দক্ষিণের পাহাড়টা অপেক্ষাকৃত ছোট। সেটা গিয়ে মিশেছে পশ্চিমের পাহাড়ের সাথে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পাহাড়ের মাথায় উঠে এল তারা। অনেক নীচে পিগমিদের গ্রাম বিন্দুর মতো দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের মাথাটা প্রায় সমতল, কিন্তু গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ। আদিম মহাবৃক্ষের দল ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও আবার নিশ্ছিদ্র বাঁশ গাছের প্রাচীর। যতটা সম্ভব চারপাশ অনুসন্ধান করতে করতে জঙ্গল কেটে এগোতে লাগল সুদীপ্তরা। বেশ কয়েকটা শিম্পাঞ্জির দল আর ছোট আকৃতির পাহাড়ি হরিণ তাদের যাত্রাপথে চোখে পড়ল। একটা চিতাও তাদের গুহামুখের সামনে দর্শন দিল। দুপুর নাগাদ উত্তরদিকে পাহাড় থেকে রাইফেলের শব্দ ভেসে আসতে লাগল। তার আওয়াজ গুমগুম শব্দে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল পাহাড় থেকে পাহাড়ে।
ম্যাকুইনা বললেন, ‘সম্ভবত গোরিলার দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেছে মাসাইদের। লড়াই শুরু হয়েছে।’
হেরম্যান আর সুদীপ্ত বাইনোকুলার দিয়ে দেখার চেষ্টা করল উত্তরের দিকে। কিন্তু মহাবৃক্ষের প্রাচীরের আড়ালে সে পাহাড়ের সব কিছুই অদৃশ্য। শুধু রাইফেলের গর্জন ভেসে আসছে সেদিক থেকে। চলতে থাকল সুদীপ্তরা। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে কখনো থেমে থেমে কখনো বা নিরবিচ্ছিন্নভাবে শোনা যেতে লাগল সেই শব্দ। ম্যাকুইনা একবার অসন্তুষ্টভাবে বললেন, ‘মূর্খ মাসাইগুলো গোরিলাগুলোর পিছনে কত গুলি নষ্ট করছে দেখুন!’
হেরম্যান বললেন, ‘আমাদেরও কিন্তু এখানে কয়েকটা গুলি নষ্ট করতে হবে। শিকারের নাম করে এখানে এসেছি। সঙ্গে করে কিছু না নিয়ে ফিরলে পিগমিদের মনে সন্দেহ হতে পারে। তাছাড়া মাংসেরও তো দরকার আছে।’
ম্যাকুইনা বললেন, ‘তা বটে।’
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই নেহাতই অদৃষ্টের পরিহাসেই এক চিত্রক মহারাজ দর্শন দিলেন গাছের মাথায়। তাকে দেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেরম্যান ইশারা করলেন টোগোকে। আবার রাইফেলের কান ফাটানো গর্জনে কেঁপে উঠল বনভূমি। এক গুলিতেই টোগো পেড়ে ফেলল প্রাণীটাকে। ম্যাকুইনার একজন মাসাইরক্ষী প্রাণীটার দেহ কাঁধে তুলে নিল। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মাসাইরা ইম্পালা হরিণ শিকার করল।
উত্তরের জঙ্গলে যথাসম্ভব অনুসন্ধান করে বেলা আড়াইটে নাগাদ তারা এসে উপস্থিত হল জঙ্গলের শেষ প্রান্তে পাহাড়ের ঢালে একটা উন্মুক্ত স্থানে। ঢালের কিছু নীচে একটা শুকনো নদীখাত, আর তারপরই পশ্চিম পাহাড়ের ঢাল। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার বিরাজ করছে সেখানে। কেমন যেন থমথমে পরিবেশ সেদিকে। জঙ্গলের মাথায় আকাশে একটাও পাখি চোখে পড়ছে না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আদিম বৃক্ষরাজি বাইরের পৃথিবী থেকে ওই পাহাড়কে আড়াল করে রেখেছে। বেশ কিছুক্ষণ সে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ম্যাকুইনা হেরম্যানকে বললেন, ‘হাতে কিছুটা সময় আছে। খাদটা পার হয়ে ওদিকটা একবার দেখে আসবেন নাকি??
