সুদীপ্ত ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে লাগল—অরণ্যের মধ্যে দিয়ে সে হেঁটে চলেছে। অন্তহীন সে পথ। কত জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত সবকিছু অতিক্রম করে সে এগিয়ে চলেছে। তার পথের চারপাশে কত রকমের জীবজন্তু, গাছপালা, তার মধ্যে দিয়ে চলেছে। কিন্তু কোথায় চলেছে তা তার জানা নেই! ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে স্বপ্নের মধ্যে সে অজানা পথ অতিক্রম করতে লাগল।
দীর্ঘ স্বপ্নের শেষ পর্যায়ে জঙ্গলের মধ্যে একসময় সে শুনতে পেল অসংখ্য শব্দ। শব্দগুলো যেন চারপাশ থেকে ব্যূহ রচনা করে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তারপর তাকে ঘিরে ধরল অসংখ্য পিগমি। হাতে তাদের বিষ মাখানো তির। পিগমি দলের মধ্যে একজনকে সে চিনতে পারল — ওটুম্বা। ওটুম্বা তাকে বলল, ‘তুমি অরণ্যের দেবতাকে ধরতে এসেছ, আমাকে তুমি মারতে চেয়েছিলে, তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম।’
সুদীপ্ত বলল, ‘না না, সে আমি নই, ম্যাকুইনা।’ কিন্তু তার কথা চাপা পড়ে গেল ঢাকের শব্দে। প্রচণ্ড জোরে ঢাক বাজছে। ওটুম্বা তির-ধনুক তাগ করল সুদীপ্তকে লক্ষ্য করে। একটা চিৎকার বেরিয়ে এল সুদীপ্তর গলা থেকে।
ঠিক এই মুহূর্তে ঘুমটা ভেঙে গেল সুদীপ্তর। সে একইভাবে পড়ে আছে তাঁবুর ভিতর । তাঁবুটা অন্ধকার হলেও পর্দার বাইরে যেন আলো আলো ভাব। পিগমিদের ঢাকের শব্দ আর বিচিত্র ধরনের আওয়াজ হচ্ছে বাইরে। মাঝে মাঝে যেন কাদের পদভারে মাটি কাঁপছে। কারা যেন ছুটে যাচ্ছে তাঁবুর পাশ দিয়ে। বাইরে কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছে না সুদীপ্ত।
মিনিট পাঁচেক একইভাবে পড়ে রইল সুদীপ্ত। বাইরে নানারকম শব্দ ক্রমশ বেড়েই চলেছে! হঠাৎ তাঁবুর খুব কাছেই যেন মানুষের গলার শব্দ কানে এল তার। সে শব্দ এগিয়ে আসছে তাঁবুর দিকে। তাহলে কী ম্যাকুইনা আসছে সুদীপ্তর ওপর প্রতিশোধ নিতে? বিস্ফারিত চোখে সে তাকাল তাঁবুর দরজার দিকে। আর তার পরমুহূর্তেই তাঁবুর পর্দা ঠেলে মশাল হাতে ভিতরে প্রবেশ করলেন হেরম্যান আর টোগো। তাদের দেখে মুহূর্তের মধ্যেই সুদীপ্তর সব যন্ত্রণা যেন মিলিয়ে গেল। আনন্দে সে উঠে বসতে যাচ্ছিল, কিন্তু দড়ি বাঁধা বলে পারল না।
তাঁবুতে ঢুকেই কোনো কথা না বলে টোগো দ্রুত সুদীপ্তর কাছে এসে বাঁধন খুলতে বসল।
সুদীপ্ত হেরম্যানকে বলল, ‘আপনারা কোথায় ছিলেন? ম্যাকুইনা কোথায়?’ হেরম্যান বললেন, ‘আমরা পাহাড়ের ঢালে কাল রাত থেকে লুকিয়ে ছিলাম। ম্যাকুইনা নেই, পালিয়েছে।’
‘পালিয়েছে মানে?’ অবাক হয়ে বলল সুদীপ্ত।
হেরম্যান বাইরের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘পিগমিদের ভয়ে পালিয়েছে। সব কথা বলার সময় নেই, এক্ষুনি পালাতে হবে। ওরা এসে পড়ল বলে।’
টোগো দ্রুত সুদীপ্তর বাঁধন খুলে দিল। তারপর তাকে হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে তাঁবুর বাইরে নিয়ে এল। বাইরে বেরিয়ে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখতে পেল সুদীপ্ত। উত্তরের সারা পাহাড় আগুনে লাল হয়ে আছে। আগুনের লেলিহান শিখা লাফিয়ে উঠছে আকাশের দিকে। আর সেই আগুন বাতাসবাহিত হয়ে দ্রুত ছুটে আসছে ঘাসের বন বেয়ে তাদের পাহাড়ের দিকে।
ইতিমধ্যে এ-পাহাড়েও বেশ কিছুটা আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আগুন গ্রাস করে ফেলেছে বনভূমি। মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ছে গাছের ডাল। ভীত সন্ত্রস্ত প্রাণীরা আগুনের থেকে বাঁচতে প্রাণ ভয়ে পালাচ্ছে। হরিণ, শিম্পাজি, বেবুন আরও কত প্রাণী। একজোড়া হাটারি চিতা সুদীপ্তর প্রায় গা ঘেঁষে দৌড়ে পালাল। আর বাজছে অজস্র ঢাক। পাহাড়ের দু-দিকের ঢাল বেয়ে ওপর দিকে উঠে আসছে সে শব্দ।
সুদীপ্ত অবাক হয়ে বলল, ‘এ কী দাবানল নাকি?’
