বুড়ো বৈজ্ঞানিকের বিকট বিটলেমি
[ দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ক্রিপিং ম্যান ]
বিশ বছর আগে প্রফেসার প্রেসবুরিকে ঘিরে অনেক কুৎসিত গুজব দানা বেঁধে উঠেছিল ইউনিভার্সিটিতে। শিউরে উঠেছিল লন্ডনের বিদগ্ধ মহল। শার্লক হোমস বরাবর বলেছে, জঘন্য এই গুজবের অবসান ঘটানোর জন্যেই বিচিত্র সেই কাহিনি জনসমক্ষে হাজির করা দরকার। কিন্তু কিছু অন্তরায়ের জন্যে তা পারিনি। টিনের বাক্সে শার্লক হোমসের অনেক আশ্চর্য অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে এই কাহিনিও বন্দি হয়ে পড়ে ছিল এতদিন। সম্প্রতি অনুমতি মিলেছে ব্যাপারটা সবাইকে জানানোর। প্র্যাকটিস থেকে রিটায়ার করার আগে হোম, যে-কটা কেস তদন্ত করে গিয়েছিল এটি সেইসবের অন্যতম। বিশ বছর পরেও কিন্তু সব কথা খোলাখুলি বলা যাচ্ছে না সংগত কারণেই রেখে ঢেকে বলতে হচ্ছে।
১৯০৩ সালের সেপ্টেম্বরের গোড়ায় এক রোববারের সন্ধ্যায় একটা চিরকুট পেলাম হোমসের কাছ থেকে। এখুনি এসো–যদি সুবিধে হয় এবং সুবিধে করে নেওয়া যদি সম্ভব হয়। শা হো। হোমসের সঙ্গে সে সময়ে আমার সম্পর্কটা বড়ো বিচিত্র রূপ নিয়েছিল। হোমস বরাবরই অভ্যেসের দাস–আমিও পড়ে গিয়েছিলাম তার মধ্যে। তামাক, কালোপাইপ, বেহালা, ইনডেক্স বুক এবং অন্যান্য হাবিজাবি বস্তু থেকে একটু পৃথক সত্তা ছিল আমার। দৌড়ঝাঁপের কেসে বিশ্বাসী সঙ্গীর দরকার পড়লেই আমি ছাড়া চলত না। এ ছাড়াও আমাকে দিয়ে ওর কাজ হত অনেক। আমি ছিলাম ওর মনের শানপাথর। উদ্দীপ্ত করে ছাড়তাম। আমি সামনে থাকলেও মনের চিন্তা প্রকাশ করত মুখ দিয়ে। আমি শুনতাম এবং বাগড়া দিতাম। আমার শ্লথগতি চিন্তাশক্তি ওকে খেপিয়ে তুলত, ফলে অগ্নিশিখার মতো সহজাত অনুভূতি আরও লকলকিয়ে উঠে ভেতর থেকে দ্রুত টেনে আনত স্পষ্টতর মানসছবিকে। মিলেমিশে তদন্তে নামলে এইভাবেই আমার দানহীন ভূমিকা পালন করে যেতাম আমি।
বেকার স্ট্রিটে পৌঁছে দেখলাম আর্মচেয়ারে বসে পা গুটিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে পাইপ কামড়ে কপাল কুঁচকে কী যেন চিন্তা করছে হোমস। নিশ্চয় বিরক্তিকর কোনো সমস্যায় জর্জরিত হয়ে রয়েছে। হাত নেড়ে আমার প্রিয় চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করল বটে, তারপর ঝাড়া আধঘণ্টা আমার দিকে ফিরেও তাকাল না–অস্তিত্বই যেন ভুলে গেছে মনে হল। তারপরেই অবশ্য ঝুঁকি দিয়ে ভঙ্গ করল তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা অভ্যেসমতো খেয়ালি হাসি হেসে সাদর সম্বর্ধনা জানাল আমাকে আমারই একদা আস্তানায়।
বললে, ভায়া ওয়াটসন, কিছু মনে কোরো না। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। গত চব্বিশ ঘণ্টায় বেশ কয়েকটা অদ্ভুত ঘটনা হাজির করা হয়েছে আমার সামনে। ভাবছি, গোয়েন্দাগিরিতে কুকুরের ভূমিকা সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লিখব।
আমি বললাম, কিন্তু হোমস, এ নিয়ে তো আগেও অনেক লেখা হয়ে গেছে। ব্লাডহাউন্ড—স্লুথহাউন্ড—
না, না, সে-ব্যাপারের কথা বলছি না। ও তো আছেই। আমি যা বলছি, তা আরও সূক্ষ্ম। মনে পড়ে, একটা কেসে আত্মতুষ্ট পরম সম্মানীয় এক ভদ্রলোকের অপরাধী স্বভাবচরিত্রের কথা বলে দিয়েছিলাম তারই ছেলের মন পর্যবেক্ষণ করে?
মনে আছে।
কুকুরদের নিয়েও ঠিক একই লাইনে ভাবছি। ফ্যামিলি লাইফের প্রতিফলন ঘটে কুকুরদের স্বভাবচরিত্রে। গোমড়া ফ্যামিলিতে আমুদে কুকুর কি দেখা যায়? সুখী পরিবারের বিষণ্ণ কুকুর কখনো দেখেছ? যাদের স্বভাব দাঁত খিচিয়ে তেড়ে আসা, তাদের কুকুররাও দাঁত খিচিয়ে তেড়ে আসতে শেখে। বিপজ্জনক ফ্যামিলির কুকুররাও বিপজ্জনক হয়। কুকুরদের মেজাজে তাদেরই মেজাজের প্রতিফলন ঘটে!
মাথা নেড়ে বললাম, কিন্তু একটু দূরকল্পনা হয়ে যাচ্ছে।
টিপ্পনী কানে তুলল না হোমস। পাইপে তামাক ভরে ফের গুটিসুটি মেরে বসল চেয়ারে। যা বললাম তা খেটে যায় হাতের কেসে। সমস্যাটা জট পাকানো। একটা প্রশ্নের মধ্যে হয়তো একদিনের খেই পাওয়া যেতে পারে। প্রশ্নটা এই : প্রফেসর প্রেসবুরির একান্ত অনুগত নেকড়ে-কুকুর তাঁকেই কামড়াতে গেল কেন?
তুচ্ছ এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার জন্যে হোমস চিঠি পাঠিয়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে বুঝে মেজাজ খিঁচড়ে গেল। বিলক্ষণ নিরাশ হলাম। অপাঙ্গে আমার নৈরাশ্য নিরীক্ষণ করে হোমস বললে, কিছুই পালটাওনি দেখছি! ওয়াটসন আগে যা ওয়াটসন এখনও তাই। ছোটোখাটো। ব্যাপারের মধ্যেই যে গুরুতর সমস্যা লুকোনো থাকে, এই সোজা তত্ত্বটা এতদিনেও শিখলে না। প্রেসবুরির নাম নিশ্চয় শুনেছ? ক্যামফোর্ড ফিজিয়োলজিস্ট। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। ধীর। স্থির গম্ভীর প্রকৃতির মানুষটার প্রাণের বন্ধু বলতে একটা উলফ-হাউন্ড–মনিব অন্ত প্রাণ তার। হঠাৎ এই কুকুর যদি দু-দুবার তেড়ে যায় মনিবকে কামড়ানোর জন্যে, জিনিসটা কি অত্যন্ত অদ্ভুত বলে মনে হয় না? তোমার কী মনে হয়?
