বুরুন্ডির সবুজমানুষ – ৫

রাতটা নিরুপদ্রবেই কাটল। তাঁবুতে প্রাতরাশ সেরে সুদীপ্তরা যখন তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়াল, তখন প্রভাতরবির কিরণে উদ্ভাসিত সবুজ উপত্যকা। যেদিকেই তাকানো যায়, সেদিকেই বনানীর অপরূপ শোভা। জঙ্গলের ভিতর থেকে দু-একটা পাখির ডাকও যেন ভেসে আসছে। শুধু পাহাড়ের মাথায় কোথাও কোথাও এখনও কুয়াশা জড়িয়ে আছে। ওটুকুই শুধু একটু রহস্যময় বলে মনে হয়। সূর্যের আলোতে তা-ও ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। মাথার ওপর ঘন নীল আকাশ, আর তার নীচে এই পাহাড় ঘেরা সবুজ উপত্যকা কী সুন্দর চারদিক! গত রাতেই সেই জমাট বাঁধা অন্ধকার, সিংহর আক্রমণ! এ সবই যেন নিছক দুঃস্বপ্ন বলে মনে হল সুদীপ্তর।

তুতসি কুলিদের তাঁবু তোলার নির্দেশ দিল টোগো। ম্যাকুইনার লোকেরা তার আগেই নিজেদের তাঁবু গোটাতে শুরু করেছে। তবে ম্যাকুইনার তাঁবু তখনও খোলা হয়নি। সম্ভবত তিনি তাঁবুর ভিতরই আছেন।

কুলিরা তাঁবু খুলতে লাগল। তার সামনে দাঁড়িয়ে হেরম্যান, সুদীপ্তরা যে দিক থেকে নেমেছে, তার উল্টোদিকে জঙ্গলের পিছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পাহাড় দেখিয়ে বললেন, ‘ওই পাহাড়ের দিকেই আপাতত এখন এগোব আমরা। কিন্তু ম্যাকুইনা কোথায়? যাত্রা শুরুর আগে সৌজন্যের খাতিরে তাঁর সাথে একবার সাক্ষাতের প্রয়োজন।’ হেরম্যানের কথা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কানে এল ম্যাকুইনার কণ্ঠস্বর, ‘গুড মর্নিং মিস্টার হেরম্যান।’

সুদীপ্ত দেখল তাঁবু ছেড়ে বেড়িয়ে ম্যাকুইনা এগিয়ে আসছেন তাদের দিকে। তিনি কাছে এসে দাঁড়াবার পর হেরম্যান তার সাথে করমর্দন করে বললেন, ‘গুড মর্নিং মিস্টার ম্যাকুইনা, যাবার আগে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই কাল আপনাদের সাহচর্যে তাঁবু ফেলতে দিয়েছেন বলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা হচ্ছি আমরা।’

ম্যাকুইনা মৃদু হেসে বললেন, ‘ধন্যবাদ। তা কোন দিকে যাচ্ছেন আপনারা?’ হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘ওই পাহাড়ের দিকে।’

ম্যাকুইনা মৃদু হেসে বললেন, ‘ওই পাহাড়কে বেড় দিয়ে ঘাসবন পার হয়ে কী রুভু নদীর উপত্যকাতে?’

তার কথা শুনে চমকে উঠল সুদীপ্ত। হেরম্যান একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘না মানে, ওরকমই একটা ইচ্ছা…।’

হেরম্যানের কথা শেষ হবার আগেই ম্যাকুইনা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘ইচ্ছা নয়। নির্দিষ্টভাবেই রুড্ডু উপত্যকাতেই যাচ্ছেন আপনারা।’

