একটা রক্ত জল-করা হাসির গররা উঠল ম্যাকুইনার গলা থেকে। সুদীপ্ত দেখল মুহূর্তের মধ্যে হেরম্যানের জামা লাল হতে শুরু করেছে! তার ওপর একটা গুলি চালিয়ে দিয়েছেন ম্যাকুইনা!
ম্যাকুইনা এরপর তার রাইফেল তাঁর ঘাড়ের ওপর তুললেন মাটিতে পড়ে থাকা হেরম্যানকে লক্ষ্য করে। অবচেতনে সুদীপ্ত কখন যে তার রিভলভার টেনে বার করেছে তা নিজেই বুঝতে পারেনি। ম্যাকুইনাকে দ্বিতীয়বার রাইফেল তাগ করতে দেখে আর সময় নষ্ট না করে ম্যাকুইনাকে লক্ষ্য করে কাঁপা কাঁপা হাতে চালিয়ে দিল গুলি। সেটা পুরোপুরি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল না। সম্ভবত ম্যাকুইনার কোমরের কাছে কোথাও লাগল গুলিটা। বিজাতীয় ভাষায় একটা চিৎকার করে টাল খেয়ে পড়ে যেতে যেতেও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন ম্যাকুইনা, রাইফেল হাতে ঘুরে দাঁড়ালেন সুদীপ্তর দিকে। কিন্তু গুলি আর তার চালানো হল না। তার আগেই গর্জে উঠল সুদীপ্তর পাশে দাঁড়ানো টোগোর রিভলভার! অব্যর্থ লক্ষ, রিভলভারের গুলি ম্যাকুইনার পাঁজর ফুড়ে বেড়িয়ে গেল।
তাঁর হাতে ধরা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল আকাশের দিকে ছিটকে উঠে সশব্দে শূন্যে ক’টা গুলি নিক্ষেপ করে ঠিকরে পড়ল মাটিতে। ম্যাকুইনার হাত দুটো হিংস্র আক্রোশে কাকে ধরার জন্য একবার শুধু মাথায় উঠল, আর তার পরই তাঁর দানবের মতো দেহটা প্রচণ্ড শব্দে আছড়ে পড়ল মাটিতে! একদম স্থির সেই দেহ।
ম্যাকুইনা পড়ে যেতেই সুদীপ্ত আর টোগো ছুটে এল হেরম্যানের কাছে। প্রচণ্ড কোলাহল করে অস্ত্র তুলে নিয়ে পিগমিরাও ছুটে এল সঙ্গে সঙ্গে। এক হাতে ভর দিয়ে মাটির ওপর উঠে বসলেন হেরম্যান। রক্ত ঝরলেও আঘাত তত গুরুতর নয়। রাইফেলের বুলেট তাঁর বাঁ কাঁধের সামান্য মাংস চিরে বেরিয়ে গেছে। হেরম্যান উঠে বসে তার ডান হাতটা সুদীপ্তর দিকে বাড়িয়ে দিতেই সে আর টোগো তাঁকে ধরে মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিল। আর তার পরমুহূর্তেই তাদের তিনজনের চোখ পড়ল সবুজ বানরের দিকে। দানবাকৃতির প্রাণীটা তখন নিজেই উঠে দাঁড়িয়েছে। কয়েক মুহূর্ত সুদীপ্তদের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রাণীটা ধীরে ধীরে তার একটা হাত তুলে আনল নিজের ঘাড়ের কাছে, তারপর সুদীপ্তদের হতবাক করে দিয়ে একটানে ঘাড়-মাথা থেকে তার রোমশ চামড়াটা টেনে সরিয়ে ফেলল। সেই চামড়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক বৃদ্ধ মানুষের মুখ! লোল চর্ম, শনের মতো সাদা চুল, নীল চোখ। গায়ের রং দেখে মনে হয় তিনি শ্বেতাঙ্গই হবেন। নীল চোখে তিনি চেয়ে রইলেন সুদীপ্তদের দিকে।
প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ওঠার পর হেরম্যান তার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনি মানুষ?’
মৃদু ঘাড় নেড়ে বৃদ্ধ একটু জড়ানো গলায় ইংরাজিতে জবাব দিলেন, ‘একদিন হয়তো তাই ছিলাম।’
হেরম্যান তার উত্তর ঠিক বুঝতে না পেরে বললেন, ‘এত লম্বা মানুষ আমি কোথাও দেখিনি! আপনি কে?’
মৃদু হাসলেন বৃদ্ধ। তারপর পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা কারা? আপনারা আর এই যুবককে দেখে তো ঠিক আফ্রিকান বলে মনে হচ্ছে না? এখানে এসেছিলেন কেন? হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘আমি হেরম্যান, জার্মানির লোক। আমার সঙ্গী একজন ইন্ডিয়ান। আমি একজন ক্রিপটোজুলজিস্ট। অর্থাৎ বলতে পারেন, বিচিত্র প্রাণী খুঁজে বেড়াই। তবে নিজের স্বার্থে নয়, বিজ্ঞানের স্বার্থে। সবুজ মানুষের কথা শুনে তার সন্ধানে আমি এখানে এসেছিলাম।’ সত্যি কথাই বললেন তিনি। সবুজ মানুষ বললেন, ‘ও বিজ্ঞানী!’ এরপর তিনি মাটিতে পড়ে থাকা ম্যাকুইনার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘এই হিংস্র মানুষটার পরিচয় আমি অনুমান করতে পারছি। কিন্তু কী নাম ওর? অনেক মানুষকে খুন করল ও। আপনার সাথে ওর সম্পর্ক কী?’
অস্ত্র হাতে পিগমির দল সতর্কভাবে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাইকে। বৃদ্ধর কথা শুনে হেরম্যান তাড়াতাড়ি জবাব দিলেন, ‘আমরা কিন্তু কোনো মানুষকে মারিনি। ও আমাদের কেউ নয়। ও একজন আফ্রিকান্ডার। তাঞ্জানিয়ার বাসিন্দা, নাম ম্যাকুইনা ডায়ার।’ “
‘ম্যাকুইনা ডায়ার!’ বিড়বিড় করে নামটা দুবার বললেন বৃদ্ধ। তারপর স্বগোতক্তির স্বরে বললেন, ‘তাহলে ও জাঞ্জিবাবের নয়?’
ম্যাকুইনার বাসস্থানের কথা বৃদ্ধ নির্ভুলভাবে জানেন দেখে বেশ আশ্চর্য হয়ে হেরম্যান বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ জাঞ্জিবারই! পঞ্চাশ বছর হতে চলল, ও দেশ আরও দু-দেশের সাথে মিশে তাঞ্জানিয়া বলে এক দেশ হয়েছে।’ এ কথা বলার পর তিনি আবার বললেন, ‘তবে আমরা সবুজ বানরের খোঁজে এলেও আপনার কোনো লোককে মারিনি। আশা করি আপনি আমাদের মুক্তি দেবেন। ম্যাকুইনার সাথে পথে আমাদের যোগাযোগ। বলতে গেলে তাঁর হাতে আমরা প্রায় বন্দি ছিলাম!’
সবুজ মানুষ ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘তা আমি জানি। আপনার সঙ্গী ওটুম্বাকে মুক্তি দিয়েছেন শুনেছি। আর এখন আপনার-আমার প্রাণ বাঁচালেন। কিন্তু আপনারা সবুজ বানরের কথা শুনলেন কোথায়? এত দূরদেশে এলেনই বা কীভাবে?’
