বুরুন্ডির সবুজমানুষ – ৩

গ্রেট রিফট্। ছোট ছোট পাহাড় ধীরে ধীরে উঁচু উঁচু হতে হতে ক্রমশ হারিয়ে গেছে উত্তর দিগন্তে। ওদিকে এর বিস্তার উগান্ডা পর্যন্ত। পশ্চিমে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো আর পূর্বে বুরুন্ডি। গ্রেট রিফট্-ই হল এ দু-দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা বিভাজক। চারপাশে ছড়িয়ে আছে পাহাড় ঘেরা অসংখ্য নাম-না-জানা উপত্যকা। বাঁশ ও অন্যান্য গাছের গহীন জঙ্গল সেখানে। দিনেরবেলাও সেখানে সূর্যের আলো প্রবেশের অনুমতি নেই। আদিম মহাবৃক্ষদের সেই রাজত্বে দিন-রাতের ফারাক বিশেষ বোঝা যায় না। সূর্যালোক আদিম মহাভ্রমদের উদ্ধৃত শীর্ষদেশ শুধু স্পর্শ করে। কখনো চোখে পড়ে গ্রেট রিফটের ওপর থেকে নেমে আসা কোনো নদী। ওপর থেকে নাচতে নাচতে নীচে নেমে তারা হারিয়ে যায় উপত্যকার মহারণ্যের বাঁকে। উপত্যকার এসব অরণ্য বহু প্রাণীর আবাসস্থল। বিশেষত গোরিলা, শিম্পাঞ্জি ইত্যাদি নানা বানর জাতীয় প্রাণীর দেখা মেলে এখানে। আর দেখা মেলে সিংহর, এবং অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে। নিরন্তর জন্ম-মৃত্যুর খেলা চলে তমসাবৃত উপত্যকার অরণ্যে। সুদীপ্তরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে যত ওপরে উঠতে লাগল, ওপর থেকে নীচে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অরণ্য উপত্যকাগুলো তত ভালো ভাবে দৃষ্টিগোচর হতে লাগল তাদের।

পাহাড়ের ঢালেও জঙ্গল আছে। তবে সে জঙ্গল খুব গভীর নয়। কিছুটা কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন সব মহাবৃক্ষ। তাদের গুঁড়িগুলো কত বিশাল তা না দেখলে ঠিক বিশ্বাস করা যায় না! পাঁচ জন লোকও হাতে হাত মিলিয়ে বেড় দিয়ে ধরতে পারবে না সেসব গাছের গুঁড়ি। পুরু শ্যাওলা জমে আছে তার গায়ে। আর নীচে জমে আছে শতাব্দী প্রাচীন পচা পাতার রাশি। সেগুলো নাড়িয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে লাগল সুদীপ্তরা। ওপরে উঠতে উঠতে মাঝে মাঝে অবশ্য হাঁফ ধরে যাবার জন্য তাদের থামতে হচ্ছিল। মিনিট দশেকের জন্য বিশ্রাম, তার পর আবার চলা। ঢালগুলো খুব খাড়া নয়, এই রক্ষা! তাছাড়া গাছের থেকে নেমে আসা মোটা মোটা লতাগুল্মগুলো ওপরে উঠতে দাড়ির মতন ব্যবহার করতে পারছিল তারা। ওপরে উঠতে উঠতে এরকমই এক লতা-গুল্ম বেষ্টিত পাহাড়ের ঢালে তাদের সাথে দেখা হয়ে গেল একদল শিম্পাঞ্জির।

এতগুলো মানুষ দেখে মোটেও ভয় পেল না তারা। বরং সুদীপ্তদের মাথার ওপর লতা ধরে দোল খেতে খেতে বেশ কিছুটা পথ কিচির-মিচির করে এগোল তাদের সাথে। যেন তাদের দেখে নয়, বরং সুদীপ্তদের দেখেই ভারী মজা পেয়েছে প্রাণীগুলো! হেরম্যান বললেন, ‘এ তল্লাটে কদাচিৎ মানুষ আসে, তাই সম্ভবত মানুষের বিপদ থেকে সচেতন নয় এরা।’

