৪
টোগো বলল, ‘নীচে নেমে আমরা সোজা ওদের ওখানেই যাব। আর একটা কথা, নিজেদের মধ্যে কোনো-আলোচনা থাকলে একটু আড়াল-আবডালে সারবেন। জঙ্গলে অচেনা লোককে চট করে বিশ্বাস করতে নেই।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই উপত্যকার মাটিতে পা রাখল সুদীপ্তরা। গভীর জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চল। চারপাশে অনুচ্চ সব পাহাড়। তাদের আড়ালে লুকিয়ে আছে এরকমই আরো নানা উপত্যকা। তার কোনো-কোনোটাতে আজও হয়তো কোনো সভ্য মানুষের পদার্পণ ঘটেনি। ওইসব অজানা-অচেনা উপত্যকারই কোথাও লুকিয়ে আছে সুদীপ্তদের গন্তব্যস্থল, পিগমিদের সেই গ্রাম।
পশ্চিমের যে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সুদীপ্তরা নীচে নামল, সূর্য তার মাথার আড়ালে চলে গেছে। যদিও সন্ধ্যা নামতে অন্তত ঘণ্টা তিনেক সময় বাকি, তবুও পাহাড়ের ছায়া উপত্যকার আলোকে সময়ের তুলনায় বেশ কিছুটা ম্লান করে রেখেছে। একটা ছায়াময় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে চারপাশে। শব্দ বলতে শুধু ঝিঁ ঝিঁ জাতীয় কোনো পোকার একটানা ডাক, আর বড়বড় গাছগুলোর ডালপালার খসখস শব্দ। নীচে নামার পর কিছুক্ষণ ধরে চারপাশটা দেখে নিল সকলে, তারপর বিরাট বিরাট গাছের গুঁড়ির ফাঁক গলে, ঝোপজঙ্গল ভেঙে তারা এগোল সেই ফাঁকা জায়গার দিকে, যেখানে তাঁবু ফেলেছে লোকগুলো।
জঙ্গলের মধ্যে একটা বৃত্তাকার জায়গা সাফ করে নেওয়া হয়েছে তাঁবু ফেলার জন্য। বেশ অনেকটা তাঁবু খাটানো হয়েছে সেখানে। তাঁবুগুলোর সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘদেহী মাসাই রক্ষীর দল। আবলুশ কাঠের মতো তাদের গায়ের রং, হাতে ধরা আছে বর্শা। কাঁধে চামড়ার স্ট্রিপে ঝুলছে রাইফেল। ভাবলেশহীন মুখ, ঠিক যেন পাথরখোদাই মূর্তি। সুদীপ্তরা জায়গাটাতে গিয়ে উপস্থিত হতেই তারা সতর্ক ভঙ্গীতে ফিরে তাকাল তাদের দিকে। আর তারপরই একটা তাঁবুর আড়াল থেকে যে লোকটা বেরিয়ে সুদীপ্তদের সামনে এসে দাঁড়াল তাকে দেখে চমকে গেল তারা। ছ-ফুট উচ্চতার লোক হামেশাই দেখা যায় আফ্রিকাতে, সুদীপ্ত নিজে পাঁচ-দশ, হেরম্যান পাক্কা ‘ছ-ফুট’, টোগোর উচ্চতাও ওরকমই হবে। মাসাইরাও বেশ লম্বা। কিন্তু এ লোকটার মাথা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে! সাতফুটের বেশিও হতে পারে! এত লম্বা লোক এর আগে কোনোদিন দেখেনি সুদীপ্ত। তার প্রস্থও আনুপাতিক। ঠিক যেন একটা দানব! লোকটার গায়ের রং মনে হয় সাদা, তবে তা আফ্রিকার প্রখর সূর্যের তাপে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। মাথার চুলের রং লালচে বাদামি। পরিষ্কার করে কামানো মুখমণ্ডলে এক জোড়া তীক্ষ্ণ চোখ, টিকালো নাসা। একটা খাঁকি রঙের পোশাক তার পরনে। পায়ে হাইহিল চামড়ার বুট। কোমরে রিভলভার। বুকের কাছে আড়াআড়িভাবে একটা কার্তুজের বেল্ট ঝুলছে। সুদীপ্তর মনে হল লোকটার বয়স বছর চল্লিশ হবে।
এই লোকটাই যে সেই আফ্রিকান্ডার, সুদীপ্তদের বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না। লোকটা কয়েক মুহূর্ত সুদীপ্তদের সতর্ক দৃষ্টিতে জরিপ করে নেবার পর তাদের উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে বলল, ‘আপনারা কোথা থেকে আসছেন?’
