বুরুন্ডির সবুজমানুষ – ১

রোজউড গাছের নীচে দাঁড়িয়ে সামনের বিশাল হ্রদের দিকে তাকিয়ে ছিল সুদীপ্ত। হ্রদ তো নয়, যেন সমুদ্র! ‘লেক-তাঙ্গানিকা!’ আফ্রিকা মহাদেশের ভুবনবিখ্যাত হ্রদ। সুদীপ্ত ভূগোলের বইতে কত পড়েছে এই হ্রদের কথা ! আজ তার চোখের সামনে সেই হ্রদ! ফ্রেডরিখ হেরম্যান কখন যে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, তা খেয়াল করেনি সুদীপ্ত। তিনি তার কাঁধে হাত রাখতেই সুদীপ্ত একটু চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকাল। হেরম্যান তাঁর দীর্ঘ দাড়িতে হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘কি, রাতে তাঁবুতে ঘুম ভালো হয়েছিল তো?’

সুদীপ্ত জবাব দিল, ‘ভালো। আপনার?’

তিনি বললেন, ‘আমি মাঝরাতে উঠে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এসে তুতসি কুলিদের সঙ্গে বসেছিলাম। চাঁদের আলোয় কত জন্তু দলে দলে জল খেতে এল হ্রদে। জেব্রা, ওয়ার্টহগ, ইম্পালা, কুড়ু! একবার ভাবলাম তোমাকে ডাকি, তারপর মনে হল, তোমার দু-দিন টানা ধকল গেছে। বিশ্রামের দরকার। তাছাড়া আজ থেকে আমাদের হাঁটা শুরু হবে। তোমাকে তাই ডাকিনি। এরপর তিনি হ্রদের ওপাশে দিক-চক্রবালের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘হ্রদের ও-পাড়ে হল, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো।’ আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি রিপাব্লিক অফ বুরুন্ডির পশ্চিম সীমানায়। এই হ্রদই হল দু-দেশের সীমারেখা।’ সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘আমরা কোন দিকে এগোব?’

হেরম্যান বললেন, ‘বুরুন্ডির ম্যাপটা তাহলে তোমাকে আগে বলি, মধ্য আফ্রিকার ভূখণ্ড বেষ্টিত এই দেশের উত্তরে অবস্থিত আরও এক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ‘রোয়াভা’। আর তার ওপাশে, উগান্ডা। বুরুন্ডির পূর্ব থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত সবটাই তাঞ্জেনিয়ার সীমানা ঘেরা। দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে তাঙ্গানিকা, আর উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে রুজিজি নদী। তাঙ্গানিকার মতো রুজিজি নদীর ওপাশেও, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো। আমরা প্রথমে এগোব, আরও পশ্চিমে রুজিজির জলধারা যেখানে তাঙ্গানিকার সাথে মিশেছে সে দিকে। তারপর রুজিজির তীর বরাবর কিছুটা পশ্চিম ঘেঁষে উত্তরে গ্রেট রিফট্ পার্বত্য অঞ্চলের উদ্দেশ্যে এগোব আমরা। ওই পার্বত্য অঞ্চলের পিছনেই আছে গভীর অরণ্য আচ্ছাদিত অনেক মালভূমি। তার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে রুড্ডু নামের এক নদী। ওই নদীর পশ্চিম উপত্যকাই আমাদের গন্তব্যস্থল। কঙ্গো, রোয়ান্ডা, আর বুরুভি—এই তিন দেশ দিয়ে ঘেরা সে জায়গা। গোরিলাদের বাসস্থান। আর মানুষ বলতে আদিম পিগমি জনজাতি।’

সুদীপ্ত তাঁর কথা শুনে বলল, ‘আপনি ও-অঞ্চলে গেছেন এর আগে? আগেও তো আপনি আফ্রিকাতে এসেছেন বলে শুনেছি!’

হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘আগে আমি একবার এ দেশে এলেও, এমনকী কঙ্গোতে গেলেও, গ্রেট রিফ্ট উপত্যকার দিকে যাইনি। আসলে, সেবার এসেছিলাম নিছক পর্যটক হিসাবে, আর এবারের আসা সত্যিকারের অভিযাত্রী হিসাবে আফ্রিকার গভীর অরণ্যে লুকিয়ে থাকা রহস্যের সন্ধানে। এই বলে হাসলেন হেরম্যান।

সুদীপ্ত কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনাকে একটা কথা বলি হেরম্যান। আমি নয় এখানে আপনার সাথে এসেছি বহু আকাঙ্ক্ষিত আফ্রিকা দেখব বলে। আপনি আমাকে যেখান নিয়ে যাবেন, যা দেখাবেন, তা সবটাই আমার কাছে নতুন, সবই আমার ভালো লাগবে। নতুন কোনো জায়গাতে বেড়াতে গেলে যেমন লাগে। কিন্তু আপনার ব্যাপারটা তো ঠিক তেমন নয়, আপনি যার সন্ধানে এবার এদেশে এসেছেন, তার ব্যাপারটা নিছক গল্প কথা নয়তো?’

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর হেরম্যান বললেন, ‘সম্ভবত ব্যাপারটা তা নয়। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, গত পঞ্চাশ বছর ধরে তার কথা বিভিন্ন সময় শোনা গেছে। শুধু স্থানীয় মানুষেরাই নয়, বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান ইওরোপীয় অভিযাত্রীও দূর থেকে তাকে দেখেছে। এঁরা সকলে মিথ্যে কথা বলবেন, এমনটা ভাবা ঠিক নয়।’

হেরম্যান এ প্রসঙ্গে আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু কিছু দূরে তাঁবুর কাছ থেকে তুতসি কুলিদের সর্দার ও পথপ্রদর্শক টোগো বলে লোকটা ডাক দিল তাঁকে। হেরম্যান তার ডাক শুনে সুদীপ্তকে বললেন, ‘তুমি এখানে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির শোভা দেখো, আমি ওদের কাছে যাই। আর আধঘণ্টার মধ্যেই যাত্রা শুরু করব আমরা। তার আগে কুলিদের সঙ্গে কিছু আলোচনা করে নেওয়া প্রয়োজন।’ এই বলে তাঁবুর দিকে এগোলেন হেরম্যান।