হেরম্যান বললেন, ‘ওটা তো আমাদের পক্ষে নিষিদ্ধ এলাকা। চুক্তি ভঙ্গ হলে পিগমিদের সাথে সংঘাতে যেতে হবে। সেটা কী ঠিক হবে?’
ম্যাকুইনা বাইনোকুলার দিয়ে খাদের ওপাশে পশ্চিম পাহাড়ের ঢাল মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করতে করতে বললেন, ‘এমনটাও হতে পারে যে ওই পাহাড়ে সবুজ বানরের বাস। পিগমিরা তাকে আমাদের থেকে আড়াল করার জন্যই দেবতার থানের গল্প ফেঁদেছে। ওদের সব শর্ত যে আমাদের বাস্তবে মানতে হবে এমন কোনো কথাই নেই। আপনারা ওদিকে গেলে চলুন, নইলে এখানে অপেক্ষা করুন। আমি একবার ওপাশে গিয়ে দেখে আসছি। ওদিকে যা জঙ্গল, তাতে পিগমিরা সচরাচর ওদিকে যায় বলে মনে হয় না।’
ম্যাকুইনার কথার জবাবে হেরম্যান বললেন, ‘ওই পাহাড়ে প্রাণীটার লুকিয়ে থাকার ব্যাপারটা আমার মাথাতেও এসেছে। তবে হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া…’ ম্যাকুইনা তাঁর কথা শেষ না হতেই ব্যঙ্গোক্তি করে বললেন, ‘আমি তো বললামই, অত ভয় পেলে আপনি এখানে অপেক্ষা করুন।’
আঁতে ঘা লাগল হেরম্যানের, তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, ‘ঠিক আছে—দেখা যাক, তাহলে চলুন।’
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে নেমে পড়ল সুদীপ্তরা। তারপর শুকনো নদীখাত পার হয়ে জঙ্গলাকীর্ণ পশ্চিম পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। সূর্য পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। তার ম্লান আভা খেলা করছে জঙ্গলে। শুধু সেখানে কোথাও নেড়া গাছের মাথার ফাঁক দিয়ে সূর্যালোক এসে নীচে নেমেছে, সে জায়গাই শুধু আলোকিত। ঢাল বেয়ে কিছুটা ওপরে ওঠার পর এমনই এক নেড়া গাছের কাছে এসে হঠাৎই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে রুদ্ধ হয়ে গেল তাদের গতি। সবাই চমকে উঠল! পাতাহীন মৃত গাছটার একটা মোটা ডাল থেকে ঝুলছে তিনটে কঙ্কাল। তারা যেন সাবধানবাণী উচ্চারণ করছে সুদীপ্তদের প্রতি। প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সুদীপ্তরা কৌতূহলবশত গিয়ে দাঁড়াল গাছটার নীচে। লোক তিনটেকে যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। গাছের ডাল থেকে চামড়ার ফিতেয় তারা ঝুলছে। তবে কঙ্কালগুলো বেশ পুরনো। বেশ কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের খসে পড়েছে। একটার শূন্য মুখগহ্বরে বোলতা জাতীয় পতঙ্গ বাসা বেঁধেছে। একটা বেশ দীর্ঘাকৃতি কঙ্কাল আছে তার মধ্যে। তাকে দেখে সুদীপ্তদের মনে হল সম্ভবত সে লোকটা ইওরোপীয় ছিল বা সভ্য সমাজের মানুষ। কোমরে রিভলভার ঝোলানোর চামড়ার খাপ আর রোদ-বৃষ্টিতে পচে যাওয়া চামড়ার হাইহিল বুট দুটো এখনও তার পায়ে ঝুলছে।
হেরম্যান সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোনো শিকারি বা ভাগ্যান্বেষী পর্যটক হবে হয়তো। এদিকে এসে পড়েছিল, পিগমিদের সঙ্গে বিরোধ বাঁধায় ফাঁসিতে লটকে দিয়েছে।’
হেরম্যানের কথা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাতাসে হঠাৎ দুলে উঠল কঙ্কালটা, আর তাতে গাছের ফাঁক বেয়ে নেমে আসা সূর্যকিরণে কঙ্কালটার ডান হাতের আঙুলে কী যেন একটা ঝিলিক দিয়ে উঠল! একটা আংটি! ব্যাপারটা ম্যাকুইনার নজর এড়াল না। আর সেটা দেখেই একজন মাসাইকে কঙ্কালটা নীচে নামাতে বললেন। দড়ি কেটে নীচে নামানো হল সেটা। ম্যাকুইনা কঙ্কালটার কাছে গিয়ে তার অনামিকা থেকে আংটিটা খুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। হীরে বসানো একটা সোনার আংটি! আংটিটা দেখতে দেখতে ম্যাকুইনার চোয়াল ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠল, বিড় বিড় করে কী যেন বলে তিনি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মাটিতে শোয়ানো কঙ্কালটার দিকে। মিনিট দু-এক এভাবে কেটে যাবার পর হেরম্যান ম্যাকুইনাকে বললেন, ‘কে ও? ওর পরিচয় সম্বন্ধে কিছু জানেন নাকি?’