শরীর খারাপ হয়েছে কুকুরের।
খুব সংগত সম্ভাবনা। পরে ভেবে দেখা যাবেখন। কিন্তু আপাতত বলো, আর কাউকে সে তেড়ে যায় না কেন, অথবা সবসময়েই নিবকে ঘঁাক করে কামড়াতে যায় না কেন–যায় শুধু বিশেষ উপলক্ষ্যে। অদ্ভুত, ভায়া ওয়াটসন খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। মিস্টার বেনেট ছোকরা দেখছি। একটু আগেই এসে গেলেন–ঘণ্টাটা নিশ্চয় উনিই বাজাচ্ছেন। ভেবেছিলাম তার আগেই তোমার সঙ্গে একটু কথা বলে নেব।
বলতে বলতেই সিঁড়িতে দ্রুত পদশব্দ এবং পরক্ষণেই আঙুলের গাঁট ঠোকার জোরালো শব্দ শোনা গেল দরজায় এবং ঘরে আবির্ভূত হলেন নতুন মক্কেল। বয়স আন্দাজ তিরিশ। দীর্ঘ, সুশ্রী যুবক। জমকালো পরিপাটি বেশ। কিন্তু হাবভাবে ছাত্রসুলভ কুণ্ঠা আর জড়তা–সংসারের সংগ্রাম ঠেলে এগিয়ে যানেওয়ালা দুঁদে পুরুষ যেন নন। হোমসের সঙ্গে করমর্দন করে সবিস্ময়ে তাকালেন আমার দিকে।
বললেন, ব্যাপারটা কিন্তু তৃতীয় ব্যক্তির সামনে বলতে সংকোচ বোধ করছি। খুবই প্রাইভেট।
নির্ভয়ে থাকুন মশায়। ডক্টর ওয়াটসন বিবেচক পুরুষ। তা ছাড়া এ-কেসে ভঁর মতো সহযোগীর আমার দরকার।
বেশ তো, তাহলে আর আপত্তি কীসের। আমার দিক দিয়ে বলা উচিত বলে বললাম।
ওয়াটসন, ইনি বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক প্রফেসর প্রেসবুরির একমাত্র সহযোগী, মিস্টার ট্রেভর বেনেট। একই বাড়িতে থাকেন–প্রফেসরের মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথাও পাকা হয়ে গিয়েছে। সেইজন্যেই এত সতর্ক ঘরোয়া ব্যাপারে। যাক এখন অদ্ভুত রহস্যের সমাধান করা যায় কীভাবে ভাবা যাক।
ডক্টর ওয়াটসন সব জানেন তো?
বলবার সময় পেলাম না।
তাহলে আমি বলছি। সম্প্রতি আরও ঘটনা ঘটেছে।
আগের ঘটনাগুলো তাহলে আমাকে বলে ঝালিয়ে নিতে দিন। ওয়াটসন, প্রফেসরের খ্যাতি সারাইউরোপে। পড়াশুনা নিয়েই আছেন। আজ পর্যন্ত কোনো কেলেঙ্কারি তাঁর নামে শোনা যায়নি। বিপত্নীক। মেয়ের নাম এডিথ। অত্যন্ত কর্মঠ, বীর্যবান পুরুষ, যা করার সোজাসুজি করেন–ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মানুষ নন। যুদ্ধপ্রিয় পুরুষ বলতে যা বোঝায়, তাই। মাসকয়েক আগেও উনি তাই ছিলেন।
তারপরেই ঘটল অঘটন। একষট্টি বছর বয়েসে বিয়ে করবেন ঠিক করলেন প্রফেসর মরফির মেয়েকে। বিয়ের কথাও পাকা হয়ে গেছে। প্রফেসর মরফি কমপ্যারেটিভ অ্যানাটমি চেয়ারে আছেন–প্রফেসর প্রেসবুরির সতীর্থ। বুড়ো বয়েসের ভালো লাগার চাইতেও এ যেন এককাঠি বেশি যৌবনোচিত আবেগ, উন্মাদনায় যেন ফুটন্ত ভালোবাসা। প্রেমে পুঁদ হয়ে গিয়েছেন প্রফেসর। মেয়েটির নাম আলিস মরফি। দেহমনে সুঠাম নিটোল মহিলা। পুরুষচিত্তে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম। প্রফেসরের মোহিত হওয়াটা আশ্চর্য নয়। কিন্তু ফ্যামিলির কেউ এ-বিয়েতে সায় দিতে পারছে না।
বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, বললেন মক্কেল ভদ্রলোক।
ঠিকই বলেছেন। অস্বাভাবিক, অতিরিক্ত এবং একটু উদ্দাম ভালোবাসাই বলতে পারেন। পাত্রীর বাবার আপত্তি নেই। পাত্রীর নিজেরও আপত্তি নেই–যদিও তাকে বিয়ে করার জন্যে উপযুক্ত বয়েসের অনেকেই এগিয়ে এসেছে কিন্তু অন্যান্য দিক দিয়ে প্রফেসরের প্রেসবুরির সঙ্গে তাদের কোনো তুলনাই হয় না। প্রফেসরের বয়সটাই কেবল বেশি টাকা আছে কাড়ি কাড়ি।
এই সময়ে ঘটল প্রথমে রহস্যটা। যা কখনো করেন না, প্রফেসর তাই করে বসলেন। কাউকে না-জানিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন। ফিরলেন পনেরো দিন পরে। কাউকে বললেন না কোথায় গেছিলেন। ভাগ্যক্রমে মিস্টার বেনেটের এক বন্ধু প্ৰাহা থেকে চিঠি লিখে জানালেন, প্রফেসর প্রেসবুরিকে তিনি সেখানে দেখেছেন কিন্তু কথা বলার সুযোগ হয়নি। এইভাবেই তৃতীয় মুখে জানা গেল কোথায় গেছিলেন প্রফেসর প্রেসবুরি।
এরপর থেকেই প্রফেসর যেন আর আগের প্রফেসর রইলেন না–অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখা গেল তার মধ্যে। বেশ শঠ, ধূর্ত, গোপন, গুপ্ত হয়ে গেলেন। সব কিছুই যেন লুকিয়ে চুরিয়ে করতে পারলে বাঁচেন–যা তার স্বভাবের ঠিক উলটো। ধীশক্তি রইল আগের মতোই প্রখর, ধারালো। কলেজের বক্তৃতার ধারও কমল না। তা সত্ত্বেও বেশ বোঝা গেল, এ যেন আরেক প্রফেসর। একটা কুটিল বদ সত্তা যেন তাঁকে আশ্রয় করেছে। এ-মুখোশ ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছে নিজের মেয়ে বার বার চেষ্টা করেছে বাবার সঙ্গে আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু পারেনি! মিস্টার বেনেট নিজেও চেষ্টা করেছেন। এবার আপনিই বলুন চিঠিপত্রের ব্যাপারটা।
ডক্টর ওয়াটসন, প্রফেসর প্রেসবুরি আমাকে বিশ্বাস করতেন পুরোপুরি। সেক্রেটারি হিসেবে আমার যে-অধিকার ছিল, ওঁর ভাই বা ছেলে হলেও এত অধিকার পেতাম কি না সন্দেহ। ওঁর সমস্ত চিঠিপত্র আমি দেখতাম। কিন্তু প্রাহা থেকে ফেরার পর এ-ব্যবস্থা পালটে গেল। উনি আমাকে ডেকে বলে দিলেন লন্ডন থেকে স্ট্যাম্পের নীচে ক্রস চিহ্ন দেওয়া কতকগুলো চিঠি আসবে–আমি যেন তা না-খুলি। এ-রকম অনেক চিঠি হাত দিয়ে ওঁর কাছে পৌঁছেছে–অশিক্ষিত হাতে লেখা ঠিকানা –আর লেখা E. C.। জবাব যদিও-বা দিয়ে থাকেন প্রফেসর, সে-খাম আমার হাত দিয়ে যায়নি, বা সব চিঠি যেখানে জমা পড়ে, সেই বাস্কেটেও রাখেননি।
এবার বলুন বাক্সর ব্যাপারটা, বললে হোমস।
প্রফেসর প্রাহা থেকে একটা কাঠের বাক্স এনেছিলেন–জার্মানিতে যে ধরনের কাঠের কাজ চালু আছে–এ-বাক্সেও সেই কাজ দেখা যায়। যন্ত্রপাতি যেখানে থাকে, বাক্সটা রেখেছিলেন। সেখানে। একদিন একটা যন্ত্র খুঁজতে গিয়ে বাক্সটা যেই তুলেছি, অমনি তেড়ে এলেন প্রফেসর। হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন বাক্সটা এবং কড়া গলায় ধমকে উঠে বললেন, আর কক্ষনো যেন বাক্সে হাত না-দিই। আমি তো অবাক। মনে খুব লাগল। এভাবে কখনো উনি কথা বলেননি আমার সঙ্গে। যদিও বললাম হঠাৎ হাত লেগে গেছে কিন্তু উনি বিশ্বাস করলেন না। সারাক্ষণ আড়চোখে নজর রাখলেন আবার হাত দিই কি না দেখবার জন্যে। পকেট থেকে ডাইরি বার করলেন মিস্টার বেনেট, সেদিন ছিল দোসরা জুলাই।
চমৎকার! আপনার লেখা তারিখগুলো দেখছি কাজে আসবে। বললে হোমস।
গুরুর কাছে গুছিয়ে কাজ করতে শিখেছি অন্যান্য অনেক বিদ্যের সঙ্গে। যেদিন থেকে ওঁর মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করলাম, সেইদিন থেকে ওঁর সব কিছুই নজরে রাখব বলেই তারিখগুলোও পর পর লিখে রেখেছি। যেমন ধরুন, ওই দোসরা জুলাই তারিখেই স্টাডিরুম থেকে যেই হল ঘরে এলেন প্রফেসর, উলফ হাউন্ড রয় তেড়ে গেল তাকে কামড়ানোর জন্যে। সেই প্রথম, দ্বিতীয়বার কামড়াতে গেল এগারোই জুলাই। তারপর বিশে জুলাই। শেষকালে আস্তাবলে চালান করতে হল রয়কে। এত ভালো কুকুরটার এহেন অবস্থা ভাবাও যায় না–আমি কি বিরক্ত করছি আপনাকে?
