বেতাল ষড়বিংশতি
প্রথম অধ্যায়–স্কুলের মাষ্টার
নূতন-পাড়া নামক একখানি গ্রাম আছে। সেই গ্রামে একটি স্কুল আছে। গৌরীশঙ্কর নামক এক ব্রাহ্মণ যুবক সেই স্কুলে মাষ্টারি করেন। তাঁহার বেতন কুড়ি টাকা। কুড়ি টাকা বেতনে কেহ বড় মানুষ হইতে পারে না; কিন্তু বড় মানুষ হইতে গৌরীশঙ্করের বড় সাধ। কাহার বা সাধ নয়? কি করিয়া রাতারাতি অর্থবান্ হইতে পারা যায়, গৌরীশঙ্কর সুবুদ্ধি লোক, সহজেই সে উপায় তিনি বাহির করিলেন।
গৌরীশঙ্কর শুনিলেন যে, শ্মশানে গিয়া শব-সাধন করিতে পারিলে দেবীর বরে যাহা ইচ্ছা তাহাই লাভ করিতে পারা যায়। একটা মড়ার উপর বসিয়া, কিছুক্ষণ জপ করা বই তো নয়! কেনই বা তা না পারিব? গৌরীশঙ্কর সাহসী পুরুষ ছিলেন, এ কার্যে তিনি ব্রতী হইলেন। কি করিয়া এ কাজ করিতে হয়, সেই দিন হইতে তিনি সে তত্ত্ব অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। গুরুগিরিতে তাঁহার বড় বিশ্বাস ছিল না। তিনি দীক্ষিত হন নাই। কিন্তু মাথায় একটি টিকি রাখিয়াছিলেন।
যাহা হউক, গৌরীশঙ্কর শব-সাধনার নিমিত্ত তিনি একটি মন্ত্র পাইলেন। আর এক জনের নিকট ইহার প্রকরণও কিছু কিছু জানিয়া লইলেন। গুরু তাঁহার ছিল না, এ কার্যে উত্তর সাধক হয়, এমন এক জন লোকও তিনি পাইলেন না। উত্তর সাধকের জন্য তিনি বিশেষ চেষ্টাও করে নাই। কারণ, রাতারাতি বড় মানুষ হইতে হইলে, সে কাজটা গোপনে হইলেই ভাল হয়; ভাগিদার করা উচিত নয়।
মন্ত্রের যোগাড় হইল, প্রকরণ ঠিক হইল। এখন চাই মড়া। মড়া না হইলে শব-সাধন হয় না। যেমন তেমন মড়ায় এ কাজ হ: না। গৌরীশঙ্কর অনেক দিন ধরিয়া, উপযুক্ত শবের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। দৈবক্রমে কিছুদিন পরে তাঁহাদের গ্রামে সর্পাঘাতে এক জন চণ্ডালের মৃত্যু হইল।
গৌরীশঙ্কর সেই চণ্ডালের আত্মীয়গণকে বলিলেন,—সর্পদংশনে লোকের প্রকৃত মৃত্যু হয় না। একপ্রকার অজ্ঞান হইয়া থাকে। ভাল রোজার হাতে পড়িলে পুনরায় জীবিত হইতে পারে। গঙ্গার ধারে হইলে, মৃতদেহ গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করাই উচিত। এ স্থানে গঙ্গা নাই। শ্মশানে লইয়া বাঁশের একটি উচ্চ মাচা নির্মাণ করিয়া, তাঁহার উপর ইহাকে সাত দিন রাখিয়া দাও। ইহার যদি আয়ু থাকে, তাহা হইলে এই সাত দিনের মধ্যে কোন স্থান হইতে রোজা আসিয়া ইহার প্রাণদান করিবেন। কত স্থানে এরূপ কত ঘটনা হইয়া গিয়াছে।
বিন্দু মাত্র আশা থাকিতে কে আর প্রিয়জনকে পরিত্যাগ করে? নূতনপাড়ার বাহিরে মাঠের মাঝখানে যে একটি পুরাতন পুষ্করিণীর ধারে এ স্থানের লোকে শব দাহ করে। বাঁশের মাচা না করিয়া, চণ্ডলেরা সেই পুষ্করিণীর ধারে একটা বটগাছের উপর আত্মীয়ের মৃতদেহ বাঁধিয়া রখিল।
গৌরীশঙ্কর বাবুর আনন্দের আর সীমা রহিল না। কারণ, একে চণ্ডালের মড়া, তাঁহার উপর আবার সর্পাঘাতে মৃত্যু,শব সাধনের পক্ষে দুলর্ভ সামগ্রী। শাস্ত্রের বচনটা বোধ হয় তিনি শুনিয়াছিলেন, যতা;–
যষ্টিবিদ্ধং শূলবিদ্ধং খড়ঙ্গবিদ্ধং পয়গামৃতং।
রবদ্ধং সর্পদষ্টং চাণ্ডালং বাতিভতিকং।।
তরুণং সুন্দরং শুদ্রং রণে নষ্টং সমুজ্জ্বলং।
পলায়নবিশূন্যঞ্চ সংমুখে রণবৰ্ত্তিনং।।
গৌরীশঙ্কর বাবুর কপালে আর একটি সুবিধা হইল। চণ্ডালের মৃত্যুর তিন দিন পরেই শনিবার অমাবস্যা পড়িল। নানারূপ শুভ লক্ষণ দেখিয়া তিনি মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন,—বিপুল ধনসম্পত্তির অধিস্বামী এইবার নিশ্চয় হইবে। ধনবান হইয়া কোথায় কাহার কন্যাকে বিবাহ করিবেন, কোন স্থানে রাজভবনসদৃশ অট্টালিকা নির্মাণ করিবেন, কিরূপ জমিদারী ক্রয় করিবেন, কি উপায় অবলম্বনে মহারাজা উপাধি লাভ করিবেন, এখন এই সমুদয় কথা চিন্তা করিতে লাগিলেন। তাঁহার বয়ঃক্রম প্রায় ত্রিশ হইয়াছিল; কিন্তু নিম্নশ্রেণীস্থ ব্রাহ্মণ বলিয়া, টাকার অভাবে এখনও তাঁহার বিবাহ হয় নাই। সংসারে বৃদ্ধা মাতা ব্যতীত আর কেহ ছিল না। মুখে প্রকাশ না করুন, কিন্তু মনে মনে বিবাহের জন্য গৌরীশঙ্কর বিশেষ লালায়িত ছিলেন। পুত্রবধূ লইয়া ঘর করিতে তাঁহার মাতারও যে একান্ত বাসনা ছিল, সে কথা আর বলা বাহুল্য। এক্ষণে সেই সমুদয় বাসনা পূর্ণ হইবে। চণ্ডালের মড়া পাইয়া, সম্মুখে শনিবার অমাবস্যা পাইয়া, গৌরিশঙ্কর বাবু আনন্দসাগরে ভাসিতে লাগিলেন।
শুভদিন আসিয়া উপস্থিত হইল। মদ্য, মৎস্য, মাংস, গুড়, পিষ্টক, পরমানু, তিল, কুশ, সর্ষপ, দীপ, এলাচি, কপুর, খয়ের, পান, আদা, পাটের দড়ি, প্রভৃতি নানারূপ কুলাচারদ্রব্য তিনি আহরণ করিলেন। রাত্রি এক প্রহরের সময় পূজায় উপকরণ লইয়া গৌরীশঙ্কর একাকী শ্মশান অভিমুখে যাত্রা করিলেন। গ্রাম হইতে প্রায় আধ ক্রোশ, মাঠের মাঝখানে, জনশূন্য সেই শ্মশানক্ষেত্র। সে কালে এই পুষ্করিণীর ধারে দুষ্ট দস্যগণ পথিকগণকে মারিয়া ফেলিত। এখনও দিনের বেলা এ স্থানে যাইতে ভয় হয়। ঘোর তিমিরাবৃত অমাবস্যা নিশার তো কথাই নাই! কিন্তু, গৌরীশঙ্করের মনে বিন্দুমাত্র ভয়ের উদয় হইল না। নির্ভয় চিত্তে একাকী তিনি গমন করিতে লাগিলেন। যদি ধন লোভবশতঃ অজ্ঞানতা-সহকারে এ কার্য তিনি না করিতেন, তাহা হইলে বলিতাম,ধন্য গৌরীশঙ্কর! তোমার সাহসকে ধন্য! তুমি বীরপুরুষ বটে। বীর সাধনে মন্ত্রসিদ্ধ হইবার নিমিত্ত তুমি উপযুক্ত পাত্র বটে। কিন্তু তোমার অজ্ঞানতার জন্য দুঃখ হয়। তুমি মনুষ্যের নিকট উপদেশ না গ্রহণ কর, সমুদয় চরাচর জগতের শিক্ষাদাতা সদাশিবকে একান্ত মনে গুরুপদে বরণ কর নাই কেন?