হেরম্যান বললেন, ‘না, পিগমিরা ম্যাকুইনার মেশিনগানের কাছে পরাস্ত হয়ে উত্তরের পাহাড়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ওরা জানে বাতাস সে আগুন এ পাহাড়ে পৌঁছে দিয়ে সকলকে পুড়িয়ে মারবে। এর ভয়েই ম্যাকুইনা পালিয়েছে।’
সুদীপ্ত বলল, ‘আমরা এখন কোন দিকে পালাব? যে দিক থেকে আমরা এসেছিলাম সে দিকেই?’
হেরম্যান বললেন, ‘না, সে পথ বন্ধ। পিগমিরা কাল রাত থেকে তাদের বিপদের কথা ঢাকের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে। আশেপাশের উপত্যকার জঙ্গলে সম্ভবত আরও কিছু পিগমি গ্রাম আছে। জাতভাইদের বিপদ থেকে রক্ষা করতে তারাও এসে পৌঁছেছে। ওই ঢাকের শব্দ তাদেরই। এ পাহাড়ের চারপাশের ঢাল তারা ঘিরে ফেলেছে। আমাদের পালাতে হবে দক্ষিণে। যদি কোনোভাবে রক্ষা পাওয়া যায়।’
আগুন যেন ঘাসের বনে বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ম্যাকুইনার তাঁবু থেকে কিছু দূরে সুদীপ্তদের তাঁবুটা যেখানে পাতা হয়েছিল সে জায়গাটা এবার গ্রাস করে নিল আগুন। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল তাঁবু। ঢাকের বাজনাও প্রায় ঢালের ওপরে উঠে এসেছে। আর না দাঁড়িয়ে হেরম্যান সুদীপ্ত আর টোগোকে নিয়ে ছুটতে শুরু করলেন দক্ষিণ দিকে।
পাগলের মতো বনজঙ্গল ভেঙে ছুটতে লাগল তারা। কখনও তারা পড়ে যাচ্ছে, অন্ধকারে গাছের গুঁড়িতে বা পাথরে ধাক্কা লেগে থেঁতলে যাচ্ছে দেহ। তবু তারা ছুটছে।
তাদের পিছনে তাড়া করে আসছে আগুনের লেলিহান শিখা। তার সঙ্গে পিগমিদের ঢাকের শব্দ আর বীভৎস চিৎকার! ছুটতে ছুটতে একসময় তারা আগুনকে বেশ কিছুটা পেছনে ফেলে দিলেও হঠাৎ তারা জঙ্গলের মধ্যে শুনতে পেল তিন দিকে খুব কাছেই যেন ঢাক বেজে উঠল। হেরম্যান বললেন, ‘সম্ভবত জঙ্গলের তিন দিক থেকে ওরা ঘিরে ফেলেছে আমাদের।’
জঙ্গলের একদিকে ফাঁকা জমি। প্রাণ বাঁচাতে গতিপথ পরিবর্তন করে সুদীপ্তরা সে দিকে ছুটল। হেরম্যান আর টোগো ছুটছে একসঙ্গে, হাত তিনেক তফাতে সুদীপ্ত। ফাঁকা জমি দিয়ে কিছুটা এগোবার পরই সুদীপ্তর সামনে হঠাৎই ভোজবাজির মতো যেন মিলিয়ে গেলেন হেরম্যান আর টোগো। সেটা দেখার সাথে সাথেই সুদীপ্ত দাঁড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু গতি নিয়ন্ত্রণ করার আগেই তার পায়ের তলার মাটি হঠাৎ সরে গেল, অন্ধকার গহব্বরের মধ্যে আছড়ে পড়ল সুদীপ্ত।
সুদীপ্তর কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল ব্যাপারটা বুঝতে। অন্ধকারের মধ্যে প্রথম টোগোর গলা শোনা গেল, ‘আমরা ফাঁদে পড়ে গেছি। যেমনভাবে পশু ধরা হয় তেমনি পিগমিরা তিন দিক থেকে তাড়িয়ে এনে আমাদের ফাঁদে ফেলল। আমরা বুঝতে পারিনি।’
হেরম্যান বললেন, ‘আর পালাতে পারলাম না। ওই যে, ওরা গর্তের কাছে ছুটে আসছে! পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে!’