এবার হেরম্যান বলে যেতে লাগলেন সব কথা। পর্যটক কলিন্সের ডায়রি ও সেই সূত্রে তাদের অভিযানের কথা, ম্যাকুইনার সাথে তাদের পরিচয়ের কথা। তাঁবুর কাছে অন্ধকারে গাছের নীচে সবুজ মানুষকে দেখার ঘটনা, পশ্চিমের পাহাড়ে অভিযান থেকে শুরু করে ম্যাকুইনার হাতে সুদীপ্তর বন্দি হওয়া থেকে মুক্তি হওয়ার ব্যাপার।
মিনিট দশেক পর কথা শেষ হল হেরম্যানের।
বৃদ্ধ সব শোনার পর বললেন, ‘বুঝলাম, কিন্তু এক কষ্ট করে এত দূর এসে শেষ পর্যন্ত তো খালি হাতেই ফিরতে হবে আপনাদের।’
তাঁর মুখে এ কথা শুনে সুদীপ্তরা বুঝতে পারল বিপদের মেঘ কেটে গেছে। হেরম্যান এবার একটু উৎফুল্ল স্বরে বললেন, ‘না, ঠিক খালি হাতে আমরা ফিরছি না। এই যে এই অভিযানে বিপুল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম, কতকিছু শিখলাম, জানলাম, এ পাওনাও তো অমূল্য। তাছাড়া যারা বিজ্ঞান চর্চা করে, নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চায়, কৃচ্ছসাধন তো তাদের করতেই হয়।’
বৃদ্ধ মনে হয় খুশি হলেন হেরম্যানের কথা শুনে। সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন তিনি। সুদীপ্ত এতক্ষণ হেরম্যান আর সবুজ মানুষের কথোপকথন শুনছিল। সে এবার সাহস সঞ্চয় করে বৃদ্ধকে বলল, ‘আপনার পরিচয় কিন্তু আমাদের জানা হয়নি। সভ্য সমাজ থেকে এত দূরে এই অরণ্য উপত্যকায় পিগমদের মাঝে আপনি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন কেন?’
সুদীপ্তর প্রশ্ন শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলেন বৃদ্ধ। তারপর শান্ত স্বরে বললেন, ‘আপনারা সত্যি জানতে চান সে কথা?’
সুদীপ্ত বলল, ‘হ্যাঁ চাই। যদি অবশ্য তা জানাতে আপনার আপত্তি না থাকে।’
বৃদ্ধ আবার কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, ‘সে কথা বলতে আজ আর আমার কোনো আপত্তি নেই। অনেক বয়স হল, আর ক-দিনই বা বাঁচব! বরং সভ্য জগতের মানুষের কাছে মৃত্যুর আগে সে কথা জানিয়ে গেলে হয়তো তৃপ্তি পাব।’
সবুজ মানুষ এরপর সমবেত পিগমিদের উদ্দেশ্যে সুদীপ্তদের দেখিয়ে কী যেন বললেন। তার কথা শেষ হবার পর পিগমিদের দলটা একটা উল্লাস করে উঠে চার দিকে ছড়িয়ে পড়ল। রূপাশে আবার ঢাক বাজতে শুরু করল। তবে এ ঢাকের ছন্দ অন্যরকম।
সবুজ মানুষ বললেন, ‘ওরা যখন যুদ্ধ জয়ের আনন্দে উৎসব করবে। আপনারা আমার ঙ্গে আসুন।’ সুদীপ্তদের এ কথা বলে ওটুম্বাকে কী একটা নির্দেশ দিয়ে বৃদ্ধ ধীরে ধীরে সুদীপ্তদের নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। একজন পিগমি যোদ্ধা মশাল হাতে তাঁদের আগে আগে চলতে লাগল।
সুদীপ্তরা এসে দাঁড়াল গ্রামের শেষ প্রান্তে এক বেশ বড় কুঁড়েঘরের সামনে। রক্ষীর হাতের মশাল নিয়ে সুদীপ্তদের সাথে করে ফোকর গলে কুঁড়ের ভিতর প্রবেশ করলেন সবুজ মানুষ। ভিতরে আছে একটা খড়ের বিছানা। চিতার চামড়া বিছানো আছে তার ওপর। বসার জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটা কাঠের গুঁড়ি। দেওয়ালে টাঙানো আছে বিভিন্ন ধরনের হরিণের মাথা আর একটা আদ্যিকালের ম্যাচলক বন্দুক। মশালটা মাটিতে গুঁজে একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসলেন বৃদ্ধ। সুদীপ্তরা তাঁকে ঘিরে বসল। তার ভিতরে ঢুকে বসার প্রায় সাথে সাথেই দুজন পিগমি ঘরে ঢুকে দুটো পাত্র নামিয়ে রেখে গেল। বড়পাত্রে ঝলসানো মাংস আর ফলমূল, আর ছোটপাত্রে একটা সবুজ রঙের ক্বাথ। সেই পাত্রটা দেখিয়ে বৃদ্ধ হেরম্যানকে বললেন, ‘এটা ওষধি লতাগুল্মর মণ্ড। ক্ষতস্থানে লাগিয়ে নিন। দ্রুত সেরে যাবে। আর, খাওয়া সেরে নিন। তারপর বলব আমার কাহিনি।’ টোগো কাজে লেগে পড়ল। হেরম্যানের ক্ষতস্থানে ক্বাথর প্রলেপ লাগিয়ে, জামার একটা হাতা ছিঁড়ে তা দিয়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দিল। ইতিমধ্যে আরও একজন পিগমি জলের পাত্র দিয়ে গেল। হেরম্যানের ক্ষতস্থান বেঁধে দেবার পর দ্রুত খেতে শুরু করল তারা। উত্তেজনায় দুদিন খিদে-তৃষ্ণার কথা ভুলেই গেছিল তারা। বৃদ্ধ তাকিয়ে দেখতে লাগলেন তাদের। সুদীপ্ত লক্ষ করল, বৃদ্ধর চোখ মুখ কেমন যেন বিষণ্ণতা মাখা! তার নীল চোখের দৃষ্টি যেন স্মৃতির অতলে ডুব দিচ্ছে!
কিছুক্ষণের মধ্যেই খাওয়া শেষ করে সবুজ মানুষের মুখোমুখি বসল সকলে।
হেরম্যান সবুজ মানুষের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনি আপনার কাহিনি আমাদের বলুন। বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, ‘কত যুগ পরে আমি সভ্য পৃথিবীর মানুষের সাথে কথা বলছি! জানি না সব কিছু আপনাদের গুছিয়ে বলতে পারব কিনা! এতদিন পরে হয়তো সব কিছু মনেও নেই। তবে নামটা কিন্তু আমার এখনও মনে আছে,—‘ম্যাকলিন ডায়ার।’ তার নাম আর পদবি শুনে চমকে উঠল সুদীপ্ত।
এরপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সবুজ মানুষ শুরু করলেন তাঁর কাহিনি—
‘আমার জন্ম উনিশশো কুড়ি খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ অধীনস্থ জাঞ্জিবারে। জাতিতে আমি ইওরোপীয়, ব্রিটিশ বংশদ্ভূত। আমার বাবা ম্যাক ডায়ার আমার জন্মের কিছুকাল আগে অন্যান্য বহু ইউরোপীয়র মতো ভাগ্যান্বেষণে আফ্রিকা আসেন ও জাঞ্জিবারে এক হীরের খনির মালিক হন। আজকের জাঞ্জিবার কেমন তা আমার জানা নেই, কিন্তু সে সময় জাঞ্জিবার ছিল পাথরের তৈরি ছোট্ট শহর। আর তার চারপাশে ছিল ছোট-বড় বেশ কিছু হীরের খনি। সেখানকার বাসিন্দা ছিল কিছু ইংরেজ, জার্মান, আরব আর স্থানীয় বান্টু জনগোষ্ঠীর লোক। ব্যবসা বাণিজ্য বলতে হীরা আর হাতির দাঁতের কারবার। আর তার সাথে সাথে ছিল দাস ব্যবসার রমরমা। আমাদের ঠিক বাড়ির কাছেই ছিল একটা দাসবাজার। আরও একটা জিনিস সেখানে সেসময় ছিল, কলেরার প্রকোপ! আমার যখন মাত্র তিন বছর বয়স তখন সে রোগেই আমার মা মারা যান। আমার বাবা আর চাকর বাকরদের কাছেই মানুষ হতে থাকি আমি। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার উচ্চতা অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমি বাবার মুখে শুনেছিলাম, আমার পিতৃপুরুষরা নাকি প্রত্যেকেই দীর্ঘকায় ছিলেন, তাঁর নিজের উচ্চতাও ছিল ছ ফুট। তবে তাঁরা কেউই অতি অস্বাভাবিক ছিলেন না, যে প্রবণতা লক্ষ করা গেল আমার মধ্যে। মাত্র দশ বছর বয়সে আমার উচ্চতা হয়ে দাঁড়াল সাড়ে পাঁচ ফুট। প্রকৃতি দেবতার আমাকে নিয়ে এই অদ্ভুত খেলাই আমার জীবনে অভিশাপ নামিয়ে আনল। আমরা এক ইওরোপীয় মহল্লায় বাস করতাম। সেই মহল্লাতেই ইওরোপীয় ছাত্রদের জন্য ছোট এক মিশনারি স্কুলে পড়াশোনার জন্য বাবা আমাকে ভর্তি করিয়ে ছিলেন আট বছর বয়সে। মাত্র দুটো ক্লাস সেখানে পড়তে পেরেছিলাম আমি। কারণ, আমার এই অস্বাভাবিক উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য স্কুলের ছেলেরা আমার পিছনে লাগতে শুরু করল। সেখানে আমি আর টিকতে পারলাম না। স্কুল ছাড়তে হল। আমি খুব কম বয়সে মাতৃহীন হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু আসল দুর্ভাগ্যের শিকার হতে শুরু করলাম ওই স্কুল ছাড়ার সময় থেকেই।