‘মানে?’ বিস্মিত হেরম্যান তাকালেন ম্যাকুইনার দিকে।

হাসলেন ম্যাকুইনা। সকালের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠল তাঁর হীরে বসানো দাঁত। কয়েকমুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে হেরম্যানের দিকে তাকিয়ে থেকে ম্যাকুইনা বললেন, ‘নিজেদের মধ্যে আর লুকোচুরি খেলে লাভ নেই মিস্টার হেরম্যান। কেনিয়া-তাঞ্জেনিয়া-উগাভা ছেড়ে যেমন কেউ আমার মতো এত দূরে সিংহ শিকারে আসে না, তেমনই নিছক কোনো প্রাণীর সন্ধানে কোনো বায়োলজিস্ট এত দূরে এই মৃত্যুর উপত্যকাতে আসে না। কী, ঠিক বললাম কিনা? তুমি তো আবার তাঁবুতে বসে আমার সিংহ শিকারের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করছিলে। বেশ বুদ্ধিমান তুমি!’ শেষের কথাগুলো ম্যাকুইনা অবশ্য বললেন টোগোকে লক্ষ্য করে।

ম্যাকুইনা যে তাঁবুর ভিতরে সুদীপ্তদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছে তা আর বুঝতে অসুবিধা হল না কারো। কাল রাতে সুদীপ্তর দেখা তাঁবুর গায়ের ছায়াটা তাহলে ম্যাকুইনা বা তার কোনো অনুচরেরই হবে!

টোগো ম্যাকুইনার কথা শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

ম্যাকুইনা এরপর হেরম্যানকে বললেন, ‘আসলে আমরা দুজনেই এসেছি সেই সবুজ বানরের খোঁজে। আপনার কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে। আমাদের উভয়েরই গন্তব্য, লক্ষ্য যখন এক তখন এই এক্সপিডিশনটা এক সাথে করা যায় না? যদি সত্যিই তার খোঁজ পাওয়া যায় তাহলে কৃতিত্বটা নয় আধাআধি ভাগ করে নেওয়া যাবে। এতে দুপক্ষেরই লাভ। যে ঘাসবনের ভিতর দিয়ে আপনারা এগোবেন, সেটা সিংহর ডেরা। কাল রাতের অভিজ্ঞতা ভোলেননি নিশ্চয়ই। সেই বন পার হয়ে আপনারা সকলে র নদী পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেন না। তারপর যদি সেখানে পৌঁছনও, সেখানে পৌঁছে আপনাদের মোকাবিলা করতে হতে পারে অসভ্য পিগমিদের। আপনাদের কয়েকটা রাইফেল তাদের ঝাঁকে ঝাঁকে আসা বিষ মাখানো তিরের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না। যদি আমরা এক সাথে যাই, তাহলে লোকসান কমবে, উভয়ের পক্ষেই তাতে সুবিধা। আপনি আমাদের নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাবেন। প্রাণীটা যদি সত্যি সেখানে থেকে থাকে তাহলে আমরা তাকে ধরার চেষ্টা করব।’

ম্যাকুইনার কথা শুনে হেরম্যান তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার আসল পরিচয় কী? আপনি প্রাণীটাকে ধরতে চাইছেন কেন?’

তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমার পরিচয় আমি মিথ্যা বলিনি আপনাকে। তবে আমার একটা নিজস্ব চিড়িয়াখানা আছে। তার জন্য আমার ওই প্রাণী প্রয়োজন। সারা পৃথিবী থেকে লোকে আমার চিড়িয়াখানাতে প্রাণীটাকে দেখতে আসবে, নাম হবে। এই আর কি। তবে আপনিও এতে উপকৃত হবেন। সত্যি যদি আপনিও জ্যুলজিস্ট হয়ে থাকেন, তাহলে আপনিও কাজ করতে পারবেন প্রাণীটাকে নিয়ে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, যদি আপনি এখানে প্রাণীটার দর্শন পানও, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি প্রাণীটাকে সভ্য জগতের সামনে হাজির করতে পারছেন, ততক্ষণ কেউ বিশ্বাস করবে না আপনার কথা। আর সে কাজ আমার সাহায্য ছাড়া আপনারা করতে পারবেন না। সেই প্রস্তুতি আপনাদের নেই।

হেরম্যান তার কথার জবাবে কী বলবেন বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলেন। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে ম্যাকুইনা হেরম্যানের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনি বরং একটু ভেবে নিন, আর প্রয়োজন হলে আপনার গাইডেরও পরামর্শ নিন, কি, তাই তো?’ টোগোর দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু ব্যাঙ্গোক্তি করে ম্যাকুইনা এরপর এগোলেন নিজের তাঁবুর দিকে।

