বেজো না চরণে চরণে
বিখ্যাত সাহিত্যিকদের কাছে নাকি নবীন সাহিত্যিকরা তাঁদের লেখা নিয়ে গিয়ে চাইদের সার্টিফিকেট চান। বেচারিদের বিশ্বাস, চাঁইরা উত্তম সার্টিফিকেট দিলে সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি-প্রতিপত্তি পেয়ে যাবেন।
চাঁইদের কেউ-কেউ সার্টিফিকেট দেন, কেউ লেখকদের অন্য চাঁইদের কাছে পাঠিয়ে দেন, কেউ-বা অসুখের ভান করে দেখাই করেন না। এ বাবদে পূজনীয় রাজশেখরবাবু রাজকীয় পন্থাটি বের করে আরামসে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি সবাইকে অকাতরে সার্টিফিকেট দেন– এমনকি মাঝে-মধ্যে না চাইলেও দেন। তাঁর বয়স হয়েছে। শেষের কটি দিন শান্তিতে কাটাতে চান। সোজাসুজি ‘দেব না’ বললে তাঁকে আর বাঁচতে হবে না, এবং ‘দেব-দিচ্ছি, দেব-দিচ্ছি’ করে টালবাহানা দেবার মতো শক্তিও তাঁর নেই। রবীন্দ্রনাথ অমিতবীর্য পুরুষসিংহবৎ ছিলেন, উমেদওয়ারদের ঠেকাবার মতো তাঁর সেক্রেটারিও ছিলেন– তবু তিনিও অকাতরে সার্টিফিকেট দিতেন। প্রাণের প্রতি তাঁর অহেতুক কোনও মায়াও ছিল না- ‘মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান’, এ গান তিনি রচেছেন অল্প বয়সেই– তবু তিনি ‘না-চাহিতে যারে দেওয়া যায়’ ভাবখানা মুখে মেখে পিলপিল করে সার্টিফিকেট বিলোতেন। আমাকে পর্যন্ত তিনি একখানা দিয়েছিলেন– অবশ্য সাহিত্যের জন্য নয়, চাকরির জন্য। আমি তাঁর ‘কৃতী ছাত্র’ এ ধরনের বহুবিধ আগড়ম-বাগড়ম লিখে তিনি আমাকে শ্যামাপ্রসাদবাবুর কাছে পাঠিয়েছিলেন। শ্যামাপ্রসাদবাবু বিচক্ষণ লোক; তিনি আমাকে চাকরি দেননি। অন্যত্র চেষ্টা করার জন্য সার্টিফিকেটখানা ফেরত পেলুম না– কারণ চিঠিখানা ছিল নিতান্ত প্রাইভেট এবং পার্সনাল। শ্যামাপ্রসাদবাবু সার্টিফিকেটের মূল্য না দিলেও রবিবাবুর হাতের লেখা চিঠির মূল্য জানতেন। চিঠিখানা সযত্নে শিকের হাঁড়িতে তুলে রেখে দিয়েছিলেন।
এবং যাঁরা কিছুতেই সার্টিফিকেট দিতে রাজি হন না, তাঁদের দু একজনকে আমি চিনি। এবং একথাও বিলক্ষণ জানি, তাঁরা যেসব বইয়ের সার্টিফিকেট দেওয়া দূরে থাক, গালিগালাজ পর্যন্ত করেছেন তারই অনেকগুলো বাজারে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছে। রাজশেখরবাবুর ‘দুই সিংহ’ গল্পে আছে কোনও লেখক তার বই কিছুতেই বিক্রি হচ্ছে না দেখে কোনও এক বাঘা সাহিত্যিককে ঘুষ দিয়ে লিখিয়ে নেয়, বইখানা অতিশয় অশ্লীল এবং কদর্য। ফলে নাকি সে বইয়ের প্রচুর কাটতি হয়েছিল।