আমার বয়স যখন বারো, তখন আমার উচ্চতা হল পাকা ছ ফুট! এবার আস্তে আস্তে বাড়ির বাইরে যাওয়াও বন্ধ করতে হল আমাকে। রাস্তায় ছেলেরা আমাকে দেখলেই ‘ডেমন! ডেমন!’ বলে চিৎকার করত, পাথর ছুড়ত। আমার বাবা ছিলেন নরম মনের মানুষ। ছেলের এই অবস্থা দেখে মনে মনে কষ্ট পেতেন। আমার অন্য কোনো ভাইবোন ছিল না। বাবা সন্ধ্যায় খনি থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি ঘরের ভিতরই কাটাতাম। বাবার এক খুড়তুতো ভাই, ‘মন্টিলা’ এ সময় ইংল্যান্ড থেকে জাঞ্জিবারে এসে উপস্থিত হলেন তার পরিবার নিয়ে। ইংল্যান্ডে কী একটা ঘটনা ঘটায় তাদের সে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। সে এসে বাবার সাথে দেখা করে বলল, সে কপর্দকহীন, বাবা যদি তার খনিতে ভাইয়ের একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে সে পরিবার নিয়ে বাঁচতে পারে। বাবা ঠিক করলেন কাকা ও তার পরিবারকে আমাদের বাড়ি এনে রাখবেন। কাকাকে তত্ত্বাবধায়কের কাজ দেবেন খনিতে। তাতে খনির কাজ ভালো করে দেখাশোনাও হবে, আর আমিও বাড়িতে আপনজনের সঙ্গ পাব। তাছাড়া, সেসময় খনি মালিকদের বাড়িতে মাঝে মাঝে ডাকাতি হতো। বাড়িতে অনেক দুর্মূল্য জিনিস আছে। অনেক লোক থাকলে, বিপদের সম্ভাবনাও কম। এসব ভেবেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কাকা
এ প্রস্তাব লুফে নিল। সে তার স্ত্রী আর তিন পুত্রকে নিয়ে ঘাঁটি গাড়ল আমাদের বাড়িতে। প্রথম প্রথম সব কিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু, যত দিন এগোতে লাগল তাদের সবার স্বরূপ আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম আমি। কাকার তিন ছেলে, ‘ম্যাকুই, মিক, আর ম্যাকুলা। আমার প্রায় সমবয়সি তারা, অসম্ভব দুর্দমনীয় আর নিষ্ঠুর প্রকৃতির। আমাকে তারা তিনজন নানাভাবে কষ্ট দিয়ে নিজেরা আনন্দ পেত। বাবাকে তাদের ব্যাপারে নালিশ জানালে বাবাকে কাকা কাকিমা বোঝাল, আমি একলা একলা থাকার কারণে ভাইদের সাথে মিশতে শিখিনি। এসব কোনো ব্যাপার নয়, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা বিশ্বাস করলেন তাদের কথা। সময় এগোতে থাকল। ঠিক কিন্তু কিছুই হল না। ক্রমশ আরও হিংস্র হয়ে উঠতে লাগল তারা। প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঝগড়া করে বেড়াত তারা। একদিন সামান্য একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে বান্টু উপজাতির একটা বাচ্চা ছেলেকে স্রেফ পিটিয়ে মেরে ফেলল তিন ভাই। বাবা অনেক কষ্টে ধামাচাপা দিলেন ঘটনাটা। ইতিমধ্যে কাকার স্বরূপও উদ্ঘাটিত হল। বাবা খবর পেলেন, কাকা খনি থেকে হীরে সরাচ্ছে! তাছাড়া আরব দাস ব্যবসায়ীদের সাথে ক্রীতদাস কেনাবেচার ব্যবসাতেও টাকা ঢালছে! এবার সতর্ক হয়ে গেলেন বাবা। ভালো করে খনির যাবতীয় হিসাবপত্র দেখতে লাগলেন। হীরে যা উঠত, তার মধ্যে যা দুর্মূল্য তা বাড়িতে এনে সবার অগোচরে পাথরের দেওয়ালে গর্ত করে লুকিয়ে রাখতেন। শুধু আমাকে জানিয়ে রাখতেন ব্যাপারটা। কাকাকে তিনি সতর্ক করে দিলেন, তার বা তার ছেলেদের কোনোরকম বেয়াদপি দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাড়ি থেকে বার করে দেবেন। মুশকিলে পড়ে গেল কাকা ও তার ছেলেরা। মুখে তারা কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারতাম। আমার ও বাবার প্রতি তাদের আক্রোশ ক্রমশ বাড়ছে। এভাবেই বছর ঘুরতে থাকল, আর আমার উচ্চতাও বাড়তে থাকল। আঠারো বছর বয়সে আমার উচ্চতা হল আট ফুট!
বাবা আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর কাকাদের ব্যবহারের কারণে এমনিতে খুব বিমর্ষ হয়ে থাকতেন। একদিন সন্ধ্যায় তিনি খনি থেকে ফিরে বেশ উৎফুল্ল হয়ে আমার ঘরে ঢুকলেন। তারপর পকেট থেকে বার করলেন প্রায় হাঁসের ডিমের আকৃতির একটা পাথর। যাকে বলে ‘আনকাট ডায়মন্ড।’ তিনি বললেন, পাথরটা নাকি সেদিনই খনি থেকে উঠেছে। এত বড় হীরা নাকি কোনো দিন কোথাও পাওয়া যায়নি। আমার ভবিষ্যতের আর কোনো চিন্তা নেই। তিনি আমাকে নিয়ে এবার ইওরোপে ফিরে যাবেন। হীরাটা ইওরোপে বেঁচে যে পয়সা পাওয়া যাবে তাতে আমরা সেখানে রাজার হালে জীবন কাটাতে পারব। আর সভ্য সমাজে আমার উচ্চতা নিয়েও তেমন বিব্রত হতে হবে না। তিনি হীরেটার একটা নামকরণও করলেন, ‘কিং অব জাঞ্জিবার’—‘জাঞ্জিবারের রাজা!’ তিনি আমাকে এ-ও বললেন, যে সুড়ঙ্গের মধ্যে তিনি পাথরটা পেয়েছেন সেখানে পরদিন একবার যাবেন তিনি। এমনও হতে পারে এ জাতীয় হীরা আরও সেখানে আছে! এরপর বাবা ফিরে গেলেন নিজের ঘরে। সারা রাত জেগে পাথরটাকে ঘষামাজা করে পরদিন তিনি রওনা হলেন খনিতে।
কিন্তু সেদিনই যে আমার জীবনে চরম দুর্যোগ নেমে আসবে তা আমি জানতাম না। কাকা ও তার ছেলেরা ভিতরে ভিতরে অন্য মতলবে ছিল। খনির কিছু লোককে তারা টাকাপয়সা দিয়ে হাত করে নিয়েছিল। বাবা সেদিন খনিতে নামতেই অন্ধকার নির্জন সুড়ঙ্গে একদল লোক গাঁইতি হাতে তাকে ঘিরে ধরল। বাবা আর ফিরলেন না খনি থেকে। কাকা কয়েকজন নিরীহ খনি-শ্রমিককে গুলি করে মেরে রটিয়ে দিলেন, তারাই নাকি হীরের লোভে খুন করেছিল বাবাকে। কাকা তাদের শাস্তি দিয়েছেন।
বাবার মৃত্যুর পরই শুরু হল আমার জীবনের ভয়ঙ্করতম দিন। বাবার লুকিয়ে রাখা হীরার সন্ধানে আমার ওপর শুরু হল অমানুষিক অত্যাচার। তাদের ধারণা হয়েছিল আমি সেসবের সন্ধান জানি। চাবুকের মার সহ্য করতে না পেরে দেওয়ালে লুকিয়ে রাখা হীরের সন্ধান আমি তাদের দিয়ে মুক্তি পেতে চাইলাম। কিন্তু তাতে ফল আরও মারাত্মক হল। তাদের ধারণা হল আমি আরও গুপ্তধনের সন্ধান জানি। অত্যাচারের পরিমাণ উল্টে আরও বেড়ে গেল! চামড়ার চাবুক প্রতিদিনই কেটে বসতে লাগল আমার পিঠে। এ কাজটা করত বিশেষত ম্যাকুলা। অত্যাচার আমার আর সহ্য হল না। আমি একদিন পালাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ম্যাকুই আমাকে ধরে ফেলল। আমাকে তালা বন্ধ করা হল ঘরে। সে দিন রাতে ম্যাকুলা তার দুই ভাইকে নিয়ে ঘরে ঢুকল আমাকে শাস্তি দেবার জন্য। আর তারপর…!”