টোগো বলল, ‘ঠিক তাই। নইলে মানুষকে সব প্রাণী এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।’ ঘণ্টা ছয় ওপরে ওঠার পর বেলা বারোটা নাগাদ সুদীপ্তরা গিরিশিরার বেশ উপরে একটা ছোট্ট ফাঁকা জায়গাতে পৌঁছে গেল। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে। চারপাশে সেখানে শুধু পাহাড়ের সারি। ছোট ছোট পাহাড়গুলো উত্তর দিকে বিস্তার লাভ করে আকাশের দিকে উঠে গেছে। তার মাঝে মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দুর্ভেদ্য জঙ্গলাকীর্ণ উপত্যকা। দক্ষিণে অনেক নীচে চোখে পড়ছে রুপালি ফিতার মতো একটা রেখাচিহ্ন। টোগো বলল, ‘ওই হল রুজিজি।’

হেরম্যান তার বাইনোকুলারটা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পশ্চিম দিকে দেখলেন। তারপর সেটা টোগোর হাত ঘুরে এল সুদীপ্তর হাতে। সুদীপ্তর চোখ রাখল তাতে। পাহাড়ের একটা শাখা চলে গেছে সেদিকেও। অনুচ্চ সব পাহাড়শ্রেণি সেদিকে। পাহাড়ের ঢালে উপত্যকার ঘন জঙ্গলগুলো ধরা দিতে লাগল সুদীপ্তর বাইনোকুলারে। সে বলল, ‘ওপাশের জঙ্গলগুলো অন্য দিকের তুলনায় অনেক বেশি যেন ঘন মনে হচ্ছে।’

হেরম্যান বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার তাই মনে হচ্ছে। ওদিকটাই হল কঙ্গো সীমান্ত। আমরা যে জায়গাতে যাব, সেটা সীমান্তবর্তী এলাকা। ঘন-জঙ্গল সেখানে বুরুন্ডি আর কঙ্গোর সীমারেখা মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমের ঢাল বেয়ে নীচে নামার পর কলিন্সের ম্যাপ দেখে নির্দিষ্ট উপত্যকা খুঁজে বার করতে হবে আমাদের। ছোট ছোট পাহাড়ের আড়ালে অসংখ্য উপত্যকা আছে ওদিকে। তারই একটায় ওই পিগমি গ্রাম।’

জায়গাটাতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর, পশ্চিমের ঢাল বেয়ে সুদীপ্তদের নীচে নামা শুরু হল। তারা যত নামতে লাগল, এপাশে জঙ্গল যেন আরও গভীর বলে মনে হতে লাগল। আশেপাশের অরণ্য উপত্যকাগুলোও ঘন জঙ্গলে ঢাকা। গত দু-দিনও জঙ্গলের মধ্যে কাটিয়েছে তারা, কিন্তু এদিককার জঙ্গল আরও অনেক বেশি থমথমে। কেমন যেন রহস্যময়! সুদীপ্তর মনে হল, তারা অন্য কোনো পৃথিবীতে পদার্পণ করতে চলেছে। এ পথে দুটো ছোট নদী পার হল তারা। অগভীর নদীখাত, গোড়ালি সমান জল তিরতির করে বয়ে চলে হারিয়ে গেছে নীচের উপত্যকার জঙ্গলে।

হেরম্যান বললেন, ‘ওপাশের জলধারাগুলো মিলে যেমন রুজিজির সৃষ্টি হয়েছে, তেমন এপাশের জলধারাগুলো কঙ্গো নদী বা গ্রেট জাইরের কোনো শাখার সাথে মিশেছে। অথবা কঙ্গোর ভূখণ্ড দিয়ে এগিয়ে মিশেছে সেই তাঙ্গানিকাতে।’ সুদীপ্ত জানতে চাইল, রুজিজির মতো কঙ্গো নদীরও উৎপত্তিস্থল ‘গ্রেট রিফট’ নাকি? এসব অঞ্চলে সভ্য মানুষের কবে প্রথম পদার্পণ ঘটে?’ হেরম্যান বললেন, ‘না। কঙ্গো বা গ্রেট জাইরে নদীর উৎপত্তিস্থল কঙ্গোর পশ্চিমে। দেশটার মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে

প্রবাহিত ওই নদী। তবে দেশটার সর্বত্রই প্রায় ওর শাখাপ্রশাখা বিস্তৃত। কঙ্গো বা আমরা এখন যে অঞ্চলে প্রবেশ করছি, এসব জায়গা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত সভ্য পৃথিবীর অজানা ছিল। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত পর্যটক ‘হেনরি মর্টন স্ট্যানলি’ সর্বপ্রথম এ তল্লাটে আসেন। আর তারই মাধ্যমে কঙ্গো এবং কঙ্গো সংশ্লিষ্ট এসব অঞ্চলে কথা সর্ব প্রথম পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁরই নাম অনুসারে বাঙ্গোর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘মার্গারিটা’র নাম রাখা হয় ‘মাউন্টস্ট্যানলি।’ নীচে নামার পথে এদিকেও একদল শিম্পাঞ্জির সাথে সাক্ষাৎ হল তাদের। তবে এ প্রাণীগুলো তাদের অনুসরণ করল না। বরং তাদের দেখে কেমন যেন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দূরে সরে গেল।

তিন ঘণ্টা ধরে চলার পর সুদীপ্তরা এক সময় তখন প্রায় নীচে নেমে এসেছে। আর হাজার খানেক ফুট নীচেই অনুচ্চ পাহাড় ঘেরা গভীর জঙ্গল ঘেরা এক ছোট্ট উপত্যকা। সেখানে নামতে আর বড়জোর আধ ঘণ্টা লাগবে। ঠিক এমন সময় এক দল কালো হরিণ চোখে পড়ল তাদের। সুদীপ্তদের যাত্রাপথের পাশেই পাহাড়ের ঢালে তারা চরে বেড়াচ্ছে। তাদের দেখার পর কুলির দল কী যেন বলল। তাদের কথা শুনে টোগো দাঁড়িয়ে পড়ে, কাঁধ থেকে রাইফেল খুলে নিয়ে হেরম্যানকে বলল, ‘কুলিরা হরিণের মাংস খেতে চাচ্ছে। তাছাড়া এদিকে এভাবেই খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে। একটা প্রাণীকে মারতে হবে।’ এই বলে যে রাইফেল তাগ করল হরিণের পালটার দিকে। রাইফেলের গর্জনে কেঁপে উঠল বনভূমি। হরিণের পালের থেকে একটা প্রাণী পড়ে গেল মাটিতে। অন্যরা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সুদীপ্তদের দিকে। ব্যাপারটা অনুধাবন করতে কয়েকমুহূর্ত সময় লাগল প্রাণীগুলোর। আর তার পরই তারা নিহত সঙ্গীর দেহ ফেলে রেখে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ল গভীর অরণ্যে।

টোগো একজন কুলিকে নির্দেশ দিল, প্রাণীটার দেহটা তুলে আনার জন্য। তার কথা শুনে সে নিজের মালপত্র অন্যদের পিঠে চাপিয়ে এগোল নির্দেশ পালন করতে। ঠিক সেই সময় নীচের উপত্যকা থেকে ভেসে এল, পরপর দু-বার দুমদুম শব্দ। রাইফেলের গর্জন! টোগো বলল, ‘মানুষ! সম্ভবত ওই আফ্রিকাভারের দল হবে! আমাদের রাইফেলের শব্দ শুনে আমাদের সংকেত পাঠাচ্ছে।’

টোগোর কথা শুনে হেরম্যান তার বাইনোকুলার দিয়ে নীচের দিকে দেখার চেষ্টা করলেন। তারপর টোগোও তার হাত থেকে সেটা নিয়ে নীচে বেশ কিছুক্ষণ দেখল, কিন্তু বড়বড় গাছের আড়ালে ঢাকা দুর্ভেদ্য জঙ্গল ছাড়া আর অন্য কিছু চোখে পড়ল না তাদের।

হেরম্যান টোগোকে বললেন, ‘তুমি একবার ছোড়ো। দেখো তো আর জবাব আসে নাকি??

