॥ ১ ॥
সেকালের দিনের কবি-সাহিত্যিকদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজারা এবং কখনও কখনও রানিরাও, যদি তাঁরা অবশ্য শিক্ষা এবং সংস্কৃতির রসজ্ঞা হতেন। কর্ণাট রাজ্যের রানি ছিলেন যেমন এক বিদগ্ধা রমণী, তেমনই একটু গর্বোদ্ধত স্বভাবের। তাঁর কাছে এসে কোনও এক সহৃদয় ব্যক্তি কালিদাসের নাম করেছিল। কালিদাস তখন উদীয়মান কবি, সবে মালবিকাগ্নিমিত্র নাটক আর কুমারসম্ভব রচনা করে উত্তর-মধ্যভারতে প্রসিদ্ধিলাভ করতে আরম্ভ করেছেন। কিন্তু কর্ণাটের রানি এখনও তাঁর কবিত্বের স্বাদ পাননি। এতদিন বাল্মীকি-ব্যাসের মহাকাব্য শুনে শুনেই তাঁর দিন রাত্রি ভরে গেছে, তিনি কোনও নতুন কবির নাম আর শুনতে পারছেন না। কালিদাসের নাম শুনেই তিনি ঝংকার দিয়ে বলে উঠলেন, রাখো তোমার কালিদাস। কবি বলতে আমি চিনি তিন জনকে। প্রথম জন ব্রহ্মা প্রজাপতি। এই বিরাট কাব্যসংসারে তিনি হলেন প্রথম কবি, যাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল শব্দ। প্রকাশিত হয়েছিল বাণীরূপা সরস্বতী। দ্বিতীয় হলেন সেই মুনি, যিনি জন্মেছিলেন কল্লোলিনী কালিন্দীর বুকে চর পড়ে-যাওয়া এক দ্বীপে। তাঁর নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। আর আমার তৃতীয় কবি হলেন বল্মীকজন্মা আদিকবি বাল্মীকি। কর্ণাটের রানি এবার ধমক দিয়ে বললেন—এই তিন জন ছাড়া আর যদি কেউ গদ্য-পদ্য রচনার চমৎকারে আমার চিত্ত মোহিত করতে চান, তা হলে তাঁর মাথায় আমি আমার এই বাঁ পাখানি ঘষে দিই—তেষাং মূর্ধ্নি দধামি বামচরণং কর্ণাটরাজপ্রিয়া।
কালিদাসের অলৌকসামান্য প্রতিভার নিরিখে কর্ণাটের রানিকে তাঁর বক্তব্য সংশোধন করতে হয়েছিল বলেই জানি, কিন্তু চতুর্থ এই কবির কারণে ব্যাস-বাল্মীকির প্রতিভা তাঁর কাছে ম্লান হয়ে যায়নি। আরও একটা কথা—বাল্মীকিকে আমরা আদি কবি বলে জানি, কর্ণাটের রানি কিন্তু ব্যাসের নাম করেছেন বাল্মীকিরও আগে। পণ্ডিতেরা অনেকে মনে করেন—মহাভারতের মূল স্তর কাব্যে গ্রন্থিত হয়ে গিয়েছিল রামায়ণের মূল স্তরবিন্যাসের আগেই। হয়তো সেই জন্যেই কর্ণাটের রানির অনুক্রমণিকায় ব্যাসের নাম এসেছে বাল্মীকিরও আগে। এমনও অবশ্য হতে পারে যে, মহাভারতের সম্পূর্ণ আখ্যানভাগ রামায়ণের সরল কাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি জটিল এবং রোমাঞ্চকর, অতএব সেই কারণেই সহৃদয় পাঠকের কাছে ব্যাসকৃত মহাভারতের আবেদন রামায়ণের চেয়ে অনেক বেশি। হয়তো কর্ণাটের রানির কাছেও তাই।
আজকাল অবশ্য মহাভারতের শবব্যবচ্ছেদ করে, রচনা স্তরের মধ্যে বহুরকম লেখার ‘স্টাইল’ দেখে অনেক পণ্ডিত বলেছেন—ব্যাস একজন নন মোটেই। বরঞ্চ বলা উচিত—ব্যাসের মূল রচনার ওপরে গভীর স্থূল হস্তাবলেপ ঘটেছে এবং তা করেছেন অন্য অর্বাচীন কবিরা। আমরা বলি—একথা পণ্ডিতেরা নতুন করে কী বলবেন, একথা তো মহাভারতেই আছে!
ব্যাস-কথিত মহাভারতকাহিনী বিবৃত করতে গিয়ে মহাভারতের কথকঠাকুর রোমহর্ষণি উগ্রশ্রবা সূত বলেছেন—এর আগেও কবিরা এই মহাভারতকাহিনী বলেছেন, পরের কবিরাও বলবেন—আচখ্যুঃ কবয়ঃ কেচিৎ সম্প্রত্যাক্ষতে পরে। এখন আমি এই কাহিনী বলছি। বস্তুত এই বার বার বলার জন্য মহাভারতের মূল কাহিনীও পরিবর্তিত হয়ে গেছে বলে আমি মনে করি না। এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন আসরে বসে যাঁরা মহাভারত-পুরাণ ব্যাখ্যা করেন, তাঁরা যে আসনে বসেন তাঁকে ‘ব্যাসাসন’ বলে এবং সাময়িকভাবে সেই পুরাণ-বক্তাকেও ব্যাসরূপে কল্পনা করা হয়। আমার বক্তব্য, পুরাণ-বক্তা যত ব্যাখ্যাই করুন, তিনি কখনও পুরাণের মূল বক্তব্যকে অতিক্রম করেন না। অন্যদিকে কথকঠাকুরেরা, বিশেষত যাঁরা রোমহর্ষণ, উগ্রশ্রবার মতো কথকঠাকুর—তাঁরা যেহেতু প্রায় সাক্ষাৎ পরম্পরায় মহাভারতের পাঠ নিয়েছেন, তাই মহাভারতের মূল পরিবর্তন করার সাধ্য ছিল না তাঁদের। কাজেই বর্তমান অবস্থার মহাভারতটুকু পড়লেও মহাভারতের ব্যাসকথিত মৌল অংশ অনুধাবন করতে কারও অসুবিধে হবার কথা নয়। স্থূলহস্তাবলেপ অবশ্যই কিছু আছে এবং তাতে সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক পরিবর্তন বুঝতে আরও সুবিধে হয়। মনে রাখা দরকার, পুরাকালে বেদবিভাগকারী ঋষিমাত্রকেই ব্যাস বলা হত। বিষ্ণুপুরাণে আমরা অন্তত আটাশটি ব্যাসের নাম পাই, যার মধ্যে, কী আশ্চর্য—বাল্মীকিরও নাম আছে। তবে বেদবিভাগকারী ঋষিরা ব্যাস-নামধারী হলেও মহাভারতের রচনাকার ব্যাসকে কিন্তু আমরা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস বলেই জানি এবং মানি। আমাদের কাছে সবচেয়ে লক্ষণীয় হল—ব্যাস এবং বাল্মীকি—এই দুজনেরই প্রেরণা হলেন সেই প্রথম কবি—প্রজাপতি ব্রহ্মা—যিনি অলৌকিক এবং লৌকিক জগতের সারস্বত সেতু।