তাঙ্গানিকার বিপুল জলরাশির দিকে তাকিয়ে মনে মনে হেরম্যানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল সুদীপ্ত। তিনি তাঁর সঙ্গী হবার জন্য তাকে আমন্ত্রণ না জানালে বহুশ্রুত এই রহস্যময় মহাদেশে পদার্পণের সৌভাগ্য হত না সুদীপ্তর। হেরম্যান থাকেন মিউনিখে আর সুদীপ্ত কলকাতাতে। কত দূরত্ব দুই শহরের মধ্যে। সুদীপ্ত একটা বেসরকারি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। ভ্রমণের শখ আছে তার। একলা যুবক, সময় পেলেই সে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। বছর দু-এক আগে বন্ধুদের সাথে নেপালে বেড়াতে গেছিল সে। সেখানে কাঠামাণ্ডুর এক হোটেলে লবিতে হেরম্যানের সাথে কাকতালীয়ভাবে সুদীপ্তর পরিচয় হয়। হেরম্যানের সাথে ঘটনাচক্রে সেবার হিমালয়ের গভীরে এক প্রাচীন বৌদ্ধ গুম্ফায় ইয়েতি বা তুষার মানবের খোঁজে অভিযানে সামিল হয় সুদীপ্ত। আর তার পর থেকেই সুদীপ্তর সাথে অসম বয়সি বছর পঞ্চাশের হেরম্যানের সম্পর্ক প্রায় বন্ধুত্বের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। আসলে, হেরম্যান তাকে প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট করেছিলেন। সেই সম্পর্ক গত দু-বছর ধরে ফোন মারফত আলাপ ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আরও দৃঢ় হয়, যার ফলশ্রুতি সুদীপ্তকে তাঁর বুরুন্ডি অভিযানের সঙ্গী হবার জন্য আমন্ত্রণ ও তাতে সাগ্রহে সাড়া দিয়ে সুদীপ্তর এই অচেনা দেশে আসা। একে তো আফ্রিকা ভ্রমণ, তার ওপর আবার হেরম্যানের সাহচর্য! এ দুয়ের অমোঘ আকর্ষণ সুদীপ্তকে এনে দাঁড় করিয়েছে এই লেক তাঙ্গানিকার ধারে।

হেরম্যানের প্রতি সুদীপ্তর যে আকর্ষণ তাদের দুজনের সম্পর্ককে বন্ধুত্বের পর্যায়ে উন্নীত করেছে, সে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হল হেরম্যানের অদ্ভুত শখ বা কৌতূহল, যা তারুণ্যে ভরপুর পঞ্চাশ বছরের যুবক অকৃতদার হেরম্যানকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে সে-প্রান্তে। হেরম্যান কিন্তু সে অর্থে নিছক গ্লোবটুটার নন। ‘আমি একজন ক্রিপটোজুলজ়িস্ট’—এভাবেই সুদীপ্তর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন হেরম্যান। ‘জুলজিস্ট’ শব্দের অর্থ সকলের মতো সুদীপ্তর জানা থাকলেও ‘ক্রিপটোজুলজিস্ট’ শব্দের অর্থ তার জানা ছিল না। হেরম্যানই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন চমকে দেবার মতো বিষয়টা। ক্রিপটোজুলজি নিয়ে যাঁরা চর্চা বা অনুসন্ধান করেন তাঁদের বলা হয় ‘ক্রিপটোজুলজিস্ট।’ ‘ক্রিপটোজুলজি’ এ শব্দের প্রবক্তা জীববিজ্ঞানী বার্নাড হুভেলম্যানস। এ শব্দের অর্থ ‘ধাঁধা প্রাণীবিদ্যা’। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলা যাক। এই বিশাল পৃথিবীর আনাচে কানাচে অনেক সময় এমন অনেক জীবের কথা শোনা যায় প্রচলিত জীববিজ্ঞান যাদের উপস্থিতি প্রমাণের অভাবে স্বীকার করে না। পর্যটকদের বিবরণ, স্থানীয় উপকথা, বা গল্প কাহিনিতে ওইসব জীবের খোঁজ মেলে। কিন্তু তাদের উপস্থিতির কোনো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি এখনও পর্যন্ত। যেমন, হিমালয়ের ‘ইয়েতি’, ক্যালিফর্নিয়ার পার্বত্য অঞ্চলের ইয়েতির সমগোত্রীয় ‘বিগফুট’। বা মালয়ের জঙ্গলের ‘লোমশ মানুষ’, স্কটল্যান্ডের লেক নেসির লম্বা গলার জলদানব ‘নেসি’, এ সবই হল সেসব প্রাণীর উদাহরণ। যাদের অনেকেই দেখেছেন বলে দাবি করেন, কিন্তু কেউ কোনোদিন তাদের খাঁচায় পুরে পৃথিবীর বিজ্ঞানী মহলের সামনে হাজির করতে পারে না। কাজেই প্রচলিত জীববিজ্ঞান এই সব প্রাণী বা ‘ক্রিপটিড’দের মানে না, এবং যারা তাদের অন্বেষণ করে বেড়ান, তাঁদেরকেও প্রাপ্য সম্মান দেয় না। হেরম্যানদের মতো ক্রিপটোজুলজিস্টরা এমনকী অনেক সময় পাগল বা প্রবঞ্চক বলেও আখ্যায়িত হন। ক্রিপটোজুলজিস্টদের কাজে অর্থ বা সম্মান কোনোটাই জোটে না। তাঁরা এ কাজ করেন এ ব্যাপারে আগ্রহ, অনুসন্ধিৎসা আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। যেমন এই হেরম্যান। বার্লিন বিশ্ব-বিদ্যালয়ের প্রাণীতত্ত্ব বিভাগের উজ্জ্বল ছাত্র ছিলেন একদা। এ বিষয়ে বেশ কয়েকটা ডিগ্রি আছে তাঁর। অনায়াসে তিনি একটা অধ্যাপনার চাকরি জোটাতে পারতেন। অথবা পৈত্রিক ইম্পোর্ট-এক্সপোর্ট ব্যবসাতে মন দিয়ে প্রচুর অর্থ রোজগার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেসব কিছু না করে পৈত্রিক কারবার বেচে দিয়ে সেই পয়সাতে ‘ক্রিপটিড’ নামের আলেয়ার পিছনে ধাওয়া করে বেড়ান সারা পৃথিবী। কাঠমাণ্ডুতে যেবার সুদীপ্তর সাথে তাঁর দেখা হয়েছিল, সেবার তিনি গেছিলেন ইয়েতি সম্বন্ধে তথ্যসংগ্রহের জন্য। নেপাল হিমালয়ের বেশ কিছুটা অঞ্চলও তিনি চষে বেড়িয়ে ছিলেন ইয়েতির খোঁজে!

হেরম্যানের এই আশ্চর্য কর্মকাণ্ডই তাঁর প্রতি সুদীপ্তর সংগ্রহ বা আকর্ষণের কারণ। এছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। খুব সুন্দর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি বলতে পারেন হেরম্যান। এ ব্যাপারে ছেলেবেলা থেকেই সুদীপ্তর দুর্বলতা আছে। অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি পড়তে শুনতে ভালোবাসে সে। এটাও তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠার পিছনে একটা কাজ করেছে।

