বড় দিন
বাইবেলে বলা হয়েছে পুব থেকে তিন জন ঋষি প্যালেস্টাইনের জুডেয়া প্রদেশের রাজা হেরোডের কাছে উপস্থিত হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘ইহুদিদের নবীন রাজা কোথায় জন্ম নিয়েছেন? আমরা পূর্বাকাশে তাঁর তারা দেখতে পেয়ে তাঁকে পুজো করতে এসেছি।’
সেই তারাই তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল বেৎলেহেম– যেখানে প্রভু যিশু জন্ম নিয়েছিলেন। মা মেরি আর তাঁর বাগদত্ত যোসেফ পান্থশালায় স্থান পাননি বলে আশ্রয় নিয়েছিলেন পান্থশালার অশ্বালয়ে। তারই মাঝখানে কুমারী মেরি জন্ম দিলেন এ জগতের নব জন্মদাতা প্রভু যিশুকে।
দেবদূতরা মাঠে গিয়ে রাখাল ছেলেদের সুসংবাদ দিলেন প্রভু যিশু, ইহুদিদের রাজা জন্ম নিয়েছেন। তারাও এসে দেখে, গাধা-খচ্চর, খড়-বিচুলির মাঝখানে মা জননীর কোলে শুয়ে আছেন রাজাধিরাজ।
এই ছবিটি এঁকেছেন যুগ যুগ ধরে বহু শিল্পী, বহুকবি, বহু চিত্রকর। নিরাশ্রয়ের ঘরে এসে আশ্রয় নিলেন বিশ্বজনের আশ্রয়দাতা।
***
বাইরের থেকে গম্ভীর গুঞ্জরণ শুনে মনে হল বিদ্যালয়ের ভিতর বুঝি তরুণ সাধকেরা বিদ্যাভ্যাস করছেন। জানা ছিল টোল-মাদ্রাসা নয়, তাই ভিতরে ঢুকে ভিরমি যাইনি।
ক’শ নারী-পুরুষ ছিলেন আদমশুমারি করে দেখিনি। পুরুষদের সবাই পরে এসেছেন ইভনিং ড্রেস। কালো বনাতের চোস্ত পাতলুন– তার দু দিকে সিল্কের চকচকে দু ফালি পট্টি; কচ্ছপের খোলের মতো শক্ত শার্ট, কোণভাঙা কলার– ধবধবে সাদা; বনাতের ওয়েস্ট কোট আর কোটের লেপেলে সেই সিল্কের চকচকে ট্যারচা পট্টি; কালো বো ফুটে উঠেছে সাদা শার্ট কলারের উপর যেন শ্বেত সরোবরে কৃষ্ণা কমলিনী। পায়ে কালো বার্নিশের জুতো– হাতে গেলাস।
কিংবা শার্ক স্কিনের ধবধবে সাদা মসৃণ পাতলুন। গায়ে গলাবন্ধ প্রিন্স কোট’ সিস-সিলিন্ডারি অর্থাৎ ছ-বোমওয়ালা। কারও বোম হাইদ্রাবাদি চৌকো, কারও বা বিদরী গোল কালোর উপরে সাদা কাজ। একজনের বোতামগুলো দেখলুম খাস জাহাঙ্গীর-শাহি মোহরের হাতে গেলাস।
তারি মধ্যিখানে বসে আছেন এক খাঁটি বাঙালি নটবর। সে কী মোলায়েম মিহি চুনট করা শান্তিপুরে ঘি রঙের মেরিনার পাঞ্জাবি আর তার উপরে আড়করা কালো কাশ্মিরি শালে সোনালি জরির কাজ। হীরের আংটি-বোম ম্যাচ করা, আর মাথায় যা চুল তাকে চুল না বলে কৃষ্ণমুকুট বললেই সে তাজমহলের কদর দেখানো হয়। পায়ে পাম্প– হাতে গেলাস।
‘দেশসেবক’-ও দু-একজন ছিলেন। গায়ে খদ্দর– হাতে? না, হাতে কিছু না। আমি আবার সবসময় ভালো করে দেখতে পাইনে– বয়স হয়েছে।
কিন্তু এসব নস্যি। দেখতে হয় মেয়েদের। ব্যাটাছেলেরা যখন মনস্থির করে ফেলেছে, সাঁঝের ঝোঁকে সাদা-কালো ভিন্ন অন্য রং নিয়ে খেলা দেখবে না তখন এই দুই স্বর সা আর রে দিয়ে কী ভেল্কিই-বা খেলবে?