তিনি চলে যাবার পর হেরম্যান টোগাকে বললেন, ‘কী করা যায় বল তো?’ টোগো বলল, ‘লোকটাকে কিন্তু আমার ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছে না। যে লোক আড়ি পেতে অন্যের কথা শোনে সে লোক ভালো লোক হতে পারে না।’

হেরম্যান বললেন, তবে লোকটার সব কথা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষত শেষের কথাগুলো। এ কথা ঠিকই যে, প্রাণীটাকে যদি সভ্য দুনিয়ার সামনে হাজির করা যায় তবে পৃথিবী চমকে যাবে, ‘ক্রিপটোজ্যুলজিস্ট’ দের আর ধাপ্পাবাজ কেউ বলতে পারবে না তবে ভয়ের ব্যাপার হল, ওঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমরা কোনো বিপদে না পড়ি।’

সুদীপ্ত এবার বলল, ‘দেখুন যদি ও আমাদের আলোচনা সব শুনে থাকে, তাহলে আমরা চাই বা না চাই, ও আমাদের পিছু ধাওয়া করবেই। সে ক্ষেত্রে ওখানে গিয়ে আমাদের সাথে গোলমাল ধরতে পারে। সংখ্যায় ওরা আমাদের চেয়ে ভারী। বরং আপাতত ওকে আমাদের সঙ্গে নিই। ওখানে গিয়ে তেমন কিছু বুঝলে কৌশলে আমাদের সড়ে পড়তে হবে। এইসব বনে জঙ্গলে ইচ্ছাকৃত ভাবে যদি কেউ হারিয়ে যায় তবে তার চট করে খোঁজ পাওয়া মুশকিল।’

হেরম্যান বললেন, ‘তোমার কথার যুক্তি আছে।’

মিনিট পাঁচেক আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত ঠিক হল এক সঙ্গে যাওয়া হবে। টোগো হুটু আস্কারি আর কুলিদের একপাশে ডেকে নিয়ে ব্যাপারটা ওদের জানিয়ে দিল। তবে তার সাথে সাথে এই বলে দিল যে, একসাথে যাওয়া হচ্ছে বলেই ওই আফ্রিকান্ডার বা তার লোকদের বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। সবাই যেন তারা সব সময় এক সাথে থাকে, আর ম্যাকুইনার দলের লোকদের সামনে কোনো পরিকল্পনার কথা আলোচনা না করে। বিশেষ হুটু আস্কারিদের সব সময় সজাগ থাকার নির্দেশ দিন টোগো।

তাদের সাথে টোগোর কথা বলা শেষ হলে, হেরম্যান সুদীপ্তকে নিয়ে রওনা হলেন ম্যাকুইনার তাঁবুর দিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁবু গুটিয়ে ম্যাকুইনার সাথে এক সাথে বেরিয়ে পড়ল সুদীপ্তরা। দলের প্রথমে হেরম্যানের হুটু রক্ষী ছাড়াও ম্যাকুইনার দলের চারজন মাসাই আস্কারি। তারপর টোগো, হেরম্যান, সুদীপ্ত ও উভয় দলের কুলিরা, শেষে মাসাই আস্কারি-পরিবৃত হয়ে ম্যাকুইনা। ফাঁকা জমি ছেড়ে, কিছুটা জঙ্গল অতিক্রম করে কিছু সময়ের মধ্যেই ঘাসবনের সামনে উপস্থিত হল সকলে। পাহাড়ের কোলে উত্তর থেকে দক্ষিণে অন্তহীন ঘাসবন। কোমর সমান উঁচু ঘাসের ঝাড়। ধূসর রঙের দেখতে। এই ঘাসবনই হল সিংহর ডেরা। গায়ের রঙের সাথে ঘাসের রং মিলে যায় বলে সিংহর লুকিয়ে থাকতে সুবিধা হয় এখানে। ঘাসবনে প্রবেশের আগে আস্কারিদের নির্দেশ দেওয়া হল, যাত্রাপথের আশেপাশে কোথাও কোনো জায়গা আন্দলিত হলে, সঙ্গে সঙ্গে সে জায়গা লক্ষ্য করে যেন গুলি ছোড়া হয়। তাদের নির্দেশ দেবার পর সকলে প্রবেশ করল সেই বনে।