ইতিপূর্বে হেরম্যান যতগুলো অভিযানে গেছেন, তার কোনোটাতেই তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেননি। কোনো ক্রিপটিডেরই সাক্ষাৎ পাননি তিনি। হেরম্যানের এবারের অভিযানও এক ক্রিপটিডের সন্ধানে। বুরুভির উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে গ্রেট রিফট উপত্যকায় রুভু নদীর বনাঞ্চলে নাকি এক দানবাকৃতির সবুজ বানর আছে। মানুষের মতো নাকি দু-পায়ে চলাফেরা করে সে। বুরুভি দেশটা হল পিগমিদের আদি বাসস্থান। সর্বত্রই তাদের কম-বেশি দেখা মেলে। যে গহীন বনাঞ্চলে ওই সবুজ বানর থাকে, সে অঞ্চলে নাকি পিগমিদের একটা অসভ্য গোষ্ঠী বাস করে। তারা পুজো করে ওই প্রাণীকে। বিষাক্ত তির হাতে ওই বনাঞ্চল পাহারা দেয়। বাইরের কোনো মানুষকে তারা সে অরণ্যে প্রবেশ করতে দিতে চায় না। আফ্রিকার এ হেন দুর্গম অঞ্চলে ওই সবুজ বানরের সন্ধানে হেরম্যানের সঙ্গী হয়ে অভিযানে অংশ নিতে চলেছে সুদীপ্ত। পদব্রজে এই অভিযান। হেরম্যান সুদীপ্তকে বলেছেন, গাইভের কথা অনুসারে জায়গাটায় পৌঁছতে দিন চারেকের মতো সময় লাগার কথা।

হেরম্যান চলে গেলেন তাঁবুর দিকে। সুদীপ্ত দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। লেকের ধারে কাদা মাটিতে নানা ধরনের জন্তুর পায়ের ছাপ আঁকা হয়ে আছে। বিচিত্র সব চিহ্ন! সুদীপ্ত দেখতে লাগল সেগুলো। একটু পরই হেরম্যান হাঁক দিলেন তাকে। সুদীপ্ত ফিরল তাঁবুর দিকে। তুতসি কুলিরা ততক্ষণে তাঁবু গোটাতে শুরু করেছে। সুদীপ্ত সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেই একজন লোক তার আর হেরম্যানের জন্য প্রাতরাশ সাজিয়ে আনল। বেশ বড় একছড়া কলা, অনেকগুলো মোটা মোটা মিষ্টি রুটি আর কফি। প্লেটে খাবারের পরিমাণ দেখে সুদীপ্ত বলল ; ‘এই ভোরবেলা এত খাবার খাব কী করে??

হেরম্যান বললেন, ‘যতটা পারো খেয়ে নাও। এটা নিছক প্রাতরাশ নয়। সারাদিন এর ওপর ভরসা করেই কাটাতে হবে আমাদের। সন্ধ্যায় তাঁবু পড়ার পর আবার খাবার মিলবে। এ পথে একটু কষ্ট করতে হবে আমাদের। আশা করি এ ব্যাপারটা একটু মানিয়ে নেবে।’

সুদীপ্ত বলল, ‘না না, এসব ব্যাপার নিয়ে আপনি ভাববেন না। আমার কোনো অসুবিধা হবে না। একটু কষ্ট না থাকলে তো যে কোনো অভিযানের আনন্দটাই মাটি হয়ে যায়।

হেরম্যান হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। কষ্ট, রোমাঞ্চ যদি না থাকে, তাহলে আবার অ্যাডভেঞ্চার কিসের?’ এরপর একটা রুটি ছিঁড়ে মুখে দিয়ে হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়ে তিনি বললেন, ‘যত ভোর ভোর যাত্রা শুরু করা যায় ততই ভালো। আফ্রিকার সূর্য বড় প্রখর। যত বেলা বাড়বে, এগোতে তত বেশি অসুবিধা হবে আমাদের।’ এরপর আর কথা না বলে খেতে শুরু করল সুদীপ্তরা।

তাদের যখন খাওয়া শেষ হল, ততক্ষণে তাঁবু গুটিয়ে ফেলেছে কুলিরা। সুদীপ্তদের এরপর আরও মিনিট দশেক সময় লাগল একদম তৈরি হয়ে নিতে। যাত্রা শুরুর আগে সকলে এসে গোল হয়ে দাঁড়াল একটা গাছের নীচে। সব মিলিয়ে দলে দশজন লোক। হেরম্যান, সুদীপ্ত ছাড়া, অভিযানের পথ প্রদর্শক টোগো, চারজন তুতসি মালবাহক কুলি আর চারজন হুটু বন্দুকধারী রক্ষী বা আস্কারি। সুদীপ্ত লক্ষ করে দেখল, আস্কারি চারজন ছাড়াও অন্যদের কাছেও কিছু না কিছু অস্ত্র আছে। পথপ্রদর্শক টোগোর কাঁধে একটা নতুন রাইফেল। মনে হচ্ছে সবাই যেন যুদ্ধে যাবার জন্য তৈরি হয়েছে। অরণ্য আফ্রিকার অরণ্য প্রদেশে অভিযানে যেতে হলে সঙ্গে অস্ত্র রাখাটা একটা আবশ্যিক ব্যাপার। গাছের নীচে দাঁড়িয়ে টোগো, কিসোয়াহিলি ভাষাতে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কি যেন বলল, কুলি আর আস্কারিদের উদ্দেশ্যে। সম্ভবত যাত্রা শুরুর আগে সে প্রয়োজনীয় নির্দেশগুলো জানিয়ে দিল সকলকে। এর পর একজন তুতমি একটা মাটির সরাতে ধুনো জাতীয় কোনো কিছু জ্বালিয়ে গাছের গুঁড়ির নীচে নামিয়ে রাখল। অন্য তুতসিরা কি যেন বলতে বলতে ভান হাতে গাছের গুঁড়িটা ছুঁয়ে বারতিনেক গাছটাকে প্রদক্ষিণ করল। হেরম্যান সুদীপ্তকে বললেন, ‘কোনো লৌকিক দেবতার উদ্দেশ্যে পুজো নিবেদন করল ওরা।’ তারপর কুলিরা মালপত্র উঠিয়ে নিল পিঠে। এক সুন্দর সকালে যাত্রা শুরু হল সুদীপ্তদের। ভাঙ্গানিকার ধার ঘেঁষে পায়েদলে এগোতে থাকল সবাই। বাঁ-পাশে হ্রদ, ডান-পাশে ঘাসে ছাওয়া দীগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর। সেই প্রান্তরে কিছু দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল গাছ। কিছু ঝোপঝাড়ও আছে। সারবেঁধে চলেছে সবাই। সবার প্রথমে পথপ্রদর্শক টোগো আর দুজন আস্কারি। নিজেদের মধ্যে কিসোয়াহিলি ভাষায় অবিরাম কথা বলে চলেছে তারা। তারপর সুদীপ্ত আর হেরম্যান। আর তাদের পিছনে তুতসি কুলিরা ও অন্য দুজন আস্কারি। হেরম্যান বেশ উৎফুল্ল। মাঝে মাঝে তিনি গুন গুন শব্দে গান করছেন। পথ চলতে চলতে একসময় তিনি বললেন, ‘অজানার উদ্দেশ্যে এই পথ চলার মধ্যে কিন্তু আলাদা একটা আনন্দ আছে। কত কিছু জানা যায়, শেখা যায়! অনেক অভিমান হয়তো শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়, কিন্তু যে অভিজ্ঞতা নিয়ে মানুষ ঘরে ফেরে তাকে কাঞ্চন মূল্যেও পরিমাপ করা যায় না। সেই অভিজ্ঞতাই মানুষকে আবার উৎসাহিত করে মানুষকে ঘর ছাড়তে, প্রস্তুত করে নতুন অভিযানের জন্য।’

এরপর তিনি বললেন, ‘যেন সুদীপ্ত, আমরা যারা ক্রিপটিডের সন্ধানে ঘুরে বেড়াই তাদের প্রথিতযশা বিজ্ঞানীরা অনেকেই বিদ্রুপ করেন, এমনকী পাগলও পর্যন্ত বলে থাকেন। কিন্তু এই জীবজগতে এমন অনেক প্রাণী আছে, যাদের সন্ধান কিন্তু আমার মতন ভবঘুরে ক্রিপটোলজিস্টরাই ‘ঘরে বা ল্যাবরেটরিতে বসে পুঁথি পড়া বা টেস্টটিউব-ফানেল নিয়ে নাড়াচাড়া করা’ পণ্ডিত বিজ্ঞানীকুলকে প্রথম দিয়েছিলেন। সুদীপ্ত উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইল, ‘ব্যাপারটা কীরকম?’