হোথায় দেখো, আহা-হা-হা। দুধের উপর গোলাপি দিয়ে ‘ময়ূরকণ্ঠী-বাঙ্গালোরি’ শাড়ি! জরির আঁচল। আর সেই জরির আঁচল দিয়ে ব্লাউজের হাতা। ব্লাউজের বাদবাকি দেখা যাচ্ছে না, আছে কি নেই তাই বলতে পারব না। বোধহয় নেই– না থাকাতেই সৌন্দর্য বেশি। ফরাসিরা কি এ জিনিসকেই বলে ‘দোকোলতে’? বুক-পিঠ-কাটা মেমসায়েবদের ইভনিং ফ্রক এর কাছে লজ্জায় জড়সড়।
ডান হাতে কনুই অবধি সোনার চুড়ি– বাঁ হাতে কবজের মতো বাঁধা হোমিওপ্যাথিক রিস্টওয়াচ। আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘ডিনারের কত বাকি? কটা বেজেছে?’ বলেই লজ্জা পেলেন, কারণ ভুলে গিয়েছিলেন নিজের হাতেই বাঁধা রয়েছে ঘড়ি। কিন্তু ‘লাল’ হলেন না, কারণ রুজ আগেভাগেই এত লাল করে রেখেছে যে, আর লাল হবার ‘পার্কিঙ প্লেস’ নেই।
হাতে? যান মশাই, আমার অতশত মনে নেই। হালকা সবুজ জর্জেটের সঙ্গে রক্তরাঙা ব্লাউজ। কপালে সবুজ টিপ। শাড়ির সঙ্গে রং মিলিয়ে বাঁ হাতে ঝুলছে ব্যাগ কিন্তু ব্যাগের স্ট্র্যাপটার রং মেলানো রয়েছে রক্তরাঙা ব্লাউজের সঙ্গে এবং তাকে ফের মেলানো হয়েছে স্যান্ডেলের স্ট্র্যাপের সঙ্গে। আর কোথায় কোথায় মিল অমিল আছে দেখবার পূর্বেই তিনি সরে পড়লেন। ডান হাতে কিছু ছিল? কী মুশকিল!
আরে! মারোয়াড়ি ভদ্রলোকরা কি পার্টিতে মহিলাদের আনতে শুরু করেছেন? কবে থেকে জানতুম না তো।
একদম খাঁটি মারোয়াড়ি শাড়ি। টকটকে লাল রঙ–ছোট ছোট বোট্টাদার। বেনারসি র্যাপার। সেই কাপড় দিয়েই ব্লাউজ– জরির বোট্টা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সকালবেলা হাওড়ায় নামলে ব্রিজ পেরিয়ে হামেশাই এরকম শাড়ি দেখতে পাই– মহিলারা স্নান সেরে ফিরছেন। সেই শাড়ি এখানে? হাতে আবার লাইফ বেল্ট সাইজের কাকন।
মাথার দিকে চেয়ে দেখি, না, ইনি মারোয়াড়ি নন। চুলটি গুছিয়েছেন একদম পাকাপোক্ত গ্রেতা গার্বো স্টাইলে। কাঁধের উপর নেতিয়ে পড়ে ডগার দিকে একটুখানি ঢেউখেলানো। শুধু চুলটি দেখলে তামা-তুলসী স্পর্শ করে বলতুম, জীবনের শেষ স্বপ্ন সফল হল- গ্রেতার সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে। কিন্তু কেন হেন জঙ্গলি শাড়ির সঙ্গে মডার্ন চুল?
নাসিকাগ্রে মনোনিবেশ করে ধ্যান করে হৃদয়ঙ্গম করলুম তত্ত্বটা। শাড়ি ব্লাউজের কন্ট্রাস্ট ম্যাচিঙের দিন গেছে। এখন নব নব কন্ট্রাস্ট-এর সন্ধান চলেছে। এ হচ্ছে প্রাচীন পন্থা আর আধুনিক ফ্যাশানের দ্বন্দ্ব। গলার নিচে ত্রয়োদশ শতাব্দী– উপরে বিংশ। প্রাণভরে বাঙালি মেয়ের বুদ্ধির তারিফ করলুম। উচ্চকণ্ঠে করলেও কোনও আপত্তি ছিল না। সে হট্টগোলের ভিতর এটম বমের আওয়াজও শোনা যেত না। কী করে খানার ঘণ্টা শুনতে পেলুম, খোদায় মালুম।
হাওড়া থেকে শেয়ালদা সাইজের খানা-টেবিল। টার্কি পাখিরা রোস্ট হয়ে উপদী হয়েছেন অন্তত শ জনা, মুরগি-মুসল্লম, অগুনতি, সাদা কেঁচোর মতো কিলবিল করছে ইতালির মারোনি হাইনৎসের লাল টমাটো সসের ভিতর, আণ্ডার রাশান স্যালাড গায়ে কম্বল জড়িয়েছে প্যোর ব্রিটিশ মায়োনেজের ভিতর, চকলেট রঙের শিককাবাবের উপর আঁকা হয়েছে সাদা পেঁয়াজ-মুলোর আলপনা, গরম মশলার ক্বাথের কাদায় মুখ গুঁজে আছেন রুইমাছের ঝাঁক, ডাঁটার মতো আটা আটা এসপেরেগাস টিন থেকে বেরিয়ে শ্যাম্পেনের গন্ধ পেয়ে ফুলে উঠেছে, পোলাওয়ের পিরামিডের উপর সসেজের ডজন ডজন কুতুবমিনার।
কনন্ট্রাস্ট, কনন্ট্রাস্ট, সবই কনন্ট্রাস্ট।
প্রভু যিশু জন্ম নিলেন খড়বিচুলির মাঝখানে– আর তার পরব হল শ্যাম্পেনে টার্কিতে!!