বেজি

বেজি

নিয়াজ ট্রলারের ছাদে বসে দেখল সমুদ্রের গাঢ় সবুজ উপকূলটি প্রথমে হালকা নীল হয়ে ধীরে ধীরে ঝাঁপসা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ উপকূলটা দেখা যাচ্ছিল ততক্ষণ মনে হচ্ছিল বুঝি বা তীরের সাথে একটি যোগাযোগ আছে। সেটি যখন অদৃশ্য হয়ে গেল তখন হঠাৎ নিয়াজ অসহায় অনুভব করতে থাকে। চারদিকে শুধু পানি আর পানি, তার মাঝে ছোট একটা ট্রলার টুকটুক করে এগিয়ে যাচ্ছে এই ব্যাপারটিকেই তার কেমন জানি অবাস্তব মনে হয়–চিন্তা সুলেই নিয়াজের পেটের ভেতরে পাক দিয়ে ওঠে। সে সাঁতার জানে না, পানি নিয়ে সব সময়েই তার ভেতরে একটা ভয়। তার চাপাচাপিতেই ট্রলারের সবার জন্যে লাইফ–জ্যাকেট রাখা হয়েছে কিন্তু হঠাৎ যদি কোনো কারণে ট্রলার ডুবে যায় তাহলে এই লাইফ-জ্যাকেট দিয়ে তারা কী করবে?

নিয়াজের পাশেই শ্রাবণী দুই হাঁটুতে মুখ রেখে দূরে তাকিয়ে ছিল। তার চোখেমুখে কেমন যেন একধরনের উদাসী ভাব। নিয়াজ নিচুগলায় জিজ্ঞেস করল, তোর ভয় লাগছে না তো?

শ্রাবণীর চোখমুখের উদাস ভাবটা কেটে সেখানে একটা তেজি ভাব ফুটে উঠল। গলা উচিয়ে বলল, তোদের ধারণা মেয়ে হলেই তার সব সময় ভয় লাগতে থাকবে?

নিয়াজ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, না, না–তা না। আমার নিজের ভয় লাগছে তো তাই তোকে জিজ্ঞেস করছি। পানি দেখলেই আমার ভয় লাগে।

শ্রাবণী শব্দ করে হেসে বলল, কী বলছিস তুই? পানি দেখলে ভয় লাগে? পানির মতো এত সুন্দর জিনিস দেখে কেউ ভয় পায়? দ্যাখ তাকিয়ে দ্যাখ।

নিয়াজ তাকিয়ে দেখল, পানির রঙটি আশ্চর্যরকম নীল, চারদিকে যতদূর চোখ যায় সেই নীল পানি এবং এই নীল রঙটির মাঝে একটা অপূর্ব সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। সে মাথা নেড়ে বলল, তা ঠিক। সমুদ্রের পানির মাঝে কিছু একটা আছে। একটা অন্যরকম ব্যাপার। তীর থেকে একরকম আবার ওপর থেকে অন্যরকম।

আর তুই এই সুন্দর পানিকে ভয় পাচ্ছিস?

জয়ন্ত ছড়িয়ে বসে অনেকক্ষণ থেকে একটা সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করছিল, বাতাসের জন্যে সুবিধে করতে পারছিল না, শেষ পর্যন্ত সফল হয়ে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, মানুষের শরীরের সিক্সটি পার্সেন্ট হচ্ছে পানি– হিসাব করলে পা থেকে এই বুক পর্যন্ত আসে। সেই পানিকে তুই পছন্দ করিস না?

শ্রাবণী আবার শব্দ করে হেসে বলল, ওভাবে বলিস না তো! সিক্সটি পার্সেন্ট পানি বললেই মনে হয় শরীরের নিচের অংশটা পানিতে থলথল করছে!

জয়ন্ত নাক–মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে হা হা করে হেসে বলল, আর সুঁই দিয়ে ছোট একটা ফুটো করলেই সব পানি লিক করে বের হয়ে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যাচ্ছে!

নিয়াজ মুখ কুঁচকে জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই এর মাঝে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললি এই সুন্দর পরিবেশটাকে পলিউট করে দিলি? বাতাসটাকে বিষাক্ত করে দিলি?

জয়ন্ত সিগারেটে আরেকটা লম্বা টান দিয়ে বলল, দ্যাখ নিয়াজ তোকে আমি আমার লোকাল গার্জিয়ান বানাই নি যে বসে বসে আমার ওপর মাতবরি করবি। আর বাতাসের পলিউশনের কথা যদি বলিস তাহলে ঐ তাকিয়ে দেখ তোর এই ট্রলারের শ্যালো ইঞ্জিন থেকে কী পরিমাণ কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে।

তাই বলে এই একবিংশ শতাব্দীর মানুষ হয়ে তুই সিগারেট খাবি? আমি বুঝতেই পারি না মেডিক্যালের একজন স্টুডেন্ট হয়ে সে কেমন করে সিগারেট খেতে পারে।

এটাকে বলে নেশা। সিগারেটে নিকোটিন বলে একটা বস্তু থাকে। সেটা রক্তের মাঝে মিশে গিয়ে স্নায়ুতে এক ধরনের আরাম দেয়। মেডিক্যালের একজন স্টুডেন্ট কেমন করে এই সহজ জিনিসটা জানে না আমি সেটাও বুঝতে পারি না।

শ্রাবণী একটা ছোট ধমক দিয়ে বলল, তোরা থামবি? দুই সতীনের মতো ঝগড়া করে দিলি দেখি!

সিগারেট খাওয়া এবং না–খাওয়ার তর্ক এত সহজে থামার কথা ছিল না কিন্তু ঠিক তখন তারা দেখতে পেল ট্রলারের পাশ দিয়ে বিশাল একটি সামুদ্রিক কচ্ছপ ভেসে যাচ্ছে। তিনজনই খানিকটা উত্তেজিত হয়ে এই বিশাল কচ্ছপটার দিকে তাকিয়ে রইল। শ্রাবণী বলল, ইস, সাথে ক্যামেরাটা থাকলে একটা ছবি নেওয়া যেত।

নিয়াজ বলল, নিয়ে এলি না কেন?

ভাবলাম যাচ্ছি রিলিফ ওয়ার্ক করতে–পিকনিক করতে তো আর যাচ্ছি না। পিকনিকে গেলেই না ক্যামেরা ক্যাসেট প্লেয়ার এসব নিয়ে যায়!

নিয়াজ বলল, এটা তো আর লোক–দেখানো ব্যাপার না যে সাথে ক্যামেরা নিতে পারব না! আসল কথা হচ্ছে সিনসিয়ারিটি। আন্তরিকতা।

জয়ন্ত সমুদ্রটাকে তার সিগারেটের এ্যাশট্রে হিসেবে ব্যবহার করে একটু ছাই ফেলে বলল, রিলিফ ওয়ার্কে গিয়ে যখন দেখবি মানুষ দুদিন ধরে না–খেয়ে আছে, গায়ে কাপড় নেই তখন এমনিতেই ক্যামেরা আর ক্যাসেট প্লেয়ারের কথা ভুলে যাবি।

ট্রলারের ছাদে তিনজন চুপ করে বসে রইল। গত সপ্তাহে এরকম সময়েই ভয়ঙ্কর একটা সাইক্লোন এই এলাকায় সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। টেলিভিশনে সেই ছবি দেখে কারো বিশ্বাস হতে চায় না বাতাসের মতো নিরীহ একটি জিনিস এরকম প্রলয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। জয়ন্ত অন্যমনস্কভাবে তার সিগারেটে দুটো টান দিয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, বাই দা ওয়ে–তোদের দুজনকে থ্যাংকস। ছুটির মাঝে ফুর্তিফার্তা না করে আমার কথায় রিলিফ নিয়ে চলে এলি। একা একা এসব কাজে খুব বোরিং লাগে। আর বদমাইশ সাইক্লোনটা দেখ, হিট করার জন্যে কী একটা সময় বেছে নিল।

শ্রাবণী বলল, তুই কি ভেবেছিলি সাইক্লোন পঞ্জিকা দেখে দিনক্ষণ ঠিক করে আসবে?

না তা অবিশ্যি ভাবি নি। জয়ন্ত শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, আর শ্রাবণী তোকে স্পেশাল থ্যাংকস। পুরুষ মানুষকে রাজি করাতে পারি না, আর দুই মেয়ে হয়ে রিলিফ নিয়ে চলে এলি!

তোদের নিয়ে তো মহামুশকিল হল! শ্রাবণী অধৈর্য হয়ে বলল, মেয়ে আর ছেলে এই জিনিসটা মনে হয় এক সেকেন্ডের জন্যেও তোরা ভুলতে পারিস না।

কে বলে ভুলতে পারি না? জয়ন্ত ষড়যন্ত্রীর মতো মুখ করে বলল, আমরা তো তুলতেই চাই। তোরাই তো ভুলতে দিস না।

কখন আমরা তোকে তুলতে দেই না?

ঐ যে লজ্জাবনত কটাক্ষ, ব্ৰীড়াময়ী ভঙ্গি, লাস্যময়ী হাসি!

কী বললি? কী বললি তুই? আমি ব্ৰীড়াময়ী ভঙ্গি আর লাস্যময়ী হাসি দিই? ধাক্কা দিয়ে যখন পানিতে ফেলে দেব তখন লাস্যময়ী হাসি আর ব্রীড়াময়ী ভঙ্গির মজাটা টের পাবি। কচ্ছপ কপ করে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।

ফর ইওর ইনফরমেশান ইওর হাইনেস শ্রাবণী–কচ্ছপ কখনো কাউকে কপ করে খেয়ে ফেলে না।

তোকে বলেছে!

নিয়াজ শ্রাবণী আর জয়ন্তের হালকা কথাবার্তায় মন দিতে পারছিল না। যতক্ষণ পর্যন্ত গন্তব্যে না পৌঁছাচ্ছে সে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না। সমুদ্রের তয়ঙ্কর ঢেউয়ে ছোট ট্রলার উথালপাথাল হয়ে দুলবে এরকম একটা ভয় ছিল কিন্তু সেরকম কিছুই হয় নি, সমুদ্রটা একটা বড় দিঘির মতো শান্ত, কিন্তু তবুও সে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে হঠাৎ করে কিছু–একটা ঘটে যাবে। সামনে দূরে কোনো–একটা দ্বীপ খুঁজতে খুঁজতে সে শুকনো গলায় বলল, আর কতক্ষণ যেতে হবে রে?

জয়ন্ত চোখ কপালে তুলে বলল, কতক্ষণ যেতে হবে মানে? মাত্র তো শুরু করলাম। এখনো কমপক্ষে চার ঘণ্টা।

চার ঘণ্টা!

হ্যাঁ। কেন? তোর ভয় লাগছে?

নিয়াজ দুর্বলভাবে হাসল, বলল, না, ঠিক ভয় না। নার্ভাস।

ধুর! নার্ভাস লাগার কী আছে? নিচে গিয়ে শুয়ে থাক।

শোয়ার জায়গা কই? টয়লেট পেপার দিয়ে ট্রলার বোঝাই করে রেখেছিস।

টয়লেট পেপার? জয়ন্ত হা হা করে হেসে বলল, টয়লেট পেপার তুই কোথায় দেখলি? ওগুলো হচ্ছে মেডিক্যাল সাপ্লাই।

আমাদের দেশের মানুষের ওরকম মেডিক্যাল সাপ্লাই কোনো কাজে লাগে না। তাদের দেশে যেগুলো কোনো কাজে আসে না সেগুলো এখানে রিলিফ নাম দিয়ে পাঠিয়ে দেয়।

সেটা ঠিকই বলেছিস। জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, একবার বন্যার পর রিলিফ নিয়ে গেছি, ব্রিটিশ একটা অর্গানাইজেশন রিলিফ পাঠিয়েছে বাক্স খুলে দেখি ভিতরে সান ট্যানিং লোশন! মানুষকে বোঝাতেও পারি না জিনিসটা কী কাজে লাগে।

জয়ন্তের কথা শুনে শ্রাবণী আর নিয়াজ দুজনেই খানিকক্ষণ হাসল এবং তারপর খানিকক্ষণ পশ্চিমা দেশের মুণ্ডুপাত করল। জয়ন্ত তার সিগারেটের শেষ অংশটুকুতে একটা লম্বা টান দিয়ে তার গোড়াটা সমুদ্রে ফেলে দিয়ে ট্রলারের ছাদে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। শ্রাবণী হাঁটুতে মুখ রেখে উদাস হয়ে বসে থাকে এবং নিয়াজ কিছু–একটা করে সময় কাটানোর জন্যে নিচে নেমে এল। তার ব্যাগে কিছু বই এবং কাগজপত্র আছে। সেগুলো দেখে সময় কাটাতে যায়।

মানব সভ্যতার বিকাশের ওপর গভীর জ্ঞানের একটা বই পড়ার চেষ্টা করে নিয়াজ বেশি সুবিধে করতে পারল না–তখন সে একটা রগরগে ডিটেকটিভ বই নিয়ে বসল। ওষুধের একটা বড় বাক্সের উপর পা তুলে দিয়ে ট্রলারের বেঞ্চে আধাশোয়া হয়ে সে দীর্ঘ সময় নিয়ে বইটা পড়ে প্রায় শেষ করে বাইরে তাকায়। চারদিকে এখনো সেই পানি। সবকিছুর যেরকম একটা সীমা থাকে, পানির বেলাতেও সেটা মনে হয় সত্যি, এত সুন্দর নীল দেখেও সে কেমন জানি হাঁপিয়ে উঠছে। নিয়াজ বইটা বগলে নিয়ে আবার ট্রলারের ছাদে উঠে এল। সেখানে জয়ন্ত লম্বা হয়ে শুয়ে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছে, হঠাৎ করে গড়িয়ে পানিতে পড়ে

যায় ভেবে নিয়াজ রীতিমতো আঁতকে ওঠে। শ্রাবণী সেই একইভাবে পা দুলিয়ে উদাস উদাস মুখ করে বসে আছে, নিয়াজকে দেখে জিজ্ঞেস করল, খিদে পেয়েছে?

নিয়াজের খাওয়ার কথা মনেই ছিল না, কিন্তু শ্রাবণীর কথা শুনেই চট করে খিদে পেয়ে গেল, মাথা নেড়ে বলল, কিছু তো পেয়েছেই।

নিচে দ্যাখ আমার ব্যাগটা আছে। নিয়ে আয়। কয়টা স্যান্ডউইচ বানিয়ে এনেছি।

নিয়াজ শ্রাবণীর ব্যাগটা নিয়ে এল। ভেতরে প্লাস্টিকের বাক্সে স্যান্ডউইচ, কয়টা লাচ্ছু, কলা এবং কয়েকটা কোল্ড ড্রিংকস। দেখে নিয়াজের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, বাহ! এই দ্যাখ তুই যে সবসময় বলিস ছেলে আর মেয়ের মাঝে কোনো পার্থক্য নাই সেটা সত্যি নয়। তুই কি মনে করিস কখনো আমি কিংবা জয়ন্ত এভাবে গুছিয়ে খাবার আনতে পারতাম?

জয়ন্ত নিজের নাম শুনে চোখ খুলে বলল, কী হয়েছে?

শ্রাবণী হেসে বলল, দেখলি খাবারের গন্ধে কীরকম জেগে উঠেছে?

খাবার! জয়ন্ত এবারে সত্যি সত্যি উঠে বসল, খাবারের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম! কে এনেছে খাবার?

শ্রাবণী!

জয়ন্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, ফ্যান্টাস্টিক! যা খিদে পেয়েছে কী বলব। বঙ্গোপসাগরের এই রুচিকর হাওয়ায় মনে হচ্ছে একটা আস্ত ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব।

শ্রাবণী স্যান্ডউইচ বের করতে করতে বলল, সরি জয়ন্ত, তোর জন্যে আমি ঘোড়া রান্না করে আনি নি। স্যান্ডউইচ খেতে হবে।

বিপদে পড়লে বাঘে ঘাস খায়–আর এটা তো স্যান্ডউইচ।

শ্রাবণী কিছু খাবার আলাদা করে নিয়াজের হাতে দিয়ে বলল, এটা মাঝিকে দিয়ে আয়।

জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, জব্বার মিয়া তোর এই আধুনিক খাবার খেতে পারবে না। শুঁটকি দিয়ে ভাত যদি থাকে দে।

বাজে বকিস না।

নিয়াজ হাতে করে স্যান্ডউইচ আর কলা নিয়ে ট্রলারের ছাদে হামাগুড়ি দিয়ে পিছনে এগিয়ে গিয়ে ডাকল, জব্বার মিয়া।।

জব্বার মিয়া মধ্যবয়সী মানুষ। দেখে মনে হয় জগতের কোনোকিছুতেই সে কখনো বিস্মিত হয় না। চোখেমুখে এক ধরনের শান্ত এবং পরিতৃপ্ত ভাব। নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, জে। শ্যালো ইঞ্জিনের প্রবল শব্দের জন্যে তাকে প্রায়ই চিৎকার করে কথা বলতে হয়।

নেন। স্যান্ডউইচ খান।

জব্বার মিয়া মুখে মনোরম একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, আপনারা খান।

আমরা তো খাচ্ছি। আপনিও খান।

জায়গামতো পৌঁছে খাব। এখন থাক।

নিয়াজ ঠিক বুঝতে পারল না যে–মানুষটা খেতে চাইছে না তাকে পীড়াপীড়ি করা। উচিত হবে কিনা। সে ফিরে আসার জন্যে মাথা ঘুরিয়েই দেখতে পায় বহুদূরে হালকা ছায়ার মতো একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। সে জব্বার মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা কি ঐখানে। যাচ্ছি?

জে না।

তাহলে কোথায় যাচ্ছি?

আরো দূরে।

আর কতক্ষণ?

জব্বার মিয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে কেমন জানি অনিশ্চিতের মতো বলল, এই তো আর কিছুক্ষণ।

কথাটার কোনো সুনির্দিষ্ট অর্থ নেই, তাছাড়া সময়ের অনুমান করার জন্যে যার সূর্যের দিকে তাকাতে হয় তার কাছে সময় সম্পর্কে সূক্ষ্ম কোনো সদুত্তর পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। নিয়াজ হামাগুড়ি দিয়ে আবার শ্রাবণী এবং জয়ন্তের কাছে ফিরে এসে বলল, জব্বার মিয়া তোর সাহেবি খাবার খাবে না।

শ্রাবণী বিরক্ত হয়ে বলল, বাজে কথা বলিস না। না খেলে না খাবে–তুই দিয়ে আয়।

নিয়াজ ইতস্তত করে বলল, ইয়ে খেতে চাইছে না–তাকে জোর করে–

শ্রাবণী নিয়াজের হাত থেকে খাবারগুলো নিয়ে বলল, পুরুষমানুষের জিনেটিক কোডিঙে কিছু গোলমাল আছে, কমনসেন্স কম। একজনকে খাবার দিলে সে না খায় কেমন করে?

শ্রাবণী ট্রলারের উপর দিয়ে হেঁটে পিছনে গিয়ে জব্বার মিয়ার হাতে খাবার ধরিয়ে দিয়ে ফিরে এল, জব্বার মিয়াকে আপত্তি করার কোনো সুযোগ পর্যন্ত দিল না। নিয়াজ এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে থাকে–মেয়েটির মাঝে এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততা আছে

যেটা সে হাজার চেষ্টা করেও আয়ত্ত করতে পারবে না।

শ্রাবণী দূরে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, দ্যাখ কী সুন্দর একটা দ্বীপ!

দেখেছি।

কী নাম এটার? শ্রাবণী জব্বার মিয়াকে জিজ্ঞেস করল, জর ভাই এইটা কোন দ্বীপ?

হকুনদিয়া।

হকুনদিয়া? কী পিকিউলিয়ার নাম।

জে। আগে এটার নাম ছিল দিঘলদিয়া। এখন নাম হকুনদিয়া। উপরে হকুন উড়ে তাই নাম হকুনদিয়া!

শ্রাবণী একটা গল্পের খোঁজ পেয়ে জব্বার মিয়ার কাছে এগিয়ে গেল, শকুন ওড়ে?

জে। হকুন উড়ে।

কেন?

কোনো মানুষ যেতে পারে না। যেই যায় সেই মরে। মড়ার খোঁজে হকুন ওড়ে।

শ্রাবণী চোখ বড় বড় করে জব্বার মিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল, যেই যায় সেই মরে?

জে। পাঁচ-ছয় বছর আগে পাগলা ডাক্তার খুন হওয়ার পর আর কেউ যেতে পারে না।

পাগলা ডাক্তার?

জে।

এখানে একজন পাগলা ডাক্তার থাকেন?

জব্বার মিয়া দাঁত বের করে হেসে বলল, আসলে পাগল ছিলেন না। এলাকার লোক মায়া করে ডাকত পাগলা ডাক্তার। বিজ্ঞান মতে গবেষণা করতেন। অনেক আলেমদার মানুষ ছিলেন।

খুন হলেন কেমন করে?

জব্বার মিয়া এই পর্যায়ে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে দার্শনিকের মতো বলল, এইটা দুনিয়ার নিয়ম। যত ভালো মানুষ সব খুন হয়ে যায়। বদ মানুষেরা বেঁচে থাকে।

এতক্ষণে দ্বীপটি আরো কাছে চলে এসেছে, সবুজ গাছে ঢাকা। বড় বড় নারকেল গাছ উপকূলটিকে ঢেকে রেখেছে। এত সুন্দর একটা দ্বীপ সম্পর্কে কীরকম অশুভ একটি প্রচার। পাগলা ডাক্তার ভদ্রলোকটির জন্যে শ্রাবণী এক ধরনের সমবেদনা অনুভব করে। মানুষটি নিশ্চয়ই অন্যরকম ছিলেন, তা না হলে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে এরকম একটি নির্জন দ্বীপে কেউ জীবন কাটাতে আসে?

শ্রাবণী নিয়াজ আর জয়ন্তের কাছে ফিরে এসে বলল, এই দ্বীপটা দেখেছিস, কী সুন্দর!

নিয়াজ গোগ্রাসে স্যান্ডউইচ খেতে খেতে বলল, হু।

এখানে কোনো মানুষ থাকতে পারে না, গেলেই মারা পড়ে।

সত্যি?

জব্বার ভাই তো তাই বলল।

আর তুই বিশ্বাস করে বসে আছিস?

কেন বিশ্বাস করব না? দ্বীপের নাম পর্যন্ত পাল্টে ফেলেছে–আগে ছিল দিঘলদিয়া, এখন হয়ে গেছে হকুনদিয়া। হকুন মানে বুঝলি তো? শকুন।

জয়ন্ত এক কামড়ে কলার একটা বড় অংশ মুখে পুরে খেতে খেতে বলল, মানুষ গেলে কেন মারা পড়ে সেটা বলেছে?