ম্যাকুইনা শুধু ঘাড় নাড়লেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সঙ্গের লোকদের বললেন, ‘একটা কবর খোঁড়ো। একে কবর দিতে হবে।’
ম্যাকুইনার ব্যাপার দেখে হেরম্যান আর সুদীপ্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মাসাইরা একটা গর্ত খুঁড়ল, তার মধ্যে কঙ্কালটাকে মাটি চাপা দেওয়া হল। প্রায় আধ ঘণ্টা লাগল কাজটা করতে। নিশ্চুপভাবে কঠিন চোয়াল চেপে পুরো ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করলেন ম্যাকুইনা। সুদীপ্তর মনে হল ম্যাকুইনার চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। কবরের ব্যাপারটা মিটলেও ম্যাকুইনা কিন্তু এগোলেন না। একবার সূর্যের দিকে তাকিয়ে তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, ‘চলুন, আজকের মতো ফেরা যাক।’
ফেরার পথ ধরল সুদীপ্তরা। সারা পথ আর একটাও কথা বললেন না ম্যাকুইনা। থমথমে মুখে পথ চললেন তিনি। বনবাদাড় ভেঙে আবার চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে অবশেষে পিগমিদের গ্রামে যখন ফিরে এল সূর্য তখন প্রায় ঢলতে বসেছে।
গ্রামের সামনে সুদীপ্তদের তাঁবু ফেলার বন্দোবস্ত হল এবং মাসাইরা থাকবে পাহাড়ের ওপর তাদের আগের জায়গাতেই।
সুদীপ্তরা ফিরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওটুম্বার সাথে উত্তরে পাহাড়ে যে দলটা গেছিল তারা ফিরে এল। না, সবাই ফেরেনি। চারজন সঙ্গীকে তাদের রেখে আসতে হয়েছে সেখানে, গোরিলার আক্রমণে মারা গেছে তারা। বুলেট খেয়েও অসীম শক্তিধর মৃত্যুপথযাত্রী প্রাণীগুলো নাকি হাতের সামনে যাকে পেয়েছে তার হাত-পা টেনে টেনে ছিঁড়েছে। শুধু বর্শা হাতে আফ্রিকার জঙ্গলে সিংহ শিকার করে বলে মাসাইদের খ্যাতি আছে। কিন্তু এমন ভয়ংকর প্রাণীর সামনে তারা পড়েনি! এমনই জানাল মাসাইদের দলপতি আকালা ।
মাসাইদের মৃত্যুতে ম্যাকুইনা দুঃখ পেলেন বলে মনে হল না। তিনি আকালার কাছে কার্তুজ আর রাইফেলের হিসেব নিলেন। একটা রাইফেলের ব্যারেল দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে গোরিলারা। সেটা দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তিনি।
ওটুম্বা আর তার কয়েকজন দাঁড়িয়েছিল মাসাইদের সাথেই। সূর্য ডুবতে চলছে। গ্রামে ঢুকতে হবে তাদের। সুদীপ্ত লক্ষ করল তাদের সঙ্গে আনা মরা চিতাটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে ওটুম্বা।
মাসাইদের সাথে ম্যাকুইনার কথা শেষ হতেই ওটুম্বা বলল, ‘আমরা এখন গ্রামে ঢুকব। তোমরা যদি ওই চিতাটা আমাদের দাও তবে ভালো হয়। ও প্রাণী আমাদের একরকম ওষুধ তৈরির কাজে লাগে।’
ম্যাকুইনা এতক্ষণ ওটুম্বার উদ্দেশ্যে কোনো কথা বলেনি। টোগোর মুখ থেকে ওটুম্বার কথা শুনে হঠাৎই কেন জানি ওটুম্বার ওপর খেপে গিয়ে হিংস্র কণ্ঠে হিস্হিস্ করে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, নিয়ে যাও। তোমারও এই চিতাটার মতো দশা হবে! সবুর করো।’
ওটুম্বা তাঁর কথা বুঝতে না পেরে টোগোকে বলল, ‘এই সাদা চামড়া আমাকে কী বলছে?’
