বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – ২

॥ ২ ॥

পরের রবিবার আবার লালমোহনবাবুর আবির্ভাব। ফেলুদা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল ভদ্রলোককে অর্ধেক খরচ অফার করবে, কারণ ওর নিজের হাতেও সম্প্রতি কিছু টাকা এসেছে। শুধু কেস থেকে নয়; গত তিন মাসে ও দুটো ইংরেজি বই অনুবাদ করেছে—ঊনবিংশ শতাব্দীর দু’জন বিখ্যাত পর্যটকের ভ্রমণ কাহিনী—দুটোই ছাপা হচ্ছে, আর দুটো থেকেই কিছু আগাম টাকা পেয়েছে ও। এর আগেও অবসর সময় ফেলুদাকে মাঝে মাঝে লিখতে দেখেছি—কিন্তু আদা-নুন খেয়ে লিখতে লাগা এই প্রথম।

লালমোহনবাবু অবশ্যি ফেলুদার প্রস্তাব এক কথায় উড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘খেপেছেন? লেখার ব্যাপারে আপনি এখন আমার গাইড অ্যান্ড গডফাদার। এটা হল আপনাকে আমার সামান্য দক্ষিণা।’

এই বলে পকেট থেকে দুটো প্লেনের টিকিট বার করে টেবিলের উপর রেখে বললেন, ‘মঙ্গলবার সকাল দশটা পঁয়তাল্লিশে ফ্লাইট। এক ঘণ্টা আগে রিপোর্টিং টাইম। আমি সোজা দমদমে গিয়ে আপনাদের জন্য ওয়েট করব।’

‘শুটিং আরম্ভ হচ্ছে কবে?’

‘বিষ্যুদ্‌বার। একেবারে ক্লাইম্যাকসের সিন। সেই ট্রেন, মোটর আর ঘোড়ার ব্যাপারটা।’

এ ছাড়াও আর একটা খবর দেবার ছিল লালমোহনবাবুর।

‘কাল সন্ধেবেলা আরেক ব্যাপার মশাই। এখানকার এক ফিলিম প্রোডিউসার—ধরমতলায় আপিস—আমার পাবলিশারের কাছ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে সোজা আমার বাড়িতে গিয়ে হাজির। সেও “বোম্বাইয়ের বোম্বেটে” ছবি করতে চায়। বলে বাংলায় হিন্দি টাইপের ছবি না করলে আর চলছে না। গপ্প বিক্রি হয়ে গেছে শুনে বেশ হতাশ হল। বইটা অবিশ্যি উনি নিজে পড়েননি; ওঁর এক ভাগ্‌নে পড়ে ওঁকে বলেছে। আমি বোম্বাই না গিয়েই বইটা লিখেছি শুনে বেশ অবাক হলেন। আমি আর ভাঙলুম না যে মারে-র গাইড টু ইন্ডিয়া আর ফেলু মিত্তিরের গাইডেন্স ছাড়া এ কাজ হত না।’

‘ভদ্রলোক বাঙালি?’

‘ইয়েস স্যার। বারেন্দ্র। সান্যাল। কথায় পশ্চিমা টান আছে। বললেন জব্বলপুরের মানুষ। গায়ে উগ্র পারফিউমের গন্ধ। নাক জ্বলে যায় মশাই। পুরুষ মানুষ এভাবে সেন্ট মাখে এই প্রথম এক্সপেরিয়েন্স করলুম। যাই হোক্‌, আমি চলে যাচ্ছি শুনে একটা ঠিকানা দিয়ে দিলেন। বললেন, “কোনও অসুবিধে হলে একে ফোন করতে পারেন। আমার এ বন্ধুটি খুব হেলপ্‌ফুল”।’

কলকাতায় ডিসেম্বরে বেশ শীত পড়লেও বম্বেতে নাকি তেমন ঠাণ্ডা পড়ে না। আমাদের ছোট দুটো সুটকেসেই সব ম্যানেজ হয়ে গেল। মঙ্গলবার সকালে উঠে দেখি কুয়াশায় রাস্তার ও পারে পল্টুদের বাড়িটা পর্যন্ত ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। প্লেন ছাড়বে তো? আশ্চর্য, ন’টার মধ্যে সব সাফ হয়ে গিয়ে ঝক্‌ঝকে রোদ উঠে গেল। ভি আই পি রোডে এমনিতেই শহরের চেয়ে বেশি কুয়াশা হয়, কিন্তু আজ দেখলাম তেমন কিছু নয়।

এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছলাম, তখন প্লেন ছাড়তে পঞ্চাশ মিনিট বাকি। লালমোহনবাবু আগেই হাজির। এমনকী বোর্ডিং কার্ডও দেখলাম উঁকি মারছে পকেট থেকে। বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, ফেলুবাবু—লম্বা কিউ দেখে ভাবলুম যদি জানলার ধারে সিট না পাই, তাই আগেভাগেই সেরে রাখলুম। এইচ রো—দেখুন হয়তো দেখবেন কাছাকাছি সিট পেয়ে গেছেন।’

‘আপনার হাতে ওটা কী? কী বই কিনলেন?’

লালমোহনবাবুর বগলে একটা ব্রাউন কাগজের প্যাকেট দেখে আমার মনে হয়েছিল উনি নিজের বই সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন ওখানে কাউকে দেবেন বলে।

ফেলুদার প্রশ্নের জবাবে ভদ্রলোক বললেন, ‘কিনব কি মশাই; সেই সান্যাল—সে দিন যার কথা বলেছিলাম—সে দিয়ে গেল এই মিনিট দশেক আগে।’

‘উপহার?’

‘নো স্যার। বম্বে এয়ারপোর্টে লোক এসে নিয়ে যাবে। আমার নাম-ধাম তাকে জানিয়ে দিয়েছেন। কোন এক আত্মীয়ের কাছে যাবে এ বই।’ তারপর একটু হেসে বললেন, ‘ইয়ে—একটা বেশ অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাচ্ছেন না?’

‘পাওয়া মুশকিল’, বলল ফেলুদা, ‘কারণ ভারত কেমিক্যাল্‌স-এর গুলবাহার সেন্টের গন্ধ আর সব গন্ধকে ম্লান করে দিয়েছে।’

গন্ধটা আমিও পেয়েছিলাম। সান্যাল মশাই এমনই সেন্ট মাখেন যে তার সুবাস এই প্যাকেটে পর্যন্ত লেগে রয়েছে।

‘যা বলেছেন স্যার, হ্যাঃ হ্যাঃ’, সায় দিলেন জটায়ু। ‘তবে অনেক সময় শুনিচি, এইভাবে লোকে উল্টোপাল্টা জিনিসও চালান দেয়।’

‘সে তো বটেই। বুকিং কাউন্টারে তো নোটিসই লাগানো আছে যে, অচেনা লোকের হাত থেকে চালান দেওয়ার জন্য কোনও জিনিস নেওয়াটা বিপজ্জনক। অবিশ্যি এ ভদ্রলোককে টেকনিক্যালি ঠিক অচেনা বলা চলে না, আর প্যাকেটটাও যে বইয়ের, সেটা সন্দেহ করার কোনও কারণ দেখছি না।’

প্লেনে তিনজনে পাশাপাশি জায়গা পেলাম না; লালমোহনবাবু আমাদের তিনটে সারি পিছনে জানলার ধারে বসলেন। ফ্লাইটে বলবার মতো তেমন কিছু ঘটেনি। কেবল লাউডস্পিকারে ক্যাপ্টেন দত্ত যখন বলছেন আমরা নাগপুরের উপর দিয়ে যাচ্ছি, তখন পিছন ফিরে দেখি লালমোহনবাবু সিট ছেড়ে উঠে প্লেনের ল্যাজের দিকটায় চলেছেন। শেষটায় একজন এয়ার হোসটেস ওঁকে থামিয়ে উল্টো দিকে দেখিয়ে দিতে ভদ্রলোক আবার সারা পথ হেঁটে সোজা পাইলটের দরজা খুলে কক্‌পিটে ঢুকে তক্ষুনি বেরিয়ে এসে জিভ কেটে বাঁ দিকের দরজা দিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। নিজের সিটে ফেরার পথে আমার উপর ঝুঁকে পড়ে কানে ফিস্‌ ফিস্‌ করে বলে গেলেন, ‘আমার পাশের লোকটিকে এক ঝলক দেখে নাও। হাই-জ্যাকার হলে আশ্চর্য হব না।’

