু দুজনে কেউ হেডলাইটের সামনে যায়নি, পাছে ড্রাইভার তাদের শরীরের অবস্থা দেখতে পায়।

তারা লরির ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল, ড্রাইভার দরজা খুলে দিতেই লাফিয়ে তার পাশে গিয়ে বসল।

তারপর একটানা যাত্রা। মসৃণ পথ। মাঝে মাঝে অন্য যানবাহনের আসা-যাওয়া। ড্রাইভার একমনে গাড়ি চালাচ্ছে।

দিপু আর তপু কেউ কথা বলতে সাহস করল না।

ড্রাইভারই একসময়ে কথা বলল। খুব হুঁশিয়ার হয়ে থাকবে। পকেট থেকে পয়সা চুরি গেল ভারী লজ্জার কথা। শহরে কিন্তু আরও সাবধান হয়ে থাকবে। শহর বড়ো খারাপ জায়গা। চোরজোচ্চেচারদের আস্তানা।

দুজনেই মাথা নেড়ে ড্রাইভারের কথায় সায় দিল।

শহরে যে ক-টা দিন থাকবে, খুবই সাবধানে থাকবে তারা।

তপু জিজ্ঞাসা করল, লরিতে কী যাচ্ছে?

পাট। পাট নিয়ে যাচ্ছি।

কোথায় যাবে পাট?

আমি তো খিদিরপুরের ডকে মাল নামিয়ে দেব। সেখান থেকে জাহাজে উঠে পাট বিলেত চলে যাবে।

দিপু দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

মানুষ না হয়ে পাট হলেই বুঝি ভালো হত। এভাবে মেরে কেউ লোপাট করে দিতে পারত না। তা ছাড়া মহানন্দে ঢেউয়ের বুকে দুলতে দুলতে দেশ-দেশান্তরে পাড়ি দেওয়া যেত।

একটু বোধহয় ঢুলুনি এসেছিল দুজনের, হঠাৎ ড্রাইভারের কথায় চমকে উঠল।

এই তো খিদিরপুর। তোমরা কোথায় নামবে?

দিপু আর তপু চোখ খুলে বাইরে দেখল।

সারি সারি অনেক জাহাজ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু জাহাজ মাঝনদীতেও নোঙর করা রয়েছে। রাত বলে মনেই হচ্ছে না। চারদিকে আলোর রোশনাই।

এখানেই থামাও, আমরা নেমে পড়ি।

লরি থামল। ড্রাইভার দরজা খুলে দিল।

দিপু আর তপু রাস্তার ওপর নেমে দাঁড়াল।

লরিটা অদৃশ্য হয়ে যেতে দিপু বলল, চল, গঙ্গার জলে মুখ-হাত ধুয়ে নিই। রক্ত শুকিয়ে রয়েছে, সেগুলোও মোছা দরকার।

দুজনে সাবধানে ধাপ বেয়ে বেয়ে নেমে গেল।

মুখ-হাত তো ধুলই, আঁজলা করে সেই অপরিষ্কার জলই পান করল।

তারপর দুজনে ইতস্তত মাল-ছড়ানো জেটির ওপর বসল।

তপু বলল, এবার কোথায় যাবি?

জাহাজের মাস্তুলের দিকে চেয়ে দিপু বলল, জাহাজে চড়ে দূরে কোথাও চলে যাব।

তপু আপত্তি করতে যাচ্ছিল, হঠাৎ পিঠের যন্ত্রণাটা বেড়ে উঠল, মনে পড়ে গেল জ্যাঠার অমানুষিক অত্যাচারের কথা।