ম্যাকুইনার বক্তব্য তাকে বলা সমীচিন হবে না বুঝে ব্যাপারটা টোগোই সামাল দিল। সে ওটুম্বাকে বলল, ‘সাদা চামড়া বলছে, ও ওটা তোমাকে উপহার দেবার জন্যই মেরে এনেছে। তুমি স্বচ্ছন্দে এটা নিতে পারো।’ খুশি হল ওটুম্বা। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে, পরদিন সকালে আবার দেখা হবে বলে, চিতাটা নিয়ে গ্রামে ঢুকে গেল সে।
সে চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁবু খাটানো হল। আকালারা এরপর চলে গেল নিজেদের ছাউনি ফেলার জন্য। তাঁবুর চারপাশে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে তুতসি কুলিরা লেগে গেল রান্নার কাজে। সুদীপ্তদের সাথে কোনো কথা না বলেই ম্যাকুইনা তাঁর তাঁবুতে গিয়ে ঢুকলেন। সুদীপ্তরাও ঢুকে পড়ল নিজেদের তাঁবুতে।
রাতটা নির্বিঘ্নে কাটল। পরদিন ভোরে উঠে তাঁবুতে বসে প্রাতরাশ সারতে সারতে হেরম্যান বললেন, ‘কাল ম্যাকুইনা হঠাৎ ওটুম্বার উদ্দেশ্যে ওরকম মন্তব্য করল কেন বলো তো? মনে হয় ভেতরে ভেতরে লোকটা ক্ষিপ্ত হয়ে আছে।’
সুদীপ্ত মন্তব্য করল, ‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। বিশেষত, কাল ওই কঙ্কালটাকে নামিয়ে কবর দেবার ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত তাই না??
টোগো বলল, ‘আমার কিন্তু মনে হয় ওই কঙ্কালটা নিশ্চিতভাবে আফ্রিকান্ডারদের ঘনিষ্ঠ কোনো ব্যক্তির। যে কারণে ওর সৎকার করল।’
সুদীপ্ত বলল, ‘কাল সন্ধ্যায় ও সেই যে তাঁবুতে গিয়ে ঢুকল, তারপর আর তো বাইরেই এল না।’
তার কথা শুনে হেরম্যান বললেন, ‘ভেতরে ঢুকলেও মনে হয় ও ঘুমোয়নি। মাঝরাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে বেরিয়েছিলাম, তখন দেখি তাঁর তাঁবুর পেছনে যে গাছটা আছে তার নীচে অন্ধকারের মধ্যে একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে দেখার পর তার আকৃতি দেখে আন্দাজ করলাম লোকটা ম্যাকুইনা। গাছের ডাল ধরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।’
‘গুড মর্নিং মিস্টার হেরম্যান। ঘুম থেকে উঠেই আমাকে নিয়ে কী আলোচনা শুরু করলেন?’ হেরম্যানের কথা শেষ হতে-না-হতেই ম্যাকুইনার কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল সবাই তাঁবুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তাঁর মুখের থমথমে ভাবটা এখনও কাটেনি। হেরম্যান একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাঁর প্রতি সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, ‘মাঝরাতে আপনি তাঁবুর বাইরে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাই বলছিলাম।’
ম্যাকুইনা শুনে গম্ভীরভাবে বললেন, ‘কাল সন্ধ্যায় তাঁবুতে ঢোকার পর আমি আর তাঁবুর বাইরে আসিনি সারারাত। আমাকে আপনি দেখলেন কীভাবে?’