পাহাড়টাকে বেড় দিয়ে এগোতে লাগল সবাই। সূর্য উঠতে থাকল মাথার ওপরে। ক্রমশই বনের ভিতরে হারিয়ে যেতে লাগল তারা। কোথাও কোথাও ঘাসবন এক মানুষ সমান উঁচু। পিছনের লোকজনেরা শুধু অগ্রবর্তী আস্কারিদের মাথার ওপর উঁচিয়ে ধরা বর্শার ফলাটাই শুধু দেখতে পাচ্ছে। যাত্রাপথের দু-পাশে এক হাত দূরের জিনিসও চোখে পড়ছে না। মাঝে মাঝে মাসাইরা এক যোগে চিৎকার করে উঠছে, প্রথমবার সেই চিৎকার শুনে, কিছু হল মনে করে ঘাবড়ে গেছিল সুদীপ্ত। টোগো বলল, ‘কোনো জানোয়ার যদি কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে থাকে, তাকে দূরে তাড়ানোর জন্যই এই চিৎকার।’

সুদীপ্ত টোগোকে চলতে চলতে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা তোমরা যারা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াও, গাইড বা রক্ষীর কাজ করো তাদের কিছু হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে?’

টোগো করুণ হেসে বলল, ‘না, আমাদের অবস্থাও সেই বান্টুদের মতো। যারা নদীতে জল ছেঁচছিল। জঙ্গলে এলে সিংহ বা অন্য প্রাণীর পেটে কেউ যেতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক। ব্যাপারটা আমাদের পরিবারও জানে, সরকারও জানে। তবে দু-পক্ষের কেউই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আজ যদি আমার কিছু হয়, তাহলে কালই হয়তো আমার ভাই কিংবা ছেলে, আপনাদের মতো কাউকে নিয়ে জঙ্গলে আসবে কোনো কিছুর পরোয়া না করে। সিংহর চেয়েও ভয়ংকর হল মানুষের পেট। জঙ্গলে আমরা, এই হুটু বা তুতসিরা, কিংবা ওই মাসাইরা কেউ শখ করে আসি না। আসি এই পেটের তাগিদে।’

সুদীপ্তর তার কথার শুনে মনে হল, টোগোকে কথাটা না জিজ্ঞেস করলেই ভালো হতো।

তবে যে আশঙ্কাটা সবার মনে ছিল সেই সিংহর দলের সাথে, যে-কোনো কারণেই হোক আর সাক্ষাৎ হল না। শুধু এক চিত্রক মহারাজ নিতান্তই দৈব-দুর্বিপাকে এসে পড়েছিল সুদীপ্তদের যাত্রাপথের একদম্ সামনে। তাকে দেখা মাত্রই একজন মাসাই এক গুলিতে তাকে সাবাড় করে দিল।

ঘণ্টা চারেক চলার পর ঘাসবন এক সময় ফাঁকা হয়ে এল। সুদীপ্তদের চোখে পড়ল এক পাহাড়। সেই পাহাড়ের একটা পাশ দেখতে ঠিক মুখের মতো। প্রকৃতির আপন খেয়ালে সেই ভাস্কর্য সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ের গায়ে। কলিন্স বর্ণিত রুভভুর সেই শাখা পাহাড়ের গা ঘেঁষে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে। আর তার পশ্চিমেই দাঁড়িয়ে আছে সেই উপত্যকা। যার সন্ধানে মধ্য আফ্রিকার গহীন অরণ্যে পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি উপেক্ষা করে হেরম্যানের সঙ্গী হয়ে সুদীপ্ত ছুটে এসেছে।