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘বুজুমবুরা। অর্থাৎ বুরুন্ডির রাজধানী থেকে। ‘ও বুজুমবুরা। কিন্তু আপনাদের দুজনকে দেখে তো আফ্রিকান বা আফ্রিকান্ডার বলে মনে হচ্ছে না!’ ভ্রু কুঁচকে বলল লোকটা।
হেরম্যান বললেন, ‘আপনার ধারণা সঠিক। আমরা দুজন ও-দুটোর কোনোটাই নই। আমরা বুজুমবুরা থেকে এখানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম। আমি, ‘ফ্রেডরিখ হেরম্যান, জার্মানির বাসিন্দা। আর আমার এই সঙ্গী হল ইন্ডিয়ান। নাম, ‘সুদীপ্ত’। সঙ্গের অন্যরা অবশ্য বুরুন্ডিরই লোক। এই টোগো হল, আমাদের গাইড অ্যান্ড ম্যানেজার।’ এই বলে তিনি আঙুল তুলে টোগোকে দেখালেন।
তা আপনারা কী বায়োলজিস্ট? নাকি, কোনো জিওগ্রাফিক সোসাইটির লোক? সাধারণ ট্যুরিস্ট এখানে এতদূর আসে না। আপনাদের দেখে ঠিক শিকারি বলেও মনে হচ্ছে না!’ লোকটা একটু সন্দিগ্ধভাবে বলল হেরম্যানের উদ্দেশ্যে।
হেরম্যান জবাব দেবার সময় একটু কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বললেন, ‘আমাকে ওই বায়োলজিস্টই বলতে পারেন আপনি। এই অঞ্চলের পশুপাখি সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য এখনও সভ্য দুনিয়ার কাছে তেমন নেই। ওদের সম্বন্ধেই তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছি। কাছেপিঠের উপত্যকাগুলোতে কী কী প্রাণী আছে সে সম্পর্কে একটু অনুসন্ধান করব।’ আফ্রিকান্ডার তার কথা শুনে ঘাড় নেড়ে মনে হয় কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই হেরম্যান তাঁর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আর আপনার পরিচয়?’
লোকটা হেরম্যানের প্রশ্ন শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর বলল, ‘আমার নাম, ম্যাকুইনা ডায়ার। তাঞ্জানিয়ার জাঞ্জিবারের বাসিন্দা। ওখানে আমার একটা ডায়মন্ড মাইন’ আছে। আমি ওখানেই থাকি।’
‘ডায়মন্ড মাইন! অর্থাৎ, হীরের খনির মালিক!’ সুদীপ্ত অবাক হয়ে তাকাল লোকটার দিকে।
নিজের পরিচয় দেবার পর ম্যাকুইনা দু-পা এগিয়ে এসে প্রথমে করমর্দন করলেন হেরম্যানের সঙ্গে, তারপর সুদীপ্তর দিকে তার ডান হাতের বিরাট থাবাটা করমর্দনের জন্য বাড়িয়ে দিয়ে একটু হাসলেন। বিকালের স্বল্প আলোতেই লোকটার দাঁতের ফাঁকে ছোট্ট একটা বিন্দু ঝিলিক দিয়ে উঠল। হীরে। হীরে বসানো আছে ম্যাকুইনার দাঁতে!
সুদীপ্তর সাথে করমর্দনের পর ম্যাকুইনা আবার হেরম্যানের দিকে ফিরে তাকাতেই, হেরম্যান এরপর তাকে মৃদু হেসে বললেন, ‘তা আপনি এখানে কিসের সন্ধানে এসেছেন?’
ম্যাকুইনা প্রশ্ন শুনে একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমি এখানে এসেছি সিংহ শিকারে। তাঞ্জানিয়াও সিংহের দেশ। আমার রক্তেও শিকারের নেশা আছে। কিন্তু তাঞ্জানিয়াতে এখন সিংহ শিকার প্রায় নিষিদ্ধ বললেই চলে। আগের দিন আর নেই। এখন বছরে মাত্র দু-একটা পাশ, লটারির মাধ্যমে দেওয়া হয় সিংহ শিকারের জন্য। তা-ও অনেক বিধি নিষেধ আছে শিকারের ব্যাপারে। কারণ ওই প্রাণীগুলোকে দেখার জন্যই তো পকেট ভর্তি ডলার নিয়ে ট্যুরিস্টরা ছুটে আসে ওখানে। গভর্নমেন্টের দু-পয়সা লাভ হয়। কিন্তু এখানে ওসব হাঙ্গাম নেই। এ জায়গাটা বুরুন্ডি আর কঙ্গোর সীমান্ত, অনেকটা ‘নো ম্যানস ল্যান্ডের’ মতো। কাগজ কলমে দু-দেশের একটা সীমারেখা নির্ধারিত থাকলেও, দু-দেশের সরকারই এ জায়গা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। আর সিংহও এখানে প্রচুর আছে। তাই খোঁজ নিয়ে আমি এখানে চলে এসেছি।’ একটানা অনেকগুলো কথা বলে থামলেন তিনি।
হেরম্যান জানতে চাইলেন, ‘এখানে এসে কোনোটাকে এখনও মেরেছেন?’
ম্যাকুইনা বললেন, ‘এখনও পর্যন্ত নয়। উল্টে গতকাল রাতে, ওদেরই একটা বড় দল হামলা চালিয়েছে আমাদের তাঁবুতে। একজন মাসাই জখম হয়েছে। ওই যে সামনের পাহাড়টা দেখছেন। ওদিক থেকে হানা দিচ্ছে ওরা। কাল বিকালে আমরা এখানে তাঁবু ফেলেছি। আজ সকালে ক’জনকে পাঠিয়ে ছিলাম ওদিকে। ওরা এসে খবর দিল যে, ওই পাহাড়ের নীচে ঘাসবনে গোটা তিনেক বড় বড় দল আছে। সিংহ-সিংহী এক-একটা দলে সাত-আটটা করে প্রাণী আছে!’