সে বলল, ঠিক বলেছিস। অনেক দূরে চলে যাব। এ দেশে আর ফিরে আসব না।

দুজনেরই দুঃখ, আজকের দেরিতে বাড়ি ফেরার কারণটা একবার শুনলও না। কিছু বলতেই দিল না। অন্যদিনের কথা অবশ্য আলাদা, কিন্তু আজ তারা কোনও অন্যায় করেনি। ভিখারিটাকে বাঁচাতে অবশ্য পারল না, সে আর কী করবে। পরমায়ু দেবার মালিক তারা নয়, কিন্তু চেষ্টা তো করেছিল। লোক তো ধারেকাছে অনেক জমেছিল, শুধু তারা দুজনেই তোড়জোড় করে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে।

পৃথিবীর কোনও লোক এমন কাজকে অন্যায় বলবে না। বইয়ের পাতায় পাতায় পরোপকারের আদর্শের ব্যাখ্যা থাকে। ক্লাসে শিক্ষকেরা নীতির কত কথা বলেন, অথচ জীবনে এসব করতে যাওয়ার ফল প্রহার।

তপু বুঝতে পারল, তার দুটি চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে।

দিপু উঠে দাঁড়াল।

চল, একটু ঘোরাফেরা করে দেখি।

এক জেটি থেকে বেরিয়ে দুজনে পাশের জেটিতে গিয়ে ঢুকল। এখানেও একটা জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। জেটি ভরতি নানা রকমের কলকবজা। বড়ো বড়ো যন্ত্রপাতি।

একেবারে কোণের দিকে গোল গোল লোহার বাটি। বিরাট আকারের। ওপরে অর্ধেক ঢাকা ডালা।

দিপু উঁকি দিয়ে বলল, ঢুকতে পারবি এর মধ্যে?

তপুও ঝুঁকে একবার দেখল। দিপুর দিকে চেয়ে বলল, তারপর?

তারপর দুজনে জাহাজে উঠব?

সে কী!

দেখ-না। আমি আগে উঠি, তারপর তুই উঠিস।

এদিক-ওদিক চেয়ে দিপু ডালার ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। কুলিরা জেটির ওপর কেউ নেই। রাস্তার ওপর জটলা করছে।

খুব সাবধানে তপুও ঢুকে পড়ল। একটুও শব্দ না করে।

ভিতরে অনেকটা জায়গা। দুজনে গুটিসুটি হয়ে শুতে কোনও অসুবিধা হল না। বরং বাইরের ঠান্ডা হাওয়ার প্রকোপ থেকে বাঁচল।

দুজনে ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ তপুর ঘুম ভেঙে গেল, মনে হল সবসুদ্ধ কে যেন তাদের শূন্যে তুলছে।

প্রথমে সে মনে করল বুঝি ভূমিকম্প, দিপুকে জড়িয়ে ধরে বলল, এই দিপু, দিপু, ভূমিকম্প হচ্ছে।

দিপু একটা হাত তপুর মুখের ওপর চেপে ধরে বলল, চুপ, চেঁচাসনি। ভূমিকম্প নয়।

তবে?

ক্রেনে করে আমাদের জাহাজে ওঠাচ্ছে। আমি অনেকক্ষণ জেগেছি, সব দেখেছি। যেমন শুয়ে ছিলি, তেমনই শুয়ে থাক।

তপু শুয়েই ছিল। দিপুর কথায় আরও সরে এসে কুঁকড়ে শুয়ে রইল, দু-হাত দিয়ে দিপুকে জাপটে ধরে।

বড়ো বাটিটা খুব দুলছে। মনে হল এ দেশের মাটি থেকে দিপু আর তপুকে যেন টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে বিদেশে। সব মায়া, সব সম্পর্ক কাটিয়ে।

খুব জোর একটা শব্দ হল। মনে হল বাটিটা মাটির ওপর কে যেন আছড়ে ফেলল।

দিপু আর তপুর শরীর অসহ্য যন্ত্রণায় কেঁপে উঠল।

বাইরে কুলির স্তিমিত কোলাহল, লোহার চেনের আওয়াজ।

দুজনেরই অদম্য ইচ্ছা হল উঠে একবার অবস্থাটা দেখবে, কিন্তু অনেক কষ্টে কৌতূহল দমন করল।