রাইফেল চালাল টোগো। আবার কেঁপে উঠল বনভূমি। এরপর কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপরই রাইফেলের শব্দ শোনা গেল নিচ থেকে। অর্থাৎ অনুমান সত্যি। টোগোর রাইফেলের শব্দ শুনে অন্য পক্ষও নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।

টোগো বলল, ‘লোকগুলো আমাদের সম্বন্ধে বেশ কৌতূহলী তা বোঝা যাচ্ছে।’

মানুষ আসে না। ঠিক আমরাও যেমন কৌতূহলী ওদের ব্যাপারে, তবে লোকগুলো কেমন কে জানে!’ টোগো জবাব দিল, ‘সেটা ওদের সাথে সাক্ষাত না হওয়া পর্যন্ত বোঝা যাবে না। আমাদের সতর্কভাবে ওদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ওদের মতলবটাও জানতে হবে। আর তেমন কিছু হলে ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই, আমরাও প্রত্যেকেই সশস্ত্ৰ। সুদীপ্ত শুনে বলল, “কিন্তু আমার কাছে তো কোনো অস্ত্র নেই!’

হেরম্যান বললেন, ‘হ্যাঁ, সেটাই স্বাভাবিক। এখানে তো সচরাচর টোগো কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর নিজের জামার তলা থেকে একটা রিভলভার বার করে সুদীপ্তর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘নিন, এটা রাখুন। জঙ্গলে চলতে হলে, এমনিতেই একটা হাতিয়ার অন্তত সঙ্গে রাখতে হয়। আমি ভেবেছিলাম, আপনার কাছে কিছু অন্তত আছে।’ একটা মৃদু তিরস্কারের স্বর শোনা গেল টোগোর গলায়। অবশ্য সেটা যে সুদীপ্তর মঙ্গল কামনাতেই তা বুঝতে তার অসুবিধা হল না।

জিনিসটা হাতে নিয়ে সুদীপ্ত, হেরম্যানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর আপনার?’

তার কথা শুনে হেরম্যান তার জামাটা তুলতেই তার কোমরে একটা রিভলভারের বাঁট চোখে পড়ল সুদীপ্তর। জামাটা ঠিক করে নিয়ে হেরম্যান সুদীপ্তকে বললেন, ‘তোমার জন্যও একটা এনেছি। সেটা তোমাকে আগেই দেওয়া উচিত ছিল। আপাতত তুমি টোগোরটাই রাখো। তাঁবুতে তোমাকে আমি ওটা দেব।’

হরিণটা কাঁধে তুলে সুদীপ্তদের কাছে ফিরে এল কুলিটা। তারপর সকলে মিলে নীচে নামতে শুরু করল।

মিনিট পনেরো ঢাল বেয়ে নামার পর, নীচ থেকে ওটা একটা ক্ষীণ ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখতে পেল তারা। তারপর তারা যত নীচে নামতে লাগল, ধীরে ধীরে নীচে জঙ্গল ঘেরা একটা ছোট্ট ফাঁকা জায়গা তাদের দৃষ্টিগোচর হতে লাগল। বেশ কয়েকটা তাঁবু আর তার সামনে কিছু লোকজন দেখা যাচ্ছে সেখানে। হেরম্যান তার বাইনোকুলার দিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, ওই আফ্রিকাভারের দলটাই হবে। একজন দীর্ঘদেহী লোক দেখতে পাচ্ছি ওদের মধ্যে। ওরাও আমাদের দেখতে পেয়েছে। একজন আমাদের লক্ষ্য করে কাপড় নাড়াচ্ছে!’