এত বছর পরও বৃদ্ধ যেন শিউরে উঠলেন সে দিনের কথা বলতে গিয়ে। মুহূর্তের জন্য চোখের পাতা মুছে ফেললেন তিনি!
‘তারপর কী? প্রশ্ন করলেন হেরম্যান।
বৃদ্ধ জবাব দিলেন, “ম্যাকুলার হাতে ছিল একটা জাঞ্জিবার নাইফ। আরব দাস ব্যবসায়ীরা ও-ছুরি ব্যবহার করত। তারপর এই যে—” বৃদ্ধ ম্যাকলিন তার পায়ের পাতাদুটো দেখালেন। সুদীপ্ত দেখতে পেল বৃদ্ধর পায়ের পাতায় বুড়ো আঙুল দুটো নেই! কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে রইল আঙুলহীন পায়ের পাতা দুটোর দিকে চেয়ে। বৃদ্ধ তারপর আবার বলতে শুরু করলেন
“সে কী অসহ্য যন্ত্রণা তা ভাবতে পারবেন না আপনারা। মৃত্যু মনে হয় তার চেয়ে শ্রেয়। কিন্তু মানুষ তো বাঁচতে চায়, বাঁচার ইচ্ছা তাই আমার মধ্যেও জেগে রইল। এ ঘটনার মাস দুয়েক বাদে সুস্থ হয়ে ওঠার পর আবার পালাবার সুযোগ খুঁজতে লাগলাম আমি। একদিন সে সুযোগ এসেও গেল। সেদিন বাড়িতে ম্যাকুইকে একলা আমার পাহারায় রেখে বাড়ির অন্য সবাই গেছে পাশের শহরে একটা আমোদ উৎসবে। রাতে আর সেদিন কেউ বাড়ি ফিরবে না। সন্ধ্যাবেলা একলা সময় কাটছে না দেখে, আমাকে নিয়ে তামাশা করার জন্য চাবুক হাতে ম্যাকুই আমার ঘরের তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল। আমিও তাকে আমার ঘরের দিকে আসতে দেখেই মনে মনে তৈরি হয়ে গেছিলাম। ঘর অন্ধকার। সে ঘরে পা রাখতেই কাঠের টেবিলের একটা ভাঙা পায়া দিয়ে আমি আচমকা আঘাত করলাম তার মাথায়। তাকে খুন করার সাহস বা ইচ্ছা না থাকলেও আঘাতটা মনে হয় জোরেই হয়ে গেছিল। কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে গেল ম্যাকুই। আমি বুঝতে পারলাম সেখানে থাকলে মৃত্যু আমার অনিবার্য। পালাতে হবে আমাকে। সামান্য কিছু টাকাপয়সা আর দেওয়ালে ঝোলানো ওই ম্যাচলক বলুকটা সম্বল করে সেই সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়লাম আমি। কিন্তু কোথায় যাব? আমার তো অন্য কোনো ঠিকানা নেই! সারা রাত পায়ে হেঁটে পৌঁছলাম নিয়ামো বলে এক ছোট শহরে, নিয়ামোজি আর আরবদের বাস সেখানে। একজনের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। সেখানে আমি শুনতে পেলাম ম্যাকুইকে খুনের অপরাধে আমার নামে হুলিয়া বেরিয়েছে। দিন তিনেক সেখানে থাকার পর আমি একদিন সেখানের রাস্তায় ম্যাকুলা আর ম্যাককে দেখতে পেলাম। বুঝলাম আমার সে তল্লাটে থাকার খবর পেয়েছে তারা। ধরা পড়লেই নির্ঘাত তারা খুন করবে আমাকে। আবার সেদিনই পালালাম আমি। তারপর এ শহর থেকে সে শহর পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম আমি। আট ফুট তিন ইঞ্চির কোনো মানুষকে কোনো ছদ্মবেশেই লুকিয়ে রাখা যায় না। আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারতাম না। খবর ঠিক পৌঁছে যেত। ম্যাকুলা আর ম্যাক আমাকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে লাগল এখান থেকে সেখানে। বেশ কয়েকবার ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম আমি। অবশেষে জাঞ্জিবারের সীমানা ত্যাগ করে আমি হাজির হলাম তাঙ্গানিকা রাজ্যে। ডেরা বাঁধলাম এক মাসাই গ্রামে। মাসাইরা কেউ আট ফুট উচ্চতার না হলেও সাড়ে ছয়, এমনকী সাত ফুট উচ্চতার লোক সেখানে হামেশাই দেখা যায়। আমি খুব একটা বেমানান হলাম না তাদের মধ্যে। সামান্য লম্বা এই যা। আমি থেকে গেলাম সেখানে।
ভালোই কাটছিল সেখানে আমার। ভাবলাম বুঝি বিপদ কাটল। কিন্তু বছর দুই কাটতে না কাটতে দুই ভাই এসে হানা দিল সেখানে। মাসাই সর্দার আমাকে তাদের হাতে তুলে দিতে না চাওয়ায় যুদ্ধ বাধল। বেশ কয়েকজন মাসাই আর ম্যাক মারা গেল লড়াইতে। ম্যাকুলা পালাল ঠিকই কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম প্রতিহিংসা নেবার জন্য ফিরে আসবে সে। মাসাইদের একটা দল সেসময় নৌকা নিয়ে তাঙ্গানিকার উত্তরে রওনা হচ্ছিল শিকারের উদ্দেশ্যে। মাসাইরা আমাকে বলল, ‘তোমার তো বন্দুক আছে, তুমি আমাদের সাথে শিকারে চলো।’ গ্রাম ত্যাগ করলে বেশি নিরাপদে থাকতে পারব ভেবে আমি তাদের নৌকাতে গিয়ে উঠলাম। নৌকা ভাসল তাঙ্গানিকাতে। কিন্তু সে যাত্রাও আমার পক্ষে শুভ হল না। সব মিলিয়ে জনা পনেরো লোক ছিলাম নৌকাতে। সে সংখ্যা কিছু দিনের মধ্যেই কমতে শুরু করল। জঙ্গলে শিকার করতে নেমে পাঁচ জন গেল সিংহর পেটে, একজন গেল সাপের কামড়ে। তিনজন কালা জ্বরে। দুর্ভাগ্য যেন আমার পিছু ছাড়ছিল না। মাসাইদের হঠাৎ কেন জানি ধারণা হল, তাদের সঙ্গীদের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। প্রত্যেকবার শিকারে এসে দু-একজন লোক আর গ্রামে ফেরে না ঠিকই, কিন্তু এত লোক তো কখনো মরে না? নিশ্চয়ই আমি কোনো অপদেবতা! নইলে সাদা মানুষ এত লম্বা হবে কেন? আর সভ্য জগৎ ছেড়ে আমি বা জংলি মাসাইদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছি কেন?