হেরম্যান এরপর কী যেন চিন্তা করে ম্যাকুইনাকে বললেন, ‘আমরা যদি আজ আপনাদের এখানে তাঁবু ফেলি, তাহলে আপনাদের আপত্তি আছে? কাল আমরা আবার অন্য দিকে এগোব।’
ম্যাকুইনা জবাব দিলেন, ‘না, আপত্তি নেই। বেশ কিছুটা জায়গা তো খালি আছে।
তাছাড়া অচেনা জায়গাতে একসঙ্গে থাকাটা উভয়ের ক্ষেত্রেই অনেক বেশি নিরাপদ।’ হেরম্যান বললেন, ‘ধন্যবাদ’। ম্যাকুইনা বললেন, “ঠিক আছে, আপনারা তাঁবু ফেলার ব্যবস্থা করুন। পরে আবার কথা হবে আপনাদের সাথে।’ এই বলে ম্যাকুইনা ‘আকালা’ বলে হাঁক দিলেন। মাসাইদের ভিড়ের ভিতর থেকে সবচেয়ে লম্বা লোকটা কাছে এসে দাঁড়াল। তাকে দেখে চমকে উঠল সুদীপ্তরা। একটা লম্বা কাটা দাগ তার ডান পাশের চোখের নীচ থেকে চিবুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। সেদিকে তার ঠোঁটের একটা অংশ নেই। শূন্য ঠোঁটের ভিতর মাড়ি সমেত দুটো দাঁত দেখা যাচ্ছে। সুদীপ্ত যে লোকটাকে দেখে চমকে গেছে তা সম্ভবত বুঝতে পেরে ম্যাকুইনা বললেন, ‘ওর মুখে সিংহ থাবা মেরেছিল, ও তারই দাগ। ও মাসাইদের সর্দার। ও রইল, সাহায্যের প্রয়োজন হলে ওকে বলবেন’—এই বলে হেরম্যানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি তাঁর তাঁবুর দিকে এগোলেন।
ম্যাকুইনার তাঁবুর পাশেই একটা ফাঁকা জায়গাতে দুটো তাঁবু ফেলা হল। একটা তাঁবুতে গিয়ে ঢুকল হেরম্যান, সুদীপ্ত আর টোগো। হেরম্যান আর সুদীপ্ত মাটিতে বসে পড়ার পর হেরম্যান টোগোর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ম্যাকুইনা লোকটাকে কেমন বুঝলে?’
টোগো বলল, ‘এ অভিযানের জন্য প্রচুর টাকা ঢেলেছে লোকটা। মাসাইদের হাতের রাইফেলগুলো একদম আনকোরা নতুন! তবে একটা জিনিস লক্ষ করলাম, এ রাইফেলগুলো স্বয়ংক্রিয় হলেও আসলে এসবই দ্রুতগতিসম্পন্ন হালকা রাইফেল। বিশেষত মানুষ বা হরিণ জাতীয় প্রাণী মারা হয় এই রাইফেল দিয়ে, সিংহ শিকারের জন্য উপযুক্ত নয়।
তার কথার মাঝখানেই সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল, ‘সিংহ শিকারের জন্য কী ধরনের রাইফেল লাগে??
টোগো জবাব দিল, ‘ভারী রাইফেল। আফ্রিকার এইসব নিবিড় জঙ্গলে এমন কার্টিজ ব্যবহার করতে হয়, যা ধীরগতিসম্পন্ন অথচ প্রচণ্ড শক্তিশালী। গাছের গায়ে লেগে পিছলে যাবে না। ‘ম্যাগনাম’ বা ‘৩৫ হোয়েলাস’ এ জাতীয় রাইফেল। চারণভূমি হলে, কেউ কেউ হয়তো ‘ইংলিশ রিপিটার’ও ব্যবহার করে। কিন্তু এ ধরনের কোনো রাইফেল দেখলাম না ওদের কাছে। এটা একটা খটকার ব্যাপার!
হেরম্যান বললেন, মাসাইগুলো তো সাধারণ গার্ড। এমন হতে পারে যে শিকারের রাইফেল ম্যাকুইনার তাঁবুতে আছে?’
টোগো বলল, ‘হতে পারে। আপনারা এখন বিশ্রাম করুন। আমি দেখি মাসাইগুলোর সাথে ভাব জমিয়ে কোনো খবর সংগ্রহ করতে পারি কিনা। তাছাড়া রান্নার তদারকিও করতে হবে। কথাগুলো বলে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে গেল টোগো। সুদীপ্ত হেরম্যানকে জিজ্ঞেস করল, ম্যাকুইনার অরিজিন কী মনে হয়? ইওরোপীয় নাকি আমেরিকান?’