না। একজন পাগলা ডাক্তার থাকতেন–সেই পাগলা ডাক্তার খুন হয়ে যাবার পর থেকে এই অবস্থা।

ভেরি ইন্টারেস্টিং! জয়ন্ত দ্বীপটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, দেখে বোঝার উপায়ই নেই যে এটা হন্টেড। এতদিন শুধু হন্টেড হাউজ শুনে এসেছি, এখন দেখা যাচ্ছে হন্টেড আইল্যান্ড! আস্ত একটা দ্বীপ হন্টেড। পাগলা ডাক্তারের প্রেতাত্মা কন্ট্রোল করছে!

শ্রাবণী বলল, সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা করবি না।

কে বলেছে আমি ঠাট্টা করছি? জয়ন্ত বিশেষ মনোযোগ দিয়ে খেতে খেতে বলল, আমি বলি কি, ফেরত যাওয়ার আগে এই হকুনদিয়া দ্বীপটা ইনভেষ্টিগেট করে যাই।

কেন?

আমি কখনো হন্টেড প্লেস দেখি নাই। এটা হচ্ছে সুযোগ। সত্যি কথা বলতে কি, পাগলা ডাক্তারের প্রেতাত্মাকে যদি একটা শিশির ভেতরে ভরে নিয়ে যেতে পারি_

শ্রাবণী বিরক্ত হয়ে বলল, বাজে কথা বলবি না।

ট্রলারটি হকুনদিয়া দ্বীপের খুব কাছে দিয়ে যাবার সময় তিনজনই খুব কৌতূহল নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। তাদের কেউই জানত না আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার মাঝেই এই দ্বীপটিকে নিয়ে তাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে।

.

ট্রলারটি যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে তখন বেলা গড়িয়ে এসেছে। নিয়াজ, জয়ন্ত আর শ্রাবণী বড় একটি রিলিফ–কাজের ছোট একটা অংশ হিসেবে এসেছে–কাজেই তাদের কোনো গুরুত্ব দেবে কিনা সেটা নিয়ে খুব সন্দেহের মাঝে ছিল–কিন্তু দেখা গেল তাদের আশঙ্কা অমূলক। বিশাল একটি বার্জ সমুদ্রের মাঝে নোঙর করে রাখা আছে। সেটি ঘিরে। নানারকম কর্মব্যস্ততা। অসংখ্য ট্রলার এবং নৌকা, কিছু ছোট লঞ্চ, বেশকিছু স্পিডবোট দাঁড়িয়ে আছে, তার মাঝে নানারকম রিলিফ–সামগ্রী তোলা হচ্ছে–লোকজনের হৈচৈ চেঁচামেচিতে একটা কর্মমুখর পরিবেশ কিন্তু তার ভেতরেই তিনজন পৌঁছানো মাত্রই তাদেরকে রিলিফ–কাজের দায়িত্বে যে–মানুষটি তার কাছে নিয়ে যাওয়া হল। ভদ্রলোক জাতিতে ব্রিটিশ, মধ্যবয়স্ক, চুলদাড়িতে পাক ধরেছে। রোদে পোড়া চেহারা। তাদেরকে দেখে ভারি খুশি হলেন। জরুরিভাবে যোগাযোগ করে এই জিনিসগুলো আনা হয়েছে– বোঝা গেল এগুলো ছাড়া রিলিফ ওয়ার্কের ওষুধপত্রে একধরনের অসংগতি থেকে যেত। ব্রিটিশ ভদ্রলোক ইংরেজিতে বললেন, তোমরা অনেক কষ্ট করে এসেছ, এখন বিশ্রাম নাও। বার্জের ওপরে তোমাদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

জয়ন্ত ইংরেজি মোটামুটি গুছিয়ে লিখতে পারে কিন্তু বলার সময় তার খানিকটা বাধো বাধো ঠেকে। তাই দিয়েই সে বলল যে তারা ট্রলারে শুয়ে–বসে এসেছে এবং মোটেও ক্লান্ত নয়। এই কথা শুনে সাথে সাথে তাদের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হল, শারীরিক পরিশ্রম করার মতো অনেক মানুষ আছে, কিন্তু মোটামুটি লেখাপড়া জানে এখানে এরকম মানুষের খুব অভাব।

বার্জ থেকে নানা রিলিফ বের করে ট্রলার এবং নৌকায় তোলা হতে লাগল। ম্যাপে ছোট ছোট দ্বীপগুলো চিহ্নিত আছে। কোথায় কত মানুষ মারা গেছে কতজন ঘরবাড়ি হারিয়েছে, কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে লিখে রাখা আছে। ম্যাপ এবং লিস্ট দেখে জিনিসপত্রের পরিমাণ ঠিক করে চিরকুটে সংখ্যাটি লিখে দেওয়া হতে লাগল। সেটি দেখে মালপত্র বোঝাই করে ট্রলার–নৌকা–লঞ্চগুলো চলে যেতে রু করল। যেগুলো গিয়েছে সেগুলো ফিরে আসতে শুরু করেছে। সেখানে মালপত্র বোঝাই করে আবার তাদের নতুন জায়গায় পাঠানো হতে লাগল।

রিলিফ ওয়ার্কে আরো অনেকে এসেছে। একটা বড় অংশ এসেছে কিছু এনজিও থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজের আরো কিছু ছাত্র এসেছে। ছাত্রী হিসেবে শ্রাবণীই একজন তবে ব্রিটিশ রিলিফ টিমের সাথে কয়েকজন মহিলা এসেছে। জয়ন্ত যদিও মুখ টিপে হেসে বলল, তারা শুধু নামেই মহিলা, দেখতে শুনতে আকারে এবং আকৃতিতে সবাই এই দেশের বড় সন্ত্রাসীর মতো!

সমস্ত কাজ শেষ করে ঘুমুতে ঘুমুতে গভীর রাত হয়ে গেল। বার্জের ডেকে সবার শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, শুধু মেয়েদের আলাদা কেবিন দেওয়া হয়েছে। শ্রাবণীর কেবিনটি দেখে জয়ন্ত এবং নিয়াজের চোখ হিংসায় ছোট ছোট হয়ে গেল! ছোট বাংক বেড, মাথার কাছে গোল জানালা, ছোট খেলনার মতো একটা সিংক, লাগোয়া বাথরুম, সবকিছু ঝকঝক তকতক করছে। জয়ন্ত দেখে শুনে মুখ সুঁচালো করে বলল, তোরা না নারীবাদী মহিলা–আমাদেরকে শুকনো ডেকের মাঝে শুইয়ে রেখে নিজে এরকম কেবিন নিয়ে ঘুমুচ্ছিস যে?

আমি নিই নি। আমাকে দেওয়া হয়েছে।

ছুঁড়ে ফেলে দে। বলে দে থাকব না এখানে।

শ্রাবণী বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, যে জাতি নারীদের সম্মান করে না সেই জাতির উন্নতি হয় না। তোরাও শেখ।

.

পরের দিনটিও ব্যস্ততার মাঝে কাটল। বিকেলের দিকে তারা একটা দলের সাথে কাছাকাছি হোট একটা দ্বীপে রিলিফ নিয়ে গেল। তাদেরকে আসতে দেখে অনেক আগে থেকে মানুষজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুকনো অভুক্ত মানুষ ঘরবাড়ি ভয়ঙ্কর সাইক্লোন আর জলোচ্ছ্বাসে উড়ে গেছে। আগে থেকে খবর পেয়েছিল বলে নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে অবিশ্যি বেশির ভাগ মানুষ প্রাণে বেঁচে গিয়েছে।

ফিরে আসার সময় আবার তারা হকুনদিয়া দ্বীপের অন্য পাশ দিয়ে ফিরে এল। গভীর অরণ্যে ঢেকে থাকা দ্বীপটি দূর থেকে খুব রহস্যময় মনে হয়। এখানে কোনো মানুষ নেই– কেউ গেলে সাথে সাথে মারা পড়ে চিন্তা করলেই কেমন জানি ভয় হয়।

পরের দিন ঘুম থেকে উঠে জয়ন্ত আবিষ্কার করল, আজকের দিনটিতে তাদের ছুটি দেওয়া হয়েছে। ঢাকা থেকে বেশকিছু ভলান্টিয়ার এসেছে, তাদেরকে ব্যস্ত রাখার জন্য সব কাজকর্মই তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে বার্জটি নোর করে রাখা হয়েছে সেই দ্বীপটি ঘুরে দেখা যেতে পারে, কিন্তু এটি একেবারেই সাদামাটা একটা দ্বীপ। সাইক্লোনে ঘরবাড়ি ধুয়ে মুছে গিয়ে আরো সাদামাটা হয়ে গেছে। গ্রাম্য পথ ধরে হেঁটে আবিষ্কার করল সঙ্গে শ্রাবণী থাকার কারণে পেছনে ছোট ছোট বাচ্চার একটি বড় মিছিল তৈরি হয়ে গেছে। বাচ্চাগুলোর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে লাভ হল না। শহরের এই মানুষগুলোকে তারা বুঝতে পারে না। কথাবার্তা বললে তারা দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। এরকম সময়ে জয়ন্ত বলল, চল, হকুনদিয়া দ্বীপ থেকে ঘুরে আসি।

নিয়াজ ভুরু কুঁচকে বলল, কী বললি?

বলেছি হকুনদিয়া দ্বীপ থেকে ঘুরে আসি।

কীভাবে যাবি?

খোঁজ করলেই একটা স্পিডবোট বা ট্রলার কিছু-একটা পেয়ে যাব।

শ্রাবণী বলল, তারপর যখন খুন হয়ে যাবি তখন কী হবে?

জয়ন্ত বলল, তুই সত্যিই বিশ্বাস করিস ওখানে গেলেই মানুষ খুন হয়ে যায়?

সবাই যখন বলছে তখন নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে।

জয়ন্ত একটু রেগে বলল, এখানকার মানুষেরা আরো কী বলেছে শুনিস নি?

কী বলেছে?

বলেছে সাইক্লোনটা সোজা আসছিল, এখানকার এক পীর সাহেব ধমক দিয়ে পুবদিকে সরিয়ে নিয়েছেন। বলছে গভীর রাতে গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ওলাবিবি ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে–যার অর্থ গ্রামের সব মানুষ কলেরায় মরে যাবে। বলছে চাঁদনী রাতে সুপারি গাছে বসে বসে পরীরা আকাশে উড়ছে। আরো শুনবি?

থাক, অনেক বক্তৃতা হয়েছে।

জয়ন্ত গলা উঁচিয়ে বলল, তোরা যেতে না চাইলে নাই। দরকার হলে আমি একা যাব।

কেন?

প্রমাণ করতে চাই পুরোটা কুসংস্কার। আর কিছু না হোক তখন মানুষ আবার এই সুন্দর দ্বীপটায় থাকতে পারবে।

শ্রাবণী কিছু না বলে জয়ন্তর চোখে তাকিয়ে রইল। জয়ন্ত বলল, মনে করিস না আমি পাগলামো করছি। এরকম একটা ব্যাপার জেনেনেও যদি দ্বীপটাতে অন্তত পা না ফেলে আসি তাহলে নিজের কাছে নিজের খারাপ লাগবে, মনে হবে কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেললাম।

ঠিক আছে। শ্রাবণী মাথা নেড়ে বলল, আমি যাব।

নিয়াজ বলল, তাহলে আমি একা আর বসে থেকে কী করব? আমিও যাব।

জয়ন্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, চমৎকার! আমি গিয়ে দেখি একটা স্পিডবোট ট্রলার নৌকা কিছু–একটা পাই কিনা।

শ্রাবণী মনে মনে আশা করছিল রিলিফ–কাজে সবাই ব্যস্ত থাকবে, জয়ন্তের এরকম পাগলামোর জন্য কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু দেখা গেল কিছুক্ষণের মাঝেই জয়ন্ত একগাল হাসি নিয়ে ফিরে এল, সে জব্বার মিয়াকেই পেয়ে গেছে। আবার মিয়া চাইছে না। তারা সেখানে যাক, কিন্তু যখন জোরাজুরি করেছে তখন শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে রাজি হয়েছে।

কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল, সমুদ্রের নীল পানি কেটে জব্বার মিয়ার ট্রলারটা ছুটে যাচ্ছে। ট্রলারের ছাদের ওপর তিনজন চুপচাপ বসে আছে।

.

হকুনদিয়া দ্বীপে পৌঁছে ট্রলারটাকে টেনে খানিকটা বালুর ওপর তুলে জব্বার মিয়া নেমে এল, সে এমনিতেই কথা বেশি বলে না। এখন আরো কম কথা বলছে। জয়ন্ত বলল, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ জব্বার মিয়া। আপনি নামিয়ে না দিলে আমাদের এখানে আসা হত না।

কাজটা ভালো হল না। জব্বার মিয়া নিচুগলায় বলল, এর আগেরবার যে খুন হয়েছে, আপনাদের মতোই একজন ছিল। কিছু–একটা সাহস দেখানোর জন্যে এসেছিল, এসে খুন হল।

জয়ন্ত একটু ফ্যাকাসে মুখে বলল, আমরা খুন হব না। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।

এখানে আসতে চেয়েছিলেন, এসেছেন। জব্বার মিয়া শক্তমুখে বলল, আমি এখানে অপেক্ষা করি, আপনারা একটু ঘোরাঘুরি করে আসেন, ফেরত নিয়ে যাই।

নিয়াজ মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ জব্বার ভাই ঠিকই বলেছে। তুই আসতে চেয়েছিলি, এসেছিস। এখন চল যাই।

জয়ন্ত বলল, তোরা যেতে চাইলে যা। আমি না–দেখে যাব না।

এখানে দেখার কী আছে? জঙ্গল গাছপালা দেখিস নি কখনো?

জয়ন্ত বলল, আমি ভেতরে ঢুকে দেখতে চাই।

জব্বার মিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে ট্রলারের পাটাতন থেকে একটা কাঠ সরাল। দেখা গেল সেখানে হাতে-তৈরি একটা বন্দুক। বন্দুকটা হাতে নিয়ে বলল, তাহলে এইটা সাথে রাখেন।

জয়ন্ত ভুরু কুঁচকে বলল, বেআইনি অস্ত্র? লাইসেন্স আছে?

লাইসেন্স কোথায় থাকবে! হাতে–তৈরি বন্দুক, ট্রলারে রাখি। চোর-ডাকাতের উৎপাতের জন্য রাখতে হয়।

না। জয়ন্ত মাথা নাড়ল, বেআইনি অস্ত্র রাখব না।

জব্বার মিয়া খানিকক্ষণ জয়ন্তের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বন্দুকটা আবার পাটাতনের ভেতরে রেখে কাঠ দিয়ে ঢেকে দিল। জয়ন্ত বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না জব্বার মিয়া। আমাদের কিছু হবে না। আমরা বেশি ভেতরে যাব একটু ঘোরাঘুরি করে চলে আসব।

আমায় গিয়ে রিলিফ নিয়ে যেতে হবে। রিলিফ পৌঁছে দিয়েই আমি চলে আসব। আপনারা ঠিক এইখানে থাকবেন।

ঠিক আছে।

অন্ধকার হয়ে গেলে কিছুতেই দ্বীপের ভেতরে থাকবেন না। আমি অন্ধকার হওয়ার আগেই আসব।

ঠিক আছে।

জব্বার মিয়া এবার ট্রলারের ছাদের সাথে লাগানো একটা লম্বা কিরিচ টেনে বের করে ওদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এইটা সাথে রাখেন। এইটা রাখার জন্য লাইসেন্স লাগে না।

জয়ন্ত ইতস্তত করে কিরিচটা হাতে নিল, সাবধানে ধরে পরীক্ষা করে বলল, এইটা রাখব?

নিয়াজ বলল, রেখে দে। কখন কী কাজে লাগে।

যদি কোনো বিপদ দেখেন আগুন জ্বালাবেন।

আগুন?

হ্যাঁ। ম্যাচ আছে সাথে?

আছে।

দুইটা মোমবাতি নিয়ে যান

দিনের বেলা মোমবাতি দিয়ে কী করব?

সাথে রাখেন। বলে জব্বার দুইটা বড় বড় মোমবাতি বের করে দিল।

নিয়াজ মোমবাতিগুলো হাতে নেয়, হঠাৎ করে সে কেমন যেন আতঙ্ক অনুভব করতে থাকে। শুকনো গলায় বলল, আর কিছু লাগবে জব্বার ভাই?

দড়ি। আর লাঠি।

কেন? দড়ি আর লাঠি কেন?

জব্বার মিয়া বলল, জানি না। তবে মানুষ বিপদে পড়লে লাগে। আগে যে লোকটা খুন হল-

জব্বার মিয়া হঠাৎ করে থেমে গেল নিয়াজ ভয়ে ভয়ে বলল, যে খুন হল?

না, কিছু না। জব্বার মিয়া মাথা নেড়ে বলল, আপনারা যখন যাবেনই তখন ভয় দেখিয়ে লাভ কী?

তবু শুনি।

শোনার কিছু নাই। একটা গর্তের মাঝে পড়ে ছিল–সাথে দড়ি আর অন্য মানুষ থাকলে বের হতে পারত।

ও।

হ্যাঁ। সব সময় তিনজন একসাথে থাকবেন।

ঠিক আছে।

আমি অন্ধকার হবার আগেই আসব।

ঠিক আছে।

জব্বার ট্রলার থেকে একটা লম্বা বাঁশ এবং নাইলনের কিছু দড়ি বের করে দিল। বাঁশটা কেটে তিন টুকরা করে তিনজনের হাতে দিয়ে বলল, আল্লাহ মেহেরবান।

নিয়াজ ফিসফিস করে বলল, আল্লাহ মেহেরবান।

আর শোনেন– জব্বার মিয়া নিচুগলায় বলল, চোখগুলি সাবধান।

চোখ?

হ্যাঁ। চশমা থাকলে সবসময় চশমা পরে থাকবেন।

জয়ন্ত অবাক হয়ে বলল, কেন?

জব্বার মিয়া কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

জব্বারের ট্রলারটা শব্দ করে সমুদ্রের বুকে অদৃশ্য হয়ে যাবার পর ওরা তিনজন একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। জয়ন্ত দুর্বল গলায় বলল, কাজটা ঠিক করলাম কিনা বুঝতে পারলাম না।

শ্রাবণী বলল, ঠিক করিস নি। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই।

জয়ন্ত দ্বীপটার দিকে তাকাল। গাছপালা–ঢাকা নিঝুম একটা দ্বীপ। সমুদ্রের ঢেউ এসে তীরে আছড়ে পড়ছে, এছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। জয়ন্ত হাতের কিরিচটার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ভেতরে আর নাইবা গেলাম। বীচটাতে একটু হাঁটাহাঁটি করে দেখি।

শ্রাবণী মাথা নাড়ল, বলল, আমাদের জোর করে এখানে এনেছিস–এখন পিছাতে পারবি না।

তুই কী করতে চাস?

ভেতরে যাব।

ভেতরে যাবি?

হ্যাঁ।

জয়ন্ত কিছুক্ষণ শ্রাবণীর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বেশ।

তিনজন হেঁটে হেঁটে যখন দ্বীপের ভেতরে ঢুকছিল তখন শরৎকালের রৌদ্র মাত্র সতেজ হতে শুরু করেছে।

.

যেখানে মানুষের জনবসতি আছে সেখানে পায়ে চলার পথ তৈরি হয়ে যায় এই দ্বীপটিতে দীর্ঘদিন কোনো মানুষ থাকে নি বলে কোনো পথঘাট নেই। ভেতরে ঢুকতে হলে ঝোঁপঝাড় ভেঙে ঢুকতে হয়, তিনজন সেভাবেই ঢুকেছে। সবার আগে জয়ন্ত। তার হাতে বড় কিরিচ–ঝোঁপঝাড় বা বুনোলতা বেশি থাকলে সেটা দিয়ে কেটে পথটা খানিকটা পরিষ্কার করছে। জয়ন্ত থেকে কয়েক হাত পেছনে শ্রাবণী। সবার পিছনে নিয়াজ। পা ফেলার আগে বাঁশের লাঠিটা দিয়ে মাঝে মাঝে পরীক্ষা করছে। ঠিক কী কারণে কারোই সঠিক জানা নেই। বালুবেলায় প্রখর রোদ ছিল, ভেতরে তার কিছু অবশিষ্ট নেই। বড় বড় গাছের ছায়ায় আলো–আঁধারি একধরনের আবছা অন্ধকার।

তিনজন চুপচাপ মিনিট দশেক হাঁটার পর শ্রাবণী হঠাৎ করে নিচুগলায় বলল, থাম।

অন্য দুজন সাথে সাথে থেমে যায়। নিয়াজ ভয়–পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

না, কিছু হয় নি।

তাহলে?

আমার শুধু মনে হচ্ছে কেউ আমাদের লক্ষ করছে।

শ্রাবণীর কথা শুনে জয়ন্ত আর নিয়াজ চারদিকে তাকাল–যতদূর চোখ যায় শুধু গাছ লতাপাতা ঝোঁপঝাড়। কেউ যদি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ করে সেটি বোঝার কোনো উপায় নেই। ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার জন্য জয়ন্ত হাত নেড়ে বলল, কে এখানে লক্ষ করবে? তোর মনের ভুল।

আমি যখন ছোট ছিলাম একদিন রাতে ঘুম ভেঙে গেল। আমার শুধু মনে হতে লাগল কেউ একজন ঘরে আছে– আমাকে লক্ষ করছে। ভয়ে আমি গুটিশুটি মেরে শুয়ে রইলাম। সকালে উঠে দেখি চোর সবকিছু চুরি করে নিয়ে গেছে।

জয়ন্ত পরিবেশটা হালকা করার জন্য বলল, তোর যে এরকম অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা আছে। আগে কখনো বলিস নি তো!

আগে কখনো দরকার পড়ে নি।

ঠিক আছে ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখা যাক।

কীভাবে?

কিছুক্ষণ সামনে হেঁটে হঠাৎ করে ঘুরে পেছনদিকে তাকাই দেখি কাউকে দেখা যায় কিনা।

ঠিক আছে।

কথা না বলে তিনজনে বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে গেল এবং হঠাৎ করে পেছনে ঘুরে কয়েক পা ছুটে গেল। ওরা অবাক হয়ে দেখল সত্যি সত্যি কী একটা প্রাণী দুদ্দাড় করে পেছনে ছুটে গিয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

শ্রাবণী ভয়–পাওয়া গলায় বলল, দেখেছিস? দেখেছিস? আমি বলেছি না!

