বৃষ্টিসন্ধ্যার বিভীষিকা
হিমাদ্রির পিঠে নোখের আঁচড় কাটতে কাটতে ঊর্মি শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দে বলল, চুপ। কারণ হিমাদ্রি ফিসফিস করে অনর্গল প্রেমের কথা বলছিল। বলার সময়। ঘনিষ্ঠতার এই চরম পর্যায়ে কতসব কথা বলতে ইচ্ছে করে। সময় ও পরিবেশ এত নিরাপদ। আজ জুলাই মাসের ১১ তারিখের সন্ধ্যাবেলায় এখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছে। কয়েকমিনিট আগে লোডশেডিং হয়ে গেছে এবং একটু তফাতে টেবিলের ওপর সরু একটা মোম জ্বলছে। আর সেই রাগী ও নির্বোধ ব্যবসাদার লোকটা, যে এই ফ্ল্যাটের মালিক–এখন দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে আরবসাগরের উপকূলে বসে আবুধাবির দিকে তাকিয়ে আছে। দশতলা বাড়িটার সাততলার এই ফ্ল্যাটে খুবই প্রাকৃতিক একটা স্বাধীনতা চনমন করছে আবেগে। হিমাদ্রি চিন্তাভাবনাহীন, নির্বিকার।
মোমের আলোটা কাঁপছে। এপাশের দেয়ালে নিজের লম্বাটে ছায়াটা দেখতে পাচ্ছিল হিমাদ্রি। নিজের ছায়া দেখে নিজের শরীরটাকে অবিকল দেখার ইচ্ছে তাকে পেয়ে বসল। তখন সে বাঁদিকে কিছুটা তফাতে ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকাল। আয়নায় প্রতিবিম্বিত শরীরের দিকে আচ্ছন্ন চোখে সে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তার চেয়ে ঊর্মি বহুগুণ ফর্সা। এতক্ষণে সে নিছক শরীরের সৌন্দর্য জিনিসটাও আবিষ্কার করল। এ একটা আবিষ্কার এবং সব পুরুষের কাছেই ঠিক তাই। ঊর্মির মুখটাকে সেদিকে ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করে সে বলল, দেখ, দেখ ঊর্মি! আহা, দেখ না!
ঊর্মি বলল, আঃ! চুপ করো!
আর ঠিক তখনই পর-পর তিনবার কেউ নক করল জোরে পাশের ডাইনিং–কাম-ড্রয়িংরুমের ওদিকে সদর দরজায়। একটু পরে আবার তিনবার। এবারকার নকে অধৈর্য যেমন, তেমনি কোনো সাংকেতিক কথাও বুঝি বা স্পষ্ট।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য কাঠ হয়ে গিয়েছিল দুটিতে। তারপর ঊর্মি ঠেলে হিমাদ্রিকে সরিয়ে উঠে বসল। মেঝেয় লুটিয়ে আছে অন্তর্বাস, নাইটি। হিমাদ্রির পোশাকের সঙ্গে মিলেমিশে আছে। ঝটপট নিজের পোশাক খুঁজে নিয়ে ঊর্মি হিমাদ্রিকে ইশারায় পোশাক পরে নিতে বলল।
হিমাদ্রির মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। ঊর্মি। পোশাক পরেই ড্রেসিং টেবিলে গেল। ব্রাস টেনে চুল ঠিকঠাক করে বিছানা গোছাতে এল তখন হিমাদ্রি তার পোশাক পরতে শুরু করেছে। তার চোখ ঊর্মির দিকে। ঊর্মির মুখে এখন শান্ত একটা দৃঢ়তা। সে হিমাদ্রির জুতোদুটো। দেখিয়ে পরে নিতে ইশারা করল। তখন আবার তিনবার শব্দ হল বাইরের দরজায়। কিন্তু আগের জোরটা নেই, কেমন যেন ক্লান্ত।
হিমাদ্রি বিভ্রান্ত হয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে ভেতর থেকে ছিটকিনি এঁটে দিল। ঊর্মি বারণ করার আগেই সে এটা করে বসল। ঊর্মি ফিসফিস করে তাকে কিচেনের পাশে স্টোররুমে যেতে বলছিল।
মোটামুটি আধমিনিট সময় লাগল এই ঘর সামলানোতে। তারপর মুখে বেপরোয়া একটা ভাব ফুটিয়ে ঊর্মি স্লিপার ফটফটিয়ে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে দিল। মৃগাঙ্কের কলিংবেল বা লোডশেডিং থাকলে দরজায় নক করার রীতি তার জানা। পরপর তিনবার। মৃগাঙ্ক সংসারী ও সতর্ক মানুষ। তার সবকিছুতে এরকম হিসেবের ছাপ আছে।
বাথরুমের ভেতর হিমাদ্রি দরজা খোলার শব্দটা শুনতে পেল না, শুনল বন্ধ হওয়ার শব্দ। বেশ জোরে বন্ধ হল দরজা। তার মানে হারামজাদা মৃগাঙ্ক দরজা। খুলতে দেরি হওয়ায় রেগে গেছে।
কিন্তু আজ সকাল সাড়ে দশটার প্লেনে যে বোম্বে গেছে, সে আজই সন্ধ্যা সাতটায় কেন এবং কীভাবে ফিরে এল, বুঝতে পারছিল না হিমাদ্রি। নাকি বউকে ফাঁদে ফেলার জন্য এ এক চক্রান্ত?
তবে ঊর্মি বুদ্ধিমতী। তার বুদ্ধির ওপর বিশ্বাস আছে হিমাদ্রির। মৃগাঙ্ককে অন্য বাথরুমের দিকেই–যদি ওর এখন বাথরুমে যাবার দরকার হয়, গাইড করবে ঊর্মি। তারপর একটা কিছু করবে, যাতে হিমাদ্রি ওর অলক্ষ্যে বেরিয়ে যেতে পারে। হিমাদ্রি অন্ধকারে ঘামতে লাগল দরদর করে।
কিন্তু মৃগাঙ্কের কথা শুনতে পেল না সে। ঊর্মিরও না। তেমনি স্তব্ধতা গুমোট হয়ে আছে। বাইরে বৃষ্টির একটানা শব্দ শোনা যাচ্ছে। এত উঁচুতে নিচের রাস্তার কোনো শব্দ এমনিতে শোনা যায় না, তাতে এখন বৃষ্টি। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে। বাথরুমের আয়নায় নিজের ভূতের মতো মূর্তি আবছা ভেসে উঠতে দেখছিল হিমাদ্রি। এতক্ষণে নিজের ওপর রাগে দুঃখে খেপে উঠছিল সে। কেন ঊর্মির কথায় এই ফ্ল্যাটে চলে এল সে? বরং তার পক্ষে একটা নিরিবিলি ফ্ল্যাট পাওয়া কঠিন ছিল না। সুব্রতর একটা ফ্ল্যাট নেওয়া আছে থিয়েটার রোডে। সেটা স্ফুর্তির জন্যই রেখেছে সুব্রত! তাকে বললে ঘণ্টাখানেকের জন্য ওই ফ্ল্যাটটা পেতে পারত। সুব্রতর কাছে তার গোপন করার কিছু নেই।
মৃগাঙ্ককে বোকা ভেবেছিল। এখন হিমাদ্রি টের পাচ্ছে, নিজেই সে রাম বোকা। মৃগাঙ্কের পেতে রাখা ফাঁদে পা দিয়ে বসে আছে। সময় যেন থেমে গেছে। দরজায় কান রেখে ভেতরে কী ঘটছে বোঝার চেষ্টা করল হিমাদ্রি। অবাক হয়ে গেল। মৃগাঙ্ক ও ঊর্মি কোনো কথা বলছে না। কোনো চলাফেরার শব্দও শোনা যাচ্ছে না। এই অস্বাভাবিক চুপচাপ হয়ে যাওয়ার কারণ কী?
কষ্টকর একমিনিট….দুমিনিট….পাঁচ মিনিট কাটল। তবু কোনো শব্দ নেই। সাত মিনিট….আট…দশ….বারো….পনের মিনিট। কোনো শব্দ নেই। শুধু একবার মনে হল, কেউ যেন জোরে শ্বাস ছাড়ল।
হঠাৎ হিমাদ্রি মরিয়া হয়ে গেল।
একটানে দরজা খুলে বেডরুমে পা বাড়িয়ে থমকে দাঁড়াল সে। তেমনি মোম জ্বলছে। তলায় ঠেকেছে শিখাটুকু। ঘরের ভেতরটা তেমনি হয়ে আছে। খাটে বেড কভার চাপানো রয়েছে। ঊর্মি নেই। মৃগাঙ্কও নেই।
সে অবাক হয়ে বেডরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং-কাম-ড্রইংরুমে পা দিল। বেডরুমের মোমের দপদপে ক্ষীণ আলোর ছটা পর্দার ফাঁক দিয়ে একটুখানি ছড়িয়ে গেছে। সেই সামান্য আলোয় সদর দরজার কাছে কী একটা সাদা হয়ে পড়ে আছে।
চোখের দৃষ্টি একটু পরিষ্কার হতেই হিমাদ্রি ঊর্মির সাদা নাইটির অংশ দেখতে পেল। সঙ্গে সে প্যান্টের পকেটে সহজাত বোধ-বশে হাত ভরে লাইটার খুঁজল।
লাইটারটা তখন তাড়াহুড়োয় প্যান্ট খোলর সময় বেডরুমেই হয়তো পড়ে গেছে। সে দুঃস্বপ্নের ঘোরে বেডরুমে ঢুকে মোমটুকু নিয়ে এল। তারপর তার সারা শরীর আতঙ্কে হিম হয়ে গেল। দুহাতে মুখ ঢাকল সে।
ঊর্মি চিত হয়ে পড়ে আছে। তার শ্বাসনালী কাটা। ভয়াবহ চাপচাপ রক্ত।
হিমাদ্রির হাত থেকে মোমটা পড়ে গেছে। সে ঊর্মিকে ডিঙিয়ে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। নির্জন করিডোর। পাশের ফ্ল্যাটে একটা কুকুর গর্জন করছিল। হিমাদ্রির সিঁড়ি বেয়ে টলতে টলতে নামতে থাকল।…
.
