ওটুম্বাও ভালো করে সকলকে একবার দেখে নিয়ে টোগোকে বলল, ‘কই, আমাদের শিকার আর আগুন-ছোঁড়া লাঠি কই? একটু পরেই অন্ধকার নামবে, আমাদের গ্রামে ফিরতে হবে।’
টোগোর মুখ থেকে তার কথা শুনে ম্যাকুইনা বললেন, ‘ওকে বলো সেগুলো আমরা দিচ্ছি, তার সঙ্গে আরও দামি জিনিস ওকে দেব। তবে ওর সঙ্গে কিছু কথা আছে, একটু বসতে হবে।’
টোগো ম্যাকুইনার কথা ওটুম্বাকে বলতেই ওটুম্বা একটু সন্দিগ্ধভাবে বলল, ‘সাদা চামড়া আমার সঙ্গে কী আলোচনা করবে? তাহলে তাড়াতাড়ি কথা বলতে বলো।’ খাদের ঢাল থেকে একটু দূরে সরে এসে এরপর গোল হয়ে বসল সবাই। সুদীপ্তদের পিছনে হুটু আস্কারিরা দাঁড়িয়ে রইল আর ম্যাকুইনার পিছন ঘিরে দাঁড়াল আকালা সমেত মাসাইরা। যারা মাটিতে বসে আছে তাদের ঘিরে একটা বৃত্তাকার ব্যূহ রচনা করল হুটু আস্কারি আর মাসাইরা। আস্কারিদের পিছনে তুতসি কুলির দল।
টোগোর মাধ্যমে কথা শুরু হল।
ম্যাকুইনা ওটুম্বাকে বললেন, ‘আমরা কাল তোমাদের এ তল্লাট ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তবে তোমার কাছ থেকে তার আগে একটা খবর জানতে চাই। যে খবর বললে তোমাকে অনেক দামি জিনিস দেব।’
‘কী খবর?’ সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করল ওটুম্বা।
‘আচ্ছা, তোমাদের এ তল্লাটে কী কী প্রাণী আছে বলো তো?’ প্রশ্ন করলেন ম্যাকুইনা। ‘সে তো তোমাদের বলেইছি। আবার জানতে চাইছ কেন? ‘ভ্রূ কুঁচকে বলল ওটুম্বা। ম্যাকুইনা বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তা বলেছ বটে, কিন্তু তাছাড়া অন্য কোনো প্রাণী? এই ধরো, গরিলার মতো অন্য কোনো দু-পেয়ে প্রাণী?’
ওটুম্বা এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল ম্যাকুইনার মুখের দিকে।
ম্যাকুইনা মৃদু হাসলেন। তারপর পকেট থেকে একটা ছোট চামড়ার থলি বার করে সেটা খুলে হাতে ঢালতেই তাঁর হাতের তালুতে একরাশ সাদা ছোট ছোট পাথরকুচি শেষ বিকেলের আলোয় ঝলমল করে উঠল। হীরের কুচি। ওরকম একটা থর বসানো আছে তাঁর নিজের দাঁতেও। আঁজলা ভরা হীরের কুচি ম্যাকুইনা এক মুহূর্তের জন্য মেলে ধরলেন ওটুম্বার সামনে। সেগুলো দেখে ওটুম্বার চোখ দুটোও চকচক করে উঠল।
এরপর ম্যাকুইনা আবার হীরেগুলো থলির ভিতর রেখে সেটা ওটুম্বার মুখের সামনে নাচিয়ে বললেন, ‘এটা আমি তোমাকে দেব, যদি তুমি আমাকে প্রশ্নের উত্তর দাও। দোপেয়ে দানব বানর, সবুজ রং?’