সুদীপ্ত বলল, ‘ওরা আমাদের মেরে ফেলবে! আমাদের কাছে তো রাইফেল, রিভলভার আছে। একটা শেষ চেষ্টা করতে হবে। কোনোভাবে যদি ওপরে ওঠা যায়।’ এই বলে সে অন্ধকারের মধ্যেই ওপরে ওঠার কোনো পথ আছে কি না, তা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল ৷
হেরম্যান সুদীপ্তর কথা শুনে বললেন, ‘ওপরে ওঠার আর কোনো সুযোগ নেই। ওরা এসে পড়ল বলে। তাছাড়া এভাবে লড়াই করে কোনো লাভ হবে না। আমরা তিনজন, ওরা সংখ্যায় অনেক। খুব বেশি হলে আমাদের তিনজনের প্রাণের বিনিময়ে ওদের কিছু লোকের প্রাণ নিতে পারি, ব্যস, এই পর্যন্তই। আমার মনে হয় যুদ্ধ না করে আত্মসমর্পণ করাই ভালো। তারপর অদৃষ্টে যা আছে তাই হবে।’
টোগো বলল, ‘হ্যাঁ, সেটাই ঠিক। যদি কোনো কারণে ওরা আমাদের মুক্তি দেয়।’ সুদীপ্ত বলল, ‘তাহলে তাই হোক, আমরা লড়াই করব না।’
তাদের কথা শেষ হবার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গর্তের ওপরে অনেক পায়ের শব্দ শোনা গেল। মশালের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল গর্ভের মুখ। সুদীপ্তরা তাকিয়ে দেখল ওপরে গর্তের চার পাশ দিয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পিগমিরা। তাদের তিরের ফলা তাগ করা হাত নীচে গর্তের মধ্যে পড়ে থাকা সুদীপ্তদের দিকে। পিগমিদের সার সার তিরের ফলা এই মুহূর্তে সুদীপ্তদের পিন-কুশন বানিয়ে দিতে পারে। যদিও ওই বিষ-মাখানো তির সুদীপ্তদের এক-এক জনের পক্ষে একটাই যথেষ্ট।
সুদীপ্তদের দিকে তির তাগ করে পিগমিরা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
সুদীপ্তরাও নড়াচড়া করছে না। সামান্য ভুল বোঝাবুঝি মুহূর্তের মধ্যে ওদের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সুদীপ্তদের পর্যবেক্ষণ করার পর পিগমিদের একজন কী যেন একটা বলল তার সঙ্গীদের। তার কথা শুনে কয়েকজন পিগমি ঘাসের দড়ি ঝুলিয়ে তা বেয়ে গর্তের মধ্যে নামতে শুরু করল। যারা নীচে নামল তারা প্রথমে সুদীপ্তদের রাইফেলগুলো কেড়ে নিয়ে দড়ি দিয়ে তাদের হাত-পা বেঁধে ফেলল। ওরাও বাধা দিল না। দড়ি বেঁধে কিছুক্ষণের মধ্যে গর্তের ওপরে তুলে ফেলা হল তাদের তিন জনকে। ওপরে প্রায় জনা পঞ্চাশেক পিগমি দাঁড়িয়ে আছে। তবে সুদীপ্তর তাদের ওটুম্বার গ্রামের লোক বলে মনে হল না। সম্ভবত অন্য কোনো গ্রাম থেকে ওটুম্বাদের সাহায্য করার জন্য এরা এসেছে। এদের চেহারা নগ্ন ও মুখে আর বুকে উল্কি আঁকা। আগুনের আভায় হিংস্র তাদের মুখ।