কিন্তু এসব শোনা কথা, কিংবা কাল্পনিক। রবিবাবু টাকের ওষুধের প্রশংসা করাতে ওষুধের বিক্রি বেড়েছিল কি না তার সঠিক স্টাটিটিস্ এখনও দেখিনি। উল্টোটাও সঠিক জানবার উপায় নেই। এ যেন আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো। বেতারে আলিপুর বলল, ‘সন্ধ্যায় বৃষ্টি হবে।’ আপনি অবিশ্বাস করে ছাতা না নিয়ে বেরুলেন। ফিরলেন ভিজে ঢোল হয়ে। তবেই দেখুন, এমনি লক্ষ্মীছাড়া দফতর যে, অবিশ্বাস করেও নিষ্কৃতি নেই, বিশ্বাস তো করা যায়ই না।
***
কিন্তু একখানা বই পড়ে আমি এ-সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ হদিস পেয়েছি।
বইখানার নাম ‘লিমিট অব আর্ট’। চল্লিশ টাকা দাম। ঢাউস মাল। কপিকল দিয়ে শেলফ থেকে ওঠাতে নাবাতে হয়।
কবিতার চয়নিকা। গ্রিক-লাতিন থেকে আরম্ভ করে, ফরাসি-জর্মন-ইংরেজি-স্প্যানিশ রুশ তাবৎ ইয়োরোপীয় ভাষা থেকে কবিতা সঞ্চয় করে এ চয়নিকাটি নির্মাণ করা হয়েছে।
গ্রন্থের ভূমিকায় সম্পাদক সবিনয় নিবেদন করেছেন, তিনি এ চয়নিকার মাধুকরী করার সময় নিজের ব্যক্তিগত রুচির ওপর নির্ভর করেননি। তবে কি তিনি বন্ধুবান্ধবদের রুচির ওপর নির্ভর করেছেন? তা-ও নয়। তিনি লিখেছেন বিখ্যাত প্রখ্যাত কবিরা যেসব অন্যান্য কবির কবিতার প্রশংসা করেছেন তাই দিয়ে তিনি এ সঞ্চয়িতা’ নির্মাণ করেছেন। যেমন মনে করুন, বায়রন বলেছেন ‘পোর্কের এ ছত্র কটি কী চমৎকার, কী অনির্বচনীয়!’ চয়নিকা-কার সেই কবিতাটি তুলে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আবার বায়রনের প্রশস্তিটিও তুলে দিয়েছেন। ঠিক এইভাবেই, শেকসপিয়র আছেন গ্যোটের প্রশংসাসহ, কিটস্ আছেন শেলির তারিফযুক্ত, এবং আরও বিস্তর চেনা-অচেনা কবি।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এর চেয়ে আর উত্তম ব্যবস্থা কী হতে পারে?
কিন্তু বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, এরকম রদ্দি, ওঁচা কবিতার সংকলন আমি জীবনে কোনও ভাষাতে কখনও দেখিনি।
এবং শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সর্বোত্তম বেশ কয়েকটি কবিতা তাতে বাদ পড়েছে। তুলনা দিয়ে বলতে পারি, একবার এই বঙ্গভূমিতেই এ ঘটনা ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথের কোন কোন কবিতা বাঙালি পাঠকের ভালো লাগে তারই ভোট নিয়ে একখানি ‘চয়নিকা’ রচিত হয়েছিল। তাতে এত বেশি ভালো কবিতা বাদ পড়েছিল, এবং অপেক্ষাকৃত কাঁচা লেখা ঢুকে গিয়েছিল যে এরপর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যে চয়ন করেন সেটিই ‘সঞ্চয়িতা’ এবং বাজারে সেইটেই চালু। এস্থলে পাঠক অবশ্য বলবেন, ‘রাস্তার লোকের ভোট নিয়ে কি আর উত্তম কবিতা-সঞ্চয়ন হয়। ওদের কীই-বা বুদ্ধি, কীই-বা রুচি।’ অতএব যে বিদেশি চয়নিকা দিয়ে আরম্ভ করেছিলুম সেইটেতেই ফিরে যাই।
অর্থাৎ ভালো ভালো কবি কর্তৃক নির্মিত সঞ্চয়নও উত্তম হল না কেন?