ঘাসজমি পার হয়ে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াল সকলে। শুকনো নদীখাত, কোথাও কোথাও হাঁটু সমান জল। অনেকক্ষণ পর সেখানে বন্য প্রাণী চোখে পড়ল। এক দল বেবুন কুকুরের মতো মুখ, দেহটা বানর জাতীয় প্রাণীর মতো। সম্ভবত তারা খাবার খুঁজছিল নদী খাতে। এত লোকজন দেখে নদী খাতের ওপর দিয়ে ছুটতে শুরু করল।

নদী পার হবার আগে হেরম্যান তাঁর বাইনোকুলার দিয়ে পশ্চিমের সেই উপত্যকার দিকে তাকালেন, অনুচ্চ পাহাড়ের সারি সেখানে হারিয়ে গেছে দিগন্তর দিকে। হেরম্যান সে দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন ও জায়গাতে সত্যিই গভীর জঙ্গল মনে হচ্ছে!

ম্যাকুইনা সমস্ত যাত্রাপথে একবারও সুদীপ্তদের সাথে কোনো কথা বলেননি। নিজেদের লোকের সাথেই তিনি পথ চলছিলেন। এবার তিনি এগিয়ে এসে হেরম্যানের হাত থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে কিছুক্ষণ পশ্চিমের সেই উপত্যকার দিকে তাকিয়ে হেরম্যানের উদ্দেশ্যে বললেন, ওই উপত্যকাতেই সেই সবুজ বানরের বাসস্থান, ‘কি তাই তো?’

হেরম্যান সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, তেমনই লোকে বলে।’

ম্যাকুইনা আর কোনো কথা বললেন না। কেমন যেন একটা বাঁকা হাসি হেসে বাইনোকুলারটা ফিরিয়ে দিলেন।

নদীখাত পার হতে শুরু করল সুদীপ্তরা। হেরম্যান সুদীপ্তকে বললেন, ‘রুভভু কিন্তু বুরুন্ডির প্রধান নদী, সারা দেশে তার শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে আছে। বর্ষাকাল হলে এ নদীখাত এ ভাবে পার হওয়া আমাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হতো না।’

কিছুর সময়ের মধ্যেই নদীখাত পার হয়ে ওপারে পৌঁছে গেল সকলে। তারপর যাত্রাশুরু করল পশ্চিমের সেই উপত্যকার দিকে। এখনই তাদের কাছে এগিয়ে আসতে লাগল সেই উপত্যকা।

এক সময় তারা সত্যি এসে উপস্থিত হল উপত্যকার পাদদেশে। ছোট ছোট পাহাড়ের গায়ে আদিম বৃক্ষের ঘন জঙ্গল। বিশাল বিশাল গাছগুলো যেন অনেক উঁচুতে উঠে আকাশকে স্পর্শ করতে চাচ্ছে। দল বেঁধে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে ওঠা শুরু হল। এখানে পাহাড়ের ঢালে সূর্যের আলো ঠিকভাবে পৌঁছয় না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমে থাকা পচা পাতার রাশি ঢিপি হয়ে আছে গাছের নীচে। কোথাও কোথাও আবার ঘন বাঁশঝাড়। সেখানে গাছ কেটে পথ করে নিতে হচ্ছে। এ ভাবেই তারা ক্রমশ প্রবেশ করতে লাগল উপত্যকার ভিতরে।

ঘণ্টাখানেক পর তারা বেশ অনেকটা ওপরে উঠে এল। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে সে জায়গা থেকে। উত্তরে যতদূর চোখ যাচ্ছে খালি ছোট ছোট পাহাড়ের সারি।

টোগো বলল, ‘ও পাহাড় চলে গেছে রোয়াভার দিকে।’

কাছের পাহাড়ের ঢালগুলোও গভীর জঙ্গলাকীর্ণ। কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ চারপাশে।

টোগো হঠাৎ কাছেই একটা পাহাড়ের ঢালের দিকে আঙুল তুলে বলল, ওই দেখুন ! ওই দেখুন!’