ওটুম্বা, ম্যাকুইনার সরাসরি প্রশ্ন শুনে মুহূর্তের জন্য চমকে উঠল। তারপর বেশ গম্ভীরভাবে বলল, ‘না, ওরকম কোনো প্রাণী এ তল্লাটে নেই।’
ম্যাকুইনা তার কথা শুনে তাকে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পাহাড়ের নীচের গ্রাম থেকে হঠাৎ ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে কান খাড়া করল ওটুম্বা আর তার সঙ্গীরা। মুহূর্তের মধ্যে কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠল তারা। ওটুম্বা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমরা এখনই ফিরে যাব, আর কথা বলব না।’
উত্তর তো এখনও দিলে না?’ ওটুম্বা টোগোকে একটু রুষ্টভাবে বলল, ‘সাদা চামড়ার আর কোনো কথার জবাব আমি দেব না।
ম্যাকুইনা বললেন, ‘কিন্তু আমার প্রশ্নের যায়। আমি এখন যাচ্ছি।’ ওটুম্বার কথা শুনে ম্যাকুইনা এবার একটা বাঁকা হাসি হেসে টোগোকে বলল, ‘বামনটাকে বলো, আমার প্রশ্নের জবাব না দিলে ও নীচে যেতে পারবে না। ও নীল বানরের সন্ধান জানে। সে কোথায় আছে তা না বললে ওকে আমি ছাড়ব না।’
কালই যেন ওরা এ তল্লাট ছেড়ে চলে
টোগো এবার উঠে দাঁড়িয়ে ম্যাকুইনার উদ্দেশে বলল, ‘এ-কাজ কিন্তু ঠিক হবে না। ও যখন বলবে না বলছে তখন ওকে যেতে দিন। ওরা নিরাপদে নীচের গ্রামে ফিরবে, এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমি ওদের এখানে এনেছি। জঙ্গলের একটা নিয়ম আছে। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে ফল খারাপ হবে।’
ম্যাকুইনা উঠে দাঁড়ালেন। হেরম্যান আর সুদীপ্তও উঠে দাঁড়াল।
টোগোর কথায় ম্যাকুইনা কর্কশস্বরে বললেন, ‘তোমাকে যা বলতে বলেছি বলো। বললাম তো, আমার কথার জবাব না দিলে ওকে আমি ছাড়ব না।’
হেরম্যান ব্যাপারটা সামাল দেবার জন্য ম্যাকুইনার উদ্দেশে বললেন, ‘টোগো ব্যাপারটা ঠিকই বলেছে। আপনার মতো আমিও ওই প্রাণীটার সন্ধানে এতটা দূরে ছুটে এসেছি। তবুও বলছি, ওটুম্বাকে যেতে দেওয়াই ভালো। ভুলে যাবেন না–আমরা কিন্তু ওদের রাজত্বেই আছি।’
হেরম্যানের কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠে ম্যাকুইনা বললেন, ‘আছি তো কী হয়েছে! ওদের তাই বলে ভয় পেতে হবে নাকি? আপনি চুপ করে থাকুন।’
ঢাকের শব্দ একটানা বেজেই চলেছে। টোগো-ম্যাকুইনা আর হেরম্যানের কথাবার্তা
ওটুম্বারা কিছুই বুঝতে পারছে না, কিন্তু ঢাকের শব্দে ক্রমশই চঞ্চল হয়ে উঠছে ওরা। ম্যাকুইনার কথা শুনে হেরম্যানও উত্তেজিত হয়ে তাঁর উদ্দেশে বললেন, ‘আপনি কী আমাকে ধমকাচ্ছেন নাকি? আমি আপনার মাসাই গার্ড নই। আমারও এ ব্যাপারে কথা বলার অধিকার আছে। বিশেষত, টোগোর প্রতিশ্রুতিতে যখন ওদের এখানে আনা হয়েছে তখন কথা বলবই। আমি আবারও বলছি ওদের যেতে দিন।’ কথাটা জোরের সঙ্গে বললেন হেরম্যান।
হেরম্যানের কথার জবাবে ম্যাকুইনা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই একটা ঘটনা ঘটল। ওটুম্বা ও তার সঙ্গীরা সম্ভবত কোনো একটা বিপদ যে ঘটতে চলেছে তা আঁচ করে ছিল। মুহূর্তের জন্য ওটুম্বা ও তার সঙ্গীদের মধ্যে কী একটা কথা হল, আর তার পরমুহূর্তেই মাসাইদের ব্যূহ ভেদ করে তাদের লম্বা পায়ের ফাঁক গলে ওটুম্বা তাদের সঙ্গীদের নিয়ে তিরের মতো ছুটল পাহাড়ের ঢালের দিকে। মুহূর্তের জন্য অসতর্ক হয়ে গিয়েছিল সবাই। আর তার পরেই ম্যাকুইনা তাঁর কোমর থেকে রিভলভার টেনে বার করে চিৎকার করে উঠলেন, ‘ধরো ধরো! শয়তান বামন সর্দার যেন পালাতে না পারে। ওকে কিন্তু জ্যান্ত ধরতে হবে!’