একাকী নির্ভয় হৃদয়ে গৌরীশঙ্কর যাইতে লাগিলেন। ঘোর অন্ধকার। ভয়াবহ নির্জন শ্মশানভূমি। রাত্রি এক প্রহরের সময় সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। শ্মশানে উপস্থিত হইয়া প্রথম তিনি অঘোর-মন্ত্র দ্বারা চারিদিক রক্ষা করিলেন। তাহার পর পুষ্করিণীর জলে স্নান করিয়া, তিনি অধৌত এক চিতায় উপর পূজার স্থান চিহ্নিত করিলেন। তাঁহার পার্শ্বে দীপ রাখিবার নিমিত্ত সামান্য এক গর্ত খুঁড়িলেন। অবশেষে তিনি ধীরে ধীরে সেই বটবৃক্ষে উঠিলেন। পকেট হইতে দীপশলাকা জ্বালাইয়া মাদ্রাবৃত মৃতদেহ দেখিতে পাইলেন। শবের সমীপে উপস্থিত হইয়া তিনি একটি মন্ত্র উচ্চারণ করিলেন!
মড়ার প্রতি লক্ষ্য করিয়া আর একটি মন্ত্র বলিয়া শবকে নমস্কার করিলেন। তাহার পর শবকে তিনবার পুস্পাঞ্জলী দিয়া, তিনি কয়েকটি মন্ত্র পাঠ করিলেন। অবশেষে যে রঙ্কু দ্বারা শব গাছে আবদ্ধ ছিল, আস্তে আস্তে তাহা কাটিয়া ফেলিলেন। এইরূপে যথাসাধ্য ধীরে ধীরে মড়াকে গাছ হইতে নামাইলেন।
তাহার পর মড়ার কোমর ধরিয়া পূজার স্থানে তাঁহাকে টানিয়া লইয়া গেলেন। পুষ্করিণী হইতে কলসী কলসী জল আনিয়া তাঁহাকে উত্তমরূপে স্নান করাইলেন ও চন্দনাদি সুগন্ধ তাঁহার শরীরে লেপন করিলেন। গৌরীশঙ্কর যখন এইরূপ করিতেছেন, তখন মড়া একবার হুহুঙ্কার শব্দ করিয়া দাঁত কিড়মিড় করিল। তাঁহার মুখদেশ তখন ভয়ানক মূর্তি ধারণ করিল। কিন্তু গৌরীশঙ্কর তাহাতে কিছুমাত্র ভীত হইলেন না। মড়ার শরীরে তিনি বার বার থু থু দিতে লাগিলেন। মড়া পুনরায় স্থির হইল। তখন তাঁহাকে পুনরায় প্রক্ষালন করিয়া, পুনরায় তাঁহার শরীরে চাদি লেপন করিলেন।
তাহার পর সেই অধৌত চিতার উপর তিনি কুশ ছড়াইলেন। মড়ার কোমর ধরিয়া, সেই কুশের উপর লইয়া পূর্ব্বশির করিয়া তাঁহাকে শয়ন করাইলেন। তাহার পর এলাচি কপূর প্রভৃতি মশলা সংযুক্ত পান তাঁহার মুখে দিয়া মড়াকে অধোমুখ অর্থাৎ উপুড় করিলেন। এইরূপ কোণা করিয়া তাঁহার পৃষ্ঠদেশে চন্দন দ্বারা, এক চারিকোণা ঘর অঙ্কিত করিলেন।সেই চারিকোণা ঘরের ভিতর একটি অষ্টদল পদ্ম অঙ্কিত করিলেন। মড়া যাহাতে উঠিতে না পারে, সেই জন্য তাঁহার পদদ্বয় পট্টসূত্র দ্বারা বন্ধন খুব জোরে করিলেন।
অবশেষে মড়ার পৃষ্ঠে একখানি কম্বল বিছাইয়া, অশ্বারোহণের ন্যায় তাহায় পৃষ্ঠে চড়িয়া বসিলেন। মড়ার দুই হাত দুই পার্শ্বে বিস্তৃত করিয়া কুশ রাখিয়া, গৌরীশঙ্কর নিজের দুই পা মড়ার দুই হাতের উপর রাখিলেন। মড়ার উপর দীর্ঘ কেশ ছিল, সেই চুলগুলি খুলিয়া গৌরীশঙ্কর ঝুটি বাঁধিয়া দিলেন। অন্ত্র মন্ত্র পাঠ করিয়া, চারিদিকে ছড়াইয়া দিলেন। তাহার পর আর কয়েকটি মন্ত্র পাঠ করিলেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়–নানা বিভীষিকা
এইরূপ নানা প্রকার আয়োজন ও মন্ত্র পাঠ করিয়া গৌরীশঙ্কর পূজা আরম্ভ করিলেন। গুরু নাই যে শুরুর পূজা করিবেন, কাজেই প্রথম তিনি দশদিকপালের পূজা করিলেন। তাহার পর ইন্দ্রকে বলি প্রদান করিলেন। নানা মন্ত্রে ও নানা উপকরণে দেবতাদিগের পূজা করিয়া, গৌরশঙ্কর জপ আরম্ভ করিলেন। অমাবস্যা রাত্রি তো ছিলই, তাঁহার উপর ক্রমে ক্রমে আকাশ ঘোর মেঘাচ্ছন্ন হইল। এরূপ নিবিড় অন্ধকার দ্বারা পৃথিবী অচ্ছন্ন হইল যে, প্রলয়ালে সেরূপ হয় কি না সন্দেহ। তাহার পর তুমুল ঝঞ্ঝাবাতে দশ দিক পূর্ণ হইল।
প্রবল বায়ুবেগে গৌরীশঙ্করকে শবের পৃষ্ট হইতে উত্তোলন করিতে চেষ্টা করিল; কিন্তু তাঁহাকে উঠাইতে পারিল না। দৃঢ় বীরাসনে তিনি শবের পৃষ্ঠে বসিয়া রহিলেন। দন্ত কিড় মিড় করিয়া হুহুঙ্কার শব্দ করিয়া মড়া উঠিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু তাঁহার পদদ্বয় পাটের দড়ি দ্বারা বাঁধা ছিল। নিজের দুই পা দিয়া গৌরীশঙ্কর তাঁহার হাত দুইটি মাটীতে চাপিয়া রাখিলেন। শব উঠিতে পারিল না। এই সময় আকাশে মাঝে মাঝে উল্কাপাত হইতে লাগিল। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ খেলিতে লাগিল, ঘোর বজ্র-শব্দে কর্ণে তালিকা লাগিতে লাগিল। এই সমস্ত উপদ্রবে গৌরীশঙ্কর কিছু মাত্র ভীত হইলেন না। শবের উপর বসিয়া একান্ত মনে তিনি জপ করিতে লাগিলেন। বায়ুবেগে মেঘ ক্রমে দূরীভূত হইল, আকাশ পরিষ্কার হইল; পৃথিবী ক্ষণকালের নিমিত্ত স্থির হইল। এমন সময় সহসা এক দিক হইতে বন্য শূকরের পাল আসিয়া দন্ত দ্বারা গৌরীশঙ্করকে বদ্ধ করিবার নিমিত্ত ধাবিত হইল। সহসা এই বিপদ দেখিয়া, ক্ষণকালের নিমিত্ত তিনি চমকিত হইলেন। কিন্তু পরক্ষণেই চক্ষু মুদিত করিয়া, তিনি জপে প্রবৃত্ত হইলেন। বন্য শূকর অদৃশ্য হইয়া পড়িল। পৃথিবী আর একবরে নিস্তব্ধ হইল। তাহার পর, সহসা অতি নিকটে ব্যাঘ্রের ভীষণ গর্জন শ্রবণ করিয়া গৌরীশঙ্কর একবার চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন যে, এক প্রাকণ্ড ব্যাঘ্র তাঁহার করাল বদন ব্যাদান করিয়া, তাঁহাকে গ্রাস করিতে আসিতেছে। গ্রাস করে আরকি! সহসা ভীত হইয়া, গৌরীশঙ্কর পলায়নের উপক্রম করিলেন। কিন্তু সে চিন্তা নিমেষের নিমিত্ত তাঁহার মনে উদয় হইয়াছিল। মনকে দৃঢ় করিয়া চক্ষু মুদিত করিয়া, পুনরায় তিনি জপে প্রবৃত্ত হইলেন। ব্যাঘ্ৰ চলিয়া গেল। তারপর গৌরীশঙ্করের চারিদিকে অসংখ্যা কালসর্প আসিয়া ফোশ ফোশ করিতে লাগিল। কিন্তু এবারও তিনি চক্ষু চাহিয়া দেখিলেন না, সে নিমিত্ত ভয়ও পাইলেন না। কিছুক্ষণ পরে সাপের গর্জন থামিয়া গেল। তাহার পর গৌরীশঙ্করের ঠিক কানের নিকট বিকট হাসির শব্দ হইল। সেরূপ বিকট হাসি কেহ কখনও শ্রবণ করে