এখন ধরা পড়ে গেলেই সব মাটি। এই ক্ষতবিক্ষত শরীরের ওপরই আবার হয়তো প্রহার চলবে। দুজনকে টেনে নামিয়ে দেবে জেটির ওপর।

এত রাতে বাড়ি ফিরে যাওয়া অসম্ভব। বাড়ি ফিরে গেলেও সেখানে কী ধরনের অভ্যর্থনা অপেক্ষা করছে, তাও তাদের অজানা নয়।

মনে হল চাকার ওপর বসিয়ে বাটিটাকে কারা যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গড়গড় করে শব্দ।

আবার ঘটাং করে আওয়াজ।

এবার ফাঁক দিয়ে খুব ঠান্ডা বাতাস বইছে। বোধহয় রেলিং-এর ধারে বাটিটা রেখেছে। জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দও শোনা যাচ্ছে।

একটু একটু করে বাইরের হট্টগোল কমে গেল। ঘুম নেমে এল দিপু আর তপুর চোখে।

একসময়ে অনেকগুলো লোকের কথা বলার আওয়াজে দুজনের ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ঠিক কিছু বুঝতে পারল না। মনে হল, নিজেদের বিছানাতেই বুঝি শুয়ে আছে। কিন্তু এত হট্টগোল কীসের? আবার কেউ লরিচাপা পড়ল নাকি, যেজন্য লোকেদের চেঁচামেচি শুরু হয়েছে?

দুজনে প্রায় একসঙ্গেই চোখ খুলল।

দেখল, ডালার ফাঁকে গোটা তিন-চার মুখ উঁকি দিচ্ছে।

ছোটো ছোটো চোখ, শুকনো কঠিন চেহারা, মাথায় সাদা টুপি।

দিপু আর তপু উঠে বসল।

কে তোমরা? এর মধ্যে এলে কী করে?

পরিষ্কার বাংলা ভাষা। উচ্চারণে একটু জড়তা আছে, কিন্তু বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না।

কী? কথা বলছ না কেন? বেরিয়ে এসো, বেরিয়ে এসো।

ঢোকা যত সহজ ছিল, বেরিয়ে আসা মোটেই সহজ নয়। বেরোবার চেষ্টা করতে গিয়েই দিপু আর তপু সেটা বুঝতে পারল।

বাইরে দাঁড়ানো লোকগুলোও বোধহয় বুঝল।

একজন লোহার মতন শক্ত দুটো হাত বাড়িয়ে দিপুকে ধরল, তারপর তাকে টেনে বের করে জাহাজের ডেকের ওপর দাঁড় করিয়ে দিল।

আবার সেইভাবে তপুকেও বাটি থেকে বাইরে নিয়ে এল।

ডেকের ওপর দাঁড়িয়েই দুজনে অবাক।

চারদিকে শুধু জল আর জল। গঙ্গার মতো ঘোলাটে কাদা জল নয়, ফিকে সবুজ জলের রং। মাঝারি আকারের ঢেউ। ঢেউয়ের সঙ্গে ঢেউয়ের ধাক্কায় সাদা ফেনার সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও স্থলের চিহ্নমাত্র নেই।

বিরাট জাহাজ। মাস্তুলে নিশান উড়ছে। কালো একটা চোঙের মধ্য দিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হচ্ছে।

ডেকের ওপর সার দিয়ে দাঁড়ানো একদল লোক। সবার পরনে একই রঙের পোশাক। হাতে লম্বা ঝার। কোণের দিকে অনেকগুলো লাল রঙের বালতি।

যে লোকটা ওদের তুলেছিল, সে এগিয়ে এসে বলল, কই, বললে না কে তোমরা? এর মধ্যে কী করে এলে?

দিপু একবার সকলের মুখের দিকে দেখে নিল, তারপর বলল, আমার নাম দীপক আর ওর নাম তপেন। আমরা দুই ভাই।

দুই ভাই, তা এর মধ্যে কী করে এলে?