মাথা ঘুরিয়ে দেখে বুঝলাম জটায়ু অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে একেবারে হন্যে হয়ে না থাকলে ও রকম নিরীহ, নেই-থুতনি মানুষটাকে কক্ষনও হাই-জ্যাকার ভাবতেন না।

সান্টা ক্রুজে প্লেন ল্যান্ড করার ঠিক আগেই লালমোহনবাবু ব্যাগ থেকে বইটা বার করে রেখেছিলেন। ডোমেসটিক লাউঞ্জে ঢুকে আমরা তিনজনেই এদিক ওদিক দেখছি, এমন সময় ‘মিস্টার গাঙ্গুলী?’ শুনে ডাইনে ঘুরে দেখি গাঢ় লাল রঙের টেরিলিনের শার্ট পরা একজন লোক মাদ্রাজি টাইপের এক ভদ্রলোককে প্রশ্নটা করে তার দিকে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে চেয়ে আছে। ভদ্রলোক একটু যেন বিরক্ত ভাবেই মাথা নেড়ে ‘না’ বলে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন, আর লালমোহনবাবুও বই হাতে লাল শার্টের দিকে এগিয়ে গেলেন।

‘আই অ্যাম মিস্টার গাঙ্গুলী অ্যান্ড দিস ইজ ফ্রম মিস্টার সান্যাল’, এক নিশ্বাসে বলে ফেললেন জটায়ু।

লাল শার্ট বইটা নিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন, আর লালমোহনবাবুও কর্তব্য সেরে নিশ্চিন্তে হাত ঝাড়লেন।

আমাদের মাল বেরোতে লাগল আধ ঘণ্টা। এখন একটা বেজে কুড়ি, শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে হয়ে যাবে প্রায় দুটো। পুলক ঘোষাল গাড়ির নম্বরটা জানিয়ে দিয়েছিলেন আগেই, দেখলাম সেটা একটা গেরুয়া রঙের স্ট্যান্ডার্ড। ড্রাইভারটি বেশ শৌখিন ও ফিটফাট; হিন্দি ছাড়া ইংরেজিটাও মোটামুটি জানে। কলকাতার তিনজন অচেনা লোকের জন্য ভাড়া খাটতে হচ্ছে বলে কোনওরকম বিরক্তির ভাব দেখলাম না। বরং লালমোহনবাবুকে যে রকম একটা সেলাম ঠুকল, তাতে মনে হল কাজটা পেয়ে সে কৃতার্থ। ড্রাইভারই খবর দিল যে শহরের ভিতরেই শালিমার হোটেলে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে, আর পুলকবাবু বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় হোটেলে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন। গাড়ি আমাদের জন্য রাখা থাকবে, আমরা যখন খুশি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি।

ফেলুদা অবিশ্যি এখানে আসবার আগে ওর অভ্যাস মতো বম্বে সম্বন্ধে পড়াশুনা করে নিয়েছে। ও বলে, কোনও নতুন জায়গায় আসার আগে এ জিনিসটা করে না নিলে নাকি সে জায়গা দূরেই থেকে যায়। মানুষের যেমন একটা পরিচয় তার নামে, একটা চেহারায়, একটা চরিত্রে আর একটা তার অতীত ইতিহাসে, ঠিক তেমনই নাকি শহরেরও। বম্বে শহরের চেহারা আর চরিত্র এখনও ফেলুদার জানা নেই, তবে এটা জানে যে শালিমার হোটেল হল কেম্পস কর্নারের কাছে।

আমাদের গাড়ি হাইওয়ে দিয়ে গিয়ে একটা বড় রাস্তায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদা ড্রাইভারকে উদ্দেশ করে বলল—‘উয়ো যো ট্যাক্সি হ্যায় না—এম আর পি থ্রি ফাইভ থ্রি এইট—উসকো পিছে পিছে চল্‌না।’