ওপরে ওঠানোর পর সুদীপ্তদের তিনজনকে, বাঁধা হল তিনটে লম্বা বাঁশের সঙ্গে। তারপর ঠিক যেমন শিকার করা প্রাণী বাঁশে বেঁধে কাঁধে করে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তেমনি কয়েকজন পিগমি বাঁশ তিনটের দু-প্রান্ত কাঁধে তুলে চলতে শুরু করল। আর অন্যরা ঢাক বাজাতে বাজাতে তাদের পিছনে চলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুদীপ্তদের নিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে নামতে লাগল পিগমিরা। বাঁশে ঝুলন্ত অবস্থাতেই সুদীপ্তরা বুঝতে পারল তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নীচে ওটুম্বাদের গ্রামের দিকে। পাহাড় থেকে সুদীপ্তদের বয়ে নিয়ে নীচে নেমে পিগমিরা সত্যিই প্রবেশ করল গ্রামের ভিতর। সারা গ্রাম মশালের আলোতে আলোকিত। কয়েকশো পিগমি সমবেত হয়েছে সেখানে। বিচিত্র তাদের সাজ-পোশাক, বিচিত্র তাদের অস্ত্র শস্ত্র। এত মানুষ গ্রামে, এর আগে ওরা দেখেনি। গ্রেট রিট্ ভ্যালির বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর যোদ্ধারা আজ এ গ্রামে উপস্থিত হয়েছে ভিনদেশি শত্রুদের শাস্তি দেবার জন্য। বাহকরা সুদীপ্তদের নিয়ে গ্রামে ঢুকতেই অপেক্ষারত পিগমিরা বীভৎস স্বরে বিজয়-উল্লাস শুরু করল। বাজতে লাগল ঢাক জাতীয় নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। তাদের শত্রুরা পরাস্ত হয়েছে, বন্দি শত্রুদের হত্যা করে এবার সঙ্গীদের হত্যার প্রতিশোধ নেবে পিগমিরা। চোখের বদলে চোখ, নখের বদলে নখ, প্রাণের বদলে প্রাণ—এই হল জঙ্গলের চিরাচরিত নিয়ম। দোষের কিছু নয়, পিগমিরা জঙ্গলের এ নিয়মই এবার পালন করবে। শত্রু নিধন করে রাত শেষে দেবতা ওঙ্গো আর বড় দেবতা টাইবুরুর আশীর্বাদ নিয়ে বাইরে থেকে আসা পিগমিরা যে যার গ্রামে ফিরে যাবে। শত্রু নিধনের প্রাক্কালে শত্রুদের ঘিরে তাদের এ উল্লাস স্বাভাবিক।
গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করে এক জায়গাতে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়াল মুখে উল্কি আঁকা পিগমির দলটা। তারপর একজন এসে কী যেন বলল উল্কি আঁকা দলের সর্দারকে। সুদীপ্তদের নিয়ে তারা আবার চলতে শুরু করল গ্রামের ভিতর। আর তাদের ঘিরে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে উদ্দাম নৃত্য করতে করতে এগোল সমবেত অন্য পিগমিরা।
সুদীপ্তদের নিয়ে গিয়ে নামানো হল সেই বটগাছের মতো বিশাল গাছটার নীচে। গাছেরা চারপাশে মাটিতে পোঁতা বাঁশের খুঁটিতে মশাল গোঁজা। সেই আলোতে গাছের গুঁড়ির নীচে রাখা ওঙ্গোর মূর্তিটা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। তার করাল মুখগহ্বর যেন গিলে খেতে আসছে সবাইকে। বীভৎস তার রূপ, ঠিক যেন মৃত্যুর প্রতিমূর্তি। গাছের নীচে একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করে দাঁড়িয়ে আছে পিগমিরা। সেই অর্ধবৃত্তের মাঝখানে সুদীপ্তদের নামিয়ে বাঁশের বাঁধন আর হাত পা-র বাঁধন খুলে তিনজনকে হাঁটু মুড়ে পাশাপাশি বসানো হল। তাদের চারপাশে বিষাক্ত তিরধনুক হাতে পিগমিদের পাহারা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে দেখছে বন্দিদের। চারপাশে তাকিয়ে দেখার পর সুদীপ্তর হঠাৎ চোখ পড়ল গাছের ওপর দিকে। একটা মোটা ডালে ঝুলছে দুটো দেহ। ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তাদের। লোক দুজনকে চিনতে পারল সুদীপ্ত। একজন ম্যাকুইনার মাসাই সর্দার আকালা, অন্যজন তার সঙ্গী মেশিনগান চালক। দুজনেই পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে পিগমিদের হাতে। সুদীপ্তর পাশে বসা হেরম্যান হঠাৎ কনুই দিয়ে মৃদু খোঁচা দিলেন সুদীপ্তকে। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে এক বিস্ময়কর ব্যাপার দেখতে পেল সুদীপ্ত। কিছুদূরে মাটির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে ম্যাকুইনা। তার পিঠে একটা তির বেঁধা, মুখটা অন্যদিকে ফেরানো, নিস্পন্দ দেহ। এক হাতে এখনও রাইফেল ধরা। তাহলে ম্যাকুইনা শেষ পর্যন্ত পালাতে পারেননি, ধরা পড়েছিলেন পিগমিদের হাতে।
হেরম্যান চাপা স্বরে বললেন, ‘সম্ভবত ম্যাকুইনাও আমাদের মতো এ পর্যন্ত জীবিত অবস্থাতেই এসেছিলেন।’
সুদীপ্ত একটু অবাক হল ম্যাকুইনার তিরবিন্ধ মৃতদেহ দেখে। তার মানে ম্যাকুইনার নেওয়া ইঞ্জেকশন পিগমিদের বিষাক্ত তিরের প্রভাব কাটাতে পারেনি। সেই তিরেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কারণ অন্য কোনো আঘাত তাঁর দেহে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
ঢাক বাজছে। হাঁটুমুড়ে সুদীপ্তরা বসে আছে। কয়েকজন পিগমি গাছে উঠে একটা ডালে দড়ি ঝোলাতে লাগল। সুদীপ্ত তাই দেখে হেরম্যানকে নীচু স্বরে বলল, ‘এরা কী আমাদেরও ফাঁসিতে ঝোলাবে?’
হেরম্যান হতাশভাবে জবাব দিলেন, ‘হয়তো তাই।’
এরপরই সুদীপ্ত হাত নাড়তে গিয়ে অনুভব করল, ‘পোশাকের নীচে তার কোমরে রিভলভারটা এখনও আছে। সুদীপ্তর মনে একটু সাহস ফিরে এল। সে হেরম্যানকে বলল, ‘আমার রিভলভারটা আছে। ম্যাকুইনার রাইফেলটাও কাছেই পড়ে আছে।’
সুদীপ্তর কথার অর্থ বুঝতে পেরে হেরম্যান বললেন, ‘রিভলভার আমার আর টোগোর কাছেও আছে। সত্যিই যদি ওরা আমাদের ফাঁসিতে ঝোলাতে চায় তবে একটা শেষ চেষ্টা করব। একমাত্র গাছের দিকটাই অরক্ষিত, ওদিকেই আমরা ছুটব।’
সুদীপ্ত মাটির দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘হ্যাঁ, যেভাবেই হোক বাঁচার একটা চেষ্টা আমাদের করতেই হবে।’
এরপর সে হেরম্যানের উদ্দেশে বলল, “পিগমিরা আমাদের বাঁধনগুলো খুলে দিল কেন? এতে কী ওদের ফাঁসিতে ঝোলাতে সুবিধে হবে? নাকি ওরা আমাদের পালানোর সুযোগ করে দিয়ে পিছন থেকে তির ছুড়ে শিকারের আনন্দ উপভোগ করতে চায়?