দেবী সরস্বতী ব্রহ্মার মুখ থেকে জন্মেছিলেন বলে তিনি ব্রহ্মার কন্যা বলে পুরাণগুলিতে বলা হয়েছে, কিন্তু এই কন্যার জন্মের পরেই পুরাণগুলির মধ্যে ব্রহ্মাকে কন্যার রূপমুগ্ধ প্রেমিক পুরুষ হিসেবে কল্পনা করায় অনেকে এই সম্বন্ধের মধ্যে একটা ‘ইনসেস্চুয়াস রিলেশন’ও খুঁজে পেয়েছেন। পৌরাণিক এই কল্পের মধ্যে যেটা আসলে বোঝবার, সেটা হল—শব্দস্বরূপা বাণী-সরস্বতীর সঙ্গে ব্রহ্মার নিত্যসম্বন্ধের কথাটি। এই নিত্যসম্বন্ধের জন্যই সরস্বতীকে একবার কন্যারূপে কল্পনা করেও আবার স্ত্রীরূপে কল্পনা করা হয়েছে। যেখানে যেখানে শব্দস্বরূপা সরস্বতীর অধিষ্ঠান, সেখানে সেখানেই সরস্বতীর জন্মদাতা ব্রহ্মার অধিষ্ঠান কল্পনা করি আমরা। এখনও পর্যন্ত সরস্বতীপুজোর সময় মন্ত্র পড়ি—যেমন নাকি লোকপিতামহ ব্রহ্মা তোমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও যান না, তেমন করেই আমাদেরও তুমি ছেড়ে যেয়ো না—
যথা ন দেবো ভগবান্ ব্রহ্মা লোক-পিতামহঃ।
ত্বাং পরিত্যজ্য সন্তিষ্ঠেৎ তথা ভব বরপ্রদা॥
প্রজাপতি ব্রহ্মার সঙ্গে সরস্বতীর এই নিত্যসম্বন্ধের নিরিখেই একথা বলতে হচ্ছে যে, যেখানে আদিকবির প্রথম কবিতা উৎসারিত হচ্ছে, অথবা মহাকবি ব্যাস যেখানে মহাকাব্য সরস্বতীর ভাবনা করেছেন, সেখানে প্রথমেই ব্রহ্মার উপস্থিতি ঘটবে না, এমনটি হতেই পারে না। ঠিক এই কারণেই ভারতবর্ষের দুই মহাকাব্য সৃষ্টির উপন্যাসমাত্রেই কবিদের প্রথম-স্ফুরিতা সরস্বতীর কল্পকুঞ্জ বনে আমরা প্রথমেই ব্রহ্মার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি।
রামায়ণ-রচয়িতা ব্রহ্মার নির্দেশ পেয়েছিলেন—মনুষ্যলোকের শ্রেষ্ঠ পুরুষ রামের চরিত্র-কীর্তনের জন্য। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের বেলায় সেরকম কিছু হয়নি। মহাভারত আখ্যান রচনার পরিকল্পনা তাঁর আগে থেকেই ছিল। ব্রহ্মা তাঁর কাছে এলে ব্যাস তাঁকে বলেছিলেন—আমার কাব্যের ভাবনা শেষ—কৃতং ময়েদং ভগবন্ কাব্যং পরমপূজিতম্। এসব ক্ষেত্রে কৌতূহলী সহৃদয়ের যেমন জিজ্ঞাসা হয়—তেমনই ব্রহ্মার মনেও সেই জিজ্ঞাসা ছিল নিশ্চয়—কাব্যের কীরকম পরিকল্পনা, নায়ক কে, নায়িকা কে, প্রতিনায়ক কে অথবা ঘটনার গতি এগোচ্ছে কীভাবে? এখানে ব্যাসের কোনও অসুবিধে ছিল না। বেশিরভাগ ঘটনাই তাঁর প্রত্যক্ষ এবং সব ঘটনার সঙ্গেই তাঁর আত্মিক যোগ আছে। ব্যাস ব্রহ্মার কাছে স্বভাবিত মহাকাব্যের সংক্ষিপ্ত খসড়া দাখিল করে জানালেন যে, তিনি তাঁর মহাকাব্যের মধ্যে বেদ উপনিষদের তত্ত্ব থেকে আরম্ভ করে লোকশিক্ষা, ন্যায়শিক্ষা, চিকিৎসা, ইতিহাস, ভূগোল, অ্যানথ্রপোলজি, যুদ্ধকৌশল এবং এই বিরাট কালচক্রের রহস্য—সব সবিস্তারে সাজিয়েছেন। কিন্তু এই বিরাট গ্রন্থখানি লিখে দেবার মতো একটা উপযুক্ত লোক তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁর গ্রন্থখানি তো শুধু মহান নয়, ভারীও বটে—মহত্ত্বাদ্ ভারবত্ত্বাচ্চ মহাভারতমুচ্যতে।
ব্রহ্মা বুঝলেন—এত বড় একজন মহাকাব্যকারকে বৃথা পরিশ্রম করতে দেওয়া যায় না। ব্যাস নিজেও এই ‘ডবল’ পরিশ্রম করতে রাজি নন। আর সত্যিই তো, একে এই বিরাট কাব্য পরিকল্পনার পরিশ্রম, তার মধ্যে যদি আবার তাঁকেই বসে বসে সেটি লিখতে হয়, ‘কপি’ করতে হয়, এত ধকল একজন মহাকবি সইবেন কেন? তখনকার দিনে ‘লেখক’ চেয়ে বিজ্ঞাপন দেবার রীতি এবং উপায় কোনওটাই ছিল না, কিন্তু সব অব্যাপারে ব্যাপার তৈরি করার ঘটকঠাকুর প্রজাপতি ব্রহ্মা ‘লেখক’ হিসেবে নাম প্রস্তাব করলেন গণেশঠাকুরের।
মহাভারতের মতো বিরাট এক মহাকাব্য সৃষ্টি করতে গেলে শুধুই যে কবিকল্প দিয়ে কাজ হয় না, এই তার প্রমাণ। মহাকবির হৃদয়স্থিতা কাব্যসরস্বতীর প্রকাশের জন্য তাঁর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন লোকপিতা ব্রহ্মা, এবার গ্রন্থকার্যের স্থূল পরিশ্রমটুকু করবার জন্য ব্রহ্মা গণেশের নাম প্রস্তাব করলেন। কেন, গণেশ কেন? আর দেবতা ছিলেন না? ইন্দ্র, যম, বরুণ এত সব বড় বড় দেবতা থাকতে গণেশ কেন? গণেশ এইজন্য যে, মহাভারত শুধু আর্যতন্ত্র বা ব্রাহ্মণ্যের ইতিহাস নয়, মহাভারত সমগ্র ভারতবর্যের জনজাতির ইতিহাস, সমগ্র ভারতবর্ষের সমাজনীতি, ধর্মনীতি, রাজনীতি আলোড়িত এবং আবর্তিত হয়েছে বিশালবুদ্ধি ব্যাসের কবিহৃদয় জুড়ে। কাজেই সেই বিশালত্ব ধারণ করে প্রকাশ করার জন্য এমন একজনের লেখনী প্রয়োজন, যিনি শুধুমাত্র বেদ এবং ব্রাহ্মণ্যের প্রতীক নন; যিনি সমস্ত মানুষের হৃদয় বোঝেন, যিনি গণতত্ত্ব বোঝেন, সেই গণপতি গণেশকে এই বিশাল কবিকল্প অক্ষর-স্বরূপে প্রকাশ করার জন্য ডাকা হয়েছে। ব্রহ্মার কথায় ব্যাস তাঁকে আবাহন করে বলছেন—তুমি গণনায়ক বলে কথা। সমগ্র ভারতবর্ষের এই গণহৃদয় তোমাকেই প্রকাশ করে দিতে হবে—লেখকো ভারতসাস্য ভব ত্বং গণ-নায়ক।
গণনায়ক গণেশকে মূর্খ ভাবেন অনেকে। গলার ওপর হাতির মাথা থাকায় এই ধারণা আরও পুষ্ট হয়েছে। কিন্তু একথা কেউ ভাবলেন না যে, হস্তিমুণ্ড হল সেই বিরাটত্ব, গাম্ভীর্য এবং বিজ্ঞতার প্রতীক, যে বিরাটত্ব, গাম্ভীর্য এবং বিজ্ঞতা মহাভারতের মধ্যেও আছে। পণ্ডিত কুমারস্বামী জানিয়েছেন—গণ শব্দটি কি দুটি অর্থ বোঝায়। প্রথম অর্থে শিবগণ, কেননা রুদ্র-শিবের যারা গণ, তাঁদের আধিপত্য পেয়েছিলেন গণেশ। আর দ্বিতীয় অর্থ নাকি গ্রন্থসমূহ। হয়তো সেই গ্রন্থ সম্বন্ধেই গণেশ ব্যাসকৃত মহাকাব্যের প্রথম লেখক। আমরা পুরাণের প্রমাণে জানি—গণেশের মতো জ্ঞানী নেই। তাঁর জন্মলগ্নেই দেবী সরস্বতী তাঁকে ‘বর্ণলোচনা’ লেখনী দিয়েছিলেন একখানি, আর স্বয়ং ব্রহ্মা তাঁকে দিয়েছিলেন জপমালা—সরস্বতী দদৌ তস্মৈ লেখনীং বর্ণলোচনাম্। জপমালার মধ্যে যে ধ্যানগম্ভীরতা আছে, আর লেখনীর মধ্যে যে দতলেখন-পটুতা আছে—এই দুটিই ব্যাসের এখন প্রয়োজন।