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘ডায়ার’ পদবিটা ব্রিটিশ অথবা আইরিশ ম্যানদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। আমার ধারণা ওর গ্র্যান্ডফাদার ব্রিটিশ ছিলেন। ১৮৮৬ সালে আমাদের দেশ, অর্থাৎ জার্মানি ও ব্রিটেন যৌথভাবে ‘তাঙ্গানিকা-জাঞ্জিবার’ অঞ্চল দখল করে। তারপর জার্মানি নেয় ‘তাঙ্গানিকা’ আর ব্রিটেন নেয় ‘জাঞ্জিবার’। হাতির দাঁত, হীরে আর সোনার লোভে বেশ কিছু ভাগ্যান্বেষী ইংরেজ সেসময় জাঞ্জিবারে বসতি স্থাপন করে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত জাঞ্জিবার ছিল ব্রিটেনের অধীনে। ঠিক যেমন ছিল তোমাদের দেশ। তবে ওদেশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা আসে ১৯৬৩ সালে। কিন্তু তার সাথে সাথেই সেখানে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মাথাতেই ১৯৬৪ তে ‘তাঙ্গানিকা’ ও ‘জাঞ্জিবার’ মিলিত হয়ে এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। তার নাম হয় ‘তাঞ্জানিয়া’। এখনও বহু বিটিশ বংশদ্ভুতরা ওখানে বসবাস করেন।
হেরম্যান এরপর বললেন, ‘আজ অন্য দিনের চেয়ে বেশ কিছুটা সময় আগে তাঁবু ফেলা গেছে। বাড়তি সময় পাওয়া গেল বিশ্রামের জন্য। কাল থেকে শুরু হবে আমাদের আসল অভিযান।’
সুদীপ্ত প্রশ্ন করল, ‘ওই পিগমি অঞ্চলে পৌঁছতে আমাদের কত সময় লাগবে?’ তিনি জবাব দিলেন ‘কলিন্সের ডায়েরি অনুসারে সম্ভবত ও-জায়গাটা ‘মাইল তিরিশ হবে। আশেপাশের কোনো পাহাড়ের আড়ালে রয়েছে ওই উপত্যকা। টোগো ফিরলে ওর সঙ্গে কলিন্সের ম্যাপটা নিয়ে আলোচনা করে আমাদের অন্তিম যাত্রাপথ ঠিক করতে হবে।’ এই বলে বিশ্রাম নেবার জন্য হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন।
সুদীপ্ত শুয়ে পড়ে নানা কথা চিন্তা করতে লাগল। ওদিকে বাইরে দ্রুত ফুরিয়ে আসতে লাগল বিকেল।
শুয়ে থাকতে থাকতে একটু তন্ত্রামতো এসে গিয়েছিল সুদীপ্তর। হঠাৎ বাইরে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে উঠে বসল সে। কারা যেন চেঁচাচ্ছে, ‘সিম্বা! সিম্বা!!’ শব্দটার অর্থ বুঝতে পেরেই সুদীপ্ত লাফিয়ে উঠে তাঁবুর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল তার কিছু তফাত দিয়ে একটা হলুদ রঙের বিদ্যুৎ, একটা মানুষকে কাঁধে ফেলে ছুটে যাচ্ছে! কয়েক মুহূর্ত মাত্র, আর তারই মধ্যে প্রাণীটা সারিবদ্ধ মাসাইদের চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে দিয়ে তাঁবুর সামনের ফাঁকা জায়গাটা পার হয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল। শেষ মুহূর্তে প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে কে যেন একটা বর্শা ছুড়ে ছিল। কিন্তু সেটা প্রাণীটাকে স্পর্শ করল না। হতভাগ্য মাসাইটার আর্ত চিৎকার জঙ্গলের ভিতর ক্রমশ দূর থেকে দূরে হারিয়ে গেল।
সুদীপ্ত দেখল ম্যাকুইনা একটা রাইফেল নিয়ে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। পাশেই তাঁর তাঁবু। হেরম্যানও উঠে পড়ে তাঁবুর দরজায় সুদীপ্তর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা দুজন বাইরে বেরিয়ে ম্যাকুইনার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মাসাইরা এসে ম্যাকুইনাকে যা বলল, তার অর্থ হল, ‘যাকে সিংহ টেনে নিয়ে গেল সে লোকটা মিনিট তিনেক আগে, বড় যে তাঁবুটা আছে তার পিছনে একটা গাছের আড়ালে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেছিল। প্রাণীটা ওখানেই ঘাপটি মেরে বসেছিল। আর তারপর…।’
অন্ধকার নেমে আসছে। এই সময়ে ওই মাসাইকে জঙ্গলে খুঁজতে যাওয়া মানে, নিজেদেরও মৃত্যু ডেকে আনা। কাজেই সে কাজ করতে গেল না কেউ। সুদীপ্তর ম্যাকুইনার কথা শুনে মনে হল, তিনি মাসাইটার থেকেও একটা বলুক চলে যাওয়াতে বেশি দুঃখ পেলেন। কারণ তিনি সুদীপ্তদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কী ভয়ংকর জায়গা দেখছেন! এতগুলো লোকের মধ্যেও লোকটাকে টেনে নিয়ে গেল। আমার গুলি চালানো উচিত ছিল। সিংহটা তো ওকে মারলই। ওর কাঁধের বন্দুকটা অন্তত বেঁচে যেত! এক একটা বন্দুকের অনেক দাম। কাল বনের ভিতর লোক পাঠাব, যদি বন্দুকটা অন্তত উদ্ধার করা যায়!’
হেরম্যান বললেন, ‘হ্যাঁ, সত্যি ভয়ংকর জায়গা। এতগুলো লোক দেখেও প্রাণীটা ভয় পেল না!’
তবে এই উপত্যকা যে সত্যি কতটা ভয়ংকর তা বুঝতে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল হেরম্যান বা ম্যাকুইনার দলের সবাইকে। চারপাশ প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। ম্যাকুইনা তাদের লোকদের তাঁবুগুলোর চারপাশে ফাঁকা জমিটা ঘিরে অগ্নিকুণ্ড জ্বালাতে বললেন।
সুদীপ্তদের সঙ্গের তুতসি কুলিরাও হাত লাগাল তাদের কাজে। হেরম্যানও হুটু গার্ডদের সতর্ক থাকতে বললেন। ম্যাকুইনা হেরম্যানকে বললেন, ‘যান, আপনারা তাঁবুতে গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমি রাতে আপনাদের তাঁবুতে যাব।’
হেরম্যান বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আসবেন। অভিজ্ঞতা বিনিময় করা যাবে।’ ম্যাকুইনা এরপর ঢুকে গেলেন নিজের তাঁবুতে। টোগো কাছেই ছিল, হেরম্যান তাকে
বললেন, ‘তুমি কখন আসছ? আমাদের একটু আলোচনায় বসতে হবে।’
সে বলল, ‘আর এক ঘণ্টার মধ্যেই রান্না হয়ে যাবে। একেবারে খাবার নিয়ে যাচ্ছি।’ তার উত্তর শুনে সুদীপ্তরা তাঁবুর দিকে এগোল।
তাঁবুর ভিতরটা অন্ধকার। হেরম্যান একটা পেট্রোম্যাক্স জ্বালিয়ে নিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে বললেন, ‘অন্য সময় জঙ্গলের মধ্যে যখন তাঁবু ফেলা হবে, তখন দিনের বেলা হলেও তাঁবু ছেড়ে কোথাও একটু দূরে গেলে, ফিরে এসে ভিতরে ঢোকার আগে বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখে নেবে। ফাঁকা তাঁবুতে কোনো প্রাণী ঢুকে বসে থাকতে পারে।’
সুদীপ্ত তাঁর কথা শুনে একটু হালকা ছলে বলল, ‘প্রাণী মানে, সিংহ নাকি?’