সুদীপ্তরা দাঁড়িয়ে রইল। ম্যাকুইনা আর তাঁর সঙ্গীরা ছুটল ওটুম্বাদের পিছনে। খাদের ধার ঘেঁষে নীচে নামার পথের দিকে ছুটছে ওটুম্বারা। প্রথমে দুজন পিগমি তারপর ওটুম্বা, তার পিছনে আরও দুজন পিগমি। তাদের কিছুটা তফাতে একটা লম্বা দড়ি হাতে আকালা ও অন্য মাসাইদের নিয়ে ম্যাকুইনা। ক্রমশই দূরত্ব কমে আসছে দু-দলের মধ্যে। ওটুম্বারা তখন প্রায় নীচে নামার পথের মুখে পৌঁছে গেছে, আকালার সাথে তাদের মাত্র হাত কুড়ির ব্যবধান, সে প্রায় তাদের ধরে ফেলেছে। ঠিক এমন সময় তাদের সর্দারকে বাঁচাবার জন্য একটা চেষ্টা করতে গেল ওটুম্বার পিছু নেওয়া পিগমি দুজন। আকালাদের থামাবার জন্য তারা থেমে গিয়ে তির-ধনুক খুলে ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু তির চালাতে পারল না তারা। ম্যাকুইনার রিভলভার গর্জে উঠল। ধনুক হাতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল তারা। আর তার পর মুহূর্তেই আকালা তার হাতের দড়ির ফাঁসটা মাথার ওপর একবার ঘুরিয়ে ছুড়ে দিল ওটুম্বাকে লক্ষ করে। যেমন করে ফাঁস দিয়ে জীবজন্তু ধরা হয়, ঠিক তেমনই দড়ির ফাঁসে ওটুম্বাকে ধরে ফেলল আকালা। মাসাইরা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওটুম্বার ওপর। ওটুম্বার অন্য দুজন সঙ্গী তখন ঢাল বেয়ে নীচের দিকে হরিণের মতো ছুটতে শুরু করেছে। এই পুরো ব্যাপারটা ঘটতে খুব বেশি হলে আধ মিনিট সময় লাগল। হতভম্ব অবস্থা কাটিয়ে হেরম্যান, সুদীপ্ত, টোগোরাও এবার ছুটল জায়গাটার দিকে।
দড়ির ফাঁসে আটক ক্রুদ্ধ সিংহের মতো ছটফট আর চিৎকার করছে ওটুম্বা। মুখ দিয়ে গ্যাজলা উঠছে তার। আকালার দড়ির ফাঁস এঁটে বসেছে তার গলায়। ইতিমধ্যে আরও একটা দড়ি বেঁধে ফেলা হয়েছে তার কোমরে। দড়ির দু-প্রান্ত ধরে আছে দুজন মাসাই। তাদের ঘিরে ম্যাকুইনা ও অন্য মাসাইরা। কয়েক হাত দূরে মাটিতে চিত হয়ে পড়ে আছে ওটুম্বার দেহরক্ষী দুজন। রক্ত আর ধুলোতে মাখামাখি তাদের দেহ। সুদীপ্তরা যখন জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছল তখনও পিগমি দুজনের মধ্যে একজনের দেহে প্রাণ আছে। থর থর করে কাঁপছে তার রক্তমাখা দেহ। তার ডান হাতে তখনও ধরা আছে ক্ষুদ্রাকৃতি তির। সেটা ছোড়ার সময় পায়নি সে। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাঁপতে কাঁপতে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে সকলের দিকে। বীভৎস দৃশ্য! সেই লোকটার দিকে তাকিয়ে হেরম্যান তিরস্কারে ভঙ্গিতে ম্যাকুইনাকে বললেন, ‘আপনি দুটো মানুষকে খুন করলেন?’