একটা অদ্ভুত চিঠি
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সকালে খুরপি হাতে ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার প্ল্যান্ট ওয়ার্ল্ড’-এ। ছাদজুড়ে দেশবিদেশের যত অদ্ভুত ক্যাকটাস, অর্কিড আর বিদঘুঁটে গড়নের কিছু উদ্ভিদ। তার হাতে ইতিমধ্যে যথেষ্ট মাটি মেখে গেছে এবং অন্যমনস্কতার দরুন সান্তাক্লজ অথবা পাদ্রীসুলভ সাদা দাড়িও কলঙ্কিত। তার। টুপিতে একটা সবুজ পোকা শীর্ষে ওঠার চেষ্টা করছে এবং কিনারায় গড়িয়ে পড়ছে। তবু তার চেষ্টার বিরাম নেই। গত বছর অ্যারিজোনার রুক্ষ মরু অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ব্যারেল ক্যাকটাসটা বাংলার কোমল জলবায়ুতে–বিশেষ করে বৃষ্টির স্বাদ পেয়ে ফুলে উঠেছে এবং মাথায় গোলাপী টুপি পরেছে। রাজসভার ভড়দের মতো দেখতে। অথচ তদ্রূপ নিরীহ নয়। ধারাল কাটা উঁচিয়ে সজারুর মতো মারমুখী। গার্গাতুয়া পাতাগুয়েলের কথা মনে পড়ে।
কিন্তু কর্নেল অন্যমনস্ক। কাল রাত থেকে একটা চাপা ক্ষোভ আর ব্যর্থতা ভেতর ভেতর তাঁকে অস্থির রেখেছে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। ভাবছিলেন, নেমে গিয়ে ডাক দফরতরকে একটা চিঠি কড়া লিখবেন। মাত্র শ পাঁচেক কিলোমিটার দুরত্ব অতিক্রম করতে একটা চিঠির প্রায় তিন মাস লেগে যায়। অথচ এমন একটা জরুরি চিঠি।
কাল সম্ভবত বিকেলে লেটারবক্সে চিঠিটা দিয়ে গেছে পোস্টম্যান। ডায়মন্ডহারবারের ওদিকে খোঁজ পেয়ে কাল একটা আমবাগান থেকে আবার এক দুর্লভ প্রজাতির অর্কিড আনতে গিয়েছিলেন। রাতে খাবার টেবিলে ষষ্ঠী চিঠিটা রেখেছিল। খাওয়ার পর অভ্যাসমতো ড্রয়িংরুমে ইজিচেয়ারে বসে কফি ও চুরুটের সঙ্গে চিঠিটা পড়েই তিনি অবাক। পুরনো নোটবই ছিঁড়ে ঝটপর্ট লেখা চিঠি। আঁকাবাকা জড়ানো হরফ। চিঠিটা এই :
বসন্তনিবাস
সেতাপগঞ্জ, পূর্ণিয়া, বিহার
৭-৪-৮০
মান্যবরেষু,
অনেক কষ্টে আপনার ঠিকানা যোগাড় করিয়াছি। বরদাভূষণ ত্রিবেদীর বাড়িতে আপনি একবার আসিয়াছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার সঙ্গে পরিচয় হয় নাই। আমি পক্ষাঘাতে চলচ্ছক্তিরহিত। নতুবা নিজেই আপনার কাছে যাইতাম। কাহাকেও বিশ্বাস করার ভরসা হয় না। তাই এই চিঠি। আপনি দয়া করিয়া শীঘ্র আসুন। আমি বিপন্ন। প্রতিমুহূর্তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় আছি। কতকগুলি অদ্ভুত ঘটনা ঘটিতেছে। সাক্ষাতে সব কথা বলিব। স্টেশনে টাঙ্গা, রিকশা, ট্যাক্সি সবই পাইবেন। বসন্তনিবাস বলিলেই চলিবে। সামান্য ইঙ্গিত দিলাম মাত্র। প্রচুর রহস্য।
ইতি–
রুদ্রেন্দুপ্রসাদ রায়চৌধুরি
আজ আঠারো জুলাই। রুদ্রেন্দুপ্রসাদ সম্ভবত বৃদ্ধ (কর্নেলও সদ্য পঁয়ষট্টিতম জন্মদিন পেরিয়ে এসেছেন) এবং অসুস্থতার দরুন হয়তো বাতিকগ্রস্তও। এক ধরনের বুড়ো মানুষ আছেন, তাঁরা বিপত্নীক হলে তো কথাই নেই, অকারণ ঝামেলা বাড়ান। বিপন্ন হন বা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায়’ থাকেন। তাছাড়া ওই প্রচুর রহস্য’। একটা ছেলেমানুষিও আঁচ করা যায়। কিন্তু ব্যাপারটা অন্যদিকে থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে কর্নেলের। চিঠির তারিখ ৭ এপ্রিল। এতদিন লেগে গেল কেন পৌঁছুতে? ঠিকানাও সঠিক লেখা আছে। অথচ কর্নেল হঠাৎ একটু চঞ্চল হলেন। চিঠিটা তার গার্ডেনিং জোব্বার পকেটে নিয়ে ছাদে উঠেছেন নিজের এই অবচেতন তাগিদটা টের পেয়েই এ চাঞ্চল্য। তাহলে কি কিছু মিস করেছেন চিঠিতে, যেজন্য আবার ওটা খুঁটিয়ে পড়ার ইচ্ছে? টেবিলে পড়ে ছিল খামটা। পকেটে ভরার সময় অতকিছু ভাবেননি। এখন ধরা পড়ল, শুধু ডাকবিভাগের দেরির জন্য নয়, যেন অন্য কোনো গূঢ় ব্যাপার আছে এর মধ্যে, যা নিয়ে তাঁর অবচেতনায় চিন্তার তরঙ্গ বয়ে চলেছে। খামটা বের করে সকালের আলোয় খোলা আকাশের নিচে আবার পড়তে গেলেন। তারপর জোব্বার অন্য পকেট থেকে বের করলেন একটা আতস কাঁচ। প্রথমে পেছনদিকটা পরীক্ষা করলেন। হুঁ, খামটা কেউ খুলেছিল। আবার ধ্যাবড়া করে এঁটে দিয়েছে। খামের ওপর ডাকঘরের ছাপ অস্পষ্ট। সেতাপগঞ্জ। অনুমান করা যাচ্ছে। তারিখের আবছা কালির আঁচড়ের সঙ্গে খামের ওপর দাগ পড়েছে। আতসকাঁচের ভেতর সব মিলিয়ে ১৩ সংখ্যাটার ছাপ ফুটে উঠল। পাশে জে হরফ।
আনলাকি থার্টিন। তের জুলাই চিঠিটা সেতাপগঞ্জ ডাকঘরে পোস্ট করা হয়েছে। তাহলে ব্যাপারটা সত্যি রহস্যময় হয়ে উঠল এতক্ষণে। ডাক দফতরের কোনো দোষ নেই। চিঠিটা এতদিন বাদে ডাকে দেওয়া হয়েছে। মধ্যে একটা রবিবার গেছে। স্থানীয় ডাকঘরের ছাপ পড়েছে ১৭ জুলাই। কর্নেল একটা চাপা উত্তেজনা বোধ করলেন। পত্রলেখক রুদ্ৰেন্দুপ্রসাদ কি এখনও বেঁচে আছেন? বেঁচে থাকুন আর মারাই যান, ব্যাপারটা গোলমেলে থেকে যাচ্ছে। মারা গেলে সেই মৃত্যুর মধ্যেই গণ্ডগোল আছে, তা সুনিশ্চিত–চিঠিটা ডাকে দেওয়ায় সেটা আঁচ করা যায়।
আর যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, কোনো কারণে সব গণ্ডগোল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আবার শুরু হয়েছে।
অবশ্য তারিখটা—
হয়তো তারিখটা সংশোধন করতে মনে ছিল না বা সুযোগ পাননি।…
ষষ্ঠী এসে দাঁত বের করল। নালবাজারের নাহিড়িসায়েব, বাবামশাই।
কর্নেল ভুরু কুঁচকে বললেন, ফোন নামিয়ে রেখে ডাকতে এসেছিস তো? নাকি সেদিনকার মতো–
ষষ্ঠী জোরে মাথা দুলিয়ে খিক খিক করে হাসল। বারেবারে ফোং ভুল হবে নাকি? দেখুন গে না, টেবিলে কাত করে রেখে এয়েছি।
কর্নেল খাম আর আতসকাচ পকেটে ঢুকিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন।…
.
আকস্মিক যোগসূত্র
কর্নেল, আমি বিপন্ন।
ডার্লিং আজকাল সবাই বিপন্ন। তাহলেও তোমার বিপন্ন হওয়ার কারণ তো দেখছি না। আবার কি নকশাল অভ্যুত্থান ঘটেছে? কাগজটাগজ তত পড়ি না। ভাল লাগে না। বয়সও একটা কারণ আর
কর্নেল! প্লিজ, শুনুন।
শুনছি। বলো।
আমি আধঘণ্টার মধ্যে যাচ্ছি। সি পি’র ঘরে একটা জরুরি কনফারেন্স চলছে। একবার ঢু মেরেই আপনার কাছে হাজির হবো পাছে আপনি কোথায় কোন দুর্লভ প্রজাতির পোকামাকড় বা গাছপালার খোঁজে বেরিয়ে যান, তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখলাম। বেরুবেন না যেন।
অরিজিৎ! মানুষের মধ্যে আজকাল তত বেশি রহস্য নেই–প্রায় সবই জানা হয়ে গেছে। তাই আমি প্রকৃতি রহস্যে তলিয়ে পড়তে চাইছি। দুর্লভ প্রজাতি বললে। কথাটার সত্যিকার তাৎপর্য যদি তোমার জানা থাকত ডার্লিং!
কর্নেল, ঘাট মানছি। বেঁফাস বলে ফেলেছি।
আচ্ছা, এস।
ফোন রেখে কর্নেল একটু হাসলেন। একালে পুলিশের গোয়েন্দা দফতরে ছেলেছোকরাদের রাজত্ব। এই ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ী–এখনও গাল টিপলে দুধ বেরুনোর আশঙ্কা আছে। পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে বেরুনো ছেলে হঠাৎ কী খেয়ালে আই পি এস করে লালবাজারে ঢুকে পড়েছে। হা– বুদ্ধিমান, চতুর, প্রত্যুপন্নমতি। সামান্যতেই উৎসাহে চনমন করে ওঠে। কিন্তু বয়স জিনিসটার চেয়ে অভিজ্ঞতার পরিধিই এ লাইনে খুব কাজের জিনিস। যেমন ডাক্তারদের। আগের দিনে ডি সি ডি ডি মনেই তুম্বো মুখো পাকা কুমড়ো এক প্রৌঢ়। ঠোঁটের কোনায় সব সময় বাঁকা হাসি। খুনে ডাকাতের মতো চাউনি। আর অরিজিতের চোখ দুটো যুবতীদের মতো কোমল। জঘন্যতম অপরাধের মধ্যেও সে আর্টের রূপরেখা আবিষ্কার করতে চায়। অবশ্য কোনো কোনো মার্ডারেও আর্ট থাকে ব্ল্যাক আর্ট বলাই ভাল। কিন্তু সব আর্টের মতো ব্ল্যাক আর্টও বাজারের পণ্য হয়ে গেছে। গার্ডেনিংয়ের পোশাক খুলে কর্নেল হাত ধুয়ে এলেন বাথরুমের বেসিনে। তারপর চিঠি আর আতসকাচ বের করে ড্রয়িংরুমে বসলেন। এবার চিঠিটার ওপর আতসকাচ রেখে দেখতে থাকলেন হরফগুলো।
মানুষের হাতের লেখায় তার চারিত্রিক ছাপ ফুটে ওঠে। ভদ্রলোক যখন চিঠিটা লিখছিলেন, তখন মানসিক চাঞ্চল্য ছিল। উৎকণ্ঠা ছিল। গোপনেই লিখছিলেন বোঝা যায়। কিন্তু হরফের গড়ন বলে দিচ্ছে, উনি লেখালিখিতে অভ্যস্ত নন। প্রচুর রহস্য কথাটায় ওঁর রোমান্টিক মনের ছাপ আছে। তাড়াহুড়ো করে লিখলেও গুছিয়ে লিখতে পেরেছেন। তার মানে ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্র, খানিকটা হিসেবী। একটু জেদীও যেন। যেতে বলার মধ্যে সেটা আঁচ করা যায়।
বরদাবাবুর কথা লিখেছেন। বরদাবাবু ছিলেন দ্বারভাঙ্গা স্টেটের দেওয়ানের পুত্র। ম্যানেজার ছিলেন একসময়। পরে ইস্তাফা দিয়ে সেতাপগঞ্জে বাড়ি করেছিলেন। ভদ্রলোকের শিকারের বাতিক ছিল। ১৯৭৮ সালের মার্চে কর্নেল সেতাপগঞ্জ গিয়েছিলেন ভারত সরকারের লোকাস্ট রিসার্চ সেন্টারের একটা সেমিনারে। গঙ্গা নদীর অববাহিকায় সিস্টেসার্কা গ্রেগারিয়া প্রজাতির যে ঘাসফড়িংয়ের প্রজননক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সেবারই তা ধ্বংস করা হয় পেস্টিসাইডস ছড়িয়ে। দেখতে নিরীহ ঘাসফড়িং হলেও ওগুলো পরবর্তী বিবর্তনে ডেজার্ট লোকাস্ট বা মরু পঙ্গপালে পরিণত হয় রাজস্থানে গিয়ে। এক শ্রেণীর পাখির মতো ওরাও পরিযায়ী। এ যেন যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ। গাঙ্গেয় ঘাসফড়িং কালক্রমে পঙ্গপালে বিবর্তিত হয়ে রাজস্থান থেকে পশ্চিম এশিয়া আর আরব হয়ে আফ্রিকার সাহারায় যায়। তারপর সর্বনাশের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে আফ্রিকা জুড়ে। দুর্ভিক্ষের হাহাকার ওঠে কালো মানুষদের দেশে।
তো বরদাবাবুর সঙ্গে আলাপ ওই সূত্রে। গত বছর ওঁর মেয়ে বিবি সুনেত্রার চিঠিতে জানতে পেরেছিলেন, বরদাবাবু গঙ্গার চরে হাঁস মারতে গিয়ে নৌকাডুবি হয়ে মারা পড়েছেন। খুব সহৃদয় অমায়িক আর বন্ধুবৎসল ছিলেন বরদাভূষণ ত্রিবেদী। কর্নেল খুব বিচলিত হয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুসংবাদে।
উনি বেঁচে থাকলে আগে যোগাযোগ করে রুদ্ৰেন্দুবাবুর ব্যাপারটা জেনে নেওয়া যেত। সুনেত্রাকৈ লিখবেন? কিন্তু ইতিমধ্যে সুনেত্রার যদি বিয়ে হয়ে গিয়ে থাকে, রেলওয়ে রেস্টরুমে ওঠা যায়। দেখা যাক।
অরিজিৎ সটান ঢুকে বললেন, আসা করি লেট নই।
না। অবিশ্বাস্য, পনের মিনিটের মধ্যে এসে গেছ, ডার্লিং! বসো।
অরিজিৎ একটু অবাক হয়ে বললেন, সর্বনাশ! আপনার অসাধারণ চোখদুটো কি হঠাৎ বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠল, কর্নেল? আতস কাঁচ দিয়ে আপনাকে চিঠি পড়তে হচ্ছে যে!
চিঠিটা খামে ঢুকিয়ে হাসলেন কর্নেল। নাঃ! এও এক বাতিক তোমার বিবেচনায় দুর্লভ প্রজাতির কিছু খোঁজার মতো।
অরিজিৎ হাসতে লাগলেন। আপনার অভিমান এখনও যায়নি। ষষ্ঠী কফির ট্রে রেখে গেল। কর্নেল কফি ঢালতে ঢালতে বললেন, বৃদ্ধরা হয়তো একটু অভিমানী হয়।
বিশেষ করে আপনার মতো ক্রনিক ব্যাচেলাররা!
কর্নেল ওঁর হাতে কফির পেয়ালা তুলে দিয়ে বললেন, ক্রনিক শব্দটা অসুখবিসুখের সম্পর্কিত, ডার্লিং!