হেরম্যান বললেন, ‘হ্যাঁ, তাও হতে পারে। আমি ঠাট্টা করছি না। তোমাকে একটা ছোট্ট গল্প বলি, ‘আমার পরিচিত এক শিকারি, শিল্ডম্যান একবার উগান্ডা গিয়েছিলেন অ্যান্টিলোপ শিকারের জন্য। ঘাসবনের এক প্রান্তে একটা বাওয়াব গাছের নীচের তাঁবু ফেলেছিলেন তিনি। সঙ্গী বলতে শুধু একজন মাসাই। তাকে নিয়ে সারাদিন শিকারের সন্ধানে ঘুরে সন্ধ্যায় রোজ তাঁবুতে ফিরে আসেন। ওরকমই একদিন শিকার শেষে ফিরে সটান তাঁবুতে ঢুকে তাঁর ক্যাম্পখাটে শুয়ে পড়লেন। তার সঙ্গী ছিল বাইরে। হঠাৎ তাঁবুর ভিতর একটা বোটকা গন্ধ পেয়ে তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখে তার ক্যাম্পখাটের ঠিক নীচেই থাবার ওপর মাথা রেখে নিদ্রা যাচ্ছেন এক সিংহ মহারাজ। তাঁবুতে ঢোকার সময় ব্যাপারটা তাঁবুর আধো অন্ধকারে ঠাহর করতে পারেননি শিল্ডম্যান। তার সঙ্গী যেন কীভাবে বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা, সে তাঁবুতে আর ঢুকল না। এদিকে সিংহর ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে খাট ছেড়ে আর নীচে নামতে শিল্ডম্যান সাহস পেলেন না। অন্ধকার নেমে এল তাঁবুর ভিতর-বাইরে। পরিস্থিতিটা বোঝো একবার! একটা মানুষ আর সিংহ, আর তাদের দুজনের মধ্যে সামান্য একটা ক্যাম্বিস কাপড়ের ব্যবধান! ওই অবস্থাতেই সারারাত কাটালেন তিনি। তবে বরাত ভালো বলতে হবে তার। শেষ রাতের দিকে ঘুম ভাঙল পশুরাজের। তারপর সে শিল্ডম্যানকে কিছু না বলেই তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সারারাত একটা মানুষ তার সঙ্গে কাটাল এ ধারণা সম্ভবত সিংহমশাইও করতে পারেননি। মাসাইটা ভোরবেলা তাঁবুতে ঢুকে দেখল, এক রাতেই যেন শিল্ডম্যান অনেকটা রোগা হয়ে গেছেন!
হেরম্যানের গল্প শুনে সুদীপ্ত বলল, ‘তাহলে সত্যিই ব্যাপারটা খেয়াল রাখতে হবে।’ সুদীপ্ত আর হেরম্যান এরপর শুয়ে তাদের যাত্রাপথের নানা কথা আলোচনা করতে লাগল।
এক ঘণ্টাও কাটেনি, হঠাৎ তাঁবুর বাইরে আবার একটা গোলযোগ শুনে উঠে বসল সুদীপ্তরা। ঠিক সেই মুহূর্তে টোগো তাঁবুর দরজার মুখে এসে দাঁড়াল। বেশ কিছুক্ষণ হল অন্ধকার নেমে গেছে। তাঁবুগুলোকে ঘিরে ফাঁকা জমিটার চারপাশে গোটা সাতেক ছোট বড় অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হয়েছে। তাঁবুর সামনের ফাঁকা জমির ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মাসাই রক্ষী ও সুদীপ্তদের সঙ্গে আসা তুতসি কুলিরা। ম্যাকুইনাদের কাছে দাঁড়াতেই টোগো আঙুল তুলে পশ্চিম দিকে দেখাল। সেদিকে একটা বড় অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে। সুদীপ্ত প্রথমে সেদিকে তাকিয়ে কিছু ঠাহর করতে পারল না, তারপর যেন মনে হল অগ্নিকুণ্ডের ঠিক ওপাশে অন্ধকার বনানীর নীচে যেন জ্বলছে সার সার কয়েক জোড়া চোখ! কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাদের অবয়বগুলো স্পষ্ট হয়ে গেল সুদীপ্তর চোখে। হ্যাঁ, সিংহ! গোটা সাতেক সিংহের একটা বেশ বড় দল! দুটো সিংহ, বাদ বাকি সিংহী। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আগুনের এ-পাশে থাকা মানুষেদের লক্ষ করছে প্রাণীগুলো।
কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর হেরম্যান বললেন, ‘ওরা আমাদের আক্রমণ করবে নাকি?’