মৃদু ভৎসনা মিশিয়ে শেষ কথাটা বললেন মিস্টার বেনেট। হোমস অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে। কড়িকাঠ দেখছে। শেষ কথাটা শুনেই সম্বিৎ ফিরে এল।
অদ্ভুত! আশ্চর্য! অসাধারণ! মিস্টার বেনেট, আপনার খুঁটিনাটি বর্ণনায় অশেষ উপকার হল আমার। অনেক নতুন ব্যাপার জানলাম। এ ছাড়াও নতুন কী ঘটেছে বলছিলেন যেন?
মুখটা কালো হয়ে গেল মিস্টার বেনেটের।
পরশু রাতের ঘটনা। রাত দুটোয় জেগে শুয়ে ছিলাম। এমন সময়ে প্যাসেজে চাপা আওয়াজ শুনলাম। দরজা খুলে উঁকি মারলাম। প্যাসেজের শেষ প্রান্তে প্রফেসরের শোবার ঘর—
তারিখটা? হোমসের প্রশ্ন।
স্পষ্টত বিরক্ত হলেন মক্কেল ভদ্রলোক। কথার মাঝে তুচ্ছ তারিখ জানার কোনো মানে হয়?
বললেন, বললাম তো পরশু রাতের ঘটনা। চৌঠা সেপ্টেম্বর।
বেশ বেশ, বলে যান।
প্যাসেজের এক প্রান্তে ওঁর শোবার ঘর, আরেক প্রান্তে সিঁড়ি। সিঁড়িতে যেতে হলে আমার ঘরের সামনে দিয়েই যেতে হয়। মিস্টার হোমস, ললাম খাড়া হয়ে গেল এই প্যাসেজের দিকে তাকিয়ে। একটিমাত্র জানলা দিয়ে আলো এসে পড়ছিল প্যাসেজে বাদবাকি অন্ধকার। আমি দেখলাম, হামাগুড়ি দিয়ে কে যেন এগিয়ে আসছে অন্ধকার প্যাসেজ বেয়ে আমার ঘরের দিকে। অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকারে গড়া যেন একটা প্রেতমূর্তি। আচমকা আলোর মধ্যে এসে পড়তেই দেখলাম সে কে। প্রফেসর প্রেসবুরি। হামাগুড়ি দিচ্ছেন মিস্টার হোমস প্রফেসর প্রেসবুরি হামাগুড়ি দিচ্ছেন! ঠিক হামাগুড়ি দেওয়া তাকে বলে না–হাঁটু টেনে টেনে আসছেন না–হাঁটছেন হাত আর পায়ের ওপর ভর দিয়ে, মুণ্ডুটা ঝুলছে দু-হাতের মধ্যে। সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে গেল ভয়াবহ সেই দৃশ্য দেখে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম তো রইলাম–উনি ওইভাবে চার হাত পায়ে হেঁটে আমার দরজা পেরিয়ে যেতেই সম্বিৎ ফিরল। পেছনে গিয়ে বললাম সাহায্য করতে পারি কি না। জবাবটা হল অসাধারণ রকমের। ছিলেছেড়া ধনুকের মতো ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠলেন প্রফেসর। তীক্ষ্ণ্ণ কর্কশ গলায় অত্যন্ত যাচ্ছেতাই ভাষায় যা মুখে এল তাই বলে গেলেন এবং ঝড়ের মতো দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ ফেরার পথ চেয়ে। ফিরলেন না দেখে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। মনে হয় ফিরেছিলেন ভোরের দিকে।
ওয়াটসন। তোমার কী মনে হয়? যেন একটা দুষ্প্রাপ্য নমুনা এগিয়ে দিচ্ছে প্যাথলজিস্ট এমনি ভঙ্গিমায় বলল হোমস।
বললাম, কোমরে বাত হয়েছে। ব্যথা বাড়লে এমনিভাবেই লোকে হাঁটে, মেজাজও তিরিক্ষে হয়ে যায়।
চমৎকার! কল্পনার ফানুসে চেপে জমিন ছেড়ে শূন্যে ভাসবার পাত্র তুমি নও। কিন্তু ভায়া কটিবাতের থিয়োরি এখানে অচল। কেননা, পরের মুহূর্তেই উনি সটান সিধে হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
মিস্টার বেনেট বললেন, ওঁর শরীরও ইদানীং খুব ভালো যাচ্ছে অত্যন্ত সুস্থ সবল জোয়ানের মতোই স্বাস্থ্য হয়েছে। এডিথ আর আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছি। বেশ বুঝছি একটা সর্বনাশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
ওয়াটসন, তোমার কী মত?
ডাক্তারে যা বলে, আমিও তাই বলব। ভালোবাসায় মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন হয়েছিল বলে প্রফেসর দেশভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। মাথা ঠান্ডা করার জন্যে। বাক্স আর গোপন চিঠির সঙ্গে টাকাপয়সার সম্পর্ক আছে–হয়তো ধার নিয়েছিলেন, নয়তো শেয়ার সার্টিফিকেট বাক্সের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন—
টাকাপয়সা নিয়ে এই লুকোচুরিও নিশ্চয় বরদাস্ত করতে পারেনি উলফ হাউন্ড–তাই ঘঁাক। করে কামড়াতে গিয়েছিল মনিবকে। না হে না, এর মধ্যে অন্য ব্যাপার আছে। আমি বলব—
যা বলতে যাচ্ছিল হোমস, তা আর বলা হল না ঘরের মধ্যে ঝড়ের মতো এক তরুণী ঢুকে পড়ায়। দেখেই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে দু-হাত সামনে বাড়িয়ে ধেয়ে গেলেন মিস্টার বেনেট, তরুণীও একই পোজে এগিয়ে এল মিস্টার বেনেটের দিকে।
এডিথ! কী ব্যাপার?
জ্যাক, আমি একা থাকতে পারলাম না। বড্ড ভয় করছিল। তাই চলে এলাম।
মিস্টার হোমস, ইনিই আমার ভাবী বউ–মিস এডিথ প্রেসবুরি।
সেইরকমই আঁচ করেছিলাম আমি আর ওয়াটসন। মিস প্রেসবুরি, নতুন কিছু ঘটল নাকি?