যে মাসাইরা কদিন আগে আমাকে রক্ষা করার জন্য রক্ত ঝরাল, আমি বুঝতে পারলাম তারাই এবার ভিতরে ভিতরে আমাকে খুন করার মতলব আটছে!’
—এ পর্যন্ত বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন বৃদ্ধ। তারপর আবার বলতে লাগলেন তাঁর কথা।
সুদীপ্তরা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে শুনতে লাগল তার রোমাঞ্চকর জীবনকাহিনি—
“আমার কাছে বন্দুক ছিল বলে আমাকে সরাসরি আক্রমণ করতে মাসাইরা সাহস পেল না ঠিকই। কিন্তু একদিন শিকারের সন্ধানে যখন আমি জঙ্গলে নেমেছি, তখন তারা আমাকে জঙ্গলে ফেলে রেখে নৌকা নিয়ে পালাল! আফ্রিকার শ্বাপদসঙ্কুল গহীন অরণ্যে একলা মানুষ আমি! সম্বল বলতে একটা বন্দুক, সামান্য কিছু গুলি বারুদ। বুঝতে পারলাম সাহস হারালে মৃত্যু আমার অনিবার্য। তাই মন শক্ত করে তাঙ্গানিকার তির বরাবর জঙ্গল ধরে উত্তরে হাঁটতে লাগলাম আমি, যদি কোনো লোকালয় পাওয়া যায় সেই আশাতে। দিনের পর দিন কাটতে লাগল। এ সময় কত কষ্ট যে আমি সহ্য করেছি, কতবার যে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছি তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন! একবার তো একটা সিংহ আমার পিঠ থেকে এক খাবলা মাংস তুলে নিল, তবু বেঁচে গেলাম আমি! কোনোদিন না খেয়ে, কোনোদিন সামান্য ফলমূল বা কাঁচা মাংস খেয়ে দিন কেটেছে আমার। বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, এ সময় একদিন খিদের তাড়নায় একটা আহত সিংহকে মেরে তার কাঁচা মাংসও খেয়েছি আমি! পরে অবশ্য আমি অভিজ্ঞতায় দেখেছি, জঙ্গলে যখন প্রাণ বাঁচানোই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে তখন খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক প্রায়শই বিপরীত হয়ে ওঠে।
যাই হোক, এ রকমই চলতে চলতে আমি একদিন জঙ্গলের মাথার ওপর দিয়ে আকাশের বুকে পাহাড়ের সারি দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম আমি চলতে চলতে গ্রেট রিফট্ উপত্যকার কাছে পৌঁছে গেছি! মাসাইদের মুখে এ জায়গার কথা আমি আগেই শুনেছিলাম। শুনেছিলাম এদিকে কোথায় যেন একটা লোকালয় আছে, যদিও পরে বুঝেছিলাম তা সঠিক নয়। লোকালয়ের কথা ভেবে এ দিকেই এগোতে লাগলাম আমি। আর তার পর দিনই একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল! সকালবেলা নদীর পাড় ধরে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলছিলাম। হঠাৎ হ্রদের পাড় থেকে মানুষের গলার শব্দ কানে এল। জঙ্গলের ভিতর থেকে তাকিয়ে দেখি, হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে চারজন লোক। কিছু দূরে জলের মধ্যে রয়েছে একটা ছোট নৌকা। তাদের দেখে মনে হল, তারা সোয়াহিলি এবং তাদের পোশাক বলছে সভ্য জগতের সাথে তাদের যোগাযোগ আছে। লোকগুলোর সাথে একটা কাঠের বাক্স ছিল, আর তারা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সেই বাক্সটাকে নৌকায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছিল। নৌকা ও লোক দেখে বাঁচার আশায় আমি জঙ্গল ছেড়ে ছুটলাম তাদের দিকে। কিন্তু তাদের কাছে যেতেই লোকগুলো বর্শা নিয়ে আমাকে আক্রমণ করে বসল। আমি ততদিনে জঙ্গলের নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। প্রাণ বাঁচাতে আমি তখনই একজনকে গুলি করে খতম করে দিলাম। বাকি দুজন ঝাঁপ দিল জলে। তারপর সাঁতরে নৌকায় উঠে নৌকা নিয়ে পালল। তাদের সম্ভবত ধারণা হয়েছিল আমি কোনো প্রেতাত্মা হব! একে তো জঙ্গলের ত্রিসীমানায় কোনো মানুষ নেই। তার পরে আমার এ রকম অদ্ভুত চেহারা, সে চেহারা আবার অনাহারে কঙ্কালে পরিণত হয়েছে! তাই তাদের ধারণাকে দোষ দেওয়া যায় না। যাই হোক নৌকা, চলে যাওয়ায় আমার সভ্য জগতে ফেরার শেষ আশাও মুছে গেল। হতাশ হয়ে আমি হ্রদের পাড়ে বসে পড়লাম। এরপর হঠাৎ যেন তাদের ফেলে যাওয়া বাক্স থেকে কীসের নড়াচড়ার শব্দ কানে এল আমার! বাক্সটা কাপড়ে মোড়া ছিল। কৌতূহলী হয়ে বাক্সটার কাছে গিয়ে তার কাপড় সরাতেই দেখি, সেটা আসলে হল কাঠের তৈরি একটা খাঁচা। আর তার মধ্যে গুটিশুটি মেরে বসে ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে একটা বাচ্চা ছেলে! তাকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম আমি। তারপর আরও ভালো করে তার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, আসলে সে বাচ্চা নয়, সে একজন বামন মানুষ,—‘পিগমি!’ ব্যাপারটা তখনই আমি মোটামুটি অনুমান করে নিলাম। ইওরোপীয়দের অনেকেই আফ্রিকার জঙ্গলচারী মানুষদের মানুষ বলেই মানত না। পিগমিদের ভাবত বানর জাতীয় জন্তু বিশেষ। জঙ্গলে লোক পাঠিয়ে পিগমিদের ধরে এনে কোনো কোনো ইওরোপীয় তাদের বাড়ির প্রাচীরঘেরা বাগানে পোষা হরিণের মতো ছেড়ে রাখত বা খাঁচায় বন্দি করে রাখত। বুঝতে পারলাম লোকগুলো সম্ভবত ওই কারণেই ধরে নিয়ে যাচ্ছিল লোকটাকে! বামন লোকটার থেকে আবার মরার কোনো সম্ভাবনা নেই আমি খাঁচা খুলে তাকে মুক্ত করে দিলাম। সে কিন্তু পালল না। আমার পায়ের কাছে পড়ে পায়ে চুমু খেতে লাগল। বান্টু, ভাষাটা আমি বলতে না পারলেও কিছু কিছু বুঝতে পারতাম। কিছুক্ষণ পর তার কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম সে আমার দানবীয় উচ্চতা দেখে আমাকে তাদের অরণ্যের লৌকিক দেবতা টাইবুরু ভেবেছে। সে ধরে নিয়েছে তার ডাক শুনে আমি তাকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছি! লোকটা জানাল তার নাম, ‘ওলাওলা’। দূরের ওই যে পাহাড় দেখা যাচ্ছে, তার ওপাশে এক পিগমি গ্রাম আছে. ওলাওলা হল সেই গ্রামের রাজা। সে কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ের এ পাশে এসেছিল শিকারের খোঁজে। আর তারপর সোয়াহিলিদের হাতে ধরা পড়ে।