গণেশকে ব্যাস বললেন—আমি এই বিশাল মহাকাব্যের কল্পনা করেছি। আমি শ্লোক বলব, তুমি লিখবে—ময়ৈব প্রোচ্যমানস্য মনসা কল্পিতস্য চ। প্রত্যেক কাজের লোকেরই নিজের কাজের গুমোর থাকে, ‘ইগো’ থাকে। গণেশ বললেন—সে না হয় আমি লিখে দিলুম। কিন্তু আমি ঝড়ের বেগে লিখব এবং লিখতে বসলে আমি থামব না। কবি ভাবলেন—এ আবার কী উটকো বিপদ। ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে মহাকাব্য হবে—সে কি ঝড়ের বেগে লেখা চলে! না হয় পরিকল্পনাটা করাই আছে, তাই বলে কবির হৃদয় দিয়ে যখন অপূর্ব নির্মাণপটু পদ-পদার্থের সম্বন্ধ ঘটানো হবে, তখন কি না ভেবে, না চিন্তে বললেই চলবে, নাকি শুধু লিখলেই চলবে! ওদিকে লেখক হিসেবে গণেশঠাকুরকেও তাঁর চাই। ব্যাস তখন বুদ্ধি করে বললেন—তোমার শর্তে আমি রাজি বটে, তবে যাই তুমি লিখবে, বুঝে লিখবে। না বুঝে কিছু লিখো না—অবুদ্ধা মা লিখ ক্কচিৎ।
মহাভারত-পাঠকের কাছে এই কথাটা একটা ‘মেসেজ’। পণ্ডিতেরা অনেকেই বলেন যে, মহাভারতের রচনা নিয়ে এ গল্প তৈরি হয়েছে অনেক পরে। আমরা বলি—তা হতেও পারে। কিন্তু মহাভারত পাঠের ক্ষেত্রে এ ‘মেসেজ’টা জরুরি। মহাভারতে বলা হয়েছে যে, গণেশকে মাঝেমধ্যেই চিন্তিত মস্তিষ্কে বসিয়ে রাখার জন্য ব্যাস তাঁর লেখার মধ্যে এখানে ওখানে কতকগুলি কূট সমস্যা উপন্যস্ত করলেন এবং সেই সমস্যা যখন বোঝার চেষ্টা করছেন গণেশ, সেই অবসরে ব্যাস শ্লোক রচনা করে চললেন নিরর্গল। এ গল্প বুঝতে অসুবিধে নেই। মহাভারতের মধ্যে যে ব্যাসকূট আছে, সেগুলো বুঝতে গেলে সময় লাগবে, তাও বুঝি। কিন্তু ওই যে ব্যাস বলেছিলেন—অবুদ্ধা মা লিখা ক্কচিৎ—না বুঝে লিখে না বাপু— এই নির্দেশটা শুধু বহুকথিত ব্যাসকূট সম্বন্ধেই খাটে না, তা খাটে মহাভারতের বহু বিচিত্র বিষয়ের ক্ষেত্রেই— যেখানে পাঠককে থামতে হবে, তাঁকে স্মরণ করতে হবে বৈদিক পরম্পরা, সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা, ধর্ম, সত্য এবং সর্বোপরি মানুষের গভীর গহন মনের বিচিত্র গতিপ্রকৃতির কথা। থামতে হবে ব্যাস-জননী সত্যবতীর সঙ্গে মহর্ষি পরাশরের কুজ্ঝটিকা-মিলনের সময়, থামতে হবে ক্ষত্রিয় কৌরববংশে যখন ব্যাসের রক্ত সংক্রমিত হবে বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে। পাণ্ডব-কৌরবের জ্ঞাতিবিরোধ যখন তুঙ্গে উঠবে, কুলবধূ দ্রৌপদীকে যখন টেনে আনা হবে রাজসভায় তখন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের দিকে অসহায়ভাবে তাকাতে হবে এবং ঠিক তখনই বিচার করতে হবে দ্রৌপদীর তর্কযুক্তি এবং প্রতিবাদের। ভুলে গেলে চলবে না সেই মুহূর্তের বিদুরকেও—যাঁর জন্মে ব্যাস আনন্দিত হয়েছিলেন এবং যে কৌরবসভায় বিদুর ছিলেন একক প্রতিবাদী।
এইরকম শত শত স্থানে আপনাকে থামতে হবে এবং বিচার করতে হবে ব্যাস প্রযুক্ত শব্দবন্ধের মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা, নইলে আজকের এই যান্ত্রিক যুগে বসে মহাকবির অযান্ত্রিক মন বুঝে ওঠা নিতান্তই দায় হয়ে উঠবে। যে মহাকবি আজ থেকে দু-আড়াই হাজার বছর আগে বুঝেছিলেন—মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই—ন মানুষাৎ শ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ—তাঁর কবিহৃদয় যদি বুঝতেই হয়, তবে তাঁর শব্দ, অলঙ্কার, ভাব, রস এবং সামাজিক, রাজনৈতিক টিপ্পনীগুলি থেমে থেমেই বুঝতে হবে, নইলে আধুনিক পণ্ডিত সম্প্রদায়ের অতিসরলীকৃত মন্তব্যের জেরে অতিসাধারণ ঘটনা অতি-গুরু হয়ে উঠবে, আর অতি-গম্ভীর বস্তু অতি-লঘুতায় পর্যবসিত হবে।
প্রথমেই আমার ভুল হল। আমি ব্যাসের কথা বলতে গিয়ে মহাভারতের কথা বলতে আরম্ভ করেছি। আসলে এ ভুল আমার ইচ্ছাকৃত। ব্যাসের কথা না উঠলেই মহাভারতের কথা না বলে ব্যাসের কথা বলাই যায় না।
একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, মহাভারতই ব্যাসের একমাত্র কীর্তি নয়। ব্যাসের প্রথম কৃতিত্ব—তিনি বেদ বিভাগ করেছিলেন। বেদ বিভাগ ব্যাপারটা সাধারণজনে কেউ বোঝেনই না, বোঝেনই না যে, এটা কত কঠিন কাজ। লোকে যাকে চতুর্বেদ বলে, এই চার রকমের বেদ আগে ছিল না। বেদ ছিল একটাই। মন্ত্র, গান, যজ্ঞীয় কর্ম সব মিলেমিশে একাকার ঘণ্ট পাকিয়ে ছিল। সেই পিণ্ডিত বস্তু থেকে মন্ত্রাংশগুলি বেছে ঋগ্বেদ, গেয় অংশগুলি পৃথক করে সামবেদ, আহুতি দেবার কাজে লাগে এমন মন্ত্ররাজি নিয়ে যজুর্বেদ এবং মারণ, উচাটন, অভিচার, শান্তিক্রিয়া এবং খানিকটা রাজধর্মের বিষয়বস্তু নিয়ে অথর্ব বেদকেও যে পৃথক করে ফেলা হল—এই কঠিন কাজটা করেছিলেন ব্যাস। সেই জন্যই তাঁর নাম বেদব্যাস।