বড়ো সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে মিস্টার হোমস। আমার বাবাকে আপনি বাঁচান। সকাল হতেই শহরে এসে জ্যাকের হোটেলে গিয়ে যখন শুনলাম ও নেই, বুঝেছি আপনার কাছেই এসেছে।
কেস এখনও অস্পষ্ট, মিস প্রেসবুরি। নতুন কিছু ঘটে থাকলে বলুন।
কাল সারাদিন কীরকম যেন ছিল বাবা। ঘটনাটা ঘটল রাত্রে। এসব ঘটনা যখন ঘটে, তখন যেন বাবার খোলসটাই শুধু দেখি বাবার মধ্যে বাবা আর থাকে না। যেন অদ্ভুত ভীষণ একটা স্বপ্নের ঘোরে থাকে। পরে কী করছে-না-করছে কিছু মনে থাকে না।
কী হয়েছে বলুন।
কুকুরটার ভীষণ চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল গভীর রাতে। রয়কে এখন আস্তাবলের কাছে শেকলে বেঁধে রাখা হয়। বাবার পরিবর্তনের পর থেকেই ও-বাড়িতে ভয়ে ভয়ে থাকি বলে দরজায় তালা দিয়ে শুয়েছিলাম। জানলার খড়খড়ি একটু ফাঁক ছিল। বাইরে চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছিল। আমি সেইদিকে তাকিয়ে কুকুরটার ভীষণ চেঁচানি শুনছি এমন সময়ে চৌকোনা ফাঁকটায় কোত্থেকে এসে গেল বাবার মুখখানা! হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি শুয়েছিলাম তিনতলার ঘরে… শার্সির কাছে স্পষ্ট দেখলাম নাক মুখ চেপে আমাকে দেখছে বাবা… আর… এক হাত দিয়ে কাচটা ঠেলে তোলার চেষ্টা করছে। আতঙ্কে আমি কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম–কাচ খুলে ফেললে নির্ঘাত পাগল হয়ে যেতাম। চোখের ভুল নয়, ভয়ের চোটে ছায়া দেখেও আবোল-তাবোল বকছি মনে করবেন না–সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে গিয়েছিল বলে নড়তেও পারলাম না। চেয়ে রইলাম বাবার মুখের দিকে। হঠাৎ কাচ থেকে সরে গেল মুখখানা। আমি খাট থেকে ছিটকে গিয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মারতেও সাহস পেলাম না। ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম ভোরের আলো না-ফোঁটা পর্যন্ত। ব্রেকফাস্টের টেবিলে বাবাকে দেখলাম আঁঝালো চড়া মেজাজে রাতের ঘটনা নিয়ে কোনো কথাই বলল না। আমিও বললাম না। অছিলা করে শহরে চলে এলাম জ্যাকের কাছে।
শার্লক হোমস হাঁ হয়ে গেল অদ্ভুত এই কাহিনি শুনে।
বললে, তিনতলায় আপনার শোবার ঘর? বাগানে লম্বা মই নেই তো?
একদম না। তিনতলার জানলায় কোনোভাবেই ওঠা যায় না। তবুও দেখেছি বাবার মুখ।
তারিখটা দেখছি পাঁচুই সেপ্টেম্বর। ফলে আরও জট পাকিয়ে গেল ব্যাপারটা।
এবার হাঁ হওয়ার পালা মিস প্রেসবুরির।
মিস্টার বেনেট বললেন, এই নিয়ে দু-বার হল তারিখ নিয়ে কথা বললেন মিস্টার হোমস। আপনি কি তাহলে চন্দ্রকলার সঙ্গে উন্মত্ততার সম্পর্ক ভাবছেন?
না, না, একেবারে আলাদা লাইনে ভাবছি। আপনি বরং আপনার ডাইরিটা রেখে যাবেন–তারিখগুলো ভালো করে দেখতে হবে। ওয়াটসন, শুনলে তো বিশেষ বিশেষ তারিখে প্রফেসর প্রেসবুরি কী করেন, পরে আর মনে করতে পারেন না। এই বিস্মৃতির সুযোগ নিয়ে আমরা তাকে গিয়ে বলব, অমুক তারিখে তিনি আমাদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলেন, তাই এসেছি। সেই তারিখের কোনো কথাই মনে করতে পারবেন না বিশ্বাসও করবেন। সেই ফাঁকে কাছ থেকে তাঁকে স্টাডি করা যাবে।
মিস্টার বেনেট বললেন, উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু একটা ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিই। প্রফেসর প্রেসবুরি অত্যন্ত কোপন স্বভাবের মানুষ। মাঝে মাঝে মারদাঙ্গা রূপ ধরেন।
মৃদু হাসল হোমস, কিন্তু দেখা আমাকে করতেই হবে আর বেশি দেরি না-করে–কারণ আছে।
আস্তানা ছেড়ে হোমসের পক্ষে বেরোনো সহজ–কোনো বন্ধন তো নেই। কিন্তু আমার পক্ষে বেরোনো কঠিন অত পসার ফেলে। যাই হোক সোমবার সকালে ট্রেনে চেপে ক্যামফোর্ড পৌঁছে সেকেলে সরাইখানার চেকার্স-এ আমাদের সুটকেস জমা রাখলাম।
পকেট থেকে মিস্টার বেনেটের ডাইরি বার করে দেখে নিয়ে হোমস বললে, ২৬ অগাস্ট অদ্ভুত ঘোরে ভুগছেন তার মানে ওই তারিখে কিছুই তার মনে নেই। আমরা গিয়ে বলব অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলেন ২৬ তারিখে। লেকচার দেন এগারোটায় লাঞ্চের সময়ে বাড়িতেই পাব। চল।
ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি চেপে পৌঁছে গেলাম প্রাচীন কলেজের সারি পেরিয়ে ভারি সুন্দর একটা বাড়ির সামনে। প্রফেসর শুধু আরামেই যে থাকেন তা নয়–একটু বিলাসের মধ্যেই থাকেন বাড়ির চেহারা দেখলেই তা মালুম হয়। দরজা থেকেই দেখলাম জানলা দিয়ে আঁকড়া-চুলো এক বুড়ো কটমট করে দেখছেন আমাদের। অচিরে হাজির হলাম তার সামনে। চশমা ঢাকা চোখের মধ্যে পাগলামির ছায়াটুকুও দেখলাম না। বিরাট চেহারা। লম্বা, গভীর কলেজ প্রফেসরের মূর্তি যেমন হয়–ঠিক তাই। দুই চক্ষু কিন্তু আশ্চর্য রকমের তীক্ষ্ণ্ণ আর ধূর্ত। চামড়া কুঁড়ে যেন ভেতর পর্যন্ত দেখার ক্ষমতা রাখেন।
আমাদের কার্ড দেখলেন, বসতে বললেন। জিজ্ঞেস করলেন, আসা হয়েছে কেন।
হোমস হাসিমুখে বললে, সেটা তো আপনিই বলবেন।
আমি বলব!
আপনিই তো আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। খবর পেয়েই দৌড়ে এসেছি।
তাই নাকি। ধূসর চোখে ক্রূর নষ্টামির নাচ দেখলাম, আমি ডেকে পাঠিয়েছি! কে খবর দিল বলুন তো?
সেটা বলতে পারব না–কথা দিয়েছি। তবে যদি আমাদের দরকার আছে বলে মনে না। করেন, আসতে পারি।
যাবেন কী? ব্যাপারটা তলিয়ে আগে দেখি। চিঠিপত্র কিছু আছে? টেলিগ্রাম? আমি যে ডেকে পাঠিয়েছি, তার প্রমাণ?
কিছু নেই।
তার মানে আমি যে ডেকে পাঠিয়েছি সেটা প্রমাণ করতে চান না?