তার কথা শুনে সেদিকে তাকাতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল সুদীপ্ত। কিছু দূরে জঙ্গলের ধারে পাহাড়ের ঢালে এক ফালি ফাঁকা জায়গা। সেখানে বসে আছে বিরাটাকারের অনেকটা শিম্পাঞ্জির মতো দেখতে প্রাণী। আগে এ প্রাণীগুলোকে কোনোদিন চাক্ষুষ না করলেও তাদের চিনতে অসুবিধা হল না সুদীপ্তর—গোরিলা ! আকার আর উঁচু কপালের পার্থক্য শিম্পাঞ্জির সাথে।

যাত্রা থামিয়ে সকলে দেখতে লাগল তাদের। টোগো বলল, ‘এ প্রাণীগুলোকে আমাদের এড়িয়ে চলতে হবে। অসীম সাহসী আর শক্তিধর প্রাণী, এমনিতে ওরাও মানুষকে এড়িয়ে চলে। তবে রেগে গেলে সিংহকেও রেয়াত করে না। আমি একবার কঙ্গোতে এ রকম এক লড়াই দেখেছিলাম। ভয়ংকর লড়াই!’ সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘কে জিতে ছিল তাতে?’

সে জবাব দিল, ‘শেষ পর্যন্ত সে লড়াই আমি দেখিনি। তা দেখতে গেলে আপনাদের সাথে আমার দেখা হত না।’

হেরম্যান কাছেই দাঁড়ানো ম্যাকুইনার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কি, ফেরার সময় এ প্রাণীও একটা নিয়ে যাবেন নাকি?’

ম্যাকুইনা জবাব দিল, সবুজ বানর না পেলে, তখন না হয়, এরই একটার গায়ে সবুজ রং মাখিয়ে নিয়ে যাব।

হেরম্যান আর সুদীপ্ত হাসল তার কথা শুনে।

গোরিলাগুলোও কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল সুদীপ্তদের। তারপর সেই ফাঁকা জায়গা ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল পাহাড়ের ঢালের গভীর জঙ্গলে। তারপর সুদীপ্তরা আবার ওপরে উঠতে শুরু করল। অবশেষে এক সময় তারা শুকনো ঘাস আর জঙ্গল ছাড়িয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে এল। আর তারপরই ঢালের বিপরীত দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল, মানুষের আস্তানা, একটা গ্রাম। গভীর জঙ্গল-আচ্ছাদিত পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামটা । গাছের গুঁড়ির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা গ্রামটার ঘর বাড়ি লোকজন সব কিছুই ওপর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের মাথা থেকে নীচের মানুষগুলোকে ঠিক পিঁপড়ের মতো দেখাচ্ছে। হেরম্যান তাঁর বাইনোকুলার দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর চাপা স্বরে তার পাশে দাঁড়ানো সুদীপ্ত আর টোগোর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এই সেই পিগমি গ্রাম। এখানইে পিগমিদের দঙ্গলে সেই সবুজ বানর বা মানুষকে দূর থেকে দেখেছিলেন কলিন্স।’

হেরম্যান এরপর আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ম্যাকুইনা এগিয়ে এলেন তাদের কাছে। হেরম্যানের কাছ থেকে বাইনোকুলার নিয়ে নীচের দিকে আর চারপাশের পাহাড়ের ঢালের জঙ্গলের দিকে দেখার পর তিনি বললেন, ‘চলুন তাহলে ওই গ্রামের দিকে এগোনো যাক। আচ্ছা, আপনি কী নিশ্চিত এ অঞ্চলেই ওই সবুজ বানরের সন্ধান মিলবে?’ হেরম্যান পুরো ব্যাপারটা না ভেঙে জবাব দিলেন, ‘আমি যতটুকু জানি এ অঞ্চলেই দেখা যায় ওই প্রাণীটাকে।’ এরপর টোগোর দিকে তাকালেন হেরম্যান। টোগো একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘বেলা গড়াতে শুরু করেছে। আর মাত্র ঘণ্টা চারেক আলো থাকবে। আমার মনে হয় এখন আর গ্রামের দিকে না এগোনোই ভালো। হাজার হোক, ওরা পুরোপুরি এখনও সভ্য নয়। আমাদের আক্রমণ করে বসতে পারে। আমার মনে হয়, এই পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলের আড়ালে আজকের মতো আমরা তাঁবু ফেলি। দিনের আলো যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ আড়াল থেকে ওদের ভাবগতিক লক্ষ করি। তারপর কাল ভোরে আমরা নীচে ওই গ্রামের দিকে নামব।’