নাই। সেই শব্দ শুনিয়া তাঁহার প্রাণ সঁপিয়া উঠিল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ তিনি মনকে স্থির করিলেন। তাহার পরক্ষণেই পালে পালে পিশাচ, ভূত, প্রেত দানা, দৈত্য, ডাকিনী শাকিনী, হাকিনী, ভৈরব, বটকু প্রভৃতি তাঁহার চারিদিকে নৃত্য করিতে লাগিল। নৃত্য করিতে করিতে মাঝে মাঝে এরূপ বিকট শব্দ করিতে লাগিল যে, সে শব্দ শুনিলে কোন মনুষ্যই চেতন অবস্থায় থাকিতে পারে না। পুনরায় আর একবার পলায়ন করিবার নিমিত্ত গৌরীশঙ্করের মন হইল, কিন্তু পরক্ষণেই তিনি মনকে দৃঢ় করিতে সমর্থ হইলেন। চক্ষু মুদিত করিয়া তিনি একান্ত মনে জপ করিতে লাগিলেন। গৌরীশঙ্কর ভাবিলেন যে,ভূত প্রেত কখন দেখি নাই, একবার চাহিয়া দেখি, ভূত-প্রেত কিরূপ হয়। এই বলিয়া তিনি নিমিষের নিমিত্ত একবার চাহিয়া দেখিলেন। কিন্তু সেই ভীষণ দৃশ্য দর্শনে পরক্ষণেই পুনরায় তাঁহাকে চক্ষু বুজিতে হইল। সে বিকট মূর্তি দেখিয়া, কেহ স্থির থাকিতে পারে না। সে অন্ধকারে তিনি তাহাদিগকে দেখিতে পাইতেন না; কিন্তু মাঝে মাঝে তাহাদের মুখবিবর হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাহির হইতেছিল। সেই আলোকে তাহাদের রূপ তাঁহার নয়নগোচর হইল। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, সর্বাঙ্গে সহস্র সহস্র কৃমি দুলিতেছে। পাতালের ন্যায় মুখবিবর। মুখের ভিতর হইতে অনবরত রক্ত নির্গত হইতেছে। গজদন্তের ন্যায় বড়, কিন্তু বক্রাকার, ভীষণ দন্ত। ললাট দেশে কেবল একটি গোলাকার চক্ষু। সেই চক্ষু হইতেও অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ও সর্প বাহির হইতেছিল। চকিতের নিমিত্ত তিনি চাহিয়া দেখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। সেই সময়ে কেবল একটি ভূতের উপর তাঁহার চক্ষু পড়িয়াছিল। সেই এক জনের যৎসামান্য রূপের পরিচয় তিনি পাইয়াছিলেন। অন্যান্য ভূতের কিরূপ আকার ছিল, তাহা দর্শন করেন নাই। ঐ ভূত ব্যতীত ক্ষণকালের নিমিত্ত আর একজন উপদেবতা তাঁহার নয়নগোচর হইয়াছিল; উপরি উক্ত ভূতকে দেখিয়া তিনি চক্ষু বুজিলেন। কিছুক্ষণ পরে উষ্ণ বায়ুস্রোত তাঁহার মুখের উপর পড়িতে লাগিল। তিনি আর একবার চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন যে, ঠিক তাঁহার সম্মুখে এক বৃদ্ধা ডাকিনী হাঁ করিয়া, দীর্ঘ ও ঘোর রক্তবর্ণ জিহ্বা বার বার লেহন করিতেছে। বৃদ্ধা ডাকিনীর একটিও দন্ত নাই। সর্ব্বশরীর তাঁহার শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। অতি ভয়ানক আকৃতি। ডাকিনীর জিহ্বা তাঁহার নাসিকা স্পর্শ করে আর কি! ডাকিনীকে দেখিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ চক্ষু মুদিত করিলেন।
গৌরীশঙ্কর পুনরায় জপ করিতে লাগিলেন। চারিদিকে ভূত-প্রেতগণ নৃত্য করিতে লাগিল। এই সময় বার বার ভূমিকম্প আরম্ভ হইল। গৌরীশঙ্কর মনে করিলেন যে, ভূমিকম্পে পৃথিবী বিদীর্ণ হইয়া গিয়াছে। মড়ার সহিত যেন তিনি পাতালপুরীতে নামিয়া যাইতেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই হুশ করিয়া উঠিয়া পড়িলেন। আর একবার মনে হইল যে, মড়ার সহিত তিনি যেন শূন্যে উঠিতেছেন; কিন্তু পরক্ষণেই হুশ করিয়া নামিয়া পড়িলেন। সেই সময় তাঁহার বুক ঢি ঢিপ করিতে লাগিল! হৃৎপিণ্ড ফাটিয়া যাইবার উপক্রম হইল। যাহা হউক, অনেক কষ্টে মনকে স্থির করিয়া পুনরায় তিনি জপে প্রবৃত্ত হইলেন। ক্রমে ভূত প্রেতের উপদ্রব নিবৃত্ত হইল। পৃথিবী আর একবার স্থির হইল। এই সময় অতি সুমধুর বামা স্বরে নিকটে কে আসিয়া গৌরীশঙ্করকে বলিল,–নাথ! অনেক কষ্ট করিয়াছ। এক্ষণে উঠ! আমি আসিয়াছি। বিবাহের নিমিত্ত তুমি লালায়িত হইয়াছিলে, এখন চাহিয়া দেখ, দেবী তোমার নিমিত্ত কিরূপ পত্নী প্রেরণ করিয়াছেন। নাথ। চিরকাল তোমাকে আমি প্রেমে আবদ্ধ রাখিব। যে স্বর্গীক সুখ শচী ইন্দ্রকে প্রদান করিতে পারে না, সেইরূপ নানা সুখে তোমাকে পরিতোষ করিব। হে প্রাণনাথ! গাত্রোখান কর। ঐ বীভৎস আসনের উপর আর বসিয়া থাকিবার আবশ্যক নাই। কামিনীর সুমধুর স্বরে গৌরীশঙ্করের হৃদয়ে যেন সুধাসিঞ্চন করিল। তিনি চাহিয়া দেখিলেন,সম্মুখে যৌবনপ্রাপ্ত প্রায় চতুর্দশ বর্ষ বয়স্কা এক কামিনী। তাঁহার রূপে সেই অমাবস্যা রাত্রিও আলোকিত হইয়াছিল।
কামিনীর মধুর বচনে গৌরীশঙ্করের হৃদয় শীতল হইল; তাঁহার স্থির বিদ্যুৎসম রূপ মাধুরী দর্শনে তাঁহার মন মোহিত হইল। তিনি মনে করিলেন,—কাজ কি আর ধনে? দেবী যখন কৃপা করিয়া এরূপ জগমোহিনী যুবতীকে আমার নিকট প্রেরণ করিয়াছেন, তখন ইহাকেই লইয়া পরম সুখে আমি জীবন অতিবাহিত করি। আমার যতই ধন ঐশ্বৰ্য্য হউক না কেন, সমস্ত পৃথিবী খুঁজিয়া আমি এইরূপ নারী জীবনে পাইব না। আর জপে প্রয়োজন নাই, উঠিয়া ইহাকে আমি হৃদয়ে ধারণ করি। এইরূপ চিন্তা করিয়া গৌরীশঙ্কর শবের উপর হইতে উঠিবার নিমিত্ত উপক্ৰম করিলেন; কিন্তু সেই সময় কে যেন তাঁহার পিঠে চাপড় মারিয়া বলিল,–কর কি? এ যে সব মায়া! জপ পরিত্যাগ করিলে মুহূর্তের মধ্যে হয় তুমি মৃত্যুমুখে পতিত হইবে, আর না হয় পাগল হইয়া যাইবে। গৌরীশঙ্করের তখন যেন চমক হইল। তিনি মনে করিলেন,সত্য বটে এ সমুদয় মায়া। কিন্তু এ কামিনীর রূপ দেখিয়া কেহই স্থির থাকিতে পারেন না। প্রাণ যায় সেও স্বীকার, তথাপি তাঁহার নিকট ধাবিত হইতে ইচ্ছা হয়। দূর হউক আর ইহার দিকে চাহিয়া দেখিব না এই বলিয়া গৌরীশঙ্কর চক্ষু মুদিত করিলেন। কামিনী অতি সুমধুর স্বরে নানারূপ সাধ্য সাধনা করিল; কিন্তু গৌরীশঙ্কর কিছুতেই আর চক্ষু উন্মীলন করিলেন না। নিরাশ হইয়া মায়াময়ী অস্তহির্ত হইল। পৃথিবী পুনরায় নীরব হইল। গৌরীশঙ্কর চাহিয়া দেখিলেন যে, এখন আর সে স্থানে বন্য পশু অথবা ভূত-প্রেত প্রভৃতি কিছুই নাই। এখন চারি দিকে কেবল নিবিড় অন্ধকার।
