একুশ
ছ’টা পর্যন্ত সময়টুকু দ্রুত ফুরিয়ে গেল। জিমে গিয়ে ফুটবল ইউনিফর্ম পরে নিলাম অন্যান্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে।
সারি বেঁধে দাঁড়ালাম আমরা, দৌড়ে বাইরে বেরোতে প্রস্তুত। দর্শকরা ইতোমধ্যেই হৈ-চৈ করছে আর ব্যাণ্ডের বাজনার তালে তালে হাততালি দিচ্ছে। মুসা আমার কাছে হেঁটে এল।
‘এখনও কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত নাকি তুমি?’ প্রশ্ন করল।
‘মুসা, আমি এখন ক্যাপ্টেন। কাজেই দলের কারও যেন কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ রাখব আমি। কথা দিচ্ছি।’
‘তুমি কী বলতে চাইছ ঠিক বুঝতে পারছি না আমি,’ বলল মুসা। ‘কিন্তু আমি সব সময় তোমার সঙ্গে আছি।’
ওকে ধন্যবাদ দিলাম। একটু পরে কোচ হুইস্ল্ বাজাতেই আমরা এক সারে দাঁড়ালাম। সবার সামনে আমি, সহখেলোয়াড়রা ক্রমিক অনুসারে পিছনে।
‘তোমরা এখন ভক্তদের সামনে যাবে,’ বললেন কোচ। তিনি দরজা খুলে দিলে সবার আগে ছুটে বেরোলাম আমি।
প্রথমটায় অল্প কিছু লোক দাঁড়িয়ে ছিল জিমের পাশে। আমাদেরকে দেখা মাত্র হর্ষধ্বনি করে হাত নাড়ল তারা।
এবার বাঁক নিয়ে, স্কুলের সামনের এলাকায় পা রাখলাম আমরা। জনতা গর্জে উঠল। ব্যাণ্ড আমাদের সামনে, মার্চিং সুর বাজাচ্ছে। স্ট্যাণ্ডের জনতা উঠে দাঁড়িয়ে শিস বাজাচ্ছে, তালি দিচ্ছে।
উৎফুল্ল জনতার পাশ দিয়ে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে চলেছি, ব্যাণ্ডের সামনের দিকে চাইলাম। ব্যাণ্ড এখন জনতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমরা দৌড়ে গিয়ে ওদের পিছনে দাঁড়াব, তারপর কোচ ও মিসেস পিয়ার্স বক্তব্য রাখার পর ব্যাণ্ড আবার বাজাতে থাকবে, এবং আমরা ওদের আগে আগে দৌড়ে যাব, দর্শকদের হাততালি কুড়োতে কুড়োতে।
ডনকে খুঁজলাম। সামনে, ব্যাণ্ডস্ট্যাণ্ডের কাছে দাঁড়িয়েও, মিসেস পিয়ার্সের ঠিক পাশে। আমার দিকে চেয়ে হাসল। শয়তানী হাসি, কেননা একটু পরই নরক ভেঙে পড়বে আমাদের উপর, যদি না আমি একটা কিছু করি।
দর্শকরা তখনও চেঁচাচ্ছে। হঠাৎই একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। এতে কাজ হতে পারে! আমাদের কোয়ার্টারব্যাক জন স্যামসনের দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম।
‘অ্যাই, জন, ইয়ার প্লাগ সঙ্গে আছে?’ প্রশ্ন করলাম।
‘মনে হয়। কেন?’
দির্শকরা কানের পোকা নড়িয়ে দিল,’ বললাম। জন হেসে উঠে, পকেটে হাত ভরে দুটো খুদে ইয়ার প্লাগ বের করে দিল। টিমের কোয়ার্টারব্যাক সাধারণত ইয়ারপ্লাগ পরে, খেলার মধ্যে সিগন্যাল কল করার সময়। এর ফলে দর্শকদের চেঁচামেচি তাকে বাধা দিতে পারে না।
‘ধন্যবাদ, জন,’ বলে ইয়ার প্লাগজোড়া নিলাম। ‘পেপ র্যালির পর ফেরত দেব।’
আমরা এখন সার বেঁধেছি এবং দর্শকরা শান্ত হয়ে গেছে। যার যার আসনে বসে রয়েছে।
মিসেস পিয়ার্স মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
‘প্রাণঢালা সাপোর্টের জন্যে ধন্যবাদ সবাইকে,’ বললেন। জনতা হর্ষধ্বনি করে উঠল। ‘আমরা আপনাদের সামনে এবছরের রকি বীচ ফুটবল টিম আর মার্চিং ব্যাণ্ডকে উপস্থাপন করলাম। ওরা আপনাদের সামনেই দাঁড়িয়ে। লেট’স স্ট্রাইক আপ দ্য ব্যাণ্ড!’