ম্যাকুইনা বললেন, ‘একটাকে নিয়ে যাবার পর খাবারের খোঁজে…সে উদ্দেশ্যেই দল বেঁধে এসেছে ওরা।’
আরও মিনিট পাঁচেক সময় কেটে যাবার পর প্রাণীগুলো অন্ধকার ছেড়ে বেরিয়ে একদম অগ্নিকুণ্ডের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। অগ্নিকুণ্ডের আলোতে দাঁড়িয়ে জিভ চাটছে প্রাণীগুলো।
আর অপেক্ষা করা সমীচীন হবে না মনে করে ম্যাকুইনা প্রাণীগুলোকে হটাবার জন্য আকালার বন্দুকধারী মাসাইদের ফাঁকা আওয়াজ করার নির্দেশ দিলেন। বেশ কয়েকটা বলুক শূন্যে গর্জে উঠল। তাদের প্রচণ্ড শব্দে খানখান হয়ে গেল রাত্রির নিস্তব্ধতা। কিন্তু তারা বন্দুকের শব্দে ঘাবড়াল না। অগ্নিকুণ্ডের থেকে কয়েক পা পিছু হটে দাঁড়াল মাত্র।
মিনিট তিনেক পর আবার রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজ করা হল। কিন্তু এবারও প্রাণীগুলো ভয় পেল বলে মনে হল না। তারা একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
সুদীপ্তর পিছনে দাঁড়িয়ে টোগো বলল, ‘ওরা দলে ভারী। এত তাড়াতাড়ি রণে ভঙ্গ দেবে মনে হয় না। ওরা ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে!’
‘কিসের ধৈর্য?’ পিছন ফিরে জানতে চাইল সুদীপ্ত।
টোগো জবাব দিল, ‘কখন আমরা অসতর্ক হই। আর সেই সুযোগে আগুন টপকে তুলে নিয়ে যাবে কাউকে!’
টোগোর কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘাড়ের ফাঁক দিয়ে পিছনের দিকে আর একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল সুদীপ্তর, সেদিকেও সবার অলক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে আরও একদল সিংহ! দুটো অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে সে দিকে। একটা বিরাট কলেবরের সিংহ দুটো অগ্নিকুণ্ডের মাঝখান দিয়ে সন্তর্পণে গুঁড়ি মেরে ফাঁকা জমিতে প্রবেশ করতে চলেছে। অগ্নিকুণ্ড যদি ও পার হয়ে যায় তবে সে-জায়গা থেকে সুদীপ্তদের যে দূরত্ব, তাতে মাত্র কয়েকটা লাফেই সে পৌঁছে যাবে তাদের কাছে!
সুদীপ্ত ব্যাপারটা অনুধাবন করার সাথে সাথেই চিৎকার করে উঠল, ‘ওই যে! ওই যে! ওদিকেও একটা দল! সকলে ফিরে তাকাল পিছনে। সেই সিংহটা তখন অগ্নিকুণ্ড পার হবার জন্য এগিয়ে এল। প্রমাদ গুনল সবাই। দু-পাশ থেকে তাদের আক্রমণে উদ্যত হিংস্র প্রাণীগুলো। সিংহগুলোকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করল রক্ষীরা। রাইফেলের শব্দ আর ক্রুদ্ধ প্রাণীদের গর্জনে কেঁপে উঠতে লাগল চারদিক। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল এ লড়াই। গোটা চারেক প্রাণী মাটিতে পড়ে যাবার পর অবশেষে রণে ভঙ্গ দিল সিংহের দল। জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়ল তারা। সেখান থেকে ভেসে আসতে লাগল তাদের ক্রুব্ধ গর্জন। তাদের আরও দূরে হটাবার জন্য বেশ কিছুক্ষণ ধরে চারপাশের অন্ধকার জঙ্গল লক্ষ্য করে গুলি চালাল মাসাইরা। তারপর এক সময় সব শব্দ থেমে গেল। যেন, কোথাও কিছু হয়নি! শুধু বাতাসে ভেসে বেড়ানো বারুদের কটু গন্ধ, আর অগ্নিকুণ্ডগুলোর আশেপাশে পড়ে থাকা মৃত প্রাণীগুলোর লাশ শুধু স্মরণ করাতে লাগল সদ্য ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনার কথা।
এ অভিজ্ঞতা হেরম্যান বা সুদীপ্তর আগে কোনোদিন হয়নি।
টোগো বলল, ‘প্রাণীগুলো কী ধূর্ত দেখেছেন! কৌশল করে দুটো দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল ওরা। প্রথম দলটা তাদের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করাচ্ছিল। আর সেই সুযোগে দ্বিতীয় দল আমাদের পিছন থেকে আক্রমণের তালে ছিল। তাদের ঠিক সময় দেখতে না পেলে আমাদের কাউকে মরতেই হত!’