হেরম্যান এবার হাসির ছলেই বললেন, ‘এই সামান্য ব্যাপারটা আপনি অস্বীকার করছেন কেন? আমি তো আর বলিনি যে আপনি আমাদের তাঁবুতে আড়ি পাতছিলেন! আপনার তাঁবুর পিছনে গাছের নীচে আমি আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। সেই কথাই আমি সঙ্গীদের বলছি’, মৃদু একটা শ্লেষের ছোঁয়া ফুটে উঠল হেরম্যানের কথায়।
ম্যাকুইনা কিন্তু সেটা গায়ে না মেখে বেশ দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘আমি বলছিই তো বাইরে যাইনি।’
হেরম্যান বললেন, ‘যদিও জায়গাটা অন্ধকার ছিল কিন্তু ওখানে বেশ দীর্ঘ একটা অবয়ব আমি স্পষ্ট দেখেছি। মাথার ওপর গাছের একটা ডাল এক হাতে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। অত লম্বা লোক আপনি ছাড়া আমাদের মধ্যে আর কেউ নেই।’
ম্যাকুইনা প্রত্যুত্তরে আর কিছু বললেন না। কী যেন ভাবলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর ছিটকে বেরিয়ে গেলেন তাঁবু থেকে। সেটা হেরম্যানের কথার পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাকুইনার রাগের বহিঃপ্রকাশ কিনা, সেটা ঠিক সেই মুহূর্তে সুদীপ্তরা বুঝতে পারল না। হেরম্যান হেসে বললেন, ‘উনি ব্যাপারটা অস্বীকার করার পরও কথাগুলো আমি জোর দিয়ে বলাতে মনে হয় চটে গেলেন। সত্যিই উনি যেন কেমন উদ্ভট প্রকৃতির।’
প্রাতরাশ শেষ করে তাঁবুর বাইরে এসে সুদীপ্তরা দেখল, ম্যাকুইনা তাঁর তাঁবুর পিছন দিকে সেই গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে আছেন। সুদীপ্তদের আর ম্যাকুইনার তাঁবু প্রায় বলতে গেলে কাছাকাছি। আর সেই গাছটা দাঁড়িয়ে আছে ম্যাকুইনার তাঁবুর আনুমানিক একশো ফুট দূরে। ম্যাকুইনা হেরম্যানের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কাল রাতে আমি এ জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম তাই তো?’ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন হেরম্যান।
ম্যাকুইনা এরপর গাছের গুঁড়ির দিকে ফিরে তার মাথার ওপর সবচেয়ে নীচে যে ডালটা আছে সেটা দেখিয়ে আবার হেরম্যানের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমি সম্ভবত এই ডালটা ধরে দাঁড়িয়েছিলাম তাই তো? একটু ঠিক করে ভেবে বলুন।’
সুদীপ্ত তাকাল ডালটার দিকে। ডালটা বেশ উঁচু। সুদীপ্ত বা হেরম্যানের নাগালের বাইরে তো বটেই। হয়তো ম্যাকুইনা ছুঁতে পারেন সেটা। হেরম্যান ম্যাকুইনার কথার জবাবে বললেন, ‘হ্যাঁ, দূর থেকে তেমনই তো মনে হয়েছিল আমার।’
ম্যাকুইনা এবার কোনো কথা না বলে তার ডান হাতটা বাড়াল সেই ডালের দিকে। ডালটা সুদীপ্তর যত উঁচু মনে হয়েছিল তার চেয়ে অনেক ওপরে। সুদীপ্তরা অবাক হয়ে দেখল ম্যাকুইনার দীর্ঘ হাতের আঙুলগুলো ডালটার ইঞ্চি ছয়-আটেক দূরে গিয়ে থেমে গেল। ম্যাকুইনা এরপর পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। তাতে ইঞ্চি তিনেক ব্যবধান কমল, কিন্তু ডালটা তিনি স্পর্শ করতে পারলেন না।
স্বাভাবিক অবস্থায় ঘুরে দাঁড়িয়ে এবার কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টিতে হেরম্যানের দিকে
তাকালেন। হেরম্যানকে দেখে সুদীপ্তর মনে হল ম্যাকুইনা ডালটা স্পর্শ করতে না পারায় তিনি স্পষ্টতই বিব্রত। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘তাহলে এতটা ভুল দেখলাম।’ ম্যাকুইনা ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘না, সম্ভবত আপনি ঠিকই দেখেছেন।’
হেরম্যান বললেন, ‘মানে?’