তৃতীয় অধ্যায়–বীরের বাক্যবাদ
গৌরীশঙ্কর পুনরায় একান্ত মনে জপে প্রবৃত্ত হইলেন। কিছুক্ষণ পরে সহসা মাতার কণ্ঠস্বর তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। সেই অমাবস্যা রাত্রি,—সেই ভয়াবহ মন বড়ই কাতর হইল। তিনি চক্ষু চাহিয়া দেখিলেন, সত্য সত্যই তাঁহার বৃদ্ধ মাতা বটে। ষষ্টি হস্তে তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া মা বলিলেন,–
উত্তিষ্ঠ বস তে কাৰ্য্যং সর্ব্বং যাতুন সংশয়ঃ।
প্রভাতসমদোজাতত্ত্বপিতা ক্রোশতে গৃহম।।
প্রায়ো বিমসরা লোকা রাজানো দণ্ডধারিনঃ।
কদাচিৎ কেন বা দৃষ্টিস্তদা কিঞ্চিদ্ ভবিষ্যতি।।
মাতার মুখে এরূপ সংস্কৃত বচন শুনিয়া গৌরীশঙ্কর বিস্মিত হইলেন। আমার পিতা নাই, দেশে রাজপুরুষ আছে বটে; কিন্তু রাজা নাই। ইনি কি আমার মাতা নহেন, ইনি কি মায়া? গৌরীশঙ্কর ভাল রূপে পুনরায় নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন হুবহু তাঁহার মাতা, কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। মস্তকে করাঘাত করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে মাতা বলিলেন-বাছা তুই আমার একমাত্র সন্তান। কেন তুই এমন অসীম সাহসিক কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিস? যদি তোর কোনরূপ বিপদ ঘটে, তাহা হইলে কাহাকে লইয়া আমি আর এ সংসারে থাকিব? কাজ কি বাছা ধনে? ব্রাহ্মণের ছেলে,–তুই ভিক্ষা করিয়া খাইবি, চল, বাছা ঘরে চল্, আর জপে প্রয়োজন নাই।
মাতা এইরূপে খেদ করিতে লাগিলেন। কিন্তু গৌরীশঙ্কর তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিলেন না। তিনি মনে করিলেন যে, যদি প্রকৃত আমার মাতা হন, তাহইলে ইনি আমার হাত ধরিয়া তুলিতে চেষ্টা করিবেন। কিন্তু মাতা তাঁহাকে স্পর্শ করিলেন না। অনেক খেদ করিয়া অবশেষে তিনি প্রস্থান করিলেন। ইহার পর আরও অনেক চেষ্টা করিল। বহুকাল পূর্ব্বে মৃত পিতা ও জ্ঞাতিগণও আসিয়া, তাঁহাকে শবের উপর হইতে উঠিতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু গৌরীশঙ্কর উঠিলেন না। নানারূপ বিভীষিকা দর্শনে তাঁহার হৃদয় কিছুমাত্র বিচলিত হইল না।
রাত্রি প্রায় তিনটা হইল। এমন সময় এক জন থিয়েটারী বীর সেই শ্মশান-ক্ষেত্রে আসিয়া উপস্থিত হইল। গৌরীশঙ্কর একবার থিয়েটার দেখিতে গিয়াছিলেন। সে স্থানে এক জন অভিমন্যু সাজিয়া আসিয়াছিল। থিয়েটারে যাঁহারা বীর সাজেন, তাঁহারা মনে করেন যে, খুব চীৎকার করিতে পারিলেই বীরত্ব প্রদর্শন করা হয়। থিয়েটারের রীতি অনুসারে অভিমন্যুও ভয়ানক চীৎকার করিয়াছিল। তাঁহার চীৎকারে অনেক লোকের কান হইতে পোকাববাহির হইয়া গিয়াছিল; অনেক লোকের কর্ণে তালি লাগিয়াছিল; তাহা ভিন্ন চারি পাঁচ জনের কর্ণতন্তু ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল; চারি পাঁচ জনের কর্ণটহে ছিদ্র হইয়া গিয়াছে। সেই হতভাগারা জন্মের মত বধির হইয়া গিয়াছে। গৌরীশঙ্কর চীৎকারে অস্থির করেন। সেই অবধি থিয়েটারী বীরকে তিনি বড় ভয় করেন। এখন সেই থিয়েটারী বীর শ্মশানক্ষেত্রে আসিয়া উপস্থিত হইল। থিয়েটারী বীর অতি কর্কশ স্বরে ঘোর চীৎকার করিয়া বলিতে লাগিল,–রে রে রে, কে রে তুই? যুদ্ধং দেহি, যুদ্ধং দেহি! জানিস আমি থিয়টারী বীর। এ জগতে এমন কে আছে যে আমার চীৎকার সহ্য করিতে পারে? আমার কর্কশ বচনে কাহার না কান ঝালাপালা হয়? আমি যখন থিয়েটারের তক্তার উপর দাঁড়াইয়া ঘোর রবে চীৎকার করিতে থাকি, তখন কোন্ দর্শক, কোন্ শ্রোতা না কর্ণে অঙ্গ লি প্রদান করে? কে না আমাকে শত শত গালি দিয়া থাকে? কে না বলে যে, যবনিকাপতন হইলে বাঁচি? যুদ্ধং দেহি। যুদ্ধং দেহি।
গৌরীশঙ্কর অনেকক্ষণ পর্যন্ত থিয়েটারী বীরের বক্তৃতা প্রাণপণে সহ্য করিলেন, কিন্তু শেষকালে তিনি আর পারিলেন না হায়! হায়! এত কষ্ট করিয়া শেষকালে সব বিফল হইল। তিনি মনে করিলেন, বরাহ-ব্যাঘের উপদ্রব সহ্য করিলাম, ভূত-প্রেতের দৌরাত্মেও মনকে স্থির রাখিলাম, অপ্সরার মোহিনী শক্তি আমাকে মোহিত করিতে পারে নাই, মাতার সকরুণ ক্রন্দনেও আমি বিচলিত হই নাই, কিন্তু এই থিয়েটারী বীরের বাক্যবাণে আমার কর্ণ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল, আমার হৃদয় বিদ্ধ হইয়া জর্জরীভূত হইল। ইহার জ্যেঠামি আমি আর সহ্য করিতে পারি না।
এইরূপ মনে করিয়া, গৌরীশঙ্কর আসন ত্যাগ করিবার উপক্রম করিলেন। কিন্তু এবারও কে যেন তাঁহার পিঠে চাপড় মারিয়া বলিল,–কর কি? এ প্রকৃত থিয়েটারী বীর নহে, এ মায়া-প্রসূত ভূত। একটু ধৈর্য্য ধরিয়া থাক। এখনি এ চলিয়া যাইবে।
গৌরীশঙ্কর মন দৃঢ় করিয়া জপে প্রবৃত্ত হইলেন। কিন্তু থিয়েটারী বীর দ্বিগুণভাবে চীৎকার আরম্ভ করিল, তাঁহার চীৎকারে গগন ফাটিয়া যাইতে লাগিল। গৌরীশঙ্কর আর ধৈৰ্য্য ধরিয়া থাকতে পারিলেন না। থিয়েটারী বীরের বাক্যবাণে তিনি জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িলেন। কানে অঙ্গুলি দিয়া ধড়মড় করিয়া তিনি শবের পৃষ্ঠ হইতে উঠিয়া পড়িলেন। শ্মশানক্ষেত্র দ্রুতবেগে পলায়ন করিবার উপক্রম করিতেছেন, এমন সময় চারিদিকে ঘোর কলরব উপস্থিত হইল। সিংহ ব্যাঘ্র বরাহ ভল্লুক প্রভৃতি হিংস্র জন্তু, ভূত প্রেত পিশাচ দানা দৈত্য ডাকিণী শাকিনী বেতাল বটুক চেক প্রভৃতি উপদেবতা, ও শত শত থিয়েটারী বীর এক সঙ্গে তর্জন-গর্জন করিতে লাগিল। কেহ লম্প্রদান করিতে লাগিল। কেহ নৃত্য করিতে লাগিল। অবশেষে ভয়ঙ্কর এক বেতাল আসিয়া গৌরীশঙ্করের টিকি ধরিল। তাঁহার টিকিটি ধরিয়া তাঁহাকে দূরে পুষ্করিণীতে নিক্ষেপ করিল। ভাগ্যে পুষ্করিণীর মাঝখানে গিয়া তিনি পড়েন নাই, তাই রক্ষা। পুষ্করিণীর যে স্থানে কেবল কম ছিল, সেই স্থানে গিয়া পড়িয়াছিলেন।