হেরম্যান তার কোনো জবাব দিলেন না।
সুদীপ্তর কথার মাঝেই পিগমিদের ঢাকের বাদ্যি হঠাৎই যেন থেমে গেল, আর তার সঙ্গে থেমে গেল চারপাশের পিগমিদের কোলাহল। চারপাশ কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল।
ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারল না সুদীপ্ত। মাথা নীচু করেই সে হেরম্যানের উদ্দেশে আর একটা প্রশ্ন করল, ‘পিগমিরা আমাদের গর্তের মধ্যে না মেরে এখানে আনল কেন?’ হেরম্যানের কাছ থেকে এবারও কোনো সাড়া মিলল না।
দ্বিতীয়বার হেরম্যানের উত্তর না পাওয়ায় সুদীপ্ত পাশ ফিরে তাঁর দিকে তাকাতেই দেখতে পেল তিনি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে।
সুদীপ্ত তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের মোটা গাছের গুঁড়ির দিকে তাকাতেই যেন পাথর বনে গেল। গাছের গুঁড়ির পিছন থেকে বেরিয়ে সুদীপ্তদের সামনের ফাঁকা জমিতে এসে দাঁড়িয়েছে ওটুম্বা, আর তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুতদর্শন দ্বি-পদ মূর্তি! তার উচ্চতা প্রায় আট ফুট হবে! সবুজ রঙের ঘন লোমে প্রাণীটার সারা দেহ ঢাকা। একটু কুঁজো হয়ে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে সুদীপ্তদের দেখছে প্রাণীটা।
বুরুন্ডির সবুজ বানর!
নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সুদীপ্ত। এরই সন্ধানে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আফ্রিকার এই দুর্গম প্রদেশে সুদীপ্তরা ছুটে এসেছে। বিপদকে বার বার ফাঁকি দিয়ে, অসহ্য কৃচ্ছসাধন করে বুরুভির গহীন অরণ্যে একেই খুঁজতে বেরিয়েছে তারা। মৃত্যুর তাকিয়ে রইল সুদীপ্ত প্রাণীটার দিকে।
পূর্বমুহূর্তে এসে দর্শন দিল তাদের। হতবাক হয়ে
পাশ থেকে বিড়বিড় করে হেরম্যান সুদীপ্তকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘যাক, মৃত্যুর আগে অন্তত একটা সান্ত্বনা পেলাম। ক্রিপ্টোজুলজি, ক্রিপটিড যে মিথ্যা নয় তা তোমাকে দেখাতে পারলাম।’
সুদীপ্ত কোনো জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে।
আরও কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। ওটুম্বা কী যেন বলল সমবেত পিগমিদের উদ্দেশে। সঙ্গে সঙ্গে পিগমিরা উচ্চস্বরে কী যেন বলে, হাত নামিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়াল। টোগো বলল, ‘ওটুম্বা দেবতা টাইবুরুর প্রতি সম্মান জানানোর নির্দেশ দিল পিগমিদের।’
ওটুম্বা এরপর নিজেও পিগমিদের দঙ্গলের একপাশে গিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়াল।
দেবতা টাইবুরুর শুধু একলা দাঁড়িয়ে রইল গাছের সামনের ফাঁকা জমিতে। প্রাণীটার মুখটা অনেকটা গোরিলার মতো, সুদীপ্তদের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু দুলছে প্ৰাণীটা।
হেরম্যান চাপা স্বরে বললেন, ‘মনে হচ্ছে এটা গোরিলা ও মানুষের মধ্যবর্তী স্তরের কোনো জীব। গোরিলার মতো হাত অতটা লম্বা নয়, দাঁড়ানোর ভঙ্গি অনেকটা মানুষের মতো।’
প্রাণীটাকে দেখার পরই বিস্ময়ে সুদীপ্তরা পালানোর চিন্তাটা যেন ভুলেই গেল। তারা প্রাণীটার দিকে তাকিয়েই রইল।
দানববানর সুদীপ্তদের কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর ধীরপায়ে সোজা এগিয়ে আসতে লাগল ওদের দিকে। সামান্য ঝুঁকে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে যেন। উত্তেজনায় নিজেদের অজান্তেই সুদীপ্তরা উঠে দাঁড়াল।
সুদীপ্ত হেরম্যানকে বলল, “ও কি আমাদের আক্রমণ করতে আসছে নাকি?’ তিনি মৃদুস্বরে জবাব দিলেন, ‘জানি না।’