হেরম্যানও উৎসাহের সাথে বলতে শুরু করলেন, ‘যেমন ধর সিলাকান্থ মাছের কথা। একচল্লিশ কোটি বছরের প্রাচীন জীবাশ্মতে তার খোঁজ পাওয়া যায়। গত শতাব্দীর প্রথমেও পুঁথিপড়া জীববিজ্ঞানীরা বলতেন ও মাছ বহুকোটি বছর আগে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে! কিন্তু কোমোরাস দ্বীপের জেলেদের কাছ থেকে ক্রিপটোজুলজিস্টরা যখন প্রথম এ মাছের কথা জানতে পেরে তা পৃথিবীর কাছে বললেন, তখন ‘এ ব্যাপারটা নাকি সম্পূর্ণ ধাপ্পাবাজ়ী!’ —এমনই মত প্রকাশ করলেন পুঁথিপড়া বিজ্ঞানী মহল। তাঁদের কেউ কেউ আবার বিবর্তনবাদের কূটব্যাখ্যায় বুঝিয়ে দিলেন কেন পৃথিবীতে আর টিকে থাকতে পারে না তারা! অথচ কোমোরাস দ্বীপের নিরক্ষর জেলেরা কিন্তু বংশপরম্পরায় জানত তাদের কথা! সেই জেলেরা ও মাছকে ডাকত ‘গামবোসা’ বলে। অর্থাৎ ‘দানব মাছ’। শেষপর্যন্ত ১৯৩৮ সালে সে মাছ হাজির করা হল পণ্ডিত প্রবর বিজ্ঞানীদের সামনে। তখনও তারা কিন্তু, ‘কিন্তু-কিন্তু’ করছেন। ১৯৮৮ সালে জলের তলায় গিয়ে যখন তাদের জীবন্ত ছবি তুলে আনা হল। তখন বিজ্ঞানীর পরিপূর্ণভাবে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন ব্যাপারটা। অথচ এরাই একদিন বলেছিলেন, ক্রিপটোলজিস্টরা প্রতারিত করতে চাইছে বিজ্ঞানী মহলকে।’ বোঝো একবার ব্যাপারটা!

একই রকম ব্যাপার বলা যায় অক্টোপাসের দানবীয় রূপ ‘জায়েন্ট স্কুইড’ সম্বন্ধে। যারা মানুষকে জেলে ডিঙি থেকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে টেনে নিয়ে হত্যা করতে পারে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গভীর সমুদ্রে যাওয়া নাবিকরা বলে আসছিল তাদের কাহিনি। গল্পগাথায় তাদের কথা চিত্রায়িতও করে আসছিল। আর তাদের কথা বার বার করে বলে আসছিল ক্রিপটোজুলজিস্টরা। প্রচলিত বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীকুল জায়েন্ট স্কুইডের ব্যাপারটাকে ভাবতেন রূপকথা বর্ণিত কোনো প্রাণী। তাঁরা হেসেই উড়িয়ে দিতেন তার কথা। ২০০৪ সালে জাপানের ‘ন্যাশানাল সায়েন্স মিউজিয়ামের’ একদল লোক যখন গভীর সমুদ্রে গিয়ে প্রথম জায়েন্ট স্কুইডের ছবি তুলে আনলেন তখন বোবা হয়ে গেল বিজ্ঞানী মহল। পরের এক্সপিডিশনটা হল ২০০৬ সালে। মুভি ফিল্ম তুলে আনা হল জায়েন্ট স্কুইডের। ক্রিপটোজুলজিস্টরা যদি বারবার তার উপস্থিতির কথা না বলবেন, তাহলে নিছক রূপকথার প্রাণী হয়েই থেকে যেত জায়েন্ট স্কুইড।

‘রূপকথার’ কথা শুনে সুদীপ্ত চলতে চলতে বলল, জানেন, আমাদের রূপকথাতে ‘ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী’ বলে দুটো পাখির কথা আছে। যারা নাকি মানুষের মতো কথা বলতে পারত! গল্প করতে পারত!’

হেরম্যান বললেন, ‘তাই নাকি! এটা আমার জানা ছিল না। টিয়া, কাকতুয়া ইত্যাদি প্যারাকিট প্রজাতির পাখিরা তো এমনিতেই মানুষের কণ্ঠস্বর নকল করতে পারে। হয়তো সেই পাখি সত্যি গল্পও করতে পারত। শতাব্দী প্রাচীন রূপকথা যাঁরা সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁদের কল্পনার কোনো ভিত্তি থাকে। এমনি এমনি কল্পনা করা যায় না। হয়তো সে পাখি সত্যি একদিন ছিল বা এখনও আছে। আমরা তার খোঁজ জানি না। সুদূর বা অদূর ভবিষ্যতে কোনো ক্রিপটোলজিস্ট তুলে ধরবে তার কথা। সে পাখি হাজির হয়ে চমকে দেবে পৃথিবীকে। পাথফাইন্ডার বা ইন্টারনেটের যুগ হলেও যে জীবজগতের সব রহস্য আমরা জেনে গেছি এমন ভাবা ভুল। ইন্দোনেশিয়ার দানবাকৃতির সরীসৃপ ‘কোমোডো ড্রাগন’ বা তাসমেনিয়ার হংসচঞ্চু ডিমপাড়া স্তন্যপায়ী প্রাণী ‘প্লাটিপাস’-এর প্রথম খোঁজ পাওয়া গেছিল রূপকথাতেই। পরবর্তীকালে সত্যিই এদের সন্ধান মিলল। আর এ ব্যাপারে ক্রিপটোলজিস্টরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। রূপকথার প্রাণী বাস্তবে আবির্ভূত হয়েছে, এমন আরও উদাহরণ আমি তোমাকে দিতে পারি।’

সুদীপ্ত এরপর পক্ষীরাজ ঘোড়ার কথাটাও বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেটা বড় বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যেতে পারে ভেবে আর বলল না।