ম্যাকুইনা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, ‘এরা আবার মানুষ নাকি? এরা জন্তু। মানুষের চেয়ে বাঁদরের সঙ্গেই এদের মিল বেশি।
ম্যাকুইনার কথা শুনে হেরম্যান উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘তাহলে কি আপনিও মানুষ? শুধু শুধু আপনি এদের খুন করলেন! আমি এসব সহ্য করব না। নীল বানর মানুষের প্রাণের চেয়ে দামী নয়। ওটুম্বাকে এখনই ছেড়ে দিন।
ম্যাকুইনাও এবার চিৎকার করে বললেন, ‘না, শয়তান বামনটাকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না। ওরাই নীল বানরকে লুকিয়ে রেখেছে। আমার হাতে তাকে তুলে দিতে হবে ওকে। নইলে ওর দশা ওর সঙ্গীদের মতো হবে। তাছাড়া ওর সঙ্গে আর একটা হিসাব বাকি আছে। ওরাই হত্যা করেছে আমার বাবাকে।’
হেরম্যান, ম্যাকুইনার কথার প্রত্যুত্তরে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে আরও একটা কাণ্ড হল! মাটিতে পড়ে থাকা মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর পিগমিটা দেহের সব শক্তি দিয়ে জীবনে শেষবারের মতো একবারের জন্য উঠে দাঁড়িয়ে হাতের ক্ষুদ্রাকৃতি তিরটা বাগিয়ে ধরে টলমল পায়ে ছুটে এল দঙ্গলের মধ্যে তার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আকালাকে লক্ষ্য করে। আকালা সেটা খেয়াল করল ঠিকই কিন্তু তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মাসাই আকালার বিরাট দেহের আড়ালে ছুটে আসা পিগমিটাকে দেখতে পায়নি। আকালা সরে গেল, তবে মৃত্যুপথযাত্রী পিগমিটা তার হাতের ক্ষুদ্রাকৃতি তিরটা বসিয়ে দিল সেই মাসাইয়ের উন্মুক্ত উরুতে। পিগমিটার দেহে মনে হয় ওইটুকুই জীবনীশক্তি অবশিষ্ট ছিল। আঘাত করেই সে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই একজন মাসাই তার স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে গুলি চালিয়ে দিল পিগমিটার নিথর দেহ লক্ষ্য করে, যদিও তার আর প্রয়োজন ছিল না।
মাসাইয়ের পায়ের বাহ্যিক আঘাত সামান্যই। ঊরুর চামড়ায় সামান্য কয়েকটা রক্তবিন্দু ফুটে উঠেছে মাত্র। মৃতপ্রায় পিগমিটার দেহে তেমন জোর ছিল না। কিন্তু ওই ক্ষুদ্রাকৃতি অস্ত্রের সামান্য একটা আঁচড়ের পরিণতি কী ভয়ংকর তা কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রত্যক্ষ করল সবাই। নিশ্চল পিগমিটার দিকে সুদীপ্তরা তাকিয়ে ছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় ওটুম্বার চিৎকারও কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল। দড়ি বাঁধা অবস্থাতেই এবার সকলকে চমকে দিয়ে ওটুম্বা হঠাৎ অট্টহাস্য করে উঠল। সকলে ওটুম্বার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল সে তিরে খোঁচা-খাওয়া মাসাইটাকে লক্ষ্য করে হাসছে। আর পরমুহূর্তে মাসাইটার দিকে চোখ পড়তেই সকলে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। কাঁপতে শুরু করেছে মাসাইটা। তার মুখ বেঁকে যাচ্ছে, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর থেকে। তীব্র বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে সে। তিরের খোঁচায় মৃত্যু প্রবেশ করেছে লোকটার দেহে। অতি দ্রুত বিষ ছড়িয়ে পড়ছে লোকটার শিরা-উপশিরায়। এরপর আধ মিনিটও দাঁড়াতে পারল না সে। কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎই কাটা কলাগাছের মতো দড়াম করে পড়ে গেল সে মৃত পিগমিটার দেহের ওপর। মাসাইটার মুখের কষ বেয়ে নেমে এল রক্তধারা। খুব জোরে একবার কেঁপে উঠে চিরদিনের মতো নিথর হয়ে গেল তার দেহ। কী ভয়ংকর মৃত্যু! শিউরে উঠল সকলে।
ওটুম্বা ম্যাকুইনার উদ্দেশে দুর্বোধ্য ভাষায় কয়েকটা শব্দ বলল। ম্যাকুইনা কথার মানে বুঝতে পারলেন না। কিন্তু টোগো সুদীপ্তর কানে চাপা স্বরে বলল, ‘ও বলছে, সাদা চামড়া, তুমিও মরবে।’
ম্যাকুইনা কিছুক্ষণ বিস্মিতভাবে তাকিয়ে রইলেন মৃত মাসাইটার দেহের দিকে। তারপর নীচু হয়ে তার দেহ থেকে রাইফেলটা খুলে নিয়ে হেরম্যানের উদ্দেশে বললেন, ‘ঘটনাটা দেখার পরও কী বলবেন জন্তু দুটোকে মেরে আমি ঠিক করিনি?’