ম্যাকুইনা বললেন, ‘সম্ভবত প্রাণীগুলো জঙ্গলের ওপাশে ঘাসবনের দিকে চলে গেল ওদের আড্ডায়।
টোগো বলল, ‘তবে কিছুই বলা যায় না। ওরা আবার ফিরে আসতে পারে। রাতটাই তো এখনও বাকি! আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’
আলোচনা করে এরপর ঠিক হল, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে তাঁবুগুলোর সামনে আরও বেশ কয়েকটা অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হবে। আর তাঁবুগুলোকে গোল হয়ে ঘিরে রক্ষীরা সারারাত পাহারা দেবে। আর নামমাত্র যে ক’জন লোক তাঁবুর ভিতর থাকবে, তারা যেন অস্ত্র নিয়ে শোয়।
আলোচনা শেষ হবার পর, সুদীপ্ত আর হেরম্যান আবার নিজেদের তাঁবুতে ফিরে গেল।
তাঁবুতে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার নিয়ে এল টোগো। হরিণের ঝলসানো মাংস আর রুটি জাতীয় একটা খাবার। খিদে পেয়ে গেছিল সবার। একসাথে বসে বেশ পরিতৃপ্তি করে খেল তারা। খেতে খেতে হেরম্যান টোগোকে বললেন, ওদের মতলব কিছু জানতে পারলে?’ টোগো বলল, ‘না, কেউ মুখ খুলল না। ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল যে, কাল সকালেই ওরা তাঁবু গুটিয়ে অন্য দিকে এগোবে। আফ্রিকান্ডার নাকি সেরকমই নির্দেশ দিয়েছে। তবে একটা ব্যাপার আমার কাছে স্পষ্ট যে ওরা সিংহ শিকারের জন্য এখানে আসেনি। যেখানে এত সিংহ, যে জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গাতে ওদের যাবার দরকার কী? তাছাড়া আমি যে বিরাট সিংহটাকে প্রথমে মারলাম, অন্য কেউ হলে ওর মাথা আর চামড়াটা ট্রফি হিসাবে নিয়ে যেত। কিন্তু আপনারা তাঁবুতে চলে আসার পর ম্যাকুইনার সামনেই দেখলাম কয়েকজন মাসাই প্রাণীটার চামড়া ছিঁড়েখুড়ে ওর হৃৎপিণ্ডটা বার করে নিল। ওর অত সুন্দর চামড়াটা নষ্ট হতে দেখেও কিছু বলল না ম্যাকুইনা।
এ ব্যাপারটাও ঠিক শিকারিসুলভ নয়।’
সুদীপ্ত শুনে বলল, ‘মাসাইরা ওই হৃৎপিণ্ড নিয়ে কী করবে?
টোগো বলল, ‘পুড়িয়ে খাবে। এ রকম একটা ধারণা আছে যে, সিংহর হৃৎপিণ্ড খেলে দেহের শক্তি বাড়ে।’
টোগো এরপর বলল, ‘এসব কথা থাক। কাল আমরা কোন দিকে এগোব তা নিয়ে আলোচনা করে নেওয়া যাক। জায়গা ভালো নয়, পরিকল্পনা না করে এগোলে বিপদ হবে।’
হেরম্যান বললেন, ‘ওই আলোচনা সেরে নেবার জন্যই তো বসেছি। এক মিনিট দাঁড়াও— এই বলে তিনি উঠে গিয়ে তাঁবুর কোনায় রাখা তার ব্যাগ থেকে একটা রোল করা কাগজ বার করে এনে সেটা মেলে ধরলেন টোগো আর সুদীপ্তর সামনে। মেট্রোম্যাক্সের আলোতে কাগজটা তিনি মাটিতে বিছাতেই সুদীপ্ত বুঝতে পারল সেটা একটা ম্যাপ। পার্চমেন্ট কাগজের ওপর পেন্সিলে অস্পষ্ট আঁকযোক করা আছে তাতে। খুদে খুদে অক্ষরে কী সব যেন লেখা দেখা যাচ্ছে। কাগজটা বয়সের ভারে জীর্ণ হয়ে গেছে।
ম্যাপটা বিছিয়ে হেরম্যান টোগোকে বললেন, ‘এই হল কলিন্সের ম্যাপ। যদিও স্কেলের কোনো বালাই নেই, কাঁচা হাতে আঁকা ম্যাপ। তবু এর ওপরই নির্ভর করতে হবে আমাদের।’
সবাই ঝুঁকে পড়ল ম্যাপের ওপর। হেরম্যান ম্যাপের ওপর আঙুল চালিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘এই হল আমাদের অবস্থান। আর এই হল সেই পাহাড়, যা ডিঙিয়ে আমরা উপত্যকাতে নেমেছি। এই জায়গা থেকেই শুরু হচ্ছে আমাদের ম্যাপ। সামনের পাহাড়টাকে বেড় দিয়ে উত্তর দিকে মাইল সাতেক এগোতে হবে আমাদের। তারপর আমরা পৌঁছাব, এই যে এই ক্রম চিহ্ন দেওয়া জায়গাতে। রুম্ভু নদীর খাত পেরিয়ে ওপারে পৌঁছলে এখানে একটা পাহাড় আছে। তার এক পাশটা দেখতে সিংহর মুখের আদলে বলে, কলিন্স তার নামকরণ করেছিলেন ‘সিংহর মুখ।’ সেখানে ছোট পাহাড় বেয়ে উপত্যকার ভিতর প্রবেশ করতে হবে। তাহলেই আমাদের চোখে পড়বে পিগমিদের সেই গ্রাম। এই অঞ্চলই হল সেই সবুজ বানরের দেশ। চারপাশে বড় বড় গাছ আর ঘন বাঁশের জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ের ঢালের ঠিক মাঝখানে অনেকটা বাটির আকৃতির নীচু জায়গাতে অবস্থান করছে পিগমি গ্রামটা। তারা অর্ধসভ্য জাতি। বাইরের পৃথিবীর সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। তারা চাষাবাদ জানে না। উপত্যকার জঙ্গলে শিকার করে খায়। কলিন্সের বিবরণ অনুযায়ী পঞ্চাশ বছর আগে ও জায়গা ঠিক এমনই ছিল। ঠিক এই জায়গাটা—এই বলে ম্যাপের ওপর একটা বিন্দুতে তর্জপি স্থির করলেন হেরম্যান।
টোগো, হেরম্যান-নির্দেশিত বিন্দুটা ভালো করে দেখার পর বলল, ‘মোটামুটি অনুমান করতে পারলাম জায়গাটা। তবে যেটাকে রুভভুনদী বলা হচ্ছে, তা সম্ভবত রুভভুর কোনো শাখানদী। কারণ মূল রুভভু প্রবাহিত হয়েছে বুরুন্ডির ঠিক মাঝখানে। যাইহোক, যাত্রাপথের কোনো বিবরণ কলিন্স সাহেব বলেছেন কি?