একস্যাক্টলি! বলেই চোখে একটা ভঙ্গি করলেন অরিজিৎ। না–আপনাকে রোগী বলছি না। যদিও বিয়ে না করে বুড়ো হয়ে যাওয়াটা একটা রোগ অবশ্য মানসিক। যেমন ধরুন আমাদের কমিশনার সাহেব। কিংবা ধরুন হোম সেক্রেটারি ভদ্রলোক। একা রামে রক্ষা নেই, তাতে লক্ষ্মণ দোসর! বাপস! প্রাণান্তকর অবস্থা একেবারে। বুঝুন, দুজনেই ব্যাচেলার এবং রিটায়ারিং এজের কিনারায় ঠেকেছেন। তাই যেন তর সইছে না। তাতে গোদের ওপর বিষফেঁড়ার মতো এক মন্ত্রীমশাইয়ের যন্ত্রণা।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে একটু হাসলেন। কোনো মন্ত্রীর জামাইয়ের কলম চুরি গেছে বুঝি?
উঁহু-ভাগ্নের। তবে কলম চুরি নয়, বউঘটিত ব্যাপার। না, না–পালাননি ভদ্রমহিলা। মার্ডার হয়েছেন।
কর্নেল তাকালেন। অরিজিৎ কফিতে ঘনঘন চুমুক দিচ্ছিলেন। কর্নেল চুরুট বের করে হাল্কা গলায় বললেন, মার্ডার নিয়ে লালবাজার বিপন্ন! এ যে বানরে সঙ্গীত গায়, শিলা জলে ভেসে যায়, ডার্লিং! আর মার্ডারের কথা বলছ–এ তো আজকাল ডালভাতের সামিল। অরিজিৎ, তোমার ভেতর একজন আর্টিস্ট আছে জানতাম। ইদানীং মার্ডারের আর্ট কোথায়? সিধে খুনে বুদ্ধির চাতুর্য দরকার হয় না। কোনো ধুরন্ধর মেধার প্রয়োজন নেই। চিন্তাভাবনা অবান্তর। তুমি যে-কোনো একটা অস্ত্র তুলে নাও হাতে। অসংখ্য লোকের সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে
ওয়েট প্লিজ। হাত তুললেন অরিজিৎ। এটা একজন মিনিস্টারের কেস। কিন্তু শুধু সে জন্যও নয়, ব্যাপারটা আগাগোড়া জটিল। আপনার ভাষায় আর্টিস্টিক এবং নিপুণ হাতের কাজ। কর্নেল চুরুট জ্বেলে পা ছড়িয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। চোখ বুজে বললেন, হুঁ বলো।
লেক প্লেসে একটা নতুন বাড়ি হয়েছে দশতলা–লেকভিলা নাম। তার সাততলায় একটা ফ্ল্যাটে থাকেন মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি নামে এক ভদ্রলোক– মিনিস্টারের দূর সম্পর্কের ভাগ্নে তিনি। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের কারবার আছে। এগারো জুলাই মর্নিং ফ্লাইটে মৃগাঙ্কবাবু বোম্বে যান। ফ্ল্যাটে তার স্ত্রী ঊর্মিমালা একা ছিলেন। ওইদিন বিকেল থেকে সারারাত বৃষ্টি ছিল! রাত নটা নাগাদ লোকাল থানায় কেউ ফোন করে জানায়, লেকভিলার সাততলায় তিন নম্বর ফ্ল্যাটে একটা গলাকাটা ডেডবডি পড়ে আছে। তার কয়েকমিনিট পরে ওই বাড়িরই একই ফ্লোরের দু নম্বর ফ্ল্যাট থেকে রঞ্জন অধিকারী নামে এক ভদ্রলোক ফোন করেন থানায়। তার কুকুর খুব ছটফট করছিল বাইরে যাবার জন্য। দরজা খুলে। দিলে কুকুরটা তিন নম্বর ফ্ল্যাটের দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওই সময় লোডশেডিং ছিল। রঞ্জনবাবু দরজা নক করে কোনো সাড়া পান না। কুকুরের কাণ্ড দেখে একটু ভয়ও পেয়েছিলেন ভদ্রলোক। অন্য ফ্ল্যাটের লোকেদের ডেকে আনেন। তারপর হাতল টানাটানি করতেই দরজা খুলে যায়। তার মানে দরজা খোলা ছিল। দরজার কাছে ঊর্মিদেবীকে পড়ে থাকতে দেখেন। মাংসপোড়া গন্ধ পান।
মাংসপোড়া?
হ্যাঁ–পরনে সিন্থেটিক ফাইবারের নাইটি ছিল। পুড়ে মাংসের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। রঞ্জনবাবুরা সুইসাইড ভেবেই ফোন করে থানায়। কিন্তু শ্বাসনালী কাটা।
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কী বলেছে?
খুন করা হয়েছে শ্বাসনালী কেটে। পরে আগুন ধরে গেছে নাইটিতে। ভদ্রমহিলার হাতে মোমবাতি ছিল। সম্ভবত খুনীকে দরজা খুলে দেওয়ার সময় সে তাকে ধরে ফেলে এবং গলায় ড্যাগার চালিয়ে দেয়। মোমটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে আগুন ধরে থাকবে। কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্টে একটা অদ্ভুত কথা বলা হয়েছে। ঊর্মিদেবীর শরীরে–আই মিন ফিমেল অর্গানে সদ্য যৌনমিলনের প্রমাণ ছিল। এটা রেপ বলা মুশকিল। কারণ অন্য কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি, যাতে মনে হবে কেউ ওঁকে রেপ করেছিল। তবে বলা কঠিন। শি ওয়াজ ম্যাচিওর্ড।
প্রাণভয়ে যৌনমিলনে রাজি হলে অবশ্য অমনটা স্বাভাবিক।
আমাদের থিওরিও তাই। ঠিক দরজা খোলার মুখে খুনী ঊর্মিদেবীকে খুন করেছে, তাতে ভুল নেই। কিন্তু পোস্টমর্টমের আগে মনে হয়েছিল, খুনী ফ্ল্যাটে ঢুকেই খুনটা করেছে। চেঁচানোর সময় দেয়নি। পরে দেখা যাচ্ছে, ঊর্মিদেবীকে ভোগ করার পর
কর্নেল চোখ খুলে সোজা হলেন। তাহলে দরজার কাছে কেন? ঊর্মি নিশ্চয় দরজা খুলে তাকে বিদায় দিতে যাচ্ছিলেন কি?
অরিজিৎ তাকালেন। দ্যাটস এ পয়েন্ট। অনিচ্ছায় বা প্রাণভয়ে যৌনমিলনে রাজি হবে যে, সে লোকটাকে দরজা খুলে দিতে যাবে কেন?
যাবে–যদি সে ঊর্মির প্রেমিক হয়। ধরো, ঊর্মির সঙ্গে মিলনের পর দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ সে কর্নেল থেকে মাথাটা দোলালেন। নাঃ! খুনের ইচ্ছা নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলে সে কামনা মিটিয়ে নিয়ে বিছানাতেই ঊর্মিকে খুন করতে পারত। –ঠিক তাই করত। দরজার কাছে খুন করাটাই গণ্ডগোল বাধাচ্ছে। যাই হোক, কোনো সূত্র খুঁজে পেয়েছ কি ঘরে?
বলছি। কিন্তু আরও অবাক লাগে, বিছানায় কিন্তু তেমন কোনো চিহ্ন পাইনি–যাতে মনে হবে যে বিছানায় কিছু ঘটেছিল। ইন্সপেক্টর মোহনবাবুর মতে, মেঝেয় ব্যাপারটা ঘটে থাকবে।
বিছানার অবস্থা কেমন ছিল?
বেডকভার চাপানো। বেডশিটও নির্ভজ। অরিজিৎ এতক্ষণে সিগারেট ধরালেন। বেডরুমের মেঝেয় একটা বিদেশী লাইটার পড়ে ছিল। মৃগাঙ্কবাবু পরদিন বিকেলের ফ্লাইটে ফিরে আসেন। লাইটারটা তাকে দেখানো হয়েছে। ওঁর নয়। ডগস্কোয়াড থেকে রেক্সিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। লাইটার শুঁকে সিঁড়ি দিয়ে নিচের ফুটপাত পর্যন্ত গিয়ে রেক্সি থেমে যায়। সম্ভবত খুনী গাড়ি চেপে এসেছিল। তবে লাইটারে আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে।
মৃগাঙ্কবাবুর আঙুলের ছাপ নিয়েছ?
হ্যাঁ। তাঁর আঙুলের ছাপ নয়।
মৃগাঙ্কবাবুর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন ছিল খোঁজ নিয়েছ?
হ্যাঁ। তেমন কোনো খারাপ সম্পর্ক ছিল না এটুকু বলা যায়। তাছাড়া ওঁরা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। গতবছর জুনে ওঁদের বিয়ে হয়েছিল। এবং হয়তো জাস্ট কোইনসিডেন্স–বিয়ের তারিখও ১১।
ঊর্মিদেবীর আগের জীবন সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছ কি? ওঁর প্রেমিক ছিল কি—
ব্যাপারটা হল, ভদ্রমহিলার বাবার বাড়ি বিহারে। পাটনা কলেজের গ্রাজুয়েট ঊর্মি। কলকাতায় মামার বাড়ি ভবানীপুরে। সেখানে থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে এম এ পড়তে এসেছিলেন। তারপর মৃগাঙ্কবাবুর সঙ্গে ঘটনাচক্রে এক বিয়েবাড়িতে আলাপ, তারপর প্রেম, তারপর পড়াশোনা খতম করে বিয়ে। মৃগাঙ্কবাবু লোকটিকে আমার সরল মনে হয় না অবশ্য।
কর্নেল তাকিয়ে ছিলেন অরিজিতের দিকে! আস্তে বললেন, বাবার বাড়ি বিহারে? কোথায়?
ভাগলপুরের কাছে কী গঞ্জ যেন। ওয়েট, বলছি। অরিজিৎ ব্রিফকেস খুলতে ব্যস্ত হলেন।
সেতাপগঞ্জ নয় তো? কর্নেল আস্তে বললেন।
অরিজিৎ একটু চঞ্চল হলেন হঠাৎ। কেন? চেনা মনে হচ্ছে নাকি? বলে নোটবই বের করে গম্ভীর হলেন আগের মতো। বলেছি কেসটা জটিল। কারণ। মাস তিনেক আগে ওঁর বাবাকেও ঠিক একইভাবে কেউ শ্বাসনালী কেটে খুন করেছিল। বিহার পুলিশের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। হ্যাঁ–ইউ আর রাইট। সেতাপগঞ্জ। রুদ্রেন্দুপ্রসাদ রায়চৌধুরি।
হোয়াট? কর্নেল উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন।
অরিজিৎ বললেন, হ্যাঁ–সেতাপগঞ্জের রুদ্রেন্দুপ্রসাদ রায়চৌধুরি।…..
.
রোবোটের দাম্পত্য জীবন
একঘণ্টা পরে লেকভিলার সামনে অরিজিৎ লাহিড়ীর শাদা ফিয়াট গাড়িটা থামল। কর্নেল ফুটপাতে নেমে প্রথমে বাড়ির উচ্চতা এবং তারপর চারপাশটা দেখে নিয়ে বললেন, যে বাড়ির নাম দেওয়া উচিত ছিল খাপছাড়া, তার নাম লেকভিলা। অরিজিৎ, নাম জিনিসটার চেয়ে বিভ্রান্তিকর আর কিছু নেই।
অরিজিৎ গাড়ির চাবি এঁটে গেটের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, আপনি পাশেই লেক দেখার আশা করেছিলেন কি? দেখা যায়–চারতলা অব্দি উঠলে। তবে এর স্থাপত্যের প্রশংসা করা উচিত।
প্রশংসার কিছু দেখছি না। কর্নেল একটু হাসলেন। কিপলিং এই মেট্রপলিসের একটা পর্যায়ে পভার্টি অ্যান্ড প্রাইড সাইড বাই সাইড দেখেছিলেন। আমরা এখন দেখছি দ্বিতীয় পর্যায়। কিপলিংয়ের মাথা ঘুরে যেত নির্লজ্জতা দেখে।
নিচের তলাটা গ্যারেজ। মৃগাঙ্কের সঙ্গে কর্নেলের ফ্ল্যাট থেকে ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করার সময় অরিজিৎ নিশ্চিত হয়েছেন, বিদ্যুৎ বারোটা অব্দি থাকবে। অটোমেটিক লিফট তরতর করে উঠছিল। অরিজিৎ কর্নেলের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। বললেন, আপনি বাড়িটা দেখে রিক্ত হয়েছেন মনে হচ্ছে!
হয়েছি বলতে পারো ডার্লিং!
কারণ?
প্রথম কথা লেকভিলা নামটা, তারপর–স্কুল প্রয়োজন যখন সৌন্দর্যের ভান করে, তখন আসলে তা আরও কুৎসিত হয়ে ওঠে। এসথেটিকস সম্পর্কে আমার ধারণা স্বতন্ত্র।
সাততলায় লিফট থেকে নেমে চোখে পড়ল সামনেই ফ্ল্যাট তিন। কলিং বেল টেপার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। মৃগাঙ্ক প্রতীক্ষা করছিল।
ডাইনিং-কাম-ড্রয়িংরুমে সোফায় ওঁদের বসিয়ে সে বলল, আপনারা আসছেন বলে আমি থানায় এখনও জানাইনি। কিছুক্ষণ আগে মিঃ লাহিড়ীর ফোন পাবার পর আবিষ্কার করেছি ঊর্মির ছোট্ট স্যুটকেসটা নেই। ওই র্যাকের তলায় ছিল ওটা। কাল রাত্তিরেও দেখেছি।
অরিজিৎ বললেন, কী ছিল স্যুটকেসে?
