সকালের খবর কাগজে পড়ি কতিপয় কৃষ্ণাঙ্গ অক্ষর
এবং একটা ফটোগ্রাফ দেখি প্রথম পাতায়।
সেই সব অক্ষরের অভ্যন্তর থেকে
এক ঝাঁক প্রজাপতি, মাছরাঙা, পুকুর পারের হাঁস আর
জলপিপি, সোনালি নূপুর,
অনেক পুরানো হলদে পাণ্ডুলিপি উড়ে
এসে বসে ছাদের কার্নিশে। বেদনার বনস্থলী
দৃশ্যত নিউজপ্রিন্টে ফুটে ওঠে চলিত ভাষায়।
তাঁকে চিনতাম, বলা যায়; তাঁর কীর্তিমালা ছিল
পরিচিত আমার নিকট,
সংক্ষিপ্ত জীবনী তাঁর জেনেছি নানান সূত্রে; কবি
ছিলেন, যদিও কাব্যলক্ষ্মী
অনেক আগেই তাঁকে নথের ঝামটা মেরে তাঁর
ভিটে ছেড়ে চলে যান। পরিত্যক্ত কেয়ুরের দিকে
কখনো কখনো তাকাতেন প্রেরণারহিত কবি বড় নীল
কুয়াশা-জড়ানো চোখে পড়ন্ত বেলায়।
মেজাজে চৈত্রের দাহ ছিল তাঁর, কেউ কেউ তাঁকে
দুর্বাসা বানিয়ে ভারি মজা পেত এবং রটাত
কেউ স্বাদ, আড্ডায়, সালুনে নুন কিছু কম হ’লে তিনি নাকি
রাঁধুনিকে করতেন তিরস্কার চার ঘণ্টা, সজারুর মতো
কাঁটা খাড়া করে উঠতেন মেতে যুক্তিতর্কে গল্পে। শোনা যায়,
ঢেঁড়স, গাজর, বীট, ফুলকপি, পালঙ ফলাতে গিয়ে তিনি
গোলাপ, টগর, জুঁই, রজনীগন্ধার প্রতি খুব
অবহেলা করেছেন অনেক ঋতুতে।
প্রাণবন্ত যৌবনের গোলদীঘিটির চতুর্দিকে
ঘুরেছেন তিনি যতবার,
ততবারই একটি পাকুড় গাছ তাঁকে দিয়েছে নির্দেশ
দীঘিতে গোসল সেরে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্যে যেতে
রহস্যের নিবাসে যেখানে কেউ থালা
সাজিয়ে রয়েছে ব’সে হাতপাখা নিয়ে;
মাধুর্যের প্রতি নয়, রুক্ষতার পঞ্চ ব্যঞ্জনের
প্রতি তাঁর আকর্ষণ বেড়েছে নিয়ত।
যতদূর জানি,
শেষ অব্দি বাজত শরীরে তাঁর ঝিঁ ঝিঁ ডাকের মতো এক
শাক্ত ভাব, আশৈশব ভালোবাসতেন
দূর-থেকে-ভেসে-আসা ঘণ্টাধ্বনি, যার
কথা আছে তাঁর এপিটাফে। চরাচরে
একটি সোনালি ঘণ্টা বাজে শব্দহীন, কেবলি রাজতে থাকে
বুকের ভেতর, রেকাবিতে
শিউলি বিষণ্নতায় ম্লান হয় প্রহরে প্রহরে।
না-খোলা একটি চিঠি, আধপড়া কবিতার বই
লেখার টেবিল পড়ে আছে; শেষ লেখা
ডায়েরির নিভৃত পাতায় ফ্যালে দীর্ঘশ্বাস, ঘরে
যেন গজিয়েছে বন অকস্মাৎ, তাঁর
ফটোগ্রাফে প্রজাপতি কী নির্ভার সময় পোহায়। এরপর
কখনো লেখার ফাঁকে চা জুড়াবে বলে
কেউ তাড়া দেবে না; এখন ঘরে হেমন্তের বেলা পড়ে আসে,
বেলা পড়ে আসে বৃদ্ধ কবির নমিত জানাজায়।