বাজনা শুরু করল ব্যাণ্ড দল। জনতা হাততালি দিয়ে গলা মিলিয়েছে, এসময় আমি তাদের মনোভাবের পরিবর্তন টের পেলাম। দর্শকরা আর হাততালি দিচ্ছে না। তার বদলে কেউ কেউ একে অপরকে ঠেলাঠেলি করছে।
অন্যরা ফুটবল মাঠে লাফিয়ে নেমে, দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। ঘুরে দাঁড়ালাম। সব দিক থেকে যেন বাঁশির শব্দ কানে আসছে। কিন্তু আসলে একটা বাঁশিই বাজছে। এবং ওটা বাজাচ্ছে একজন। স্ট্যাণ্ডের মাথায় দাঁড়িয়ে ইংরেজি সুরটা লাউডস্পিকারে বাজিয়ে চলেছে ডন। অন্যান্য যন্ত্র চাপা পড়েছে ওর বাঁশির শব্দে।
হঠাৎই মনে হলো ইউনিফর্ম ছিঁড়ে ফেলে এক দৌড়ে কাছের গাছটায় উঠে পড়ি। এবার ইয়ার প্লাগজোড়া বের করলাম! দু’কানে দুটো লাগালাম। মুহূর্তে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এল। বাঁশির শব্দ নেই। আমার উন্মাদনাও নেই।
ডন এখনও বাঁশি বাজাচ্ছে। তবে এখন ও স্ট্যাণ্ড থেকে নেমে মাঠের দিকে গট-গট করে এগোচ্ছে। ‘ চোখজোড়া বিস্ফারিত, তাতে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। যারা শুনছে তাদেরকে বাঁশির বশ করে ফেলছে।
ওকে থামাতে হবে এবং এখুনি!
বাইশ
সবাই, খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ব্যাণ্ড সদস্যরা, স্ট্যাণ্ডে উপস্থিত অভিভাবকরা, ফ্যাকাল্টি সদস্যরা, প্রত্যেকে উন্মত্ত আচরণ করছে। কেউ স্বাভাবিক নয়। সবাই কিছু না কিছু উদ্ভট কাজ করার চেষ্টা করছে। কয়েকজন মাঠের উপরে ভাসছে, গোল হয়ে ঘুরছে!
আমি জানি ডন যদি টের পায় আমি বাঁশির বশীভূত হইনি তা হলে আমাকে বশ করার কোন না কোন উপায় বের করে ফেলবে। কাজেই আমি ভান করলাম বশ হয়ে গেছি। চক্রাকারে ঘুরতে লাগলাম। কিন্তু প্রতি চক্করে কাছিয়ে যাচ্ছি ডনের দিকে।
ক্রমেই ওর নাগাল ধরে ফেলছি। এখন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। বাঁশিটা কেড়ে নিতে পারলে সমস্ত পাগলামি বন্ধ করতে পারব।
হাত বাড়িয়ে কেড়ে নিতে যাব, আচমকা এসময় অ্যান্টিক স্টোরের মালিক মি. রনসন আমার দিকে আঙুল তাক করে দৌড়ে এলেন, চেঁচাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে জ্যাক আর ব্যাঙ্কের অন্য কয়েকজন গার্ড। ডন আর তার বাঁশিকে রক্ষা করতে এসেছে এরা সবাই।
আমাকে পালাতে হবে। এক দৌড়ে জনতার ভিড়ে মিশে গিয়ে ওদের হাত এড়ালাম। কিন্তু সে সঙ্গে ডনকেও হারিয়ে ফেললাম। দর্শকদের সবাইকে উন্মাদ করে তুলেছে ও। এবার ওকে দেখতে পেলাম। শহরের প্রান্তসীমার বনভূমির উদ্দেশে চলেছে ও।
ডন সবাইকে নিয়ে ওদিকে যাচ্ছে কেন, ভাবলাম। এবার ওটা চোখে পড়ল। হৃৎপিণ্ড জমে গেল। বনভূমির উপরে কুয়াশা জমাট বাঁধছে। ডন শহরের মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একশো বছর আগে হ্যারিসের শহরের লোকদের কপালে ঠিক যা ঘটেছিল!