ওলাওলা এরপর তার সাথে তার গ্রামে যাবার জন্য অনুরোধ জানাল। পিগমিদের গ্রাম হোক আর যাই হোক, মানুষের গ্রাম তো, জঙ্গল অপেক্ষা অনেক নিরাপদ। তাছাড়া ওলাওলা বলল, তার ওই পিগমি গ্রাম ছাড়া আশেপাশে কোনো গ্রাম নেই। কাজেই তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে তার সাথে এ গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমি। তারপর পাহাড় ডিঙিয়ে তার সাথে একদিন এ গ্রামে পৌঁছে গেলাম। গ্রামের লোকেরা আমাদের দেখে অবাক হয়ে গেল। রাজাকে তারা ফিরে পাবে ভাবেনি। তাছাড়া তার সাথে দানবাকৃতি একজন লোক। ওলাওলা পিগমিদের বলল সব ঘটনা। আমার আকৃতি দেখে তারাও নিঃসন্দেহ হল আমি দেবতা টাইবুরু। এরপর গ্রামে থাকতে শুরু করলাম আমি। তারাও আমাকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করতে লাগল। আর আমিও তাদের আমার সাধ্যমতো শিক্ষিত করে তুলতে লাগলাম। প্রথম প্রথম আমি ভেবেছিলাম যদি কোনো সভ্য লোক এ তল্লাটে আসে তাহলে তার সাথে সভ্য পৃথিবীতে ফিরে যাব। কিন্তু এখানে থাকতে থাকতে কখন কীভাবে আমি এদের একজন হয়ে গেলাম তা আমি নিজেই জানি না! আস্তে আস্তে ফেরার ইচ্ছাটা আমার মন থেকে মুছে গেল। দিন, মাস, বছর কাটতে লাগল। প্রথম কয়েক বছর সন-তারিখের হিসাব আমি রাখতাম, তারপর একদিন সেসব কিছুও হারিয়ে গেল। আমি কত বছর এখানে আছি, আমার বয়স কত, এ সব কোনো কিছুই আজ আমি বলতে পারব না।”
একটানা তাঁর জীবনকাহিনি বর্ণনা করে দম নেবার জন্য থামলেন বৃদ্ধ। সুদীপ্ত-হেরম্যান বিস্মিত হয়ে শুনছে তাঁর কথা! তাদের চোখের পলক পড়ছে না। ঘরের ভিতর মশালের আলোও নিবু নিবু হয়ে এসেছে। বৃদ্ধ আবার ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন;“এই এত বছরের মধ্যে.সভ্য দুনিয়ার মানুষ যে আমি দেখিনি তা নয়। বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকজন ইওরোপীয় এ গ্রামের আশেপাশে এসেছিল। এদের কেউ বা পাদ্রী, কেউ বা শিকারি। দূর থেকে তাদের দেখেছি আমি। তাদের দেখে এক এক সময় তাদের কাছে গিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা হতো। কিন্তু পরক্ষণেই আমি নিজেকে সামলে নিতাম আসলে এখানে আসার পরও ম্যাকুলাদের আতঙ্ক মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। ভাবতাম যদি তাঁর কাছে কোনো ভাবে খবর পৌঁছে যায় সে তাহলে আমার সন্ধানে এখানেও পিছু ধাওয়া করবে। তবে আমার ধারণা অমূলক ছিল না। খবর নিশ্চয়ই তার কাছে পৌঁছে ছিল। হয়তো এখানে যারা এসেছিল তারা কেউ আমাকে দেখে ফেলে আমার কথা গল্প করেছিল সভ্য সমাজে। ঠিক যেভাবে আপনাদের কাছে পৌঁছেছিল সবুজ মানুষের খবর। বছর কুড়ি আগে এত বছর বাদেও একজন এখানে এসেছিল আমার সন্ধানে। আমাদের বহু লোককে সে গুলি চালিয়ে মারে। শেষপর্যন্ত পিগমিরা তাকে মেরে পশ্চিমের পাহাড়ে দেহটাকে ঝুলিয়ে দেয়। যে কঙ্কালটাকে নামিয়ে আপনারা কবর দেন। তার হাতে একটা আংটি ছিল, সেটা দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম সে ডায়ার বংশেরই কেউ হবে। আর আজ ম্যাকুইনার মুখটাও ভালোভাবে কাছ থেকে দেখলাম। সেটা ঠিক যেন ম্যাকুইনার মুখ! একইরকম হিংস্রতা সেই মুখে। ম্যাকুলার মুখ আমি আজও ভুলিনি। আজও তারা খুজে বেড়াচ্ছে আমাকে। ম্যাকুইনা তার প্রমাণ।” কথা শেষ করলেন বৃদ্ধ।
তন্ময়ভাবে তাঁর কথা শোনার পর হেরম্যান প্রথমে বৃদ্ধকে বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনার ধারণাই ঠিক। ম্যাকুইনা বলেছিল, ওই কঙ্কালটা তার বাবার। এখন বুঝতে পারছি ম্যাকুইনা আপনার আসল পরিচয় জানত। বংশপরম্পরায় তারা আপনাকে খুঁজছে! এরপর তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার পরনের এই সবুজ চামড়ার আচ্ছাদনের রহস্য কী?
বৃদ্ধ জবাব দিলেন, ‘পিগমিদের আরাধ্য দেবতা টাইবুরুর সাথে আমার চেহারার শুধু একটাই পার্থক্য ছিল। অরণ্যের রক্ষাকর্তা, পিগমিদের দানবীয় দেবতার গায়ের রং নাকি সবুজ। যুগ যুগ ধরে চলে আসা তাদের লৌকিক উপকথায় তাই তারা শুনছে। যে কারণে বছরে একদিন তারা আমাকে পশ্চিম পাহাড়ে দেবতা রূপে পুজো দেবার আগে আমার গায়ে সবুজ রং মাখিয়ে দিত। আমি একদিন ভাবলাম ব্যাপারটা মন্দ নয়। সবুজ পোশাকে সহজেই জঙ্গলের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখা যায়। তাছাড়া এভাবে কেউ যদি আমাকে দেখে সভ্য জগতে ফিরে গিয়ে আমার কথা গল্প করে তবে কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। এ ভাবনা মাথায় আসতেই একটা গোরিলার চামড়া সংগ্রহ করলাম। তারপর তাতে সবুজ রং মাখিয়ে পোশাক বানিয়ে নিলাম। তবে আমার জানা ছিল না, আপনাদের মতো কিছু মানুষ আছেন যারা এ জাতীয় প্রাণীর সন্ধানে এত দূরে ছুটে আসতে পারেন!’
এরপর একটু থেমে বৃদ্ধ বললেন, ‘তবে আজ আবার বুঝলাম, আট ফুট তিন ইঞ্চির কোনো মানুষ কোনো ছদ্মবেশেই কোথাও নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না! হয়তো আবার আমার সন্ধানে কয়েক বছর পর এখানে কেউ আসবে। ম্যাকুইনার ছেলে বা ভাই অথবা আপনাদের মতো কোনো অভিযাত্রী। তবে তারা আর কেউ আমাকে পাবে না। আমি বুঝতে পারছি আমার জীবনীশক্তি শেষ হয়ে এসেছে, চোখে ঝাপসা দেখি আমি। এমনিতেই বুড়ো আঙুল দুটো চলে যাবার পর থেকে হাঁটা চলার সময় ভারসাম্য রাখতে আমার অসুবিধা হত। সে সমস্যা আরও বাড়ছে। পশ্চিমের পাহাড়ে টাইবুরুর থানে আমার আস্তানা ছেড়ে আমি আর এখন নীচে গ্রামে নামি না। নেমেছিলাম আপনাদের জন্য। ওই পাহাড়ে আমার সমাধির ব্যবস্থা করবে ওটুম্বা। সভ্য জগৎ থেকে অনেক অনেক দূরে গহীন অরণ্যের পার্বত্য উপত্যকায় শান্তিতে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকব আমি। শেষ হতে চলেছে আমার দীর্ঘ অভিশপ্ত জীবনকাহিনি। আজ বহু বছর পর মৃত্যুর আগে যা সভ্য জগতের মানুষের কাছে জানিয়ে যেতে পেরে কিছুটা শান্তি পেলাম আমি।
মশালের আলো প্রায় নিভে গেছে। শুধু তার একটা মৃদু আভা এসে পড়েছে বৃদ্ধর মুখে। বিষাদ মাখানো নীল চোখে বৃদ্ধ ম্যাকলিন নিশ্চুপভাবে তাকিয়ে আছেন সুদীপ্তদের দিকে। নিস্তব্ধ, প্রায় অন্ধকার ঘরে বৃদ্ধ মানুষটার হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা বেদনা যেন স্পর্শ করেছে সুদীপ্তদের। বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। তারপর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সুদীপ্ত বলল, ‘বংশ পরম্পরায় প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য মানুষ কত দূর ছুটে আসতে পারে তাই না? ভাবতেও অবাক লাগে! কী বিচিত্র প্রাণী মানুষ!’