কোনো প্রশ্নের জবাব দোব না।
বটে! বটে! এ-প্রশ্নের জবাবটা কিন্তু এখুনি বের করা যাবে। বলেই ঘণ্টা বাজালেন প্রফেসর। ঘরে ঢুকলেন মিস্টার বেনেট।
বেনেট, হোমস নামে কোনো লোককে ডেকে পাঠিয়েছিলে চিঠি লিখে? এই দুই ভদ্রলোকের ধারণা নাকি আমি লন্ডন থেকে এঁদের ডেকে এনেছি।
আজ্ঞে, না, রক্তিম মুখে বললেন মিস্টার বেনেট।
ব্যস, তাহলে আর কোনো কথা নয়, জ্বলন্ত ক্রুদ্ধ চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে টেবিলের ওপর দু-হাতের ভর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে প্রফেসর বললেন, মশায়, এবার তো বেকায়দায় পড়লেন।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে হোমস বললে, অকারণে ঢুকে পড়ার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কী করতে পারি বলুন।
আচমকা চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠে চোখে-মুখে উৎকট বিদ্বেষ ছড়িয়ে আমাদের পথ রুখে দাঁড়ালেন প্রফেসর, যাবেন কোথা? জবাবদিহি না-করে বেরোতে পারবেন ভেবেছেন? অর্থহীন ক্রোধের নিদারুণ অভিব্যক্তি আর বিকট মুখভঙ্গিমা দেখে বেশ বুঝলাম গায়ের জোরে বেরোতে হবে বাড়ি থেকে। মিস্টার বেনেট মাঝে এসে না-দাঁড়ালে শেষকালে তাই করতে হত।
গলা ফাটিয়ে বললেন, করছেন কী? মানসম্মান জলাঞ্জলি দিতে বসেছেন দেখছি? টিটি পড়ে যাবে যে ইউনিভার্সিটিতে! মিস্টার হোমস বিখ্যাত মানুষ! দেশসুদ্ধ লোক তাঁকে চেনে। এ কী অসভ্যতা করছেন!
অপ্রসন্ন মুখে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন প্রফেসর। রাস্তায় বেরিয়ে এলাম দুই বন্ধু। হোমস। দেখলাম বেশ মজা পেয়েছে এই ঘটনায়।
বললে, ভদ্রলোকের নার্ভের অবস্থা শোচনীয়। কিন্তু যা জানবার জানা হয়ে গেছে। এ কী। ওয়াটসন, লোকটা আবার পেছনেও ধাওয়া করল নাকি।
খড়মড় আওয়াজ শুনলাম পেছনে। ঘুরে দেখি প্রফেসর নন, মিস্টার বেনেট দৌড়ে আসছেন। হাঁফাতে হাঁফাতে পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, দুঃখিত মিস্টার হোমস, সত্যিই দুঃখিত। ক্ষমা চাইছি।
মাই ডিয়ার স্যার, ক্ষমা চাওয়ার কোনো দরকারই নেই। এসবই পেশাদারি অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়ে।
এ-রকম বিপজ্জনক মেজাজে ওঁকে কখনো দেখিনি। দিন দিন মেজাজ সপ্তমে উঠছে। এখন বুঝলেন তো কেন ওঁর মেয়ে আর আমি দুজনেই এত ভয় পেয়েছি। অথচ মন দেখুন প্রফেসরের দিব্যি পরিষ্কার।
এক্কেবারে। হিসেবে ভুল করে ফেলেছিলেন এখানেই। কিছুই ভোলেননি–সব মনে রাখেন। ভালো কথা, মিস প্রেসবুরির ঘরটা দেখতে পারি?
ওই তো। বাঁ-দিক থেকে দ্বিতীয়।
সর্বনাশ! ওখানে ওঠা তো সোজা কথা নয়। জানলার ঠিক নীচে একটা লতা আর ওপরে একটা জলের পাইপ অবশ্য আছে।
থাকলেও ওই বেয়ে ওঠা আমার পক্ষেও সম্ভব নয়, মিস্টার হোমস।
ঠিক কথা। স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে কাজটা বিপজ্জনক।
প্রফেসর লন্ডনে যাকে চিঠি লেখেন, তার ঠিকানাটা পেয়ে গেছি। আজই লিখেছেন একটা চিঠি। ব্লটিং পেপারে ঠিকানাটা উঠে গেছে। আমি টুকে রেখেছি–এই দেখুন।
হোমস কাগজটা দেখে পকেটে রেখে বললে, ডোরাক নামটা কিন্তু অদ্ভুত। স্ল্যাভেনিক মনে হচ্ছে। মিস্টার বেনেট, আর কিছু করার নেই অপেক্ষা করা ছাড়া। প্রফেসর অন্যায় করেননি যে গ্রেপ্তার করব। পাগল নন যে ঘরবন্দি করব। এই অবস্থায় কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া যাবে না।
তাহলে?
ধৈর্য ধরুন। মঙ্গলবার একটা চুড়ান্ত সংকট দেখা যাবে আশা করছি–সেইদিন ফের আসব ক্যামফোর্ডে। তদ্দিন এই অবস্থা থেকে যদি দূরে সরে থাকতে চান মিস প্রেসবুরি থাকতে পারেন।
সে-ব্যবস্থা করা যাবে।
তাহলে তাই করুন। প্রফেসরকে এখন ঘাঁটাতে যাবেন না।
ওই যে বেরিয়ে এসেছেন দেখছি! চাপাগলায় বললেন মিস্টার বেনেট। ঝোঁপের ফাঁক দিয়ে দেখলাম সদর দরজার বাইরে এসে ইতিউতি তাকাচ্ছেন প্রফেসর–দু-হাত ঝুলছে সামনে। সাঁৎ করে সরে পড়লেন মিস্টার বেনেট। দূর থেকে দেখলাম যেন রুখে উঠলেন প্রফেসর। উত্তেজিতভাবে কথা বলতে বলতে দুজনেই ঢুকে পড়লেন বাড়ির মধ্যে।
হোমস পা বাড়িয়ে বললে, প্রফেসরের ব্রেন অত্যন্ত পরিষ্কার। বাড়ি বয়ে গোয়েন্দা এসেছে। দেখে সন্দেহ করেছেন সেক্রেটারিকে মিস্টার বেনেটের এখন সময় খুব খারাপ।
ফেরার পথে পোস্টঅফিস থেকে একটা টেলিগ্রাম পাঠাল হোমস। জবাব এল সন্ধে নাগাদ। আমিও পড়লাম, কমার্শিয়াল রোডে ডোরাকের সঙ্গে দেখা করলাম। সেয়ানা লোক। বোহেমিয়ার মানুষ। বয়স্ক। মনিহারি দোকান আছে। মার্সার।
হোমস বললে, তুমি আমাকে ছেড়ে ডাক্তারি আরম্ভ করার পর থেকে এই মার্সারকে দিয়ে অনেক খবর আমি জোগাড় করি। প্রফেসর কাকে চিঠি লেখেন জানা দরকার ছিল। লোকটা বোহেমিয়ার লোক প্রফেসরও প্রাহায় গিয়েছিলেন।
কিন্তু আমি তো কোনোটার সঙ্গে কোনোটার সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি না হোমস। তিরিক্ষে মেজাজের উলফ-হাউন্ডের সঙ্গে বোহেমিয়ায় যাওয়ার কী সম্পর্ক মাথায় আসছে না। অথবা এই দুইয়ের সঙ্গে সুস্থ-সবল এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের নিশুতি রাতে প্যাসেজে চার হাতপায়ে হাঁটার কী যোগসূত্র আছে, আমার ঘিলুতে প্রবেশ করছে না। সব চাইতে জটিল রহস্য হল তারিখ নিয়ে তোমার কচলাকচলি।
কথা হচ্ছিল সরাইখানায় বসে, এ-শহরের বিখ্যাত সুরার বোতল সামনে নিয়ে। হোমস দু-হাতের আঙুল একত্র করে ক্লাসরুমে বক্তৃতা দেওয়ার ঢংয়ে বলল, মিস্টার বেনেটের ডাইরি থেকে দেখা যাচ্ছে প্রফেসরের বিচিত্র উন্মত্ততার প্রথম ঝোক এসেছিল দোসরা জুলাই–তারপর থেকেই এই প্রকোপ দেখা গেছে ন-দিন অন্তর ব্যতিক্রম দেখা গেছে শুধু একবারই। শেষ আক্রমণটা ঘটেছে শুক্রবার তেসরা সেপ্টেম্বর। ২৬ অগাস্টও এই পর্যায়ের মধ্যে বেশ খাপ খেয়ে যাচ্ছে। একে কাকতালীয় বলা যায় না।
স্বীকার করতে বাধ্য হলাম আমিও।
হোমস বললে, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে ন-দিন অন্তর প্রফেসর এমন একটা কড়া ওষুধ শরীরে প্রবেশ করান যার প্রভাব ক্ষণস্থায়ী কিন্তু বিষাক্ত। ওঁর উগ্র স্বভাবের ইন্ধন জোগায় এই দ্রব্যটি। প্রাহায় থাকার সময়ে অভ্যেসটা রপ্ত করেছিলেন। লন্ডন থেকে এখন দ্রব্যটি জোগান দেয় একজন বোহেমিয়ার দালাল। সব মিলে যাচ্ছে তাই না?