ম্যাকুইনা বললেন, ‘তাহলে সেই ব্যবস্থাই করা যাক। কাল সকাল থেকে ওই গ্রাম আর ওই উপত্যকাতে অনুসন্ধান চালাব আমরা। যদি ও প্রাণী এখানে থাকে তাহলে তাকে ধরতেই হবে।’

হেরম্যান জানতে চাইলেন, ‘আপনি ওর সন্ধান পেলে কীভাবে ধরবেন ওকে?’ ম্যাকুইনা জবাব দিলেন, আমার কাছে ট্রাঙ্কুলিন গান’ আছে। তাই দিয়ে অচৈতন্য করে ফেলব ওকে।

হেরম্যান শুনে বললেন, ‘আপনি তো সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন দেখছি।’ ম্যাকুইনা শুধু হাসলেন, হেরম্যানের কথা শুনে। তারপর এগোলেন লোকজনকে তাঁবু ফেলার নির্দেশ দেবার জন্য।

শুকনো ঘাস ছাওয়া পাহাড়ের মাথায় গাছের আড়ালে তাঁবু ফেলা হল। ইচ্ছা করেই ম্যাকুইনার তাঁবু থেকে কিছুটা তফাতে সুদীপ্তদের তাঁবু বসাল টোগো। হুটু আস্কারিদের সে নির্দেশ দিল, তারা যেন কড়া নজর রাখে তাঁবুর ওপর। ম্যাকুইনা বা তার কোনো লোকজন তাঁবুর দিকে এলেই তার যেন সংকেতে ভিতরের লোককে সে ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়।

পাহাড় ভাঙতে বেশ কষ্ট হয়েছে সকলের৷ তাঁবু ফেলার পর সুদীপ্ত আর হেরম্যান চলে গেলেন তাঁবুর ভিতর বিশ্রাম নেবার জন্য, আর টোগো, হেরম্যানের বাইনোকুলারটা নিয়ে পাহাড়ের ঢালে একটা গাছের আড়ালে বসল, গ্রামটাকে লক্ষ করার জন্য।

ঘণ্টা তিন পর যখন সুদীপ্ত আর হেরম্যান তাঁবু ছেড়ে টোগোর কাছে এসে বসল এখন বিকাল পার হয়ে সন্ধ্যা নামতে চলেছে। আশেপাশের পাহাড়ের মাথায় কুয়াশার আস্তরণ ক্রমশ জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। দূরের পাহাড়গুলোর মাথায় বিদায়ী সূর্যের লাল আভা এখনও কিছুটা ছড়িয়ে আছে। মৃদু-মন্দ বাতাস ভেসে আসছে উত্তর দিক থেকে। শুকনো ঘাসের বন আর জঙ্গলের মাথাগুলো কাঁপছে তাতে। টোগোর পাশে বসে হেরম্যান নীচের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তেমন কিছু চোখে পড়ল?’

টোগো জবাব দিল, ‘না তেমন কিছু দেখিনি। যা মনে হচ্ছে, তাতে শ-দুয়েক লোক আছে ওই গ্রামে।’

সুদীপ্ত তাকে বলল, ‘কাল তো আমরা ওই গ্রামে যাচ্ছি। তা তুমি ওদের ভাষা জানো?’