এই যে পৃথক করার পদ্ধতি, একে ইংরেজিতে বোধহয় ‘এডিটিং’ বলা চলে। এই এডিটিং-এর কাজ অনেক আগেই আরম্ভ হয়েছিল। যাঁরা একটু একটু করে বেদকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে সাজাচ্ছিলেন, তাঁদেরই ব্যাস বলা হয়েছে এবং সেই কারণেই আমরা অন্তত আটাশ জন ব্যাসের নাম পেয়েছি বিষ্ণুপুরাণে। কিন্তু সমস্ত ব্যাসদের থেকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের পার্থক্য হল—তিনি নিশ্চয়ই পূর্বসূরিদের প্রারব্ধ কার্য অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে এবং আরও সুষ্ঠুভাবে শেষ করেন। ফলত বেদ বিভাগকর্তা হিসেবে অন্য সব ব্যাসের নাম চাপা পড়ে গেল এবং একা নিজের যোগ্যতায় টিকে রইলেন শুধু মহামুনি ব্যাস। তাঁর গুরুত্ব আরও বেড়েছে এই কারণে যে, বেদ বিভাগ করেই ব্যাস বসে ছিলেন না, তাঁর ভাবনা, রীতি, পদ্ধতি তিনি বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করলেন তাঁর চারজন শিষ্যের মাধ্যমে। অর্থাৎ বেদের বিভাজন তত্ত্বত এবং তৰ্কত প্রতিষ্ঠা করে তিনি তাঁর প্রায়োগিক উপচারটুকুও দেখিয়ে গেছেন শিষ্যদের দ্বারা প্রচার করে। পৈল নামে ব্যাসের যে শিষ্যটি, তিনি ব্যাসের বেদ বিভাজন মেনে ধারণ করলেন ঋগ্বেদ। জৈমিনি গ্রহণ করলেন সামবেদ। বৈশম্পায়ন পেলেন যজুর্বেদ এবং সুমন্তু পেলেন অথর্ববেদ।
এই চার প্রধান শিষ্য ছাড়াও আরও একজন সম্পূর্ণ বেদ-শিক্ষা লাভ করলেন। তিনি ব্যাসপুত্র শুকদেব। শিক্ষা সম্পূর্ণ হলে পৈল, জৈমিনি, বৈশম্পায়ন এবং সুমন্তু একান্তে ব্যাসের কাছে বিনীত প্রার্থনা জানিয়ে বললেন—আমরা এই আপনার চার শিষ্য, আর আছেন আমাদের গুরুপুত্র শুকদেব। সম্পূর্ণ বেদ যেন এই পাঁচ জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আপনার ষষ্ঠ কোনও শিষ্য যেন এ ব্যাপারে অধিকারী না হয়—ষষ্ঠো শিষ্যো ন তে খ্যাতিং গচ্ছেদত্র প্রসীদ নঃ।
শিষ্য যদি অত্যন্ত উপযুক্ত তথা গুরুর অতি প্রিয় হয়, তবে গুরুরা তাঁদের আবদারও রাখেন। অতিপ্রিয় বিদ্যার্থীর প্রতি গুরুর এই পক্ষপাত আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে, ভবিষ্যতেও তেমনই থাকবে। কিন্তু বিশালবুদ্ধি ব্যাস বলেই হয়তো শিষ্যদের ওই বিনীত অনুরোধ তিনি স্বীকারও করলেন একভাবে, আবার অস্বীকারও করলেন বোধহয়। কেননা অন্যান্য প্রার্থিত বরদানের ক্ষেত্রে যেমন বহুশ্রুত ‘তথাস্তু’, ‘তাই হোক’—শব্দগুলি শোনা যায়, ব্যাস তেমন কিছু বললেন না। তিনি নিজে আর কাউকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন না—এ কথা স্পষ্টত উচ্চারণ না করেও যে কথা আরও স্পষ্ট করে বললেন, তার মানে দাঁড়ায়—আমি না হয় আর কোনও শিষ্য গ্রহণ করলাম না, কিন্তু তাই বলে বেদবিদ্যাকে আবদ্ধ করে রাখা চলবে না। তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। বরঞ্চ তোমরা পাঁচ জনেই অনেক হও—তোমাদের শিষ্য-প্রশিষ্যের পরম্পরায় বিস্তারিত হোক এই বেদবিদ্যা—ভবন্তো বহুলাঃ সন্তু বেদো বিস্তাৰ্য্যতাময়ম্।
চিরকাল শুধু এই শুনেছি—বেদকে গোপনে রাখো। নিজে জানো এবং জিতেন্দ্রিয়, সদাচারী, শুশ্রূষু ব্রাহ্মণকে জানাও। এ কথা ব্যাসও তাঁর সমকালীন সমাজের তাগিদে অস্বীকার করেননি। কিন্তু বাড়তি একটি নতুন কথা তাঁর মুখে আমরা শুনেছি। ধর্মশাস্ত্র এবং অন্যান্য সমস্ত শাস্ত্রে বার বার বলা হয়েছে—শূদ্রের সামনে বেদ পড়বে না, বেদের একটি বর্ণও যেন তাঁদের কর্ণগোচর না হয়। চিরন্তন ব্রাহ্মণ সমাজ এই বাক্য মস্তকে ধারণ করে বেদের মর্যাদার সঙ্গে আপন মর্যাদাও বৃদ্ধি করেছেন বেদকে গোপন গহনে আবদ্ধ রেখে। কিন্তু মহাভারতে এই প্রথম ব্যাসের মুখে শুনলাম যে,—হ্যাঁ নিশ্চয়ই, ব্রাহ্মণকে তো সামনে রাখতেই হবে। শুদ্ধাচার সদাচার এবং পরম জ্ঞানের ধারক এবং বাহক যাঁরা সেই ব্রাহ্মণরা প্রমুখ আসনে বসে থাকুন, কিন্তু তাঁদের সামনে রেখে চতুর্বর্ণকেই বেদ শ্রবণ করাতে হবে—শ্রাবয়েচ্চতুরো বর্ণান্ কৃত্বা ব্রাহ্মণমগ্রতঃ।
আমরা তো চিরকাল শুনেছি—বেদ-শ্রবণে শূদ্রের কোনও অধিকার নেই, স্ত্রীলোকেরও অধিকার নেই; কিন্তু কই, ব্যাস তো তা বললেন না। তিনি যে বললেন—বেশ তো, বামুনকে সামনে রাখো, তবে চতুর্বর্ণকেই বেদ শোনাও। বেদকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন ব্যাস। সবার মধ্যে আসমুদ্র-হিমাচল, আব্রহ্ম-স্তম্ব পর্যন্ত—বেদো বিস্তাৰ্য্যতাময়ম্। আমরা জানি, ব্যাস এই রকমই চাইবেন, কেননা এই চাওয়ার পিছনে তাঁর নিজের জীবন আছে; আর আছে কবিজনোচিত বেদনাবোধ। তাঁর পিতা মহামুনি পরাশর বটে, কিন্তু মাতা সত্যবতী! তিনি তো ধীবরগৃহে লালিতা, ধীবরকন্যা বলেই পরিচিত। জননীর হৃদয় ব্যাসের মতো মহাকবি অস্বীকার করবেন কী করে? আপনার মধ্যে সদা-প্রবহমান তাঁর শোণিতবিন্দু অস্বীকার করবেন কী করে? মনুমহারাজের রক্তিম শাসন তাঁর জানা ছিল। মনু বলেছিলেন—যে ব্রাহ্মণ একবার শূদ্রার অধররস পান করিয়াছে—বৃষলীফেনপীতস্য—কিংবা তাহার গর্ভে পুত্র উৎপাদন করিয়াছে, তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিয়াও ফল নাই।