জয়ন্ত খানিকক্ষণ প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা একটা বেজি। নেউল। ইংরেজিতে বলে উইজল।

নেউল? বেজি?

হ্যাঁ।

শ্রাবণী ভুরু কুঁচকে বলল, তুই কেমন করে জানিস?

আমি জানি কারণ আমি বেজি দেখেছি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে একজন মানুষ ছিল। তার একটা পোষা বেজি ছিল।

ও।

অসম্ভব হিংস্র প্রাণী। কিন্তু সাইজটা বেড়ালের মতো। কাজেই আমার মনে হয় তোর ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

এরকম করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে কেন?

মনে হয় আগে কোনো সুন্দরী মেয়ে দেখে নি।

ফাজলেমি করবি না। বাঁশ দিয়ে মাথায় একটা বসিয়ে দেব।

ঠিক আছে ফাজলেমি করব না।

দ্যাখ কীভাবে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে–যেন আমাদের কথা বুঝতে পারছে।

বুঝতে পারছে না। বেজি হচ্ছে বেজি। তাদের মানুষের কথা বোঝার কথা নয়।

তাহলে পালিয়ে যাচ্ছে না কেন?

কৌতূহলে।

এত কৌতূহল কেন?

জয়ন্ত মাথা নেড়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, তুই কি বলতে চাইছিস এই বেজিটা দেখে আমাদের ভয়ে চিৎকার করতে করতে পালিয়ে যাওয়া উচিত?

না, তা বলছি না। শ্রাবণী ইতস্তত করে বলল, কিন্তু এটার ভাবভঙ্গি দেখে ভালো লাগছে না। হয়তো এটা পাগল–হয়তো এটা র‍্যাবিড।

ঠিক আছে আমি এটাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি– বলে জয়ন্ত তার কিরিচ উঠিয়ে বেজিটার দিকে ছুটে গেল। বেজিটা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করল এবং একেবারে শেষ মুহূর্তে পেছনের দুই পায়ের ওপর ভর দিয়ে প্রায় মানুষের মতো দাঁড়িয়ে পেছন দিকে লাফিয়ে একটা ঝোঁপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। জয়ন্ত স্বীকার না করে পারল না, বেজিটা একটু অস্বাভাবিক। এই ধরনের বুনো প্রাণী মানুষকে আরো অনেক বেশি ভয় পায়।

জয়ন্ত শ্রাবন্তীর কাছে এসে বলল, হয়েছে তো? তোর বেজি পালিয়েছে।

শ্রাবন্তী মাথা নাড়ল, কিন্তু কোনো কথা বলল না।

তিনজন আবার হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে নিয়াজ চাপা গলায় বলল, আমার ব্যাপারটা ভালো লাগছে না।

জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, কোন ব্যাপারটা?

নিয়াজ বলতে পারল না। প্রকৃত ব্যাপারটি যদি তারা জানত তাহলে তাদের কারোই ভালো লাগত না। তারা তখনো বুঝতে পারছিল না প্রতি পদক্ষেপেই তারা একটা বিশাল বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।

.

আরো মিনিট দশেক হাঁটার পর হঠাৎ করে গাছপালা হালকা হয়ে তারা ভোলা একটা জায়গায় চলে এল। ঘন অরণ্য থেকে বের হওয়ার কারণেই তাদের ভেতরের চাপা আতঙ্কের ভাবটা একটু কমে এসেছে। তারা চারদিকে ঘুরে তাকাল এবং আবিষ্কার করল প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একটা বাসা। এরকম একটি দ্বীপের জন্যে বাসাটি নিঃসন্দেহে আধুনিক। কিন্তু এতদূর থেকেও তাদের বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না যে বাসাটি দীর্ঘদিন থেকে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। ঝোঁপঝাড়ে ঢেকে আছে জানালা খোলা, দরজা ভাঙা এবং রঙ উঠে বিবর্ণ হয়ে আছে। নিয়াজ বলল, ওটা নিশ্চয়ই পাগলা ডাক্তারের বাসা।

হ্যাঁ। শ্রাবণী মাথা নাড়ল, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই খুব শৌখিন ছিলেন। এরকম একটা নির্জন দ্বীপে কী চমৎকার একটা বাসা তৈরি করেছেন দেখেছিস?

শৌখিন এবং মালদার। জয়ন্ত সলল, এরকম একটা নির্জন দ্বীপে এরকম একটা বাসা তৈরি করতে অনেক মালপানি দরকার।

শ্রাবণী কোনো কথা না বলে দূরে বাসাটির দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ পর বলল, এতদূর যখন এসেছি তখন বাসাটি দেখে যাই।

নিয়াজ ইতস্তত করে বলল, এখনো আরো এতদূর যাবি?

এতদূর কী বলছিস? ঐ তো দেখা যাচ্ছে।

নিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, চল তাহলে, দেরি করিস না।

তিনজনের ছোট দলটা আবার রওনা দিল। একটু আগে সবাই মিলে যেভাবে সাবধানে হাটছিল, খোলামেলা জায়গায় এসে সেই সাবধানতাটুকু অনেক কমে গেল। তাড়াতাড়ি গিয়ে ফিরে আসার জন্যে এবারে নিয়াজ হাঁটছে সামনে–নিয়াজের পিছনে জয়ন্ত এবং সবার পিছনে শ্রাবণী।

হাঁটতে হাঁটতে নিয়াজ সম্ভবত একটু অন্যমনস্ক হয়েছিল, বাংলোর মতো চমৎকার বাসাটির কাছাকাছি চলে এসেছে সেটাও দেখছিল একটু পরে পরে, তাই ঠিক কোথায় পা ফেলছে খেয়াল করে নি। হঠাৎ করে নিয়াজ আবিষ্কার করল, সামনের ঝোঁপঝাড় লতাপাতার আড়ালে মাটি নেই এবং সে একটা গর্তে পড়ে যাচ্ছে। নিজেকে বাচানোর সহজাত প্রবৃত্তিতে সে হাতের কাছে ঝোঁপঝাড় গাছপালা যেটাই পেল সেটাই ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু কোনোটাই তার ওজনকে ধরে রাখার মতো শক্ত নয় এবং সে সবকিছু নিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখন জয়ন্ত আর শ্রাবণী ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলল। নিয়াজ আতঙ্কে চিৎকার করে হাত–পা ছুঁড়তে থাকে এবং আরেকটু হলে সে অন্যদেরকে টেনে নিয়ে গর্তে পড়ে যেত– কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারা নিজেদের সামলে নিল। শ্রাবণী আর জয়ন্ত কোনোমতে নিয়াজকে গর্ত থেকে টেনে তুলল।

ঘটনার আকস্মিকতায় এত হতবাক হয়ে গেছে যে নিয়াজ প্রথমে কোনো কথা বলতে পারল না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, বুবি ট্র্যাপ।

বুবি ট্র্যাপ? জয়ন্ত ভুরু কুঁচকে বলল, এই জঙ্গলে বুবি ট্র্যাপ কে বসাবে?

শ্রাবণী সাবধানে গর্তটার কাছে এগিয়ে গেল। বেশ বড় গোলাকার একটা গভীর গর্ত। গর্তের ওপর লতাপাতা গাছপালা দিয়ে ঢাকা। উপর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে এতবড় একটা গর্ত। শ্রাবণী মাথা নেড়ে বলল, নিয়াজ ঠিকই বলেছে। আসলেই বুবি ট্র্যাপ।

এখানে বুবি ট্র্যাপ কে বসাবে? জয়ন্ত সাবধানে পুরো জায়গাটা দেখে বলল, এই দ্বীপে কোনো মানুষ থাকে না।

হয়তো থাকে।

যদি থাকে তাহলে সে বুবি ট্র্যাপ বানাবে কেন? জয়ন্ত গর্তের উপর লতাপাতা গাছপালাগুলো দেখে বলল, আমার মনে হয় এটা একটা ন্যাচারাল ফেনোমেনন। এমনিতেই একটা বড় গর্তের উপর কিছু ঝোঁপঝাড় গজিয়েছে।

কোনো কারণ ছাড়াই?

কারণ থাকলেও সেটা প্রাকৃতিক কারণ।

জয়ন্তের ব্যাখ্যাটা কারোরই ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না–কিন্তু আপাতত সেটা গ্রহণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। শ্রাবণী খানিকক্ষণ গর্তটা পরীক্ষা করে নিয়াজকে জিজ্ঞেস করল, তুই ব্যথা পাস নি তো?

নিয়াজ মাথা নাড়ল, মনে হয় না। একটু-আধটু ছাল উঠে গেছে।

শ্রাবণী তার ব্যাগ খুলে একটা মলম জাতীয় টিউব বের করে বলল, নে, লাগিয়ে নে। এন্টিসেপটিকের কাজ করবে।

নিয়াজ শুকনো গলায় বলল, পড়ে গেলে কী হত?

কী আর হতদড়ি দিয়ে বেঁধে আমরা টেনে তুলে ফেলতাম।

মনে আছে জব্বার মিয়া বলেছিল গর্তের মাঝে পড়ে গিয়ে মরে গিয়েছিল?

এই গর্তের ভেতর পড়লে কেউ মরে যায় না–বড়জোর হাত–পা ভেঙে যেত। শ্রাবণী আবার গর্তের ভেতরে উঁকি দিয়ে হঠাৎ কী একটা দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে পিছনে সরে গেল।

জয়ন্ত ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী? কী হয়েছে?

ভেতরে তাকিয়ে দ্যাখ।

জয়ন্ত একটু এগিয়ে গিয়ে ভেতরে তাকাল। ভেতরে অন্ধকার, ভালো দেখা যায় না। সরসর করে এক ধরনের শব্দ হচ্ছে। সে রোদ থেকে চোখ আড়াল করে ভেতরে তাকিয়ে শিউরে উঠল, এক মানুষ সমান একটি গর্তের নিচে কিলবিল করছে সাপ। একটি–দুটি সাপ নয়–অসংখ্য সাপ। জয়ন্ত নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে সে নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে।

নিয়াজ অবাক হয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে এল, বলল, কী?

জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, সাপ।

সাপ?

হ্যাঁ।

কী সাপ?

জানি না তাকিয়ে দ্যাখ।

নিয়াজ রোদ থেকে চোখ আড়াল করে নিচে তাকিয়ে হতচকিত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ সে নিশ্বাস নিতে পারে না। তারপর বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোরা যদি আমাকে টেনে তুলতে না পারতি কী হত বুঝতে পারছিস?

জয়ন্ত মাথা নাড়ল।

আমি আর এখানে এক সেকেন্ডও থাকছি না। চল যাই।

জয়ন্ত কোনো কথা না বলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো গর্তের নিচে তাকিয়ে থাকে। নিয়াজ বলল, কী হল? কথা বলছিস না কেন?

স্নেক–পীট। এটা হচ্ছে সাপের গর্ত–এখানে সাপেরা থাকে।

হ্যাঁ। সাপদের বাসা।

কিন্তু_

কিন্তু কী?

গর্তের দেয়ালটা তাকিয়ে দ্যাখ।

কী দেখব?

দেখেছিস দেয়ালটা কত মসৃণ? তার মানে এখান থেকে কোনো সাপ বের হতে পারে না।

শ্রাবণী কয়েক হাত পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তুই কী বলতে চাইছিস?

সাপগুলো যদি এখান থেকে বের হতে না পারে তাহলে ওরা খায় কী?

শ্রাবণী চোখ পাকিয়ে বলল, সাপের লাঞ্চ ডিনার নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা কেন?

না, জয়ন্ত একটু অধৈর্য হয়ে বলল, বুঝতে পারছিস না–দেখে মনে হচ্ছে এখানে কেউ সাপগুলোকে পুষছে?

একটু আগেই তুই-ই না বললি এখানে কোনো মানুষ নাই?

সেই জন্যেই তো বুঝতে পারছি না।

শ্রাবণী মাথা নেড়ে বলল, সাপদের বের হওয়ার জন্যে লিফট লাগে না। তারা গর্ত দিয়ে বের হতে পারে। নিচে গর্ত আছে। আর না থাকলে তারা গর্ত করে নেবে।

জয়ন্ত মাথা নাড়ল, বলল, তা ঠিক। কিন্তু

কিন্তু কী?

দেখে মনে হয়, কেউ যেন খুব যত্ন করে একটা স্নেক–পীট তৈরি করেছে। দ্যাখ একবার তাকিয়ে দ্যাখ।

শ্রাবণী মুখ শক্ত করে বলল, জয়ন্ত, পৃথিবীতে রাজাকারদের পরে আমি যে-জিনিসটা ঘেন্না করি সেটা হচ্ছে সাপ। কাজেই তুই আমাকে সাপ দেখানোর চেষ্টা করবি না।

জয়ন্ত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, তোকে দেখানোর চেষ্টা করব না। কিন্তু এটা একটা ফ্যাসিনেটিং জায়গা।

নিয়াজ বলল, আমার মতো আছাড় খেয়ে ভেতরে তো পড়িস নি তাই মনে হচ্ছে ফ্যাসিনেটিং জায়গা।

ব্যথা তো পাস নি।

ব্যথা না–পেলে কী হবে? ভয় পেয়েছি। ভয়। বুঝলি?

জয়ন্ত নিয়াজের কাঁধে হাত রেখে বলল, আই অ্যাম সরি নিয়াজ। আমি খুব ইনসেনসেটিভ মানুষের মতো ব্যবহার করছি।

ঠিক আছে। এখন সেনসেটিভ মানুষের মতো ব্যবহার কর। এখান থেকে বের হ।

জয়ন্ত পকেট থেকে সিগারেট বের করে মুখে লাগিয়ে সাবধানে ম্যাচ দিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে দূরের বাসাটির দিকে তাকিয়ে বলল, বাসাটার এত কাছে এসে না–দেখে চলে যাব?

নিয়াজ ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, তোর এখনো শখ আছে?

না মানে, এখন তো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। এরকম একটা গর্তে পড়ে গিয়ে মানুষ সাপের কামড় খেয়ে মারা যায়। এর মাঝে কোনো রহস্য নেই–কোনো ভৌতিক ব্যাপার নেই।

তুই কী বলতে চাইছিস?

আমি বলছিলাম কি–এখন যেহেতু কারণটা জেনে গিয়েছি আমাদের তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ঐ বাসাটায় গিয়ে একটু ঘুরে দেখে আসি।

নিয়াজ শ্রাবণীর দিকে তাকাল। শ্রাবণী বলল, জয়ন্তের কথায় একটা যুক্তি অবিশ্যি আছে। এতদূর যখন এসেছি বাসাটা দেখে যাই। দেখি পাগলা ডাক্তারের কোনো রহস্যভেদ করতে পারি কি না।

জয়ন্ত বলল, তুই নিশ্চিত থাক–এবার আখি সামনে সামনে যাব। লাঠি দিয়ে ঠুকে ঠুকে দেখব কোনো গর্ত আছে কি না।

নিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, চল। কিন্তু তোদের বলে রাখছি, বাসাটায় যাব, ঢুকব আর বের হব।

ঠিক আছে।

ওয়ার্ড অব অনার?

জয়ন্ত নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ওয়ার্ড অব অনার।

.

তিন জনের ছোট দলটা বাসার সামনে এসে একধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। জংলী গাছপালায় পুরোটা ঢেকে গিয়েছে কিন্তু তবু বোঝা যায় একসময় এটি নিশ্চয়ই ছবির মতো একটা সুন্দর বাসা ছিল। দোতলা কাঠের বাসা। ওপরে একটি চমৎকার ডেক। এখানে বসে নিশ্চয়ই সমুদ্রের একটা চমৎকার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। বাসাটি ঘিরে যত্ন করে গাছ লাগানো হয়েছিল। সেগুলো পুরো এলাকাটিকে ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে। একসময়ে একটা গেট ছিল। এখন সেখানে কিছু নেই। সুড়কি বিছানো ছোট একটা পথ।

তিন জন হেঁটে হেঁটে বাসাটির বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। জানালাগুলো খোলা। কাচ ভেঙে গিয়ে কেমন যেন অসহায় মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে। জয়ন্ত দরজাটি ধাক্কা দিতেই সেটি ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে জয়ন্ত ধীরে ধীরে ভেতরে ঢোকে। দীর্ঘদিন কেউ না আসায় ঘরের ভেতরে একধরনের ভ্যাপসা গন্ধ। জয়ন্ত সাবধানে চারদিকে তাকিয়ে আরো কয়েক পা ভেতরে ঢুকে হাত দিয়ে অন্য দুজনকে ইঙ্গিত করতেই তারা ভেতরে ঢুকল।

ঘরটি একসময় নিশ্চয়ই সুন্দর করে সাজানো ছিল, এখনো তার কিছু চিহ্ন রয়ে গেছে। তিন জন সাবধানে হেঁটে ঘরটিকে পরীক্ষা করে। একটি শেলফ কাত হয়ে পড়ে আছে। একটা টেবিল–ল্যাম্প একপাশে ভাঙা। একটা সুদৃশ্য চেয়ার। ঘরের দেয়ালে ধূলি–ধূসরিত একটা অয়েল পেইন্টিং–শ্রাবণী কাছে গিয়ে ফুঁ দিতেই খানিকটা জায়গা পরিষ্কার হয়ে উজ্জ্বল রঙ বের হয়ে এল। শ্রাবণী দেয়ালে টাঙানো অন্য ছবিগুলো পরীক্ষা করে দেখল, এলোমেলো। চুলের হাসিখুশি একজন মানুষ একটি বিদেশী মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণী বলল, এটা নিশ্চয়ই পাগলা ডাক্তার।

জয়ন্ত এগিয়ে এসে বলল, তুই কেমন করে বুঝতে পারলি?

দেখছিস না পাশে ফরেনার মেয়ে?

পাশে ফরেনার মেয়ের সাথে পাগলা ডাক্তারের কী সম্পর্ক?

আমাদের দেশের যত সাকসেসফুল মানুষ তাদের সবার বিদেশী বউ।

তোকে বলেছে!

বিশ্বেস কলি না?

আর এই পাগলা ডাক্তার সাকসেসফুল কে বলেছে? সাকসেসফুল মানুষ এরকম জঙ্গলে থাকে? থেকে খুন হয়ে যায়?

শ্রাবণী দার্শনিকের মতো মুখভঙ্গি করে বলল, বেঁচে থাকাটাই যদি জীবনের অর্থ হয়ে থাকে তাহলে কচ্ছপ হচ্ছে সবচেয়ে সাকসেসফুল। কয়েক শ বছর বেঁচে থাকে।

নিয়াজ একটু অধৈর্য হয়ে বলল, অনেক ফিলসফি হয়েছে। এখন চল যাই।

জয়ন্ত বলল, একটু অন্য ঘরগুলো দেয়ে যাই।

কথা ছিল ঢুকব এবং বের হব।

এই তো ঢুকেছি। এখন অন্য ঘরগুলোতে ঢুকে বের হয়ে যাব।

নিয়াজ হতাশ হওয়ার ভঙ্গিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

নিচের সবগুলো ঘরই ধুলায় ধূসর। মাকড়সার জাল এবং পোকামাকড়ে ঢেকে আছে। কিছু ব্যবহারী জিনিস, দেয়ালে আরো কিছু ছবি, কয়েকটা আসবাবপত্র পাওয়া গেল। দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা একটু নড়বড়ে মনে হল। জায়গাটা দিনের বেলাতেই অন্ধকার, তাই মোমবাতি দুটো জ্বালিয়ে নেওয়া হল। তিন জন সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে। জয়ন্ত কয়েক পা উঠে বলল, সিঁড়ি মনে হয় ঘূণ ধরে ক্ষয়ে গেছে। সাবধান।

শ্রাবণী জিজ্ঞেস করল, সাবধানটা কীভাবে হব? ওজন কম করে দেব?

তা বলছি না। নিচে দেখে পা ফেলিস। রেলিংটা শক্ত করে ধরে রাখিস। হঠাৎ করে ভেঙে গেলে যেন আছাড় খেয়ে পড়ে না যাস।

নিয়াজের মতো!

হ্যাঁ, নিয়াজের মতো।

নিয়াজ বিরক্ত হয়ে বলল, ব্যাপারটা ফানি ছিল না। যদি পড়ে যেতাম তাহলে মরে যেতাম।

শ্রাবণী বলল, এবং হকুনদিয়ার নামটি সার্থক হত।

উপরে উঠে একটা দরজা পাওয়া গেল। দরজাটি বন্ধ। জয়ন্ত কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে। বলল, তালা মারা রয়েছে।

আমাদের কাছে চাবি নাই–কাজেই এখন এটি মিশন ইমপসিবল।

জোরে একটা লাথি দিয়ে দেখি, তালা ভাঙতে পারি কি না।

একজনের বাসায় তালা ভেঙে ঢোকা আইনত দণ্ডনীয়।

জয়ন্ত দাঁত বের করে হেসে বলল, কিন্তু যদি সেই বাসাটা হয় হকুনদিয়ার পাগলা ডাক্তারের বাসা এবং সেই বাসায় গত পাঁচ বছর কেউ ঢুকে না থাকে তাহলে সেটা আইনত দণ্ডনীয় নয়। সেটা ভদ্রতা–

বলে জয়ন্ত একটু পিছিয়ে এসে প্রচণ্ড জোরে লাথি দিল। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে মরচে পড়ে তালা নিশ্চয়ই নড়বড় হয়ে ছিল, জয়ন্তের লাথিতে তালা ভেঙে দরজা শব্দ করে ভেতরের দিকে খুলে যায়। শ্রাবণী চোখ বড় বড় করে বলল, তোর পায়ে জোর তো ভালোই আছে। রাত্রিবেলা মানুষের ঘরের দরজা ভেঙে বেড়াস নাকি?

জয়ন্ত বুকে থাবা দিয়ে বলল, হাফ ব্যাক, নাজিরপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন।

নিয়াজ জয়ন্তকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে একটা বিস্ময়সূচক শব্দ করল, বলল, কী আশ্চর্য!

জয়ন্ত এবং শ্রাবণী ভেতরে ঢুকে নিয়াজের মতোই চমকৃত হয়ে যায়। ভেতরে অত্যন্ত চমৎকার আধুনিক একটি ল্যাবরেটরি। চমৎকার শ্বেতপাথরের টেবিল। দামি মাইক্রোস্কোপ। উপরে তাকে কাচের শেলফ। টেবিলের পাশে ছোট ফ্রিজ, হিটার সেন্ট্রিফিউজ। পাশে শেলফে সারি সারি বই খাতা, নোট বই।

শ্রাবণী অবাক হয়ে বলল, এই ল্যাবরেটরিটা দেখি একেবারে চকচক করছে।

দরজা জানালা সব বন্ধ ছিল বলে নষ্ট হয়নি।

কী সুন্দ ল্যাবরেটরি দেখেছিস? নিয়াজ মুগ্ধ হয়ে চারদিকে তাকিয়ে বলল, এরকম একটা জঙ্গুলে জায়গায় কেউ এরকম ল্যাবরেটরি তৈরি করতে পারে?