হেরম্যান সুদীপ্তকে এসব প্রসঙ্গে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ অগ্রবর্তী টোগো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে আঙুল তুলে কী যেন দেখাল। দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। সুদীপ্তদের যাত্রাপথের কিছু দূরে একটা বিরাট গাছ দাঁড়িয়ে আছে। সকালের নতুন সূর্যের আলোয় লম্বা গলা বাড়িয়ে গাছটার মগডাল থেকে কচিপাতা খাচ্ছে দুটো জিরাফ! এখানে এসে এই প্রথম ওয়াল্ড লাইফ দেখতে পেল। সকলে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। হেরম্যান বললেন, ‘কী সুন্দর দৃশ্য!’ সুদীপ্ত রুকস্যাক খুলে ক্যামেরা বার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ভোরবেলা এই দুপেয়ে প্রাণীগুলোর অবাঞ্ছিত উপস্থিতি মনে হল পছন্দ হল না জিরাফ দুটোর। সুদীপ্তকে ছবি তোলার সুযোগ না দিয়ে, লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘাসবনের ভিতর দিয়ে তারা ছুটতে শুরু করল মাঠের অন্য দিকে।

সুদীপ্ত একটু আক্ষেপের সুরে বলল, ‘ইস্, এত সুন্দর ছবিটা তোলা গেল না! হেরম্যান বললেন, ‘আক্ষেপ কোরো না। এমন আরও অনেক দৃশ্য আমাদের যাত্রাপথে পড়বে।’

আবার চলতে শুরু করল সবাই। সুদীপ্তদের এক পাশে তাঙ্গানিকার কাদামাটি মাখা পাড়, অন্যপাশে ঘাসবন, প্রান্তরের সীমারেখা। মাঝের একচিলতে শক্ত মাটি ধরে এগোচ্ছে তারা।

চলতে চলতে সুদীপ্ত এক সময় প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা এখানে সিংহ আছে?’

প্রশ্নটা সে হেরম্যানকে করলেও টোগো তা শুনতে পেয়ে বলল, ‘সিংহ তো আফ্রিকার সব জঙ্গলেই কমবেশি আছে। তবে আমরা এখন যে পথে হাঁটছি তার খুব কাছাকাছি নেই বলেই মনে হয়। ওরা সাধারণত বড় জলাশয় থেকে দূরে দু-একটা গাছওলা ফাঁকা জমিতে দল বেঁধে ঘোরে। ছোট ঘাসওলা শক্ত জমি তাদের পছন্দ। আমরা যেদিকে যাচ্ছি সেদিকে প্রচুর সিংহ আছে।’

এরপর একটু থেমে বলল, ‘কিন্তু এই ঘাসবনে চিতা আছে। মাঝে মাঝে মাটিতে ওদের পায়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছি। তবে সচরাচর এই রকম ফাঁকা জায়গাতে দিনের বেলায় ওরা মানুষকে আক্রমণ করে না। আফ্রিকার সিংহ গোরিলা আর হাতি ছাড়া জঙ্গলের অন্যসব প্রাণী মানুষকে কমবেশি ভয় পায়। ওই তিন প্রাণীর কথা অবশ্য আলাদা। আপনার হাতে রাইফেল থাকলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বোঝা যায় না সত্যিকারের কে শিকারী আর কেই বা শিকার? নিজের বনে ওরা হল রাজা।

সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘ওই তিন রাজার মধ্যে লড়াই বাঁধে না?’

টোগো জবাব দিল, ‘হাতি আর গোরিলার মধ্যে সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে৷ গোরিলা থাকে গভীর অরণ্য আচ্ছাদিত পাহাড়ের ঢালে বা তার পাদদেশের অরণ্যে। হাতি সেখানে যায় না। কিন্তু সিংহর গতিবিধি সর্বত্র। মাঝে মধ্যেই তার সাথে অন্য দুই প্রাণীর সাক্ষাৎ হয়ে যায়। কলেবরে হাতির শক্তি বেশি। স্বভাবসুলভ রাজকীয় গাম্ভীর্য নিয়ে চলে। সচরাচর অহেতুক কোনো প্রাণীকে সে আক্রমণ করে না। গোরিলার মধ্যে কিন্তু হিংস্রতা আর আক্রমণের প্রবণতা আছে। নিজের রাজ্যে তারা অন্য কারো উপস্থিতি সহ্য করে না। আর সিংহ যেমন হিংস্ৰ, তেমনই ধূর্ত। সর্বত্রই এ প্রাণীর অবাধ গতিবিধি। মাঝে মাঝেই অন্য দুই প্রাণীর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়ে যায়। তখন প্রলয় ঘটে। বনের সব প্রাণী জেনে যায়, রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হচ্ছে। সে লড়াই চলে আমৃত্যু।

এগিয়ে চলল সুদীপ্তরা। সময় যত এগিয়ে চলল সূর্যের তেজও তত বাড়তে লাগল। আফ্রিকার প্রখর সূর্য! তা-ও আবার মধ্য আফ্রিকা! সুদীপ্তদের সকলেরই পরনে হালকা পোশাক, কিন্তু তা-ও ঘামে ভিজে যেতে লাগল। একটা গাছের তলায় এরপর দুটো অ্যান্টিলোপ চোখে পড়ল তাদের। আফ্রিকার ঝলসানো ধু ধু প্রান্তরে প্রচণ্ড সূর্যের তেজ থেকে বাঁচতে গাছের ছাওয়ায় আশ্রয় নিয়েছে ওরাও। সুদীপ্ত দেখল তার ঘড়িতে সবে দশটা বাজে ৷ অর্থাৎ মাত্র ঘণ্টা তিন-চারেক হেঁটেছে তারা। এর মধ্যেই এই অবস্থা! তবে টোগোর কথা বলার বিরাম নেই। সে আস্কারির সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে সুদীপ্তদের এটা-ওটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। তাতে পথশ্রমের ক্লান্তি তাদের কিছুটা লাঘব হচ্ছে। আরও বেশ কিছুটা চলার পর একপাল হিপো দেখতে পেল তারা। লেকের পাড়ের কাদামাটিতে গা ডুবিয়ে বসে ছিল দলটা ৷ সুদীপ্তরা তাদের কাছাকাছি যেতেই প্রাণীগুলো প্রথমে উঠে দাঁড়াল। গোল গোল লাল চোখ দিয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল তাদের। একটা প্রাণী একবার একটা বিরাট হাঁ করল৷ ততক্ষণে অবশ্য তাদের বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিয়েছে সুদীপ্ত। টোগো বলল, ‘বিরাট কলেবরের হলেও এ প্রাণীগুলো সাধারণত অন্য প্রজাতির প্রাণীদের সাথে ঝঞ্ঝাটে যায় না। তবে নিজেদের মধ্যে প্রায়ই লড়াই করে। ওভাবে মারাও যায় অনেকে। জলহস্তীগুলোকে দেখায় ও তাদের ছবি তুলতে পারায় প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও সুদীপ্তর চলার একটা উৎসাহ ফিরে এল। চারপাশে তাকাতে তাকাতে টোগোর পাশে পাশে তাকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করতে করতে এগোল সে।