ব্যাস জানেন—তাঁর জন্মলগ্নে এই প্রায়শ্চিত্তের অতীত অপরাধ ঘটেছিল, কিন্তু মহামুনি বলে তাঁর পিতা সর্বভুক্ বহ্নির মতো আপন তেজে দীপ্যমান থাকলেও তাঁর শূদ্রা জননীর সতত কম্পমান হৃদয়টুকু তিনি অনুভব করতে পারেন। তা পারেন বলেই পিতা পরাশরের সাগ্নিক ব্রাহ্মণ্য যেমন তাঁর লেখনীর মধ্যে ক্রিয়া করে, তেমনই শূদ্রা ধীবরজননীর সমাজ-ভয়-ভীত কম্প্র শোনিতবিন্দুগুলিও তাঁর অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে। সেই কতকাল আগে তাঁর জন্ম হয়েছিল, তারপর যুগ-যুগান্তের ওপার থেকে তাঁর সম্বন্ধে লোকে বলেছে—কী আর করবে বল, যাঁরা পুরাণ লিখে গেছেন, তাঁদের ব্যভিচার, কেচ্ছার কথা ভেবে লাভ নেই। দেখো না, মহাভারত লিখেছেন, পুরাণ লিখেছেন, অত বড় সম্মানী মানুষ যে ব্যাস, তাঁর বাবাও ছিলেন ব্যভিচারী, তিনি নিজেও ছিলেন ব্যভিচারী—পুরাণকর্তা ব্যভিচারজাত স্তস্যাপি পুত্রো ব্যভিচারজাতঃ—ব্যভিচারের ফলেই ব্যাসেরও পুত্রজন্ম।
আমাকে অনেকেই এসব কথা বলেন। বলেন—মশাই! আর বলবেন না। আপনাদের মুনি ঋষিরা এত তপস্যা, সংযম আর ব্রত-নিয়ম পালন করে এক-এক জন মুহূর্তের বিভ্রমে মেনকা-রম্ভার মতো অপ্সরাদের যেভাবে ভোগ করে গেছেন, তাতে আর তপস্যা-নিয়মাচারের উপকার এবং মূল্য কিছু আছে বলে মনে হয় না। খুব সংক্ষেপে হলেও লৌকিক এবং অলৌকিক—দুইভাবেই মুনিঋষিদের ওই তথাকথিত অসংযমের ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। ষোড়শ খ্রিস্টাব্দের দার্শনিক-ধুরন্ধর শ্রীজীব গোস্বামী বলেছেন—প্রারব্ধ কর্ম এমনই বস্তু, এমনই অলক্ষণীয় তার নিয়ম যে, মুনি ঋষি, সাধুপুরুষেরা জ্ঞান, তপস্যা অথবা ঈশ্বরকৃপার বলে তা লঙ্ঘন করার ক্ষমতা রাখলেও, তা লঙঘন করেন না। ফলে মুনি-ঋষিদের মধ্যেও ‘দগ্ধপটবৎ’ কতগুলি ‘কষায়’ অবশিষ্ট থেকে যায়, যা কখনও তাঁদের ভোগসুখেরও সৃষ্টি করে, আবার কখনও বা রোগভোগও। দুটোই তাঁদের কাছে একইরকম, কেননা পুণ্য এবং পাপ দুটিই বন্ধন এবং ভোগের কারণ। পুণ্যের ফল সুখ ভোগ, পাপের ফল রোগব্যাধি ভোগ। এইভাবে প্রারব্ধ কর্মের ভোগটুকু যে ঘটে, সেটা বিশিষ্ট সাধুপুরুষেরা অস্বীকার করেন না। ঠিক এই কারণেই মেনকা-রম্ভার মতো অপ্সরা-সম্ভোগও যেমন তাঁদের কপালে জুটেছে কখনও, আবার কখনও বা জুটেছে কঠিন রোগব্যাধির দুর্ভোগ। সাধুপুরুষ এই দুটোকেই সমদৃষ্টিতে দেখেন।
আবার লৌকিক দৃষ্টিতে কথাটা ভাবুন একটু। সারা জীবন ব্রত-নিয়ম, সদাচার, তপস্যা যাঁরা করেন, তাঁরাও তো মান। রক্তমাংসের তৈরি ইন্দ্রিয়বৃত্তিসম্পন্ন মানুষ। ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে শুষ্ক রুক্ষ মুনিবৃত্তিতে যাঁদের জীবনে সায়াহ্ন গড়িয়ে যায়, তাঁদের কেউ যদি কখনও বসন্তের উতলা হাওয়ায় আন্দোলিত হয়ে ক্ষণিকের জন্যও অসংহত হয়ে পড়েন, তা হলে সেটা কি খুব অস্বাভাবিক! নাকি সেটাই পরম দোষের? সাধারণ জন, যারা সর্বক্ষণই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের আহার জুটিয়ে জুটিয়েই ইন্দ্রিয়বৃত্তি শিথিল করে ফেলেন, তারা এমনই মজার মানুষ যে, মুনি ঋষি এবং সাধুপুরুষের এই ক্ষণিকের অসংযম বা বিচ্যুতির ওপরেই সমস্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, তাঁদের সারা জীবনের জ্ঞানতপস্যা সাধারণের কাছে এক মুহূর্তেই মূল্যহীন হয়ে যায়।
একটা জিনিস এরা বোঝে না যে, জীবনভর ইন্দ্রিয়বৃত্তি চরিতার্থ করে একদিন কি দশদিন উপবাস আর গীতাপাঠ করে যেমন সংযমী সাধু বনে যাওয়া যায় না, তেমনই সারা জীবন যাঁরা ইন্দ্রিয় নিগ্রহ করে জ্ঞান আর তপস্যার তেজে দীপ্র হয়ে উঠেছে, একদিন কি দশদিনের অসংযমে তাঁদের জ্ঞানতপস্যার আলো ক্ষণিকের জন্য আবৃত হলেও তা লপ্ত হয়ে যায় না। যেতে পারে না, কোনও যুক্তিতেই তা যেতে পারে না।
পিতৃশ্রাদ্ধের সময় দশ দিন মাত্র হবিষ্যি খাওয়ার পর মৎস্যমুখীর দিন দশ-দিবস-সংযত সেই পুরুষ যখন হামলে মাছমাংস খায়, তখন সে কিন্তু বোঝে না যে, জীবনভর যাঁরা ব্রত-নিয়ম-সংযম পালন করেছেন, সেই বৈরাগী পুরুষ যদি ভোগলালসায় দশ দিনও মত্ত হন তব একাদশ দিনেই তাঁর অনুতাপ আসবে—এ আমি কী করলাম। সারা জীবন ঈশ্বর আরাধনা করে, এ আমি কী করলাম! এই অনুতাপই তাঁর তমসাবৃত জ্ঞানকে আবারও পুনরুন্মীলিত করে। নষ্ট জ্ঞান পুনর্লব্ধ হয় তখনই।
আরও একটা অদ্ভুত ঘটনা এখানে লক্ষ করার মতো। পুরাণ-ইতিহাসে যতবারই আমরা মুন ঋষিদের কামনা বাসনায় লুপ্তসংও হতে দেখছি, একেবারে সর্বক্ষেত্রে না হলেও বেশির ভাগ সময়েই দেখা যাচ্ছে, কামনা তৃপ্ত হতেই তাঁরা চলে যাচ্ছেন। তাঁরা থাকছেন না অথবা ঘরসংসার পেতে মায়াময় মধুচক্র রচনা করছেন না। অর্থাৎ মুহূর্তের জন্য যে বিচ্যুতি ঘটল, মুহূর্তের মধ্যেই তা কাটিয়ে উঠছেন তাঁরা। বলতে পারেন, আধুনিকের তীক্ষ্ণতায় আপনি বলতেই পারেন—এ আবার কেমন ব্যবহার? এ তো মধুকর বৃত্তি! যে রমণীকে তিনি পথভ্রষ্ট করছেন, যাঁর কুমারীত্ব তিনি লঙ্ঘন করছেন, তাঁর কথা চিন্তা করে সেই সব মুনি ঋষিদের তো উচিত ছিল যাতে মহূর্তের মিলন এক দায়িত্বপূর্ণ বৈবাহিক সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়।