কিন্তু কুকুর, জানলায় মুখ, প্যাসেজে চার হাতপায়ে হাঁটা?
আরে ভায়া, সবে তো শুরু করলাম। মঙ্গলবারে বোঝা যাবে কত দূর এগোলাম। আপাতত বেনেট ছোকরা কী খবর দিতে পারে দেখা যাক। আর এই চমৎকার টাউনটার হাওয়া খাওয়া যাক।
খবর যথাসময়ে নিয়ে এলেন মিস্টার বেনেট। প্রফেসর সত্যিই খেপে গিয়েছিলেন। বাড়ির মধ্যে গোয়েন্দা হানা দেওয়ায়। সরাসরি বেনেটকে দোষারোপ করেননি যদিও, কিন্তু বিঁধিয়ে কথা বলেছেন অনেক। পরের দিন সকালেই আবার অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছেন। ক্লাসেও তোফা লেকচার দিয়ে এসেছেন। ব্রেন বেশ ঝরঝরে। কিন্তু মানুষটা পালটে গিয়েছে–দিব্যি গেলে মিস্টার বেনেট বললেন, এ-প্রফেসর সে-প্রফেসর নন।
হোমস বললে, যাই ঘটুক না কেন, দিন সাতেক কিছু করা যাবে না। আমাদের কাজ আছে লন্ডনে। রুগি ফেলে এসেছেন ডক্টর ওয়াটসন। তাই এখন ফিরে যাচ্ছি–সামনের সোমবার এই সময়ে এই সরাইখানায় ফের দেখা হবে। এর মধ্যে চিঠি লিখে ওয়াকিবহাল রাখবেন আমাদের।
পরের কটা দিন হোমসের টিকি দেখা গেল না। সোমবার একটা চিরকুট পেলাম। পরের দিন যেন ট্রেনে দেখা করি। ট্রেনে বসে ও বললে, বেনেট জানিয়েছে এ ক-দিন খুব খোশমেজাজে আছেন প্রফেসর। নতুন কিছু ঘটেনি।চেকার্স সরাইখানায় পৌঁছোনোর পর সন্ধে নাগাদ মিস্টার বেনেট এসে বললেন, আজ লন্ডন থেকে একটা চিঠি আর একটা ছোটো প্যাকেট এসেছে প্রফেসরের নামে–দুটোরই ডাকটিকিটের তলায় ক্রস চিহ্ন দেওয়া। কাজেই আমি খুলিনি–নিষেধ আছে বলে।
গম্ভীর হয়ে গিয়ে হোমস বললে, মিস্টার বেনেট, যা বললেন, তার মধ্যেই অনেক প্রমাণ পেলাম আমার সিদ্ধান্তের। উপসংহার টানাব আজ রাতে। প্রফেসরকে চোখে চোখে রাখবেন আপনি রাত্রে ঘুমোবেন না। দরজার সামনে দিয়ে গেলেও পথ আটকাবেন না। ধারেকাছেই থাকব আমি আর ডক্টর ওয়াটসন। সেই বাক্সটার চাবি কার কাছে থাকে?
প্রফেসরের ঘড়ির চেনে।
বাক্স নিয়েও গবেষণার প্রয়োজন হবে। দরকার হলে তালা ভাঙব। বাড়িতে শক্তসমর্থ আর কেউ আছে?
কোচোয়ান ম্যাকফেল আছে।
ঘুমোয় কোথায়?
আস্তাবলের ওদিকে।
ওকেও দরকার হতে পারে। আগে নিজেরা দেখি, তারপর। গুডবাই, কাল ভোরের আগেই ফের দেখা হবে।
মাঝরাতে গিয়ে দুই বন্ধু ঘাপটি মেরে বসলাম হল ঘরের দরজার উলটো দিকের ঝোঁপের মধ্যে। বেশ কনকনে ঠান্ডা, তার ওপর হাওয়া দিচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে মেঘের দল। ভাগ্যিস গায়ে ওভারকোট ছিল, তাই রক্ষে। ভাঙা চাদ মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে ছুটন্ত মেঘের আড়াল থেকে। হোমসের বিশ্বাস অভিযানের শেষ পর্ব হয়তো এইটাই, ক্লাইম্যাক্সের আর দেরি নেই–সেই আশাতেই উদগ্রীব হয়ে বসে থাকতে পারলাম–নইলে বড়োই একঘেয়ে লাগত।
হোমস বললে, ঠিক ন-দিন অন্তর প্রফেসরের পাগলামি মাথা চাড়া দেয় এবং সেটার সূত্রপাত ঘটেছে প্রাহা থেকে ফিরে আসার পরেই। আজই নবম দিন এবং আজ রাতেই ফের ঘটবে। লন্ডনের দালাল সেই দ্রব্যটা চালান দেয় প্রফেসরকে এবং ন-দিন অন্তর সেটি সেবন করার নির্দেশ আছে প্রফেসরের ওপর। দ্রব্যটি কী এখনও জানি না কিন্তু বাদবাকি সব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ভালো কথা, ওয়াটসন, প্রফেসরের আঙুলের গাঁটগুলো লক্ষ করেছ?
না তো।
করা উচিত ছিল। চামড়া পুরু হয়ে গিয়েছে, কড়া পড়ে গিয়েছে। এ-রকমটি আর কখনো কারো আঙুলের গাঁটে দেখিনি। আঙুলের গাঁটে নজর রাখবে সবার আগে। তারপর দেখবে শার্টের হাতা, প্যান্টের হাঁটু, আর বুটজুতো। প্রফেসরের আঙুলের গাঁটের অদ্ভুত চেহারাটা দেখলে। মনে হয়–বলেই থেমে গেল হোমস। খপাৎ করে কপাল খামচে ধরে বলে উঠল, উফ! ওয়াটসন, ওয়াটসন, কী বোকা আমি! অসম্ভব মনে হলেও এ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে বলে মনে হয় না। কড়া-পড়া আঙুলের গাঁটটা দেখেও আগে ধরতে পারিনি–মাথায় আসেনি…ইস! কী করছিলাম অ্যাদ্দিন? তারপর কুকুরের চেঁচানি… আইভি লতা… কী বোকা… কী বোেকা আমি! ওই তো প্রফেসর… বেরিয়ে এসেছেন… নিজের চোখেই দেখে এবার মিলিয়ে নেওয়া যাক যা ভয় করেছি তা ঠিক কি না!