বেলা বারোটা নাগাদ একটা গাছের তলায় বিশ্রামের জন্য তারা থামল। আধ ঘণ্টার জন্য একটু জিরিয়ে নেওয়া, একটু জলপান, তারপর আবার পথ চলা। এবার সূর্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য যতদূর সম্ভব ঝোপঝাড় ঘেঁসে চলতে থাকল সকলে। তীক্ষ্ণ চোখে চারপাশে তাকাতে তাকাতে চলছে টোগো, সামান্য কোনো শব্দ জঙ্গলের মধ্যে শুনলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছে। থেমে যাচ্ছে অন্যরাও। এ দফায় পথ চলতে একটু যেন সতর্ক টোগো। হেরম্যান তার কারণ জানতে চাওয়াতে সে বলল, ‘এখানে চিতার আড্ডা আছে। মাটিতে মাঝে মাঝেই পায়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছি।’ তার কথা শুনে সতর্ক হয়ে গেল সকলে। আস্কারিরা বন্দুক কাঁধ থেকে হাতে নিল। ঘণ্টা তিনেক চলার পর এক সময় সূর্যের তাত কমে এল। টোগো হেরম্যানকে বলল, ‘এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরে “হুট” উপজাতীয়দের একটা গ্রাম আছে। এ তল্লাটে আমাদের যাত্রাপথে ওটাই শেষ গ্রাম। তাড়াতাড়ি পা চালালে সন্ধ্যার আগেই ওখানে পৌঁছে যাওয়া যেতে পারে। তাহলে আর জঙ্গলে তাঁবু ফেলার হ্যাঙ্গামা থাকে না। জায়গাটা জঙ্গলের তুলনায় নিরাপদও বটে। তবে সেখানে যেতে হলে তাঙ্গানিকার পাড় ছেড়ে সামান্য পুবে এগোতে হবে। তাতে কাল সকালে শুধু সামান্য বাড়তি হাঁটতে হবে আমাদের।’

হেরম্যান শুনে বললেন, ‘তাহলে তাই চলো। এদিককার কিছু খবরও পাওয়া যেতে পারে সেখানে গেলে।’

তাঁর সম্মতি পাওয়ার পর সামান্য গতিপথ পরিবর্তন করল টোগো। তারা এবার এগোল ঝোপঝাড় ছেড়ে ঘাসে ভরা প্রান্তরের মধ্য দিয়ে। তাদের সাথে সাথে মাথার ওপর সূর্যদেবও পশ্চিমে পরিক্রমণ শুরু করলেন। চলতে চলতে বড় ঘাসের জঙ্গল অতিক্রম করে এক সময় তারা এসে উপস্থিত হল এক উন্মুক্ত প্রান্তরে। সূর্যের আলো নরম হয়ে এসেছে তখন। সুদীপ্ত আশ্চর্য হয়ে দেখল, অসংখ্য জেব্রা, আর অনেকটা বড় বাছুরের মতো দেখতে দাড়িওলা প্রাণী চরে বেড়াচ্ছে সেখানে। দূর থেকে দুটো জিরাফও চোখে পড়ল তার। টোগোর মুখ থেকে সুদীপ্ত শুনল, ওই দাড়িওলা প্রাণীগুলোর নাম নাকি ‘উইল্ডা বিস্ট’ (wilde beast)। আফ্রিকার অন্য প্রদেশের সর্বত্রই প্রায় এদের দেখা মেলে। তবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পাশের রাজ্য তাঞ্জেনিয়ার সেরেঙ্গেটিতে। জুলাই মাস নাগাদ আফ্রিকার তৃণভোজী প্রাণীদের বিখ্যাত মাইগ্রেশন পর্ব শুরু হয়। সেসময় হাজার হাজার ‘উইল্ডা বিস্ট’ সার বেঁধে সেরেঙ্গেটি থেকে যাত্রা শুরু করে কেনিয়ার মাসাইমারা অরণ্যের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ সেই যাত্রাপথে তাদের একটা বড় অংশ নদী পার হতে গিয়ে কুমিরের পেটে আর সাভানাতে সিংহ চিতার পেটে যায় বলে বাঁচোয়া। নইলে নাকি ওই প্রাণীতে সারা আফ্রিকা ছেয়ে যেত!

জেব্রা আর উইল্ডা বিস্টের দঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সেই প্রান্ত অতিক্রম করতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। অবশেষে তারা এসে উপস্থিত হল সেই গ্রামের কাছে। গ্রাম মানে, তিনটে বড় গাছের নীচে গোটা পনেরো মাটির দেওয়াল আর শন ছাওয়া ঘর। তাকে বেষ্টন করে গাছের গুঁড়ির প্রাচীর। সুদীপ্তরা গ্রামের বাইরে উপস্থিত হতেই গ্রামের ভিতর থেকে পিলপিল করে লোক বেরিয়ে এসে ঘিরে দাঁড়াল তাদের। তার মধ্যে বৃদ্ধ-নারী-শিশু সবই আছে। অধিকাংশর পরনে মলিন বস্ত্র, খালি পা, শিশুগুলো উলঙ্গ। দেখলেই বোঝা যায় এরা ভীষণ গরিব। শুধু তার মধ্যে একজন বিশালবপু মানুষের পোশাক একটু ঝলমলে। গলায় নানা রঙের পাথরের মালা। একটা চিতার মাথা সমেত ছাল সে শালের মতো জড়িয়ে রেখেছে ঊর্ধ্বাঙ্গে। তার গা ঘেঁসে একজন বর্শাধারী রক্ষীও আছে। সুদীপ্ত লক্ষ করল লোকটার পায়ে একজোড়া নতুন হাই হিলবুট। টোগো লোকটাকে ইশারায় দেখিয়ে বলল ওই লোকটাই এ গ্রামের মোড়ল ও পুরোহিত। লোকটা বেশ কিছুক্ষণ সতর্ক চোখে দেখল সুদীপ্তদের, তারপর সুদীপ্তদের উদ্দেশ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলল! টোগো তার জবাব দিল, তারপর পোশাকের ভিতর থেকে একটা ছোট কাঠের বাক্স বার করে সেটা খুলল। তার মধ্যে সাজানো আছে চুরুট। সুদীপ্ত টোগোকে ধূমপান করতে দেখেনি। সে একটু অবাক হল বাক্সটা দেখে। টোগো এরপর বাক্সটা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে সেটা ধরল মোড়লের সামনে। লোকটা একটা চুরুট তুলে নাকের কাছে নিয়ে কিছুক্ষণ শুকল, তারপর চুরুটের বাক্সটা তার হাত থেকে নিয়ে টোগোর সাথে অজানা ভাষায় কথা বলতে শুরু করল। সুদীপ্তরা তাদের দুজনের কিছু দূরে দাঁড়িয়ে রইল। সুদীপ্ত, হেরম্যানের দিকে তাকাতেই, তিনি চাপাস্বরে বললেন, ‘চুরুটগুলো ওকে খুশি করার জন্য টোগো উপঢৌকন দিল। তামাক জিনিসটা এরা ভারী পছন্দ করে। আফ্রিকার বনাঞ্চলে তামাক চাষ হয় না। তাই অরণ্য উপজাতিদের কাছে তামাক বড় লোভনীয়। একটা সময় ছিল, যখন ইওরোপীয়রা এসব গ্রামে ঘুরে ঘুরে আদিবাসীদের সিগার বা চুরুট উপহার দিত। আর সামান্য তামাকের পরিবর্তে তারা এদের কাছ থেকে কী পেত জানো? আনকাট ডায়মন্ড! যার মূল্য লক্ষ টাকা! টোগো মিনিট পাঁচেক ধরে কথা বলল মোড়লের সাথে। সে লোকটা কথা বলতে বলতে তুতসি কুলিদের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে টোগোকো কী যেন বলল, তার নতুন জুতো পরা পা-টাও তুলে টোগোকে একবার দেখাল।