আজকের সামাজিক ভাবনায় কথাটা খুব অযৌক্তিক নয় এবং যুক্তি দিয়ে মুনি ঋষিদের ওই আকুল ব্যবহারের প্রতিষ্ঠাও করা যাবে না, কেননা পৃথিবীতে বিবাহপূর্ব কোনও মিলনের মধ্যেই অথবা বৈবাহিক সম্পর্কহীন কোনও মিলনের মধ্যেই তৎকালীন আকুলতা এবং ভালবাসা ছাড়া অন্য কোনও যুক্তি থাকে না। তা ছাড়া ত্যাগ, বৈরাগ্য এবং দার্শনিকতার যুক্তি ছাড়া মুনি ঋষিদের অন্য সব ব্যবহারে খুব যুক্তিপূর্ণ সাংসারিক আচরণও লক্ষ করা যায় না। অভিশাপ এবং বরদানের ক্ষেত্রগুলিতেও বৃহত্তর কোনও অভীষ্ট সম্পন্ন হয়ে থাকলেও মুহূর্তের বিচারে মুনি ঋষিদের অভিশাপ এবং বরদানও সব সময় সযৌক্তিক হত না।
আসলে সারা জীবন যাঁরা ত্যাগ-বৈরাগ্যের সাধনে যুক্ত থাকতেন, তাঁরা যদি বসন্তের উতলা হাওয়ার তাড়নায় কখনও যদি বা মার্গভ্রষ্ট হতেনও, তবু মায়াময় সংসারসুখে মত্ত হয়ে ওঠাটা তাঁদের ধাতেও সইত না, জ্ঞান-তপস্যার দৃষ্টিতেও সেই মায়ার বন্ধন ছিল তাদের কাছে অন্য এক প্রতিবন্ধকতার সামিল। ঠিক এই কারণেই দেখবেন, বেশির ভাগ সময়েই—মিলন সম্পূর্ণ হলেই মুনি ঋষিরা আর সেখানে থাকছেন না, তাঁরা ফিরে যাচ্ছেন নিজেদের ব্রত-নিয়মের আসনে। পুরাণে-ইতিহাসে অবশ্য যেসব রমণীদের সঙ্গে ঋষি মুনিদের হঠাৎ সঙ্গত হতে দেখছি, সেই সব রমণীদের মধ্যে অধিকাংশই হলেন অপ্সরাজাতীয়—উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, ঘৃতাচী অথবা মিশ্রকেশী।
অপ্সরারা মূলত অভিজাত গণিকা বলে পরিচিত এবং প্রায় সব সময়েই তাঁরা অন্যের প্ররোচনায় মনি ঋষিদের ধ্যানভঙ্গ করার অপকর্মে লিপ্ত হতেন এবং তাঁদের তাঁরা প্রলুব্ধ করতেন শারীরিক প্রলোভনে। এসব ক্ষেত্রে মুনি ঋষিদের দোষ দেবেন কী করে? সাময়িক শারীরিক মুক্তি ঘটানো মাত্রেই এসব ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেদের ওপর নিজেরাই ক্ষুব্ধ হতেন এবং সেই ক্রোধের ফল ভুগতে হত প্রলোভিকা রমনীকেও। কিন্তু এইসব ক্ষেত্র ছাড়া আর যে সব জায়গায় মুনি ঋষিদের শারীরিক মিলনে তৃপ্ত হতে দেখছি, সেই সব জায়গায় মহৎ এবং বিশাল সৃষ্টিরই দ্যোতনা আছে। অনেক সময় কন্যাত্ব লঙ্ঘিত হলেও এমন মহান পুরুষের অথবা এমন কন্যারও জন্ম সম্পন্ন হচ্ছে, যাকে অভ্যুদয় ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
মহাভারতের সৃষ্টিকর্তা ব্যাসও এই পৃথিবীতে এক বিশাল অভ্যুদয়। অবশ্য উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, কেউ সেদিন মহামুনি পরাশয়ের ধ্যান ভঙ্গ করতে আসেননি। অন্য আর সব দিনের মতই তীর্থ-পরিক্রমণ করতে করতে মহর্ষি পরাশর সেদিন খেয়াঘাটে এসেছিলেন নদী পার হবার জন্য। কিন্তু প্রতিদিন যে খেয়া পারাপার করে, সেই মানুষটি সেদিন উপস্থিত ছিল না। সে জাতিতে ধীবর। হয়তো মৎস্যজীবিকার কারণেই সে অন্যত্র ব্যস্ত ছিল। তা ছাড়া দিনের এই শেষভাগে যাত্রীও তেমন থাকে না বলে সে তার পালিতা কন্যাটিকে নৌকো চালানোর ভার দিয়ে অন্য কাজে গিয়েছিল। ধীবরের কন্যার নাম সত্যবতী, মৎস্যজীবীদের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠার ফলে তার গা দিয়ে আঁশটে গন্ধ বেরোয়। ফলে মৎস্যগন্ধা বলেও লোকে তাকে ডাকে। তবে সাধারণ ঘরে কালো মেয়ে জন্মালে যেহেতু অনেক সময় এখনও তার ডাকনাম হয় কালী, তাই কালীই ছিল তার আদরের ডাকনাম।
গায়ের রং কালো বটে, কিন্তু সে অতিশয় সুন্দরী। তার রূপের মাদকতা ছিল এতটাই যে, পুত্র হয়েও ব্যাসকে লিখতে হয়েছে—সে রূপ তপঃসিদ্ধ মুনি ঋষিদেরও মনোহরণ করে—অতীবরূপসম্পন্নাং সিদ্ধানামপি কাঙিক্ষতাম্। বাস্তবেও তাই হল। কেননা পরাশর তীর্থযাত্রার কারণে নদীতীরে উপস্থিত হয়ে একাকিনী সত্যবতীকে নৌকোর ওপর বসে থাকতে দেখেই মনে মনে আকুল আকর্ষণ বোধ করলেন তার প্রতি—দৃষ্ট্বৈব স চ তাং কন্যাংশ্চকমে চারুহাসিনীম্। অবশ্য এই আকর্ষণের এক অতিবাস্তব নিমিত্তকারণ ছিল। পরাশরকে যাত্রী হিসেবে পেয়ে নৌকোয় বসা সত্যবতী স্মিতহাস্যে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল নৌকোয় বসার জন্য। এই ভুবনমোহিনী আমন্ত্রণী হাসির সঙ্গে তার কদলীস্তম্ভসদৃশ উন্মুক্ত ঊরুস্থল মহর্ষি পরাশরের মনে যে অন্য আবেদন তৈরি করেছিল রমণী হয়তো তা তেমন করে বোঝেনি। কিন্তু পরাশরের কাছে এটাই হয়তো ছিল প্রকৃত আমন্ত্রণ। অন্তত সেই মুহূর্তে।
অন্য সময় হলে কী হত। ঋষি আসতেন, নৌকোয় উঠতেন এবং নদীর ওপারে চলে যেতেন। কিন্তু এখন তা হল না। তরুণী রমণীর সঙ্গে প্রথম দেখা এবং ভাল লাগার পর এখনও যেমন তরুণ পুরুষ ভাব জমানোর ইচ্ছেতেই শুধু অনর্থক বাক্য সৃষ্টি করে, বয়স্ক প্রাচীন ঋষির ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হল না। কারণ স্ত্রীলোকের মন যাচাই করার জন্য প্রথম আলাপচারিতার লক্ষণ চিরকালই একরকম। পরাশর বললেন—হ্যাঁগো সুন্দরী! এখানে প্রতিদিন যে নৌকো বেয়ে ওপারে নিয়ে যায়, সেই নেয়ে গেলেন কোথায়—ক্ব কর্ণধারো নৌর্যেন নীয়তে ব্রূহি ভামিনি। মৎস্যগন্ধা সত্যবতী অত্যন্ত ‘স্মার্ট’। পুরুষের প্রশ্ন শুনে লজ্জাবতী লতার মতো সে এলিয়ে পড়ল না। বলল—আমার পিতা ধীবরদের মুখ্য পুরুষ। কিন্তু তাঁর ছেলে নেই। আমিই তাঁর একমাত্র মেয়ে। তবে মেয়ে বলে নৌকো নিয়ে ওপারে যেতে পারব না, এমন ভাববেন না যেন। হাজার মানুষ এলেও আমি তাঁদের এই নৌকোয় উঠিয়ে পার করে দেব ঠাকুর।
