ব্যোমকেশের মাঞ্জা

‘টোকিয়ো—কিয়োটো—নাগাসাকি—য়োকোহামা’ — বোর্ডের উপর প্রকাণ্ড ম্যাপ ঝুলিয়ে হারাণচন্দ্র জাপানের প্রধান নগরগুলি দেখিয়ে যাচ্ছে। এর পরেই ব্যোমকেশের পালা কিন্তু ব্যোমকেশের সে খেয়ালই নেই। কাল বিকেলে ডাক্তারবাবুর ছোট্ট ছেলেটার সঙ্গে প্যাঁচ খেলতে গিয়ে তার দুটো-দুটো ঘুড়ি কাটা গিয়েছিল, সে-কথাটা ব্যোমকেশ কিছুতেই আর ভুলতে পারছে না। তাই সে বসে বসে সুতোর জন্যে কড়া রকমের একটা মাঞ্জা তৈরির উপায় চিন্তা করছে। চীনে শিরিস গালিয়ে, তার মধ্যে বোতলচুর আর কড়কড়ে এমেরি পাউডার মিশিয়ে সুতোয় মাখালে পর কি রকম চমৎকার মাঞ্জা হবে, সেই কথা ভাবতে ভাবতে উৎসাহে তার দুই চোখ কড়িকাঠের দিকে গোল হয়ে উঠছে। মনে মনে মাঞ্জা দেওয়া ঘুড়ির সুতোটা সবে তালগাছের আগা পর্যন্ত উঠে, আশ্চর্য কায়দায় ডাক্তারের ছেলের ঘুড়িটাকে কাটতে যাচ্ছে, এমন সময়ে গম্ভীর গলায় ডাক পড়ল— “তারপর, ব্যোমকেশ এস দেখি।”
ঐ রকম ভীষণ উত্তেজনার মধ্যে, সুতো-মাঞ্জা, ঘুড়ির প্যাঁচ সব ফেলে আকশের উপর থেকে ব্যোমকেশকে হঠাৎ নেমে আসতে হল একেবারে চীন দেশের মধ্যিখানে। একে তো ও দেশটার সঙ্গে তার পরিচয় খুব বেশি ছিল না, তার উপর যা-ও দু-একটা চীনদেশী নাম সে জানত, ওরকম হঠাৎ নেমে আসবার দরুন, সেগুলোও তার মাথার মধ্যে কেমন বিচ্ছিরি রকম ঘন্ট পাকিয়ে গেল। পাহাড়, নদী, দেশ, উপদেশের মধ্যে ঢুকতে না ঢুকতে বেচারা বেমালুম পথ হারিয়ে ফেলল। তার কেবলই মনে হতে লাগল যে চীনদেশের চীনে শিরীষ, তাই দিয়ে হয় মাঞ্জা। মাস্টারমশাই দু-দুবার তাড়া দিয়ে যখন তৃতীয়বার চড়া গলায় বললেন, “চীন দেশের নদী দেখাও” তখন বেচারা একেবারেই দিশেহারা আর মরিয়া মতন হয়ে বললে— “সাংহাই।” সাংহাই বলবার আর কোনো কারণ ছিল না, বোধ হয় তার সেজমামার যে স্ট্যাম্প সংগ্রহের খাতা আছে তার মধ্যে ঐ নামটাকে সে পেয়ে থাকবে — বিপদের ধাক্কায় হঠাৎ কেমন করে ঐটেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
গোটা দুই চড়-চাপড়ের পর ব্যোমকেশবাবু তাঁর কানের উপর মাস্টারমশায়ের প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে, বিনা আপত্তিতে বেঞ্চের উপর আরোহণ করলেন। কিন্তু কানদুটো জুড়োতে না জুড়োতেই মনটা তার খেই-হারানো ঘুড়ির পিছনে উধাও হয়ে, আবার সুতোর মাঞ্জা তৈরি করতে বসল। সারাটা দিন বকুনি খেয়েই তার সময় কাটল, কিন্তু এর মধ্যে কত উঁচুদরের মাঞ্জা-দেওয়া সুতো তৈরি হল আর কত যে ঘুড়ি গণ্ডায় গণ্ডায় কাটা পড়ল সে জানে কেবল ব্যোমকেশ।