জেটিতে যখন এগুলো রাখা ছিল, তখন আমরা এর মধ্যে ঢুকেছি।

কেন?

এ পর্যন্ত বলতে কোনও অসুবিধা ছিল না, কিন্তু এবার কী বলবে?

কী করে বলবে, বাড়িতে মার খেয়ে পালিয়ে এসেছিল? এ দেশের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে বাইরে কোথাও চলে যেতে চেয়েছিল।

দিপুকে চুপ করে থাকতে দেখে লোকটা ধমক লাগাল, কী, চুপ করে আছ যে? কথা বলো।

তপু এতক্ষণ চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হালচাল দেখছিল, এবার এক-পা এগিয়ে এসে বলল, আমাদের কেউ কোথাও নেই। শুধু এক সৎমা আছে, ভীষণ নির্যাতন করে। বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে।

কয়েকদিন আগেই তপু একটা গল্পের বই পড়েছিল। তাতে এক সৎমার অত্যাচারের কাহিনি ছিল। সেটা মনে পড়ে গেল।

মনে হল লোকটার মুখের কঠিন রেখাগুলো একটু যেন সরল হল। চোখের ভাবও কিঞ্চিৎ করুণ।

কিন্তু এভাবে মালের জাহাজে লোক যাওয়ার নিয়ম নেই।

এ কথার দিপু আর তপু কোনও উত্তর দিল না।

ইতিমধ্যে লোকগুলো গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জটলা করছে নিজেদের মধ্যে।

একটু পরে সেই লোকটাই এগিয়ে এল। বলল, চলো, তোমাদের ক্যাপ্টেনের কাছে যেতে হবে।

আগে আগে দিপু আর তপু, পিছনে জন তিনেক লোক সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল।

ডেকের ওপর আবার একটা ডেক। তার মাঝখানে সাদা রঙের ছোটো সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে সবাই আরও ওপরে উঠল।

সিঁড়ির শেষে ছোটো একটা ঘর। গোল কাচের জানলা। ঝকঝকে তকতকে ব্রাসের হ্যান্ডেল দরজার। দরজার গোড়ায় মোটা পাপোশ।

একটি লোক বন্ধ দরজায় আস্তে আস্তে টোকা দিল।

সাব। সাব।

দরজা খুলে গেল।

দীর্ঘ চেহারার একটি লোক দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।

হাঁসের পালকের মতন সাদা ধবধবে পোশাক। সার সার বোতাম বসানো। মাথায় হেলমেট ধরনের টুপি।

এই তাহলে ক্যাপ্টেন।

ক্যাপ্টেন ভ্রূ কুঁচকে বলল, কী হয়েছে?

মেশিন কভারের মধ্যে দুটো ছেলে, সাব।

কী?

ক্যাপ্টেনের কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর।

কয়েক পা এগিয়ে এসে দাঁড়াল কেবিনের চৌকাঠ পেরিয়ে, আর সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ে গেল।

একপাশে জড়াজড়ি করে দিপু আর তপু দাঁড়িয়ে।

আরে, এ তো একদম বাচ্চা।

ক্যাপ্টেন হাতের ইশারায় দুজনকে কাজে ডাকল।

দিপু আর তপু আস্তে আস্তে পা ফেলে সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

কে তোমরা? জাহাজে চড়েছ কেন?

দিপু আর তপুকে কিছু বলতে হল না। দলের লোকটাই বলল, এরা বুঝি দুই ভাই সাব। বাড়িতে মা-র অত্যাচারের জন্য পালিয়ে এসেছে।

কিন্তু জাহাজে উঠলে জাহাজের ভাড়া দিতে হবে।

তপু আর দিপু হিসাব করল।

তপুর পকেটে আট আনা আছে, আর দিপুর পকেটে একটা সিকি। টিফিনের পয়সা থেকে বাঁচানো। একজনের কাছে কত আছে, আর-একজনের জানা।

তা-ই তপু বলল, আমাদের কাছে বারো আনা আছে। এতে আপনার জাহাজের ভাড়া হবে?