এমন সপ্রতিভ জবাবের জন্য বোধহয় প্রস্তুত ছিলেন না ঋষি। তিনি ঠেকে গিয়ে বললেন—না না, সে তো বেশ ভাল কথা। তা হলে আর দেরি কীসের, নৌকো ছেড়ে দাও। আজকে তোমার খেয়াতরীর শেষ যাত্রী হলাম আমি। তুমি নৌকো ছাড়ো—অহং শেষো ভবিষ্যামি নীয়তামচিরেণ বৈ। মৎস্যগন্ধা সত্যবতী নৌকো ছেড়ে দিল। যমুনার নীল জলে নৌকো চলতে লাগল তির তির করে। প্রথম সন্ধ্যার অস্তরাগ কালো যমুনার জলের মধ্যে যদি কোনও মায়া সৃষ্টি করে থাকে, তবে সেই অনুরাগবতী সন্ধ্যা তার রক্তিম আভাটুকু সত্যবতীর কৃষ্ণকান্তি কপোলেও সঞ্চারিত করেছিল। কারণ স্ত্রীলোকের স্বভাবসিদ্ধ তৃতীয় নয়নে সত্যবতী দেখতে পাচ্ছিলেন—মহর্ষি পরাশর সতৃষ্ণ নয়নে তাঁর কদলীস্তম্ভসদৃশ উন্মুক্ত ঊরুস্থলের দিকে দৃষ্টিপাত করছেন, দৃষ্টিপাত করছেন তাঁর শরীরের উচ্চাবচ সংস্থানের প্রতি—বীক্ষমাণং মুনিং দৃষ্টা প্রোবাচেদং বচস্তদা।
রমণীমাত্রেই পুরুষের এই দৃষ্টিপাতের অর্থ বোঝে। সত্যবতী মহর্ষির সানুরাগ দৃষ্টিটুকু বুঝতে পারলেন এবং তাঁকে খানিকটা অন্যদিকে চালনা করার জন্যই বললেন—মহর্ষি! আমি ধীবররাজার মেয়ে। তাঁর কাছেই আমি মানুষ হয়েছি। লোকে আমাকে মৎস্যগন্ধা বলে ডাকে। আমার আসল বাবা-মা কে, তাও আমি জানি না। সে জন্য অনেক দুঃখও আছে আমার মনে। আপনি কি জানেন সেসব কথা? দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন মহর্ষি পরাশর মৎস্যগন্ধার পূর্বজন্মের ইতিহাস শোনালেন। এই পূর্বজন্মের ইতিহাসের মধ্যে হয়তো সত্যবতীর জন্মগরিমা কিছু বেড়েছে। ধীবরদের জাতি-নিম্নতার পরিবর্তে সত্যবতীর জন্ম সম্বন্ধে খানিকটা রাজরক্ত এবং খানিকটা দৈবাবেশ ঘটেছে পরাশরের বক্তব্যে। কিন্তু পরাশরের বয়ান এবং তাঁর সঙ্গে সত্যবতীর প্রথম মিলনের সময় এইসব জাতি-তত্ত্বের বিচার শুনে মনে হয়—এই বৃত্তান্ত যেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অর্থাৎ ওই মুহূর্তে যেন এসব কথা আসে না এবং ভবিষ্যতে মহাভারতের রচয়িতা ব্যাসের জননী হয়েছেন বলেই যেন সত্যবতীর জন্মকথা পরিবেশন করতে হয়েছে নতুনভাবে মহিমান্বিত করে। হয়তো স্বয়ং ব্যাসের রচনায় এই কাহিনী ছিল না, কিন্তু পরবর্তী কালে ব্যাসের প্রতিভা এবং অমানুষী ক্ষমতার নিরিখে অন্য কোনও মহাজন ব্যাসজননীর পূর্ব-জন্মমাহাত্ম্য খ্যাপন করেছেন স্বয়ং ব্যাসপিতা পরাশরের মুখ দিয়ে। বোঝাতে চেয়েছেন, যেন ব্যাসের মতো মহাকবি এবং দার্শনিক কোনও অনভিজাত গর্ভের জাতক হতে পারেন না।
আমাদের আধুনিক বুদ্ধিতে আমরা যা বুঝি, তাতে আমরা ব্যাসের রচিত কাহিনীর মূল ধারাই অনুসরণ করব। আমরা সেই যমুনার তরঙ্গবাহিত নৌকাটির ওপরে ফিরে যাব, যেখানে মহর্ষি পরাশরকে সত্যবতীর যৌবনোদ্ধত অঙ্গসংস্থানের ওপর দৃষ্টিনিক্ষেপ করতে দেখেছি। পরাশরের সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে সত্যবতী খানিকটা সংকুচিত বোধ করতেই মুনি অত্যন্ত ভদ্রভাবে তাঁর কাছে সবিনয় প্রার্থনা জানিয়ে বলেছেন—আমি তোমার কাছে একটি পুত্রসন্তান কামনা করি, ভদ্রে—যে পুত্র আমার বংশধারা রক্ষা করবে, আর সেই জন্যই আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গত হতে চাই, কল্যাণী—সঙ্গমং মম কল্যাণি কুরুষ্বেত্যভ্যভাষত।
সত্যবতী তাঁর স্ত্রীজনোচিত অনুভবে পরিষ্কার বুঝতে পারছিলেন যে, মহর্ষি কী চান। তবু মহর্ষির ব্যবহারে কোনও কামোন্মত্ততা ছিল না, ছিল না সেই তাড়াহুড়ো যাতে কোনও বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়। তিনি তাঁর ঈপ্সিত কামনা অপরিস্ফুট রাখেননি এবং সেই ঈপ্সা নিবেদন করেছেন অলঙ্ঘ্য এক যৌক্তিকতায়—তিনি একটি বংশরক্ষক পুত্র চান—যাচে বংশকরং সুতম্। অর্থাৎ শুধুই কামচরিতার্থতা নয়, সেকালের দিনের সামাজিকতার নিরিখে এই পুত্রলাভের আকাঙ্ক্ষা নিতান্তই এক ধর্মীয় প্ররোচনা, যার গৌণফল রতিলিপ্সা। সত্যবতী যতখানি সুন্দরী, ততখানিই বুদ্ধিমতী। পরাশরের মিলনেচ্ছাকে তিনি সযৌক্তিভাবেই গ্রহণ করেছেন, কিন্তু রমণীর স্বাভাবিক সলজ্জ প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন—কীভাবে এই শরীর-সঙ্গম সম্ভব হবে, মহর্ষি! যমুনার পরপারে আরও কত মুনি ঋষিদের দেখা যাচ্ছে। আপনার দিকেও তাঁরা চেয়ে রয়েছেন এবং হয়তো আপনার নির্বিঘ্ন নদী-তরণের প্রতীক্ষাতেই এই চেয়ে থাকা। কিন্তু এইভাবে তাঁরা আমাদের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলে কীভাবেই বা আপনার ঈপ্সিত মিলন সম্ভব—আবয়ো-র্দৃষ্টয়ো-রেভিঃ কথং নু স্যাৎ সমাগমঃ! পরাশর বুঝলেন—তাঁর ঈপ্সিত মিলন সত্যবতী প্রত্যাখ্যান করেননি, কিন্তু প্রত্যাখ্যান করেননি বলেই পৌরুষেয়তার তাড়নায় যা ইচ্ছে তাই করা যায় না। সত্যবতীর মান, সম্ভ্রম এবং তাঁর স্ত্রীজনোচিত লজ্জার সম্মান রাখবার জন্য তপঃসিদ্ধ মুনি এবার আপন যোগপ্রভাবে নিজেদের চারিদিকে ঘনিয়ে নিলেন ঘন কুয়াশার আবরণ। মনে হল যেন যমুনাতরঙ্গবাহিনী নৌকোর চারদিকে নেমে এল ঘন অন্ধকার প্ৰেমনত নয়নের দীর্ঘচ্ছায়াময় পল্লবের মতো—যেন দেশঃ স সর্বস্তু তমোভূত ইবভবৎ।