টোগো তার সঙ্গে কথা শেষ করে সুদীপ্তদের কাছে এগিয়ে এসে হেরম্যানকে বলল, ‘মোড়ল আমাদের আজ রাতে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছে। তবে ওরা কুলিদের গ্রামে ঢুকতে দেবে না। ওদের বাইরে থাকতে হবে।’

সুদীপ্ত তার কথা শুনে প্রশ্ন করল, ‘ওদের ঢুকতে দেবে না কেন?’ ‘ওরা তুতসি বলে।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল টোগো।

উত্তরটা সুদীপ্তর কাছে পরিষ্কার না হওয়ায় সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল হেরম্যানের দিক।

তিনি ব্যাপারটা ধরতে পেরে সুদীপ্তকে বুঝিয়ে বললেন, ‘বুরুন্ডিতে হুটু-তুতসি, এ দুই উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ভয়ংকর বিরোধ চলছে। বুরুন্ডির আদি অধিবাসীরা হল পিগমি। হুটু গোষ্ঠীরা বাইরে থেকে প্রথম এখানে এসে চাষাবাদ-বসবাস শুরু করে। তাদেরও পরে উগান্ডা থেকে তুতসিরা এ ভুখণ্ডে আসে। তারা আসার পরপরই বিরোধ শুরু হয় উভয়ের মধ্যে। বুরুন্ডি প্রথমে জার্মানির, পরে বেলজিয়ামের দখলে ছিল। ১৯৬২ সালে মূলত তুতসিরাই এ দেশের স্বাধীনতা আনে। কিন্তু তারপর থেকেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রবল লড়াই শুরু হয় দুই উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে। উভয়েরই বহু রক্ত ঝরে এতে। ১৯৮৮ সালে তুতসি সেনারা, তিন হাজার হুটু পরিবারকে হত্যা করে। হুটু উপজাতির ষাট হাজার মানুষকে সে সময় দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। ১৯৯২ সালে এ দেশে নতুন সংবিধান রচিত হয়। রাষ্ট্রসংঘ এ দেশে শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টা শুরু করে, কিন্তু তবুও আজও এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা বর্তমান। মাঝে মাঝেই চোরা-গোপ্তা খুনোখুনি হয় উভয় উপজাতির মধ্যে। এ জন্যই ওরা তুতসিদের গাঁয়ে প্রবেশ করতে দেবে না।’

হেরম্যান আর টোগো এরপর কর্মপন্থা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিল। ঠিক হল, কুলিরা বাইরেই থাকবে তাঁবু ফেলে। তাদের আর মালপত্রের নিরাপত্তার জন্য দুজন আস্কারিও তাদের মধ্যে থাকবে। টোগো সঙ্গের লোকদের বিষয়টা বুঝিয়ে দিল। তারপর মোড়লের পিছন পিছন দুজন আস্কারিকে নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করল। তাদের নিয়ে যাওয়া হল একটা গাছের নীচে শনের নীচু ছাদওলা কুটিরে। তার ঠিক সামনেই মাটিতে পোঁতা একটা লম্বা খুঁটিতে টাঙানো আছে বিরাট সিংহ-সহ একটা হরিণ জাতীয় প্রাণীর সাদা খুলি। আশেপাশের অন্য ঘরগুলোর সামনেও খুঁটির মাথায় এ জাতীয় নানা প্রাণীর খুলি টাঙানো আছে। সম্ভবত এটা এদের গ্রাম সাজানোর রীতি। সুদীপ্তদের তাদের থাকার আস্তানাটা দেখিয়ে দিয়ে, টোগোর উদ্দেশ্যে কী যেন বলে মোড়ল পা বাড়াল অন্যত্র। তাদের পিছনে আসা বয়স্ক লোকরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল নানা দিকে। শুধু বাচ্চারা সুদীপ্তদের চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী চোখে দেখতে লাগল। নানাবয়সি বাচ্চা, অপুষ্টিতে ভোগা দেহ থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসা উদর। যারা একটু বড় তাদের পরনে নামমাত্র বস্ত্রখণ্ড, আর ছোট শিশুরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ। হেরম্যান সুদীপ্তকে বললেন, ‘এ দেশটা খুব গরিব। পৃথিবীর সব চেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর একটি। অল্প সংখ্যক শহরবাসী শুধু খাদ্য ও চিকিৎসার সুযোগ পায়। যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। পুরুষদের গড় আয়ু মাত্র ৪৩ বছর। নারীদের সামান্য বেশি ৪৬।’ হেরম্যান এরপর একটু আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘আগে এখানে আসব জানলে অন্তত সামান্য লজেন্স-টজেন্স, আনতাম এই বাচ্চাগুলোর জন্য। খুশি হত ওরা।’

হঠাৎ বাচ্চাদের দঙ্গলের ভিতর থেকে একটু বড় একটা ছেলে এসে দাঁড়াল সুদীপ্তদের সামনে। ছেলেটার কোলে অদ্ভুত দেখতে ছোট্ট একটা প্রাণী। প্রাণীটার মুখ ও লেজ বেজির মতো, তবে শরীরের গঠনটা অন্য ধরনের। প্রাণীটাকে দেখিয়ে ছেলেটা কী যেন বলল সুদীপ্ত হেরম্যানের উদ্দেশ্য।

টোগো সুদীপ্তদের বলল, ‘ও বলছে এই প্রাণীটা ওর পোষা। আপনারা চাইলে ও প্রাণীটাকে আপনাদের কাছে বিক্রি করতে পারে।’

সুদীপ্ত প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘এটা কী প্রাণী?’