পরদিন প্রাতঃকালে সকলে দেখিল যে, সেই স্থানে তিনি পড়িয়া রহিয়াছেন সে সময় তাঁহার কিছুমাত্র সংজ্ঞা ছিল না। অজ্ঞান অভিভূত হইয়া তিনি পড়িয়া ছিলেন। কেবল অল্প অল্প নিশ্বাস-প্রশ্বাস চলিতেছিল, কেবল অল্প অল্প গোঁ গোঁ শব্দ করিতেছিলেন, কেবল অল্প অল্প রক্ত মিশ্রিত ফেনা তাঁহার মুখ হইতে নির্গত হইতেছিল। জীবনের এই সামান্য মাত্র চিহ্ন কেবল অবশিষ্ট ছিল।
চতুর্থ অধ্যায়—থি-বী, যু-দে
প্রাতঃকালে এক জন রাখাল-বালক গৌরীশঙ্কর বাবুকে এই অবস্থায় প্রথম দেখিতে পাইল। তাঁহার চীৎকারে চারিদিক হইতে লোক আসিয়া পড়িল। নিকটে সেই চণ্ডালের শব ও পূজার আয়োজন দেখিয়া সকলে বুঝিতে পারিল যে, কি কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে। গৌরীশঙ্কর বাবুকে ধরাধরি করিয়া সকলে গৃহে লইয়া গেল। প্রথমে ডাক্তার বৈদ্য আসিয়া তাঁহার চেতনা-সম্পাদনের নিমিত্ত চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু কিছুতেই কেহ তাঁহাকে চেতন করিতে পারিল না।
যদি বা যৎসামান্যভাবে তাঁহার দেহে একটু জীবনের সঞ্চার হয়, যদি বা তাঁহার মনে একটু জ্ঞানের উদয় হয়, কিন্তু প্রতিদিন রাত্রি তিনটার সময় গৌরশঙ্করের পৃষ্ঠদেশে গুপ গাপ শব্দ হয়। কিরূপে তাঁহার পৃষ্ঠে এরূপ শব্দ হয়, তাহা কেহ দেখিতে পায় না; কিন্তু কে যেন সবলে তাঁহার পৃষ্ঠে কিল মারিতেছে, এইরূপ বোধ হয়। সেই সময় প্রহারের চোটে যন্ত্রণায় গৌরশঙ্করের মুখ বির্বণ হইয়া পড়ে। দিনের বেলা শরীরে যাহা একটু বলের সঞ্চার ও মনে যাহা একটু জ্ঞানের উদয় হয়, সেই প্রহারের চোটে তাহা লোপ পাইয়া যায়। তাহার পর গৌরীশঙ্কর পুনরায় জড়ের মত পড়িয়া থাকেন। ফল কথা, ডাক্তার ও বৈদ্য দ্বারা কোন রূপ উপকার হইল না।
একমাত্র পুত্রের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, গৌরীশঙ্করের মাতার দুঃখের আর সীমা রহিল না। তিনি রাত্রি দিন কাঁদিতে লাগিলেন। আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া পুত্রের সেবা শুশ্রূষা করিতে লাগিলেন। রোজার কথা শুনিলেই, দৌড়িয়া তিনি তাঁহার নিকট গমন করেন; নানারূপ মিনতি করিয়া তাঁহাকে ডাকিয়া আনেন। প্রতি রাত্রিতে রোজাগণ নানারূপ ঝাড়ান করিতে লাগিল। দিনের বেলা একটু উপশম হয়। এক আধ বার চক্ষু উন্মীলিত করিয়া, গৌরীশঙ্কর বিস্ময়াপন্ন মুখে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করেন। কিন্তু দিনের বেলা যাহা একটু উপকার হয়, রাত্রি তিনটার সময় ভূতের ভূতে তাঁহার পিঠে গু-গান্ গুপ্ কিল মারে। আধ ঘন্টা পরে কিলের শব্দ থামিয়া যায়। গৌরীশঙ্কর তাঁহার অনেকক্ষণ পর্যন্ত গোঁ-গোঁ শব্দ করিতে থাকেন ও সেই সময় তাঁহার মুখ হইতে রক্ত মিশ্রিত ফেনা নির্গত হইতে থাকে। তাঁহার পিঠে কোন স্থানে কৃষ্ণবর্ণ, কোন স্থানে রক্তবর্ণ,–কিলের দাগও সকলে দেখিতে পায়; কিন্তু কে যে আসিয়া কিল মারিয়া যায়, কেহ তাহা দেখিতে পায় না। এইরূপে এগার দিন কাটিয়া গেল। এখনও গৌরীশঙ্করের চেতনা হইল না। এখনও প্রতি রাত্রিতে ভূতের প্রহার নিবারিত হইল না। শব-সাধনের একাদশ দিন পরে গৌরাঙ্করের মাতা শুনিলেন যে, যে চণ্ডালের শব লইয়া গৌরীশঙ্কর সাধনা করিতেছিলেন, তাঁহার পিতৃব্য ভূতের মন্ত্র অবগত আছে। গৌরীশঙ্করের মাতা তাঁহার নিকট গমন করিলেন। প্রথমে সে কিছুতে স্বীকার পাইল না। কারণ তাঁহার ভ্রাতুস্পুত্রের দেহ লইয়া গৌরীশঙ্কর সেই বিড়ম্বনা করিয়াছিলেন। কিন্তু অনেক মিনতির পর, সে আসিয়া ঝাড়ান কাড়ান করিতে লাগিল। তাঁহার মন্ত্রের বলে সামান্য একটু উপকার হইল। গৌরীশঙ্কর এবার চাহিয়া থিবী, যু-দে এই শব্দ দুইটি কয়বার তিনি উচ্চারণ করিলেন।
চণ্ডালের মন্ত্রে আর অধিক উপকার হইল না। গৌৰীশঙ্করের জ্ঞান হইল না, রাত্রিকালের ভূতের প্রহার নিবারিত হইল না। আরও অনেক রোজা আসিযা চিকিৎসা করিল; কিন্তু তাহাদের মন্ত্রেও বিশেষ কোনরূপ উপকার হইল না।।
এইরূপে প্রায় এক মাস কাটিয়া গেল। ইতিমধ্যে গৌবীশঙ্করের মাতা এক ব্রাহ্মণের কথা শুনিলেন। তাঁহার নিবাস প্রায় দশ ক্রোশ দূরে। তিনি ভূত প্রেত সম্বন্ধে জ্ঞানী ব্যক্তি বলিয়া প্রসিদ্ধ। গৌরীশঙ্করের মাতা বৃদ্ধা ছিলেন, তথাপি লাঠি হাতে করিয়া আস্তে আস্তে সেই ব্রাহ্মণের গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন। বাহ্মণের পদতলে তিনি শয়ন করিয়া পড়িলেন। বৃদ্ধার কাতরোক্তি শ্রবণ করিয়া ব্রাহ্মণের দয়া হইল। তিনি গৌরীশঙ্করের নিকট আগমন করিয়া নানারূপ ঔষধ প্রদান করিলেন ও নানারূপ মন্ত্র পাঠ করিলেন। দুই দিন কোনরূপ ফল হইল না। তৃতীয় রাত্রিতে অ ক্ষঃ কাং-ক্ষৌ কাজসি নৌ, ব্রাহ্মণ যেই এই কয়টি শব্দ উচ্চারণ করিয়াছেন, আর গৌরীশঙ্কর বিপরীত ভাবে হাসিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে তিনি উঠিয়া বসিলেন। এত দিন পরে এই প্রথম তিনি উঠিয়া বসিতে সমর্থ হইলেন। গৌরীশঙ্করের এইরূপ ভাব দেখিয়া ব্রাহ্মণ পুনরায় এই শব্দগুলি উচ্চারণ করিলেন, রা রাঁ সাঁ সাঁ লা লা হঃ সং সঃ খং খঃ তং ও ধঃ সং ফুং হীং হুং হুং ক্ষীং ক্ষীং সং সঃ স্তং স্তুঃ হ্রীং হৃং ক্ষীং ক্ষীং ক্ষৌং সং ফং হুং ফটু স্বাহা; কাহার আজ্ঞা—না শ্রীশ্রীউড্ডামরেশ্বরের আজ্ঞা। এ শব্দগুলির অর্থ কি, যাঁহাদের এ সম্বন্ধে বোধ আছে, তাঁহারা অনায়াসেই অবগত হইতে পারিবেন।