দেখলাম, আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে হল ঘরের দরজা। ঘরের ভেতরে ল্যাম্প জ্বলছিল বলেই আলোর পটভূমিকায় দেখা গেল প্রফেসর প্রেসবুরির দীর্ঘ মূর্তি। পরনে ড্রেসিং গাউন। চৌকাঠে এসে দাঁড়ালেন দু-হাত পাশে ঝুলিয়ে শিরদাঁড়া বোঁকিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। শেষবার এই ভঙ্গিমাতেই দেখেছিলাম ভদ্রলোককে।
তারপরেই বেরিয়ে এলেন বাইরে এবং পর মুহূর্তেই আশ্চর্যভাবে পালটে গেল দেহভঙ্গিমা। অসাধারণ সেই পরিবর্তন চোখে না-দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। দু-হাত নামিয়ে মাটি ধরে হাঁটতে লাগলেন কোমর বেঁকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায়। মাঝে মাঝে সড়াৎ করে ওইভাবেই চার হাতপায়ে দৌড়ে গেলেন। যেন প্রচণ্ড প্রাণশক্তি আর এনার্জি উপচে পড়ছে দেহে মনে। দেখতে দেখতে অদৃশ্য হলেন বাড়ির কোণ ঘুরে পাশের দিকে। অমনি সদর দরজা দিয়ে সুড়ুৎ করে বেরিয়ে এলেন মিস্টার বেনেট পা টিপে টিপে পেছন ধরলেন প্রফেসরের।
চাপা গলায় বলে উঠল হোমস, ওয়াটসন, এসো। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এমন একটা জায়গায় পৌঁছোলাম যেখান থেকে প্রফেসরের কীর্তিকলাপ স্পষ্ট দেখা যায়। প্রফেসর দাঁড়িয়ে ছিলেন আইভিলতায় ছাওয়া দেওয়ালের গা ঘেঁষে। আচমকা দেওয়াল বেয়ে আইভিলতা আঁকড়ে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় উঠতে লাগলেন ওপরদিকে এবং এক লতা থেকে লাফিয়ে গিয়ে ধরতে লাগলেন আরেক লতা–যেন ভীষণ ভালো লাগছে খেলাটা, প্রচণ্ড মজা পাচ্ছেন লতা বেয়ে লাফালাফি করতে। আশ্চর্য, একবারও পা ফসকায় না, হাত সরে গেল না। নিজের হাত পায়ের ওপরেও যেন অসীম প্রত্যয় প্রফেসরের। বেশ কিছুক্ষণ লম্ফঝম্ফ করার পরে এ-খেলা যেন আর ভালো লাগল না, এমনিভাবে সরসর করে নেমে এলেন নীচে। ঝপ করে মাটিতে লাফিয়ে পড়ে ফের দাঁড়ালেন চার হাতপায়ে ভর দিয়ে এবং সাঁ সাঁ করে ছুটে গেলেন উলফ-হাউন্ড যেখানে বাঁধা আছে, সেইদিকে। আগে থেকেই ভয়ংকর গলায় ঘেউ ঘেউ আরম্ভ করেছিল কুকুরটা–এবার বেরিয়ে এল বাইরে। প্রফেসর যতরকমভাবে পারলেন খেপাতে লাগলেন কুকুরটাকে না-দেখলে প্রত্যয় হয় না সেই দৃশ্য। গম্ভীরবদন বিশুদ্ধমূর্তি বিদগ্ধ প্রফেসর চার হাতপায়ে ভর দিয়ে কুকুরটার নাকের দু-এক ইঞ্চি দূরে হাত নাড়ছেন, কখনো মুঠোমুঠো নুড়ি তুলে মুখ টিপ করে ছুঁড়ে মারছেন, কখনো ভাঙা ডাল তুলে নিয়ে দূর থেকে খোঁচা মারছেন। কুকুরটা এমনিতেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল–তার ওপর এই খোঁচাখুঁচি পাথর ছোড়াছুড়ির মতো অকারণ নিষ্ঠুরতার ফলে বর্ণনাতীত ক্রোধ আর জিঘাংসায় লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পাগলের মতো চেন ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম করল ভয়াল নেকড়ে কুত্তা।
এর পরের ঘটনা ঘটল মুহূর্তের মধ্যে! চেন ছিঁড়ল না কিন্তু কলার পিছলে গেল। ঘাড় মোটা নিউফাউন্ডল্যান্ড হাউন্ডের ফঁদালো কলার বলেই পিছলে গলে বেরিয়ে গেল উলফ-হাউন্ডের সরু লম্বা ঘাড়ের ওপর দিয়ে। চোখের পলকে মাটির ওপর দিয়ে একসঙ্গে গড়িয়ে গেল কুকুর আর মানুষ এবং কানে ভেসে এল উন্মত্ত হাউন্ডের ক্রুদ্ধ গর্জনের সাথে প্রফেসরের আতঙ্ক বিকৃত মুহুর্মুহু অদ্ভুত আর্তনাদ। নিমেষ মধ্যে বুঝলাম প্রফেসরের আয়ু ঝুলছে। সুতোর ওপর। ধেয়ে গেলাম সামনে ততক্ষণে কিন্তু উলফ-হাউন্ডের দাঁত বসে গেছে প্রফেসরের গলায় এবং আমরা যখন কাছে পৌঁছোলাম ততক্ষণে জ্ঞানও হারিয়েছেন; রয়কে টেনে আনাটাও আমাদের দুজনের পক্ষে তখন অতীব বিপজ্জনক কিন্তু তাও সম্ভব হল মিস্টার বেনেটের উপস্থিতিতে। ওকে দেখে, ওর গলা শুনে উলফ-হাউন্ডের যেন চৈতন্য হল। হট্টগোল শুনে ভ্যাবাচ্যাকা মুখে ঘুম জড়ানো চোখে বেরিয়ে এল কোচোয়ান। বললে, জানতাম এ-রকম ঘটবে। আগেও দেখেছি রয়কে এইভাবে শুধু শুধু রাগিয়েছেন প্রফেসর।
উলফ-হাউন্ডকে ফের চেনে বেঁধে রাখার পর প্রফেসরকে ধরাধরি করে নিয়ে গেলাম তার ঘরে। মিস্টার বেনেটের মেডিক্যাল ডিগ্রি ছিল বলেই দুজনে মিলে ড্রেস করে দিলাম ভীষণভাবে ক্ষতবিক্ষত কণ্ঠদেশ। অল্পের জন্যে বেঁচে গেছেন প্রফেসর। আর একটু হলেই ক্যারোটিড আর্টারি দু-টুকরো হয়ে যেত। রক্তক্ষরণ হচ্ছিল সিরিয়াস রকমের–আধ ঘণ্টার চেষ্টাও তাও বন্ধ করলাম। তারপর একটা মরফিন ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম পেশেন্টকে।
বললাম, ফার্স্ট ক্লাস সার্জনকে দিয়ে দেখানো দরকার।
আঁতকে উঠে মিস্টার বেনেট বললেন, খেপেছেন? টি-টি পড়ে যাবে তাহলে। মেয়ের মাথা কাটা যাবে।
হোমস বললে, ঠিক বলেছেন। এ-ব্যাপার পাঁচ কান না-করাই ভালো নিজেরা যা পারি করা যাক। বাক্সের চাবিটা এবার খুলে দিন ঘড়ির চেন থেকে। কী রহস্য আছে বাক্সে, দেখা যাক।
খুব বেশি কিছু ছিল না বাক্সে, কিন্তু যা ছিল, তাই যথেষ্ট। একটা শূন্য অ্যাম্পুল, একটা অর্ধেক খালি অ্যাম্পুল, একটা ইঞ্জেকশন দেওয়ার সিরিঞ্জ, কয়েকটা চিঠি। ঠিকানা বিদেশি হাতে লেখা, ডাকটিকিটের তলায় ক্রস চিহ্ন দেওয়া। সব খামই এসেছে কমার্শিয়াল রোড থেকে, টাকা পেয়ে রসিদ পাঠিয়েছে এ. ডোরাক। লিখেছে, নতুন অ্যাল পাঠানো হচ্ছে। একটা খামেই কেবল দেখা গেল ঠিকানাটা শিক্ষিত লোকের হাতে লেখা, ডাকটিকিটটা অস্ট্রিয়ার, ছাপ প্রাহার। লাফিয়ে উঠে হোমস বলল, এই তো পাওয়া গেছে আসল জিনিস! বলেই ভেতর থেকে টেনে বার করল চিঠিটা।
মাননীয় সতীর্থ,