জানি না। বিয়ের কিছুদিন পরে ঊর্মিকে নিয়ে সেতাপগঞ্জ গিয়েছিলুম। আসার সময় ও সুটকেশটা নিয়ে এসেছিল। আমি জানতে চাইনি কিছু।
আজ ঘুম থেকে ওঠার পর আপনি কি বেরিয়েছিলেন?
সাড়ে আটটায় একটা জরুরি চিঠি পোস্ট করতে গিয়েছিলাম। ডাকবাক্স বাড়ির সামনেই ফুটপাতে আছে। কারেন্ট ছিল। বড়জোর মিনিট পাঁচেকের বেশি বাইরে ছিলুম না। ঊর্মির ডুপ্লিকেট চাবিটাও আলমারির লকারে আছে।
ফ্ল্যাটে কে ছিল তখন?
কেউ না। কাজের মেয়েটি ঊর্মি মার্ডার হবার পর এসে বলে গেছে আর আসবে না। তার দরকারও হত না। আমি বাইরে খেতেই অভ্যস্ত বরাবর। শুধু চা-ফা আর ব্রেকফাস্টটা।
কর্নেল আস্তে বললেন, ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি এঁটে বেরিয়েছিলেন তো?
অবশ্যই। মৃগাঙ্কের মুখে দৃঢ়তা ফুটে উঠল। সে উঠে দাঁড়াল। বসুন, আসছি। বলে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল।
কর্নেল তাকে দেখছিলেন। লম্বা, একটু রোগা, ফর্সা চেহারা মৃগাঙ্কের। নাকটা বেশ বড়ো, চাচা গাল, চিবুক সংকীর্ণ। চোখে কড়া পাওয়ারের স্টিল ফ্রেমের চশমা। কিন্তু রোগা হলেও মোটা শক্ত হাড়ের কাঠামো। আঙুলগুলো লম্বাটে আর মোটা। ঠোঁটের কোনায় সূক্ষ্ম একটা ভাজে আত্মবিশ্বাসের ছাপ আছে। কর্নেল অনুমান করছিলেন, একসময় খুব লড়াই করে জিতে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গি আছে যেন ওর ব্যক্তিত্বে।
কর্নেল অরিজিৎকে মৃদু স্বরে বললেন, তোমরা ঊর্মির জিনিসপত্র সার্চ করোনি?
অরিজিৎ মাথা দোলালেন। ওঁর কিছু চিঠিপত্র চেয়েছিলাম মৃগাঙ্কবাবুকে। সবই আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের চিঠি। বন্ধুদের মধ্যে কোনো পুরুষমানুষের চিঠি দেখিনি। তারপর একটু হেসে বললেন, কোনো কু পাইনি এটুকু বলতে পারি।
এ বাড়িতে ফ্ল্যাটের সংখ্যা কত?
নিচের ফ্লোরে গ্যারেজ। দারোয়ান আর কোঅপারেটিভ আপিসের গোটা তিনেক ঘর আছে। বাকি নটা ফ্লোরে সাতাশটা ফ্ল্যাট। দুটো এখনও খালি। বাকি পঁচিশটা ভর্তি। মৃগাঙ্কবাবুকে বাদ দিলে চব্বিশজনের নামধাম পেশা এসব তথ্য আমরা জেনেছি।
কোঅপারেটিভের কর্মচারী কজন?
দুজন। একজন ক্লার্ক, একজন পিওন। সেক্রেটারির নাম দুলাল গুপ্ত! থার্ড ফ্লোরে দুনম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন। তিনিই এই হাউসিং কোঅপারেটিভের প্রধান উদ্যোক্তা।
মৃগাঙ্ক ঝটপট চা করে আনল। তারপর বসে বলল, বলল, এঁকে চিনতে পারলাম না–
অরিজিৎ বললেন, সরি। ইনি আমার ফ্রেন্ড ফিলসফার অ্যান্ড গাইড বলতে পারেন। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
মৃগাঙ্ক জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে নমস্কার করল। কর্নেল চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, বাঃ! অপূর্ব!
মৃগাঙ্ক একটু হাসল। কিছু কিছু ব্যাপারে আমি এখনও স্বাবলম্বী। পুরনো অভ্যাস আর কী! যেমন চা করা। নিজের হাতের চা না হয়ে আমার তৃপ্তি হয় না। তবে বুঝতেই পারছেন, যে কারবারে আছি, ক্রমশ সব শৌখিনতা ছাড়তে হয়েছে। ছুটোছুটি দৌড়ঝাঁপ সারাক্ষণ। আপনারা না এলে আমি এতক্ষণ বেরিয়ে যেতাম।
গাঙ্কের চেহারায় শোকের ছাপ এরই মধ্যে মুছে গেছে। হয়তো ভেতরে রেখে দিয়েছে শোকটাকে। কর্নেল তাকে দেখছিলেন। যত দেখছিলেন, তত একটা চরিত্রের আদল স্পষ্ট হচ্ছিল। ছত্রিশ-সাঁইত্রিশের মধ্যে বয়স। এখনই এমন পরিণত শক্তির আভাস সচরাচর আশা করা কঠিন। লড়াই করেছে, ঘা খেয়েছে। হয়তো বিস্তর। কিন্তু প্রেম করে পাওয়া বউয়ের এমন ভয়ঙ্কর মৃত্যুর ধাক্কা সামলানো সহজ কি? অথচ ওর মুখে নির্বিকার উদাসীন ওই ভাব। ঊর্মির স্যুটকেসটা এমন অদ্ভুতভাবে চুরি যাওয়াতেও তত বিচলিত নয়। হুঁ, সব কিছুকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে দেরি করে না এমন এক চরিত্র মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি।
অরিজিৎ চুপ করে আছেন। কারণ কথা বলার কথা কর্নেলেরই। মৃগাঙ্ক চায়ের কাপে চোখ রেখে কিছু ভাবছে। কর্নেল তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পরিবেশটা আবার দেখে নিলেন। কোথাও বিলাসিতার চিহ্ন নেই। একালীন রুচি হয়তো আছে। ছবি, ভাস্কর্য এসব বলতে যৎকিঞ্চিৎ। সোফার অংশে সাধারণ একটা কার্পেট। এই ঘরের ঘরণী সম্পর্কেও প্রশ্ন জাগে! সাজিয়ে নিতে জানার মতো শিক্ষা বা রুচি কি তারও ছিল না? নাকি মনের ভেতর অনিচ্ছা, বিদ্রোহ বা ঘৃণা ছিল? অথচ নাকি প্রেম করে বিয়ে!
কর্নেল বললেন, আপনার শ্বশুর রুদ্রেন্দুবাবুও একইভাবে খুন হয়েছিলেন, তাই না মৃগাঙ্কবাবু?
মৃগাঙ্ক সোজা হয়ে বসল। হ্যাঁ। সেজন্যই আমি মিঃ লাহিড়ীদের বলেছি এর পেছনে কোনো পারিবারিক প্রতিহিংসার ব্যাপার আছে। অশ্রদ্ধা মনে হবে, কিন্তু আমি ফ্যাক্টস বলছি–শ্বশুরমশাই মোটেও ভালমানুষ ছিলেন না। না– আমার সঙ্গে ওঁর মেয়ের বিয়েতে রাজি ছিলেন না বলেও বলছি না। খুব উদ্ধত রাগী প্রকৃতির লোক ছিলেন। জমিদারবংশের ব্যাপার আর কী! কোন যুগে কী সব ছিল-টিল, তারই দেমাক। তাছাড়া এলাকায় ওঁর সুনামও ছিল না। মামলাবাজ ছিলেন ভীষণ। অবশ্য আমি বিয়ের পর ঊর্মির তাগিদেই মাত্র একবার গেছি। তখন উনি পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। আমার সঙ্গে একটা কথাও বলেননি।
মৃগাঙ্ক একটা শ্বাস ছেড়ে চুপ করল। কর্নেল বললেন, ঊর্মিদেবীর সঙ্গে আপনার আলাপ কীভাবে?
শ্যামবাজারে আমার এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে গিয়েছিলাম। সেখানেই ওর সঙ্গে আলাপ হয়।
কেউ আলাপ করিয়ে দিয়েছিল নাকি…
মৃগাঙ্ক মুখ নামিয়ে কথা বলছিল। আস্তে বলল, হ্যাঁ। আমার আরেক বন্ধু হিমাদ্রি রায়ের সঙ্গে আলাপ ছিল ঊর্মির। হিমাদ্রিই আলাপ করিয়ে দেয়। হিমাদ্রিও সেতাপগঞ্জের ছেলে, সেদিনই জানতে পেরেছিলাম।
হিমাদ্রিবাবু কোথায় থাকেন?
সাউদার্ন এভেনিউতে। ওর বাসায় কখনও যাইনি। নাম্বারও জানি না।
কী করেন?
কোল ইন্ডিয়া অফিসে পার্সোনেল ডিপার্টের অফিসার।
ঊর্মিদেবী খুন হওয়ার পর আপনার বন্ধুরা নিশ্চয় এসেছিলেন আপনার কাছে?
মৃগাঙ্ক একটু হাসবার ভঙ্গি করে মাথাটা দোলাল। সত্যি বলতে কী, আমার সে অর্থে কোনো বন্ধুই নেই। জাস্ট কাজকর্মের সূত্রে পরিচয়। তারপর একটুখানি মেলামেশা বড়জোর। আসলে কোনোরকম সামাজিকতা বা মেলামেশার মতো অঢেল সময় আমি পাই না। সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয়।
হিমাদ্রিবাবুর দেশের মেয়ে ছিলেন ঊর্মি?
হ্যাঁ প্রতিবেশী ছিল। তবে হিমাদ্রিরা নাকি চলে এসেছিল ওখান থেকে বাড়ি-টাড়ি বেচে দিয়ে।
হিমাদ্রিবাবু আসেননি বলছেন?
না। সেটাই একটু অবাক লাগছিল। পরশু ওর অফিসে তাই ফোন। করেছিলাম। শুনলাম ছুটিতে আছে। বাইরে কোথায় গেছে নাকি।
হিমাদ্রিবাবু এ ফ্ল্যাটে এসেছেন কখনও?
বিয়ের পর বউভাতের দিন এসেছিল। তার মানে, একবছর আগে। মৃগাঙ্ক সিগারেট অফার করল প্রথমে অরিজিৎকে। অরিজিৎ নিলেন। কর্নেল থ্যাংকস, বলে পকেট থেকে চুরুটের কৌটো বের করলেন।
চুরুট ধরিয়ে বললেন, আপনার শ্বশুর খুন হবার খবর পেয়েও আপনি যাননি সেতাপগঞ্জ?
সময় পাইনি। ঊর্মি গিয়েছিল ওর মামার সঙ্গে।
তিনি তো ভবানীপুরে থাকেন?
অরিজিৎ বললেন, এখান থেকে আমরা ওঁর কাছে যাব। ওঁর নাম বনবিহারী চক্রবর্তী।
মৃগাঙ্ক বলল, ঊর্মির মামা অসাধারণ মানুষ। ঊর্মি হয়তো শেষ পর্যন্ত বিয়েতে রাজি হত না–অন্তত আমার সেটাই মনে হয়েছিল ওর মতিগতি দেখে। উনি ওকে রাজি করান। আসলে ঊর্মির দ্বিধার কারণ হল ওরা তিন বোন, ভাই-টাই নেই। ও মেজ। বড় শ্রাবন্তীতার বিয়ে হয়নি এখনও। অদ্ভুত একটা অসুখে ভুগছে ছোটবেলা থেকে। ওখানকার লোকের ধারণা কোন দেবীর ভর হয়েছে–আমি জানি, ওটা হিস্টিরিয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
কর্নেল চোখ বুজে শুনছিলেন। চোখ খুললেন। আপনি দেখেছেন তো?
দেখেছি। হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে। তারপর মাথা দোলাতে থাকে। বিড়বিড় করে কী-সব বলে। মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যায় না। বিশ-তিরিশ মিনিট পরে শুয়ে পড়ে। তারপর উঠে বসে। শ্রাবন্তী একটা প্রবলেম।
আপনার শাশুড়ি বেঁচে আছেন কি?
না। মৃগাঙ্ক সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে বলল, বছর সাতেক আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। ওদের ফ্যামিলিটা দেখে মনে হবে যেন অভিশপ্ত। বাড়ির পরিবেশও কেমন অস্বস্তিকর। আমি জাস্ট তিনটে দিন ছিলাম। আমার দম আটকে যাচ্ছিল। অতবড় একটা পুরনো বাড়ি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে যেন পোড়োবাড়ি।
ঊর্মির ছোট বোনের নাম কী?
অপালা। ওদের মধ্যে বয়সের ফারাক বেশি নয়। ঊর্মির বাইশ ছিল। শ্রাবন্তীর চব্বিশ। আর অপালার উনিশ। মৃগাঙ্ক একটু পরে ফের বলল, ঊর্মির মামার কাছে ওদের বাড়ির কথা সামান্যই শুনেছি। ঊর্মি কোনো কথা বলতে চাইত না। এড়িয়ে যেত। নিজের ফ্যামিলি সম্পর্কে ওর কেমন একটা যেন আড়ষ্টতা ছিল।
শ্রাবন্তী, অপালা–এসেছিলেন তো বোনের মৃত্যুর খবর পেয়ে?