মশালের আলো সুদীপ্তর কথা প্রায় শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিভে যাবার আগে একবার দপ্ করে জ্বলে উঠল। মুহূর্তের জন্য সুদীপ্তর যেন মনে হল, বৃদ্ধের ঠোঁটের কোণে একটা আবছা হাসির রেখা ফুটে উঠেছে! আর এরপরই ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। আবার, কিছু সময়ের নিস্তব্ধতা। তারপর বৃদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলুন এবার বাইরে যাই, ভোর মনে হয় হয়ে এল!’
বৃদ্ধর সাথে কুঁড়ের বাইরে এসে দাঁড়াল সুদীপ্তরা। পিগমিদের ঢাকের বাজনা অনেকক্ষণ থেমে গেছে। কুঁড়ের ভিতর তন্ময় হয়ে গল্প শুনতে শুনতে সুদীপ্তরা সেটা খেয়াল করেনি। ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে খোলা আকাশের নীচে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে তারা। নিস্তব্ধ চারপাশ। প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। শুকতারা ফুটে উঠেছে আকাশের কোণে। অল্প অল্প ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে বাইরে। পাহাড়ের মাথার ঘাসের জঙ্গলের আগুনও নিভে এসেছে, শুধু একটা সাদা ধোঁয়ার রেখা ছড়িয়ে আছে পাহাড়ের মাথায়। অনেকটা ঠিক ভোরের কুয়াশার মতো। অচেতন পিগমির দল। নিদ্রিত কুঁড়েঘরের পাশ দিয়ে বৃদ্ধ ধীর পায়ে সুদীপ্তদের নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন ওঙ্গোর থানের দিকে।
কিছু দূর থেকেই সুদীপ্তর চোখে পড়ল ওঙ্গোর পাশে ঝাঁকড়া গাছটার ডাল থেকে কী যেন একটা ঝুলছে! ভালো করে সেদিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল ওটা আসলে ম্যাকুইনার মৃতদেহ। পিগমিরা তাকে ঝুলিয়ে রেখেছে গাছের ডালে।
সুদীপ্তরা এসে দাঁড়াল গাছটার নীচে ওঙ্গোর মূর্তির সামনে। এখন এখানে আর কেউ নেই। রাত শেষের বাতাসে মৃদু মৃদু দুলছে ম্যাকুইনার মৃতদেহ। সুদীপ্তদের আর ম্যাকুইনার রাইফেলগুলো কাছেই মাটিতে শীতঘুমে পড়ে আছে। ম্যাকুইনার দেহর দিকে তাকিয়ে হেরম্যান বৃদ্ধকে বললেন, ‘ওকে ঝোলানো হল কেন?’ ম্যাকলিন বললেন, ‘এটা এখানকার প্রথা। যারা কোনো চরম অপরাধ করে, তাদের মৃত্যুর পর এভাবে ফাঁসিতে লটকে দেওয়া হয়। যাতে তারও ওই একই পরিণতি হতে পারে ভেবে ভবিষ্যতে অন্যরা অন্যায় কাজ করা থেকে বিরত থাকে।’
ম্যাকুইনার ঝুলন্ত মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে সুদীপ্ত বলল, বংশপরম্পরায় লালিত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এসে শেষপর্যন্ত বাবা-ছেলে দুজনকেই নিজেদের জীবন খোয়াতে হল! তাছাড়া আরও কত মানুষ মরল ওদের জন্য! কী ভয়ঙ্কর এই প্রতিহিংস বাসনা!
তার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই বৃদ্ধ বলে উঠলেন, ‘প্রতিহিংসা ঠিক নয়, লোভ। লোভই ওদের শেষ করল!’
তাঁর কথা শুনে হেরম্যান আর সুদীপ্ত একসাথে বলে উঠল, ‘মানে?’
স্পষ্টতই এবার একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল বৃদ্ধর বলিরেখা আঁকা মুখমণ্ডলে। সুদীপ্তদের কথার কোনো জবাব না দিয়ে তিনি ওঙ্গোর মূর্তির দিকে ফিরে তার ডান হাতটা সটান ঢুকিয়ে দিলেন দেবতা ওঙ্গোর করাল মুখগহ্বরে। সেখানে হাতড়ে হাতড়ে কী যেন একটা জিনিস তিনি তুলে এনে সেটা হাতের তালুতে নিয়ে মেলে ধরলেন সুদীপ্তদের সমনে। সেটা একটা বেশ বড় নুড়ি আকৃতির পাথর। আধো অন্ধকারে যেন একবার সেটা ঝিলিক দিয়ে উঠল!
সুদীপ্তদের সেটা দেখিয়ে রুদ্ধ ধীরকণ্ঠে তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘নিছক প্রতিহিংসার জন্য নয়, আসলে এর সন্ধানেই যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় ম্যাকুলা-ম্যাকুইনারা খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে।’
সুদীপ্ত জিনিসটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী ওটা?’
বৃদ্ধ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইলেন তার হাতে ধরা জিনিসটার দিকে। তারপর শান্ত স্বরে বললেন, ‘বাড়ি থেকে এটা সঙ্গে করে পালিয়েছিলাম আমি। এ হল আমার কাহিনির সেই ‘কিং অব জাঞ্জিবার!’
বিস্মিত হয়ে সুদীপ্তরা বেশ কিছুক্ষণ পাথরটার দিকে তাকিয়ে থানার পর, সুদীপ্ত ম্যাকলিনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমরা একবার ওটা হাতে নিয়ে দেখতে পারি?’ নিশ্চুপভাবে বৃদ্ধ পাথরটা এগিয়ে দিলেন তার দিকে।
সুদীপ্ত হাতে নিয়ে দেখল পাথরটা। একটু লম্বাটে ধরনের। মুরগির ডিমের আকৃতির একটা হীরা! সে পাথরটা দেখার পর সেটা তুলে দিল হেরম্যানের হাতে।
হেরম্যান পাথরটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে যখন আবার বৃদ্ধর হাতে ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছেন তখন সুদীপ্তদের চমকে দিয়ে বৃদ্ধ বলে উঠলেন, ‘ওটা আপনারা আপনাদের কাছেই রাখুন। এত কষ্ট করে এত দূর এসে খালি হাতে ফিরে যাবেন?’
হেরম্যান বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বললেন, ‘আমরা এটা নেব কেন? এর সন্ধানে তো আমরা এখানে আসিনি। আমাদের এর প্রতি কোনো লোভ নেই।
বৃদ্ধ মৃদু হেসে প্রথমে বললেন, ‘লোভ নেই বলেই তো ওটা ম্যাকুইনার হাতে তুলে না দিয়ে আপনাদের দিলাম।’ তারপর একটু থেমে বললেন, তাছাড়া ওটা আর এখানে থাকুক আমি তা চাই না। আমার জীবন তো শেষ হয়ে এল। পিগমিরা এখনও জিনিসটার সঠিক মূল্য জানে না। হয়তো একদিন তা জানবে। আমার মৃত্যুর পর ওর জন্য খুনোখুনি করবে নিজেদের মধ্যে। অথবা ম্যাকুইনার মতো কেউ আবার হানা দেবে এখানে, নিজেরা মরবে বা গুলি চালিয়ে মারবে অরণ্যচারী নিরীহ পিগমিদের, ধ্বংস করবে অরণ্য। তাছাড়া এসব রত্ন অসভ্য পিগমিদের জন্য নয়, সভ্য সমাজেই ওর স্থান হওয়া উচিত।
বৃদ্ধর শেষের কথাতে যে একটা চাপা শ্লেষ রয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হল না সুদীপ্তর।
হেরম্যান বললেন, ‘কিন্তু…
বৃদ্ধ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আলো ফুটতে শুরু করবে। এবার ফিরতে হবে। আপনাদের পুবের পাহাড়ে পৌঁছে দিয়ে পশ্চিমে নিজের ডেরায় ফিরব আমি।’—এই বলে মাটিতে পড়ে থাকা রাইফেলগুলো ইশারায় তুলে নিতে বলে বৃদ্ধ ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলেন।
সুদীপ্তরা রাইফেল কুড়িয়ে নিয়ে নিশ্চুপভাবে তাঁকে অনুসরণ করল।
গ্রাম ছেড়ে পুবের পাহাড়ে উঠতে উঠতে আকাশ বেশ ফর্সা হয়ে এল। শুকতারা প্রায় মুছে গেছে তখন। সে পাহাড়ে উঠে বৃদ্ধর সাথে উল্টো দিকের ঢালের সামনে সুদীপ্তরা এসে উপস্থিত হল। ঢাল বেয়ে ফেরার পথ ধরতে হবে।
সারাটা পথ কেউ কোনো কথা বলেনি। এক অদ্ভুত বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে সবাই।
ঢাল বেয়ে নামার আগে হেরম্যান বৃদ্ধর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এখনও কিন্তু ভেবে দেখার সুযোগ আছে।’
‘কী?’ মৃদুস্বরে বললেন বৃদ্ধ।
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘আমাদের সাথে ফেলে আসা পৃথিবীতে ফেরার।’
বিষণ্ন চোখে বৃদ্ধ কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন সুদীপ্তদের দিকে। তারপর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন, ‘না।’ সুদীপ্তরা ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল।
.