নিয়াজ হাতের মোমবাতিটা নিয়ে শেলফের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা বই টেনে নেয়। ধুলা ঝেড়ে বইটা দেখে বলল, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙের বই।

তার মানে পাগলা ডাক্তার একজন জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার ছিল?

নিয়াজ বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় হাতে–লেখা নামটি পড়ে বলল, পাগলা ডাক্তারের ভালো নাম মাজেদ খান। ড. মাজেদ খান।

এরকম সুন্দর একটা নাম থাকার পরও তাকে সবাই পাগলা ডাক্তার ডাকে কেন?

আমাকে জিজ্ঞেস করিস না। আমি এই নাম দিই নি। নিয়াজ শেলফ থেকে আরো কয়েকটা বই নামিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। নিয়াজ পড়াশোনা সংক্রান্ত ব্যাপারে খুব উৎসাহী। কোনো বই পেলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে না–দেখে নামিয়ে রাখে না। যদিও একটু আগে সে চলে যাবার জন্যে অধৈর্য হয়ে উঠেছিল কিন্তু হঠাৎ করে বই এবং কাগজপত্র দেখে সে খুব উৎসাহী হয়ে ওঠে। মোমবাতিটা টেবিলে বসিয়ে সে কাগজপত্র বের করে দেখতে থাকে। জয়ন্ত একটা মাইক্রোস্কোপের ধুলা ঝেড়ে চোখ লাগিয়ে দেখার চেষ্টা করে। শ্রাবণী একধরনের বিস্ময় নিয়ে ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এরকম একটি নির্জন দ্বীপে একজন মানুষ এরকম চমৎকার একটি ল্যাবরেটরি দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারে।

নিয়াজ বই এবং কাগজপত্র ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ করে বলল, এই দ্যাখ! কী পেয়েছি।

কী? জয়ন্ত মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ তুলে নিয়াজের দিকে তাকাল।

ডায়েরি।

ডায়েরি? শ্রাবণী নিয়াজের কাছে এগিয়ে এল।

হ্যাঁ। পার্সোনাল ডায়েরি। নিয়াজ পৃষ্ঠাগুলো উল্টাতে থাকে এবং হঠাৎ করে সেখান থেকে ভাজ–করা একটা কাগজ নিচে পড়ল। শ্রাবণী কাগজটা তুলে নিয়ে ভাজ খুলে তাকায়, ভেতরে টানা হাতে কিছু একটা লেখা। শ্রাবণী কৌতূহলী হয়ে মোমবাতির আলোতে পড়ার চেষ্টা করল। মানুষটির হাতের লেখা সুন্দর হলেও পড়তে কষ্ট হয়।

সম্ভবত লিখেছে খুব তাড়াহুড়ো করে। সেজন্যে পড়তে শ্রাবণীর সময় লাগল। পড়ে হঠাৎ করে শ্রাবণীর রু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। সে কাঁপা গলায় বলল, কী লেখা এখানে?

নিয়াজ মুখ তুলে তাকাল, বলল, কী লেখা?

শ্রাবণী ভয়-পাওয়া গলায় বলল, পড়ে দ্যাখ।

নিয়াজ কাগজটি হাতে নিয়ে মোমবাতির আলোতে পড়ার চেষ্টা করে। সেখানে লেখা, এ আমি কী করেছি! একজন একজন করে সবাইকে খুন করেছে এখন কি আমার পালা? কেউ যদি ভুল করে এই দ্বীপে চলে আসে তার কী হবে?

ওরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, কী লিখেছে এখানে? কে খুন করেছে? কাকে খুন করেছে?

নিয়াজ ডায়েরিটার পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে। পেছন থেকে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে। তারপর কিছু পৃষ্ঠা আগে চলে আসে। হঠাৎ করে সে মুখ তুলে তাকায়। মোমবাতির আলোতে দেখায় তার মুখ ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে আছে। শ্রাবণী ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী লেখা আছে ডায়েরিতে?

বেজি!

বেজি? কী হয়েছে বেজির?

এই বেজিগুলো সাধারণ বেজি সয়। মাজেদ খান জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে ওদের মাঝে বুদ্ধিমত্তার একটা জিন্স ঢুকিয়ে দিয়েছে।

কী বলছিস তুই!

হ্যাঁ। এই দ্যাখ। নিয়াজ ডায়েরির পৃষ্ঠা খুলে পড়ে শোনাল, সুইডেনের ক্ৰান্স ল্যাবরেটরিতে প্রফেসর সোয়ন্সন যে এক্সপেরিমেন্টটি করেছেন আমি আজকে সেটি করেছি। বেজির যে ক্লোনটি তৈরি করেছি তার তিন নম্বর ক্রমোজমে বুদ্ধিমত্তার জিন্সটিতে মানুষের বুদ্ধিমত্তার জিন্সটি বসিয়ে দিয়েছি। জানি না এই ভ্রূণটা ঠিকভাবে বড় হবে কি না–যদি বড় হয় তাহলে প্রথম একটা স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাঝে মানুষের এরকম একটা জিন্স ঢুকিয়ে দেওয়া হল।

নিয়াজ মুখ তুলে তাকাল। কাঁপা গলায় বলল, তার মানে বুঝতে পারছিস? মাজেদ খান এখানে কিছু বেজি তৈরি করেছে যেগুলোর বুদ্ধিমত্তা মানুষের মতো–

জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, কী বলছিস পাগলের মতো?

আমি পাগলের মতো বলছি না, এই দ্যাখ মাজেদ খান কী লিখেছে। নিয়াজ ডায়েরির আরো কিছু পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পড়তে থাকে। বেজিটির বুদ্ধিমত্তা অন্য বেজি থেকে বেশি কি না সেটা আজকে প্রমাণিত হয়ে গেল। বেজিটি খাঁচা থেকে পালিয়ে গেছে। এই খাঁচা থেকে কোনোভাবে বেজিটির পালিয়ে যাবার কথা নয়। কারণ বুদ্ধিমত্তাহীন কোনো প্রাণী এই খাঁচার ছিটকিনি খুলতে পারবে না। শুধুমাত্র অত্যন্ত উন্নত শ্রেণীর বুদ্ধিমত্তা আছে এরকম একটা প্রাণীই ছিটকিনি খুলে বের হয়ে যেতে পারে। কাজটি খুব ভুল হয়ে গেল। সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রাণী ছাড়া পেয়ে গেল। এখন এটি যদি তার বাচ্চাদের মাঝে এই বুদ্ধিমত্তার জিন্স ছড়িয়ে দেয়? তারা যদি নতুন বাচ্চার জন্ম দেয়? এই পুরো দ্বীপটি যদি বুদ্ধিমান বেজি দিয়ে ভরে ওঠে?

শ্রাবণী ভয়-পাওয়া গলায় বলল, তার মানে আমাদের পিছু–পিছু যে বেজিটা আসছিল সেটা মানুষের মতো বুদ্ধিমান?

কেউ শ্রাবণীর কথার উত্তর দিল না। নিয়াজ ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, এই দ্যাখ কী লেখা–আমি এই দ্বীপের সব বেজিগুলো মারার চেষ্টা করেছি। গুলি করে মারার চেষ্টা করেছি। বিষাক্ত খাবার দিয়ে মারার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেই বুদ্ধিমান বেজিকে মনে হয় মারতে পারি নি। আজকে প্রথম কিছু বেজির বাচ্চাকে পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে ছুটে যেতে দেখলাম। তাহলে কি বুদ্ধিমান নতুন বেজির বাচ্চার জন্ম হয়েছে? সর্বনাশ। এখন কী হবে? আমি বেজিগুলোকে মারার চেষ্টা করেছি বলে আমাকে শক্ত হিসেবে ধরে নিয়েছে। এই বেজিগুলো কি এখন থেকে আমাকে কিংবা সব মানুষকেই শত্রু হিসেবে বিবেচনা করবে?

মোমবাতির আলোতে সবাই চুপ করে বসে থাকে। কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। নিয়াজ ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ করে থেমে গিয়ে আবার পড়তে শুরু করল, বেজিদের একটি বুদ্ধিমান প্রজন্মের জন্ম হলে তারা কী করবে? সবার আগে নিজেদের খাবার সগ্রহের ব্যাপারটি নিশ্চিত করবে। আজকে আমি তাই আবিষ্কার করেছি। তারা একটি বড় গর্ত করে সেখানে সাপদের এনে জড়ো করেছে। আমি জানতাম না সাপ তাদের এত প্রিয় খাবার। সাপগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে ইঁদুর ধরে এনে গর্তের মাঝে ছেড়ে দিচ্ছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার!

নিয়াজ মুখ তুলে তাকিয়ে বলল, এখন বুঝতে পারছিস আমি যেই গর্তটাতে পড়তে যাচ্ছিলাম সেটা কোথা থেকে এসেছে?

হ্যাঁ। বুঝতে পেরেছি।

শ্রাবণী ভয়-পাওয়া গলায় বলল, এখন কী হবে?

জয়ন্ত অনিশ্চিতের মতো মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি না। সে ধীরে ধীরে দরজার কাছে হেঁটে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ভেতর থেকে ছিটকিনি আটকে দিল। অন্য দুজন একধরনের আতঙ্ক নিয়ে জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে ছিটকিনি আটকে দিয়ে তারা প্রথমবার স্বীকার করে নিল এখানে তারা একটা ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি এসে পড়েছে।

নিয়াজ ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ করে থেমে গিয়ে আবার পড়তে শুরু করল, বুদ্ধিহীন প্রাণী চলে সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে কিন্তু বুদ্ধিমান প্রাণী নতুন জিনিস শিখতে পারে। এই বেজিগুলো বুদ্ধিমান। তারা প্রতিদিন নতুন জিনিস শিখছে। আজকে আবিষ্কার করলাম, বেজিগুলো আমার পোষা কুকুরটিকে মেরে ফেলেছে। রাত্রিবেলা কুকুরটার চিৎকার শুনে আমি বন্দুক নিয়ে ছুটে বের হয়ে গেছি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বেজিগুলো জানে–একটা প্রাণীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তার দৃষ্টি। কাজেই সবার আগে সেগুলো কুকুরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার চোখ দুটো খুবলে তুলে নিয়েছে। তার পরের অংশটি সহজ। বেজিগুলো ধারালো দাঁত দিয়ে কুকুরের ঘাড়ের বড় আর্টারিটা ছিন্ন করে দিয়েছে। কী নৃংশস! বেজিগুলো তাদের থেকে অনেক বড় প্রাণীকে হত্যা করতে শিখে গেছে এখন কি আমাদের হত্যা করবে?

আমার ল্যাবরেটরি এসিস্টেন্ট খুব ভয় পেয়েছে। ভয় পাওয়ারই কথা।

নিয়াজ ডায়েরি থেকে মুখ তুলে বলল, মনে আছে জব্বার মিয়া কী বলেছিল?

কী বলেছিল?

চোখ দুটো সাবধান।

হ্যাঁ। মনে আছে—

এখন বুঝেছিস তো কেন?

কেউ কোনো কথা না বলে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে রইল। নিয়াজ ডায়েরির পৃষ্ঠা উন্টাতে উল্টাতে হঠাৎ করে থেমে যায়। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে আবার পড়তে শুরু করল, আজকে আমার ল্যাবরেটরি এসিস্টেন্ট খুন হয়ে গেল। মৃতদেহটি বাসার সামনে পড়ে ছিল। চোখ দুটো খুবলে নিয়ে ঘাড়ের বড় আর্টারিগুলো ধারালো দাঁত দিয়ে কেটে নিয়েছে। কাজটি করেছে প্রায় নিঃশব্দে। আমি রাতে কোনো শব্দও শুনতে পারি নি। তাকে আমি ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু সে আমার কথা না–শুনে ঘর থেকে বের হয়েছিল। কেন বের হল? আমার ধারণা বেজিগুলো কোনো একটা বুদ্ধি করে তাকে বের করে নিয়েছে। এখন এই দ্বীপে আমি একা। আমার ধারণা বাইরে থেকে কোনো সাহায্য না পেলে আমার অবস্থাও আমার ল্যাবরেটরি এসিস্টেস্টের মতো হবে।

নিয়াজ আবার মুখ তুলে তাকাল। জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, ডায়েরি কি এখানেই শেষ?

না। আরো কয়েক পৃষ্ঠা আছে।

কী লেখা আছে এখানে?

নিয়াজ পড়তে শুরু করে, বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রথম প্রচেষ্টাই হল তার বুদ্ধিমত্তাকে ছড়িয়ে দেওয়া। কাজেই এই বেজিগুলো যে সেরকম চেষ্টা করবে সে–ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। এই দ্বীপের যেদিকেই তাকাই সেদিকেই আমি বেজিগুলোকে দেখতে পাই। নিষ্পলক দৃষ্টিতে দূর থেকে আমাকে লক্ষ করে। দৃষ্টিগুলো দেখে আমার বুক কেঁপে ওঠে। আমি আজকাল ঘর থেকে বের হই না। মাথার কাছে লোডেড বন্দুকটা রাখি। কিন্তু কেন। জানি মনে হয়, এই বন্দুক আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। আমার মনে হয়, এটি খুব বড় সৌভাগ্য যে বেজিগুলো এই দ্বীপের মাঝে আটকা পড়ে আছে। এখান থেকে অন্য দ্বীপে কিংবা দেশের মূল ভূখণ্ডে যেতে পারছে না। যদি একবার চলে যায় তখন কী হবে! ভেবেই আমার বুক কেঁপে ওঠে।

আমি কদিন থেকেই ভেবে বের করার চেষ্টা করছি একটি প্রাণী যদি হঠাৎ করে বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে তার ফল কী হতে পারে। মানুষ ক্রমবিবর্তনে ধীরে ধীরে বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই বেজিগুলোর ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এরা বিবর্তনে বুদ্ধিমান হয় নি। এরা। বুদ্ধিমান হয়েছে আমার একটা ভুলের জন্যে। আমি অগ্র–পশ্চাৎ বিবেচনা না করে এই এক্সপেরিমেন্টটি করে ফেলেছি এবং বেজিটি আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে। পৃথিবীর মানুষ আমাকে যেন ক্ষমা করে।

আমার মনে হয় প্রাণীটা বুদ্ধিমান হবার পর নিশ্চয়ই তারা ভাব বিনিময় করার জন্যে নিজেদের একটা ভাষা আবিষ্কার করেছে। ডেকের ওপর বসে আমি বাইনোকুলার দিয়ে চারপাশের বেজিগুলোকে দেখি। মনে হয় এগুলো এখন নিজেদের মাঝে কথা বলছে। মনে হচ্ছে বেজিগুলোর নিজস্ব কোনো ভাষা আছে। শুধু–যে ভাষা আছে তা নয় মনে হয় সামনের পা দুটোকে হাত হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। আজকাল আমাকে খুব সাবধান থাকতে হয়–মনে হয় বেজিগুলো ঘরের ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকে যেতে পারে।

যে–জিনিসটি এখনো বেজিগুলো শিখে নি সেটা হচ্ছে আগুনের ব্যবহার। তাহলে কি এই আগুন দিয়েই কোনোভাবে এদের ধ্বংস করতে হবে? আমি জানি না।

আমার কী হবে আমি জানি না। আমি যে ভুল করেছি সেজন্যে ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন।

নিয়াজ ডায়েরিটা বন্ধ করে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ডায়েরিটা এখানেই শেষ।

কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। মোমবাতির আলোটি স্থির হয়ে ছিল, মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে, দেয়ালে তাদের বড় ছায়া পড়েছে। শ্রাবণী কাঁপা গলায় বলল, এখন কী হবে?

মাজেদ খানের একটা বন্দুক ছিল, সে পুরো ব্যাপারটা জানত তারপরও নিজেকে বাঁচাতে পারে নাই। আমরা কেমন করে বাঁচব? নিয়াজ সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের কোনো আশা নেই।

সব আমার দোষ। জয়ন্ত মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমি যদি তোদের জোর করে নিয়ে আসতাম–

ওসব বলে লাভ নেই। আমরা কেউ বাচ্চা শিশু না, কেউ কাউকে জোর করে আনতে পারে না।

তবুও–আমি যদি–

ওসব কথা বলে লাভ নেই। শ্রাবণী মাথা নেড়ে বলল, এখন কী করা যায় সেটা বল।

এমন কি হতে পারে যে আমরা শুধু-শুধু জয় পাচ্ছি?

মানে?

এই যে বুদ্ধিমান বেজির ব্যাপারটা– আসলে এটা খানিকটা বাড়াবাড়ি। আসলে সেরকম কিছু নেই। একটা বেজি আর কত বিপজ্জনক হবে? এইটুকু একটা জন্তু–

নিয়াজ এবং শ্রাবণী নিঃশব্দে জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে রইল। জয়ন্ত বলল, আগেই কেন ভয়ে কাবু হয়ে থাকব। ব্যাপারটা দেখা যাক। এই ডায়েরিটা পাঁচ বছর আগে লেখা, পাঁচ বছরে কত কী হতে পারে।

উল্টোটাও হতে পারে। নিয়াজ বলল, পাঁচ বছর আগে এটা যত ভয়ঙ্কর ছিল এখন হয়তো আরো অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে।

হ্যাঁ। উল্টোটা হতে পারে কিন্তু আগেই সেটা ধরে নেব কেন? এই যে আমরা তিন জন হেঁটে হেঁটে এসেছি, আমাদের কিছু হয়েছে? সত্যিই যদি ভয়ঙ্কর বেজি আক্রমণ করে মানুষকে মেরে ফেলতে পারত–তাহলে আমাদের মারল না কেন?

তা ঠিক। নিয়াজ মাথা নেড়ে বলল, তাহলে তুই কী করতে চাস?

প্রথমে এখান থেকে বের হয়ে বাসাটা দেখি। কী হচ্ছে না হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করি। এখন মনে হচ্ছে জব্বার মিয়ার বন্দুকটা নিয়ে এলে খারাপ হত না।

মাজেদ খানের একটা বন্দুক ছিল, সেটা খুঁজে দেখলে হয়।

শ্রাবণী ভুরু কুঁচকে বলল, তুই কখনো বন্দুক দিয়ে গুলি করেছিস?

না। কিন্তু সেটা আর কত কঠিন হবে?

একটা নাকি ধাক্কা লাগে বেকায়দা ধাক্কা লেগে নাকি মানুষ উন্টে পড়ে।

ধুর। বাজে কথা। পুঁচকে পুঁচকে সন্ত্রাসীরা বন্দুক দিয়ে কাটা রাইফেল দিয়ে গুলি করছে না?

তুই তো আর সন্ত্রাসী না। সন্ত্রাসী হলে তো আর চিন্তা ছিল না।

যাই হোক নিয়াজ বলল, এখন আর সেটা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। আমাদের কাছে বন্দুক নাই, আছে বাঁশের লাঠি, সেটা হাতে নিয়ে বের হতে হবে।

হ্যাঁ। জয়ন্ত লাঠিটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

সাবধানে দরজা খুলে তারা ল্যাবরেটরি–ঘর থেকে বের হয়। একটা ছোট করিডর ধরে হাঁটতে থাকে। পাশাপাশি কয়কটা ঘর, একটা সম্ভবত স্টোর রুম, একটা লাইব্রেরি, আরেকটা ছোট বিশ্রাম করার ঘর। করিডরের একপাশে দরজা, দরজা খুলে সম্ভবত বারান্দায়। যাওয়া যায়। দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করে জয়ন্ত দরজা খুলে বের হয়ে এল। ভেতরে অন্ধকার থেকে হঠাৎ করে প্রখর আলোতে এসে তাদের সবার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মোমবাতিগুলো ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে তারা বারান্দায় রেলিঙের কাছে এগিয়ে যায় ভালো করে দেখার জন্যে তাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। উজ্জ্বল আলোতে চোখ সয়ে যাবার পর তারা আবিষ্কার করল এই বারান্দাটি থেকে একপাশে সমুদ্রের চমৎকার একটি দৃশ্য দেখা যায়, অন্যপাশে দ্বীপের গাছগাছালি। তাদের মনের ভেতরে বেজি নিয়ে ভয়ঙ্কর দুর্ভাবনাটি না থাকলে নিঃসন্দেহে এখানে দাঁড়িয়ে তারা দৃশ্যটি উপভোগ করত। তারপরও তারা সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। শ্রাবণী হেঁটে বারান্দার অন্যপাশে এসে বনের দিকে তাকিয়ে থাকে। বড় বড় গাছ, গাছের নিচে ঝোঁপঝাড়। গাছপালা ঝোপঝাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শ্রাবণী একধরনের অস্বস্তি বোধ করে, অস্বস্তিটি ঠিক কেন বোধ করছে সে ধরতে পারে না তার শুধু মনে হয় ওখানে কিছু একটা জিনিস ঠিক নেই। শ্রাবণী রেলিঙে ঝুঁকে পড়ে আরো তীক্ষ্ণচোখে তাকাল, হঠাৎ করে মনে হল গাছের নিচে ঝোঁপের আড়ালে কিছু-একটা যেন নড়ে উঠেছে। শ্রাবণী তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে হঠাৎ ভয়ানকভাবে চমকে ওঠে। বাসাটি ঘিরে গাছপালাগুলোর নিচে যতদূর চোখ যায় অসংখ্য বেজি নিশ্চল হয়ে বসে আছে। এতদূর থেকে বোঝা যায় না কিন্তু তাদের ছোট ছোট কুতকুতে চোখ তাদের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে নিবদ্ধ হয়ে আছে। শ্রাবণী আতঙ্কে একটা আর্ত চিৎকার করে উঠল এবং সেই চিৎকার শুনে নিশ্চল বেজিগুলো একসাথে পেছনের দুই পায়ের ওপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

জয়ন্ত কাঁপা গলায় বলল, কী হয়েছে?

শ্রাবণী হাত তুলে দেখাল, ঐ দ্যাখ।

জয়ন্ত এবং নিয়াজ তাকিয়ে দেখে বাসাটি ঘিরে কয়েক হাজার বেজি পেছনের পায়ের ওপর ভর দিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে স্থিরচোখে তাদের তিন জনের দিকে তাকিয়ে আছে।

.