রাগ করতে গিয়েও ক্যাপ্টেন হেসে ফেলল।

ক্যাপ্টেন বাঙালি নয়, কিন্তু বাংলায় কথা বলতে পারে। ভাঙা ভাঙা বাংলা। বুঝতেও পারে।

হাসি চেপে বলল, এ জাহাজ প্রথমে রেঙ্গুন যাবে। একজনের ভাড়া ডেকে পঁচিশ টাকা। দিতে পারবে?

প্রায় একসঙ্গে দিপু আর তপু মাথা নাড়ল, না।

তাহলে?

তাহলে কী হবে দিপু-তপুর জানা নেই। কী নিয়ম জাহাজের? জলে ফেলে দেয় বিনা টিকিটের যাত্রীদের?

যা ইচ্ছা করুক। এভাবে আর পারছে না। ক্লান্তিতে সারা দেহ ভেঙে পড়ছে। যা-ই করুক—মেরে ফেলে দিক, জলে ফেলুক, তার আগে দুজনকে পেট ভরে অন্তত খেতে দিক। তা না হলে, অসহ্য ক্ষুধার জ্বালাতেই দুজনে মারা যাবে।

কী ব্যাপার, ভিড় কীসের এত?

পিছন থেকে ভারী গলার আওয়াজে চমকে দিপু আর তপু মুখ ফেরাল।

বেশ মোটাসোটা চেহারা, গোলগাল মুখ, মাথাটা ডিমের মতন মসৃণ। একগাছা চুল নেই। চোখে চশমা।

ক্যাপ্টেন উত্তর দিল, এই যে ডাক্তার, আপনার দেশের লোকের কাণ্ড দেখুন।

কী হল?

ডাক্তার ঠিক দিপু আর তপুর পিছনে এসে দাঁড়াল।

রাত্রিবেলা চুপি চুপি কখন মেশিন কভারের মধ্যে ঢুকে বসে ছিল। বিনা ভাড়ায় জাহাজ চড়বার শখ।

ডাক্তার চোখ ফিরিয়ে দিপু আর তপুকে দেখল, তারপর বলল, আমাদের দেশের ছেলেরাই তো এসব করে। পাহাড়-পর্বত লীন করে, ময়ূরপঙ্খি ভাসায় ঢেউয়ের বুকে, গুলির সামনে বুক পেতে দেয়। কিন্তু এরা দেখছি নিতান্ত বাচ্চা।

কিন্তু মাঝদরিয়ায় এদের নিয়ে কী করা যায়?

উপস্থিত এদের চেহারা দেখে যা বুঝছি, অনেকক্ষণ বোধহয় পেটে কিছু পড়েনি। এদের কিছু খাওয়াবার বন্দোবস্ত করো।

ক্যাপ্টেন হেসে বলল, তারপর?

তারপর আর কী, রেঙ্গুনে পৌঁছাবার পর ফিরতি জাহাজে যাদের বাছা তাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। কই, এসো তোমরা আমার সঙ্গে।

ডাক্তারের পিছন পিছন দিপু আর তপু সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল।

জাহাজের সামনের দিকে মাঝারি সাইজের একটা কেবিন।

ঢুকেই দিপু আর তপু অবাক হয়ে গেল।

ভিতরে এলে মনে হয় যেন কোনও সাজানো বাড়ির কামরা। জাহাজের মধ্যে আছে তা মনেই হয় না।

একদিকে ধবধবে বিছানা পাতা। দেয়াল আলমারি। গোল টেবিলের দু-পাশে দুটো চেয়ার।

ডাক্তার বিছানার ওপর বসল। তার নির্দেশে দিপু আর তপু দুটো চেয়ারে বসল।

নাম কী তোমাদের বলো তো এইবার।

কী জানি কেন, বোধহয় ডাক্তারের কথা বলার ভঙ্গিতে, দিপু আর তপু দুজনেরই মনে হল যেন নিরাপদ একটা আশ্রয়ে এসেছে। আর ভয়ের কোনও কারণ নেই। এমন একটা মানুষের কাছে নিশ্চিন্তে মনের কথা বলা যায়।

তাই দিপু বলল, আমার নাম দীপক সেন, ওর নাম তপেন সেন। তপেন আমার খুড়তুতো ভাই।

তা বেশ তপেনবাবু, মাঝরাত্রে ওভাবে হাঁড়ির মধ্যে ঢুকতে গেলে কেন?