হেরম্যান বিস্ময়ভাব কাটিয়ে দৃঢ়ভাবে ম্যাকুইনাকে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, এখনও বলছি আপনি ঠিক করেননি। আপনি ওটুম্বাকে আটকাবার চেষ্টা না করলে এসব ঘটনা ঘটতই না। এই মাসাইটাকেও এভাবে মরতে হত না। এ রকম ঘটনা আরও ঘটার আগে আপনি ওটুম্বাকে ছেড়ে দিন।
‘আপনি থামুন হেরম্যানের কথা শুনে ম্যাকুইনা ক্রোধে চিৎকার করে উঠে বললেন, এবার। আমার কাজে বাধা দিতে আসবেন না। আমি শুধু দুটো বাঁদর মেরেছি। প্রয়োজন হলে এবার মানুষও মারব।’
ম্যাকুইনার কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে অসুবিধা হল না হেরম্যান বা সুদীপ্তর। হেরম্যান প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে কোমর থেকে রিভলভার বার করে ম্যাকুইনাকে চেঁচিয়ে বললেন, ‘আপনি আমাদেরও মারার ভয় দেখাচ্ছেন? এত বড় সাহস! তাহলে এখনই ফয়সালা হয়ে যাক।’
মুহূর্তের মধ্যে হাত দশেকের তফাতে দুটো দলে যেন আপনা থেকেই বিভক্ত হয়ে গেল সকলে। এক পাশে রিভলভার হাতে ম্যাকুইনা আর রাইফেলধারী জনা কুড়ি মাসাই; অন্যদিকে হেরম্যান, সুদীপ্ত, টোগো, চারজন হুটু আস্কারি ও চারজন তুতসি কুলিসহ মোটা এগারো জন লোক। তবে শেষ চারজনের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র নেই। বর্শা উঁচিয়ে তারাও দাঁড়াল সুদীপ্তদের পিছনের সারিতে ।
মাঝখানে মাটিতে পড়ে থাকা পিগমি আর মাসাইটার মৃতদেহ আর তার দুপাশে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে সার বেঁধে দাঁড়ানো যুযুধান দু-পক্ষ। উভয়েরই রাইফেল-রিভলভারের নল তাগ করা অপর পক্ষের দিকে। হেরম্যান ও ম্যাকুইনা দুজনেই নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছেন রিভলভার হাতে। ম্যাকুইনার মুখে হিংস্রতার স্পষ্ট চিহ্ন ফুটে উঠেছে, হেরম্যানের ভাবলেশহীন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুখ ৷ এই মুহূর্তে যে-কোনো ঘটনার জন্য প্রস্তুত তিনি। ম্যাকুইনারা সংখ্যায় ও শক্তিতে সুদীপ্তদের দ্বিগুণ। সংঘর্ষ হলে ম্যাকুইনাদের ক্ষতি হবে ঠিকই কিন্তু সুদীপ্তদের ক্ষতির পরিমাণ বেশি হওয়া স্বাভাবিক। সুদীপ্ত ভয় পায়নি, সে-ও রিভলভার তুলে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা কী হতে পারে তা অনুমান করতে অসুবিধা হল না তার। যেভাবে হেরম্যান ও ম্যাকুইনা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছেন তাতে যে-কোনো মুহূর্তে কোনো পক্ষ গুলি চালানো শুরু করলে কোনো পক্ষ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত এ লড়াই থামবে না। সুদীপ্ত বুঝতে পারল এ লড়াই থামাতে হবে। পরে কৌশলে চেষ্টা করতে হবে ম্যাকুইনাকে প্রতিহত করার। কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধভাবে কেটে গেল। নীচ থেকে ভেসে আসা ঢাকের শব্দও বন্ধ হয়ে গেছে। দম বন্ধ করে দু-দল তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। সুদীপ্ত হঠাৎ রিভলভার