অপালা এসেছিল। ওর মামার কাছে উঠেছিল। মামার সঙ্গে এসেছিল। আধঘণ্টা থেকেই চলে গেল।
কান্নাকাটি করছিল খুব?
মৃগাঙ্ক শক্ত মুখে বলল, ওরা সত্যি অদ্ভুত প্রাণী–আপনি ক্ষমা করবেন কর্নেল সরকার! আমার।
কর্নেল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলুন!
আমার ভুল হয়েছিল ডিসিশন নিতে!
বিয়ের?
আবার কিসের? মৃগাঙ্কের মুখের রেখা বিকৃত দেখাল। ওরা তিন বোনই কমবেশি অ্যাবনর্মাল-বাবার মতোই।
কথাটা সম্ভবত ঝোঁকের বশে বলেছে। তখনই সংযত হয়ে হাসবার চেষ্টা করল সে। অবশ্য ঊর্মি একটু অন্যরকম ছিল। বাইরে থেকে লেখাপড়া শেখার দরুনও হতে পারে সেটা, খানিকটা ইমোশনাল আর হঠকারী বুদ্ধির মেয়ে হলেও ওর মধ্যে সিভিলাইজড ম্যানার ছিল। শ্রাবন্তী তো স্কুলের গণ্ডি পার হয়নি-নাকি ওই অসুখের জন্য। আর অপালা কলেজে ভর্তি হয়েই পড়াশুনো ছেড়ে দেয়। ভীষণ প্রিমিটিভ টাইপ। দেখলে হিন্দুস্থানী মেয়ে মনে হবে।
অরিজিৎ হাসলেন। সম্ভবত বিহারের জলবায়ুর গুণ।
আই এগ্রি।
কর্নেল বললেন, বিয়ের পর এই একবছরে আপনার শ্যালিকারা কেউ আসেনি বোনের কাছে–মানে ঊর্মির মৃত্যুর পরে ছাড়া?
নাঃ।
মামার কাছে?
এসে থাকবে। জানি না।
আপনার শ্বশুরের আর্থিক অবস্থা কেমন?
মন্দ না। জমিজমা আছে কিছু। দেখাশুনো করার লোক আছে।…
কর্নেল একটু পরে বললেন, আপনি এ ফ্ল্যাট কিনেছেন কতদিন?
বছর দুই হল প্রায়। গোড়া থেকেই আমি অন্যতম প্রমোটার।
এর আগে কোথায় থাকতেন?
বেহালায়।
আপনার বাবা-মা বেঁচে আছেন?
না।
ভাইবোন?
আমি বাবা-মায়ের এক সন্তান। বাবা স্কুলটিচার ছিলেন।
ফোন বাজল। মৃগাঙ্ক উঠে গিয়ে ফোন ধরল। মৃদুস্বরে কথা বলে ফোন রেখে ফিরে এল সোফায়। ঘড়ি দেখে একটু হাসল সে। ডাক এসেছে। বেরুতে হবে। অবশ্য আর কিছু জানবার থাকলে জিগ্যেস করতে পারেন।
কর্নেল বললেন, আপনার তো এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের কারবার? কোথায় অফিস?
চৌরঙ্গীতে। সে উঠে গিয়ে একটা কার্ড এনে দিল কর্নেলকে।
আপনাকে তাহলে বেশির ভাগ সময় বাইরে কাটাতে হয়।
হয়। কখনও একসপ্তাহ বোম্বেতে কাটাতে হয়।
ঊর্মি একা থাকতেন ফ্ল্যাটে?
উপায় ছিল না। মৃগাঙ্ক গম্ভীর হল। অবশ্য ঊর্মি সাহসী মেয়ে ছিল– বেপরোয়াও বলা যায়।
একা থাকার জন্য অভিযোগ করতেন না ঊর্মি?
করত। কিন্তু উপায় ছিল না।
আপনার ফ্ল্যাট একবার দেখতে চাই। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর অরিজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ডেডবডি কোথায় পড়ে ছিল, এবং সিগারেট লাইটারটা? তুমি দেখিয়ে দেবে অরিজিৎ! তবে আগে ফ্ল্যাটটা দেখে নিই।
মৃগাঙ্ক উঠল। আসুন! বলে সে বেডরুমে নিয়ে গেল প্রথমে।
কর্নেল একটু অবাক হলেন। দম্পতির শোবার ঘর বলে মনে হয় না। বিয়ের ছবি তো দূরের কথা, কোনো ফোটোই নেই। আসবাবপত্রও কিঞ্চিৎ। ড্রেসিং টেবিলে তত কিছু প্রসাধনসামগ্রী নেই। আশা করেছিলেন, আমদানি, রফতানির কারবারীর বউয়ের ড্রেসিং টেবিলে দেখবেন বিদেশী হরেক প্রসাধনদ্রব্য থরেবিথরে। ড্রয়ার টেনেও নিরাশ হলেন। মৃগাঙ্ক এগিয়ে নিজেই বাকি ড্রয়ারগুলো টেনে দেখাল। বলল, ঊর্মি সাজতে ভালবাসত না। কিছু এনে দিলে পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েদের বিলিয়ে দিত। শেষে আর কিছু আনতাম না।
অরিজিৎ খাটের মাথার দিকে মেঝে দেখিয়ে বললেন, লাইটারটা এখানে পড়েছিল।
কর্নেল মৃগাঙ্কের মুখের দিকে তাকালেন। মৃগাঙ্ক মুখ নামিয়ে আস্তে বলল আগেই বলেছি, আমার ডিসিশনে ভুল হয়েছিল। ঊর্মিকে আমি চিনতে পারিনি।
কর্নেল একটু হাসলেন। একটা লাইটার তত কিছু প্রমাণ করে না, যদি না আরও কোনো ফ্যাক্ট–
মৃগাঙ্ক কথা কেড়ে বলল, লাইটারটা আমি দেখেছি। জাপানি। অন্তত কুড়ি ডলার দাম।
এবাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটের লোকেদের সঙ্গে আপনার স্ত্রীর আলাপ ছিল নিশ্চয়?
ছিল। অবশ্য এক ফ্ল্যাটের সঙ্গে অন্য ফ্ল্যাটের লোকেদের মধ্যে রেষারেষিও প্রচণ্ড। আলাপ আছে–ভাব নেই তত। ভদ্রতাটুকু। আর ঊর্মি তেমন আলাপী মেয়ে ছিল না। ওর আলাপের গণ্ডি ছিল লিমিটেড। পাশের দুনম্বর ফ্ল্যাটের রঞ্জনবাবুর স্ত্রী বা তার মেয়েরা, নাইনথ ফ্লোরের তিন নম্বর ফ্ল্যাটের পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের বউ, আর থার্ড ফ্লোরের স্কুলমিস্ট্রেস মহিলা–এক নম্বর ফ্ল্যাটের। এর বাইরে কারুর সঙ্গে আলাপ থাকার কথা আমি জানি না। ঊর্মির কাছে শুনিনি অন্তত আর কারুর কথা।
কর্নেল অ্যাটাচড বাথরুমে উঁকি মেরে পাশের একটা ঘরে গেলেন। একেবারে খালি! এবার ড্রইং-কাম-ডাইনিং রুমের অন্য পাশের ঘরে উঁকি দিলেন। একটা স্টোর রুম, তার লাগোয়া কিচেন। পাশে একটা ছোট্ট সার্ভেন্টস রুম সম্ভবত সেটাও একেবারে খালি। দরজার পাশেই দ্বিতীয় বাথরুম। এটা অব্যবহৃত মনে। হল। আসলে টুরুম ফ্ল্যাট বলা যায়। ছোট ফ্যামিলির পক্ষে যথেষ্টই।
অরিজিৎ দরজার সামনে একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, এখানে ডেডবডি পড়েছিল। আশ্চর্য ব্যাপার, মেঝেয় যা একটু রক্ত পড়েছিল। খুব এক্সপার্ট হাতের কাজ।
কর্নেল বললেন, আপাতত এই। মৃগাঙ্কবাবু, আপনি এবার বেরুতে পারেন। অরিজিৎ, আমি একবার রঞ্জনবাবুর সঙ্গে কথা বলতেই চাই।
অরিজিৎ কিছু বলার আগে মৃগাঙ্ক বলল, ওঁকে এখন পাওয়া যাবে কি? এখন অফিসে থাকার কথা।
ওঁর স্ত্রী সঙ্গে কথা বলব বরং!
মৃগাঙ্ক বেরিয়ে দু নম্বর ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজাল। কর্নেল ও অরিজিৎ তার পেছন পেছন বেরিয়ে এলেন। দরজা একটু খুলে এক মহিলা কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করে কর্নেল ও অরিজিৎকে দেখে থমকে গেলেন। মৃগাঙ্ক বলল, রঞ্জনদা বেরিয়েছেন নাকি?
অনেকক্ষণ।
বউদি, এঁরা লালবাজার থেকে এসেছেন। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান।
রঞ্জনবাবুর স্ত্রী বললেন, ভেতরে আসুন! এস মৃগাঙ্ক!
মৃগাঙ্ক বলল, আমি আর যাচ্ছি না বউদি। এখনই বেরুতে হবে। তারপর কর্নেল ও অরিজিতকে নমস্কার করে বিদায় জানিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে গেল। কর্নেল বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মৃগাঙ্ক যেন যন্ত্রমানুষ।…
.
দুবার দরজায় নক
ফ্ল্যাটগুলো এই গড়নের, একই আয়তনের। কিন্তু রঞ্জনবাবুর ফ্ল্যাটে সংসারী মানুষের ভোগী মনোভাবের ছাপ স্পষ্ট। অরিজিৎ বললেন, প্লিজ, চা-ফা আর নয়। মৃগাঙ্কবাবুর ওখানে হয়ে গেছে। আমরা বেশি সময় নেব না আপনার।
পাশের ঘরে কুকুরের গজরানি শোনা যাচ্ছিল। কর্নেল একটু হেসে বললেন, রঞ্জনবাবুর, নাকি আপনার পেট?
রঞ্জনবাবুর স্ত্রী হাসলেন। দুজনেরই।
চেহারায় সৌন্দর্য এবং বুদ্ধিমত্তার ছাপ আছে মহিলার। সপ্রতিভ ভঙ্গি। একটু যেন স্মিতভাষিণীই। কথা বলেন যেন হিসেব করে। কর্নেল বললেন, আপনার ছেলেমেয়েরা স্কুলে?
স্কুলে, কলেজে।
ঊর্মিদেবীর সঙ্গে আপনার আলাপ ছিল শুনলাম।
ছিল–তত বেশি কিছু না।
যাতায়াত ছিল পরস্পর?
বিশেষ না। একটু খামখেয়ালী মনে হত ভদ্রমহিলাকে।
আপনার ছেলেমেয়েরা যেত ওঁর কাছে?
গেছে কখনও-সখনও।
একটু অপ্রীতিকর প্রশ্ন হয়তো কিন্তু আপনার সাহায্য মূল্যবান হতে পারে। কর্নেল একটু ইতস্তত করছিলেন। একটু হাসলেন এবার। অবজার্ভার হিসেবে পুরুষের চাইতে মেয়েরা শ্রেষ্ঠ। মেয়েদের ইনটুইশানে আমি বিশ্বাসী।
রঞ্জনবাবুর স্ত্রী বললেন, নিঃসঙ্কোচে বলুন কী জানতে চান।
মৃগাঙ্কবাবুকে কেমন লোক মনে হয় আপনার?
আমিশুকে প্রকৃতির। কৃপণটাইপ বলতে পারেন। ভীষণ হিসেব করে চলে।
আপনার কি মনে হয় ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নর্মাল ছিল?
তেমন কিছু দেখিনি যে মতামত দেব। তবে
তবে?
কয়েকবার ঝগড়া হতে শুনেছি। সেটা কোথায় না হয়?
ফ্ল্যাটে–ধরুন, যখন মৃগাঙ্কবাবু নেই, তখন কেউ এসেছে কি না দেখেছেন?
কেউ এলে আবছা কলিং বেলের বা লোডশেডিং থাকলে নক করার শব্দ শোনা যায় আমাদের ফ্ল্যাট থেকে। তাছাড়া সনি, মানে আমাদের কুকুরটা একটু চাচামেচি করে। রঞ্জনবাবুর স্ত্রীর ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। আমার নাক গলানোর অভ্যাস নেই অন্যের ব্যাপারে।
তাহলে কেউ এসেছে মাঝে মাঝে–মানে মৃগাঙ্কবাবু না থাকার সময়?
হ্যাঁ। এসেছে বৈকি। ফ্ল্যাটগুলোর দরজা ডিফেক্টিভ। প্রাইভেসি রাখা একটা প্রব্লেম।
দৈবাৎ কি আপনার চোখে পড়েনি মৃগাঙ্কবাবুর ফ্ল্যাটে কারা আসেন?
ভদ্রমহিলা কয়েক সেকেন্ড আঙুল খুঁটে মুখ তুললেন। মৃগাঙ্কবাবুর বউ মার্ডার হওয়ার দিন–মানে সন্ধ্যা ৭টা হবে তখন, সনি হঠাৎ দরজায় আঁচড় কাটতে কাটতে চাঁচামেচি করছিল। শুনলাম কেউ নক করছে ওদের দরজায়। তাই দরজা একটু ফাঁক করে উঁকি দিয়েছিলাম।
কাকে দেখলেন?