আপনি আসার পর আপনার কেস ভেবে দেখলাম। এ-অবস্থায় চিকিৎসার বিশেষ যুক্তি যদিও আসে, তাহলেও বলব এ-চিকিৎসায় বিপদের সম্ভাবনা আছে। আগেভাগেই হুঁশিয়ার করছি।
মানবাকার কোনো জীবের সিরাম পেলেই সব চাইতে ভালো হত–যেমন বনমানুষের। কিন্তু আগেও বলেছি আপনাকে, কালো মুখে ল্যাংগুর ছাড়া আর কিছু না-পাওয়ায় কাজে লাগিয়েছি তাকেই। ল্যাংগুর চার হাতপায়ে হাঁটে, লতা বেয়ে লাফালাফি করে। বনমানুষ জাতীয় মানবাকার জীব পেলে সিধে হয়ে হাঁটত–মানুষের কাছাকাছি ফলাফল পাওয়া যেত।
একটু সাবধানে থাকবেন। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই যেন সব ফাঁস হয়ে না-যায়। আপনি ছাড়া ইংলন্ডে আরও একজন মক্কেল আমার আছে। ডোরাক আমার এজেন্ট হয়ে থাকবে আপনাদের দুজনের কাছেই।
ফি হপ্তায় রিপোর্ট পেলে খুশি হব।
শ্রদ্ধাসহ
এইচ ললায়েনস্টাইন
ললায়েনস্টাইন! স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠল হারিয়ে যাওয়া নামটা। খবরটা পড়েছিলাম খবরের কাগজে। জীবনসুধা আর পুনর্যৌবনের দাওয়াই আবিষ্কার করেছেন অজ্ঞাত-পন্থায় প্রাহারের লোয়েনস্টাইন। কিন্তু সুধার উৎস বলতে নারাজ হওয়ায় তার ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে বিজ্ঞান দুনিয়ায়। ইনিই সেই লোয়েনস্টাইন–বিস্মৃতপ্রায় বৈজ্ঞানিক! সংক্ষেপে বললাম যা মনে করতে পারলাম। বইয়ের তাক থেকে প্রাণীবিজ্ঞানের একটা কেতাব পেড়ে এনে মিস্টার বেনেট ল্যাংগুর কাকে বলে পড়ে শোনালেন।হিমালয়ের মুখপোড়া বৃহদাকার বানর। লতা বেয়ে ওপরে উঠতে পারে যেসব বানর, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো এবং মানুষের নিকটতম মিস্টার হোমস, বিজ্ঞানজগৎ কৃতজ্ঞ রইল আপনার কাছে বিষময় জীবনসুধার উৎস অন্ধকার থেকে আলোয় আনার জন্যে।
হোমস বললে, আসল কাজটা করলেন অবশ্য প্রফেসর। যৌবন ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন বিয়ের আগেই–উৎস তিনিই বের করেছেন। মানুষ স্বভাবে উধ্বে উঠতে গেলেই আরও নীচে তলিয়ে যায়। নিয়তির সোজা সড়ক ছেড়ে বাঁকা পথ ধরলে শ্রেষ্ঠ মানবকেও পশু হয়ে যেতে হয়। নির্নিমেষে চেয়ে রইল অ্যাম্পুলের টলটলে তরল পদার্থটার দিকে, এ-বিষ বাজারে ছাড়া যে আইনত অপরাধ, লোয়েনস্টাইনকে তা লিখে জানালেই আর কোনো ঝঞাট হবে না ঠিকই, কিন্তু এ-ব্যাপারের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা যাবে না। ইনি না-করলেও আর কেউ অন্যভাবে এ-কাজ করে যাবে। মানবসমাজের বিষম বিপদ দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে। ওয়াটসন, ভাবতে পার ইন্দ্রিয়ভোগে আসক্ত কিছু মানুষ শুধু ইন্দ্রিয়বৃত্তি চরিতার্থ করার জন্যে অর্থহীন জীবন প্রলম্বিত করতে চাইছে ভয়ংকর এই বিষের সাহায্য নিয়ে? সেইসঙ্গে অবশ্য আধ্যাত্মিক মানুষ বসে থাকবে না–ভোগের ঊর্ধ্বে ওঠার প্রয়াসেও বিরাম ঘটবে না। দেখা যাক এ-সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত কে জেতে, কে হারে। বলতে বলতে স্বপ্নলোক ছেড়ে ফিরে এল বাস্তবে। ধাঁ করে লাফিয়ে উঠল চেয়ার ছেড়ে।মিস্টার বেনেট, আমাদের করণীয় আর কিছু নেই। এখন তো সব পরিষ্কার হল? রয় কুকুর বলেই আপনার চাইতে আগেই বুঝেছিল প্রফেসর আর প্রফেসর নেই–হনুমান হয়ে গেছেন। গায়ের গন্ধেই তা বোঝা যাচ্ছে। বাঁদর তাকে জ্বালাতন করেছে–বাঁদরকেই সে তেড়ে গেছে। লতা বেয়ে বাঁদরের ফুর্তিতে লাফালাফি করতে করতে মেয়ের জানলায় পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রফেসর। ওয়াটসন, পরের ট্রেনেই লন্ডন ফেরার আগে চলো চেকার্স গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে যাওয়া যাক।
———
টীকা
বুড়ো বৈজ্ঞানিকের বিকট বিটলেমি : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ক্রিপিং ম্যান ইংলন্ডের স্ট্যান্ড ম্যাগাজিন এবং আমেরিকার হার্স্টস ইন্টারন্যাশনাল ম্যাগাজিনের মার্চ ১৯২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সম্প্রতি অনুমতি মিলেছে : অনেক ক্ষেত্রেই গল্প প্রকাশে শার্লক হোমসের অনুমতি দেরিতে পেয়েছে ওয়াটসন। কিন্তু এর কারণ জানানো হয়নি কখনো।
ক্যামফোর্ড : ক্যামফোর্ড নাম নিশ্চয়ই কেজি এবং অক্সফোর্ডের মিশ্রণ। তবুও চেকার্স পাব বা অন্য কয়েকটি সূত্রে গবেষকরা মনে করেন কন্যান ডয়াল অক্সফোর্ডের কথা মাথায় রেখেই এই গল্পটি লিখেছিলেন।
অশিক্ষিত হাতে লেখা ঠিকানা : অশিক্ষিতই যদি হবে, তাহলে সে লিখবে কী করে? প্রশ্ন তুলেছেন কয়েকজন সমালোচক।
E.C.: লন্ডনের ইস্ট-সেন্ট্রাল পোস্টাল-ডিস্ট্রিক্ট বোঝানো হয়।
জ্যাক : ট্রেভর বেনেটকে তার প্রেমিকা হঠাৎ জ্যাক নামে ডাকলেন কেন? লেখকের অন্যমনস্কতা? নাকি অন্য কোনো কারণে?
মঙ্গলবার : শেষ আক্রমণ যদি শুক্রবার তেসরা সেপ্টেম্বর হয়ে থাকে, তাহলে মঙ্গলবার নয়, হোমস কত দূর এগিয়েছে বোঝা যাওয়ার কথা রবিবার, বারোই সেপ্টেম্বর, নয়দিন পরে। অবশ্য ১৯০৩-এর তেসরা সেপ্টেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার এবং তার ন-দিন পর বারো তারিখ ছিল শনিবার।
বৈজ্ঞানিক : ভিয়েনার বৈজ্ঞানিক ইউজিন স্টিনাথ (১৮৬১-১৯৪৪) ১৯১২ সালে জীবদেহের গ্রন্থি-নির্গত এক ধরনের রস আবিষ্কার করে তার নাম দেন হরমোন। আবার ব্রাউন-সেকোয়া (১৮১৭-১৮৯৪) নামে এক ফরাসি বিজ্ঞানী চিরযৌবন প্রাপ্তির ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন বলে দাবি করেন ১৮৮৯-এ। কোনো কোনো গবেষকের অনুমান। লোয়েনস্টাইন চরিত্রটি এদের অনুকরণে সৃষ্টি করেছিলেন ক্যান ডয়াল।