তপু ভেবেছিল ডাক্তারের কাছে সত্যি কথাটা বলবে, কিন্তু একটু ভেবেই সাবধান হয়ে গেল।

কিছু বলা যায় না, সকলের কাছে এক ধরনের কথা বলাই ভালো। এক-একজনের কাছে এক-এক রকমের কথা বললে ধরা পড়ে যাবে। কেউই তাদের বিশ্বাস করবে না।

তাই সৎমার নির্যাতনের কথাটাই আবার বলল।

কিন্তু বিদেশে গিয়ে তোমরা করবে কী? লেখাপড়া এমন জানো না যে চাকরি করবে। হাতেকলমে কোনও কাজ জানো না যে কারখানায় কাজ পাবে।

তপু বলল, আমরা অত কথা কিছু ভাবিনি। রাগের মাথায় বেরিয়ে এসেছি।

এমন সময় দরজা ঠেলে একটা লোক ঢুকল।

তার হাতে একটা ট্রে। তাতে দু-কাপ দুধ, অনেকগুলো পাঁউরুটির টুকরো, দুটো ডিমসেদ্ধ আর একরাশ ফল।

লোকটা সেগুলো টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখার আগেই দিপু আর তপু সাগ্রহে জিনিসগুলো টেনে নিল।

কিন্তু খেতে যাবার মুখেই বিপদ।

একটু দাঁড়াও। ডাক্তারের গম্ভীর গলার স্বর।

দুজনেই চমকে উঠল। আবার কী হল? খাওয়ার ব্যাপারে জাহাজের জন্য কোনও নিয়ম আছে নাকি!

তপু, তোমার হাতে লালচে দাগটা কীসের?

শুধু হাতে। অবশ্য হাতটাই দেখা যাচ্ছে। পিঠ আর বুক তো জামায় ঢাকা।

দিপু উঠে দাঁড়িয়ে শার্টটা টেনে খুলে ফেলল, ডাক্তারের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, দেখুন পিঠের অবস্থা। সারা পিঠ জুড়ে কালশিটে আর রক্তাক্ত আঁচড়।

দিপুর দেখাদেখি ততক্ষণে তপুও জামা খুলে ফেলেছে। তার পিঠেরও একই অবস্থা।

ইস! আহা, কচি ছেলেকে এভাবে কেউ মারে!

ডাক্তার দাঁড়িয়ে উঠে দেয়াল আলমারি খুলে তুলো আর ওষুধ বের করল, তারপর খুব সাবধানে তপু আর দিপুর আঘাতচিহ্নের ওপর লাগিয়ে দিল।

ওষুধ লাগানো হতে দুজনে খেতে বসল।

অত খাবার শেষ হতে মিনিট দশেকের বেশি লাগল না। পেটের মধ্যে যে যন্ত্রণা মোচড় দিয়ে উঠছিল, সেটার উপশম হল।

এবার তোমরা বাইরের ডেকে চলে যাও। তোমাদের থাকার ব্যবস্থা একটা করছি।

দুজনে বেরিয়ে এল।

বেরিয়ে এসেই অবাক।

ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেবিনে বাতি জ্বলছিল বলে কিছু বোঝা যায়নি।

আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। জল এখন আর ফিকে সবুজ নয়, গাঢ় কালো। ঢেউয়ের আকার দারুণ বেড়েছে। হাওয়ার বেগের জন্য এগোনোই দুঃসাধ্য। ঠেলে যেন পিছনে হটিয়ে দিচ্ছে।