বিকেলবেলায় সবাই যখন বাড়ি ফিরছে, তখন ব্যোমকেশ দেখল, ডাক্তারের ছেলেটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মস্ত একটা লাল রঙের ঘুড়ি কিনছে। দেখে ব্যোমকেশ বন্ধু পাঁচকড়িকে বলল, “দেখেছিস, পাঁচু, আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে আবার ঘুড়ি কেনা হচ্ছে! এ-সব কিন্তু নেহাত বাড়াবাড়ি। না হয় দুটো ঘুড়িই কেটেছিস বাপু, তার জন্যে এত কি গিরিম্বাড়ি!” এই ব’লে সে পাঁচুর কাছে তার মাঞ্জা তৈরির মতলবটা খুলে বলল। শুনে পাঁচু গম্ভীর হয়ে বলল, “তা যদি বলিস, তুই আর মাঞ্জা তৈরি করে ওদের সঙ্গে পারবি ভেবেছিস্? ওরা হল ডাক্তারের ছেলে, নানা রকম ওষুধ-মশলা জানে। এই তো সেদিন ওর দাদাকে দেখলুম, শানের উপর কি একটা আরক ঢেলে দিলে, আর ভসভস্ করে গ্যাঁজালের মতো তেজ বেরুতে লাগল। ওরা যদি মাঞ্জা বানায়, তাহলে কারু মাঞ্জার সাধ্যি নেই যে তার সঙ্গে পেরে ওঠে।” শুনে ব্যোমকেশের মনটা কেমন দমে গেল। তার ধ্রুব রকম বিশ্বাস হল যে, ডাক্তারের ছেলেটা নিশ্চয় কোনো আশ্চর্য রকম মাঞ্জার খবর জানে। তা নইলে ব্যোমকেশের চাইতেও চার বছরের ছোট হয়ে, সে কেমন করে তার ঘুড়ি কাটল? ব্যোমকেশ স্থির করল, যেমন করে হোক ওদের বাড়ির মাঞ্জা খানিকটা যোগাড় করতেই হবে। সেটা একবার আদায় করতে পারলে, তারপর সে ডাক্তারের ছেলেকে দেখে নেবে।
বাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি জলখাবার সেরে নিয়ে ব্যোমকেশ দৌড়ে গেল ডাক্তারবাবুর ছেলেদের সঙ্গে আলাপ করতে। সেখানে গিয়ে সে দেখে কি, কোণের বারান্দায় বসে সেই ছোট্ট ছেলেটা একটা ডাক্তারি থলের মধ্যে কি যেন মশলা ঘুঁটছে। ব্যোমকেশকে দেখে সে একটা চৌকির তলায় সব লুকিয়ে ফেলে সেখান থেকে সরে পড়ল। ব্যোমকেশ মনে মনে বললে, ‘বাপু হে! এখন আর লুকিয়ে করবে কি? তোমার আসল খবর আমি পেয়েছি’ — এই ব’লে সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলে, কোথাও কেউ নেই। একবার সে ভাবল, কেউ আসলে এর একটুখানি চেয়ে নেব। আবার মনে হল, কি জানি চাইলে যদি না দেয়? তারপর ভাবলে, দূর! ভারি তো জিনিস তা আবার চাইবার দরকার কি? এই একটুকু মাঞ্জা হলেই প্রায় দুশো গজ সুতোয় শান দেওয়া হবে। এই ভেবে সে চৌকির তলা থেকে এক খাবলা মশলা তুলে নিয়েই এক দৌড়ে বাড়ি এসে হাজির।
আর কি তখন দেরি সয়? দেখতে দেখতে দক্ষিণের বারান্দা জুড়ে সুতো খাটিয়ে, মহা উৎসাহে মাঞ্জা দেওয়া শুরু হল। যাই বল, মাঞ্জাটা কিন্তু ভারি অদ্ভুত — কই, তেমন কড়কড়্ করছে না তো! বোধ হয়, খুব মিহি গুঁড়োর তৈরি — আর কালো কাচের গুঁড়ো। দুঃখের বিষয়, বেচারার কাজটা শেষ না হতেই সন্ধ্যা হয়ে এল, আর তার বড়দা এসে বললে, “যা, যা! আর সুতো পাকাতে হবে না, এখন পড়গে যা।”