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘তেমন ডিটেল কিছু নেই, ডায়েরিতে আছে নদী পর্যন্ত উত্তরে ঘাসবন। বর্ষা ছাড়া অন্য ঋতুতে নদীখাত শুকনো থাকে। আর, পিগমি গ্রামের উপত্যকার জঙ্গলে নাকি গোরিলার দেখা মেলে।
টোগো আর হেরম্যান এরপর পরদিন যাত্রা শুরুর ব্যাপারে পরিকল্পনা ছকতে লাগল, আর সুদীপ্ত শুনতে লাগল তাদের কথা।
হঠাৎ তাঁবুর ভিতরে বসেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করল সুদীপ্ত। ম্যাকুইনা আর তাদের তাঁবুর মাঝে একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হয়েছে। আগুনের লাল আভা এসে পড়েছে সুদীপ্তদের তাঁবুর সে পাশে। তাঁবুর সেই ক্যানভাসের পর্দায় ফুটে উঠেছে একটা মানুষের দীর্ঘ অবয়ব। যেন তাঁবুর গা ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে কেউ! মুহূর্তের জন্যই যেন দৃশ্যমান হল সেই অবয়ব। সুদীপ্ত আঙুল তুলে বলল, ‘কে ওখানে?’ কিন্তু টোগো আর হেরম্যান সেদিকে তাকাবার আগেই ছায়াটা অদৃশ্য হয়ে গেল!
‘কীসেদিকে তাকিয়ে কিছু না দেখতে পেয়ে হেরম্যান বললেন,?’
সুদীপ্ত জবাব দিল, ‘মনে হয়, কে যেন ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল!’
টোগো সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে রিভলভার টেনে বার করে তাঁবুর বাইরে ছুটে গেল। কিন্তু হুটু আস্কারি ছাড়া অন্য কাউকে চোখে পড়ল না তার। তারা বলল, ওদিকে আগুন জ্বালানো আছে বলে ওরা সেদিকে যায়নি। টোগো একবার তাকাল অগ্নিকুণ্ডের ওপাশে ম্যাকুইনার তাঁবুর দিকে। তার ভিতরটা অন্ধকার। সেখানে কেউ আছে কিনা সে বুঝতে পারল না। বাইরে আশেপাশেও কোথাও ম্যাকুইনাকে দেখতে পেল না সে। টোগো আবার তাঁবুতে ফিরে এল। হেরম্যান আর টোগোর আলোচনা প্রায় শেষ হয়ে গেছিল। কলিন্সের ম্যাপটা গুটিয়ে যথাস্থানে রাখার পর হেরম্যান তাঁর কাছে রাখা একটা রিভলভার এনে সুদীপ্তর হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা আমার দেশের বিখ্যাত “জার্মান মাউজার।” ছোট হলেও শক্তিশালী অস্ত্র। এটা এখন থেকে তোমার সম্পত্তি।’ সুদীপ্ত জিনিসটা নেড়েচেড়ে দেখার পর নিজের কাছে রেখে দিয়ে টোগোর রিভলভারটা তাকে ফেরত দিয়ে দিল।
হেরম্যান এরপর টোগোকে বললেন, ম্যাকুইনা আসবেন বললেন, কিন্তু কই, তিনি তো এলেন না?’
টোগো জবাব দিল, ‘বাইরে তাকে দেখলাম না। তার তাঁবুও অন্ধকার। হয়তো তিনি শুয়ে পড়েছেন।’ হেরম্যান বললেন, ‘তাহলে আমরাও শুয়ে পড়ি। কাল আবার নতুন অভিজ্ঞতার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।’
তাঁবুর বাতি নিভিয়ে দেওয়া হল। হেরম্যান আর সুদীপ্ত শুয়ে পড়ল। শুধু টোগো তাদের মাঝে বসে রইল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে হেরম্যান নাক ডাকতে শুরু করলেন। প্রথমে সুদীপ্তর ঘুম এল না। অন্ধকার তাঁবুতে শুয়ে সে ভাবতে লাগল, ‘তাঁবুর গায়ে যে ছায়াটা সে দেখে ছিল, সেটা কী সত্যি? নাকি সেটা আসলে তার মনের ভুল?’
কিছুসময় পর বাইরে থেকে ভেসে আসতে লাগল মাসাইদের সমবেত সঙ্গীত। কেমন যেন একটা করুণ সুর তাতে। সুদীপ্ত টোগাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এত রাতে কী গান গাইছে ওরা?’
টোগো চাপাস্বরে বলল, ‘সন্ধ্যায় ওদের যে সঙ্গীকে সিংহ টেনে নিয়ে গেল, তার উদ্দেশে গানের মাধ্যমে শোক প্রকাশ করছে ওরা। আর বনদেবতার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে যে, তিনি যেন ওই মৃত ব্যক্তির আত্মাকে শান্তি দেন।’
এরপর টোগো তাকে বলল, ‘আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি জেগে আছি। তেমন কিছু হলে ডাকব।
মাসাইদের সঙ্গীতধ্বনি শুনতে শুনতে এরপর এক সময় সুদীপ্ত ঘুমিয়ে পড়ল।