টোগো বলল, ‘ওরা কী ভাষায় কথা বলে তা আমার জানা নেই, তবে আমি বান্টু ভাষা জানি। আফ্রিকার দুশোর বেশি জনগোষ্ঠী এ ভাষায় কথা বলে। আর তাতে কাজ না হলে ‘কমন আফ্রিকান কোডে’ কথা বলব।’

“কমন আফ্রিকান কোড’ কী জানতে চাইলে সুদীপ্ত।

এ উত্তরটা হেরম্যানই দিলেন, বহু জনগোষ্ঠীর দেশ এই আফ্রিকা। গোটা সাতেক ইউরোপীয় ভাষা ছাড়াও ৭৫০টা ভাষা আছে এখানে। জঙ্গলের মধ্যে এখানে এমন অনেক গ্রাম আছে, সেখানে এক গ্রামের মানুষ, পাশের গ্রামের মানুষের ভাষা বোঝে না। জঙ্গলে যারা ঘুরে বেড়ায়, তারা এই অসুবিধা দূর করার জন্য কিছু ‘কমন শব্দ’ আর সংকেত ব্যবহার করে। অন্যের ভাষা না জানানও ওই শব্দ আর সংকেতের মাধ্যমে তাকে বক্তব্য মোটামুটি বুঝিয়ে দেওয়া যায়। একেই বলা হয় ‘কমন আফ্রিকান কোড।’

হেরম্যান এরপর বললেন, পিগমিদের সঙ্গে কথা বলাটা একান্ত জরুরি। তাদের সাথে কথা বলে ওই সবুজ প্রাণীর ব্যাপারে জানার চেষ্টা করতে হবে। নইলে এই দুর্গম উপত্যকাতে তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

টোগো এবার বলল, ‘সবই তো বুঝলাম, কিন্তু এই আফ্রিকাভার যে আমাদের ঘাড়ে এসে চাপল, এ ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছে না। লোকটা সুবিধার নয়, ও আমাকে হীরের লোভ দেখিয়ে হাত করতে চাচ্ছিল!’

হেরম্যান আর সুদীপ্ত তার কথা শুনে, একসাথে অবাক হয়ে বলল, ‘মানে!’

টোগো বলল, ‘ওর সাথে যারা এসেছে তাদেরকে ও নগদ টাকার পরিবর্তে একটা করে ছোট হীরে দিয়েছে। অর্থমূল্যে যা নাকি আস্কারিদের মজুরির অনেক অনেকগুণ বেশি, ফেরার পরও নাকি আরও একটা করে দেবে! ওরকমই একটা হীরে লোকটা আপনারা তাঁবুতে ঢোকার পর আমাকে বকশিশ হিসাবে দিতে এসেছিল। ও বকশিশের মানে আমি বুঝি।’

এরপর একটু থেমে টোগো বলল, ‘ওই সবুজ বানরের জন্য দেদার পয়সা খরচ করছে লোকটা। এতগুলো নতুন রাইফেল! এতগুলো হীরে! হোক না সেগুলো তার নিজের খনি থেকে তোলা, হাজার হোক লোকটা একজন ব্যবসায়ী, নিছক একটা অদ্ভুত প্রাণীকে চিড়িয়াখানায় রাখার জন্য সে পয়সা খরচ করছে বলে মনে হয় না, আমার ধারণা ওই দানব বানরকে ও বিশেষ কোনো কারণে ধরতে চাচ্ছে!’

টোগের কথা শুনে সুদীপ্ত বলল, ‘তাহলে সে কারণ, কী হতে পারে?’

সুদীপ্তর এ প্রশ্নর উত্তর অবশ্য টোগো বা হেরম্যান কেউই দিতে পারল না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নেমে এল উপত্যকাতে। পাহাড়ের নীচে পিগমি গ্রামে জ্বলে উঠতে শুরু করল বিন্দু বিন্দু মশালের আলো। সুদীপ্তরা তাদের তাঁবুতে ফেরার জন্য উঠে পড়ল। বাইরে বেশ জোরেই বাতাস আসছে উত্তর থেকে। ও দিকেই তো গ্রেটরিফটের বড় বড় শৃঙ্গগুলো। রাত বাড়ার সাথে বাতাস বাড়ছে।

রাতে ম্যাকুইনা এলেন সুদীপ্তদের তাঁবুতে। দু-চারটে মামুলি কথাবার্তা বলে চলে গেলেন তিনি। সুদীপ্তরা বেশ তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে তাঁবুতে শুয়ে পড়ল।