আমরা যখন হেঁটে আসছিলাম–এই কয়েক হাজার বেজি ইচ্ছে করলে আমাদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারত। শ্রাবণী বলল, কেন করে নি কে জানে।

জয়ন্ত কিংবা নিয়াজ কোনো কথা বলল না।

একটি দুটি খ্যাপা জন্তু-জানোয়ার থেকে রক্ষা পাওয়া যায় কিন্তু এরকম কয়েক হাজার থেকে রক্ষা পাবে কেমন করে?

নিয়াজ একটু নড়েচড়ে বলল, জব্বার মিয়া। আমাদের একমাত্র ভরসা জব্বার মিয়া।

শ্রাবণী বলল, কীভাবে?

জব্বার মিয়া এসে যখন দেখবে আমরা নেই–তখন আমাদের খোঁজ নেওয়ার একটা ব্যবস্থা করবে না?

সেটা কখন করবে? ততক্ষণ আমরা কী করব?

ততক্ষণ যেভাবেই হোক আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।

জয়ন্ত এতক্ষণ চুপচাপ ওদের কথা ছিল। এবারে সোজা হয়ে বসে বলল, দ্যাখ– আমরা মনে হয় ব্যাপারটাকে একটু বেশি মেলোড্রামাটিক করে ফেলছি। বাইরে যে–প্রাণীটা দুই পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে সেই প্রাণীটা কী? প্রাণীটা হচ্ছে বেজি। একটা বেজির ভয়ে আমরা আঁকুপাকু করব সেটা ঠিক হচ্ছে না

শ্রাবণী বাধা দিয়ে বলল, একটা নয়–কয়েক হাজার

জয়ন্ত প্রায় নাটকের ভঙ্গিতে পা দিয়ে শব্দ করে বলল, কয়েক হাজার হোক আর কয়েক লক্ষ হোক তাতে কিছু আসে যায় না। বেজি হচ্ছে বেজি। আমি এই লাঠি দিয়ে পিটিয়ে এদের বারোটা বাজিয়ে দেব।

অনেকক্ষণ পর প্রথমবার শ্রাবণীর মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, শুনে খুশি হলাম। এই পিটানোর কাজটা কখন শুরু করবি? এখনই বের হবি লাঠি হাতে?

জয়ন্ত একটু ক্রুদ্ধচোখে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুই ঠাট্টা করছিস? এটা ঠাট্টার সময়?

শ্রাবণী বলল, আই অ্যাম সরি। তুই ঠিকই বুলেছিস–এটা ঠাট্টার সময় নয়–কিন্তু তুই একটা লাঠি নিয়ে ইয়া-আলী বলে লাফঝাঁপ দিয়ে বেজি মারছিস, দৃশ্যটা কল্পনা করে কেমন জানি হাসি পেয়ে গেল।

জয়ন্ত কোনো কথা না বলে একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি বিশ্বাস করতে পারি একজন মানুষ এরকম সময় ঠাট্টা করতে পারে।

নিয়াজ বলল, এটা দোষের ব্যাপার না, এরকম একটা সময়ে যে ঠাট্টা করতে পারে বুঝতে হবে তার মাথা ঠাণ্ডা–বিপদের সময় সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

জয়ন্ত কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তা ঠিক।

কাজেই এখন ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা ভেবে দেখা যাক। নিয়াজ শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুই শুরু কর।

আমি? আমি কেন?

এক্ষুনি না প্রমাণ করে দিলাম যে তোর মাথা সবচেয়ে ঠাণ্ডা।

আমার মাথা ঠাণ্ডা না। কখনো ছিল না। তোর প্রমাণে গোলমাল আছে।

ঠিক আছে, জয়ন্ত তাহলে তুই বল।

জয়ন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, প্রথমে উপরতলাটা সিকিউর করতে হবে যেন। ঐ বদমাইশ বেজিগুলো উপরে আসতে না পারে।

সেটা কীভাবে করবি?

নিচের দরজা উপরের দরজা সবকিছু বন্ধ রেখে।

তারপর?

তারপর এই পুরো বাসাটি খুঁজে দেখতে হবে কী কী জিনিসপত্র আছে। সেই জিনিসপত্র দিয়ে একটা নতুন প্ল্যান করতে হবে।

ভেরি গুড।

বন্দুকটা খুঁজে পেলে খারাপ হয় না।

যদি না পাই?

তাহলে আপাতত আমাদের হাতে একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে এই ম্যাচটা। জয়ন্ত পকেট থেকে ম্যাচটা বের করে বলল, যদি সিগারেট না খেতাম তাহলে এই ম্যাচটাও থাকত না।

তাহলে আপাতত পরিকল্পনা হচ্ছে এই বাসাটাকে দুর্গের মতো ব্যবহার করে থাকা?

জয়ন্ত শ্রাবণীর দিকে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

খাওয়াদাওয়া?

তুই যদি কিছু না এনে থাকিস তাহলে বন্ধ।

আমি কোত্থেকে আনব? ব্যাগ হাতড়ে কয়েক টুকরো চকলেট বের করে বলল, এই হচ্ছে একমাত্র ফুড সাপ্লাই।

নিয়াজ বলল, আমরা নিশ্চয়ই এখানে মাসখানেক থাকার পরিকল্পনা করছি না–বড় জোর আজকের দিনটা।

তা ঠিক। জয়ন্ত দুর্বলভাবে হেসে বলল, কিন্তু খাওয়ার কথা বলতেই কেমন জানি খিদে পেয়ে গেল!

নিয়াজ হাসার চেষ্টা করে বলল, শুধু শুধু খাওয়ার কথা চিন্তা না করে কাজে লেগে যাওয়া যাক।

হ্যাঁ। জয়ন্ত বলল, একজনকে সবসময় থাকতে হবে বারান্দার কাছাকাছি। বেজির গুষ্টি কোনো বদমাইশি করার চেষ্টা করলেই অন্যদের জানিয়ে দেবে।

শ্রাবণী বলল, আমি বসে বসে এই বেজির বাচ্চাগুলো দেখতে পারব না। তোরা কেউ দ্যাখ।

জয়ন্ত বলল, ঠিক আছে, আমি এখছি। তোরা এই ল্যাবরেটরি, স্টোর রুম, রেস্ট এরিয়া খুঁজে দেখ কী কী পাওয়া যায়

কোনো বিশেষ কিছু খুঁজব নাকি?

একটা মেশিনগান হলে মন্দ হয় না!

জয়ন্তের কথা শুনে দুজনেই শব্দ করে হাসল এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারল দীর্ঘ সময় পর এই প্রথমবার তারা হাসছে। আনন্দহীন হাসি–কিন্তু তবুও হাসি।

ল্যাবরেটরিতে বেশকিছু প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া গেল–যেমন বেশ কিছু সলভেন্ট, এগুলো দিয়ে এই মুহূর্তে কোনোকিছু পরিষ্কার করার প্রয়োজন নেই কিন্তু বিশাল একটা আগুন জ্বালানোর জন্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। বড় বড় কয়েকটা কাচের বোতলে কিছু এসিড এবং ক্ষার পাওয়া গেল। ড্রয়ারে প্রচুর সিরিঞ্জ রয়েছে। সিরিঞ্জের ভেতরে এই এসিড। কিংবা ক্ষার ভরে কিছু ভয়ানক অস্ত্র তৈরি করা যেতে পারে। এছাড়াও ধারালো ব্লেড এবং চাকু রয়েছে। রবারের গ্লাভস রয়েছে প্রচুর। যদিও দীর্ঘদিন পড়ে থাকার কারণে খানিকটা আঠা আঠা হয়ে আছে। ওরা সবচেয়ে খুশি হল চোখের ওপর পরার জন্যে প্রাস্টিকের গগলস পেয়ে–পাজি বেজিগুলো যদি চোখের ওপর হামলা চালাতেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে তাহলে এগুলো কাজে লাগবে।

ল্যাবরেটরির ড্রয়ারে তারা একটা বাইনোকুলার পেয়েই সেটা সাথে সাথে জয়ন্তকে দিয়ে এল–বেজিগুলোর কাজকর্ম এখন খুব ভালোভাবে দেখা যাবে।

স্টোররুমে অনেক ধরনের ব্যবহারী জিনিস পাওয়া গেল। মোমবাতি দুটি শেষ হয়ে

আসছিল, সৌভাগ্যক্রমে সেখানে কয়েক বাক্স মোমবাতি পাওয়া গেল। নাইলনের দড়ি, স্কু ড্রাইভার, করাত–হাতুড়ি এ–ধরনের বেশকিছু প্রয়োজনীয় জিনিসও ছিল। বেশকিছু ব্যাটারি ছিল কিন্তু সেগুলো কোনো কাজে আসবে না–নষ্ট হয়ে ভেতর থেকে আঠালো কেমিক্যাল বের হয়ে আসছে।

তবে সবচেয়ে দরকারি জিনিসটা তারা পেয়ে গেল বিশ্রাম নেবার ঘরে। সোফার কুশনের নিচে লুকিয়ে রাখা একটা দোনলা বন্দুক এবং ড্রয়ারের ভেতরে বন্দুকের গুলি। বন্দুকটা হাতে নিয়ে নিয়াজের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, যুদ্ধবাজ জেনারেলের মতো বন্দুকটা উপরে তুলে বলল, এবারে দেখে নেব বেজির বাচ্চা বেজিদের।

শ্রাবণী বলল, এভাবে কথা বলিস না–তোকে ঠিক সন্ত্রাসীর মতো দেখাচ্ছে।

নিয়াজ মাথা নেড়ে বলল, বন্দুক জিনিসটা নিশ্চয়ই খারাপ। হাতে নিলেই নিজের ভেতরে কেমন জানি মাস্তান–মাস্তান ভাব এসে যায়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, হাতে নিয়ে দ্যাখ।

শ্রাবণী হাতে নিয়ে বলল, কোথায়? আমার তো হাতে নিয়ে নিজেকে কীরকম জানি বেকুব–বেকুব লাগছে!

নিয়াজ বলল, সেটাই ভালো। আসলে বেকুব–বেকুবই লাগার কথা।

আয় জয়ন্তকে সুসংবাদটা দিই–এখন আমদের একটা অস্ত্র আছে। মেশিনগান না হলেও বন্দুক তো বটেই!

জয়ন্ত বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে বারান্দায় গুড়ি মেরে বসে ছিল, পায়ের শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকিয়ে নিয়াজ আর শ্রাবণীকে বন্দুক হাতে আসতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বন্দুক! কোথায় পেলি?

সোফার কুশনের নিচে লুকানো ছিল। শ্রাবণী বলল, বন্দুকটা হাতে নেওয়ার পর থেকে নিয়াজ মাস্তান–মাস্তান ব্যবহার করছে!

জয়ন্ত বাইনোকুলারটা শ্রাবণীর কাছে দিয়ে বন্দুকটা হাতে নিয়ে চাপ দিয়ে সেটা খুলে ব্যারেলের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে বলল, ময়লা হয়ে আছে পরিষ্কার করতে হবে।

শ্রাবণী অবাক হয়ে বলল, তুই বন্দুক চালাতে পারিস?

আমার এক মামা পাখি শিকার করতেন, তার সাথে মাঝে মাঝে যেতাম।

পাখি শিকার! শ্রাবণী চোখ কপালে তুলে বলল, ইশ! কী নিষ্ঠুর।

তুই কি চিকেন খাস না?

খাই। কেন?

চিকেন একধরনের পাখি। সেটা জ্যান্ত খাওয়া হয় না। মেরে কেটেকুটে খাওয়া হয়– সেটা নিষ্ঠুর না?

নিয়াজ বাইনোকুলারটা নিয়ে বেজিগুলোকে দেখার চেষ্টা করছিল। জয়ন্ত বলল, দেখেছিস? মোষ্ট ফেসিনেটিং।

শ্রাবণী জিজ্ঞেস করল, কী জিনিস মোস্ট ফেসিনেটিং?

এই বেজিগুলো। মনে হচ্ছে এদের মাঝে একটা সমাজব্যবস্থা তৈরি হয়েছে।

এতে অবাক হবার কী আছে? প্রায় জন্তুদেরই তো সমাজব্যবস্থা থাকে। জংলী কুকুর, হায়না, হাতি

না, না, সেরকম না। এখানে মনে হচ্ছে এদের দায়িত্ব ভাগ করা আছে। কেউ কেউ শ্রমিক–কেউ কেউ

আঁতেল?

জয়ন্ত শব্দ করে হেসে বলল, হ্যাঁ অনেকটা সেরকম। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আর ডিসকভারি চ্যানেলে সব সময়ে দেখেছি জন্তু–জানোয়ারে সবেচেয়ে যেটা বেশি শক্তিশালী সেটাই হচ্ছে নেতা। কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে অন্য ব্যাপার।

কী ব্যাপার?

কড়ই গাছের নিচে শুকনো হাড় জিরজিরে একটা বেজি বসে আছে আর অনেকগুলো ধুমসো মোটা বেজি সেটাকে পাহারা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে কোনো বেজি দেখা করতে আসে–সেটাকে এস্কর্ট করে নিয়ে যায়, হাড় জিরজিরে বুড়ো বেজিটার সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে থাকে। আর সবচেয়ে পিকুলিয়ার

কী?

মনে হয় এই বেজিগুলোর একটা ভাষা আছে, নিজেদের মাঝে এরা কথা বলে। মনে হয় হাড়–জিরজিরে বুড়ো বেজিটা হাত নাড়িয়ে কথা বলে, কিছু একটা অর্ডার দেয়। সে–ই নেতা।

সত্যি?

হ্যাঁ, দ্যাখ বাইনোকুলারটি দিয়ে।

শ্রাবণী বাইনোকুলারটি চোখে দিয়ে দূরে তাকায়। কড়ই গাছের নিচে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে একটা শুকনো দুর্বল বেজি বসে আছে। গাছটিকে ঘিরে আরো অনেকগুলো বেজি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই বোঝা যায়, এই শুকনো হাড়-জিরজিরে দুর্বল বেজিটি আসলে দুর্বল নয়–অন্য বেজিগুলো ক্রমাগত তার কাছে আসছে এবং যাচ্ছে, আদেশ নিচ্ছে এবং ছুটে চলে যাচ্ছে। যদি ব্যাপারটি এরকম পরিবেশে না হত তাহলে শ্রাবণী নিশ্চিতভাবে এর মাঝে খানিকটা কৌতক খুঁজে পেত কিন্তু এখন সে কোনো কৌতুক খুঁজে পেল না।

.

ঠিক দুপুরবেলা বেজিগুলো প্রথমবার তাদের আক্রমণ করল। নিয়াজ বাইনোকুলার চোখে দিয়ে বসে ছিল। হঠাৎ করে সে চিৎকার করে বলল, বেজিগুলো কিছু একটা করছে।

জয়ন্ত ল্যাবরেটরি–ঘরে কিছু কাঠের টুকরায় কাপড় বেঁধে মশাল তৈরি করছিল। সেগুলো টেবিলে রেখে চিৎকার করে জানতে চাইল, কী করছে?

ছুটোছুটি করছে।

কেন?

বুঝতে পারছি না।

কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই কারণটা বোঝা গেল। বেজিদের বিশাল বাহিনী থেকে একটা বিরাট অংশ হঠাৎ করে বাসাটির দিকে ছুটে আসতে শুরু করল। এর মাঝে তারা বাসার দরজা জানালা যতটুকু সম্ভব বন্ধ করে দিয়েছিল কিন্তু তবু বেজিগুলোকে নিরুৎসাহিত করা গেল না। পুরোনো বাসার ফাঁকফোকর দিয়ে সেগুলো পিলপিল করে ভেতরে ঢুকতে রু করে। জয়ন্ত হাতে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শ্রাবণী আর নিয়াজ বড় বড় লাঠিগুলো নিয়ে অপেক্ষা করে।

এই ঘরের ভেতরে যদি ঢুকে যায় তাহলে গুলি করব। ঠিক আছে?

অন্য দুজন মাথা নাড়ল।

মশালগুলো রেডি আছে। সলভেন্টে চুবিয়ে শুধু আগুন লাগাতে হবে।

ঠিক আছে।

সিরিঞ্জগুলোতে এসিড ভরে রেখেছি–খুব কাছে এলে সেটা পুশ করে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু সেটা হচ্ছে একেবারে নিরুপায় হলে। লাস্ট রিসোর্ট।

শ্রাবণী বলল, আমার মনে হয় সবাই চোখে পাষ্টিক গগলসটা পরে নিই।

হ্যাঁ, যদি কোনোভাবে ঘরে ঢুকে যায় তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।

বেজিগুলো বুদ্ধিমান, কাজেই তারা খুব বুদ্ধিমানের মতো কিছু করবে এরকম একটা আশঙ্কা ছিল। কিন্তু দেখা গেল সেরকম বুদ্ধিমানের মতো কিছু করল না। দল বেঁধে বেজিগুলো তাদের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করতে লাগল। নিচে দরজা জানালা বন্ধ থাকলেও জানালার ভাঙা কাচ এবং ঘরের ফঁকফোকর দিয়ে সেগুলো ঢুকতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মাঝেই সিঁড়িতে ধুপধাপ শব্দ শোনা গেল এবং তারপরই ল্যাবরেটরির দরজায় সেগুলো ধাক্কা দিতে শুরু করল। ল্যাবরেটরির দরজাটা ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ করে রাখা আছে। কয়েকটা বেজি সেগুলো ধাক্কা দিয়ে খুলতে পারবে না। তবু তারা তিনজন আতঙ্কে সিঁটিয়ে রইল। শুধু যে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে তা নয়, তারা দেখতে পেল দরজার নব ঘুরিয়ে বেজিগুলো দরজা খোলার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য যে বেজির মতো একটা প্রাণী জানে দরজা খোলার জন্যে নব ঘোরাতে হয়।

কী করবে বুঝতে না পেরে জয়ন্ত দরজার ভেতর থেকে কয়েকটা লাথি মেরে চিৎকার করে বলল, বদমাইশ বেজির বাচ্চা বেজি। ভাগ এখন থেকে, না হলে খুন করে ফেলব গুলি করে।

জয়ন্তের কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্যে হঠাৎ করে দরজায় ধাক্কা থেমে গেল। মনে হল জয়ন্তের কথা বুঝি বুঝতে পেরেছে। কিন্তু পরমুহূর্তে আবার দরজায় ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে। কান পেতে ওরা শুনতে পেল, বেজিগুলো মুখ দিয়ে বিচিত্র নানা ধরনের শব্দ করছে।

নিয়াজ আর শ্রাবণী কী করবে বুঝতে পারছে না। যদি কোনোভাবে দরজা ভেঙে বেজিগুলো ঢুকে যেতে পারে তাহলে কী হবে তারা চিন্তাও করতে পারে না। এক মুহূর্তে হয়তো তাদের ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলবে।

হঠাৎ ঝনঝন করে কোথায় জানি কাচ ভাঙার শব্দ হল। জয়ন্ত বন্দুক হাতে ল্যাবরেটরির পিছনে ছুটে গিয়ে হতবাক হয়ে যায়। বেজিগুলো আসলেই বুদ্ধিমান সামনে তাদেরকে ব্যস্ত রেখে সেগুলো পিছন দিয়ে ঢুকে পড়ছে। ল্যাবরেটরির পিছনে পর্দার পিছনে কাচের জানালা ভেঙে বেজিগুলো ঢুকতে শুরু করেছে। জয়ন্ত হতবাক হয়ে দেখল, বেজিগুলো মুখে পাথরের টুকরো ধরে সেগুলি দিয়ে কাচের ওপর আঘাত করে কাচ ভেঙে ফেলছে। কাচের ধারালো ভাঙা টুকরোয় বেজিগুলোর পা কেটে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে ক্ৰক্ষেপ করল না, লাফিয়ে লাফিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। কিছু বোঝার আগেই জয়ন্ত টের পেল গোটাদশেক বেজি তাকে ঘিরে ফেলেছে। জয়ন্ত পিছনে ঘুরে লাথি দিয়ে কয়েকটা বেজিকে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল, সে পিছন থেকে কোনোটাকে আক্রমণ করতে দিতে চায় না। কিছু বোঝার আগে একটা বেজি লাফিয়ে তার শরীর বেয়ে উপরে উঠে তার চোখে কামড় দেওয়ার চেষ্টা করল–কিন্তু শক্ত পাষ্টিকের গগলস থাকায় সেটা প্লাস্টিকের উপর তার ধারালো দাঁতের চিহ্ন রেখে নিচে গড়িয়ে পড়ল। জয়ন্ত হাত দিয়ে বেজিটাকে সরিয়ে দিয়ে বন্দুক দিয়ে গুলি করার চেষ্টা করে কিন্তু বেজিগুলো ক্রমাগত ছুটছে বলে কিছুতেই নিশানা ঠিক করতে পারে না।

জয়ন্তের চিৎকার শুনে নিয়াজ আর শ্রাবণী লাঠি হাতে ছুটে এসে বেজিগুলোকে আঘাত করার চেষ্টা করে। প্রচণ্ড আঘাতে বেজিগুলো ছিটকে পড়ে বিচিত্র শব্দ করতে শুরু করে। জয়ন্ত ঘরের ভেতরে গুলি করার সাহস পায় না বলে বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করে কয়েকটার মাথা থেতলে দিল। বেজিগুলো একধরনের জান্তব শব্দ করে তাদের শরীর বেয়ে ওঠার চেষ্টা করে চোখে কামড় দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু প্লাস্টিকের গগলস থাকায় তারা প্রতিবারই রক্ষা পেয়ে গেল। ঘরের ভেতরে ভয়ঙ্কর একটা নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে গেছে। একটার পর একটা বেজি এসে ঢুকছে–কতক্ষণ এদের সাথে টিকে থাকতে পারবে তারা বুঝে উঠতে পারছিল না। অসম্ভব দ্রুত বেজিগুলো কিছু বোঝার আগে তাদের শরীর বেয়ে উপরে উঠে কামড়ে ধরার চেষ্টা করতে থাকে। জয়ন্ত কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে চিৎকার করে বলল, মশালগুলো নিয়ে আয়।

শ্রাবণীর শরীরে কয়েকটা বেজি কামড়ে ধরেছে, তার মাঝে সে কোনোভাবে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে ছুটে গিয়ে মশালটা নিয়ে সলভেন্টের ড্রামে ভিজিয়ে নিয়ে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে দিল। সাথে সাথে সেটা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। দ্বিতীয় মশালটা জ্বালিয়ে সে জয়ন্ত আর নিয়াজের কাছে ছুটে এল। একটা মশাল নিয়াজের হাতে দিয়ে অন্য মশাল নিয়ে এলোপাতাড়ি বেজিগুলোকে মারতে থাকে। সারা ঘরে বেজির লোম পোড়া একটা গন্ধে ভরে যায়। হঠাৎ করে বাইরে থেকে বেজি ঢোকা বন্ধ হয়ে গেল। ভেতরের বেজিগুলোও ঘরের আনাচে–কানাচে লুকিয়ে পড়ে–আগুন জিনিসটাকে মনে হয় সত্যিই ওরা ভয় পায়।

জয়ন্ত হিংস্র গলায় চিৎকার করে বলল, কোথায় পালিয়েছিস বদমাইশ বেজির দল? সবগুলোকে খুন করে ফেলব। জবাই করে ফেলব, পুড়িয়ে কয়লা করে দেব

নিয়াজ আর শ্রাবণীও বেজিগুলোকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু বড় ল্যাবরেটরির আনাচে কানাচে কোথায় লুকিয়ে আছে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এক পলকের জন্যে একটা দেখতে পেলেও সেটা চোখের পলকে অন্য কোথাও সরে যাচ্ছে।

হঠাৎ এক কোনা থেকে একটা বেজি ছুটে বের হয়ে এসে অবিকল মানুষের গলায় বলল, ক্রিঁকি ক্রিঁকি এবং এরকম শব্দ করতে করতে সেটি জানালার ফুটো দিয়ে বের হয়ে গেল। সাথে সাথে ঘরের আনাচে–কানাচে লুকিয়ে থাকা বেজিগুলোও ক্রিঁকি ক্রিঁকি শব্দ করতে করতে ছুটে পালিয়ে যেতে শুরু করে। নিয়াজ, শ্রাবণী আর জয়ন্ত প্রচণ্ড আক্রোশে পালিয়ে যেতে থাকা বেজিগুলোকে লাঠি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করে কয়েকটার মাথা থেঁতলে দিল।

শেষ বেজিটি পালিয়ে যাবার পর তারা ল্যাবরেটরি–ঘরটির চারদিকে তাকাল। সমস্ত ঘরের লণ্ডভণ্ড অবস্থা। গোটা–ছয়েক বেজি মরে পড়ে আছে। গোটা–দশেক অধমৃত হয়ে এখানে–সেখানে ছটফট করছে। নিজেদের দিকে তাকানো যায় না–চোখগুলো বেঁচে গিয়েছে কিন্তু শরীরের প্রায় পুরোটুকু ক্ষতবিক্ষত। জামাকাপড় ছিঁড়ে গিয়ে রক্তাক্ত হয়ে আছে। শ্রাবণী নিয়াজ এবং জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে দেখতে যদি তোদের মতো দেখাচ্ছে তাহলে খবর বেশি ভালো নয়।

জয়ন্ত বন্দুকটা দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে বলল, তোকে আরো বেশি খারাপ দেখাচ্ছে।

কত খারাপ?