একটা লোক দৌড়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, ওদের দেখে বলল, নীচে চলে যাও তোমরা। ভীষণ ঝড় উঠছে।

নীচে? নীচে আর কোথায় যাবে? এ জাহাজের কোথায় কী আছে কিছুই তাদের জানা নেই। জানার অবকাশই পায়নি।

ছুটতে ছুটতে তারা সিঁড়ি দিয়ে নীচে চলে এল। একেবারে জাহাজের খোলে।

নেমেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

বিশ্রী একটা গন্ধ। অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে যাবার দাখিল।

একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে দেখল, একগাদা ছাগল বাঁধা রয়েছে। এদিকে খাঁচার ওপর খাঁচা। তার মধ্যে মুরগি, হাঁস আর কুঁকড়ো।

গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকাই মুশকিল।

কিন্তু ওপরে ওঠবারও উপায় নেই। বোঝা গেল জাহাজটা বেশ দুলছে। একবার এদিক থেকে ওদিক, আর-একবার ওদিক থেকে এদিক।

দোলার সঙ্গে পাঁঠা, মোরগ, হাঁসের ঐকতানে কানে তালা ধরবার জোগাড়।

দুজনে নাক চেপে সিঁড়িতেই বসে পড়ল।

একটু আগে যেসব সুখাদ্য পেটে গিয়েছিল, সেগুলো পাক দিয়ে উঠতে লাগল। গন্ধে আর জাহাজের দোলানিতে।

দু-হাতে মুখ চেপে ধরে দুজনে বমির বেগ সামলাল।

প্রায় আধ ঘণ্টার ওপর একভাবে চলল, তারপর মনে হল জাহাজ যেন একটু সামলে নিল। বোধহয় ঝড়ের বেগ কম।

ওরা সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল।

সমস্ত ডেকটা ভিজে গিয়েছে। বোধহয় প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছিল।

এক জায়গায় কুণ্ডলী-পাকানো ম্যানিলা দড়ি ছিল, দুজনে তার ওপর গিয়ে বসল।

সকালের মতন একদল লোক লম্বা ঝার দিয়ে ঠেলে ঠেলে জল ফেলে দিতে লাগল রেলিংয়ের ফাঁকে।

একটা লোক কাছে আসতে তপু জিজ্ঞাসা করল, খুব বৃষ্টি হয়ে গেছে বুঝি?

ঝার রেখে লোকটা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, বৃষ্টি কোথায়? এ তো ঢেউয়ের জল।

ঢেউ?

হ্যাঁ, ঝড়ের সময় ঢেউয়ের সাইজ তিনতলা-চারতলা পর্যন্ত হয়। এদিক দিয়ে ঢেউ উঠে ওদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়।

বিস্ময়ে দিপু আর তপু অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না।

কিছুক্ষণ পরেই দমকলের ঘণ্টার মতন ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতে লাগল।

দিপু আর তপু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল।

সর্বনাশ, জাহাজে আবার আগুন লাগল নাকি?

সবাই ঝার-বালতি সরিয়ে সার হয়ে দাঁড়াল, তারপর চলতে শুরু করল।

দিপু আর তপুর পাশ দিয়ে যেতে যেতে একজন বলল, চলো, খাওয়ার ঘণ্টা পড়েছে। খেতে যাবে না?

ওটা দমকলের ব্যাপার নয়, খাওয়ার ঘণ্টা। দিপু আর তপু একটু আশ্বস্ত হল। দুজনে আর সকলের পিছন পিছন হাঁটতে আরম্ভ করল।

এভাবে দু-দিন দু-রাত কাটল।

শোবার জন্য দুজনে একটা কেবিন পেয়েছে। ডাক্তারের কেবিনের মতন অমন চমৎকার সাজানো নয়। শুধু দুটো বিছানা, আর একটা আয়না।

ওদের পক্ষে এই যথেষ্ট।

.