মহর্ষির অলৌকিক যোগপ্রভাবে ঘন নীহার সৃষ্টি হতে দেখে সত্যবতী বুঝলেন যে, মহর্ষির প্রতীক্ষিত মিলন কোনওভাবেই আর বিলম্বিত করা যাবে না। এবারে তাঁর মনে একটু শঙ্কা হল। মনের মধ্যে জেগে উঠল প্রখর বাস্তব। তাঁর কথার সম্মান রেখেই মুনি এই ঘন নীহারিকার সৃষ্টি করেছেন, এখন তাঁর কথা না শুনলে তিনি যদি অভিশাপ দেন! আবার মুনির কথামতো তাঁর সঙ্গে মিলিত হলে এবং গর্ভবতী হলে ঘরে তাঁর পিতা কী বলবেন? এক দিকে মুনির অভিশাপ, অন্য দিকে পিতার তিরস্কার—যুগপৎ এই দুই ভয়ে সত্যবতী বেশ সন্ত্রস্ত বোধ করলেন এবার—তমহং শাপভীতা চ পিতুর্ভীতা চ ভারত।
কুমারীর মনে এ এমনই এক সন্ত্রাস, যা কিছুতেই চেপে রাখা যায় না। সত্যবতী তাই সবিনয়ে ঋষিকে জানালেন—মহর্ষি! আমি কুমারী এবং পিতার অধীন। আপনার সঙ্গে যদি এইভাবে মিলিত হই, তবে লঙ্ঘিত হবে আমার কুমারীত্ব, সেই অবস্থায় আমি ঘরে ফিরব কী করে, বাঁচবই বা কী করে? আমার ভয় করছে ঋষি! আমি ঘরে ফিরে যেতে চাই—গৃহং গন্তুমৃষে চাহং ধীমন্ ন স্থাতুমুৎসহে। আমার সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিবেচনা করে আপনি যা করবার হয় করুন। সত্যবতীর কথায় পরাশর অসন্তুষ্ট হলেন না। বরঞ্চ খুশি হয়ে বললেন—আমার প্রিয়কার্য সম্পন্ন করার পর তুমি আবারও কুমারীত্ব লাভ করবে। কোনও ভয় নেই তোমার। এ ছাড়া আরও যদি তোমার ইচ্ছে কিছু থাকে তো বলো, আমি পূরণ করব।
আগেই বলেছি, মৎস্যজীবীদের ঘরে মানুষ হওয়ায় সত্যবতীর গায়ে মাছের আঁশটে গন্ধ বেরোত। অন্য রমণীদের সঙ্গে নিজের তুলনা করে, এই গন্ধ নিয়ে নিশ্চয় বিব্রত হতেন তিনি। অতএব পরাশরের কাছে বর চাইবার সময় তিনি আর অন্য কিছু খুঁজে পেলেন না। তাঁর গায়ে যাতে উত্তম সুগন্ধের সৃষ্টি হয়—শুধু এইটুকু প্রার্থনা করে মুনির সঙ্গে তাঁর ঈপ্সিত মিলন সম্পন্ন করলেন সত্যবতী। যোগসিদ্ধ মুনির কাছে এই সামান্য বর-প্রার্থনায় মহাকবি হিসেবে স্বয়ং ব্যাস আশ্চর্য হননি। আপন জননীর এই ব্যবহারের মধ্যে মহাকবি দেখতে পেয়েছেন স্ত্রীজনোচিত চিরন্তন সৌন্দর্য-মাধুর্যের আকাঙক্ষা, যে কারণে অন্য কোনও দুর্লভ বর প্রার্থনা না করে শুধু সুগন্ধবতী হবার আশীর্বাদ চেয়েছিলেন সত্যবতী—ততো লব্ধবরা প্রীতি স্ত্রীভাবগুণভূষিতা।
ধীবরকন্যা সত্যবতীর সঙ্গে পরাশর মুনির যে ঈপ্সিত মিলন হল, আমাদের সমাজের প্রাচীন অভিভাবক মনুমহারাজের এতে সায় ছিল না মোটেই। আমি আগেই বলেছি তিনি তাঁর আপন গ্রন্থে প্রায় ধমক দিয়ে বলেছিলেন—যে ব্রাহ্মণ শূদ্রার অধররস পান করিয়াছে—বৃষলীফেনপীতস্য—কিংবা তাহার গর্ভে পুত্র উৎপাদন করিয়াছে, তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিয়াও নিস্তার নাই। কিন্তু পরাশরের আপন যুগে সমাজের বন্ধন কিছু শিথিল ছিল বলেই হোক, অথবা তিনি সর্বতোভাবে এই মনুমতের গুণগ্রাহী ছিলেন না বলেই হোক, অথবা মহাপুরুষের আকস্মিক ইচ্ছায় এবং লগ্নের অনুকূলতায় ভারত-মহাকবির অভ্যুদয় ঘটবে বলেই হয়তো মহর্ষি পরাশরের সঙ্গে ধীবরকন্যার মিলন সম্পন্ন হল। মহাযোগীর ক্ষণিক ইচ্ছায়, ক্ষণিক মিলনে, সত্যবতীর সদ্যোগৰ্ভ প্রকাশিত হল এবং যমুনার অন্তর্বর্তী এক দ্বীপের মধ্যে জন্ম হল ব্যাসের। তিনি জন্মেই বড় হয়ে উঠলেন পিতা পরাশরের অলৌকিক প্রভাবে। মাতা সত্যবতীর এমন কোনও দায় থাকল না যাতে তিনি বলতে পারেন যে, তাঁর গর্ভসঞ্চারী পরাশর এবং তাঁর গর্ভস্থ সন্তান ব্যাস তাঁর স্বাভাবিক এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় আর কোনও ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন। ঠিক সেই জন্যই বুঝি পরবর্তী পৌরাণিকেরা লিখেছেন—জয় হোক সেই পরাশরাত্মজ ব্যাসের, যিনি মাতা সত্যবতীর হৃদয়ের আনন্দ কন্দস্বরূপ।
যেমনটি বলেছিলাম, অভীষ্ট পুত্র লাভ করার পর মহর্ষি পরাশর রতিক্রীড়ার মায়াময় যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ হবার জন্য আর সেখানে থাকেননি, এমনকী সত্যবতীকে একবার বিদায়সম্ভাষণ জানিয়েও বলেননি যে—ভদ্রে! আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে। ভবিষ্যতে যিনি নিষ্কাম এবং নির্বিন্নভাবে মহাভারত মহাকাব্যের সৃষ্টি করবেন, তাঁর পরম অভ্যুদয় ঘটিয়েই পরাশর চলে গেছেন। আর জন্মমাত্রেই তাঁর পুত্রের আচরণ কীরকম! জন্মমাত্রেই তিনি জননী সত্যবতীকে বলছেন—আমি তপস্যার জন্য যাচ্ছি মা! কোনও প্রয়োজন উপস্থিত হলেই আমাকে স্মরণ করবেন আপনি, আমি চলে আসব—স্মৃতো’হং দর্শয়িষ্যামি কৃত্যেষ্বিতি চ সো’ব্রবীৎ।