হৃৎস্পন্দন বন্ধ করে সুদীপ্তরা প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে আছে, দানববানর এগিয়ে আসছে সামনের দিকে। তিনদিক ঘিরে নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকশো পিগমি। অথচ একটা পাতা পড়লেও যেন শব্দ পাওয়া যাবে, এমনই নিস্তব্ধতা। তারাও তাকিয়ে আছে সবুজ প্রাণীটার দিকে। কয়েক মুহূর্ত পর প্রাণীটা তখন প্রায় সুদীপ্তদের সামনে চলে এসেছে, হাত দশেকের মতো ব্যবধান, আর ঠিক সেই সময় একটা বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটল। সুদীপ্তর যেন মনে হল, একটু দূরে পড়ে থাকা ম্যাকুইনার মৃতদেহটা হঠাৎই নড়ে উঠল, আর তারপরই ম্যাকুইনা বিদ্যুৎগতিতে লাফিয়ে উঠে সবুজ বানরের দিকে রাইফেল তাগ করে চিৎকার করে উঠলেন, ‘সবাই অস্ত্র না ফেললে এখনই গুলি চালাব।’ এই বলে এক হাত দিয়ে অবলীলায় নিজের পিঠ থেকে তিরটা খুলে মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিলেন।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সবুজ বানর। হতবাক পিগমিরা, হেরম্যানরাও। পিগমিদের বিষাক্ত তির খেয়েও যে কেউ এভাবে বেঁচে উঠতে পারে তা অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
যদিও পিগমিদের কয়েকজন ম্যাকুইনাকে লক্ষ্য করে তির তাগ করল, কিন্তু সে তির কেউই ছুড়তে পারল না। কারণ তাইবুরু আর আগুনলাঠি হাতে শত্ৰু এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে যে তির লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেই দেবতার গায়ে লাগতে পারে।
সুদীপ্তও যেন ব্যাপারটা দেখে প্রথমে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পরমুহূর্তে ব্যাপারটা বুঝতে পারল—ম্যাকুইনা তাকে ঠিকই বলেছিলেন, অ্যান্টিডোটের প্রভাবে পিগমিদের বিষাক্ত তির ওঁর দেহে কাজ করেনি। তিনি এতক্ষণ মরার ভান করে সুযোগের অপেক্ষায় পড়েছিলেন।
সবুজ বানর আর ম্যাকুইনা হাত খানেকের ব্যবধানে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। দুজনেই পাথরের মূর্তির মতো স্থির! ম্যাকুইনা আবার চিৎকার করে উঠলেন, ‘শেষ বারের মতো বলছি, সবাই হাতিয়ার না ফেললে এখনই গুলি চালাব।’
পিগমিরা তার চিৎকারের মর্মার্থ বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। কিন্তু সবুজ বানরের মুখ থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বেরিয়ে এল। সে শব্দ শুনে মৃদু একটা গুঞ্জন উঠল পিগমিদের দঙ্গলে। তারপর তারা নিজেদের অস্ত্র নামিয়ে রাখল পায়ের কাছে।
সুদীপ্ত স্পষ্ট দেখতে পেল সবুজ বানরের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি ফুটে উঠল ম্যাকুইনার মুখে। মশালের আলোতে ঝিলিক দিল তার হীরে বসানো দাঁত। হিস্হিস্ করে চাপাস্বরে কী যেন বললেন ম্যাকুইনা। সেকথা সুদীপ্তর কানে এল না ঠিকই কিন্তু ম্যাকুইনার রাইফেলের নল যে সবুজ বানরের দেহ স্পর্শ করে আছে তা ওর নজর এড়াল না। ম্যাকুইনা সত্যি কী প্রাণীটাকে গুলি করতে যাচ্ছেন নাকি?
পরমুহূর্তেই হঠাৎ হেরম্যান সুদীপ্তকে চমকে দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গিয়ে ম্যাকুইনার রাইফেলের নল এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে আগলে দাঁড়ালেন সবুজ বানরকে। তারপর চিৎকার করে উঠলেন, ‘না, ওকে আমি মরতে দেব না। ওর প্রাণ আমার আপনার চেয়ে অনেক দামি। এ প্রাণী একবার পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্লিজ, মিস্টার ম্যাকুইনা!’
ম্যাকুইনা সে কথায় কর্ণপাত না করে হিংস্রভাবে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘সামনে থেকে সরে না গেলে এখনই গুলি করে মারব। আমি তিন গুনব, ‘এক… দুই…’ ম্যাকুইনা তিন গোনার আগেই হেরম্যান ম্যাকুইনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর হাতের রাইফেল ছিনিয়ে নেবার জন্য। দুজনের মধ্যে প্রচণ্ড ঝাপটা-ঝাপটি হল, তারপরই শোনা গেল রাইফেলের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে হেরম্যান পড়ে গেলেন সবুজ বানরের ওপর। সে ধাক্কায় প্রাণীটাও টাল সামলাতে পারল না। কয়েক হাত তফাতে দুজনে ম্যাকুইনার দুদিকে ছিটকে পড়ল।