ম্যাকুইনা মুখে কিছু না বলে আঙুল দিয়ে গাছের গুঁড়ির কাছে মাটিতে একটা জায়গা দেখালেন। সুদীপ্তরা সেখানে ভালো করে তাকাতেই দেখতে পেল শুকনো মাটির মৃদু ধুলোর আস্তরণের ওপর ফুটে আছে অস্পষ্ট কয়েকটা পায়ের ছাপ। সবাই জায়গাটা গোল হয়ে দাঁড়াবার পর টোগো উবু হয়ে বদল ছাপগুলো পরীক্ষা করতে। বেশ কিছুক্ষণ ছাপগুলো খুঁটিয়ে দেখার পর সে বলল, ‘এ ছাপগুলো দেখতে অনেকটা মানুষের বা মানুষজাতীয় কোনো প্রাণীর মতো। তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল পায়ের পাতার চারটে করে আঙুল, বুড়ো আঙুল বলে কিছু নেই! ছাপটা এক ফুটেরও বেশি লম্বা, অর্থাৎ সে আটফুট অন্তত লম্বা হবে।’
ছাপটা দেখে আর টোগোর কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল হেরম্যান আর সুদীপ্ত। কয়েক মুহূর্ত পর প্রথম মুখ খুললেন ম্যাকুইনা। বললেন, ‘টোগোর কথা যদি ঠিক হয় তবে আমরা ঠিক জায়গাতে এসেছি। সে আছে! এই পাহাড়-জঙ্গলের কোথাও সে লুকিয়ে আছে। কাল সে আমাদের তাঁবুর কাছে এসেছিল। এই তার চিহ্ন হয়তো রাতে ঘুরতে ঘুরতে এদিকে চলে এসেছিল। অথবা তাঁবু দেখে আকৃষ্ট হয়েছিল। হেরম্যান যদি তাকে দেখে আমার নাম ধরে ডাকতেন তাহলেও হয়তো তখনই ব্যাপারটা ধরা পড়ে যেত।’
টোগো বলল, ‘শিম্পাঞ্জি অথবা গোরিলা জাতীয় প্রাণীর অনেক সময় এ ধরনের কৌতূহল থাকে। তারা আড়াল থেকে মানুষকে লক্ষ করে। তাঁবুতে হানা দিতে আসে।’ বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে হেরম্যান বললেন, ‘এই পায়ের ছাপ যদি সত্যিই সেই দানব বানরের হয়ে থাকে তাহলে সে সম্ভবত এই পাহাড়ি জঙ্গলেই কোথাও আছে। হয়তো বা ওই পশ্চিম পাহাড়েই। তবে সে তো আর বারবার আমাদের তাঁবুর কাছে আসবে না। এত বড় জায়গা। আমাদের হাতে মাত্র দু-দিন সময়, পরিকল্পনা মাফিক অনুসন্ধান না করলে প্রাণীটার খোঁজ পাওয়া মুশকিল।’
ম্যাকুইনা বললেন, ‘হ্যাঁ, সেই পরিকল্পনাই করা প্রয়োজন। ওই প্রাণীটা যখন গ্রামের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে তখন ওটুম্বা নিশ্চয়ই ওর সন্ধান জানে। শয়তান বামনটা সে খবর দেবে বলে মনে হয় না। আমাদের যা করার নিজেদের করতে হবে। আমারও ধারণা ওই পশ্চিম পাহাড়টা রহস্যজনক। একটা পরিকল্পনা আমার মাথায় এসেছে। কোনো অজুহাত দেখিয়ে ওটুম্বার সাথে গোরিলা মারতে আজ আর কোনো লোক পাঠাব না। তেমন হলে তারা কাল ওর সঙ্গে যাবে। ওটুম্বাদের দেখিয়ে আমরা চিতা শিকারের নামে যাব দক্ষিণের জঙ্গলে। গ্রামের দৃষ্টিপথের বাইরে দক্ষিণের পাহাড়ে ওঠার পর আকালার নেতৃত্বে একটা বড় দল থেকে যাবে সেই পাহাড়ে। তারা শিকার-টিকার করতে বা শূন্যে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগোবে দক্ষিণ থেকে পুবে। সেই শব্দ শুনে ওটুম্বারা গ্রামে বসে ভাববে আমরা সে দিকেই এগোচ্ছি। আর আমরা একটা ছোট দল নিয়ে এগোব পশ্চিম পাহাড়ের উদ্দেশ্যে।’