সে রাত্তিরে ব্যোমকেশের ভালো করে ঘুমই হল না। সে স্বপ্ন দেখল যে, ডাক্তারের ছেলেটা হিংসে করে তার চমৎকার সুতোয় জল ফেলে সব নষ্ট করে দিয়েছে। সকাল হতে না হতেই ব্যোমকেশ দৌড়ে গেল তার সুতোর খবর নিতে। কিন্তু গিয়েই দেখে, কে এক বুড়ো ভদ্রলোক ঠিক বারান্দার দরজার সামনে বসে তার দাদার সঙ্গে গল্প করছেন, তামাক খাচ্ছেন। ব্যোমকেশ ভাবলে, দেখ তো কি অন্যায়! এর মধ্যে থেকে এখন সুতোটা আনি কেমন করে? যাহোক, অনেকক্ষণ ইতস্তত করে সে খুব সাহসের সঙ্গে গিয়ে, চট করে তার সুতো খুলে নিয়ে চলে আসছে — এমন সময়, হঠাৎ কাশতে গিয়ে বুড়ো লোকটির কলকে থেকে খানিকটা টিকে গেল মাটিতে পড়ে। বৃদ্ধ তখন ব্যস্ত হয়ে হাতের কাছে কিছু না পেয়ে, ব্যোমকেশের সেই মাঞ্জা-মাখানো কাগজটা দিয়ে টিকেটাকে তুলতে গেলেন।
সর্বনাশ! যেমন টিকের উপর কাগজ ছোঁয়ানো, অমনি কিনা ভসভস্ করে কাগজ জ্বলে উঠে ভদ্রলোকের আঙুল-টাঙুল পুড়ে, বারান্দার বেড়ায় আগুন-টাগুন লেগে এক হুলস্থুল কাণ্ড! অনেক চেঁচামেচি ছুটোছুটি আর জল ঢালাঢালির পর যখন আগুনটা নিভে এল, আর ভদ্রলোকের আঙুলের ফোস্কায় মলম দেয়া হল, তখন তার দাদা এসে তার কান ধরে বললেন, “হতভাগা! কি রেখেছিলি কাগজের মধ্যে বল্ তো?” ব্যোমকেশ কাঁদ-কাঁদ হয়ে বললে, “কিচ্ছু তো রাখিনি, খালি সুতোর মাঞ্জা রেখেছিলাম।” দাদা তার কৈফৈয়ৎটাকে নিতান্তই আজগুবি মনে করে, “আবার এয়ার্কি হচ্ছে?” ব’লে বেশ দু-চার ঘা কষিয়ে দিলেন। বেচারা ব্যোমকেশ এই ব’লে তার মনকে খুব খানিক সান্ত্বনা দিল যে, আর যাই হোক, তার সুতোটুকু রক্ষা পেয়েছে। ভাগ্যিস সে সময়মতো খুলে এনেছিল, নইলে তার সুতোও যেত, পরিশ্রমও নষ্ট হত।
বিকেলে সে বাড়ি এসেই চটপট ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে ছাতের উপর উঠল। মনে মনে বলল, ‘ডাক্তারের পো আজ একবার আসুক না, দেখিয়ে দেব প্যাঁচ খেলাটা কাকে বলে।’ এমন সময়ে পাঁচকড়ি এসে বড় বড় চোখ করে বললে, “শুনেছিস্?”ব্যোমকেশ বললে, “না— কি হয়েছে?” পাঁচু বললে, “ওদের সেই ছেলেটাকে দেখে এলুম, সে নিজে নিজে দেশলাইয়ের মশলা বানিয়েছে, আর চমৎকার লাল নীল দেশলাই তৈরি করছে।” ব্যোমকেশ হঠাৎ লাটাই-টাটাই রেখে, এত বড় হাঁ করে জিগ্গেস করলে, “দেশলাই কিরে! মাঞ্জা বল?” শুনে পাঁচু বেজায় চটে গেল, “বলছি লাল নীল আলো জ্বলছে, তবু বলবে মাঞ্জা, আচ্ছা গাধা যা হোক!”
ব্যোমকেশ কোনো জবাব না দিয়ে, দেশলাইয়ের মশলা-মাখানো সুতোটার দিকে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে রইল। সেই সময় ডাক্তারদের বাড়ি থেকে লাল রঙের ঘুড়ি উড়ে এসে, ঠিক ব্যোমকেশের মাথার উপর ফরফর্ করে তাকে যেন ঠাট্টা করতে লাগল। তখন সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। বলল, “আমার অসুখ করেছে।”