নানারূপ মন্ত্রবলে ব্রাহ্মণ গৌরীশঙ্করকে জড়ভাব হইতে মুক্ত করিলেন; কিন্তু তিনি ঘোর উন্মাদ অবস্থায় রহিলেন। তাঁহার জ্ঞান কিছুমাত্র হইল না। রাত্রিতে প্রহারও বন্ধ হইল না। গৌরীশঙ্কর যথারীতি আহারাদি করিতে লাগিলেন, উঠিয়া হাঁটিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণের চিকিৎসায় এই পৰ্য্যন্ত হইল। কিন্তু তিনি কথা কহিতেন না। কখন কখন আপনা-আপনি, অথবা লোকের কথার প্রত্যুত্তরে কেবল থি-বী, যু-দে এই শব্দ উচ্চারণ করিতেন। এই দুইটি শব্দ ভিন্ন অন্য কথা তিনি মুখে আনিতেন না। এই দুইটি শব্দ উচ্চারণ কবিবামাত্র তাঁহার সর্ব্বশরীর শিহরিয়া উঠিত ও সেই সময় আতঙ্কে তাঁহার মুখমণ্ডল বিবর্ণ হইয়া উঠিত। প্রতি রাত্রিতে ভূতের প্রহারে গৌরীশঙ্করের দেহ দিন দিন শীর্ণ হইতে লাগিল। অবশেষে গৌরীশঙ্করের মাতাকে ব্রাহ্মণ বলিলেন, আপনার পুত্রকে সামান্য ভূতে পাই নাই। সামান্য ভূত হইলে আমি তাঁহার প্রতিকার করিতে পারিতাম। বেতালকে দূর করি, আমার সেরূপ ক্ষমতা নাই। এই বলিয়া ব্রাহ্মণ প্রস্থান করিলেন।
পুত্রের উন্মত্ততা দূর করিবার নিমিত্ত ও ভূতের প্রহার হইতে তাঁহাকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত, মাতা যথাসাধ্য চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁহার চেষ্টা সফল হইল না। সেই একমাত্র পুত্র। তাঁহার যখন এ দশা হইল, তখন সংসার ধর্ম্ম আর কাহাকে লইয়া?
গৃহে থাকিয়া আর লাভ কি? মাতা ভাবিলেন,—পুত্রকে লইয়া যে দিক দুই চক্ষু যায়, সেই দিকে আমি চলিয়া যাইব। নানা তীর্থস্থানে আমি ঘুরিয়া বেড়াইব। যদি কোন স্থানে কোন মহাত্মার সহিত সাক্ষাৎ হয়, তাহা হইলে তাঁহার কৃপায় আমার পুত্র আরোগ্য লাভ করিবে। আর তা না হয়, তাহা হইলে পথে পথে বেড়াইয়া, আমি অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করিব। আমার অবর্তমানে এই উন্মাদের কপালে যাহা আছে তাহাই হইবে।
এইরূপ ভাবিয়া, তিনি পুত্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—গৌরীশঙ্কর! বাবা! আমারা যদি কাশী বৃন্দাবনে যাই, তাহা হইলে তুমি কি ভাল হইবে?
গৌরীশঙ্কর উত্তর করিলেন,–থিবী, যু-দে। মাতা জানিতেন যে, ঐ দুইটি শব্দ ভিন্ন গৌরীশঙ্কর অন্য কোন কথা মুখে আনিবেন। তথাপি মায়ের প্রাণ! তিনি কেবল ঐ দুইটি শব্দই শুনিবার নিমিত্ত গৌরীশঙ্করকে সম্বোধন করিয়া নানা কথা কহিতেন, নানা পরিচয় তাঁহাকে প্রদান করিতেন, চক্ষের জল ফেলিতে ফেলিতে, আঁচলে চক্ষু মুছিতে মুছিতে, পুত্রের সহিত নানা গল্প করিতেন। পুত্র কেবল বলিত,–থিবী, যু-দে।
পঞ্চম অধ্যায় – দেখিতে সামান্য লোক
পুত্রকে লইয়া গৌরীশঙ্করের মাতা বাটী হইতে বাহির হইলেন। প্রথম অর্থাভাব, দ্বিতীয় পাঁচ জনের সহিত সাক্ষাৎ হইবার সম্ভাবনা,এই দুই কারণে তাঁহারা পদব্রজে পথ চলিতে লাগিলেন। মাতা বৃদ্ধা ছিলেন, অধিক পথ চলিবার তাঁহার শক্তি ছিল না। এক দিনের পথ তিন চারি দিনে অতিক্রম করিতে লাগিলেন। তাঁহার হাতে অতি সামান্য টাকা ছিল। পাছে সেগুলি শীঘ্র শেষ হইয়া যায়, সেই ভয়ে যথাসাধ্য ভিক্ষা দ্বারা তিনি পথে দিনপাত করিতে লাগিলেন। ক্ষিপ্ত পুত্র সহিত বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীকে দেখিয়া, সকলের দয়া হইত। সে নিমিত্ত পথে আহারাভাবে তাহাদিগকে ক্লেশ পাইতে হয় নাই। পুত্র কিরূপে ক্ষিপ্ত হইয়াছে তাহা শুনিয়া অনেকে বৃদ্ধার দুঃখে দুঃখী হইত। তাঁহার দুঃখে কাতর হইয়া, কোন স্থানে ধনবান লোকের গৃহিণীগণ তাঁহাকে নগদ অর্থ প্রদান করিতেন। পুত্রের চিকিৎসার নিমিত্ত কোন দিন কি আবশ্যক হয়, এই ভাবিয়া ব্রাহ্মণী যথাসাধ্য কিছু কিছু সঞ্চয় করিতেন। এইরূপে দুইজনে গয়া, কাশী, প্রয়াগ, বৃন্দাবন, হরিদ্ধার কুরক্ষেত্র প্রভৃতি নানা তীর্থস্থানে ভ্রমণ করিলেন। সাধু সন্ন্যাসী দেখিলে সকলকেই মাতা অতি বিনীত ভাবে পুত্রের বিবরণ প্রদান করিতেন। কিন্তু কোনও স্থানে কাহারও দ্বারা তাঁহার বাসনা পূর্ণ হইল না; গৌরীশঙ্করকে কেহই সে বিপদ হইতে মুক্ত করিতে পারিলে না। তবে বায়ু পরিবর্তনে, নানা দেশ পর্যটনে ও নানা দৃশ্যদর্শনে এই মাত্র উপকার হইল যে, গৌরীশঙ্করের বিমর্ষভাব অনেকটা দূর হইল; পূর্বাপেক্ষা তাঁহার চিত্ত যেন কিছু প্রফুল্লভাব ধারণ করিল। কিন্তু যে স্থানেই গমন করেন, যে স্থানেই দুই জনে রাত্রি যাপনের নিমিত্ত শয়ন করেন, সেই স্থানেই রাত্রি তিন প্রহরের সময় গৌরীশঙ্করের পৃষ্ঠে ভূতের প্রহারে প্রপীড়িত হয়। তবে প্রহারে প্রহারে পিঠে পিঠে কড়া পড়িয়া গেল। পিঠ কঠিন হইয়া পূর্বাপেক্ষা যাতনার কিছু লাঘব হইল। যাহা হউক, গৌরীশঙ্করের উন্মত্তা ঘুচিল না, ভূতও তাঁহাকে ছাড়িল না।