ডাইনি বুড়ির মতো।

থ্যাংক ইউ জয়ন্ত। তোর মতো আন্তরিক সমবেদনাসম্পন্ন মানুষ পাওয়া খুব কঠিন।

নিয়াজ নিজের হাতপায়ের দিকে লক্ষ করে বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এটা ঘটেছে।

ঘটেছে না। বল ঘটছে। শ্রাবণী বলল, আমি বাজি ধরে বলতে পারি এই বদমাইশগুলি আর দশ মিনিটের মাঝে ফেরত আসছে।

নিয়াজ কাচভাঙা জানালাগুলোর দিকে তাকাল, বলল, আবার যখন আসবে তখন কী করব?

জয়ন্ত দাঁড়িয়ে বলল, জানালাগুলো কাঠের তক্তা দিয়ে লোহা মেরে বন্ধ করে দিতে হবে।

তক্তা কোথায় পাবি?

জয়ন্ত ল্যাবরেটরির চেয়ার টেবিল দেখিয়ে বলল, এগুলো ভেঙে বের করতে হবে।

নিয়াজ প্রথমে ভাবল জয়ন্ত ঠাট্টা করছে, কিন্তু তার মুখে কৌতুকের কোনো চিহ্ন নেই। নিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, চল তাহলে দেরি করে লাভ নেই।

শ্রাবণী ঘরের মৃত এবং অর্ধমৃত বেজিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, এগুলো কী করব?

দরজা খুলে বাইরে ফেলে দে। বদমাইশগুলোকে দেখলেই গা ঘিনঘিন করছে।

কিছুক্ষণের মাঝে দেখা গেল সবাই মিলে ঘরটাকে আবার সুরক্ষিত করার চেষ্টা করছে। পরের আক্রমণটা কখন হবে কেমন হবে সেটা এখনো কেউ জানে না।

.

দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে তিনজন বসে আছে। শরীরের নানা জায়গায় রক্ত শুকিয়ে আছে। কোথাও পানি নেই। তিনজন তিনটি বিকারে খানিকটা এলকোহল নিয়ে একটুকরো কাপড়ে ভিজিয়ে রক্ত মোছার চেষ্টা করছে।

শ্রাবণী বলল, শুধু শুধু চেষ্টা করছি। বেজির দল আবার এল বুঝি।

প্রথম ধাক্কাটা তো সামলে নিয়েছি।

শ্রাবণী জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, পরের ধাক্কাটা হবে আরো শক্ত।

নিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা কি একটার পর একটা ধাক্কা সহ্য করতে থাকব? আমাদের কি এখান থেকে বের হয়ে যেতে হবে না?

হ্যাঁ। যেতে হবে।

সেটা কীভাবে করব? এই ল্যাবরেটরিতে অল্প কয়টা বেজি আমাদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দিয়েছে–বাইরে আমরা কেমন করে যাব? আমাদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে। ফেলবে না?

জয়ন্ত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই শ্রাবণী চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অন্য দুজন তাকিয়ে দেখে একটা সাপ ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, ভয় পাবি না, কেউ ভয় পাবি না। আমার কাছে বন্দুক আছে, আরেকটু কাছে এলেই গুলি করে দেব।

জয়ন্ত কথা শেষ করার আগেই দ্বিতীয় সাপটিকে দেখা গেল এবং সেটি পুরোপুরি ঘরের ভেতরে আসার আগেই দরজার নিচে দিয়ে তৃতীয় সাপটির মাথা প্রবেশ করল।

শ্রাবণী পেছনে সরে গিয়ে একটা টেবিলের ওপরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, কী হচ্ছে এখানে? কী হচ্ছে? এত সাপ কোথা থেকে আসছে? কোথা থেকে আসছে?

শ্রাবণীর কথা শেষ হবার আগেই আরো দুটি সাপের মাথা উঁকি দিল। জয়ন্ত আতঙ্কিত হয়ে দেখল, দরজার নিচে দিয়ে আরো সাপের মাথা কিলবিল করছে। জয়ন্ত হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, হঠাৎ করে সে এত সাপ কোথা থেকে আসছে খানিকটা অনুমান করতে পারে। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই। সে বন্দুকটা তুলে চিৎকার করে বলল, সরে যা সবাই, পেছনে সরে যা।

জয়ন্ত বন্দুকটা তুলে বড় কয়েকটা সাপ লক্ষ করে নিশানা করে ট্রিগার টেনে ধরল। গুলি হবে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না, কিন্তু গুলি হল। বন্ধ ঘরে সেই বিকট শব্দে সবার কানে তালা লেগে যায়। ধোঁয়া সরে গেলে দেখতে পেল সাপগুলো গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। কয়েকটা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা অনেকগুলো বেজির চিৎকার শুনতে পেল–সেগুলো দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে।

নিয়াজ হাতের লাঠি দিয়ে সাপগুলোকে মারার চেষ্টা করে। কয়েকটার শিরদাঁড়া ভেঙে দিল। কয়েকটা ল্যাবরেটরির কোনায় লুকিয়ে গেল। প্রাথমিক উত্তেজনাটুকু কেটে যাবার পর শ্রাবণী কাঁদো–কাদো গলায় বলল, দেখলি? দেখলি বেজিগুলো কী করছে?

সাপ ধরে ধরে এনে ছেড়ে দিচ্ছে।

কত বড় বদমাইশ দেখেছিস?

নিয়াজ হাতের লাঠিটা হাতে নিয়ে সতর্ক–চোখে ঘরের চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলল, তুই এমনভাবে কথা বলছিস যেন ওগুলো বেজি না–মানুষ।

হ্যাঁ। শ্রাবণী মাথা নেড়ে বলল, ফিচলে বুদ্ধি দেখেছিস?

জয়ন্ত বলল, পড়িস নি–-অহি-নকুল সম্পর্ক। এই হচ্ছে সেই অহি-নকুল। নকুল অহিকে ধরে ধরে এনে এখানে ছেড়ে দিচ্ছে।

এরপরে কী করবে?

ভাগ্যিস এখনো আগুন জ্বালানো শিখে নি–যদি জানত তাহলে আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর বাসায় আগুন লাগিয়ে দিত।

নিয়াজ একটা নিশ্বাস যেলে বলল, আঁতেলদের মতো শুধু কথা বলিস না–কী করা যায় ভেবে ঠিক কর।

জয়ন্ত রেগে গিয়ে বলল, আমি আঁতেলদের মতো শুধু কথা বলছি?

বলছিসই তো। সেই তখন থেকে ভ্যাদর ভ্যাদর করছিস।

শ্রাবণী বিরক্ত হয়ে বলল, এটা ঝগড়া করার সময়? চুপ করবি তোরা?

দুজনে চুপ করে কঠিন মুখে শ্রাবণীর দিকে তাকাল। শ্রাবণী বলল, আগে এই ঘরটা মোটামুটি সিকিওর ছিল, এখন এর ভেতরে সাপ ছেড়ে দিয়েছে। ভেতরে কয়টা সাপ লুকিয়ে আছে কে জানে। এখানে থাকা যাবে না।

এখন পর্যন্ত দেখা গেছে বেজিগুলো আগুনকে ভয় পায়। আগুনটাই আমাদের ভরসা।

জয়ন্ত নিজের দিকে তাকিয়ে বলল, কী করবি আগুন দিয়ে?

ধর, অনেকগুলি মশাল তৈরি করে সেগুলো হাতে নিয়ে যদি হেঁটে যাই? বিচে গিয়ে জব্বার মিয়ার ট্রলারের জন্যে অপেক্ষা করি?

জয়ন্ত খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণচোখে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ইট মে ওয়ার্ক। ঠিকই বলেছিস। তবে একটা ডেঞ্জার আছে।

কী ডেঞ্জার?

যদি আমাদের আক্রমণ করে বসে আমাদের কিছু করার নেই।

বন্দুকটা আছে।

হ্যাঁ, বন্দুকটা দিয়ে কিছু গুলি করতে পারি–কয়েকটা মারতে পারি কিন্তু তাতে লাভ কী?

শ্রাবণী অস্থির হয়ে বলল, কিন্তু কিছু–একটা তো করতে হবে–আমরা তো এভাবে বসে থাকতে পারব না?

জয়ন্ত একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বেঁচে থাকার জন্যে দরকার হলে এভাবে বসেই থাকতে হবে। এখনো জব্বার মিয়া আছে–জব্বার মিয়া হচ্ছে আমাদের বাইরের পৃথিবীর সাথে কানেকশন। সে যখন এসে দেখবে আমরা বিচে নাই–তখন নিশ্চয়ই কিছু–একটা করবে। দরকার হলে আমাদের এখানে সাপের সাথে বেজির সাথে বসে থাকতে হবে।

.

বেজিদের দ্বিতীয় আক্রমণটা হল আরো পরিকল্পিতভাবে। বাসার ছাদে ধুপধাপ শব্দ শুনে তারা বারান্দায় এসে দেখে, পাশের একটা বড় কড়ই গাছের ওপরে বেজিগুলো একটা গাছের লতা বেঁধেছে। সেই লতাটি ধরে ঝুল খেয়ে ছাদের ওপর বেজিগুলো লাফিয়ে এসে নামছে। দৃশ্যটি নিজের চোখে না দেখলে তারা বিশ্বাস করত না। বেজির মতো একটা প্রাণী যে গাছের ডালে একটা লতা বাঁধতে পারে সেটাই বিশ্বাস হতে চায় না। দড়ির মতো চমৎকার এরকম একটা লতা কোথায় পেয়েছে সেটাও একটা রহস্য। নিয়াজ বাইনোকুলার দিয়ে দেখে বলল, লতাটি বেণির মতো বুনে নেওয়া হয়েছে।

তিনজন খানিকক্ষণ বেজিদের এই অবিশ্বাস্য কার্যক্রম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। শেষ পর্যন্ত জয়ন্ত বলল, এগুলোকে থামাতে হবে।

নিয়াজ জিজ্ঞেস করল, কীভাবে থামাব?

গুলি করে।

বন্দুকে গুলি ভরতে গিয়ে জয়ন্ত থেমে গিয়ে বন্দুকটা নিয়াজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে এবারে তুই গুলি কর।

আমি আগে কখনো গুলি করি নি।

সেই জন্যেই দিচ্ছি। এইম করে ট্রিগার টেনে ধরবি।

নিশানা যদি না হয়?

না-হওয়ার কী আছে? ছররা গুলি–নিশানার দরকারও নেই।

নিয়াজ গাছের লতা বেঁধে ঝুলে আসা একটা বেজিকে গুলি করতেই বেজিগুলো কর্কশ স্বরে চিৎকার করতে শুরু করল। তারা অবাক হয়ে লক্ষ করল, বেজিগুলো অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। চোখের পলকে সেগুলো কোথাও লুকিয়ে গেল। দেখে মনে হল কোথাও কিছু নেই। মিনিট দশেক পর ধীরে ধীরে বেজিগুলো বের হয়ে আসে, তারপর আবার লতাটি টেনে টেনে একটা বেজি গাছের উপর উঠতে থাকে। তাদের ধৈর্যের কোনো অভাব নেই এবং কিছুক্ষণের মাঝে আবার লতায় ঝাল খেয়ে বাসার ছাদে লাফিয়ে পড়তে শুরু করে। দেখে মনে হয় বেজিগুলো। বুঝে গিয়েছে তাদের কাছে গুলি বেশি নেই। এভাবে খুব বেশিবার তাদেরকে উৎপাত করা হবে না।

বাসার ছাদে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা উপস্থিত হওয়ার পর সেগুলো নিশ্চয়ই কার্নিশ বেয়ে ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। একসাথে কতগুলো আসবে এবং কীভাবে আক্রমণ করবে তারা এখনো জানে না। বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। ছাদে বেজিদের ধুপধাপ শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। চারপাশে একধরনের ভয়–ধরানো আতঙ্ক। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে–কিছুক্ষণ পর অন্ধকার হয়ে আসবে–তখন কী হবে কে জানে!

ঠিক এরকম সময়ে তারা অনেক দূর থেকে একটা ট্রলারের শব্দ শুনতে পেল। শ্রাবণী বলল, জব্বার মিয়া ট্রলার নিয়ে এসেছে।

অন্য দুজন কোনো কথা বলল না। এই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের জগৎ থেকে পালিয়ে যাবার একটা অদম্য ইচ্ছে কাজ করছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না। হঠাৎ করে তাদের ভেতরে একধরনের অস্থির হতাশা এসে ভর করে। নিয়াজ প্রায় বেপরোয়া হয়ে বলল, চল মশাল জ্বালিয়ে বের হয়ে যাই।

গত কয়েক ঘণ্টার ঘটনায় তাদের ভেতরে এরকম ভয়ঙ্কর একটা চাপ পড়েছে যে, সেটা সহ্য করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।

তারা আরেকটু হলে নিয়াজের কথায় হয়তো সত্যি সত্যি বের হয়ে পড়ত। কিন্তু ঠিক তখন হঠাৎ করে ঝুপঝুপ করে চারদিক থেকে বেজিগুলো লাফিয়ে পড়তে শুরু করল। জয়ন্ত চিৎকার করে বলল, ল্যাবরেটরি ঘরে।

কিন্তু জয়ন্তের কথা শেষ হবার আগেই প্রায় বিশ থেকে ত্রিশটি বেজি তার ওপর একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রচণ্ড ধাক্কা সহ্য করতে না–পেরে সে হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে যায়। জয়ন্ত ছটফট করতে থাকে এবং তার সারা শরীরে বেজিগুলো কিলবিল করতে থাকে। নিয়াজ আর শ্রাবণী পাগলের মতো লাঠি দিয়ে মারার চেষ্টা করে কিন্তু সেগুলো ভ্রূক্ষেপ করে না। নিয়াজ এগিয়ে আসা কিছু বেজিকে লক্ষ করে গুলি করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করল কিন্তু একই জায়গায় কাছাকাছি জয়ন্ত এবং শ্রাবণী—সে গুলি করতে পারল না। বন্দুকের কুঁদো দিয়ে বেজিগুলোর মাথা আর শরীর থেঁতলে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।

শ্রাবণী ছুটে ল্যাবরেটরি-ঘরে গিয়ে দুটো মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে বাইরে ছুটে আসে। জয়ন্তকে বাঁচানোর জন্যে মশাল দিয়ে তার শরীরের ওপরেই বেজিগুলোকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে। এইভাবে তারা কতক্ষণ যুদ্ধ করেছে জানে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেজিগুলো কর্কশ শব্দ করতে করতে জয়ন্তকে ছেড়ে সরে যায়। জয়ন্ত টলতে টলতে কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড আক্রোশে একটা লাঠি তুলে নিয়ে বেজিগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে। পড়ে। লাঠির প্রচণ্ড আঘাতে বেজিগুলোর মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, শিরদাঁড়া ভেঙে সেগুলো যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। নিয়াজ আর শ্রাবণীর জ্বলন্ত মশালের আগুনের ঝাঁপটায় শেষ পর্যন্ত শেষ বেজিটিও পালিয়ে যাবার পর জয়ন্ত দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলল, মোস্ট পিকুলিয়ার।

শ্রাবণী আর নিয়াজ জয়ন্তের কাছে গিয়ে তাকে পরীক্ষা করে। শরীরের নানা জায়গা কেটে গেছে। আগুনের হলকায় বুক পেট হাতের কনুই ঝলসে গেছে। সারা শরীরে কালিঝুলি মেখে তাকে কিম্ভুতকিমাকার দেখাচ্ছে। জয়ন্ত নিয়াজ আর শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, বেজিগুলো এবার শুধু আমাকে আক্রমণ করল কেন? আমি কী করেছি?

শ্রাবণী চিন্তিতভাবে বলল, হ্যাঁ। আমিও বুঝতে পারছি না। মনে হল একেবারে চিন্তা ভাবনা পরিকল্পনা করে তোকে ধরেছে।

জয়ন্ত কাঁপা গলায় বলল, একসাথে এতগুলো আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যে ইচ্ছে করলে আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারত। কিন্তু মনে হল ওদের অন্য একটা উদ্দেশ্য ছিল

কী উদ্দেশ্য?

কিছু বুঝতে পারছি না। মনে হয়েছে সারা শরীর তন্নতন্ন করে খুঁজেছে কিছু–একটার জন্য

নিয়াজ হঠাৎ চিৎকার করে বলল, এই দ্যাখ।

শ্রাবণী ছুটে গেল, জয়ন্ত পিছু পিছু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে গেল। টেবিলের নিচে একটা বেজি মরে পড়ে আছে। সম্ভবত লাঠির আঘাতে মাথাটা পুরোপুরি থেঁতলে গেছে। তবে বেজিটা এখনো শক্ত করে একটা ম্যাচের বাক্স ধরে রেখেছে। নিয়াজ অবাক হয়ে বলল, এটা ম্যাচটা কোথায় পেয়েছে?

জয়ন্ত নিজের পকেটে হাত দিয়ে বলল, আমার ম্যাচ। আমার পকেট থেকে নিয়েছে।

তিনজনই একজন আরেকজনের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, বুঝতে পেরেছিস আমাকে কেন ধরেছে?

হ্যাঁ।

আমাকে নিশ্চয়ই ম্যাচ দিয়ে সিগারেট ধরাতে দেখেছে–তাই এখন ম্যাচটা চায়। আগুন ধরানো শিখতে চায়।

নিয়াজ নিচু হয়ে মৃত বেজিটার সামনের দুই পা দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখা ম্যাচটি হাতে নিয়ে বলল, তাহলে কি আমরা বেজিদের সাথে একটা সন্ধি করতে পারি? আমরা ওদেরকে এই ম্যাচটা দেব–তারা আমাদের চলে যেতে দেবে!

শ্রাবণী কিছু–একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন মনে হল খুব কাছে থেকে ট্রলারের শব্দটা শোনা যাচ্ছে। তারা প্রায় ছুটে বের হয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়াল–সেখান থেকে সমুদ্রের খানিকটা দেখা যাচ্ছে। জব্বার মিয়া তার ট্রলারটা নিয়ে আসছে। শ্রাবণী অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! জব্বার মিয়া এখানে চলে এল কেমন করে? সে কেমন করে জানে আমরা। এখানে?

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই– নিয়াজ ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে সুবিধে করতে পারল না।

নিশ্চয়ই কী?

জয়ন্ত বলল, গুলির শব্দ শুনে অনুমান করেছে আমরা নিশ্চয়ই মাজেদ খানের বাসায় আছি?

হ্যাঁ। তাই হবে!

তিন জন বারান্দায় দাঁড়িয়ে জব্বার মিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু কয়েকটা গাছের আড়ালে থাকার কারণে তারা মোটামুটি বেশ স্পষ্ট জব্বার মিয়াকে দেখতে পেলেও জব্বার মিয়া তাদের দেখতে পাচ্ছে না। নিয়াজ বলল, এই সুযোগ। আমাদের এখন অল্প কিছুদূর যেতে হবে! মাত্র এইটুকু।

কিন্তু মাত্র এইটুকু যেতে কতগুলো বেজি পার হয়ে যেতে হবে দেখেছিস?