লোডশেডিং ছিল। তাছাড়া তখনই দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। দেখতে পাইনি।
বাই দা বাই, মৃগাঙ্কবাবু বাড়ি ফিরলে সনি কি চাচামেচি করে?
সনি কিন্তু খুব মেজাজী। কখন কাকে তার পছন্দ বলা কঠিন। তবে তিনবার নক করলে বুঝতে পারি মৃগাঙ্ক এল। শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সনি কমবেশি চাচামেচি তো করেই।
কাউকে দেখতে পেয়েছিলেন সেদিন সন্ধ্যাবেলা? কর্নেল রিপিট করলেন।
না। রঞ্জনবাবুর স্ত্রী আবার নখ খুঁটতে থাকলেন। একটু পরে মুখ তুলে বললেন, বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার সনি দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়ে চাঁচামেচি করতে লাগল। তখন আমার ভয় করছিল। ওঁকে বললাম, সনি এমন করছে। কেন। উনি একটু ভীতু মানুষ। বললেন, বেঁধে রাখো। দরজা খুলো না আর। …..হ্যাঁ, আবার শুনতে পেয়েছিলাম কেউ ওদের দরজায় নক করছে। ভেবেছিলাম। মৃগাঙ্ক। কিন্তু সে নাকি বোম্বে গেছে।
তাহলে কিছুক্ষণ অন্তর দুবার নক করার শব্দ?
হ্যাঁ। সনির ব্যাপারটাতে বুঝতে পেরেছিলাম দুবারই ওর অপছন্দ লোক এল ও ফ্ল্যাটে।
অরিজিৎ বললেন, আপনি পুলিশকে একথা বলেছেন। নিশ্চয়?
না জিগ্যেস করলে কেন আগ বাড়িয়ে বলব? ইনি জিগ্যেস করছেন, তাই বলছি।
অরিজিৎ হাসলেন। আপনার স্বামীর নিষেধ ছিল।
রঞ্জনবাবুর স্ত্রী জোরে মাথা দুলিয়ে বললেন, মোটেও না। উনি মৃগাঙ্ককে খুব ভালবাসেন। খুনী, ধরা পড়ার জন্য সবরকম সাহায্য করেছেন পুলিশকে। অথচ পুলিশের লোকেরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত।
কর্নেল বললেন, এক নম্বর ফ্লাটে কে থাকেন।
মিঃ নায়ার। সাউথ ইন্ডিয়ান। অবশ্য একনাগাড়ে থাকেন না–মাঝে মাঝে এসে থাকেন। পার্ক স্ট্রিটেও ওঁদের ফ্ল্যাট আছে।
এখন আছেন কি?
না। মার্ডারের সময়ও ছিলেন না ওঁরা। দুদিন পরে এসে আবার চলে গেছেন। এ বাড়ির অনেকেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। আচ্ছা–অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
রঞ্জনবাবুর স্ত্রী ওঁরা লিফটে ওঠা অব্দি দরজা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
.
সেতার শিল্পী বনবিহারী
ভবানীপুরের দিকে এগোচ্ছিল শাদা ফিয়াট। অরিজিৎ বললেন, ওই ভদ্রমহিলা– মানে রঞ্জনবাবুর স্ত্রী সম্ভবত আরও কিছু জানেন। চেপে গেলেন। তাই না কর্নেল?
কর্নেল একটু হাসলেন। কেন একথা মনে হল তোমার?
মাই গুডনেস! সেটা আমাকেই বলতে হবে?
হবে। কারণ ধারণাটা তোমার।
আপনার কী ধারণা?
আমি অন্তর্যামী নই, ডার্লিং! বিশেষ করে স্ত্রীলোক সম্পর্কে আমি অতিমাত্রায় অজ্ঞ। ক্রনিক ব্যাচেলার–তোমার ভাষায়।
অরিজিৎ হাসতে লাগলেন। আপনি যাই বলুন, ভদ্রমহিলা গভীর জলের। মাছ। অনেককিছু জানেন। একটু চাপ দিলেই আরও কথা বেরিয়ে পড়তে পারে। পুলিশী পদ্ধতি সব সময় ইমিডিয়েট রেজাল্ট দেয়।
কর্নেল আধপোড়া চুরুটটা হাওয়া বাঁচিয়ে ধরালেন। আমার পদ্ধতি সম্পূর্ণ অন্যরকম। সাইকো-অ্যানালেসিস প্রক্রিয়ার মতো। কাউকে মনের কথা বলাতে হলে তার স্বাধীনতাবোধকে এগিয়ে দিতে হয়। আরও একটা ব্যাপার আছে, অরিজিৎ! যার কাছে তথ্য পেতে চাইছ, সে কিন্তু জানে না কোন তথ্যটা তোমার কেসে মূল্যবান বা প্রয়োজনীয়। কাজেই আমার স্লোগান হল, প্রাণ খুলে বলতে দাও। তারপর তুমি সেইসব কথা থেকে তোমার দরকারি জিনিসটা বেছে কুড়িয়ে নাও।
বাপস! পুলিশ এ পদ্ধতিতে চললে একেকটা কেসে দশ বছর লেগে যাবে চার্জশিট দিতে।
কর্নেল চোখ বুজে সিটে হেলান দিয়েছেন। ঠোঁটে চুরুটটা কামড়ানো। সেই অবস্থায় বললেন, ঊর্মির সুটকেসের ব্যাপারটা আরও জট পাকিয়ে তুলল। দেখছি।
খুনী ওই বাড়িতেই আছে–দেখবেন। কারণ মাত্র পাঁচ মিনিটের সুযোগে বাইরের কেউ একাজ সারতে পারে না। তাছাড়া দরজার একটা নকল চাবি করা তার পক্ষেই সম্ভব।
কো-অপারেটিভ অফিসে মাস্টার কি আছে কি না জানো?
থাকতেও পারে। অনেক বাড়িতে আজকাল থাকে। খোঁজ নেব।
স্যুটকেসে কি এমন কিছু ছিল, যা খুনীকে চিনিয়ে দিতে সাহায্য করত? কর্নেল স্বগতোক্তি করলেন। তাছাড়া ওটা চুরির কারণ কী থাকতে পারে?.. হুঁ স্যুটকেসটা একটা প্রব্লেম এনে ফেলল।
অরিজিৎ বললেন, সমস্যা হল, অতগুলো ফ্ল্যাট সার্চ করা একটা বিরাট ঝামেলার ব্যাপার। তাছাড়া অনেক প্রভাবশালী লোকও আছে। দেখুন না, লাইটারের হাতের ছাপের সঙ্গে মৃগাঙ্কবাবুর হাতের ছাপ মেলেনি। কিন্তু যদি ও বাড়ির অন্যান্য লোকের হাতের ছাপ মিলিয়ে দেখার সুযোগ পেতাম–আমার ধারণা, ঠিক লোকটি বেরিয়ে আসত। কিন্তু সেও বড় অসুবিধার ব্যাপার। প্রায় অসম্ভব। মৃগাঙ্কবাবুর মামা মিনিস্টার। অনেকের মামা হয়তো তার চেয়েও ভি আই পি।
অরিজিৎ হাসতে লাগলেন। একটু পরে চোখে ঝিলিক তুলে বললেন ফের, লেকভিলার একটা খালি ফ্ল্যাটে আপনার বসবাসের ব্যবস্থা করতে পারি। থাকবেন নাকি?
কর্নেল মাথা দোলালেন। না ডার্লিং! বরং তুমি তোমার কোনো লোককে সপরিবারে ওখানে ঢোকানোর ব্যবস্থা করো। তাতে বেশি কাজ হবে।
সিরিয়াসলি বলছেন কি?
কর্নেল চোখ বুজে আছেন। ঠোঁটে কামড়ানো চুরুট। জবাব দিলেন না।
রাসবিহারী অ্যাভেনিউয়ের মোড়ে মিছিল চলেছে। প্রবল স্লোগানের চাপে কথা বলা মুশকিল।
ভবানীপুরে পৌঁছে একটা গলির মুখে গাড়ি রেখে এগিয়ে গেলেন দুজনে। পুরনো একটা দোতলা বাড়ির বারান্দায় উঠে নক করলেন অরিজিৎ। একটু পরে এক প্রৌঢ়া দরজা খুলে বললেন, কাকে চান?
বনবিহারীবাবু আছেন কি?
আছেন। আপনারা কোত্থেকে আসছেন?
ওঁকে বলুন অরিজিৎ লাহিড়ী এসেছেন। বললেন বুঝবেন।
একটু পরে ঊর্মির মামা বনবিহারীবাবু এসে সসম্মানে অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। বসবার ঘরে জীর্ণতা দাঁত বের করে আছে। মাথার ওপরকার ফ্যানটা পুরনো। নিচের সোফা জীর্ণ। বনবিহারীবাবু মোটাসোটা লম্বাটে চেহারার মানুষ। মুখে অমায়িকতা ঝলমল করছে। বয়স ষাটের কাছাকাছি। কিন্তু সমর্থ শরীর। মাথার চুল বাবরি করে রাখা। খাড়া নাক। পোড়খাওয়া মুখের চামড়া। পুরুষ্টু গোঁফ। চোখদুটো কয়রা। সব মিলিয়ে হিন্দুস্থানী চেহারার ছাপ চোখে পড়ে। কর্নেল বললেন, আপনার ভগ্নীপতি রুদ্রেন্দুবাবু সম্পর্কে কিছু কথা জানতে এসেছি।
বেশ তো। বলুন কী জানতে চান?
বাই দা বাই, আপনি নিশ্চয় সঙ্গীত চর্চা করেন?
বনবিহারীবাবু হাসলেন। আমার চুল দেখে বলছেন তো? আমি–
না। আপনার আঙুল দেখে। আপনি সেতারশিল্পী।
নিজের ডান তর্জনী দেখে নিয়ে বনবিহারীবাবু বললেন, ওই একটু আধটু– মানে একসময় ভীষণ রেওয়াজ করেছি-টরেছি। এখন বিশেষ না। তাছাড়া সাংসারিক প্রব্লেম। বনবিহারীবাবুর হাসিটা কমে একটু বিষণ্ণতা ঘনিয়ে এল মুখে। ভাগলপুরে থাকার সময় একটু নামটামও হয়েছিল। কিন্তু সবাইকে সবকিছু সয় না। হঠাৎ আঙুলটাতে ক্র্যাম্প হয়ে গেল। মেজরাব পরলেই ব্যথা করে।
আপনি ভাগলপুরে ছিলেন?
আমার পৈতৃক বসবাস ওখানেই। কলকাতায় চলে এসেছি বছর বিশেক হবে। স্বাধীনতার পর ওখানকার লোকজন ও পরিবেশ খুব বদলে যাচ্ছিল। চলে। এসেছিলাম অগত্যা। এই বাড়িটা ছিল এক মুসলমান ভদ্রলোকের। ভাগ্যিস বুদ্ধি, করে কিনে নিয়েছিলাম। নৈলে এ বয়সে ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হত।
রুদ্ৰেন্দুবাবুদের শুনেছি জমিদারি ছিল সেতাপগঞ্জে?
ছিল। খুব দাপটে রাজত্ব করেছে একসময়। তারপর অবস্থা পড়ে গিয়েছিল রুদ্রদার আমলে। ভাগলপুরে থাকার সময়ই ওঁদের সঙ্গে আমাদের ফ্যামিলির আত্মীয়তা হয়।
রুদ্ৰেন্দুবাবুও শুনেছি খুব তেজী লোক ছিলেন?
একটু হাসলেন বনবিহারীবাবু। সেই তেজেই শেষে প্যারালেসিস। তাছাড়া আর কী বলব?
কিন্তু উনিও ওঁর মেজমেয়ের মতো খুন হয়েছেন?
বনবিহারীবাবু গম্ভীর হলেন সঙ্গে সঙ্গে। একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ব্যাপারটা খুব মিসট্রিয়াস, জানেন? বিহারের আবহাওয়াই অন্যরকম। পুলিশের ব্যাপার-স্যাপারও অন্যরকম। নৈলে একটা ফয়সালা হয়ে যেত–খুনী ধরা পড়ত। হতভাগিনী মেয়েটাকেও ও ভাবে–
ঢোক গিলে শোকের আবেগ সামলে নিলেন। কর্নেল বললেন, আপনার ধারণা একই লোক বাবা ও মেয়েকে খুন করেছে?
বনবিহারীবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, রুদ্রদার অনেক শত্রু ছিল একসময়। তবে তারা বেশির ভাগই দেহাতী জোতদার। জমিজমা নিয়ে বিবাদ আর কী! কিন্তু একটা ব্যাপার আমার কাছে খুব অদ্ভুত লাগে। রুদ্রদাকে কোনো শত্রু খুন করতেই পারে। কিন্তু তাঁর তিন মেয়ের ভেতর বেছে শুধু মেজকেই সে খুন করল কেন! ঊর্মির তো বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল কম। ছোটবেলা থেকে বাইরে-বাইরে মানুষ। পাটনায় পিসিমার কাছে থেকে পড়াশুনো করেছে। যদুর মনে পড়ে, ক্লাস সেভেনেই ওকে সেতাপগঞ্জ স্কুল থেকে পাটনা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বি এ অব্দি সেখানেই পড়েছে। তারপর মাস চারেক মাত্র বাড়িতে ছিল। আমাকে লিখল কলকাতায় এসে এম এ পড়বে। গিয়ে নিয়ে এলাম ওকে।
শুনলাম, বড় বোনের নাকি দেবীর ভর ওঠে।
ওই এক ঝামেলা ওদের। একবার তো গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে ডুবে মরতে বসেছিল প্রায়। জেলেরা ভাগ্যিস দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে। ডাক্তাররা কেউ বলেন মৃগী, কেউ বলেন হিস্টিরিয়া। সব রকম চিকিৎসা তো হয়েছেই, এমন কী ওঝা-তান্ত্রিক-ফকির সে সবও যথেষ্ট হয়েছে। ঊর্মির খবর পেয়ে অপু–মানে ছোটবোন অপালা এসেছিল লাস্ট উইকে। তার কাছে শুনলাম, ওর বড়দির মাথায় নাকি একটুখানি জটা দেখা যাচ্ছে। ইদানীং শ্মশানের কাছে মন্দির তলায় গিয়ে নাকি বসেও থাকছে। বাড়ি আসতে চায় না।
জোরালো শ্বাস ছাড়লেন বনবিহারীবাবু। কর্নেল বললেন, বাড়িতে দুইবোন ছাড়া আর কে থাকেন?
ইন্দুবাবু-ইন্দুমাধব ভট্টাচার্য নামে একজন আছে। পুরনো আমলের কর্মচারী। সেই আগলে রেখেছে সংসারটাকে। আর ধরুন, শ্যামা নামে একজন চাকর। সেও আগের আমলের লোক। আর মনিয়া নামে আদিবাসী মেয়েটা–ঝি বলতে পারেন। আর একজন রাঁধুনী দয়াল নামে। ওড়িশার লোক। কানে কালা।
আপনি রুদ্ৰেন্দুবাবুর হাতের লেখা দেখলে চিনতে পারবেন? বনবিহারী। চমকে উঠে তাকালেন মুখের দিকে। তারপর মাথা একটু দুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ–পারি। কেন স্যার?
কর্নেল পকেট থেকে রুদ্রেন্দুবাবুর লেখা চিঠিটা এগিয়ে দিলেন ওর হাতে। অরিজিৎ অবাক। উঁকি মেরে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুখে উত্তেজনা থমথম করছে। বনবিহারীবাবু দ্রুত চিঠিটা পড়ে নিয়ে বললেন, রুদ্রদার হাতের লেখা। হ্যাঁ, রুদ্রদা খুন হওয়ার মাস দু তিন আগে থেকে বাড়িতে নাকি ভৌতিক উপদ্রব হচ্ছিল। আমাকেও লিখেছিল রুদ্রদা। কিন্তু আশ্চর্য তো! আমাকে আপনার কথা কিছু জানায়নি রুদ্রদা। শুধু লিখেছিল, ভৌতিক উপদ্রব হচ্ছে।
ভৌতিক উপদ্রব মানে?
বনবিহারীবাবু হাসবার চেষ্টা করলেন। দেখুন স্যার, আমি নাস্তিক মানুষ। ভূত-ভগবানে বিশ্বাস নেই। ওসব কোনো শত্রুর কারসাজি। বললাম না? জমিদারি রক্তের দাপটে রুদ্রদা অসংখ্য লোককে শক্ত করে ফেলেছিল।
কী উপদ্রব হত?
রাতবিরেতে ঢিল পড়ত। ওদের বাড়ির পেছনে বাগান আছে। এখন অযত্নে জঙ্গল হয়ে গেছে। সেখানে একটা ফোয়ারাও ছিল একসময়। মদ্যিখানে লাইমকংক্রিটের বেদির ওপর একটা বিদেশী স্কাল্পচার আছে। রুদ্রদার ঠাকুর্দরা আমলের। এখন ওটা বোঝাই যায় না কিসের মূর্তি ছিল। তো সেটা নাকি রাতে চলাফেরা করে বেড়াত বাগানে। রুদ্রদা একরাতে দেখতে পেয়ে বন্দুক নিয়ে। দৌড়ে যান। তারপর কিন্তু ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে পড়ে যান। ব্যস! সেই আছাড় খেয়ে একেবারে পক্ষাঘাত।
এ ব্যাপারে আপনার কী ধারণা বনবিহারীবাবু?
বনবিহারী গুম হয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর বললেন, কেউ রুদ্রদাকে ভয় দেখাত। তবে আমি একবার গিয়ে রাত্রি জেগে ওত পেতে থেকেছি। কিছু ঘটেনি, তেমন কিছু দেখিও নি।
রুদ্রবাবু খুন হন কীভাবে।
গত এগারো এপ্রিল ভোরে অপু বাবার ঘরে রোজকার মতো ফুল দিতে গিয়ে দেখে, রুদ্রদার ঘরের দরজা ফাঁক হয়ে আছে আর একটা হাত বেরিয়ে আছে। সে ভেবেছিল, বাবা বেরুতে গিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। কিন্তু কপাট ঠেলে দেখতে পায়, গলা ফাঁক হয়ে আছে। চাপচাপ জমাটবাঁধা রক্ত।
কর্নেল আনমনে বললেন, এগারো এপ্রিল! খুনীর কাছে এগারো তারিখটা পছন্দসই।
সেই প্রৌঢ়া মহিলা–বনবিহারীবাবুর স্ত্রী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ কথা শুনছিলেন। এবার চাপা গলায় উত্তেজিতভাবে বললেন, আগের সন্ধ্যার ঘটনাটা বলো ওঁদের! নৈলে বুঝবেন কী করে?
বনবিহারীবাবু বললেন, ও হ্যাঁ। আগের সন্ধ্যায় খুকু, মানে রুদ্রদার বড় মেয়ে শ্রাবন্তী বাগানে গিয়েছিল কী জন্য। হঠাৎ জোরে চেঁচিয়ে ওঠে। বাড়ির লোকেরা দৌড়ে যায়। গিয়ে দেখে খুকুর ভর উঠেছে। নাকিস্বরে সুর ধরে বলছে, আজ তোর শেষদিন রুদ্র…
তাই বুঝি? আশ্চর্য তো! অরিজিৎ বললেন।
হ্যাঁ। গিয়ে ইন্দুর কাছে সব শুনেছিলাম। তখন খুকুর কাছে সে ছিল। মানিয়া ছিল। শ্যামা ছিল। অপুও দাঁড়িয়ে শুনেছিল দোতলার বারান্দা থেকে। ওই এক কথা–আজ তোর শেষদিন রুদ্র। বারবার ওই কথাটা বলছিল খুকু। পরে যখন। জ্ঞান ফিরল, তখন জিগ্যেস করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কিছু জানে না।
কর্নেল বললেন, সেরাতে কোনো প্রিকশান নেওয়া হয়নি?
খুকুর কথায় গুরুত্ব দেওয়ার কারণ ছিল না। ভর ওঠার সময় সে বাবাকে নাম ধরে অশ্লীল গালাগালি করত। শাসাত। কাজেই ওর ওসব কথা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। বরং সবাই হাসাহাসি করত। রুদ্রদাও।
এতক্ষণে চা এবং প্লেটে সন্দেশ বিস্কুট নিয়ে এল ফ্ৰকপরা একটি মেয়ে। বাড়িতে কাজকর্ম করে এমন মেয়ে। সে প্যাটপ্যাট করে দাড়িওলা কর্নেলকে দেখতে থাকল। প্রৌঢ়া ধমক দিলে সে ফিক করে হেসে চলে গেল।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, কোনো দুর্বোধ্য কারণে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের আমি দ্রষ্টব্য।
অরিজিৎ মন্তব্য করলেন, সান্তা ক্লজ মনে করে আর কী! জ্যান্ত সান্তা ক্লজ!
বনবিহারীবাবু বললেন, ওনাকে দেখলে সায়েব মনে করে, তাই। সায়েবরা এখনও এদেশের ছোটদের কাছে আজগুবি মানুষ।
আমি খাঁটি বাঙালি। বলে কর্নেল চায়ে বিস্কুট ডোবালেন। তারপর ছোটদের মতো চুষতে থাকলেন। শাদা দাড়িতে গলিত বিস্কুট মেখে গেল। টের পেলেন না।
চা খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল। অসংখ্য ধন্যবাদ বনবিহারীবাবু। চলি, পরে আপনাকে আবার দরকার হতেও পারে। তবে আপাতত অনেক খবর পাওয়া গেল আপনার কাছে।
বনবিহারীবাবু করযোড়ে বললেন, একটা অনুরোধ স্যার। আপনারা বিহার পুলিশকে একটু তাগিদ দেবার ব্যবস্থা করুন। আমার বিশ্বাস খুনী ধরা পড়ে যাবে।
অরিজিৎ বললেন, তা আর বলতে! এই ব্যাকগ্রাউন্ডটা আমাদের দেয়নি ওরা। দেখি, এবার কতটা এগোনো যায় নতুন অ্যাঙ্গেলে।
কর্নেল দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে বললেন, বনবিহারীবাবু, আর একটু কথা।
বলুন স্যার!
প্লিজ স্যার-ট্যার বলবেন না। আমি সাধারণ মানুষ আপনার মতোই। শুধু কর্নেল বললেই আমি খুশি হই। কর্নেল নিভন্ত চুরুট জ্বেলে নিলেন। কথাটা হল ঊর্মি সম্পর্কে। ঊর্মিকে কেন বাইরে রেখে পড়াশুনো করানো হয়েছিল? নিশ্চয় জানেন আপনি।
বনবিহারীবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, তিন বোনই কমবেশি তেজী আর ডানপিটে মেয়ে। ঊর্মি একটা বয়স পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ডানপিটে প্রকৃতির ছিল। এখন যেমন অপু হয়েছে।
শুধু কি এটাই কারণ?
প্রৌঢ়া এটু রাগ দেখিয়ে বললেন, বলতে তোতলামি করছ কেন? গুণের ভাগ্নী সব! দেখো, আরও কী বরাতে আছে ওদের!
বনবিহারীবাবু অপ্রস্তুত হয়েছিলেন। সামলে নিয়ে বললেন, আসলে ঊর্মির একার দোষ ছিল না। ওদের প্রতিবেশী ছিলেন এক বাঙালি ভদ্রলোক। তিনি ছিলেন ডাক্তার। তার ছেলেটা ছিল হাড়ে বজ্জাত প্রকৃতির। তারই অত্যাচারে রুদ্রদা টুকু–মানে ঊর্মিকে পাটনায় রেখে আসেন। নৈলে কবে ইলোপ করে ফেলত।
আপনি চিনতেন ডাক্তারের ছেলেকে?
খুব চিনতাম। এখন অবশ্য ভীষণ বদলে গেছে। একদিন দেখা হয়েছিল ওমাসে। প্রণাম করল পায়ে হাত দিয়ে। বলল, কোল ইন্ডিয়ায় অফিসার হয়ে কলকাতা অফিসে আছে।
কোল ইন্ডিয়ায় অফিসার? কর্নেল অরিজিতের দিকে তাকালেন।
অরিজিৎ বললেন, কী নাম বলুন তো?
ডাকনামটা মনে আছে–হিম। আসল নামটা কী যেন…পেটে আসছে, মুখে আসছে না।
কর্নেল বললেন, হিমাদ্রি রায়?
বনবিহারীবাবু নড়ে উঠলেন। হিমাদ্রিই বটে। ওর বাবার নাম ছিল ডাঃ নিরঞ্জন রায়। একমিনিট! একটা কার্ডও দিয়েছিল। দাঁড়ান, আছে নাকি খুঁজে দেখি।
বনবিহারীবাবু ভেতরে গেলেন। একটু পরে একটু কার্ড নিয়ে বেরিয়ে এলেন। হ্যাঁ–এই যে। বাসার ঠিকানা, ফোন নম্বর সবই আছে। কিন্তু…
কর্নেল কার্ডটা দেখে অরিজিৎকে দিলেন। তারপর বললেন, কিন্তু কী বনবিহারীবাবু?
সে কেন এতকাল পরে খুনোখুনি করতে যাবে? সে-সব ঘটনা দশ-বারো বছর আগের ব্যাপার। তখন ঊর্মি যেমন, তেমনি হিমুরও বয়স কম ছিল। নেহাত দুষ্টুমি করা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে কী জানেন? আজকাল যা হয়েছে, কাউকে চেনা কঠিন।
অরিজিৎ বললেন, রুদ্ৰেন্দুবাবুর তো খুব দাপট ছিল। উনি হিমাদ্রিবাবুকে শায়েস্তা করতে পারেননি?
করেছিল বৈকি। অবস্থা এমন ঘোরালো করে তুলেছিল, ওদের বাড়ি বেচে চলে আসতে হয়েছিল সেতাপগঞ্জ থেকে।
তাহলে?
তাহলেও হিমাদ্রি খুন করবে? কিছু বলাও যায় না অবশ্য।
বনবিহারীবাবুর স্ত্রী ঝাঁঝালো স্বরে মন্তব্য করলেন, সবাই তো তোমার মতো করুণার অবতার নয়! কার পেটে কী থাকে তুমি জানো? ওঁদের কাজ ওনারা করুন। নাক গলাতে যেও না।….
গাড়িতে উঠে অরিজিৎ বললেন, পুরো ব্যাপারটা বিহারে চলে গিয়েছিল দেখে খুব মুষড়ে পড়েছিলাম। যাই হোক, কলকাতায় ফিরে এল শেষপর্যন্ত।
কর্নেল আস্তে বললেন, তোমরা কি হিমাদ্রিবাবুকে অ্যারেস্ট করবে?