তার প্রধান কারণ, সাধারণ এবং সুরুচিসম্পন্ন পাঠক কবিতা পড়ে কিংবা গান শুনে যদি আনন্দ পায় তবেই সে বলে, কবিতা কিংবা গানটি ভালো। অর্থাৎ তার কাছে যেকোনো বস্তু রসোত্তীর্ণ হলেই হল। কিন্তু কবি যখন অন্য কবির কবিতা পাঠ করেন তখন তাঁর নজর যায় কবিতার গঠন, ভাষা, ছন্দ, মিল– এক কথায় আঙ্গিকের দিকে। কবিতাটি রচনা করতে গিয়ে কবিতাকার কী কী মালমশলা নিয়ে আরম্ভ করেছেন, তাকে কোন কোন বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে সেগুলো তিনি কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন কি না পাঠক-কবির দৃষ্টি থাকে প্রধানত সেইদিকে। কিংবা মনে করুন, আপনি-আমি যখন গান শুনি তখন গানটি মিষ্টি এবং মর্মস্পর্শী হলেই হল। পক্ষান্তরে আকছারই দেখবেন, বদখদ গলা নিয়ে, বিকুটে মান্ধাতার আমলের একটা সম্পূর্ণ অজানা রাগ ধরল এক হাড়-চিমসে গাওয়াইয়া। তবলচিও বাজাতে লাগল এমন এক তাল যে তার কোথায় সম, কোথায় ফাঁক কিছুই মালুম হচ্ছে না। আপনি বিরক্তিতে উঠি-উঠি করছিলেন, এমন সময় দেখেন হঠাৎ মফিলের অন্য গাওয়াইয়া শ্রোতারা ‘আহা, আহা, ক্যাবৎ ক্যাবাৎ’ বলে অচৈতনি প্রায়। কী হল? ব্যাপারটা কী? না, এই ওস্তাদস্য ওস্তাদ এক অ্যাসন অতি-অতি কোমল এমন এক কঠিনস্য কঠিন জায়গায় লাগিয়ে দিয়ে অ্যাসা এক পানিপথ নাকি জয় করেছেন যা পূর্বে কেউ কখনও করতে পারেনি– না, তানসেন নাকি মাত্র দু বার পেরেছিলেন, ওস্তাদ আব্দুল করীম কুলে একবার! ব্যস, হয়ে গেল।
অবশ্য সব পাঠক-কবি কিংবা শ্রোতা-গাওয়াইয়াই যে শুদ্ধমাত্র আঙ্গিক এবং টেকনিকল স্কিলের দিকে এক-চোখা দৈত্যের মতো তাকিয়ে থাকেন সেকথা বলছি না– তবে ওই হল গিয়ে নিয়ম, এবং পূর্বোল্লিখিত ‘লিমিট অব আর্ট’ ওই পর্যায়ের বই।
সমসাময়িক লেখক যখন অন্য লেখকের লেখা পড়েন তখন আরেক মুশকিল। দৃষ্টান্ত দিয়ে কথাটা খোলসা করি।
এই মনে করুন, গৌরকিশোর ঘোষ রম্য-রচনা লিখে দেশে নাম করে ফেলেছেন। আমারও বাসনা গেল, ওই লাইনে যখন খ্যাতি আছে, পয়সাও থাকতে পারে, তখন আমিও-বা বাদ যাই কেন? গৌরকিশোরের লেখার অনুকরণে আমিও কয়েকটি রম্য-রচনা লিখে নিয়ে গেলুম তাঁর কাছে। তিনি দেখলেন, তাঁর এক নবীন শাকরে জুটল, তাঁর অনুকরণ এবার একটা ‘স্কুল’ ‘ঘরানা’ গড়ে উঠতে চলল। আমার রচনা যে আদপেই ‘রম্য’ হয়নি, এমনকি এরে ‘রচনা’ও কওয়া যায় না সেদিকে তাঁর নজরই গেল না। তিনি সার্টিফিকেট দিলেন, ‘তোফা লেখা, খাসা লেখা, বেড়ে লেখা!’ আমিও খুশি। অবশ্য এ সার্টিফিকেট আমি এখনও কাজে লাগাইনি। সাহিত্যিকের সার্টিফিকেট হাল-পাঠকের পানি পাবে কি না সে বাবদে আমার মনে এখনও ধোঁকা রয়ে গেছে।
পক্ষান্তরে ফরাসি কবি-সম্রাট মলিয়ের নাকি তার তাবৎ কৌতুকনাট্য পড়ে শোনাতেন তাঁর নিরক্ষরা বাড়িউলিকে। বাড়িউলি যেসব রসিকতা শুনে হাসত, তিনি সেসব রসিকতার মাত্রা বাড়িয়ে দিতেন; যেগুলো শুনে গম্ভীর মূর্তি ধারণ করত সেগুলো তিনি নির্মমভাবে কেটে দিতেন। অথচ আজ তো গুণীমূর্খ সবাই তার নাট্য দেখে আনন্দ লাভ করে। এই কয়েকদিন মাত্র হল, জ্যোতিরিন্দ্রনাথকৃত তাঁর বাঙলা অনুবাদ কলকাতার রসিক সমাজকে যা হাসাল তা দেখে স্বয়ং মলিয়েরই অবাক হতেন।
তবে কি ওই বাড়িউলি অতিশয় সুরসিকা ছিলেন? এ পর্যন্ত কেউ তো তা বলেনি। তবে কি ওঁকে না শুনিয়ে সে যুগের নামকরা সমঝদারকে শোনালে মলিয়েরের কাব্য আরও রসোত্তীর্ণ হত? বলা অসম্ভব।
***
যে নল চালিয়েছিলুম, সে তবে এখন এসে খাড়া হল কোথায়, পাকড়ালো কাকে? অর্থাৎ হরে-দরে দাঁড়াল কী?