ম্যাকুইনার প্রস্তাব শুনে তা নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত তাতে রাজি হয়ে গেলেন হেরম্যান। হাতে মাত্র আর দু-দিন সময়। পিগমিদের চোখ এড়িয়ে পশ্চিমের পাহাড়ে যাবার একটা ঝুঁকি তাদের নিতেই হবে। বিশেষত, ওই প্রাণীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রাথমিক প্রমাণ সম্ভবত যখন তারা দেখতেই পাচ্ছে। এরপর হেরম্যানের নির্দেশে ওই ছাপের ছবি নিল সুদীপ্ত। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্দুকধারী মাসাইরা নেমে এল ওপরের পাহাড় থেকে। তাদের নামতে দেখেই সম্ভবত পিগমি গ্রামের আগল ঠেলে ওটুম্বাও তার জনা পাঁচেক সঙ্গী নিয়ে গ্রামের বাইরে বেরিয়ে সুদীপ্তদের তাঁবুর সামনে এসে দাঁড়াল। সে আজ বেশ সেজে এসেছে। তার কোমরে জড়ানো চিতার উজ্জ্বল চামড়া, উন্মুক্ত ঊর্ধ্বাঙ্গে নানা ধরনের পাথরের মালা, মাথায় রঙিন পালক গোঁজা। তাঁবুর সামনে উপস্থিত হয়ে সে বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে টোগোকে বলল, ‘তোমাদের সব লোকজন তৈরি তো? তাহলে তাদের নিয়ে উত্তর পাহাড়ের দিকে বেরিয়ে পড়ি।’
টোগো পূর্ব-পরিকল্পনা মতো একটু বিমর্ষভাবে তার উদ্দেশ্যে বলল, ‘ওরা আবার কাল ওখানে যাবে।’
ওটুম্বা বিস্মিতভাবে জানতে চাইল, ‘কেন, আজ নয় কেন?’
টোগো বলল, ‘কাল মাসাইদের যে সঙ্গীরা মারা গেছে, তাদের আত্মার শান্তির জন্য ওরা চিতা শিকারে যাবে দক্ষিণের পাহাড়ে। সাদা চামড়াসহ সবাই যাব সেখানে। চিতা না মারলে ওদের প্রেতাত্মা শান্তি পাবে না। তারা নানা প্রাণীর রূপ ধরে ঘুরে বেড়াবে গ্রামের চারপাশের পাহাড়ে। তাতে তোমাদেরও অনিষ্ট হবে। আমরা তো এখানে কালকের দিনটা পর্যন্ত আছি, তাই ও কাজটা আজই সেরে রাখা জরুরি।’
আফ্রিকার বিভিন্ন উপজাতিদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পারলৌকিক কার্যের প্রথা আছে, তাছাড়া ভূত-অপদেবতা, এসবে তাদের বিশ্বাসও প্রবল, কাজেই ওটুম্বা অবিশ্বাস করল না টোগোর কথা। ওটুম্বা শুনে গম্ভীরভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, আত্মারা নানারকম ক্ষতি করে। তাদের শান্তির দরকার। আমাদের গ্রামে কেউ মারা গেলে আমরা শিম্পাঞ্জির হৃদপিণ্ডের মধ্যে তার আত্মা ভরে তা পুড়িয়ে ফেলি। ঠিক আছে, আমরা কালই আবার তোমাদের লোকদের সাথে যাব। আর একটা কথা, চিতার দেহগুলো যদি কাজে না লাগে তাহলে ওগুলো গতকালের মতো আমাদের দিয়ো।’
টোগো বলল, ‘ঠিক আছে, সেগুলো আমরা তোমাদের দেব।’
টোগোর কথা শুনে ওটুম্বা খুশি হয়ে তার পারিষদসমেত আবার গ্রামের ভিতর ঢুকে গেল ।
সে চলে যাবার কিছু সময়ের মধ্যেই সুদীপ্তরা তাদের অভিযানে বেরিয়ে পড়ল।
পরিকল্পনামতো দক্ষিণ পাহাড়ে পৌঁছে তারা দুটো দলে বিভক্ত হয়ে গেল। মাসাইরা অধিকাংশই এগোল উত্তরমুখে, আর ম্যাকুইনা-হেরম্যান-সুদীপ্ত-টোগো, হুটু আস্কারি ও দু-জন মাত্র মাসাইকে নিয়ে এগোল দক্ষিণ পাহাড় হয়ে পশ্চিম পাহাড়ের উদ্দেশ্যে।