ডন যেন হ্যামিলনের বাঁশিবাদক। মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে শ্রোতাদের। জিন্দালাশের মত সবাই ডনকে অনুসরণ করে বনভূমির দিকে চলেছে-যেটা এখন পুরোপুরি ঢাকা পড়েছে কুয়াশার চাদরে।
এতটাই ভিড়, ওর কাছে যেতে পারলাম না। লোকজন একদৃষ্টে চেয়ে, পলকহীন, ডনের বাঁশির তালে তালে হাঁটছে। ঘন কুয়াশা থেকে আমরা এখন মাত্র ক’গজ দূরে। ডন থেমে দাঁড়াল, কিন্তু অন্যরা হেঁটেই চলল কুয়াশা লক্ষ্য করে। আমি যদি এখুনি কিছু একটা না করি তবে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে মানুষগুলো।
পথের সামনে যারা পড়ল তাদেরকে ঠেলে সরালাম। কাউকে কাউকে ফুটবল হেলমেট ব্যবহার করে ফেলে দিলাম। যা করছি সবার ভালর জন্যই।
ডনকে থামাতে হবে। এখুনি। ক্রমেই কাছিয়ে যাচ্ছি আমি। ওর চোখজোড়া এখন বড় বড় আখরোটের সমান। অন্য ভুবনের দৃষ্টি। ডজন ডজন লোক মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার মধ্যে। আর সময় নেই। যা করার করে ফেলতে হবে। হাত বাড়িয়ে দিলাম। ডন আমার দিকে চাইল, বিস্মিত। এবার সে কাজটাই করলাম, ডনকে থামাতে হলে একমাত্র যেটা করা যায় বলে ভেবেছি। পকেটে হাত ভরে দিলাম। হ্যারিসের মায়ের দলিলের এক মুঠো ছাই নিয়ে ছুঁড়ে দিলাম বাঁশিটার উপরে!
তেইশ
ধোঁয়ার রেখা উঠল। তারপর দেখা গেল ডনের হাতে কিছু নেই, স্রেফ কালো ছাই। বাঁশিটা, দলিলের মত ছাইয়ে পরিণত হয়েছে। এবং মুহূর্তে, ঘন কুয়াশা মিলিয়ে গেল।
আমার চারধার থেকে মানুষজন বেরিয়ে আসছে। যারা কুয়াশার ভিতরে ঢুকেছিল তারা এখন স্বচ্ছ বাতাসে দাঁড়িয়ে। চোখ পিটপিট করছে, চারধারে দৃষ্টি বুলাচ্ছে-বিভ্রান্ত।
কান থেকে প্লাগ টেনে খুললাম। সবাইকে কেমন যেন হতভম্ব দেখাচ্ছে।
‘কী হলো?’ মিসেস পিয়ার্স প্রশ্ন করলেন। ‘আমরা মাঠ আর গ্র্যাণ্ডস্ট্যাণ্ড ছেড়ে এখানে কেন? এখানে এলাম কীভাবে?’
ব্যাখ্যা করার উপায় নেই, কাজেই চুপ করে থাকলাম। সবাই শ্রাগ করে, কী সব আওড়ে, স্কুলের মাঠের উদ্দেশে পা বাড়াল।
ডনের দিকে চাইলাম। চাচা-চাচীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ও। তিনজনই হতচকিত।
‘কী ব্যাপার, ডন?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘মনে হচ্ছে কিছু একটা হারিয়েছ?’
‘ওর বাঁশিটা হারিয়ে গেছে,’ চাচী বলল।
‘তাতে কিছু যায় আসে না,’ বলল ডন। ‘পাওয়া যাবে। অবশ্য জিনিসটা আমার এমন কিছু প্রিয় ছিল না।’
ডন আবার আগের মত স্বাভাবিক কথা-বার্তা বলছে, আচরণ করছে।
‘মাঠের দিকে যাওয়া যাক,’ রাশেদ চাচা বলল। আমরা ঘুরে দাঁড়িয়ে মাঠের উদ্দেশে চললাম। ডন যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিকে শেষবারের মত ঘাড় ফিরিয়ে চাইলাম। মাটিতে ছাই পড়ে। এবার
আবার সবার সঙ্গে হাঁটা দিলাম। হঠাৎই শব্দটা কানে এল। বাঁশির অস্পষ্ট সুর। ঘুরে আবারও পড়ে থাকা ছাইয়ের দিকে চাইলাম। এসময় দমকা বাতাসে ছাইগুলো উড়ে গেল আকাশে। হারিয়ে গেল গাছ-পালা এবং অরণ্যের মাঝে।
চিরদিনের জন্য, আশা করি।
***