আমার বিশ্বাস এ নল কোথাও দাঁড়াবে না। এ আলোচনায় কস্মিনকালেও কোনও হদিস পাওয়া যাবে না।
তবে যদি শোধান, আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস কী, তবে আমি নবীন, লেখককে অকুণ্ঠ ভাষায় বলব, সার্টিফিকেট কুড়োতে যেও না। ওতে কানাকড়ির লাভ নেই। ওই যে পাঠক-সম্প্রদায় নামক কিম ভূত কিম্ আকার জীব আছে সে যে কখন কার প্রতি সদয়, কার প্রতি নির্দয়, কখন কাকে আশা-গাছের শাখায় চড়ায়, আর কখন কাকে নির্মমভাবে জিলট করে তার হদিস কেউ কখনও পায়নি।
অবশ্য আপনি যদি ভবিষ্যৎ যুগের পাঠকের জন্য লেখেন তবে আপনার কোনও ভাবনা নেই। তবে সেকথাটা পুস্তকের অবতরণিকায় বলে দিলেই সাধু আচরণ হয়। এ বছরের তাজা মাছকে আসছে বছরের শুঁটকি বলে চালানোটা জোচ্চুরির শামিল। পঞ্চাশ বছর পরে যে র মাল মেচ্যোর লিকোর হবে সেটা আজ বাজারে ছাড়া ধাপ্পা। তার জন্য আজ যে লোক সার্টিফিকেট দেয় সে-ও ধাপ্পাবাজ।
***
হালে আকাশে এক নয়া চিড়িয়া উদয় হয়েছে।
নিজের সার্টিফিকেট নিজে লিখে, কিংবা এবং চেলা-চামুণ্ডাদের সামনে নিজের লেখার গুণকীর্তন করতে গিয়ে পয়েন্ট বাতলে বিজ্ঞাপন লিখিয়ে নিয়ে কিংবা এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের অন্যান্য লেখাতে সে লেখা সম্বন্ধে দারুণ-দারুণ রেফরেস্ ঝেড়ে সবকিছু প্রকাশককে দিয়ে। বিজ্ঞাপনরূপে ছাপিয়ে দেওয়া।
এ সিস্টেমের সঙ্গে ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’র বেশ মিল আছে। বাঙলা ভাষায় লেখা দেখে পড়তে গিয়ে মালুম হল যে কিছুই মালুম হচ্ছে না– এ ভাষায় শব্দরূপ, ধাতুরূপ কৃৎ তদ্ধিত আপনি কিছুই জানেন না। অর্থাৎ বন্ধু বাঙলা ভাষার মুখোশ পরে অজানাজন এসে মেরেছে চাকু।
প্রকাশকের মুখোশ পরে এখানে আসে লেখক– হাতে চাক্কু! পাঠক সাবধান!!
রবীন্দ্রনাথ কী যেন গেয়েছেন, দুখের বেশে এসেছ বলে তোমাকে ডরাব না? এ তার উল্টো পিঠ; মিত্রের বেশে এসেছ বলে তোমাকেই যত ভয়।
এ সিসটেম পাঠক-ব্যাঙ্কারের চালানো জুয়ো-ভূমি মন্টে কার্লোর ব্যাংক ভাঙতে পারবে কি না, সেই খবরের প্রত্যাশায় আছি। এযাবৎ তো কোনও সিস্টেম পারেনি।
আর যা করুন, করুন, কিন্তু পাঠকসাধারণকে আহাম্মুখ ঠাউরে আপন আহাম্মুখির পচা ডিম হাটের মধ্যিখানে ফাটাবেন না!!