এইরূপে তিন বৎসর পথে পথে কাটিয়া গেল। মাতার বার্ধক্য দিন দিন বাড়িতে লাগিল। বয়সের গুণে, পথক্লেশে, ভাবনা চিন্তায়, দিন দিন তিনি দুর্বল হইতে লাগিলেন। চক্ষুদ্বয়ের দৃষ্টিশক্তি ক্রমে ক্ষীন হইতে লাগিল। রোগগ্রস্ত হইয়া, যদি কিছু দিন তাঁহাকে পড়িয়া থাকিতে হয়, তাহা হইলে দুই জনের কি দশা হইবে, আর সহসা যদি তাঁহার মৃত্যু হয়, তাহা হইলে পুত্রের কি দুর্দশা হইবে, এই সব ভাবিয়া প্রাণ তাঁহার বড়ই আকুল হইল। যাহা হউক, তিন বৎসর পরে শীতকালের প্রারম্ভে তাঁহারা উত্তরাখণ্ড হইতে নামিয়া, পুনরায় হরিদ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হরিদ্বারের নিকট জ্বালাপুর নামক একখানি গ্রাম আছে। সেই গ্রামের প্রান্তদেশে বৃহৎ একটি আমবাগান আছে। একদিন অপরাহ্নে গৌরীশঙ্কর ও তাঁহার মাতা সেই বাগানের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। পথশ্রমে কাতর হইয়া দুই জনে এক বৃক্ষতলে বসিয়া পড়িলেন। সেই বৃক্ষতলে আর একটি পুরুষ বসিয়াছিলেন। লোকটি দেখিতে বাঙ্গালীর মত, পরিধান বাঙ্গালীর মত, তবে চাদরখানি তিনি মাথায় বাঁধিয়াছিলেন। সাধু-সন্ন্যাসীর মত তাঁহার বেশভূষা ছিল না। ভদ্র বাঙ্গালী সন্তানের যেরূপ হয়, তাঁহার পরিধেয় বস্ত্র ও ভাব-ভঙ্গী সেইরূপ ছিল। তাঁহার বয়স ত্রিশ বৎসরের কিছু অধিক হইবে। সাধু-সন্ন্যাসী দেখিলেই, গৌরীশঙ্করের মাতা পুত্রের কথা জিজ্ঞাসা করেন। ইনি সাধু নহেন; সুতরাং বৃদ্ধা তাঁহাকে কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। সেই লোকটি এক বৃক্ষমূলে ঠেস দিয়া, অৰ্দ্ধশায়িত ভাবে বসিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন। মাতা ও পুত্র সেই স্থানে আসিয়া তাঁহার নিকট হইতে কিছুদুরে উপবেশন করিলেন। বাঙ্গালী তাঁহাদের প্রতি একবার কটাক্ষপাত করিবামাত্র তিনি চমকিত হইলেন। তাহার পর, কিয়ৎক্ষণের নিমিত্ত তিনি স্থিরদৃষ্টিতে গৌরীশঙ্করকে নিরীক্ষণ করিলেন। গৌরীশঙ্করকে ভাল করিয়া দেখিয়া, চক্ষু মুদিত করিয়া ভাবিতে লাগিলেন। অবশেযে চক্ষু চাহিয়া তিনি বৃদ্ধাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন—মা! আমি বাঙ্গালী তোমরা আমার দেশস্থ লোক। কত দিন ধরিয়া তোমার পুত্রের এ দশা হইয়াছে?
সামান্য এই কয়টি কথা শুনিবামাত্র বৃদ্ধার মনে কিরূপ এক অনির্বচনীয় আশার সঞ্চার হইল। সকল লোকেই প্রথম জিজ্ঞাসা করে,তোমার পুত্রের কি হইয়াছে? ইনি যে কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। গৌরীশঙ্করের যাহা হইয়াছে, তাহা যেন তিনি সম্পূর্ণ ভাবে অবগত আছেন, কথার ভাবে সেইরূপ প্রকাশ হইল। তাঁহার দয়া-দাক্ষিণ্য ভাবে, তাঁহার সুমধুর কথায়, বৃদ্ধার তাপিত-হৃদয় যেন শীতল হইল। ফল কথা, বৃদ্ধাকে কে যেন বলিয়া দিল যে,ইনি সামান্য পুরুষ নহেন। ভাগ্যবলে আজ তুমি ইহার দর্শন পাইলে; এইবার তোমার দুঃখের অবসান হইল। তাঁহার প্রশ্নেব কোনও রূপ উত্তর না দিয়া, বৃদ্ধা তাড়াতাড়ি তাঁহার পা দুইটি ধরিতে যাইলেন।
বৃদ্ধাকে নিবারণ করিয়া তিনি বলিলেন,–ছি! মা! অমন কাজ করিবেন না। আপনি বৃদ্ধা আমার মাতৃস্থানীয়া।।
গৌরীশঙ্করের মাতা বলিলেন,–বাছা! ভগবান আমাকে যেন বলিয়া দিতেছেন যে, তোমা হইতে আমার পুত্র আরোগ্য-লাভ করিবে। বাছা! এই দুঃখিনীকে তুমি এ দায় হইতে উদ্ধার কর। অধিক আর তোমাকে কি বলিব, এই পুত্রটি ভিন্ন জগতে আমার আর কেহ নাই। ইহার এই দশায় আমি মৃতপ্রায় হইয়া আছি, পাগলের ন্যায় আমি দেশে দেশে ঘুরিতেছি। তুমি আমার প্রতি কৃপা কর।
বাঙ্গালী উত্তর করিলেন,—আমি কিছু করিতে পারিব কি না, তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি না। তবে মা আপনার পুত্রকে সুস্থ করিতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব। নিকটে এই গ্রামখানির নাম জ্বালাপুর, এ স্থানে পাণ্ডাদের বাস। আমি আজ দুই দিন এ স্থানে আসিয়াছি। এক জন পাণ্ডার বাটীতে বাসা লইয়া আমি অবস্থিতি করিতেছি। আমার সঙ্গে বাসায় চলুন। আজ রাত্রিতে আপনার পুত্রের নিমিত্ত আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব।
বলা বাহুল্য যে, গৌরীশঙ্করের মাতা অতি আগ্রহে এ কথায় সম্মত হইলেন। তিন জনে ধীরে ধীরে জ্বালাপুর অভিমুখে চলিলেন। অল্পক্ষণ পরে তিন জনে সেই পাণ্ডার বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। বাঙ্গালী আহারাদির আয়োজন করিয়া দিলেন। সন্ধ্যার পর সকলে আহারাদি করিয়া নিশ্চিন্ত হইলে, বাঙ্গালী গৌরীশঙ্করকে এক স্বতন্ত্র ঘরে একাকী শয়ন করিতে দিলেন। তাঁহার মাতাকে অন্য এক ঘরে বিশ্রাম করিতে বলিলেন। গৌরীশঙ্কর শয়ন করিলে সেই ঘরে বাঙ্গালী গিয়া নানারূপ ক্রিয়া করিলেন। কি কি কাজ করিলেন, তার বিবরণ প্রদান করিবার আবশ্যক নাই। বাঙ্গালী নানারূপ ক্রিয়া করিয়া, ঘরের বাহিরে আসিয়া বসিলেন। দ্বারের নিকট বসিয়া বাতির আলোকে একখানি পুস্তক পাঠ করিতে লাগিলেন। ঘরের ভিতর গৌরীশঙ্কর নিদ্রা যাইতে লাগিলেন।
রাত্রির প্রথম ভাগে কোনও রূপ ঘটনা হইল না। তিনটার সময় যথারীতি গুপ-গাপ শব্দ আরম্ভ হইল। সেই শব্দ শুনিয়া বাঙ্গালী আলোক লইয়া ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন যে, গোরীশঙ্করের পিঠের উপর সেই শব্দ হইতেছে, তিনি গোঁ গোঁ করিতেছেন, মুখ দিয়া তাঁহার ফেনা বাহির হইতেছে, মাঝে মাঝে তিনি চিৎ হইতে চেষ্টা করিতেছেন। কিন্তু যোর তিনি চিৎ হইতে চেষ্টা করিতেছেন, ততবার কে যেন তাঁহাকে বলপূর্ব্বক উপুড় করিয়া ফেলিতেছে। উপুড় করিয়া কে যেন তাঁহার পিঠে কিল মারিতেছে। আলোটি ঘরের মাঝখানে রাখিয়া বাঙ্গালী গৌরীশঙ্করের শিয়রদেশে গিয়া উপবেশন করিলেন। সে স্থানে বসিয়া তিনি তাহা মাথায় জপ করিতে লাগিলেন। জপ আরম্ভ করিবামাত্র কিলের শব্দ থামিয়া গেল। গৌরীশঙ্কর সুস্থির হইলেন। কিন্তু তাঁহার নিঃশ্বাস ঘন ঘন বহিতে লাগিল।
কিছুক্ষণ পরে গৌরীশঙ্কর একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন,—থিবী যু-দে।
বাঙ্গালী বলিলেন,—পরিষ্কার করিয়া সকল কথা বল?