সুদীপ্তরা তখন বেশ অনেকটা পথ নেমে এসেছে। বেশ আলো ফুটেছে। আস্তে আস্তে প্রভাতকিরণে দৃশ্যমান হচ্ছে নীচের সবুজ বনানী আচ্ছাদিত উপত্যকা। দু-একটা পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে। একটা বাঁকের মুখে এসে শেষ বারের জন্য একবার পিছনে ফিরে তাকাল সুদীপ্ত। ফেলে আসা পাহাড়ের মাথার ওপর উদিত হচ্ছেন সূর্যদেব। তার আলো ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের মাথায়। সুদীপ্ত স্পষ্ট দেখল এক দীর্ঘকায় সবুজ মানুষ একলা দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের মাথায় সে একবার যেন হাত নাড়ল সুদীপ্তর উদ্দেশ্যে, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সুদীপ্তর দৃষ্টিপথের বাইরে।
.
পুনশ্চ : আবার তাঙ্গানিকা! দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির সমারোহ। দু-দিন পর এক সকালে হ্রদের পাড়ে এক বিরাট বাওয়াব গাছের তলায় সুদীপ্তরা বসেছিল। গতকাল সন্ধ্যায় তারা এসে পৌঁছেছে এখানে। রাতটাও এখানেই কাটিয়েছে। পথে আস্কারি আর কুলিদের সন্ধান মিলে গেছে। তারাও সঙ্গে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঙ্গানিকার তীর ধরে দিনের যাত্রা শুরু করবে তারা। সেই পথ ধরে, যে পথে এসেছিল তারা।
হেরম্যান ফেরার পথে কেমন যেন চুপ মেরে গেছেন। প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা তিনি বলেননি এ দু-দিনে। রাতেও তাকে জেগে বসে থাকতে দেখেছে সুদীপ্ত। যেন সব সময় কী যেন তিনি চিন্তা করে চলেছেন। তবে এই নিশ্চুপতা তার এত বড় অভিযান ব্যর্থ হয়ে যাবার কারণে কিনা তা সুদীপ্তর জানা নেই। কিন্তু অভিযান পণ্ড হলেও হেরম্যান যে এখন বেশ ধনী তা বলতে দ্বিধা নেই। পাথরটার কত দাম হবে কে জানে!
হেরম্যান নিশ্চুপভাবে চেয়ে ছিলেন জলরাশির দিকে। পাশে বসা সুদীপ্ত তার উদ্দেশ্যে বলল, ‘এর পরের অভিযান কোথায় করবেন? সেখানে আমায় সঙ্গে নেবেন তো? হেরম্যান কোনো জবাব দিলেন না তার কথায়।
এরপর কিছু দূরে এক অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল সুদীপ্তর। একদল জলহস্তী হ্রদের পাড়ে একটা বড় ঝাঁকড়া গাছের নীচে কাদামাটিতে এতক্ষণ বসেছিল। এবার তারা উঠে দাঁড়িয়েছে মুখ হাঁ করে। কোত্থেকে একদল লাল মুখো বাঁদর এসে জড়ো হয়েছে সেই গাছে। বেলের মতো অনেক ফল ঝুলছে সেই গাছে। বাঁদরগুলো ওই ফল ছিঁড়ে ছুড়ে দিচ্ছে জলহস্তীদের বিরাট হাঁ করা মুখের ভিতর। প্রাণীগুলো ফলগুলো গিলে নিচ্ছে! অদ্ভুত দৃশ্য! সুদীপ্ত ব্যাপারটা দেখার পর প্রথমে হেরম্যানের সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘ওই দেখুন কী অদ্ভুত ব্যাপার!’ তারপর টোগোকে বলল, ‘বাঁদরগুলো ওদের ফল খাওয়াচ্ছে কেন?’
টোগো বলল, ‘এ দৃশ্য আমি এর আগে দেখেছি। জঙ্গলের বিভিন্ন প্রাণীদের মধ্যে নানা অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জলহস্তীরা ওই ফল খায় কারণ, ওই ফলের শক্ত খোলা ওদের পরিপাকে সাহায্য করে। আর বাঁদররা ওই ফল ছুড়ে দিয়ে ওদের ডেকে আনে কারণ, তাহলে জলহস্তীর উপস্থিতিতে কুমিরদের দূরে সরিয়ে ওরা জল খেতে পারে। ওই দেখুন জলহস্তীর দঙ্গলের ফাঁক দিয়ে একদল বাঁদর হ্রদে জল খেতে নেমেছে।’ টোগোর কথা শুনে হঠাৎ হেরম্যান উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলেন সেই গাছের দিকে।
সুদীপ্ত বলল, ‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?’
হেরম্যান শুধু জবাব দিলেন, ‘জলহস্তীকে ফল খাওয়াতে।’
তাঁর কথা বুঝতে না পেরে কাদামাটিতে নেমে সুদীপ্ত তাকে অনুসরণ করল। হেরম্যান আর সুদীপ্ত গাছটার কাছাকাছি পৌঁছাতেই তাদের দেখে গাছের ডাল ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল। সতর্ক হয়ে জলহস্তীগুলো একে একে জলে নেমে যেতে লাগল। তারা যখন জায়গাটাতে পৌঁছল তখন একটাই মাত্র জলহস্তী দাঁড়িয়ে আছে হ্রদের কিনারে। তার আকার দেখে মনে হল সম্ভবত এ প্রাণীটাই পালের গোদা। প্রাণীটা লাল চোখ দুটো দিয়ে সতর্কভাবে দেখতে লাগল সুদীপ্তদের। হেরম্যান কাদা ভেঙে সোজা তার দিকে এগোতে লাগলেন। তার পিছনে সুদীপ্ত।
হেরম্যান তখন প্রাণীটার প্রায় কাছাকাছির মধ্যে পৌঁছে গেছেন। জলে নামার আগে শেষবারের মতো একটা বিরাট হাঁ করল প্রাণীটা। আর হেরম্যান মুহূর্তের মধ্যে তাঁর ট্রাউজারের পকেট থেকে কী যেন বার করে অব্যর্থ লক্ষে জিনিসটা ছুড়ে দিলেন জলহস্তির হাঁ করা মুখে। সুদীপ্তর মনে হল প্রাণীটার মুখগহ্বরে মুহূর্তের জন্য যেন সেটা ঝিলিক দিয়ে উঠল। পরমুহূর্তে প্রাণীটা মুখবন্ধ করে বিশাল বপু নিয়ে ঝাঁপ দিল জলে। জল তোলপাড় করতে করতে জলহস্তীর ঝাঁক এগিয়ে চলল তাঙ্গানিকার গভীরে।
এবার সুদীপ্তর দিকে ফিরে তাকালেন হেরম্যান। তাঁর মুখে মেঘ কেটে গিয়ে ঝিলিক দিচ্ছে হাসির রেখা। ঠিক সকালের ওই সূর্যের মতো। সুদীপ্তর উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, ‘জাঞ্জিবারের রাজাকে তাঙ্গানিকাকে দিয়েদিলাম। উফ্ঃ, এ দুটো দিন কী দুশ্চিন্তাতেই কেটেছে আমার! এ জিনিস আমাদের জন্য নয়। ওটা কাছে রাখলে আর কোনো ক্রিপটিডের সন্ধানে যাওয়া হত না আমার।’