হ্যাঁ। শ্রাবণী মাথা নাড়ল, ঠিকই বলেছিস।

কিন্তু কিছু তো করার নেই। আয় মশালে আগুন জ্বালিয়ে বের হয়ে যাই। নিয়াজের কথা শুনে সবাই বাইরে তাকাল। কয়েক হাজার বেজি নিচুপ হয়ে বসে আছে দেখে আবার তারা সাহস হারিয়ে ফেলল। এই দুঃস্বপ্নের জগৎ থেকে পালিয়ে যাবার সুযোগ এত কাছে চলে এসেছে তবুও যেতে পারছে না বলে তারা একধরনের হতাশায় ছটফট করতে থাকে।

তারা দেখতে পেল, জব্বার মিয়া ট্রলারটাকে খানিকটা টেনে তীরে তুলল যেন সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে না যায়। তারপর রোদ থেকে চোখ আড়াল করে এদিক–সেদিক তাকাল। কিছু দেখতে না–পেয়ে চিন্তিতমুখে নৌকার পাটাতন তুলে তার হাতে বানানো পাইপগানটা তুলে নিয়ে হেঁটে আসতে শুরু করল। হাঁটার ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল জব্বার মিয়া এই জায়গাটা মোটামুটি চেনে। সে এখন মাজেদ ধানের বাসার দিকেই আসছে।

জয়ন্ত অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, সর্বনাশ, এখন দেখি জব্বার মিয়া এদিকে আসছে। একেবারে সোজাসুজি বেজিদের মুখে পড়বে।

হ্যাঁ। ওকে আসতে নিষেধ কর। শ্রাবণী ভয়–পাওয়া গলায় বলল, চিৎকার করে নিষেধ করে দে।

নিয়াজ চিৎকার করে জব্বার মিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। সেই চিৎকার শুনে বেজিগুলো সচকিত হয়ে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল কিন্তু জব্বার মিয়া কিছু শুনতে পেল না। দ্বীপটার ঠিক এই জায়গা দিয়ে সমুদ্রের হাওয়া শনশন করে বইছে। গাছের পাতার শব্দ, সমুদ্রের গর্জন সব মিলিয়ে কিছু শোনার কথা নয়। তিন জন একধরনের আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে রইল এবং দেখতে পেল জব্বার মিয়া আলগোছে তার পাইপগানটা ধরে ধীরে ধীরে একটা ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে পা দিতে আসছে।

শ্রাবণী ফ্যাকাসে মুখে বলল, সর্বনাশ! কী হবে এখন! জব্বার মিয়া যে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না—

তিন জনে মিলে আবার চিৎকার করল। মনে হল জব্বার মিয়া কিছু–একটা শুনতে পেল। কিন্তু সেটা শুনে সে থেমে না গিয়ে আরো বেশি উৎসাহ নিয়ে ওপরে ছুটে আসতে শুরু করল।

জয়ন্ত বলল, জব্বার মিয়াকে থামাতে হবে এক্ষুনি থামাতে হবে।

কীভাবে থামাবি?

বন্দুকটা দে একটা গুলি করি। গুলির শব্দ শুনলে থেমে যাবে।

ব্যাপারটা পুরোপুরি চিন্তা না করেই জয়ন্ত বন্দুকটা হাতে নিয়ে একটা ফাঁকা আওয়াজ করল এবং সাথে সাথে জব্বার মিয়া চমকে উঠে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেল। গুলির প্রচণ্ড শব্দে বেজিগুলো এক মুহূর্তের জন্যে নিচু হয়ে যায় এবং পরমুহূর্তে মাথা তুলে তাকিয়ে জব্বার মিয়াকে দেখতে পেয়ে তাকে আক্রমণ করার জন্যে ছুটে যেতে থাকে।

এতদূর থেকেও তারা জব্বার মিয়ার মুখে ভয়ঙ্কর আতঙ্কের চিহ্ন দেখতে পেল, সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কয়েক মুহূর্ত সে ছুটে আসা বেজিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাজেদ খানের বাসার দিকে ছুটতে শুরু করল। জয়ন্ত, শ্রাবণী এবং নিয়াজ একটি ভয়ের ছবির দৃশ্যের মতো দেখতে পেল একজন মানুষ তার প্রাণ নিয়ে ছুটছে এবং তার পেছন থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ধূসর মৃত্যু এগিয়ে আসছে। জব্বার মিয়া ছুটছে এবং তার মাঝে কয়েকটা বেজি লাফিয়ে তার শরীরের নানা জায়গায় কামড় দিয়ে ঝুলে পড়ল। জব্বার মিয়া হাত দিয়ে সেগুলো ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। শেষ পর্যন্ত হাতের পাইপগানটা লাঠির মতো ব্যবহার করে প্রচণ্ড আঘাতে সে কিছু বেজিকে ছিটকে ফেলে দিল। ছুটতে ছুটতে সে একটা গুলি করে বেশকিছু বেজিকে রক্তাক্ত করে দিল কিন্তু তবু বেজিগুলো থামল না। মাজেদ খানের বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে জয়ন্ত নিয়াজ আর শ্রাবণী দেখতে পেল ছুটতে ছুটতে জব্বার মিয়া বাসার খুব কাছে চলে এসেছে কিন্তু তবু শেষ রক্ষা করতে পারবে বলে মনে হয় না। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অসংখ্য বেজি পেছন থেকে একসাথে জব্বার মিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং টাল সামলাতে না পেরে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। পরমুহূর্তে দেখা গেল জব্বার মিয়া একটা ধূসর আবরণে ঢেকে গেছে, তার ওপর অসংখ্য বেজি কিলবিল করছে, চোখের পলকে নিশ্চয়ই তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে।

শ্রাবণী চিৎকার করে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি দেখার মতো সাহস তার নেই।

জয়ন্ত কয়েক মুহূর্ত নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পায়। সে চিৎকার করে বলল, জব্বার মিয়াকে বাঁচাতে হবে!

নিয়াজ জিজ্ঞেস করল, কীভাবে?

জানি না। জয়ন্ত বন্দুকে গুলি ভরে নিচে ছুটতে ছুটতে বলল, তোরা মশালে আগুন জ্বালিয়ে আন, তাড়াতাড়ি।

জয়ন্ত চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল। জব্বার মিয়া ছটফট করছে, তার ওপরে ঢেউয়ের মতো বেজিগুলো দৌড়াদৌড়ি করছে–তাদের হিংস্র আস্ফালনের মাঝেও জয়ন্ত জব্বার মিয়ার আর্তচিৎকার শুনতে পেল। জয়ন্ত জব্বার মিয়াকে বাঁচিয়ে তার কাছাকাছি বেজিগুলোকে লক্ষ করে গুলি করল। গুলির আঘাতে অসংখ্য বেজি ছিটকে পড়ে যায়– মুহূর্তের জন্যে সেগুলো থমকে দাঁড়ায়, বেশকিছু ছুটে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। জয়ন্ত সেই অবস্থায় চিৎকার করে জব্বার মিয়ার কাছাকাছি ছুটে যেতে যেতে দ্বিতীয়বার গুলি করল। বেজিগুলো এবারে লাফিয়ে খানিকটা দূরে সরে গেল, কিন্তু একেবারে চলে গেল না। তারা কুতকুতে হিংস্র চোখে জব্বার মিয়া এবং জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে রইল।

ততক্ষণে শ্রাবণী এবং নিয়াজও ছুটে আসছে। তাদের দুই হাতে চারটি জ্বলন্ত মশাল। সেখানে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুন দেখে বেজিগুলো আরো কয়েক পা পিছিয়ে যায়। জয়ন্ত ছুটে গিয়ে এবার জব্বার মিয়াকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। সারা শরীর রক্তাক্ত। মনে হয় বেজিগুলো খুবলে তার শরীর থেকে মাংস তুলে নিয়েছে। জব্বার মিয়া চোখ খুলে তাকাল। তার চোখে আতঙ্ক এবং অবিশ্বাস।

নিয়াজ এবং শ্রাবণী মশালগুলো নাড়তে নাড়তে আগুনের শিখা দিয়ে বেজিগুলোকে ভয় দেখাতে দেখাতে এগিয়ে আসতে থাকে। বেজিগুলো নিরাপদ দূরত্বে থেকে একধরনের চাপা গর্জন করতে থাকে। শ্রাবণী এবং জয়ন্ত মিলে জব্বার মিয়াকে টেনে সোজা করে দাঁড় করাল। নিয়াজ মাটি থেকে তার পাইপগানটা তুলে নেয়। এটা দিয়ে কীভাবে গুলি করতে হয় সেটা সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই, তবু সেটি বেজিদের দিকে তাক করে রাখল।

শ্রাবণী চোখের কোনা দিয়ে বেজিগুলোকে লক্ষ করে, সেগুলো আক্রমণের ভঙ্গিতে তাদের লেজ নাড়ছে। যে–কোনো মুহূর্তে আবার তাদের আক্রমণ করে বসতে পারে। জব্বার মিয়াকে দুই পাশ থেকে ধরে জয়ন্ত আর শ্রাবণী মাজেদ খানের বাসার দিকে নিতে থাকে, তাদের ঠিক পেছনে পেছনে নিয়াজ মশালটি নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসে।

বাসার সিঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছে যাবার পর হঠাৎ করে বেজিগুলো আক্রমণ করল। তাদের নিজস্ব কোনো সংকেত আছে–সেটি পাওয়ামাত্রই চলন্ত ট্রেনের মতো ছুটে এসে কয়েক শ বেজি তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার প্রচণ্ড ধাক্কায় তারা সিঁড়ির ওপরে আছড়ে পড়ল। হাত থেকে মশাল ছিটকে পড়ে এবং হঠাৎ করে শ্রাবণী বুঝতে পারল তাদেরকে বেজিগুলো এখন শেষ করে ফেলবে। ঘাড়ের কাছে কোথায় জানি কয়েকটা বেজি কামড়ে ধরেছে। সেগুলো ছোটানোর জন্যে সে প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকে–কিন্তু একটাকে সরানোর আগেই আরো দশটি এসে জাপটে ধরছে। আগুনের মশালের ওপরে কেউ গড়াগড়ি খাচ্ছে, মাংস এবং লোম পোড়ার একটা উৎকট গন্ধ নাকে এসে লাগে। যন্ত্রণায় কেউ একজন চিৎকার করছে–গলার স্বরটি কার শ্রাবণী বুঝতে পারল না। মৃত্যু তাহলে এরকম–এই ধরনের একটা কথা মনে হল তার, ব্যাপারটি ভয়ঙ্কর, ব্যাপারটি বীভৎস। তার মাথায় একটা বেজি কামড়ে ধরে শক্ত চোয়ালের আঘাতে ছিঁড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। পায়ে কয়েকটা কামড়ে ধরে মাংস ছিঁড়ে নিতে চাইছে। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায় শ্রাবণী আর্তনাদ করে উঠল। মৃত্যু যদি আসবেই সেটি তাহলে আরো তাড়াতাড়ি কেন আসছে না?

শ্রাবণী প্রচণ্ড যন্ত্রণায় অচেতন হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তার ভেতরেও কে জানি তাকে বলল, চেষ্টা কর–বেঁচে থাকার চেষ্টা কর। সে তাই শেষবার চেষ্টা করল, চিৎকার করে বলল, ক্রিঁকি ক্রিঁকি ক্রিঁকি।

হঠাৎ করে জাদুমন্ত্রের মতো বেজিগুলো থেমে গেল। একটি আরেকটির দিকে তাকাল। মনে হচ্ছে কিছু–একটা বুঝতে পারছে না। শ্রাবণী আবার বলল, ক্রিঁকি ক্রিঁকি ক্রিঁকি

সাথে সাথে বেজিগুলি লাফিয়ে তাদের শরীর থেকে নেমে গিয়ে অবিকল মানুষের গলায় ক্রিঁকি ক্রিঁকি ক্রিঁকি বলতে বলতে ছুটে পালিয়ে যেতে শুরু করে।

বেজিগুলো সরে যেতেই শ্রাবণী মাথা তুলে তাকাল। অন্য তিনজন সিঁড়ির ওপরে এবং নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদেরকে দেখে মানুষ বলে চেনা যায় না। দেখে মনে হয় রক্তাক্ত কিছু মাংসপিণ্ড। শ্রাবণী কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে ভয়–পাওয়া গলায় ডাকল, নিয়াজ, জয়ন্ত।

কোনোমতে নিয়াজ আর জয়ন্ত উঠে বসে। তারা বিস্ফারিত চোখে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে থাকে–বেজিগুলো যে তাদের টুকরো—টুকরো না করেই চলে গেছে এখনো সেটা তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না।

শ্রাবণী টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তোরা উঠতে পারবি?

মনে হয় পারব। নিয়াজ বন্দুকটার ওপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। শ্রাবণী গিয়ে জয়ন্তের হাত ধরে তুলল। জয়ন্ত আর নিয়াজ মিলে চেষ্টা করে জব্বার মিয়াকে টেনে তুলল। তারপর ছোট দলটা কোনোভাবে নিজেদেরকে টেনে হিঁচড়ে নিতে থাকে।

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, শ্রাবণী, তুই কেমন করে জানলি যে ক্রিঁকি ক্রিঁকি বললে বেজিগুলো আমাদের ছেড়ে দেবে?

যদি জানতাম তাহলে আরো আগেই বলতাম। জানতাম না বলেই তো এই অবস্থা।

কী বলছিস তুই–আমরা জানে বেঁচে গিয়েছি জানিস?

আমি এত নিশ্চিত নই। একবার বেঁচে গিয়েছি মানে নয় যে সব বার বেঁচে যাব। তবে এইভাবে মরব কখনো ভাবি নি।

এখনো তো মরি নি–

শ্রাবণী কোনো কথা বলল না। জয়ন্ত আবার জিজ্ঞেস করল, তুই কেমন করে বুঝতে পারলি ক্রিঁকি ক্রিঁকি বললে ওগুলো চলে যাবে?

মনে নেই ল্যাবরেটরিতে প্রথম যখন এসেছিল পালিয়ে যাবার সময় একটা বেজি বলল ক্রিঁকি ক্রিঁকি। তখন সবগুলো মিলে পালিয়ে গেল।

হ্যাঁ। মনে আছে।

আমার তাই মনে হল হয়তো ক্রিঁকি ক্রিঁকি মানে, বিপদ বিপদ পালাও। সেটা শুনে হয়তো সবগুলো পালাবে।

নিয়াজ এই অবস্থায় হাসার চেষ্টা করে বলল, তুই বেজিদের একটা মাত্র শব্দ শিখেছিস–সেটা দিয়েই চারজন মানুষের জান বাঁচিয়ে দিয়েছিস। কী আশ্চর্য!

শ্রাবণী কোনো কথা বলল না। সে কোনোকিছু চিন্তা করতে পারছিল না, যদি পারত তাহলে বুঝতে পারত যে ব্যাপারটি সত্যিই খুব আশ্চর্য।

ল্যাবরেটরি–ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চারজন মেঝের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। তাদের শরীর থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ে মেঝের বড় অংশ রক্তাক্ত হয়ে যেতে থাকে।

.

শ্রাবণী চোখ খুলে দেখল জয়ন্ত জব্বার মিয়ার হাত ধরে পালস পরীক্ষা করছে। শ্রবণী কোনোভাবে উঠে বসল। শরীরের নানা জায়গা ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। একটু নড়লেই প্রচণ্ড ব্যথায় শরীর অবশ হয়ে আসতে চায়, সেই অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে জয়ন্তের কাছে যেতে যেতে বলল, কী হয়েছে?

অবস্থা খুব ভালো না। তবে রক্তটা বন্ধ করা গেছে।

তবু ভালো।

হ্যাঁ। কিন্তু এখনই হাসপাতালে নেওয়া দরকার।

শ্রাবণী বিচিত্র দৃষ্টিতে জয়ন্তের দিকে তাকাল। সে এখনো একজনকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা ভাবছে ব্যাপারটি তার বিশ্বাস হতে চায় না। জয়ন্ত এলকোহলে ভরা একটা বিকার শ্রাবণীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে, তোর শরীরের রক্ত মুছে নে। দেখতে খুব খারাপ লাগছে।

শ্রাবণী আবার জয়ন্তের দিকে তাকাল। দেখতে খারাপ লাগা–না লাগার ব্যাপারটি নিয়ে এখনো কেউ মাথা ঘামাতে পারে সেটিও তার বিশ্বাস হয় না।

জয়ন্ত নরম গলায় বলল, আয় কাছে আইয় তোর মুখটা মুছে দিই।

শ্রাবণী কিছু বলার আগেই জয়ন্ত একটা কাপড়ের টুকরো এলকোহলে ভিজিয়ে শ্রাবণীর কপাল এবং গালে শুকিয়ে থাকা রক্ত মুছে দিতে দিতে বলল, তোকে সব সময় দেখেছি সেজেগুজে সুন্দর হয়ে থাকা একজন মানুষ। তাই তোকে এভাবে দেখলে আমরা ইনসিকিওর ফিল করি।

ক্ষতস্থানগুলোতে এলকোহলের স্পর্শ লাগামাত্র জায়গাগুলো তীব্রভাবে জ্বালা করে ওঠে। শ্রাবণী দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল। জয়ন্ত নিচুগলায় বলল, সবচেয়ে সমস্যাটা হয়েছে কী জানিস?

কী?

পানি।

হ্যাঁ তৃষ্ণায় বুকটা একেবারে ফেটে যাচ্ছে।

এত ব্লিডিং হয়েছে, যে আর পারছি না। এভাবে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।

এরকম সময় জব্বার মিয়া চোখ খুলে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ট্রলারে আপনাদের জন্যে পানি নিয়ে এসেছি।

জয়ন্ত জব্বার মিয়ার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, আপনার এখন কেমন লাগছে?

দুর্বল লাগছে। জব্বার মিয়া একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।

কেন চিন্তা করব না?

আমাদের জান হচ্ছে বিড়ালের জান। আমরা এত সহজে মরি না। আল্লাহ হায়াত দিলে বেজির বাচ্চা বেজি কিছু করতে পারবে না।

শ্রাবণী জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, এই হচ্ছে খাঁটি স্পিরিট।

জব্বার মিয়া আস্তে আস্তে বলল, তবে আপনারা যদি তখন না আসতেন তাহলে কেউ আমারে বাঁচাতে পারত না। আজরাইল জানটা কবচ করে নিয়েই ফেলেছিল।

জয়ন্ত কাধ স্পর্শ করে বলল, ঠিক আছে। এখন আর বেশি কথা বলবেন না। শক্তিটা বাঁচিয়ে রাখেন।

শ্রাবণী হামাগুড়ি দিয়ে নিয়াজের কাছে গিয়ে বলল, নিয়াজ তোর কী অবস্থা?

নিয়াজ চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, বেশি ভালো না।

ভালো না হলে হবে কেমন করে? উঠে বস।

নিয়াজ খুব কষ্ট করে উঠে বসল, একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, যা পানির তৃষ্ণা পেয়েছে কী বলব!

শ্রাবণী হাসার চেষ্টা করে বলল, এই ট্রলারেই পানি আছে, চিন্তা করিস না।

সত্যি?

হ্যাঁ।

আমি আর পারছি না। এখানে থেকে পানির তৃষ্ণায় মরার থেকে বাইরে বেজির কামড় খেয়ে মরা অনেক ভালো।

ঠিকই বলেছিস।

জয়ন্ত কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে আরো একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে বলল, এতক্ষণে বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। আমাদের ফেরত যাওয়ার কাজটা আরো কঠিন হয়ে গেল।

যত সময় যাচ্ছে তত দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। নিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বেজির দল আবার যদি এটাক করে, মনে হয় আর নিজেদের রক্ষা করতে পারব না।

কিন্তু চেষ্টা করতে হবে। জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, আমরা এতক্ষণ যখন পেরেছি, বাকিটাও পারতে হবে।

কীভাবে পারবি?

সেটাই চিন্তা করছি। জয়ন্ত দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, আমাদের অস্ত্র হচ্ছে বন্দুক, পাইপগান, কিরিচ আর আগুন। কিন্তু সামরিকভাবে তার সমাধান করতে পারব মনে হয় না। সমাধানটা হতে হবে কূটনৈতিক!

শ্রাবণী শব্দ করে হেসে বলল, ভালোই বলেছিস।

না না, আমি ঠাট্টা করছি না। আমি সিরিয়াসলি বলছি।

কিন্তু সেই কূটনৈতিক মিশনটা চালাবি কেমন করে?

সেটাই ভাবছি। বেজিগুলো ম্যাচটা নেওয়ার জন্যে খুব ব্যস্ত। সেটা দিয়ে একটা কম্প্রোমাইজ করা যেতে পারে। তুই বেজির ভাষা ব্যবহার করে দেখিয়েছিস যে তাদের সাথে ডায়ালগও করা যায়।

কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত মাত্র একটা শব্দ জানি, সেটা হচ্ছে ক্রিঁকি। এক শব্দ দিয়ে কূটনৈতিক আলাপ কেমন করে হয়?

সেটাই হয়েছে মুশকিল। জয়ন্ত চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, কথা দিয়ে যদি না পারি তাহলে কাজকর্ম দিয়ে করতে হবে। জেসচার দিয়ে করতে হবে।

কী হবে তোর সেই জেসচার?

জয়ন্ত কথা না বলে চুপ করে রইল এবং ঠিক তখন শ্রাবণী হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, ওটা কী?

শ্রাবণীর দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই টেবিলের নিচে তাকায়। মোমবাতির আলোয় দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে। জয়ন্ত বন্দুকটা হাতে নিয়ে বলল, কী আবার হবে? একটা ধুমসো বেজি।

এটা এখানে এসেছে কেন?

এখনো জানিস না কেন আসে?

হ্যাঁ জানি। শ্রাবণী চিন্তিত মুখে বলল, কিন্তু যখন আসে তখন তো দল বেঁধে আসে। এখন একা এসেছে কেন? কোন দিক দিয়ে এসেছে?

জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, তুই কি ভেবেছিস আমরা ল্যাবরেটরি–ঘরটা পুরোপুরি সীল করতে পেরেছি? পারি নাই। কত ফাঁকফোকর আছে। তার কোনো একটা দিয়ে ঢুকে গেছে।

শ্রাবণী চিন্তিত মুখে বলল, এমনভাবে বসে আছে যেন আমাদের সব কথা বুঝতে পারছে।

হ্যাঁ। জয়ন্ত বলল আমার ধারণা ব্যাটা স্পাইগিরি করতে এসেছে।

নিয়াজ একটা লাঠি নিয়ে বলল, দাঁড়া ব্যাটার স্পাইগিরি করা বের করছি।

কী করবি?

পিটিয়ে ঘিলু বের করে দেব।

আজ সারাদিনে তারা অসংখ্য বেজির ঘিলু বের করে দিয়েছে, শরীর থেতলে দিয়েছে, শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়েছে, পুড়িয়ে দিয়েছে। কাজেই নিয়াজের কথাটা অর্থহীন আস্ফালন নয়। তবে প্রতিবারই এই বীভৎস কাজগুলো করেছে নিজেদের বাঁচাতে গিয়ে। একসাথে যখন অসংখ্য বেজি তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন হাতের লাঠিটা ঘোরালেই কিছু বেজি তার আঘাতে থেঁতলে গেছে। তবে এটা ভিন্ন ব্যাপার–নিয়াজ নির্দিষ্ট একটা বেজিকে একটা উচিত শিক্ষা দেবার চেষ্টা করছে। 

বেজি অত্যন্ত ধূর্ত প্রাণী। ল্যাবরেটরি ঘরে টেবিলের নিচে ঘাপটি মেরে থাকা একটা বেজিকে নিয়াজ লাঠি দিয়ে কিছু একটা করে ফেলতে পারবে সেটা কেউই ভাবে নি। কিন্তু নিয়াজ হঠাৎ করে সেই অসাধ্য সাধন করে ফেলল। লাঠিটা দিয়ে আচমকা খোঁচা মেরে বেজিটাকে দেয়ালের সাথে আটকে ফেলে চিৎকার করে বলল, ধরেছি শালার ব্যাটাকে, যাবি কোথায় এখন? স্পাইগিরি করতে এসেছিস?