টোগো বলল, ‘এরা একে ‘মোয়া’ বলে ডাকে। বনবিড়াল ও বেজির সংকর। এ রকম অনেক উদ্ভট প্রাণীর দেখা মেলে আফ্রিকার অরণ্যে।’

সুদীপ্তদের ওই প্রাণীর প্রয়োজন নেই শুনে একটু হতাশ হয়ে অন্যদিকে চলে গেল ছেলেটা। বাচ্চাদের দঙ্গলটাকে এরপর হটিয়ে দিল টোগো। ঘরের ভিতর ঢুকল সুদীপ্তরা। মেঝেতে খড়ের বিছানা পাতা। ভিতরে ঢুকেই সেখানে শুয়ে পড়ল সুদীপ্ত। টোগো বলল, ‘আপনারা বিশ্রাম নিন। আমি মোড়লের কাছে গিয়ে দেখি, আমরা যেদিকে যাচ্ছি সেদিক সম্বন্ধে কোনো খবর সংগ্রহ করা যায় কিনা। তাছাড়া রান্নার ব্যবস্থাও করতে হবে।’ এই বলে টোগো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাইরে সন্ধ্যা নামছে। সারাদিন অনেক পরিশ্রম গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খড়ের বিছানাতে ঘুমিয়ে পড়ল সুদীপ্ত।

হেরম্যানের ডাকে সুদীপ্ত যখন উঠে বসল, তখন রাত ন’টা বাজে। খাবার নিয়ে এসেছে টোগো। আর তার সঙ্গে বাইরের তাঁবু থেকে একটা ছোট পেট্রোম্যাক্স বাতি। তারই আলোতে তিনজন খাবার নিয়ে বসল। খাওয়া শুরু করার পর টোগো বলল, ‘কাল সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা শুরু করব আমরা। কুলিদের সেইমতো তাঁবু গোটাতে বলে এসেছি। ভোরে রওনা হলে আমরা ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে রুজিজি নদীর মোহানায় পৌঁছে যাব। তারপর ঠিকমতো চলতে পারলে সন্ধ্যা নাগাদ “গ্রেট রিফট্” উপত্যকার মুখে পৌঁছে যাব। অন্তত ঘণ্টা দশ-বারো কাল হাঁটতে হবে। গ্রেট রিফটের কাছে জঙ্গলটা ভালো নয়। সিংহের উৎপাত খুব! যতটা সম্ভব দিনের আলো থাকতে থাকতেই ওখানে পৌঁছতে হবে।’

হেরম্যান বললেন, ‘পরিশ্রম করতে আমার আপত্তি নেই। যেভাবেই হোক গন্তব্যে পৌঁছতে হবে আমাকে। তার জন্য জীবন বাজি রাখতেও রাজি।’

টোগো জানাল, রুজিজি নদীর মোহানা অতিক্রম করার পরই, কার্যত সভ্য পৃথিবীর সাথে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তারপর শুধু আফ্রিকার শ্বাপদসঙ্কুল গহীন অরণ্য আর দুর্গম পাহাড়। সেসব অতিক্রম করে তবে পৌঁছনো যাবে পিগমিদের সেই রহস্যময় উপত্যকাতে।

রুটি খেতে খেতে হেরম্যান এরপর তাকে বললেন, ‘মোড়লের সাথে আর কোনো কথা হল? কিছু জানতে পারলে ওদিককার খবর?’

টোগো বলল, ‘হ্যাঁ হয়েছে। একটা আশ্চর্য খবর পেলাম। সেটাই আপনাকে দিতে যাচ্ছিলাম।’

খাওয়া থামিয়ে হেরম্যান বললেন, ‘কী খবর??

টোগো বলল, ‘আমরা যেদিকে যাচ্ছি, গতকাল একটা বেশ বড় দল গেছে সে দিকে। জনা পঁচিশেকের দল। একজন খুব লম্বা আফ্রিকান্ডার ওই দলের নেতা। পনেরো জন মাসাই আস্কারি আছে ওই দলে। গতকাল দুপুরে গ্রামের ঠিক বাইরে বিশ্রামের জন্য থেমেছিল দলটা। তখন মোড়লের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা হয় তাদের দলনেতার সঙ্গে। মোড়লের পায়ের নতুন জুতোটা ওই আফ্রিকান্ডারই উপহার দিয়েছে। সে নাকি গ্রেট রিফট উপত্যকার জঙ্গলে সিংহ শিকারে যাচ্ছে। আফ্রিকাভার নাকি ওই অঞ্চল সম্পর্কে খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করছিলেন মোড়লের কাছ থেকে। আশ্চর্যর বিষয় হল সে লোকটা নাকি সবুজ দানব বানরের সম্বন্ধেও বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে মোড়লকে! যদিও সে ব্যাপারে মোড়ল কোনো জবাব দিতে পারেনি তাকে কারণ, মোড়ল বা এ গ্রামের কোনো লোক ওদিকে কখনো যায়নি। লোকমুখে আমাদের মতোই ওই বানরের কথা শুনেছে মাত্র, তার বেশি মোড়লের কিছু জানা নেই।’ একটানা কথাগুলো বলে থামল টোগো।

“আফ্রিকান্ডার কাদের বলে?” জানতে চাইল সুদীপ্ত। এ শব্দটা প্রথম শুনল সে। হেরম্যান প্রথমে সুদীপ্তর কথার জবাবে বললেন, “আফ্রিকাজাত শ্বেতকায় ব্যক্তিদের বলা হয়, ‘আফ্রিকাভার’। এদের পূর্বপুরুষরা প্রায় সকলেই ভাগ্যান্বেষণে ইওরোপ থেকে এদেশে এসেছিলেন।” এরপর তিনি টোগোকে বললেন, ‘ও লোকটা সবুজ বানরের ব্যাপারে জানতে চাচ্ছিল কেন? সিংহ শিকারের সাথে সবুজ বানরের সম্পর্ক কী?” টোগো জবাব দিল, ‘জানি না। গল্পটা সে কোথাও শুনেছে। এমনও হতে পারে ওদিকে

সে যাচ্ছে বলে নিছক কৌতূহলবশত বানরের ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করেছে মোড়লের কাছে।’

সুদীপ্ত এরপর বলব না-বলব না করেও বলেই ফেলল, ‘ব্যাপারটা এমন নয়তো যে, ওই লোকটাও আমাদের মতোনই ওই সবুজ বানরের খোঁজে যাচ্ছে? যদি সত্যিই ও প্রাণী ওখানে থেকে থাকে, আর ওই আফ্রিকান্ডার আমাদের আগেই তার খোঁজ পেয়ে যায়, তাহলে তো আমাদের পরিশ্রমটাই মাটি হবে।’

সুদীপ্তর কথা শুনে হেরম্যান কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর মৃদু হেসে বললেন, ‘আমার মতো পাগলের সংখ্যা পৃথিবীতে বেশি নেই। মনে হয় সে সত্যিই সিংহ শিকার বা অন্য কোনো কাজে ওদিকে যাচ্ছে। যদি আমাদের সাথে তার দেখা হয়, তাহলে পরস্পর পরস্পরের কাজে অসুবিধা সৃষ্টি না করলেই হল।’ এরপর আর কোনো কথা না বলে খেতে শুরু করলেন হেরম্যান। সুদীপ্তর কিন্তু হেরম্যানের মুখের দিকে তাকিয়ে কেন জানি মনে হল, মুখে যাই বলুন না কেন, সুদীপ্তর কথাটা পুরোপুরি তিনি উড়িয়ে দিতে পারছেন না!

কিছুক্ষণের মধ্যেই সুদীপ্তদের খাওয়া শেষ হল। হেরম্যান পরদিনের যাত্রা সম্পর্কিত কিছু টুকিটাকি কথা সেরে নিলেন। পরদিন খুব ভোরে উঠতে হবে। তাই এরপর রাত আর না বাড়িয়ে বাতি নিভিয়ে খড়ের গাদায় শুয়ে পড়ল তারা।