‘কী ব্যাপার মশাই?’ লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

‘একটা সামান্য কৌতূহল’, বলল ফেলুদা।

আমাদের গাড়ি একটা স্কুটার আর দুটো অ্যাম্বাসাডারকে ছাড়িয়ে ফিয়াট ট্যাক্সিটার ঠিক পিছনে এসে পড়ল। এবার ট্যাক্সিটার পিছনের কাঁচ দিয়ে দেখলাম ভিতরে বসা লাল টেরিলিনের শার্ট।

একটু যেন বুকটা কেঁপে উঠল। কিছুই হয়নি, কেন ফেলুদা ট্যাক্সিটাকে ধাওয়া করছে তাও জানি না, তবু ব্যাপারটা আমার হিসেবের বাইরে বলেই যেন একটা রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চারের ছোঁয়া লাগল। লালমোহনবাবু অবিশ্যি আজকাল ধরেই নিয়েছেন যে, ফেলুদার সব কাজের মানে জিজ্ঞেস করে সব সময়ে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না; যথাসময়ে আপনা থেকেই সেটা জানা যাবে।

আমাদের গাড়ি দিব্যি ট্যাক্সিটাকে চোখে রেখে চলেছে, আমরাও নতুন শহরের রাস্তাঘাট লোকজন দেখতে দেখতে চলেছি। একটা জিনিস বলতেই হবে—হিন্দি ছবির এত বেশি আর এত বড় বড় বিজ্ঞাপন আর কোনও শহরের রাস্তায় দেখিনি। লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ ধরে ঘাড় ফিরিয়ে ফিরিয়ে সেগুলো দেখে বললেন, ‘সবাইয়ের নামই তো দেখছি, অথচ কাহিনীকারের নামটা যেন চোখে পড়ছে না। এরা কি গপ্প লেখায় না কাউকে দিয়ে?’

ফেলুদা বলল, ‘গপ্প লেখক হিসেবে নাম যদি আশা করেন, তা হলে বম্বে আপনার জায়গা নয়। এখানে গপ্প লেখা হয় না, গপ্প তৈরি হয়, ম্যানুফ্যাকচার হয়—যেমন বাজারের আর পাঁচটা জিনিস ম্যানুফাকচার হয়। লাক্স সাবান কে তৈরি করেছে, তার নাম কি কেউ জানে?—কোম্পানির নামটা হয়তো জানে। টাকা পাচ্ছেন, ব্যস; মুখটি বন্ধ করে বসে থাকুন। সম্মানের কথা ভুলে যান।’

‘হুঁ…।’ লালমোহনবাবু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ‘তা হলে মান হল গিয়ে আপনার বেঙ্গলে, আর বম্বেতে হচ্ছে মানি?’

‘হক্‌ কথা’, বলল ফেলুদা।

ফেলুদা যে-এলাকাটাকে মহালক্ষ্মী বলে বলল, সেটা ছাড়িয়ে কিছু দূর গিয়ে আমাদের মার্কামারা ট্যাক্সিটা একটা ডান দিকের রাস্তা ধরল। আমাদের ড্রাইভার বলল যে, শালিমার হোটেল যেতে হলে আমাদের সোজাই যাওয়া উচিত।

ফেলুদা বলল, ‘আপ দাঁয়া চলিয়ে।’

ডান দিকে ঘুরে মিনিট দু’-এক যেতেই দেখলাম ট্যাক্সিটা বাঁ দিকে একটা গেটের ভিতর ঢুকে গেল। ফেলুদার নির্দেশে আমাদের গাড়ি গেটের বাইরেই থামল। আমরা তিনজনেই গাড়ি থেকে নামলাম, আর নামার সঙ্গে সঙ্গেই লালমোহনবাবু হিঁক করে একটা অদ্ভুত শব্দ করলেন।

কারণটা পরিষ্কার। আমরা একটা বিরাট ঢ্যাঙা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছি, তার তিনতলার হাইটে বড় বড় উঁচু উঁচু কালো অক্ষরে ইংরাজিতে লেখা—শিবাজী কাস্‌ল।