গৌরীশঙ্কর কোন উত্তর করিলেন না! বাঙ্গালী আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া ক্রমাগত জপ করিতে লাগিলেন। প্রায় আধ ঘন্টা এই ভাবে কাটিয়া গেল। জপ ব্যতীত তিনি আরও নানারূপ ক্রিয়া করিলেন। অবশেষে গৌরীশঙ্কর আর একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন,–থি-বী, যু-দে। বাঙ্গালী বলিলেন,–ভাল করিয়া বল!
গৌরীশঙ্কর বলিলন,—থিয়েটারী বীর যুদ্ধং দেহি।
বাঙ্গালী বলিলেন,—থিয়েটারী বীর! আজ হইতে আর তুমি ইহাকে বিরক্ত করিতে পারিবে না। কেমন! আমার আজ্ঞা তুমি পালন করিবে তো?
গৌরীশঙ্কর এইবার প্রকৃতপক্ষে বক্তা হইলেন। আজ তিন বৎসর ধরিয়া থি-বী, যু-দে ভিন্ন অন্য কথা মুখে আনেন নই, আজ তিনি নানারূপ কথা বলিতে লাগিলেন।
কিন্তু এখন তিনি যে সমুদয় কথা বলিতে লাগিলেন, তাহা তাঁহার নিজের নহে। যে ভূত তাঁহাকে আশ্রয় করিয়াছিল, এ সমুদয় তাঁহার কথা।
গৌরীশঙ্করের মুখ দিয়া সেই ভূত বলিল,–মহাশয়! আপনি আমাকে যেরূপ আজ্ঞা করিবেন, আমি সেইরূপ করিব। এ ব্যক্তি অতি অন্যায় কাজ করিয়াছে। ধনলোভে বিনা শিক্ষায় এ অসীম সাহসিক কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিল। দেখি, মন্ত্র সফল হয় কি না? দেখি, আরাধনা করিলে ঈশ্বর সত্য সত্য মনুষ্যের প্রতি কৃপা করেন কি না, এইরূপ মনে করিয়া মন্ত্র ও মহাশক্তির পরীক্ষা করিতে এই ব্যক্তি গিয়াছিল। সেরূপ কাৰ্য্যের পরিণাম এইরূপ হয়। বাঙ্গালী বলিলেন,–যাই হউক, ইহার যথেষ্ট দণ্ড হইয়াছে। আর কেন? ইহাকে এক্ষণে নিষ্কৃতি প্রদান কর।
ভূত বলিল,–আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, আপনি যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিব। আপনি মহাত্মা লোক। মানুষে আপনাকে জানে না, কিন্তু আমি আপনাকে জানি। বিষ্ণুপ্ৰয়াগ অঞ্চলে তুষারাবৃত হিমালয়শিখরে যেরূপে তাঁহার সহিত আপনার সাক্ষাৎ হয়, যেরূপে আপনি প্রভুর নিকট শিক্ষা লাভ করিয়া, নানা শাস্ত্রে অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তাহা আমি জানি। যোগিগণ কেবল সমাধিযোগে যাঁহার দর্শন লাভ করেন, তিনি সর্ব্বদাই আপানর হৃদয় মন্দিরে বিরাজ করিতেছেন। অতি সূক্ষ্ম পরমাণু হইতে জড়জগতের অপর পারে সেই মহানু জ্যোতিমণ্ডল পৰ্য্যন্ত সকল বিষয় আপনি অবগত আছেন। কেবল লোক শিক্ষার নিমিত্ত অজ্ঞের ন্যায় অজ্ঞ সাজিয়া আপনি সংসারে বিচরণ করেন। মোহে মুগ্ধ, ক্ষুধায় ক্ষীণ, বোগে রুগ্ন, শোকে আকুল ভারতের কোটি কোটি লোকের দুঃখ-নিবারণের নিমিত্ত কত ক্লেশ, কত অপমান, আপনি না ভোগ করেন। জগতের হিতের নিমিত্ত দীনবেশে সামান্য লোকের ন্যায় আপনি অর্থ উপার্জন করিয়া অকাতরে তাহা বিতরণ করেন। হে মহাত্ম! আমি– বাঙ্গালী বলিলেন,–চুপ!
এই বলিয়া তিনি গৌরীশঙ্করের মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন। অগ্নিশিখার ন্যায় সেই দৃষ্টি যেন রোগীর উপর পড়িতে লাগিল। তাঁহার সমুদয় মনের ভাব যেন রোগীর মনকে বিদ্ধ করিয়া, তাঁহার ভিতর ওতপ্রোতভাবে প্রবেশ করিতে লাগিল।
সে দৃষ্টি সহ্য করিতে না পারিয়া, গৌরীশঙ্কর অর্থাৎ ভূত, মন্তক অবনত করিয়া বলিল,–বেশ! আপনার যাহা ইচ্ছা তাহাই হউক! অজ্ঞ সাজিয়া সংসারে আপনি থাকিতে ইচ্ছা করেন, তাহাই হউক। পাগল বলিয়া, লোকের নিকট পরিচিত হইতে ইচ্ছা করেন, তাহাই হউক। এক্ষণে আপনার কি আজ্ঞা বলুন।
বাঙ্গালী বলিলেন,—এ ব্রাহ্মণকে আর তুমি ক্লেশ দিতে পারিবে না।
যে আজ্ঞা বলিয়া ভূত গৌরীশঙ্করের দেহ হইতে প্রস্থান করিল। গৌরীশঙ্কর সম্পূর্ণরূপে আরোগ্যলাভ করিলেন। মাতার সহিত তিনি দেশে প্রত্যাগমন করিলেন। বাঙ্গ লীর কৃপায় তাঁহার ভাল কর্ম হইল। যথাসময়ে তিনি বিবাহ করিলেন। গৌরীশঙ্করের মাতা, পুত্র ও পুত্রবধূ লইয়া পরম সুখে ঘর কান্না করিতে লাগিলেন।
***
গড়গড়ি মহাশয় বলিলেন—এই গল্পটি শেষ করিয়া আমি দেখিলাম যে, এখন কেবল একটি মুণ্ডু বাকী আছে। মুশু-মালার আর সমুদয় মুণ্ডুগুলি রক্ত মুক্তার আকার ধারণ করিয়াছে। এই শেষ মুণ্ডু আমাকে বলিল,–তুমি এই মাত্র যে গল্পটি বলিলে, সেটি অতি চমৎকার গল্প। সে গল্পটি আমাদের সম্বন্ধে। গৌরীশঙ্করকে যে বেতাল পাইয়াছিল, সে আমার ভগিনীপতির আঁবুই খুড়ো। এখন আমার নিকট সেইরূপ আর একটি ভাল গল্প কর। ভগিনীপতির আঁবুই খুড়ো কাহাকে বলে, তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম না। যাহা হউক, আমি শেষ মুণ্ডুকে বলিলাম,অপনাদিগের নিকট আমি অনেক গল্প করিলাম। কিন্তু ডাকিনীর হাত হইতে কেহই আমাকে পরিত্রাণ করিলেন না। আমাকে ফাকি দিয়া সকলেই লাল মুক্তা হইয়া বসিলেন। আপনিও কি তাহাই করিবেন? মুণ্ডু উত্তর করিল—ডাকিনীর জন্য তোমার কোন চিন্তা নাই। তুমি ভাল একটি গল্প বল।
আমি ভাবিলাম যে,–পূর্ব্বেই আমি স্থির করিয়াছি যে, ইহার শেষ পর্যন্ত দেখিব। একান্তই যদি ডাকিনীর হাত হইতে নিষ্কৃতি না পাই, তাহা হইলে মায়ের এই খড়গ দ্বারা আমার মুণ্ডু কাটিয়া মায়ের চরণে অৰ্পণ করিব।
এইরূপ ভাবিয়া মুণ্ডুকে আমি বলিলাম,–আপনার নিকট এবার আমি চমৎকার একটি গল্প বলিব। ইহা মদন ঘোষের গল্প। মদন ঘোষ নিজে এই গল্পটি বলিতেছেন।
মুণ্ডু বলিল,–তবে শীঘ্র আরম্ভ করিয়া দাও।
আমি মদন ঘোষের গল্প বলিতে আরম্ভ করিলাম।