জয়ন্ত এবং শ্রাবণী এগিয়ে গেল। ধূসর রঙের বড়সড় বেজিটা লাঠির চাপে আটকা পড়ে কাতর শব্দ করছে। নিয়াজ হিংস্র গলায় বলল, আরেকটা লাঠি দিয়ে এই জানোয়ারের বাচ্চার মাথাটা থেঁতলে দে দেখি। বোঝাই শালার ব্যাটাকে মজাটা!

শ্রাবণী হঠাৎ উত্তেজিত গলায় বলল, দাঁড়া, দাঁড়া, পাগলামি করিস না।

কী হয়েছে?

শ্রাবণী মোমবাতিটা নিয়ে আরেকটু কাছে গিয়ে বেজিটাকে ভালো করে লক্ষ করে বলল, দেখছিস না এটা কোনো কথা বলার চেষ্টা করছে?

নিয়াজ এবং জয়ন্ত ভালো করে তাকাল, সত্যি সত্যি বেজিটা সামনের দুই পা-কে হাতের মতো নেড়ে কিছু–একটা বলার চেষ্টা করছে। তারা কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, দেখল বেজিটা মাথা নেড়ে অবিকল মানুষের গলায় বলল, সুসু সুসু।

শ্রাবণী উত্তেজিত হয়ে বলল, আরেকটা শব্দ শিখলাম। সুসু। সুসু মানে নিশ্চয়ই আমাকে মেরো না প্লিজ।

জয়ন্ত মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছিস। সে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলল, দেখি এর সাথে কথাবার্তা চালানো যায় কিনা।

শ্রাবণী বলল, দাঁড়া, উল্টাপাল্টা কিছু বলে এটাকে কনফিউজ করিস না।

কী করব তাহলে?

যেহেতু এটা বলছে ছেড়ে দিতে, কাজেই এটাকে ছেড়ে দিতে হবে। এটা হচ্ছে ওদের কাছে নাইস জেসচার দেখানোর সুযোগ।

নিয়াজ বলল, ছেড়ে দেব?

শ্রাবণী বলল, আগেই ছাড়িস না। কথা বলার চেষ্টা করে দেখি। সে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বেজিটার দিকে তাকিয়ে বলল, সুসু।

হঠাৎ করে ম্যাজিকের মতো একটা ব্যাপার হল। বেজিটি এতক্ষণ ছটফট করে কাতর শব্দ করছিল, সবকিছু একমুহূর্তে থেমে গেল। বেজিটি প্রবল ঔৎসুক্য নিয়ে শ্রাবণীর দিকে তাকাল।

শ্রাবণী আবার বলল, সুসু।

নিম্নশ্রেণীর প্রাণীর চোখেমুখে আনন্দ বা দুঃখের ছাপ পড়ে না কিন্তু শ্রাবণীর স্পষ্ট মনে হল বেজিটির চোখমুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে গেছে। বেজিটি সামনের দুটি পা হাতের মতো নেড়ে নেড়ে বলল, সুসু সুসু…।

শ্রাবণী নিয়াজকে বলল, বেজিটাকে ছেড়ে দে।

ছেড়ে দেব?

হ্যাঁ। শ্রাবণী লাঠিটা হাত দিয়ে সরিয়ে দিতেই বেজিটা মুক্ত হয়ে দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল, দৌড়ে পালিয়ে গেল না। শ্রাবণী চাপা গলায় বলল, দেখেছিস, এটা আমাকে বিশ্বাস করেছে!

হ্যাঁ। জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, দ্যাখ বিশ্বাসটা আরো পাকা করা যায় কি না।

শ্রাবণী বলল, সুসু সুসু…

বেজিটাও বলল, সুসু সুসু…

শ্রাবণী চাপা গলায় বলল, একটা মোমবাতি আর ম্যাচটা দে।

জয়ন্ত তাড়াতাড়ি একটা মোমবাতি আর ম্যাচ এগিয়ে দিল। শ্রাবণী ম্যাচের বাক্স থেকে একটা ম্যাচের কাঠি বের করে বাক্সের পাশে ঘসে আগুন জ্বালাতেই বেজিটি বিচিত্র একটি ভয়ের শব্দ করে লাফিয়ে পিছনে সরে গেল। জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, ভয় পেয়েছে।

কিন্তু পালিয়ে যায় নি। দূর থেকে দেখছে।

শ্রাবণী নরম গলায় বলল, সুসু সুসু… তারপর ম্যাচটি দিয়ে মোমবাতিটি জ্বালিয়ে দিল। বেজিটি তীক্ষ্ণচোখে সেটি দেখে খুব ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এসে মোমবাতিতে আগুনের শিখাটি দেখে। এর আগে এত কাছে থেকে কোনো বেজি আগুনের শিখা দেখে নি। জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, বুদ্ধিমত্তার প্রথম ব্যাপারটাই হচ্ছে কৌতূহল। বেজিটার কী কৌতূহল দেখেছিস!

শ্রাবণী বলল, বেজি সাহেব, তোমাকে আমি আগুন জ্বালানো শিখিয়েছি। এখন আগুন নেভানো শিখিয়ে দেই। এই দ্যাখো এভাবে আগুন নেভায়– শ্রাবণী ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিতেই বেজিটি চমকে একটু পিছনে সরে গেল। কিন্তু পালিয়ে গেল না।

জয়ন্ত খুশি–খুশি গলায় বলল, কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রায় হয়েই গেছে–এবারে বেজিটাকে চলে যেতে দে।

শ্রাবণী বলল, যাওয়ার আগে কিছু-একটা উপহার দেওয়া যায় না?

কী উপহার দিবি?

ফুলের তোড়া আর মানপত্র।

ফাজলেমি করিস না। ম্যাচটা নেবার জন্যে পাগল কিন্তু সেটা এখন দেওয়া যাবে না।

ঠিক আছে– শ্রাবণী বলল, এই মোমবাতিটা দিই।

শ্রাবণী মোমবাতিটা বেজির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, সুসু।

বেজিটা তার ছুঁচালো নাক দিয়ে মোমবাতিটা কয়েকবার শুঁকে সেটাকে কামড়ে ধরল। তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যেতে শুরু করল। জয়ন্ত বলল, নিয়াজ দরজাটা খুলে দে। বেজিটাকে সসম্মানে যেতে দিই।

নিয়াজ দরজাটা খুলে দিতেই মোমবাতিটা কামড়ে ধরে রেখে বেজিটা লাফিয়ে বের হয়ে গেল।

.

জব্বার মিয়া একটা কাতর শব্দ করতেই জয়ন্ত মোমবাতিটা হাতে নিয়ে তার কাছে এগিয়ে যায়। শরীরের নিচে রক্তে ভিজে গেছে। জয়ন্ত চিন্তিত মুখে বলল, আবার ব্লিডিং শুরু হয়েছে।

শ্রাবণী এগিয়ে গিয়ে বলল, দেখি মোমবাতিটা ধর দেখি।

জয়ন্ত মোমবাতিটা ধরল, শ্রাবণী একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে জব্বার মিয়ার ক্ষতস্থানগুলো বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।

নিয়াজ আবার দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল, কেউ যদি আমাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দিত–আমি তাকে চোখ বুজে এক লাখ টাকা দিয়ে দিতাম।

মাত্র এক লাখ? শ্রাবণী বলল, আমি দশ লাখ দিতাম।

জয়ন্ত বলল, কল্পনাতেই যখন দিবি বেশি করে দে। টাকায় না দিয়ে ডলারে দে।

ঠিক আছে তাই সই। এক মিলিয়ন ডলার দিতাম।

তোরা এমনভাবে কথা বলছিস যেন সবাই এক একজন বিল গেটস।

ভৈরবের ফেরিতে ছোট ছোট বাচ্চারা পানি বিক্রি করে, এক গ্লাস পানি এক টাকা! এখন মনে হচ্ছে বিল গেটস না হয়ে ঐ পানিওয়ালা বাচ্চা হলেই ভালো হত–ঢক ঢক করে পুরো কলসি পানি খেয়ে ফেলতাম।

জয়ন্ত হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, বলল, হ্যাঁ, এভাবে আর থাকা যাচ্ছে না। আয় বের হই।

বের হব? শ্রাবণী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জয়ন্তের দিকে তাকাল, তুই সিরিয়াস?

হ্যাঁ। যদি আক্রমণ করতে চায় বলব সুসু সুস…।

তারপরও যদি আক্রমণ করে?

তাহলে কিছু করার নেই। বন্দুক দিয়ে গুলি করে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে আগুন ধরিয়ে কোনোভাবে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করব।

শ্রাবণী দুর্বলভাবে হেসে বলল, একেকজনের কী দশা দেখেছিস?

যখন এনার্জি পাবি না তখনই চিন্তা করবি ট্রলার পর্যন্ত পৌঁছলেই বোতল ভরা ঠাণ্ডা পানি! সাথে সাথে শরীরে এড্রনালিনের ফ্লো শুরু হয়ে যাবে।

নিয়াজ বলল, সমস্যা শুধু জব্বার মিয়াকে নিয়ে।

জব্বার মিয়া সাথে সাথে চোখ খুলে বলল, আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনারা যদি পারেন, আমিও পারব।

ঠিক আছে, তবে রওনা দিই। ওঠো বাই।

জব্বার মিয়া খুব ধীরে ধীরে বসল। তারপর জয়ন্তের হাত ধরে সাবধানে উঠে দাঁড়াল। জয়ন্ত উৎসাহ দিয়ে বলল, চমৎকার!

ছোট দলটি রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিল। শ্রাবণীর হাতে বন্দুক, নিয়াজের হাতে পাইপগান, জয়ন্তের হাতে কিরিচ। সবার হাতেই একটা করে লাঠি এবং মশাল। সলভেন্টের বড় বোতল সাথে আছে, প্রয়োজন হলে ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া যাবে।

শ্রাবণী বলল, বাইরে অন্ধকার, মোমবাতি জ্বালিয়ে নিই?

জব্বার মিয়া বলল, চাঁদনী রাত আছে। মোমবাতি জ্বালালে দূরে কিছু দেখবেন না। তাছাড়া বাতাসে নিভে যাবে।

জয়ন্ত বলল, হ্যাঁ, জব্বার মিয়া ঠিকই বলেছে। বাসা থেকে বের হবার সময় মোমবাতি নিভিয়ে নেব। ভালো জোছনা হলে পরিষ্কার দেখা যায়।

দলটি দরজা খুলে খুলে ধীরে ধীরে বের হল। করিডর ধরে হেঁটে সিঁড়ির সামনে দাঁড়াল। ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে নেমে এল। বাইরের দরজা খুলে বারান্দায় বের হয়ে আসে। জম্বার মিয়া ঠিকই বলেছে, আকাশে মস্তবড় চাঁদ। শহরে তারা কখনো অমাবস্যা পূর্ণিমার খবর রাখে না–আকাশে চাঁদটি ওঠে অপরাধীর মতো, ডুবে যায় অপরাধীর মতো। অথচ এখানে চাঁদটি কী ভয়ঙ্কর অহঙ্কারীর মতো পুরো আকাশটিকে উজ্জ্বল করে রেখেছে।

জয়ন্ত ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিতেই হঠাৎ করে জোছনার আলোতে চারদিক প্লবিত হয়ে গেল। মনে হচ্ছে পুরো এলাকাটি বুঝি জোছনার আলোতে উথালপাথাল করছে। শ্রাবণী নিশ্বাস ফেলে বলল, ইশ! কী সুন্দর!

জয়ন্ত বলল, আসলেই।

যদি একটু পরে মরে যাই তোরা কোন দাবি রাখিস না।

কেউ কোনো কথা বলল না। এই সুন্দর পরিবেশে ভয়ঙ্কর বীভৎস একটা মৃত্যুর কথা কেউ চিন্তা করতে পারছে না। শুধু জব্বার মিয়া নিচুগলায় বলল, আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখেন। হায়াত মউত আল্লাহর হাতে।

জয়ন্ত বলল, আয় রওনা দিই।

চার জনের ছোট দলটি নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে পথে নেমে এল। সুরকি বিছানো পথে তারা খুব সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যায়। সামনে বড় বড় গাছ ঝোঁপঝাড় তার নিচে হাজার হাজার বেজি নিঃশব্দে বসে আছে, তারা জানে বেজিত্তলো তীক্ষ্ণচোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

শ্রাবণীর হৃৎপিণ্ড বুকের মাঝে ধকধক করে শব্দ করছে, প্রতিমুহূর্তে মনে হতে থাকে বেজিগুলো বুঝি তাদের ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সবার আগে শ্রাবণী, তার পেছনে জব্বার মিয়া, জব্বার মিয়াকে দুইপাশ থেকে নিয়াজ আর জয়ন্ত ধরে রেখেছে।

কাঁপা–কাঁপা পা ফেলে শ্রাবণী আরো একটু এগিয়ে এল। এখন বেজিগুলোর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে এত কাছে যে প্রতিবার পা ফেলার আগে তাকে লক্ষ করতে হচ্ছে সে কোথায় পা ফেলছে, কোনো বেজির উপর পা ফেলে দিচ্ছে কি না। জোছনার আলোতে চারদিক থই থই করছে, তার মাঝে বড় বড় গাছের ছায়া। জোছনার নরম আলোতে সবকিছু দেখা যায় কিন্তু কিছু স্পষ্ট বোঝা যায় না। গাছের নিচে ঝোঁপের আড়ালে বেজিগুলো বসে আছে অনুভব করা যায়, কিন্তু ঠিক ভালো করে দেখা যায় না। নিশ্বাস বন্ধ করে শ্রাবণী আরো কয়েক পা এগিয়ে গেল। তার মনে হল হঠাৎ করে সামনে একটা বড় গাছের নিচে কিছু একটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। হিংস্র শব্দ করে কিছু বেজি নড়তে শুরু করেছে। আতঙ্কে শ্রাবণীর হৃৎপিণ্ড থেমে আসতে চায়–সে কাঁপা গলায় বলল, সুসু–সুসু…

সাথে সাথে সবকিছু যেন স্থির হয়ে যায়, নিঃশব্দ হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ এলাকায় হিংস্র চোখে বসে থাকা বেজিগুলো হঠাৎ যেন বিভ্রান্ত হয়ে যায়। অনভ্যস্ত হাতে শক্ত করে ধরে রাখা বন্দুকটা নিয়ে শ্রাবণী আবার বলল, সুস সুস…।

কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আবার উচ্চকণ্ঠে বলল, সুসু সুসু…।

হঠাৎ করে প্রতিধ্বনির মতো কথাগুলো ফিরে আসতে শুরু করে। মনে হয় সমস্ত বনাঞ্চল যেন প্রতিধ্বনি করে ওঠে, সুসু সুসু…

জয়ন্ত কাঁপা গলায় বলল, কমিউনিকেট করা গেছে। মনে হয় বেঁচে গেলাম।

এখনো জানি না। শ্রাবণী বলল, হাঁটতে থাক।

চার জনের ছোট দলটা দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। হাতে ধরে রাখা সলভেন্টের ভারী বোতলগুলো ঠেলে নেওয়া কষ্টকর হতে থাকে। তারা তখন একটা একটা করে ফেলে দিয়ে আসতে থাকে। জোছনার নরম আলোতে লম্বা লম্বা পা ফেলে তিন জন এগুতে থাকে। তাদের ডানে বায়ে সামনে পিছনে বেজি। ধূসর বেজিগুলো সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দিচ্ছে, তারা সে জায়গায় পা ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে। একটু পরপর তারা দাঁড়িয়ে পড়ে চাপা গলায় বলছে, সুসু সুসু… যার অর্থ আমাদের মেরে ফেলো না প্লিজ! তার প্রত্যুত্তরে বেজিগুলোও বলছে, সুসু সুসুI পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রজাতির কাছে সেটাও যেন অবোধ প্রাণীগুলোর এক ধরনের আকুতি।

জোছনার নরম আলোতে পা ফেলে ফেলে হাজার হাজার বেজিকে পিছনে ফেলে। তারা শেষ পর্যন্ত বালুবেলায় চলে এল। বালুবেদার নরম বালুতে পা ফেলে তারা এগিয়ে যায়। এই তো সামনে আর কিছুদূরে ট্রলারটি সমুদ্রের ঢেউয়ে দুলে দুলে উঠছে। আর কয়েক পা এগিয়ে গেলে তারা বেঁচে যাবে– ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন থেকে তারা রক্ষা পেয়ে যাবে।

ঠিক তখন জয়ন্ত দাঁড়িয়ে গেল। নিয়াজ বিরক্ত হয়ে বলল, কী হল?

তোরা যা আমি আসছি। 

নিয়াজ অবাক হয়ে বলল, কোথা থেকে আসছিস?

বেজিগুলোর কাছ থেকে।

বিদায় নিয়ে আসবি? নিয়াজ খেপে গিয়ে বলল, গালে চুমু দিয়ে বিদায় নিয়ে আসবি?

না, একটা জিনিস দিয়ে আসব।

কী জিনিস?

ম্যাচটা। মনে নেই ম্যাচটার জন্যে কী করল?

নিয়াজ রেগে বলল, দ্যাখ জয়ন্ত পাগলামি করিস না। তোর একগুঁয়েমির জন্যে আমরা সবাই মরতে বসেছিলাম। এখন আবার একগুঁয়েমি করে ফেরত যাচ্ছিস? ফাজলেমির একটা সীমা থাকা দরকার।

জয়ন্ত বলল, তোদের যা ইচ্ছে বলতে পারিস। কিন্তু এই বেজিগুলো হচ্ছে মানুষের বুদ্ধিমত্তার একটা অংশ তাদের বুদ্ধিমত্তাকে সম্মান করতে হবে। তোরা যা, আমি ম্যাচ দিয়েই চলে আসব। বুদ্ধিমত্তার প্রথম স্টেপ হচ্ছে আগুন। ওদেরকে আগুন জ্বালানোর একটা সুযোগ করে দিই।

নিয়াজ ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, টং করার জায়গা পাচ্ছিস না জয়ন্ত? এটা একটা ঢং করার ব্যাপার হল? ন্যাকামো হল।

হোক। জয়ন্ত পাথরের মতো মুখ করে বলল, তোরা যা।

শ্রাবণী, নিয়াজ এবং জব্বার মিয়া হতবুদ্ধি হয়ে দেখল, জয়ন্ত আবার গভীর অরণ্যের মাঝে ঢুকে যাচ্ছে। মানুষের বুদ্ধিমত্তার একটি অংশ বহন করছে যে প্রাণী সেই প্রাণীর তীব্র কৌতূহলকে সম্মান না দেখিয়ে সে ফিরে যেতে পারবে না।

জোছনার নরম আলোতে জয়ন্তের অপসৃয়মাণ দেহটিকে একটি অতিপ্রাকৃতিক প্রতিমূর্তির মতো মনে হতে থাকে।

.

চাঁদের আলোতে সমুদ্রের পানি কেমন জানি ঝিকমিক করছে। তার মাঝে চাপা শব্দ করে ট্রলারটি এগিয়ে যাচ্ছে। নিয়াজ অনভ্যস্ত হাতে ট্রলারের হালটি ধরে রেখেছে সে। কল্পনাও করতে পারে না দুদিন আগে ট্রলারের উপর বসে থাকা নিয়ে তার ভেতরে একধরনের আতঙ্ক ছিল অথচ এখন সে এটি সমুদ্রের ওপর দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ট্রলারের ভেতরে জব্বার মিয়া লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তার দুর্বল দেহে চেতনা আসছে এবং চলে যাচ্ছে। ট্রলারটি সোজা দক্ষিণে গেলে লোকালয় পাওয়া যাবে, সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। জব্বার মিয়া ভয় পায় না—সমুদ্রের বুকে সে এর থেকে অনেক বড় দুর্ঘটনাও পার হয়ে এসেছে। মৃত্যু বারবার আসে না একবারই আসে এবং সত্যি সত্যি যখন আসবে সে একটুও ভয় না পেয়ে তার মুখোমুখি হবে।

চাঁদটি এখন ঠিক মাথার ওপরে। পিছনে হকুনদিয়া দ্বীপ। জোছনার নরম আলোতে এত দূর থেকে হকুনদিয়া দ্বীপটি দেখা পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু সেটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কারণ পুরো দ্বীপটি দাউদাউ করে জ্বলছে। আগুনের কমলা রঙের শিখা জীবন্ত প্রাণীর মতো লকলক করে নাচছে। সমস্ত আকাশ সেই আগুনের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

ট্রলারের ছাদে হাত রেখে শ্রাবণী দাঁড়িয়ে ছিল। সে জয়ন্তের হাত স্পর্শ করে বলল, মন খারাপ করিস না জয়ন্ত।

জয়ন্ত কাঁপা গলায় বলল, আমি দায়ী। আমি যদি ম্যাচটা না দিয়ে আসতাম!

শ্রাবণী নিচু গলায় জোর দিয়ে বলল, না, তুই দায়ী না। এই বেজিগুলো প্রকৃতির স্বাভাবিক সৃষ্টি না। এটা মানুষের তৈরি একটা কৃত্রিম সৃষ্টি। যেটা স্বাভাবিক না সেটা প্রকৃতিতে থাকে না, থাকতে পারে না।

কিন্তু আমি যদি ম্যাচটি না দিয়ে আসতাম তাহলে এতবড় আগুন লাগত না।

তোর ধারণা কাজটি ভূল হয়েছিল?

অবশ্যই ভুল হয়েছিল।

একটা ভুলের জন্যে যে প্রাণী সারা পৃথিবী থেকে শেষ হয়ে যায় সেই প্রাণীর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কথা না।

কিন্তু।

না জয়ন্ত। এই বেজিগুলো ছিল একটা ভয়ঙ্কর ভুল। তোর আরেকটা ভুল দিয়ে সেই ভুলটিকে সংশোধন করা হল।

.

জয়ন্ত কোনো কথা না বলে দূরে হকুনদিয়া দ্বীপের দিকে তাকিয়ে রইল। আগুনের লাল আভায় পুরো আকাশটি আলোকিত হয়ে আছে। ভয়ঙ্কর আগুনের মাঝে বেজিগুলো না জানি কী ভাষায় চিৎকার করে আর্তনাদ করছে।