নামিয়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল দু-পক্ষে মাঝখানে। তারপর হেরম্যান আর ম্যাকুইনা উভয়ের উদ্দেশে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে কাজটা আমরা ঠিক করছি না। আমরা কেউই দুর্বল নই, লড়াইটা এখনই হতে পারে। কিন্তু তাতে কোনো পক্ষেরই লাভ হবে না। বরং ক্ষতিই হবে। আমরা লড়াই করতে এখানে আসিনি, এসেছি সবুজ বানরের খোঁজে। আমার মনে হয় এ লড়াইয়ে যে-ই জিতুক না কেন, লড়াইয়ের ফলে তার আসল উদ্দেশ্য পণ্ড হবে। বরং মাথা ঠান্ডা করে বিবাদের নিষ্পত্তি করাই শ্রেয়। আমার প্রস্তাবটা মিস্টার হেরম্যান ও মিস্টার ম্যাকুইনা উভয়কেই ভেবে দেখতে বলছি।’
আবার কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। সুদীপ্তর কথার যে যুক্তি আছে তা সম্ভবত বুঝতে পারলেন ম্যাকুইনা। তাঁর রিভলভারের মুখটা আস্তে আস্তে নীচের দিকে নেমে এল। হেরম্যানও তাঁর অস্ত্র নীচে নামালেন।
ম্যাকুইনা সুদীপ্তর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ঠিক আছে আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি। রাতে বসে আলোচনা করা যাবে।’
সুদীপ্ত বললে, ‘আপনাকে ধন্যবাদ মিস্টার ম্যাকুইনা। এ পথটাই ঠিক। ‘আমি আপনার প্রস্তাব মানলাম ঠিকই, কিন্তু কেউ কোনো চালাকির চেষ্টা করলে তার পরিণতি পিগমি দুজনের মতো হবে।’ এ কথা বলে হেরম্যানের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে অন্য দিকে মুখ ফেরালেন ম্যাকুইনা।
হেরম্যান ম্যাকুইনার কথার প্রত্যুত্তরে কোনো কথা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আবার ঝঞ্ঝাট এড়াতে সুদীপ্ত হেরম্যানকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তাঁর হাত ধরে টানতে টানতে ভিড়ের বাইরে বার করে আনল।
জমায়েতটা ভেঙে গেল। ম্যাকুইনা দলবলসমেত দড়ি বাঁধা ওটুম্বাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল, কিছু দূরে তাঁবুগুলোর দিকে। সুদীপ্ত, হেরম্যান আর টোগো গিয়ে বসল একটু দূরে একটা ফাঁকা জমিতে। তুতসি কুলিরা হুট আস্কারিদের তত্ত্বাবধানে লেগে গেল সুদীপ্তদের তাঁবু ফেলার কাজে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য ডুব দিল পশ্চিম পাহাড়ের আড়ালে। সুদীপ্তদের চারপাশে পাহাড়ের মাথায় নেমে এল এক শান্ত সমাহিত ভাব। শুধু মাটিতে পড়ে থাকা পিগমি দুজন আর মাসাইরক্ষীর মৃতদেহ পাহাড়ের মাথায় ভয়ংকর ঘটনার চিহ্ন হয়ে রইল। সুদীপ্তরা দূর থেকে দেখতে পেল ওটুম্বাকে নিয়ে গিয়ে তাঁবুগুলোর পিছনে একটা গাছের গুঁড়ির সাথে বাঁধা হচ্ছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এল। ম্যাকুইনাদের তাঁবুগুলোর সামনে অগ্নিকুণ্ড জ্বলে উঠল। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিক থেকে বাতাস বইতে লাগল। এ বাতাসের ব্যাপারটা এ পাহাড়ের মাথায় প্রথম দিন সুদীপ্তরা যখন তাঁবু ফেলেছিল তখনও দেখেছিল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বাতাস বাড়ে। সারা দিন ধরে আফ্রিকার প্রখর রোদে জ্বলেপুড়ে যাওয়া পৃথিবীর বুকে শান্তি এনে দেয়।