কেন? আপত্তি আছে আপনা?
কর্নেল মাথাটা একটু দুলিয়ে বললেন, না। আপত্তি কিসের?..
.
নস্টালজিয়া
সুনেত্রা চিঠি পোস্ট করতে গিয়েছিল ডাকঘরে। ফেরার সময় গঙ্গার ধারে উঁচু বাঁধের ওপর পিচের রাস্তা ধরে আসছিল। এ সড়ক মুঙ্গের হয়ে চলে গেছে পাটনার দিকে। নিচে বর্ষার গঙ্গা ফুলে উঠেছে। ভাগ্যিস এবার বর্ষাটা কম। বেশির ভাগ সময় আকাশ পরিষ্কার, উজ্জ্বল রোদ্দুর–হঠাৎ কখনও একটুখানি মেঘ, তারপর ঝিরঝির করে বৃষ্টি কিছুক্ষণ।
আজ সকাল থেকে অবশ্য মেঘ করে আছে। হাল্কা সাদা মেঘ, কোথাও রঙটা সামান্য ধূসর। ভরা গঙ্গায় পাল উড়িয়ে নৌকো চলেছে। স্টেশনঘাটের নিচে অসংখ্য নৌকোর ঝক। দূরে চরের ওপর হঠাৎ রোদ্দুর আবার হঠাৎ মেঘের ছায়া খেলা করছে।
কর্নেল চিঠিটা পেয়ে অবাক হয়ে যাবেন হয়তো। কিন্তু গুরুত্ব দেবেন কি? বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো ইতিমধ্যে আবার কতবার আসতেন কর্নেল! বাবা। যেমন ছিলেন, তেমনি উনিও এক পাগলা মানুষ। পাখি-প্রজাপতির পেছনে সারাদিন টোটো করে মাইলের পর মাইল ঘুরে কী পান, কে জানে! সুনেত্রা লিখেছে, ডানায় হলুদ-লাল ফুটকিওয়ালা সেই কালো প্রজাপতিগুলো ইটখোলার জঙ্গলে বেরিয়ে পড়েছে। সেবার তো একটা ধরতেই হন্যে হয়েছিলেন। এবার একশোটা ধরতে পারবেন শুধু হাত বাড়িয়ে। জালের দরকার হবে না। আর উড্ডাকের কথা বলেছিলেন। শুশানের ওখানে আশ্বত্থ গাছে একজোড়া উড্ডাক এসে জুটেছে। চিঠি পেয়েই চলে না এলে পালিয়ে যাবে। লোকের যা অত্যাচার!
ঊর্মির অদ্ভুত চিঠিটার কথা সে লেখেনি। কর্নেল এলে তাঁকে দেখাবে। ঊর্মি বেচারীও ওর বাবার মতো মারা পড়ল। ঊর্মির জন্য বড় কষ্ট হয় সুনেত্রার। ছোটবেলায় দুজনে কী কাণ্ড না করে বেড়িয়েছে। আর হিমুদা! সে এসে জুটলে চলে যেত সেই ধোয়াড়ির দহে। সাঁতার শিখতে যেত লুকিয়ে। ফেরার পথে আস্তরের জঙ্গল হয়ে আসার সময় পাকা বৈঁচি পেড়ে খেত। মালা গেঁথে নিয়ে। আসত। কথাটা আস্তর নয়, আতর। ওই জঙ্গলে মাঝেমাঝে আতরের সুগন্ধ ওঠে। একবার ভরদুপুরে সেই গন্ধ পেয়ে ঊর্মি ভয়ে কাঠ। কিছুতেই তাকে আটকানো গেল না। বাড়ি ফিরে সুনেত্রা শুনল, ঊর্মিকে পেয়ারা গাছে বেঁধে খুব পিট্টি দিয়েছে ওর বাবা।
বরদাবাবু ছিলেন অন্যরকম মানুষ। সুনেত্রার এসব দুষ্টুমির প্রশ্রয় দিতেন বরং। রুদ্রবাবুকে বলতেন দেখবে, বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো না হয়। বেশি শাসন করলে একদিন মেয়ে দেখবে চম্বলের ডাকুরানী হয়ে উঠেছে।
সুনেত্রা জানে ঊর্মি যত বেপরোয়া ভাব দেখাক, সে ভেতর-ভেতর ছিল খুব ভীতু প্রকৃতির। পাটনা কলেজে পড়ার সময় মাঝেমাঝে বাড়ি আসত। তখন। অনেকটা বদলে গিয়েছিল। খুব ভদ্র আর স্মার্ট থাকার চেষ্টা করত! ইংরেজি বলত অনর্গল। সুনেত্রাও এখানকার মিশনারি স্কুলকলেজে পড়েছে। কিন্তু ইংরেজি বলতে খারাপ লাগে। বরং হিন্দিটাই বেশি বলে। বাংলা সামান্য পাড়ানো হত স্কুলে। বাবার তাগিদে বাড়িতে বাঙালি শিক্ষক রেখে শিখেছে। সেতাপগঞ্জে বাংলা স্কুলও ছিল। এখন সেটা হিন্দির চাপে প্রায় বদলে গেছে। অ্যাডিশনাল সাবজেক্ট হয়ে গেছে বাংলা। এখানে আর বাঙালিদের সে-প্রভাবও নেই। অনেকে চলে গেছে পশ্চিমবঙ্গে। শুধু যাদের জমিজমা আছে, কিংবা অন্য অসুবিধা, তারাই রয়ে গেছে।
সুনেত্রা রাস্তা থেকে ডাইনে ঘুরে রেলফটক পেরুনোর সময় হঠাৎ বৃষ্টি এসে গেল। ফটকের ঘুপটি ঘরটার পেছনে গিয়ে মাথা বাঁচাবে ভাবল। কিন্তু এই সাতসকালে ফটকওলার ঘর আর বারান্দাজুড়ে একদঙ্গল দেহাতী মুস্কো চেহারার লোক। একটা প্রকাণ্ড কালো কলসী থেকে সাদা তাড়ি ঢেলে গিলছে আর হাসাহাসি করছে। তারা সুনেত্রার দিকে অশালীন দৃষ্টে তাকাচ্ছিল।
সুনেত্রা হনহন করে সর্বমঙ্গলার মন্দিরতলায় গিয়ে ঢুকল। ওপরে প্রকাণ্ড বটগাছ। চারদিকে নিচু পাঁচিল। খুব পুরনো ভাঙাচোরা মন্দির চত্বরের আটচালাটা এবার বর্ষার মুখে ব্যবসায়ীরা মেরামত করে দিয়েছেন। তার তলায় গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে উঠল সুনেত্রা।
একটা থামে হেলান দিয়ে পিছন ফিরে কেউ সিগারেট টানছিল। মুখটা ঘুরিয়েছে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। গায়ে নীলচে টিশার্ট, ছাইরঙা প্যান্ট পরনে। দারুণ ঝকমকে চেহারা।
সুনেত্রা আধমিনিট পরে শুনল, তুমি বিবি না?
সুনেত্রা হেসে ফেলল। হিমুদা!
হিমাদ্রি হাসতে হাসতে বলল, মেয়েদের ঝটপট সবকিছু বদলে যায়। ইশ! তুমি তো একেবারে মহিলা হয়ে উঠেছ বিবি!
সুনেত্রা অবাক চোখে ওকে দেখছিল। বলল, কবে এসেছ তুমি। আমাদের বাড়ি যাওনি কেন? কতবছর পরে তোমাকে দেখছি বলো তো!
হিমাদ্রি বলল, পাটনা গিয়েছিলাম অফিসের কাজে। কলকাতা ফেরার সময় হঠাৎ নেমে পড়েছি গতকাল। জন্মভূমি দর্শনের ইচ্ছে হল।
আশ্চর্য! উঠেছ কোথায়?
স্টেশনে রেস্টরুমে। ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার ট্রেনে ফিরে যাব ভাবছি।
যাওয়াচ্ছি! চলো, ব্যাগেজ নিয়ে আমাদের বাড়ি যাবে।
আরে! বৃষ্টির মধ্যে–একটু দাঁড়াও। বৃষ্টি ছাড়ুক, তারপর দেখা যাবে।
সুনেত্রা উঁকি মেরে আকাশ দেখল। তারপর হিমাদ্রির দিকে ঘুরে মুখ টিপে হাসল। আশ্চর্য! তুমি কাউকে দেখা না করে চলে যেতে? আজিব আদমি!
হিমাদ্রি হাসতে লাগল। এখনও খোট্টাই চাল বজায় রেখেছ, বিবি!
মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। যস্মিন দেশে যদাচার। সুনেত্রা একটু গম্ভীর হল হঠাৎ। হিমুদা, তুমি জানো, টুকুর বাবা মার্ডার হয়েছে–লাস্ট এপ্রিলে?
জানি। টুকুও তো একইভাবে
ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত। তাই না? তারিখ সেই এগারো!
হিমাদ্রি আস্তে বলল, হ্যাঁ। কিছু বোঝা যায় না।
সুনেত্রা চাপা গলায় বলল, গত শীতের সময় থেকে বসন্তনিবাসে অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড হচ্ছিল। আমার খালি মনে হত, ওদের কিছু বিপদ ঘটবে। ঘটল।
হিমাদ্রি তাকাল। কেন মনে হত?
সুনেত্রা একটু চুপ করে থাকার পর বল, এ সবই রঘুনাথের কাণ্ড।
রঘুনাথ মানে?
রঘুয়া! সাহুজীর ছেলে। তোমার সঙ্গেও তো খাতির ছিল ওর।
ও, রঘুয়া! সে এখন কী করে? সে তো নকশাল ছিল একসময়।
কিছুদিন খুব পলিটিকস করে বেড়াচ্ছিল। টুকুর বাবার সঙ্গে জমিটমি নিয়ে খুব লড়াই করেছিল। তারপর একটা ডাকাতি কেসে ফেঁসে গিয়েছিল–আমার ধারণা, রুদ্রজ্যাঠাই এর পেছনে ছিলেন। গত পুজোর সময় শুনলাম, জেল থেকে পালিয়ে গেছে ও।
হিমাদ্রি হাসবার চেষ্টা করল। কিন্তু সে ঊর্মিকে খুন করবে কেন?
সুনেত্রা ফিসফিস করে বলল, কিছুদিন আগে টুকুর একটা চিঠি পেয়েছিলাম। লিখেছিল, ওর বরের সঙ্গে কোন হোটেলে একটা পার্টিতে গিয়ে সেখানে। রঘুনাথকে দৈখেছে। ভয় পেয়ে শরীর খারাপ করছে বলে চলে আসে টুকু।
হিমাদ্রি একটু উত্তেজিতভাবে বলল, রঘুয়াকে ঊর্মির অত ভয় পাবার কারণ কী?
সুনেত্রা তাকাল বড়ো বড়ো চোখে। তুমি জান না?
কী?
সুনেত্রা আবার ফিসফিস করে বলল, রঘুনাথের সঙ্গে টুকুর রিলেশান ছিল পাটনায় থাকার সময়। রঘুনাথও তো পাটনা কলেজে পড়ত। ওদের ঝি মনিয়াবুড়ির কাছে শুনতাম এসব। রঘুনাথ নাকি রুদ্রজেঠুকে সামনাসামনি বলেছিল টুকুর সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। রুদ্রজেঠু ওকে গুলি করতে বন্দুক বের করেছিলেন পর্যন্ত।
হিমাদ্রি বাঁকা মুখে বলল, ছেড়ে দাও! ঊর্মি ভাল মেয়ে ছিল না–সে তুমিও যেমন জান, আমিও তেমনি জানি।
বৃষ্টিটা থেমে গেছে। সুনেত্রা বলল, চলো স্টেশনে যাই হিমুদা! জিনিসপত্র নিয়ে রিকশো করে–
কিন্তু আমার যে ছুটি নেই!
সুনেত্রা নিঃসঙ্কোচে তার হাত ধরে টানল। ছোড়ো জী! বলেই সে ঘুরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। মা তোমাকে দেখলে ভীষণ খুশি হবে। প্রায়ই তোমাদের কথা বলে।
হিমাদ্রি মুখে আনন্দ আর স্বস্তিটা প্রকাশ করতে পারছিল না। রেস্টরুমে ব্যাগেজ রেখে সে আসলে মনস্থির করতে এসেছিল নির্জনে। বুঝতে পারেনি, কোথায় কার বাড়ি উঠবে, তারা কীভাবে নেবে তাকে। তার এখানে কিছুদিন থাকা দরকার। ঊর্মি বা তার বাবার খুনী কে, সেটা খুঁজে বের করার তাগিদ সেই ভয়ঙ্কর সন্ধ্যার পর থেকে তার মাথায় ঢুকে গেছে। হয়তো আত্মরক্ষার স্বার্থেই। তার বিশ্বাস, পুলিশ তার সেদিন ওই ফ্ল্যাটে উপস্থিতির সূত্র যদি পায়ও কোনোভাবে, তার কাছে আসার আগেই সে খুনীকে ধরে ফেলতে পারবে।
সুনেত্রা অনর্গল কথা বলতে বলতে হাঁটছিল রেললাইন ধরে। হিমাদ্রি শুনছিল না। দেখছিল–মনের ভেতর আঁধারে একটা আবছা মূর্তি। তার হাতে ঠাণ্ডা নীল একটুকরো ইস্পাতের ফলা।……
.