সুদীপ্তদের তাঁবু খাটানো হয়ে গেলেও খোলা আকাশের নীচেই তারা বসে রইল চুপ করে। হেরম্যানের মাথা ঠান্ডা হবার পর তিনি সুদীপ্তকে বললেন, ‘কাজটা তুমি ঠিকই করেছ। অতটা উত্তেজিত হওয়া আমার উচিত হয়নি। আসলে অনর্থক ম্যাকুইনার জন্য মানুষ মরতে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি।’
সুদীপ্ত বলল, ‘যা হয়ে গেছে তা আর ভেবে লাভ নেই। এখন আমাদের কী করা উচিত তা আলোচনার প্রয়োজন।’
টোগো বলল, ‘আমাদের বিপদ কিন্তু দুদিকেই। একদিকে ওই আফ্রিকান্ডার আর অন্য দিকে পিগমিরা। যে পিগমি দুজন পালাল তারা নিশ্চয়ই গ্রামে গিয়ে খবর পৌঁছে দেবে। ওরা কাউকে ছাড়বে না। আমি ওটুম্বাকে ডেকে এনেছি, তাই আমার প্রতি পিগমিদের আক্রোশ বেশি হবে।
সুদীপ্ত শুনে বলল, ‘আমার ধারণা ওটুম্বা দানব-বানরের সন্ধান দিলেও ম্যাকুইনা তাকে ছাড়বে না। ম্যাকুইনা সম্ভবত তাঁর পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবেন।’
টোগো মন্তব্য করল, ‘হ্যাঁ, আমারও ধারণা আফ্রিকান্ডার খুন করবে ওটুম্বাকে, তবে কাজটা সে চট করে করবে না। ওটুম্বার কাছ থেকে আগে সবুজ বানরের সন্ধান জানার চেষ্টা করবে। তবে সে কাজে আমার সাহায্য লাগবে আফ্রিকান্ডারের। ওই সুযোগটাই আমি কাজে লাগাবার চেষ্টা করব। ওটুম্বাকে জানিয়ে দেব আমরা ওর শত্রু নই, আমরা ওকে ছাড়াবার চেষ্টা করছি। ওটুম্বা আমার কথায় ভরসা করে এখানে এসেছিল, ওর জন্য প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নেব।’
সুদীপ্ত তার কথার জবাবে বলল, ‘তোমার মতলবটা মন্দ নয়। তবে ম্যাকুইনার সংস্পর্শ ছেড়ে যত দ্রুত সম্ভব চলে যাওয়া প্রয়োজন।’
হেরম্যান বললেন, ‘হ্যাঁ, এতক্ষণ ধরে আমিও এ-কথাই ভাবছিলাম। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে করে সবুজ বানরের সন্ধানে এ অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার সঙ্গে তোমরা যারা এসেছ, আস্কারি বা কুলিরা যারা এসেছে তাদের পেটের খিদে মেটাতে সামান্য পয়সার আশায় সকলের জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারটাও আমার লক্ষ রাখার প্রয়োজন। আমি ভাবছি কালই আমাদের ফেরার পথ ধরব।’ শেষ কথাটা বলার সময় হেরম্যানের গলায় স্পষ্ট বিষণ্ণতা ফুটে উঠল।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সুদীপ্ত বলল, ‘কী আর করা যাবে! তবে ম্যাকুইনার সঙ্গে মাথা ঠান্ডা রেখে শেষ একবার কথা বলে নেওয়ার প্রয়োজন। আমরা যে কাল চলে যাচ্ছি, সেটা তাঁকে জানানো যেতে পারে। আশা করি তার এ ব্যাপারে আপত্তি থাকবে না। আমরা চলে গেলে তিনি নিজের মতো কাজ করতে পারবেন। চলুন, এবার তাঁর তাঁবুর দিকে যাওয়া যাক।’ এই বলে সুদীপ্ত উঠে দাঁড়াল। সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে হেরম্যান আর টোগোও উঠে পড়ল। তিন জনে হাঁটতে শুরু করল ম্যাকুইনার তাঁবুর দিকে।